প্রবন্ধ:: কামান কাহিনি - ড. সৌমিত্র চৌধুরী


কামান কাহিনি
সৌমিত্র চৌধুরী

বেড়াতে এসেছি অতীতের মল্লভূমি বাঁকুড়া শহরের বিষ্ণুপুর মহকুমা এসে দাঁড়ালাম জনবহুল লোকালয়ের সরু এক রাস্তায় নাম দলমাদল রোড রাস্তার পাশে আম গাছের তলায় লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা অল্প উঁচু এক বেদি তার উপর শোয়ানো একটা কামান কামানের কালো মসৃণ শরীর চকচক করছে দুপুরের রোদে
চনচনে রোদ মাথায় নিয়ে কিছু মানুষ বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে থাকেন কামানটার দিকে মরচে (Rust)-বিহীন বারো ফুট লম্বা লোহার কামান নামদল মার্দন’, চলতি কথায় দলমাদল দল মানে শত্রুদল আর মার্দন - ধ্বংস করা
শত্রু নিধনকারী কামানটির ব্যাস, বাইরে থেকে মাপলে, দুফুটেরও বেশি (৬৬. সেমি), আর ভিতরের ব্যাস ২৯ সেমি অনেকগুলো লোহার বলয় (রিং) দিয়ে তৈরি গুণে দেখা হয়েছে ৬৩ খানা লোহার বলয় জোড়া লেগেছে কারিগর যিনি বানিয়েছিলেন, তাঁর নাম জগন্নাথ কর্মকার কামান তৈরির খরচ তখনকার দিনের দেড় লক্ষ টাকা
বিশাল এই কামানটি নিয়ে একদা যুদ্ধ করেছে বঙ্গবাসী কামানের ভিতর বারুদ ঠেসে শত্রু সৈন্যের দিকে তাক করে আগুন দিয়েছে সত্যি কথা, কামান বানাতে জানত বাঙালি, আর বারুদ (Gun powder) তৈরি করাও
শত্রু আক্রমণ থেকে মল্লভূমি রক্ষা করতে কামান নিয়ে যুদ্ধ করেছে সৈন্যদল নেতৃত্বে মল্লভূমির রাজা বীর হাম্বীর (১৫৬৫-১৬২০) তখন দিল্লির মসনদে আসীন সম্রাট আকবর আর বাংলার মল্লভূমিতে বীর হাম্বীর
অবশ্য ভিন্ন মতও আছে কৃষ্ণভক্ত রাজা গোপাল সিং-এর আমলে (১৭৩০- ১৭৪৫) তৈরি হয় দলমাদল তাঁর সময়কালেই (১৭৪২) বর্গী আক্রমণ ঘটেছিল বাংলায় মারাঠা যোদ্ধা ভাস্কর রাও অতর্কিতে মল্লভূমির সমৃদ্ধ জনপদ বিষ্ণুপুরে আক্রমণ হেনেছিল আক্রমণ ঠেকাতে যুদ্ধ করেছিল মল্লভূমির বীর যোদ্ধারা গর্জে উঠেছিল দলমাদল লোকমুখে প্রচলিত কথা, রাজার প্রার্থনায় স্বয়ং শ্যামরাই, মানে দেবতা কৃষ্ণ, শত্রু সৈন্যের দিকে কামান দেগেছিলেন
ইতিহাসের বিতর্ক থেকে সরে এসে আগের প্রসঙ্গে ফিরে যাই মল্লভূমি বীর হাম্বীরের কথা বঙ্গদেশের বিশাল অঞ্চল জুড়ে ছিল মল্লভূমির ব্যাপ্তি বর্ধমানের কিছু অংশ, বীরভূম, সাঁওতাল পরগণা, মেদিনীপুর, পুরুলিয়া রাজধানী ছিল বিষ্ণুপুর
বিষ্ণুপুরের রাজ সিংহাসনে বসেছেন রাজা হাম্বীর মল্লদেব উনপঞ্চাশতম রাজা ডাকাবুকো রাজা তিনি কয়েকজন বৈষ্ণব সাধুকে তাঁদের বৃন্দাবন-গৌড় যাত্রাপথ থেকে হরণ করে মল্লভূমে নিয়ে এলেন নিত্যানন্দ দাসের লেখাপ্রেম বিলাসগ্রন্থে এর বর্ণনা আছে অপহৃত সাধুদের একজন শ্রীনিবাস
মহাজ্ঞানী আর উচ্চ কোটির সাধক শ্রীনিবাস গোস্বামীর মুখে শ্রীমদভাগবতের ব্যাখ্যা শুনে মোহিত হয়ে যান রাজা হাম্বীর বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নেন সাধু শ্রীনিবাসকে ধর্ম চর্চার জন্য জমি অনেক অর্থ বরাদ্দ করেন তারপর থেকে বৈষ্ণব সংস্কৃতির প্লাবন বয়ে যায় রাজ্যে অসংখ্য কৃষ্ণ মন্দির তৈরি হয় বিষ্ণুপুরে আর শহরটিদ্বিতীয় বৃন্দাবননামে প্রসিদ্ধ হয়ে যায় ইতিহাসের বহু গবেষণাপত্র গ্রন্থে এসব তথ্য লিপিবদ্ধ আছে (যেমন, মিত্তাল প্রকাশনীরহেরিটেজ ট্যুরিজম’, লেখক গৌতম কুমার দাশগুপ্ত-সহ কয়েকজন)
রাজা, রাজবংশ, যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাস লেখা হয়েছে বিস্তর কিন্তু দলমাদলের ইতিহাস? লোহার তৈরি এই কামান সম্পর্কিত বিজ্ঞান? জল বাতাসের খোলা আবহাওয়ায়, এমনকি দীর্ঘ দিন মাটির নিচে থেকেও চারশো বছরে যার গায়ে মরচে ধরেনি!
এই কামান চারশো বছর আগে বাংলার বুকে উন্নত বিজ্ঞান কারিগরি চর্চার উজ্জ্বল নিদর্শন কিন্তু কারিগরি ফলিত বিজ্ঞান চর্চা বিচ্ছিন্নভাবে কোনো এক অঞ্চলে তো গড়ে ওঠে না তাহলে এই কামান তৈরি ধাতু বিজ্ঞানের প্রেক্ষাপট কী ছিল?
দুঃখের কথা, বিশেষ লিখিত তথ্যাদি হাতে নেই বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার অতীত ইতিহাস তাই অনেকটাই অজানা বিক্ষিপ্ত কিছু তথ্য উদ্ধার হয়েছে জানতে পারি, ভারত তথা বাংলার কর্মকার সম্প্রদায় প্রাচীন কাল থেকেই হাপরে লোহা গলিয়ে বহু যন্ত্রপাতি বানাতেন এখনও, একুশ শতকের উন্নত কারিগরির যুগে, ভারতের বহু অঞ্চলে কাজের উপযোগী যন্ত্র বানিয়ে চলেছেন তাঁরা অতীত ইতিহাস জানাচ্ছে, আড়াই হাজার বছর আগে ভারতীয় শল্য চিকিৎসক (সার্জেন) উন্নত মানের লোহার ছুরি কাঁচির সাহায্যে অপারেশন করতেন বরাহমিহির তার বই, কার্বন-লোহার ধাতু-সংকর বিষয়টি এবং বানাবার প্রক্রিয়া বর্ণনা করেছেন এই লোহার ধাতু-সংকরের সাহায্যে শক্ত তরবারি বানানো হত তিন ধরনের লোহার কথা জানিয়েছেন বরাহমিহির - কান্ত লোহা, তীক্ষ্ণ লোহা এবং মুন্ডা (আমাদের বর্তমান ধারণা - কাস্ট আয়রন, রট আয়রন এবং স্টিলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ)
ইতিহাস-নির্ভর তথ্য অনুযায়ী, ভারতের বিভিন্ন স্থানে - কুমায়ুন, আসাম, উড়িষ্যা, বাংলাতেও লোহার খনি ছিল স্থানীয় মানুষ লোহা গলিয়ে (Smelting) কাজের উপযোগী যন্ত্র বানাতেন উত্তর ভারতে ধাতু বিজ্ঞান, বিশেষত লোহা গলানো, লোহার অস্ত্র যন্ত্র তৈরির বিষয়টি উন্নতির শিখরে উঠেছিল লোহার আকরিক এবং লোহা গলানোর জ্বালানিও (কয়লা) পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুত ছিল ভারতবর্ষে প্রসঙ্গে কানপুর আই আই টি-র অধ্যাপক তাঁর বই- (Marvels of India through the ages) বহু তথ্য পরিবেশন করেছেন যেমন, কার্বন মেশানো শক্ত লোহা (Wootz steel) দিয়ে তৈরি হয়েছিল দামাস্কাস সোর্ড মধ্য যুগের ইউরোপে এই স্টিল আর দামাস্কাস সোর্ড ছিল খুবই জনপ্রিয় - আর বহু তথ্য প্রমাণ করেছে, দামাস্কাস সোর্ডের জন্ম ভারত ভূখন্ডে
পঞ্চদশ শতকে ধাতু বিজ্ঞান (Metallurgy) চর্চায় অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন কর্মকার সম্প্রদায় শুধু মরচে প্রতিরোধী লোহা নয়, লোহার সঙ্গে বিশেষ মাত্রায় কার্বন মিশিয়ে (Carbon nano tube?) বা অন্য ধাতু যোগ করে লোহার কঠিনতর রূপ আবিষ্কার করেছিলেন তাঁরা দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, বিহার এবং বাংলার (মুর্শিদাবাদের জাহান কোশা কামান) বিভিন্ন স্থানেও বড়ো আকারের কামান বানানো হয়েছিল কামানের ব্যবহার হয়েছে আকবর বাদশার আমলে বাংলায় ধাতুবিজ্ঞান চর্চার এই প্রেক্ষাপট আংশিক উদ্ধার হলেও বেশির ভাগটাই অজানা
বিষ্ণুপুর শহরে দলমাদলের সামনে দাঁড়িয়ে মনে আনাগোনা করছিল অনেক কথা যুগে উন্নত মানের স্টিল বানাতে পারি আমরা, কিন্তু পাঁচ শতক আগে যখন আধুনিক বিজ্ঞানভূমিষ্ঠ হয়নি, উন্নত বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ ছিল বাংলা
চার-পাঁচ শতক আগের তৈরি কামানের দিকে তাকিয়ে বড়ো একটা শ্বাস ফেললাম লোহার অস্ত্র এবং কামান ছিল, তবু দুশো বছর ব্রিটিশের পদানত হয়ে থাকল ভারত! অনেক কথা উঠে এল মাথায় ভাবনায় ছেদ পড়ল সঙ্গী-সাথিদের ডাকে হোটেলে ফিরতে হবে
প্রাচীন ঐতিহ্যময় বিষ্ণুপুরে উন্নত টেরাকোটার কাজ নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে অতীতের অনেক সুদৃশ্য মন্দির পরদিন একে একে দেখব - মদন মোহন মন্দির, শ্যামরাই মন্দির, রাস মঞ্চ, রাধাশ্যাম মন্দির, রাধা গোবিন্দ মন্দির...
সঙ্গীত শিল্পকলায় অতি সমৃদ্ধ বিষ্ণুপুর এখানকার সিল্ক ভারত-বিখ্যাত কলকাতা থেকে মন্দির নগরটি বেশ কাছেই (মাত্র ১৫০ কিমি) পৌঁছোনো অতি সহজ দ্রুত গতির ট্রেনে সাড়ে তিন ঘণ্টা হোটেল বা সরকারি অতিথিশালায় রাত্রিবাসের সুযোগ নিয়ে দেখে নেওয়া যায় বিখ্যাত সব মন্দির, আর আশ্চর্য এক কামান, দলমাদল
----------
[লেখক পরিচিতি: . সৌমিত্র কুমার চৌধুরী, এমএসসি, পিএইচডি ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান এমেরিটাস মেডিক্যাল সায়েনটিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থান]
----------
ছবি - আন্তর্জাল

1 comment:

  1. তথ্য সমৃদ্ধ লেখাটি ভারি মনোগ্রাহী। দারুণ উপভোগ করলাম।

    ReplyDelete