গল্পের ম্যাজিক:: আমার দিদি হওয়া - সোহিনী দেবরায়


আমার দিদি হওয়া
সোহিনী দেবরায়

তখন আমার তিন বছর বয়স। গোলু মোলু ফুলো পেটটা দেখিয়ে মা বলত বটে, “এখানে তোর পুঁচকে ভাই আছে... কিন্তু বছর তিনেকের আমি মোটেই তা বিশ্বাস করিনি। এ কীরকম বোকা বোকা কথা...!! আমাকে তো ভগবান এসে দিয়ে গেছিল মায়ের কোলে। তাহলে ‘পুঁচকে ভাই’ মায়ের পেটে কেন থাকবে...? তাছাড়া পেটটা ‘পুঁচকি ভাই’ থাকার জায়গা নাকি!! এসব জিনিস তো দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। ওই যে গো ওই দোকানটা আছে না!! যেখানে সব মানুষের বাচ্চা কিনতে পাওয়া যায়...! রঙবেরঙের প্যাকেটে ভরে গোলুমোলুফুলো বাচ্চা বিক্রি হয়!
এসবই জানতাম আমি। হঠাৎ করে গভীর সমস্যায় পড়ে গেলাম। এটা তো ঠিক না। মা আমাকে কেন এভাবে মিথ্যা কথা বলছে!
কিন্তু কয়েকদিন বাদেই বুঝলাম, মা মোটেই মিথ্যা বলেনি। সত্যি সত্যি মায়ের পেট থেকেই পুঁচকি ভাইটা বেরিয়েছে। প্রমাণ আছে। মায়ের পেটে অপারেশনের দাগও দেখতে পাচ্ছি। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আমিও তো মায়েরই মেয়ে। তাহলে আমি মায়ের পেট থেকে হইনি কেন...? চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছিল। ঝাপসা চোখেই দেখলাম রড দেওয়া একটা চাকা লাগানো কেমন অদ্ভুত ধরনের গাড়িতে কাপড়ে জড়ানো একটা ছোট্ট পুঁচকু ঘুমাচ্ছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। দেখতেই পাচ্ছিলাম না বাচ্চাটাকে।
পাপ্পা (মানে আমার বাবা) তখন আমাকে কোলে তুলে ভালো করে দেখালেন পুঁচকেটাকে। দেখেই মনটা ভালো হয়ে গেল। মায়ের পেট থেকে ও এসেছে... এই ব্যাপারটা যেন ভুলেই গেলাম। সেই আমাদের প্রথম দেখা।

কয়েকদিন বাদেই ও আর মা বাড়ি চলে এল। অত ছোটো একটা বাচ্চা আমাদের বাড়িতে থাকবে কীভাবে সেটা ভেবেই ভয় ভয় লাগছিল। ও খাবে কী? আমাকে তো ঠাম্মি কাঁটা বেছে মাছ আর ভাত খাইয়ে দেয়। আমি দাঁত দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খাই। মুখের মধ্যে ভাত টোবলা করেও রাখি না। মুখের মধ্যে ভাত রেখে দিলে কেউ ‘ভালো মেয়ে’ বলে নাকিন্তু পুঁচকেটা কি এসব পারবে...? ওর তো দাঁতও নেই। এসব ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বাড়ির কেউ এটা বুঝতেই চাইছিল না। সবাই শুধু হাসছিল। যত্তসব বাজে পচা লোকজন।
সেদিনই বিকেলে মা আমাকে ডেকে বিছানার মাঝখানে বসিয়ে পুঁচকুটাকে আমার কোলে দিলেন। হালকা নরম ছোট্ট একটা ঘুমন্ত বাচ্চা। ভয় ভয় লাগছিল। কোলে নিতেই ঠোঁটটা অল্প কাঁপিয়ে ছোট্ট করে একটা হাই তুলল। যেন কিছু বলতে চাইল। ‘দিদি’ বলল কি?
কিছুদিন পর ওর নাম রাখা হল। ভালো নাম স্বর্ণাভ, আর ডাকনাম রোহন। আমি দুটোর একটাও ঠিক করে বলতে পারতাম না। আমি বলতাম, ‘মুনু’মুনু তখন ড্যাবড্যাব করে তাকাতে শিখে গেছে। আমিও ওকে কোলে নিতে শিখে গেছি। আর মুনুর সবথেকে ভালো ব্যাপার হল ও আমার কোলে উঠলে অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, একটুও কাঁদে না।
আমি যখন বছর চারেকের হলাম, ওকে ভালো মতো কোলে নিতে শিখে গেলাম। এমনকি ওকে কোলে নিয়ে চলাফেরা করতেও খুব অসুবিধা হয় না। কিন্তু একদিন কীভাবে যেন ও আমার হাত থেকে পড়ে গেল! অত জোরে কান্না দেখে আমি ভয়ে সিঁটকে গেছিলাম, বেশ কিছুদিন কোলে নিইনি।
ও একটু বড়ো হওয়ার পর টের পেলাম, ও আমাকে একবেলা না দেখলে কান্নাকাটি করে। আমি একা মামার বাড়ি থেকে যাওয়ার কথা বললে দৌড়ে এসে ছোট্ট দুটো হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে এক সুরে বলে যেত, ‘দিদিভাইয়া চল। আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারব না আমি পড়তে বসলে ও পাশে এসে পড়তে বসে যেত। আমি পড়তে গেলে ও মায়ের সঙ্গে আমাকে আনতে যেত। ম্যাম দেরিতে ছাড়লে ও ‘দিদিভাইয়া আয় আয়’ করে কান্না শুরু করে দিত।
ততদিনে ও স্কুলে ভরতি হয়ে গেছে। স্কুল থেকে ফিরেই ওর কাজ ছিল আমি স্কুল থেকে ফিরেছি কিনা সে খোঁজ নেওয়া। তারপর আমাকে খুঁজে পেয়ে গেলে ওর খেলনা সাইকেলে আমাকে বসিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ানো। আমিও কীভাবে যেন সেই ছোট্ট সাইকেলটায় ঠিক বসে যেতাম!
আর একটু বড়ো হওয়ার পর সাইকেলটা অকেজো হয়ে গেল। তখন শুরু হল দুপুরে পাঁচিল বেয়ে বাড়ির আমগাছে উঠে আম পাড়া। সেই আম কেটে নুন লঙ্কা চিনি মাখিয়ে দু’জনে মিলে খাওয়া। অদ্ভুত সুন্দর ছিল সেসব দিন।
পড়াশোনার চাপে, দুপুরে স্কুলে থেকে ক্লাস করার চাপে, বিকেলে স্কুল শেষে পড়তে যাওয়ার চাপে সেসব মায়াবী রূপকথার দিনগুলো চিরতরে হারিয়েই গেল।

অগুনতি মারপিট ঝগড়াঝাঁটি রক্তারক্তি কাণ্ডের মধ্যে দিয়েই আবিষ্কার করলাম আমরা কবে যেন বড়ো হয়ে গেছি। চোখের সামনে দিয়ে পুঁচকুটা কবে যেন বড়ো হয়ে এখন আমার থেকেও লম্বা হয়ে গেছে...!! পুঁচকে ভাইটারও বাইশ বছর বয়স হয়ে গেল...!!
এর মধ্যে অনেক কিছু পালটেছে। আমি ওকে আর মুনু বলে ডাকি না। রোহন বলে ডাকি। কলেজপড়ুয়া ছেলেকে মুনু বলে ডাকা যায় নাকি...! না বললে হয়তো ওর বা কারোর আপত্তিই থাকত না, কিন্তু সেসব মায়াবী দিনগুলো যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘মুনু’ ‘দিদিভাইয়া’... মায়াবী ডাকগুলোও হারিয়ে গেছে। ব্যস্ততা তার জালে সব জড়াতে জড়াতে সব কিছু কেড়ে নিচ্ছে যে...!
তবু ওর কথা মনে পড়লে চোখ বুজলেই যেন দেখতে পাই বেবিকটে শোয়ানো সেই কাপড় জড়ানো পুঁচকুটাকে।
----------
ছবি - সুকান্ত মণ্ডল

3 comments:

  1. স্মৃতিটুকু মায়াবী আলো মেখে উজ্জ্বল হয়ে থাকুক 🌿❤️

    ReplyDelete
  2. খুব সুন্দর...

    ReplyDelete