গল্পের ম্যাজিক:: প্রিয় লেখকের সই - বৈশাখী ঠাকুর


প্রিয় লেখকের সই
বৈশাখী ঠাকুর

সকাল থেকেই পিকার মনটা খারাপ। ঘুম থেকে উঠেই শুনল তার প্রিয় লেখক শ্রী অনীক চৌধুরী যে প্লেনে করে বিদেশ থেকে ফিরছিলেন সেটা একটা দুর্ঘটনার কবলে পড়ে পাহাড়ে আছড়ে পড়েছে। কোনও যাত্রীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। জায়গাটাও এত দুর্গম যে সেখানে রেসকিউ টিম পৌঁছতেও বেশ সময় লেগে যাবে। তবুও রোজ বুকে একরাশ আশা নিয়ে পিকা খবরের কাগজ খুলত। টিভির নিউজ শোনার অপেক্ষায় থাকত।
অনীক চৌধুরী যে যে পত্রপত্রিকায় লিখতেন, সেইসব পত্রপত্রিকা পিকার চাই-ই- চাই। ছোটোবড়ো যেসব পূজাবার্ষিকীতে ওনার লেখা বেরোত সব কিনে গোগ্রাসে গিলত পিকা। কোনওটা মানবিক, কোনওটা রহস্য, কোনওটা সাই-ফাই তো কোনওটা অ্যাডভেঞ্চার। যে কোনও ধরনের লেখাতেই শিশুসাহিত্যিক অনীক চৌধুরীর হাত দারুণ খেলত। এমন সহজ সরল ভাষায় মনের কথাটা বলতে জানতেন যে মনে হত, এটা তো আমিই আমার কথাই লেখা। কী করে উনি আমার মনের কথাটা টের পেলেন? নিজেকে কেমন গল্পের নায়ক মনে হত পিকার। আর অ্যাডভেঞ্চার গল্পে তো মনশ্চক্ষে ভেসে উঠত সেইসব জীবন্ত বিবরণ, আর পিকাও যেন সঙ্গী হয়ে উঠত প্রতিটা রোমহর্ষক যাত্রার। আর সাই-ফাই গল্প? অনীক চৌধুরীর সাই-ফাই গল্প পড়েই না তার মন বসেছে ফিজিক্স-কেমিস্ট্রিতেনা হলে তো আগে যা বোরিং লাগত! আর গোয়েন্দা অজাতশত্রু স্যানালের তো পিকা ডাই-হার্ড ফ্যান। মনে মনে তার ইচ্ছে জাগে মাঝে মাঝে সে যদি অমন একটা তুখোড় গোয়েন্দা হতে পারত! সেইসব চরিত্রগুলো তার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে ভাবলেই তার কান্না পেয়ে যাচ্ছে।
এই তো সেদিন বইমেলা থেকে একগুচ্ছ বই কিনেছিল অনীক চৌধুরীর। এস বি আই অডিটোরিয়ামে উনি এক আলোচনাসভায় উপস্থিত ছিলেন। সেখানে গিয়ে সই পর্যন্ত নিয়ে এসেছিল পিকা। কী হাসিখুশি ভদ্র সজ্জন ব্যক্তি। তেমন বয়সও না। পিকার বাবার বয়সিই হবে। ওকে দেখে একগাল হেসে মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিয়েছিলেন তারপর ওর নাম জেনে মুক্তোর মতো হাতের লেখায় তাকে শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা জানিয়ে বইগুলোর ভেতর স্বাক্ষর করেছিলেন কিন্তু তারপরে সে আরও একটা বই কিনেছিল, ‘গোয়েন্দা অজাতশত্রু সমগ্র’সেটা যে সই করানো হল না! মনটা দুঃখে ভরে যায় পিকার।

একহপ্তা পরে সবরকম তল্লাশি চালিয়েও অনেকে নিখোঁজ রইল। কোনও খোঁজই পাওয়া গেল না বহু যাত্রীর অথবা বডির এমন হাল যে চেনা দুষ্কর। অনীক চৌধুরীকেও সেভাবে খুঁজে পাওয়া গেল না। অনেক অলীক স্বপ্নের ভেতর ডুবে রইল পিকা। যদি এমন হয়, যদি অমন হয়! কোনও সময় জানা যায় উনি জীবিত! একহপ্তা বাদে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হল যে কোনও যাত্রীরই বেঁচে থাকার আর কোনও সম্ভাবনা নেই।
কী আর করবে পিকা? সে এখন থেকে তার প্রিয় লেখকের পুরনো সব রচনাই আবার ঝালাবে। তবে সামনে পরীক্ষা। তারপরে তারা আন্দামান বেড়াতে যাবে। তখন তো তার বই লাগবেই লাগবে। সে এমনিই বইয়ের পোকা। তারপরে পরীক্ষা হয়ে গেলে তো কথাই নেই। ছোটোবেলা থেকেই তার বাবা-মা তার হাতে বই তুলে দিয়েছে। তাই তার অত টিভি বা ভিডিও গেমসের নেশা নেই। সে অজাতশত্রু স্যানালের সমগ্রটাই নিয়ে যাবে। ওটা বেশ মোটা আছে। ওখানে পড়ার অবকাশও পাবে।

দেখতে দেখতে তাদের বেড়াতে যাবার দিন চলে এল। প্লেনে করে যেতে যেতে পিকা ভেবেছিল বই পড়বেকিন্তু ইচ্ছে করল না। মনে হল, অত ওপর থেকে একটু নিচের দৃশ্য দেখবে। তার বারো বছরের জীবনে পিকা এই প্রথম প্লেনে চাপল। তাই একটা আলাদা উন্মাদনা কাজ করছিল। শিহরণ জাগছিল আকাশের অত ওপরে মেঘেদের সাথে যেতে যেতে।
আড়াই ঘণ্টার মাথায় তারা কলকাতা থেকে চলে এল ভারতের একদম দক্ষিণপ্রান্তে। সেদিন তারা সেলুলার জেল ছাড়া আর কিছু দেখেনি। রাতে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড দেখে সে কেমন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিল। একটা চাপা কষ্টও কাজ করছিল কয়েদিদের অত্যাচারের গাথা শুনে।
পরদিন তাদের গন্তব্য ছিল নর্থ বে আইল্যান্ড। সেখানে পিকার বাবা-মা স্নরকেলিং করবে। খুব সম্ভবত পিকা করতে পারবে না তার বয়সের জন্যে। সত্যি কথা বলতে কী, পিকা খুব একটা লালায়িতও নয় এইসব ওয়াটার স্পোর্টসের জন্য। কিন্তু সে দেখতে পাচ্ছে, বাবা-মা দারুণ উত্তেজিত। তার চেয়ে একটা ছায়া দেখে সে চুপচাপ বই পড়তে পারলে তার ভালো লাগবে অনেক বেশি কিন্তু বাবা-মায়ের একটু চিন্তা হচ্ছিল তাকে একা ফেলে দু’জনে মিলে স্নরকেলিং করতে যাবে কী করে কিন্তু পিকাই আশ্বাস দেয়, “কোনও ব্যাপার না মা, তোমরা যাও। আমি বরঞ্চ তোমাদের জিনিসপত্র দেখব। ছায়ায় বসে বই পড়ব। আমার সেটাই ভালো লাগবে।”
তাঁদের গাইডও অভয় দিল যে এখানে এমনি কোনও ভয় নেই। এরকম সবাই ছোটো বাচ্চাদের বিচে রেখে স্নরকেলিং করে আসে। কোনও অসুবিধে নেই তাতে। পিকারও পোয়া বারো। সেও এই অবসরে তার প্রিয় বইটা পড়বে। তারা দ্বীপের পেছন দিকটায় গেল। বেশ কিছু দোকান আছে সেইসব ছাড়িয়ে একটু দূরে বেশ কিছু গাছের সারি। তেমনই একটা গাছের ছায়া দেখে সে বই নিয়ে বসলবাবা–মা তার কাছে সব জিনিস গচ্ছিত রেখে সমুদ্রের তলায় স্নরকেলিং করতে গেল নিশ্চিন্ত মনেফিরে এসে তাকে নিয়ে গ্লাস বোটে যাবে বলে কথা দিয়েছেসেটাতে গেলেও সে সমুদ্রের তলার নানাধরনের উদ্ভিদ, কোরাল, রঙিন মাছ দেখতে পাবে। ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে পিকা গোয়েন্দা অজাতশত্রুতে মনোনিবেশ করল।
কেসটা বেশ জমে উঠেছে। একটা ধাঁধার সমাধানে গুপ্তধনের আশা রয়েছে। ধাঁধার সমাধানটাই এখন ব্যাপার। মন দিয়েই পড়ছিলও পিকা তবে কেমন একটা সুড়সুড়ি অনুভব করল। বই থেকে চোখ সরাতেই নজরে পড়ল ছোট্টমতো একটা লাল কাঁকড়া। মুহূর্তে সে পা সরিয়ে নিল। আরও দু-চারটে বেরিয়ে এল সাদা সাদা বালি ফুঁড়ে। একটু একটু ভয় করছিল পিকার। কী জানি, যদি কামড়ে দেয়! তাই সে সাজসরঞ্জাম উঠিয়ে অন্য একটা গাছের তলায় যাবার তদ্বির করতে শুরু করল। সবার জামা-জুতো-মোবাইল-বই সামলে সে যে কোথায় পা দিয়ে চলেছে কে জানে। আচমকা একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে তার সব জিনিস হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেলএকমাত্র তার প্রাণের বইটাকে সে আঁকড়ে ধরে থাকল প্রাণপণে ও বুঝতে পারছিল,  কোনও এক বড়ো গর্তে তার পা পড়ে গেছে, আর সে তলিয়ে যাচ্ছে কোন অতলে

ভ্রমে বিভ্রমে তারপর যখন চোখ খুলল, নিজেকে খুঁজে পেল একটা বড়ো ঘরেবেশ বড়ো বড়ো বইয়ের শো-কেস। সার সার বইয়ের সম্ভার। বিছানা ছাড়া রয়েছে একটা বড়ো টেবিল, যার মাথায় পাখা আর পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা। খাট-সংলগ্ন একটা টেবিল আর টেবিল-ল্যাম্পও মজুত। এ তো তার নিজের ঘর নয়ই, হোটেলের ঘরও নয়। কিন্তু এমন একটা ঘরে সে আগে কখনও আসেওনি। কোথায় এসে পড়ল সে? ঘরের আসবাবপত্র, দরজা-জানলা-পর্দা সবই একটু অন্যরকমের। টেবিলে সে খেয়াল করে দেখল কোনও গল্প লেখার অর্ধেক খসড়া যেন কেউ লিখতে লিখতে একটু বাইরে বেরিয়েছে। তবে কি কোনও লেখকের ঘর? তারপর তাকে চমকে ঘরে ঢুকলেন তার অতি প্রিয় সাহিত্যিক অনীক চৌধুরী। আচমকা দেখে কেমন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল পিকার। অত্যাশ্চর্য হয়ে গেল সে। তার সঙ্গে আর একজন ছিলেন। তাকে দেখে দু’জনেই স্মিত হাসলেন।
গল্পে আড্ডায় যে কতটা সময় কেটে গেল কে জানে। পিকা জানতে পারল, সে এক নিম্নমাত্রার দুনিয়ায় এসে পড়েছে। আর পিকার তো কথাই ফুরোয় না। কত কথাই না সে তুলে রেখেছিল তার প্রিয় লেখকের জন্য। লেখক নিজেই আগ্রহ নিয়ে তার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। সই করে দিয়েছেন তার বইয়ে। এদিকে পিকার বেজায় খিদেও পেয়েছিল। কীসব কিম্ভুতকিমাকার দেখতে সেদ্ধ-সেদ্ধ খাবার দিয়েছিল। মন্দ ছিল না। আবার বিরাট কিছুও ছিল না। খিদের মুখে সে খেয়ে নিয়েছে চোখ বন্ধ করে। একটু বিশ্রাম নিতে গিয়ে কখন যে চোখ লেগে গেছিল কে জানে। তারপর যখন ঘুম ভাঙল সে টের পেল যে সে বালিয়াড়িতে শুয়ে আছে। আর একরাশ মুখের মিছিল আর চিৎকার তার চারপাশে। পিকা ধড়মড় করে উঠে বসল মায়ের গলা শুনতে পেল, “কী রে, ঘুমিয়ে পড়েছিলি বুঝি! এখানে এলি কী করে? তুই ঐ গাছের তলায় বসেছিলি তো! আমরা তো খুঁজে খুঁজে হয়রান। সব জিনিসপত্র চারপাশে ছড়ানো, দেখেশুনে কী চিন্তা হচ্ছিল।”
কোথা থেকে তখন বাবাও ছুটতে ছুটতে এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে। কীরকম আশ্চর্য হয়ে বলল, “সে কী গো! আমি তো এখানটা খুঁজে গেলাম মনে হল। কই, তখন তো দেখতে পাইনি ওকে!”
মা অমনি বলে উঠল, “তোমার তো দেখা!”

পরে পিকার গল্প শুনে বাবা-মা দু’জনেই কীরকম অবাক হয়ে গেছিল। তবে অবিশ্বাস করেনি কারণ, অজাতশত্রু সমগ্রের ভেতর অনীক চৌধুরীর স্বাক্ষর যে জ্বলজ্বল করছে। আর তার বাবা তখন ব্যক্ত করেছিল এইরকমই একটা ঘটনার কথা।
২০০৯ সালে জেমস রিচার্ড নামে একটা ছেলে ক্যালিফোর্নিয়ার মরুভূমি অঞ্চলে ডেল পুয়ের্টো ক্যানিয়নে তার কুকুরকে নিয়ে ঘুরছিল। কুকুরটা একটা খরগোশের পেছনে ধাওয়া করাতে জেমস তার পেছন পেছন গিয়ে একটা খরগোশের গর্তেই পা হড়কে পড়ে যায়। কীভাবে যেন সে অজ্ঞান হয়ে গেছিল। জ্ঞান ফিরলে সে টের পায়, সে একটা ঘরে রয়েছে। বাইরে থেকে হালকা যানবাহনের আওয়াজ আসছিল। ঘরটা খানিক অদ্ভুত লেগেছিল তার দেখতে। জানলায় একটা অদ্ভুত ইলেকট্রনিক মেশিন দেখেছিল। তারপর এক ঋজু দীর্ঘ চেহারার মানুষকে ঢুকতে দেখে ঘরে, যিনি নিজেকে জোনাস নামে পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন জেমসকে যে সে ক্যানিয়নের কুড়ি ফুট তলার এক শহরে এক সমান্তরাল দুনিয়ায় রয়েছে। তার অবস্থা সঙ্গীন দেখে তাকে সাহায্য করেছিল জোনাস এখানে নিয়ে এসে, যদিও এটা নিয়ম-বিরুদ্ধ। কিন্তু মানবিকতার দিক দিয়ে বেধেছিল বলে সে জেমসকে রক্ষা করেছিল। তারা দু-দুনিয়া সম্বন্ধে অনেক কথা বলে, অনেক আলাপ আলোচনা হয়। দুই জগতেই দূরদর্শনের মতো বিনোদনের আয়োজন ছিল। স্বভাবতই কথা উঠেছিল গান নিয়ে। কথা প্রসঙ্গে বিখ্যাত ব্যান্ড বিটলসের কথা ওঠে। জোনাস জানান, তারা এখন ট্যুরে। শুনে অবাক হয়ে যায় জেমস। জোনাস জানান, তিনি সঙ্গীত-জগতের সঙ্গে যুক্ত। তিনি ক্যাসেট বানিয়ে থাকেন। আসলে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে তারা পৃথিবীর থেকে পেছিয়ে ছিল এখনকার প্রজন্ম যেমন ক্যাসেটের নাম শোনেনি, তারা তেমনি সিডির নাম শোনেনি। জোনাস তাকে দেখায় বিটলস ব্যান্ডের ক্যাসেট – এভরিডে কেমিস্ট্রি। জেমস অবাক হয়ে যায় ঐ সমান্তরাল দুনিয়ায় বিটলসের অস্তিত্বের কথা শুনে। চুপিসাড়ে জেমস সেই ক্যাসেট আমাদের পৃথিবীতে নিয়ে আসে এবং দুনিয়ার সামনে সেই গান তুলে ধরে। এই ক্যাসেট, এভরিডে কেমিস্ট্রি ছিল সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ যে বিটলস ব্যান্ড আজও রয়েছে, তবে অন্য দুনিয়ায়।
হাততালি দিয়ে উঠল পিকা, “যেমন বেঁচে আছেন অনীক চৌধুরী অন্য এক সমান্তরাল দুনিয়ায়। আর তার জলজ্যান্ত প্রমাণ হচ্ছে আমার বইয়ের ভেতর ওনার সই।”
তার পিঠ চাপড়ে বাবা বললেন, “ঠিক তাই।”
পিকার মনটা আনন্দে ভরে যায় যাক, যেখানেই থাক অনীক চৌধুরী বেঁচে তো আছেন! সেখানেও উনি নিশ্চয়ই ভালো ভালো গল্প-উপন্যাস লিখছেন। কিন্তু সেগুলো পিকা পড়বে কী করে? এইটা একটা সত্যি ভাবার ব্যাপার বটে!
_____
অলঙ্করণঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী

2 comments: