বহুরূপী :: পাখি দেখুন পাখি চিনুন – প্রতিম দাস

পাখি দেখুন পাখি চিনুন
প্রতিম দাস

হঠাৎ করেই ২০১৩ সালে শুরু করেছিলাম নিজের জন্য পাখি আঁকাতারপর ফেসবুক বন্ধুদের আগ্রহে সেটা হয়ে গেল সবার জন্য। শুরু করলাম ওদের বিষয়ে বিস্তারিতভাবে জানতে। তারই ফলশ্রুতি আমার পাখি দেখুন পাখি চিনুন সিরিজ। দেখতে দেখতে ৭০০+ বিভিন্ন ভারতীয় প্রজাতির পাখি ছবি এঁকে ফেলেছি। লক্ষ্য ১৪২৬টি প্রজাতির সবগুলোকেই আঁকা। হয়তো আর পাঁচ বছর লাগবে তবু শেষ করব, এ আশা আছে।


প্যাডিফিল্ড পিপিট বা ওরিয়েন্টাল পিপিট (Anthus rufulus) পিপিট এবং ওয়াগটেইল গোত্রের পাখি এরা আবাসিক (অপরিযায়ী) জাতের পাখি যারা দক্ষিণ এশিয়া থেকে ফিলিপাইনস পর্যন্ত খোলা তৃণভূমি এবং চাষাবাদ ক্ষেত্রে বিচরণ করে। যদিও শীতকালে সনাক্তকরণ কঠিন হয়ে পড়ে যখন প্রজননকালে এশিয়ার কিছু পিপিট দূরদূরান্তে উড়ে যায়। প্রায় একইধরনের দেখতে হওয়ায় অন্য গোষ্ঠীভুক্ত পিপিটদের থেকে এদের আলাদা করা বেশ কঠিন হয়
১৫ সেমি লম্বা প্রধানত উপরে ধূসর-বাদামী এবং বুকের দিকে হাল্কা ডোরাকাটা দাগ থাকে। লম্বা লেজ এবং দীর্ঘ কালচে ঠোঁট, সঙ্গে লম্বা পা পুরুষ-নারী অনুরূপ দেখতে। গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন পালকে কোন পরিবর্তন হয় না। তরুণ পাখিদের প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে নিচের দিকে রঙ বেশি উজ্জ্বল থাকে এবং পালকের উপরের অংশের প্রান্তভাগ ফ্যাকাশে হয়। বুকের ওপরের দাগ তুলনামূলকভাবে প্রকট থাকে
রিচার্ড পিপিট (Anthus richardi) এবং ব্লাইথ পিপিট (Anthus godlewskii) থেকে এদের আলাদা করে চেনাটা শীতকালে বেশ কঠিন হয়ে পড়ে প্রজনন মরশুমে এরা মাটি থেকে কয়েক ফুট ওপরে একটি সংক্ষিপ্ত মনোরঞ্জনকারী উড়ান দেয় মেয়ে-পাখিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যসাথে পুনরাবৃত্তির শব্দসহ গান করে। কোনও কারণে বাসার কাছে বিরক্তিকর কিছু ঘটলে নিম্নমাত্রার tsip-tsip-tsip শব্দ করে ডাকে। মাটিতে ঝোপের ধারে বা আড়ালে কাপের মতো বাসা বানায় ঘাস ও পাতা দিয়ে। ছোটো পোকামাকড় প্রধান খাদ্য। যদিও বড়ো বিটল, ছোটো শামুক, কৃমি জাতীয় প্রাণী খেতেও দেখা যায়। উড়ন্ত অবস্থায় মশা বা উইপোকার মতো পোকামাকড় ধরতেও দেখা যায়।


ইন্ডিয়ান প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার (Terpsiphone paradisi) মধ্য থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি মাঝারি আকারের পাখি বাংলায় এদের পরিচিতি দুধরাজ নামে। পুরুষ-পাখিদের লেজ দীর্ঘ, কালো এবং রুফাস রঙের পালক সাধারণত দেখা যায়কিছুর সাদা পালকও চোখে পড়ে। মেয়ে-পাখিদের লেজ তুলনামূলকভাবে বেশ ছোটো রুফাস রঙের ডানা এবং কালো মাথা
প্রাপ্তবয়স্ক ইন্ডিয়ান প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার ১৯ - ২২ সেমি (. - .৭ ইঞ্চি) লম্বা হয়। মাথা চকচকে কালো এবং সাথে মুকুট থাকে। কালো ঠোঁট বৃত্তাকার এবং বলিষ্ঠ চোখ কালোডানা ৮৬ - ৯২ মিমি (. - .৬ ইঞ্চি) দীর্ঘ হয় তরুণ পুরুষদের প্রায় মেয়েদের মতো চেহারা শুধু কালো গলা এবং নীল বৃত্ত দিয়ে ঘেরা চোখ এদের আলাদা করে চিনতে সাহায্য করে। প্রাপ্তবয়স্কদের লেজ ২৪ সেন্টিমিটার (.৪ ইঞ্চি) পর্যন্ত লম্বা হয়তরুণ পুরুষদের রং রুফাস থাকে এবং লেজ ছোটো হয় দুই বা তিন বছর বয়স থেকে এদের লেজ বড়ো হতে শুরু করে এরা পরিযায়ীশীতকালে ক্রান্তীয় এশিয়া এলাকায় চলে যায়। ইন্ডিয়ান প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার যথেষ্ট পরিমাণে কলরব সৃষ্টিকারী পাখিতীক্ষ্ণ skreek আওয়াজ এদের ডাকের বৈশিষ্ট্য কীটভক্ষক এবং ঊড়ন্ত অবস্থায় শিকার ধরতে সক্ষম। সন্ধ্যাকালীন সময়ে ছোটো জলাশয়ে ঝাঁপ দিয়ে এদের স্নান করতে দেখা যায়


ভ্যারিগেটেড লাফিংথ্রাস (Trochalopteron variegatum) Leiothrichidae পরিবারেএকটি পাখি প্রজাতি ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরাংশসহ প্রাথমিকভাবে হিমালয়ের কম থেকে মাঝামাঝি উচ্চতায় বিচর করে ছাড়াও ভুটান, নেপাল ও তিব্বতে এদের দেখা মেলে। ২৪ - ২৬ সেমি লম্বা, ৫৭ - ৭৯ গ্রাম ওজনমাঝারি আকারের জলপাই ও বাফ রঙবিশিষ্ট পাখি। মুখের নিম্নভাগ সাদাটে, চওড়া কালো মধ্যরৈখিক ডোরাকাটা থাকে মুখে। ধূসর, কালো এবং সাদা রঙ থাকে ডানায় উচ্চমাত্রার শিশযুক্ত পুনরাবৃত্তিমূলক ডাক যা গঠিত Weet-a-Weer ধরনের শব্দ দিয়ে ঘন রডোডেনড্রন, দেবদারু এবং বার্চ বা ওকগাছের জঙ্গল এবং ঝোপঝাড়যুক্ত বাঁশবনে এদের বসবাস করতে দেখা যায়। পোকামাকড়, ফল এবং বেরি প্রধান খাদ্য। প্রজনন মরশুমে জোড়ায় জোড়ায়, অন্যথায় ২০টি বা তার বেশি সংখ্যক পাখিকে দল বানিয়ে ঝোপঝাড়ের মধ্যে খাদ্য অন্বেষণ করতে দেখা যায় এপ্রিল - আগস্ট মাসে বাসা বানায় যা সুগঠিত বলা যেতে পারেমোটা ঘাস, শুকনো পাতা দিয়ে তৈরি বাসা অগভীর পেয়ালার মতো দেখতে।


ইন্ডিয়ান রোলার (Coracias benghalensis) পাখি Roller পরিবারের সদস্য গ্রীষ্মমন্ডলীয় এশিয়া থেকে শুরু করে ইরাক, পূর্বদিকে ইন্দোচীন থেকে ভারতীয় উপমহাদেশজুড়ে ব্যাপকভাবে দেখতে পাওয়া যায় প্রজনন মরশুমে পুরুষ-পাখিদের মাঝ-আকাশে aerobatic প্রদর্শনের জন্য এদের ইংরেজী নামকরটি হয়েছে। সাধারণভাবে পথিপার্শ্বস্থ গাছ এবং ইলেকট্রিক বা টেলিফোনের তারের ওপর এদের বসে থাকতে দেখা যায়। এরা পরিযায়ী নয়, যদিও কিছু কিছু মরসুমে এর দূরদূরান্তে উড়ে যায়। এই পাখি অন্ধ্রপ্রদেশ, উড়িষ্যা, কর্ণাটক ও তেলেঙ্গানার ভারতীয় রাজ্যের দ্বারা রাজ্য-পাখি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে
ইন্ডিয়ান রোলার পাখি ২৬ - ২৭ সেমি লম্বা অনেকসময় পরিযায়ী ইউরোপীয় রোলারের সঙ্গে মিশে থাকায় বিভ্রান্ত হতে হয়। তবে ইন্ডিয়ান রোলারের বুক বাদামি যেখানে ইউরোপীয় রোলারের নীল মুকুট এবং লেজ নীল রঙের হয় প্রাইমারি পালকের এলাকায় নীলচে বেগুনির ওপর ফ্যাকাশে নীল একটি ব্যান্ড দেখা যায়। লেজ প্রুশিয়ান নীল এবং কেন্দ্রীয় পালকে ফ্যাকাশে সবুজ আভা দেখা যায়। ঘাড় এবং গলায় বেগুনি আভাযুক্ত খয়েরি রঙের ওপর সাদা দাগ দাগ পালক লক্ষণীয়চোখের চারপাশ লোমহীন গৈরিক রঙের হয়। পায়ের সামনের তিনটে আঙুল একটি চামড়া দ্বারা যুক্ত থাকে। এদের ঠোঁট দীর্ঘ, বাঁকানো ঊর্ধ্বপ্রান্ত এবং হুকের মতো অগ্রভাগ নাসারন্ধ্র বেশ বড়ো
ইন্ডিয়ান রোলার ভারতের পৌরাণিক মাহাত্ম্যযুক্ত একটি পাখিএকে ত্রিদেবের অন্যতম বিষ্ণুর সাথে সম্পর্কযুক্ত মনে করা হয়। একে নীলকণ্ঠ নামে ডাকা হয়। যার সূত্র ধরে একে দেবতা শিবের সাথেও জুড়ে রাখা হয়েছে তেলুগুতে স্থানীয় নাম পালা পিট্টা এবং কন্নড়ে একে নীলকন্ঠী বলা হয়


রাডি কিংফিসার (Halcyo coromanda) একটি মাঝারি আকারের গেছো মাছরাঙা যাদের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, উত্তরে দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপান, দক্ষিণে ফিলিপাইনস থেকে সুন্দা দ্বীপপুঞ্জ এবং পশ্চিমে ভারত ও চিনে দেখা যায়। এরা পরিযায়ী শীতের সময় দক্ষিণে বোর্নিও পর্যন্ত ড়ে যায়। এই মাছরাঙা ক্রান্তীয় অঞ্চল নাতিশীতোষ্ণ এলাকার ঘন জঙ্গলে এবং রেনফরেস্টের মধ্যে বসবাস করেগোত্র-নামটি ভারতের করমণ্ডল কোস্টের সূত্রে রাখা হয়েছে।
প্রায় ২৫ সেমি দীর্ঘ এই মাছরাঙার বেশ বড়ো উজ্জ্বল লাল রঙের ঠোঁট এবং লাল পা লক্ষণীয়শরীর মরিচা লাল, লেজে লালের সাথে বেগুনি রঙের মিশ্র থাকে। পুরুষ-পাখিদের পালক মেয়েদের তুলনায় কিছুটা উজ্জ্বল রংয়ের হয় অন্যান্য মাছরাঙার মতো এরাও সাধারণত মাছ, খোলাযুক্ত ছোটো প্রাণী এবং বড়ো পোকামাকড় খেয়ে থাকে বহমান জলস্রোতের মধ্যে এদের ব্যাঙ ও অন্যান্য উভচর প্রাণী ধরতেও দেখা যায়। যেহেতু এরা ঘন জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় বসবাস করে সেজন্য এই পাখিকে দেখতে পাওয়া যায় কম, ডাক শোনা যায় বেশি


ইয়েলো ওয়াটেইলড ল্যাপ উইং (Vanellus malabaricus) ভারতীয় উপমহাদেশের একটি দ্রুত উড়তে সক্ষম পরিচিত পাখি। এদের উপদ্বীপীয় ভারতের শুষ্ক সমভূমিতে প্রধানত দেখতে পাওয়া যায় এরা পরিযায়ী নয়, তবে বৃষ্টির মরসুমে একস্থান থেকে অন্যত্রড়ে যায়। ফ্যাকাশে ধূসর বাদামি গায়ের রঙ। মাথায় কালো টুপির মতো থাকে, পা হলুদ এবং ঠোঁটের গোড়ায় একটি হলদে ত্রিকোণ দেখা যায়অন্যান্য lapwings এবং plovers-দের মতো রা স্থলচর পাখি এবং এদের বাসা ছোটো নুড়িপাথর দিয়ে বানায়। যার মধ্যে এদের ডিম মিশে থাকে শিকারিদের নজর বাঁচিয়ে। ২৬০ - ২৮০ মিমি লম্বা। পাখনা ১৯১ - ২১১ মিমি দীর্ঘ। ২৩ - ২৬ মিমি ঠোঁট। পা ৫৭ - ৬৬ মিমি এবং লে ৭১ - ৮৪ মিমি দীর্ঘ হয় নারীপুরুষ একইরকম দেখতে। পুরুষদের ডানা সামান্য বড়ো হয়এদের ডাক উচ্চমাত্রার tchee ধরনের শব্দ। খাদ্য তালিকায় বিটল, উইপোকা   এবং অন্যান্য অমেরুদণ্ডী প্রাণী যাদের মাটি থেকে ধরা যায়।


ইস্টার্ন ইয়েলো ওয়াগটেল (Motacilla tschutschensis) ওয়াগটেল পরিবার Motacillidae গোত্রভুক্ত পাখি। নাতিশীতোষ্ণ এশিয়ায় এই প্রজাতির মূল বসবাস। মাইগ্রেট করে দক্ষিণ এশিয়া, উত্তর আমেরিকার আলাস্কা এবং অস্ট্রেলিয়াতে ড়ে যায়। সরু ধরনের ১৫ - ১৬ সেমি লম্বা পাখি বিশেষভাবে লক্ষণীয় দীর্ঘ এবং বিরামহীনভাবে নাড়াতে থাকা লেজ। প্রজননসক্ষম প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ-পাখির পালক উপরে এবং নিচে হলুদ জলপাই রঙ। অন্যান্য পালক হলুদ সাদা দ্বারা মিশ্রিত থাকে। পুরুষদের মাথায় রং ও নকশার বিভিন্নতা দেখা যায় উপপ্রজাতি অনুসারে। উচ্চ মাত্রার jeet jeet শব্দ এদের ডাকের ধরন। কীটভক্ষক এই পাখিরা তৃণভূমিসহ কাছাকাছি জল আছে এমন খোলা জায়গায় থাকতে ভালোবাসে
(ক্রমশ)
_____
ছবিঃ প্রতিম দাস

1 comment:

  1. লেখা ভাল হচ্ছে। এর সাথে প্রতিটি পাখীর বাংলা নাম দিলে মনে হয় ভাল হবে। প্রয়োজনে সাহায্য করতে পারি।

    ReplyDelete