ডিজনিদা’
পূর্বা
মুখোপাধ্যায়
ভিঞ্চিদা’ সিনেমা হওয়ার অনেক আগে থেকেই আমাদের পাড়ায় সবচেয়ে
পপুলার মানুষ ডিজনিদা’। ডিজনিদা’র একটা ভালো নাম অবশ্যই আছে এবং বাবা-মায়ের দেওয়া ডাকনামও আছে, কিন্তু সেই যে একবার ডিজনিদা’র আঁকা কার্টুন ছবি দেখে পটকা তাকে “আরে তুমি তো ডিজনিদা!”
বলে উঠল, সেই থেকেই ওই নামটাই রয়ে গেল। শোনা যায় ডিজনিদা’র মা প্রণতি কাকিমাও নাকি তাঁকে আর বাবলু বলেন না, বলেন “এই তোদের ডিজনিদা’ কোথায় রে? একটু ডেকে দে
তো...”
আর বলবেন
নাই বা কেন? তাঁর আদরের বাবলুর
ডিজনি প্রেমের উৎস তো তিনিই। ছেলের যখন বছর তিনেক বয়েস, একটা পপ আপ বই কিনে এনেছিলেন গড়িয়াহাট থেকে
ডোভার লেনে ঢোকার মুখে যে সরু বইয়ের দোকান সেখান থেকে – থ্রি
লিটল পিগস। ওই বইটা দেখে দেখেই ছেলে
হাঁ করত আর মা গল্প বলতে বলতে মুখে চালান করতেন পেঁপে, গাজর, বিনস-সহ চিকেন স্টু
দিয়ে মাখা গলা ভাতের মণ্ড। গল্প শেষ আর ভাতের থালাও
চাটিপুটি পরিষ্কার, এমনই টাইমিং। ইংরিজিতে লেখাগুলো পড়তেন না, নিজের মতো করে গল্প বলতেন বাংলায়...
“আর সবচেয়ে বোকা আর ভালোমানুষ যে পিগিটা তার নাম হল পোর্কার...”
পাতা
শেষ। উলটে আবার –
“ওরা একটা বাড়ি বানাল আর খুব মজায় থাকত তিন জনে।”
ফের পাতা
উলটে –
“কিন্তু সেই গ্রামে ছিল একটা দুষ্টু নেকড়ে। পিগিদের দেখেই তার লম্বা জিভটা বেয়ে টপ টপ করে লাল পড়তে লাগল
আর সে ফন্দি করতে লাগল কী করে খাওয়া যায়।”
পাতা
ওলটানো আবার।
তখনও
পড়তে শেখেনি ডিজনিদা’ মানে তখনকার বাবলু,
কিন্তু ছবিগুলো দেখেই বুঝতে পারত কোন ঘটনা ঘটছে। মা যদি অন্যমনস্ক হয়ে
ভুল লাইন বলে ফেলত সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে পাতাটা উলটে দিয়ে বলত – “আবাত”। অর্থাৎ পড়া ভুল হয়েছে, আবার করো।
বইয়ের
শেষ পাতায় তিন পিগির ছবি, হাতে গিটার,
মুখে হাসি। মা বলত – “ব্যস, আর কোনও চিন্তা
রইল না, দুষ্টু নেকড়ে কেমন জব্দ! তিন পিগিতে
গিটার বাজিয়ে গাইতে আর নাচতে লাগল – সুনো গওর সে দুনিয়াওয়ালো,
বুরি নজর না হামপে ডালো, চাহে জিতনা জোর লাগালো
, সব সে আগে হোগে হিন্দুস্তানী।”
খুব হিট
ছিল তখন গানটা। মা অত ভেবে প্রথম দিন এটা
বলেনি। বলতে হয় তাই বলেছে, কিন্তু ছোট্টো ডিজনিদা’র এটাই ছিল সবচেয়ে আনন্দের অংশ। বইটা এখনও আছে, মাঝে মাঝেই খুলে দেখে আর মনে মনে মায়ের কথাগুলো শুনতে পায়, হুবহু।
সেই থেকে
শুরু হল আঁকার ঝোঁক। পরে যখন আর্ট কলেজে ভর্তি
হতে চাইল, বাবা যথারীতি ঘোর আপত্তি জানিয়েছিল। কিন্তু মা ঠিক বুঝিয়ে–সুঝিয়ে রাজি করিয়েছিল বাবাকে। মা’কে বরাবর তার মেরি পপ্পিন্স
মনে হয়। মেঘের ওপর চড়ে এসে হাজির
হয়েছিল তাদের ভবানীপুরের বাড়িতে। কম্প্যাক্টের কৌটো খুলে মুখে
বোলাচ্ছে তার সুন্দরী মা মেরি পপ্পিন্স। এক পাশে ব্যাগ আরেক পাশে সেই লাঠিটা, যে লাঠিটাই আসলে ম্যাজিক
ওয়ান্ড। বেজায় গম্ভীর পুরোনো বাড়িটাতে
তার মা’ই ছিল একমাত্র হাসি, রোদ্দুর ঢুকত কেবল মায়ের ঘরের বারান্দা দিয়েই। ওদিকে বাবা দারুণ রাগী মানুষ। একটা দোকান আছে তার বাড়ির নিচের তলায়। খুব বেশি আয় হয় না, ওই টেনেটুনে চলে যায় আর কি। তাইই বোধহয় বাবা আরও খিটখিটে
হয়ে যাচ্ছিল প্রতিদিন। আর মা তার মধ্যেই সুমনের
গান শুনত, ছুটির দিনে নিউ মার্কেট নিয়ে যেত,
সুন্দর সুন্দর সেলাই করত আর সুস্বাদু রান্না করত বই দেখে দেখে। মায়ের ইচ্ছে ছিল বাবার স্টেশনারি দোকানটা তুলে দিয়ে একটা রেস্তোরাঁ
করবে। বাবা শুনে রেগেই আগুন। মা কিন্তু রাগ করত না কখনও, কেবল আরও ভালো কোনও রান্না করত। আর সেটা খেয়ে তিন ভাই-বোন যখন আহা আহা করত মা খালি বলত – “বল্লুম একটা রেস্তোরাঁ
করি! টাকার ওপর শুয়ে থাকতে, বুঝলে?” বাবা আরও রেগে গরগর করতে করতে বলত – “লজ্জা করে না?
রায়বাড়ির বউ চালাবে রেস্তোরাঁ? লোকে কী বলবে?
স্বামী দুটো খেতে দিতেও পারে না?” মা তখন
“কোন রানি রাসমণির যুগে পড়ে আছ?” বলেই রান্নাঘরে
ঢুকে যেত।
ডিজনিদা
একদিন মাকে বলেছিল - “তোমার রাগ হয় না?” মা হেসে বলেছিল –“তোর ওয়াল্ট ডিজনি কী বলেছিল জানিস?
পৃথিবীতে সবচেয়ে বড়ো মুশকিল হল যে, সব মানুষই বড়ো হয়ে যায়, কেউ ছোটো থাকে না। আর বলেছিল – ফার্স্ট থিঙ্ক, সেকেন্ড ড্রিম, থার্ড
বিলিভ অ্যান্ড ফাইনালি ডেয়ার। বুঝলি? তবে এর সঙ্গে যেটা লাগে সেটা হল একটু সাপোর্ট…।” মায়ের মুখটা একটু যেন করুণ হয়ে যেত কয়েক সেকেন্ডের
জন্য। তার পরেই সামলে নিত মা, মায়ের মতোই হেসে উঠে নতুন কোনও উৎসাহে মেতে
উঠত।
সেই
ভাবা শুরু ডিজনিদা’র। স্বপ্ন তো ছিলই, তার সঙ্গে আস্তে আস্তে জড়ো হতে লাগল আত্মবিশ্বাস।
ডিজনিদা’
চাকরি করে একটা প্রকাশনী সংস্থায়, যারা
মূলতঃ পড়ার বই ছাপে। মজা পায় ডিজনিদা’ যখন ইঁদুর, বেড়াল, বাঘ, ঘোড়া, ট্রেন,
এরোপ্লেন, বেলুন হাতে ছেলে-মেয়ে, লোকা ধোবা বা বাবুদের ডালকুকুর এইসব ছবি আঁকার সুযোগ
আসে। বাবা এখন আর কিছু বলে না, ছেলে রোজগেরে। বাবাকে একটা পঞ্চাশ
ইঞ্চি সোনি টিভি কিনে দিয়েছে এবার। বাবাও সেদিন লেক মার্কেট থেকে ঘুরে এসে বলে –
আজ জমিয়ে মাংস রাঁধো দেখি! আর ইলিশটা কাল সকালের......
ফোন
বাজে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ডিজনিদা’ বারান্দায় যায়, ঘরের মধ্যে সিগন্যালের প্রবলেম,
কথা কেটে কেটে যায়।
“হ্যাঁ
তপনদা বলুন...”
“শোন,
পুজোর সময় একটা কাজ আছে, সল্ট লেকে। থিমের কাজ। করবি? টাকা ভালোই দেবে, আর তোর যা
ট্যালেন্ট, ফাটিয়ে দিবি, জানি, তাই তোর নামটা বলেছি, বুঝলি?”
“ঠিক
আছে তপনদা, ক’টায় আর কোথায় কার সঙ্গে দেখা করতে হবে?”
সল্ট
লেক সেবার পুজোয় কলকাতাকে চমকে দিতে চেয়েছিল আর অবশ্যই পুরস্কার। ডিজনিল্যান্ড,
এটাই ছিল ডিজনিদা’র প্রস্তাব। আর কীই বা হতে পারে তার স্বপ্নের কাজ? সেবার সল্ট লেকে
ফুট ফল হল অভাবনীয়। সপ্তমীর দিনেই দুটো টিভি চ্যানেল, একটা খবরের কাগজ , একটা রঙের
কোম্পানি আর একটা এম এন সি ফার্স্ট প্রাইজ দিয়ে দিল। টাকাগুলো ব্যংকে রেখে
ডিজনিদা’ পাড়ার হারু দালালের সঙ্গে দেখা করল। একটা জায়গা লাগবে রেস্তোরাঁর জন্য।
কলকাতার বুকে থিম রেস্তোরাঁ - ডিজনি’স।
কেবল ব্রেকফাস্ট। ইংলিশ, কন্টিনেন্টাল আর বং ফর এভার – লুচি আর সাদা আলুর চচ্চড়ি
কালো জিরে ফোড়ন দেওয়া।
সাহস
আছে ডিজনিদা’র। আর সাপোর্টও আছে - মায়ের।
শুধু
মায়ের কেন? পাড়ার ছেলে-মেয়েগুলো সব ডিজনিদা’র ফ্যান। এই তো সামনের উইক এন্ডে পাড়ার
সব ক’টা বাড়ি, দেওয়াল ভরে যাবে মিকি মাউস, ডোনাল্ড ডাক, গুফি, প্লুটো, মোগলি,
টারজান, র্যাপুঞ্জেলে ...... প্ল্যান রেডি।
আসলে
স্বপ্নের শেষ নেই কোনও। ওয়াল্ট ডিজনির বিখ্যাত উক্তিগুলো বাংলায় লিখে নিজের
ডিজাইনে পোস্টার, কফি মাগ আর টি-শার্ট বানাচ্ছে ডিজনিদা’। তার নিজের
ব্র্যান্ড, নাম দিয়েছে - ডিজনিদা’স।
ভারতবর্ষব্যাপী বড়ো একটা চেইন অফ স্টোরের সঙ্গে কথা ফাইনাল, তারা রাখবে এই মার্চেন্ডাইজ।
পাশের
বাড়ির গাঙ্গুলিকাকুর ছেলে পাপ্পু, ফিল্ম স্টাডিস
নিয়ে পড়ছে; বলছিল একদিন সেও একটা সিনেমা বানাবে – ডিজনিদা’।
_____
ছবিঃ
আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment