আমার বন্ধু
সত্যজিৎ দাশগুপ্ত
ইট দিয়ে উইকেট বানাব, ক্রিকেট খেলব। তাই একসঙ্গে দুটো ইট তুলে আনতে হবে। ভয় কী? বন্ধু আছে। স্কুলের বন্ধু বুম্বা খুব দস্যি
ছেলে। সবাই ভয় পায়। কিন্তু আমি পাই না। বন্ধু আছে। স্কুলে যাবার সময় সামনে রাস্তার
মোড়ে কুকুরটা আমায় টেরিয়ে টেরিয়ে দেখে। আগে ভয় পেতাম। এখন পাই না। বন্ধু আছে। ভয় পেলে বন্ধু।
কাউকে ভয় দেখানোর দরকার পড়লে
বন্ধু। গায়ে জোর আনার দরকার হলে বন্ধু। এমনকি, পিলে চমকে যাবে, এমন আকারের মাঠেও
প্রায় ফুঁ মেরে ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে বলটাকে
এক ড্রপে মাঠের বাইরে ফেলে দিয়েছি। শুধুমাত্র বন্ধুর কথা ভেবে মনে জোর এনে! ছেলেবেলার
অনেকটা আমার কেটেছে, মানে বলতে গেলে উতরে গেছে, বন্ধুর হাত ধরে।
তো এই বন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় একটা
সাদা পাতায়। আমার এক দাদু আছেন। উনি বেশ স্কেচ করতে পারতেন। একেবারে
দারুণ আহামরি কিছু না হলেও ওই
বয়সে আমার মতো একটা বাচ্চা ছেলের মন কেড়ে নেবার পক্ষে যথেষ্ট। অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি, দাদুর ওই স্কেচ আঁকা দেখেই
আমার ছবি আঁকার প্রতি ভালোবাসা
জন্মায়। তাই
তো বলে, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গ বাস, আর অসৎ সঙ্গে নরক বাস।’ তো যাই হোক, দাদুভাইকে ওইরকম চেহারার একটা মানুষের ছবি আঁকতে দেখে আমি
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “এটা কে গো দাদুভাই?”
তাতে দাদুভাই হেসে বলল, “চেনো না একে?”
ওনার তখন প্রায় ছবি আঁকা শেষ। টাক মাথাটা অনেকটা যেন আমের আকারের। শরীরের ওপরের অংশটা আরব দেশের তেলের পিপের মতো বিশাল হলেও পাতলা কোমর থেকে শুরু করে শরীরের নিচে পা পর্যন্ত দেহের গঠন রোগা
লিকলিকে। কিন্তু সিংহের থাবার মতো পায়ের পাতা দুটো আবার লম্বা গোদা গোদা। লোকটা কোনও জুতো বা চটি পরে না। মনোহর
আইচের মতো তাক লাগানো হাতের গুলি। এক ঘুসিতে গামা পালোয়ানও সেকেন্ডে কুপোকাত হবে এমন শক্তিশালি কবজিওয়ালা হাত।
এই সাংঘাতিক শরীরের গঠনে গোলাপি রঙের টাইট স্যান্ডো গেঞ্জি আর তার সঙ্গে খয়েরি
টাইট হাফ প্যান্ট। আশ্চর্য চেহারার এই মানুষটা চোখ বন্ধ করে মুখে
সিটি দিতে দিতে আপন মনে কোথায় যেন হেঁটে চলেছে। আরও আশ্চর্যের, লোকটার পেছনে দু’পাশে দুটো উড়ুক্কু মাছের মতো চেহারার বদ ছোকরা ওর দিকে বন্দুক তাক করে রেখেছে। আর সেই
বন্দুকগুলো থেকে চারটে গুলি বেরিয়ে এসে লোকটার বুকে লেগে পিংপং বলের মতো লাফিয়ে চারধারে ছিটকে পড়েছে! এক
কথায়, দেখেই মনে হয় লোকটা পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী মানুষ!
সেই আমার বন্ধুর সঙ্গে প্রথম দেখা। আমি অবাক হয়ে
চেয়ে থেকে দাদুভাইকে বললাম, “আমি চিনি
না।”
দাদুভাইয়ের ততক্ষণে ছবি আঁকা শেষ। হেসে আমায় বলল, “পড়বে ওর গল্প?”
“গল্প!” - এই জিনিসটার ওপর আমার দুর্বলতা
সেই ছেলেবেলা থেকে। কথাটা শুনে আমার ঠোঁটের দুই কোণ দু’গালে ছড়াতে দাদুভাই আমার মনের কথা
পড়ে ফেলে ফুলস্কেপ কাগজের আকারের গোটা দশেক বই আমাকে দিয়ে বলল, “এই নাও, কিন্তু পড়াশুনার ক্ষতি করে নয়।”
আমি সঙ্গে সঙ্গে বইগুলোর ওপর হামলে পড়লাম।
শুধু ছবি আর ছবি। আর সেই ছবির চরিত্রগুলোর মুখে বসানো রয়েছে কথা। সেই প্রথম পড়তে
শুরু করলাম ছবিতে গল্প।
হ্যাঁ, এইভাবেই আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হল বন্ধুর। কী? চিনে ফেলেছ তো সবাই বন্ধুকে?
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। গ্রেট অফ অল গ্রেটস, মানে সেরার সেরা সেই মানুষটা আর কেউ না – ‘বাঁটুল দি গ্রেট’। আমার বন্ধু! আমার
ছেলেবেলা। একরাশ স্মৃতি! আর একই সঙ্গে পরিচয়
হল তার দুই ভয়ানক দুষ্টু সাগরেদ, বাচ্চু আর বিচ্ছুর সঙ্গে। ওদের অবশ্য একটা করে নাম আছে। ভজা আর গজা! বাঁটুল ওদের ভালোবেসে বাচ্চু আর বিচ্ছু নামে ডাকে।
কাকে নিয়ে আগে কথা বলি বুঝতে পারছি না। বাঁটুল, নাকি তার স্রষ্টা? বাংলাদেশের প্রবাদপ্রতিম
মানুষদের মধ্যে নিঃসন্দেহে উঠে আসবে নারায়ণ দেবনাথের নাম। একেবারে ‘লিভিং লিজেন্ড’ বললে যা বোঝায়, উনি হয়তো, হয়তো কেন, তাইই।
নারায়ণ দেবনাথ, নামটা শুনলে আমার কেন
জানি একটা ছবি মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। ওই দূর থেকে
হেঁটে আসছে হাঁদা ভোঁদা (সঙ্গে
কাকাবাবু), বাঁটুল দি গ্রেট (সঙ্গে বিটকেল ভজা আর গজা) আর নন্টে ফন্টে (সঙ্গে কেল্টুদা আর তার পেছনে ছুটছেন ইয়া মোটা ভুঁড়িওয়ালা স্যার) - আর এদের সবার
আগে আগে হেঁটে আসছেন আমাদের সবার প্রিয় নারায়ণ দেবনাথ। হ্যাঁ, ১৯৬২ সালে শুরু করেছিলেন ইতিহাস রচনা। সৃষ্টি হয়েছিল হাঁদা ভোঁদা। চলছে এখনও। বলতে গেলে
বিশ্বরেকর্ডের শিরোপাটা কিন্তু ওনার ঝুলিতেই! সেই ১৯৬২ থেকে শুরু হয়ে হাঁদা ভোঁদার
কর্মকাণ্ড (শুকতারাতে) আজও রমরমিয়ে চলেছে।
যা কিনা একজন একক কমিক শিল্পীর সবথেকে বেশি দিন ধরে চালানো কোনও কমিকসের একটা
রেকর্ড! হ্যাঁ, হাঁদা ভোঁদা আজ ধরতে গেলে আটান্ন ছুঁয়ে ফেলল! এরপর ১৯৬৫-তে জন্ম নিল আমার এই বন্ধুরা। মিঃ বাঁটুল আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। আর তারও বছর চারেক পর, ১৯৬৯-এ নারায়ণ দেবনাথ আমাদের সঙ্গে পরিচয় করালেন আরেকটা দলের, নন্টে
ফন্টে, সঙ্গে কেল্টুদা আর ইয়া মোটা ভুঁড়িওয়ালা
স্যারের। বলে রাখি, উনিই কিন্তু একমাত্র কমিক আর্টিস্ট, যিনি ডি. লিট. (ডক্টর অফ লেটারস) উপাধি পেয়েছেন! ভাব তো! আমরা যারা খালি বিদেশ বিদেশ করে লাফাই, তারা তো
জানিই না যে এমন একটা সোনার খনি রয়েছেন আমাদের হাতের কাছে। আমাদের এই
বাংলায়!
বাঁটুলের স্রষ্টা নারায়ন দেবনাথ, ফোটোঃ
কুশল দাস
|
পূর্বপুরুষ বাংলাদেশের ঢাকা বিক্রমপুরের মানুষ হলেও নারায়ণ দেবনাথের জন্ম
কলকাতার পড়শি শহর হাওড়ার শিবপুরে। ছোটো থেকেই উনি ‘ভিসুয়াল আর্ট’ বা ‘দৃশ্যমান অঙ্কনের’ প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে ফাইন আর্ট নিয়ে পড়াশুনা
করলেও সে পড়া আর শেষ করতে পারেননি। এর পর কোনও সংস্থার সঙ্গে যুক্ত না হয়েই বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থার হয়ে কাজ করতে শুরু করেন। নিজেই
নিজের মালিক হয়ে ওঠেন। প্রথম থেকেই ছিল বিদেশি কমিকস-এর ওপর আনুগত্য। কিন্তু কমিকস - বাংলাতে!
অনেক ভাবার ব্যাপার রয়েছে! অনেক দূর যেতে হবে যে। আর সেই থেকেই বাংলা কমিকস যেন নারায়ণ দেবনাথের কোলে চেপে বসল। আর বলতে বাধা নেই, সে কোল ছাড়া হয়নি আজও!
আসলে ফেলুদার কথা উঠলে যেমন সত্যজিৎ রায়, ব্যোমকেশের কথা উঠলে শরদিন্দুবাবু
বা পান্ডব গোয়েন্দার জন্য ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের কথা না বলে থাকা যাবে না, তেমনই,
বাঁটুলের কথা উঠলে নারায়ণ দেবনাথ বা তাঁর অন্যান্য কীর্তি বা সৃষ্টির কথা না বললে
পেটের ভাত হজম হবে না!
শুধু হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল বা নন্টে ফন্টে নয়, নারায়ণ দেবনাথের আরও অনেক
কালজয়ী সৃষ্টি আজও বেঁচে আছে আমাদের মধ্যে। থাকবে চিরটা কাল। ব্ল্যাক ডায়মণ্ড
ইন্দ্রজিৎ রায়, পটলচাঁদ দি ম্যাজিশিয়ান, কৌশিক রায়, বাহাদুর বেড়াল (আমাদের বাড়ির বেড়ালটাকে ছোটোবেলায় আমি বাহাদুর নাম দিয়েছিলাম আর ওকে সত্যিকারের
বাহাদুর বেড়াল বলেই মনে করতাম), ডানপিটে
খাঁদু আর তার কেমিক্যাল দাদু, পেটুক মাস্টার বটুকলাল বা সুঁটকি মুটকি। একের পর এক
অমর সৃষ্টি! চরিত্রগুলো এতটাই প্রাণবন্ত যে সব সময় মনে হত ওরা আমার আশেপাশে ঘুরে
বেড়াচ্ছে। আর এগুলোর প্রভাব ছিল আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও। বাঁটুলকে যেমন আমি বন্ধু
বলে মনে করতাম, আপন মনে ওর সঙ্গে কথা
বলতাম, তেমনই পাড়ার দুটো ‘মর্কট’ ধরনের ছেলেকে (আমার ঘুড়ি কেটে দিত) দেখে বাচ্ছু বা বিচ্ছুর কথা মনে পড়ত। আমি ছেলেবেলাতে থাকতাম শিয়ালদার বি আর সিং
হাসপাতালের কোয়ার্টারসে,
মামাবাড়িতে। সেই সময় আমি বেশ মোটা ছিলাম (এখনও আছি)। আর
আমার পাড়ার একটা ছেলে চন্দন ছিল খুব রোগা। ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব যেমন ছিল তেমন মারামারিও
হত খুব। আমি স্বভাবে বেশ বোকাসোকা ছিলাম। আর ও ছিল পাক্কা দুষ্টু। খালি আমাকে ফাঁসানোর
চেষ্টা করত (যদিও ক্ষতি করত না)। কিন্তু কী আশ্চর্য! প্রতিবারই ও কী ভাবে যেন
নিজেই ফেঁসে যেত! তখন নিজেকে হাঁদা ভোঁদার ‘ভোঁদা’ বলে মনে হত। পাড়ার এক দাদা টিটুদা অবশ্য আমাদের দুই বন্ধুকে ‘নন্টে-ফন্টে’ বলে ডাকত আর থেকে থেকে আমাদের দু’জনের কান মুলে দিত (কারণটা আজও জানি না!)। তাই ও আমাদের কাছে ছিল ‘কেল্টুদা’! আর সেই দাদাও কিন্তু ছিল
কেল্টুদার মতো ঢ্যাঙা লম্বা! আরও মজার ব্যাপার
কী জানো? আমাদের উলটোদিকের
ফ্ল্যাটে নিত্যানন্দ দাদু বলে এক দাদু থাকতেন। ইয়া মোটা ভুঁড়িওয়ালা। উনি আমাদের
খুব ভালোবাসতেন। টিটুদা আমাদের ওপর
অত্যাচার চালালে উনি ওকে ঠ্যাঙানোর জন্য তাড়া করতেন। অনেকটা নন্টে-ফন্টের সেই
স্যারের মতো। কী? কেমন অজান্তেই তৈরি হয়ে গেছিল দেখেছ 'টিম নন্টে-ফন্টে’?
প্রাথমিক পর্যায়ে হাঁদা ভোঁদা কিন্তু পেনসিল স্কেচে আঁকা হত। কমিকসে রং
চড়েছিল বাঁটুল দি গ্রেট থেকে। যা প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল শুকতারাতে। ছোটো থেকে বড়ো, সবার কাছে সমান জনপ্রিয়তা লাভ
করেছিল বাঁটুল।
ইতিহাস সৃষ্টি হয় অজান্তেই। সৃষ্টিকর্তা নিজেও ঠাহর করতে পারেন না যে তাঁর সৃষ্টি অমরত্ব লাভ করতে চলেছে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল
নারায়ণ দেবনাথের বেলাতে। বেশ কিছুদিন ধরেই মাথায় ঘুরছিল বাংলা কমিকসের জগতে সুপার হিরো গোছের কিছু একটা জন্ম দেওয়ার, যে হবে অতি বলশালী, যার
কাজের ক্ষমতা হবে আর পাঁচটা মানুষের থেকে অনেক বেশি। অনেকটা যেন মহাভারতের ভীমের মতো। কিন্তু
যার অস্তিত্ব নেই, তাকে সৃষ্টি করা কতটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার, তা একমাত্র শিল্পীই জানে।
সেবার সাহিত্যের তীর্থক্ষেত্র কলেজ স্ট্রিট থেকে ফিরছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। আর সেখানেই যেন দেবী সরস্বতী তাঁকে একটা
বুদ্ধি দিলেন। তাঁর অতি প্রিয় বন্ধু ছিলেন মনোহর আইচ। গাঁট্টাগোট্টা বেঁটেখাটো
চেহারার বিখ্যাত বডি বিল্ডার মনোহর
আইচ তখন ভারত বিখ্যাত। ততদিনে উনি ‘মিঃ
ইউনিভার্স’ হয়ে গেছেন। কলেজ স্ট্রিট থেকে ফেরার সময় ওনার কথাই মাথায় এল নারায়ণবাবুর।
মনোহর আইচকে যদি বাস্তব থেকে বইয়ের পাতায় তুলে আনা যায় তাহলে কেমন হয়? তাঁকে যদি
এক রূপকথার নায়কে পরিণত করা যায়, তবে? ব্যস, যেমন ভাবা
তেমন কাজ। ক্ষণিকের চিন্তা রূপ নিল বাস্তবের আর তা হয়ে উঠল অমর। চোখের পলকেই হয়ে
গেল নামকরণ আর মনে মনে রূপ নিয়ে নিল সেই চরিত্রের চেহারা। তবে প্রথমদিকে কিন্তু
উনি বাঁটুলকে তেমন অতিমানবিক কোনও ক্ষমতা দেননি।
সেটা ছিল ১৯৭০-৭১। চলছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। লেখকের কাছে প্রস্তাব এল
বাঁটুলকে নিয়ে নতুন কিছু করার। তাকে অপরাজেয় করে তোলার। কিন্তু প্রথমটায় মন মানেনি
নারায়ণবাবুর। কারণ তাঁর মনে সংশয় ছিল বাঁটুলের এই রূপের বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা
নিয়ে। কিন্তু পরে আশ্বস্ত হয়ে তিনি রাজি হলেন, আর বাঁটুল
হয়ে উঠল ‘অতিমানব’।
দেখতে দেখতে বাঁটুলের এমন শক্তি সঞ্চয় হয় যে অনায়াসে সে গোটা পৃথিবীও দু’হাতে তুলে ধরতে পারে। খালি হাতেই মেরে ফেলে তিমি মাছ বা
হাঙর! এমনকি বন্দুক বা কামানের গোলাগুলিও তার বুকে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে যায়! অসম্ভব
খাবার ক্ষমতার জন্য মাঝে মধ্যেই আমরা দেখি বাঁটুল তার সকালের খাবার সারছে তিমি মাছ
দিয়ে!
দেখতে দেখতে বাঁটুল হয়ে উঠল চোর, ডাকাত আর গুন্ডাদের দুঃস্বপ্ন। সাধারণ
মানুষ এই সব গুন্ডাদের থেকে রেহাই পেতে ছুটে যেতে শুরু করল বাঁটুলের কাছে।
বাঁটুলের এই অতিশক্তি কিন্তু অনেকসময় অনেকের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াল। যেমন তাকে
হয়তো কোনও মেশিন চালাতে বলা হল। দশজন মিলে যে মেশিনটা খুব কষ্ট করে চালাবে, বাঁটুল কিন্তু সেটা এক হাতে অনায়াসেই চালিয়ে
দেবে। কিন্তু
সেটা চালাতে গিয়ে বেশি পরিমাণ হাতের চাপে সে মেশিনটাই দিল ভেঙে। আবার
ভয়ঙ্কর ষাঁঢ়ের পিঠে খুব সহজে উঠে বসলেও বেশি ওজনের
জন্য বেচারা ষাঁঢ়ের পা-ই গেল বেঁকে! কখনও আবার বাচ্চু বিচ্ছুর সঙ্গে লাট্টু খেলতে গিয়ে লেত্তিটা এত জোরে টানল, যে সেই লাট্টু আকাশে উড়তে উড়তে
পাড়া ছেড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল! কোথাও কোথাও আমরা আবার বাঁটুলকে ডিটেকটিভ হিসেবেও পেয়ে গেলাম।
বাঁটুলের কথা উঠলে নিঃসন্দেহে আসবে ওর দুই স্কুল পালানো সাগরেদ বাচ্চু আর
বিচ্ছু, মানে ভজা আর গজার কথা। এদের কথা যদিও আমি আগেই বলেছি। সবসময়
দুষ্টু বুদ্ধি এদের মাথায়। ব্যাঙ্ক লুঠ থেকে শুরু করে নানা
রকম ভয়ঙ্কর অপরাধের সঙ্গে জুড়ে থাকে এরা। তাই মাঝে
মাঝে শায়েস্তাও হতে হয় বাঁটুলদা'র কাছে।
এছাড়াও আছে লম্বকর্ণ। যার কান জোড়া
ইয়া লম্বা আর শোনার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের থেকে কয়েকশো গুণ বেশি।
পোষা কুকুর ‘ভেদো’ আর পোষা উটপাখি ‘উটো’ বাঁটুলের খুব কাছের। এই উটো কিন্তু যেমন তেমন পাখি নয়। ওর মাথায় হাত দিয়ে
ঘষলে আগুন জ্বলে ওঠে।
তো এই হল আমার বন্ধু। দি গ্রেট অফ অল গ্রেটস। বাঁটুল দি গ্রেট। অনেক কথা বললাম আমার বন্ধুকে নিয়ে। যারা আমার বন্ধুকে
চেনো, তাদের আর নতুন করে কী বলব ওর কথা! আর যারা ওর কথা শোনোনি, পড়োনি, তারা এখুনি
পড়ো আমার বন্ধুর কীর্তিকলাপ। আর তাছাড়া আজকাল তো টিভিতেও বাঁটুল দি গ্রেট দেখানো
হয়। দেখতে মজা লাগে জানি। কিন্তু একটা সত্যি কথা বলি? টিভির অনুষ্ঠানকে এতটুকু ছোটো না করেই বলছি, আসল কমিকসের বইটা না পড়লে কিন্তু তাতে আঁকা ছবির
গন্ধটা ঠিকঠাক পাওয়া যায় না। কারণ বাঁটুল দি গ্রেট বা হাঁদা ভোঁদা অথবা নন্টে
ফন্টে তো শুধু মাত্র সাহিত্য নয়, একেকটা আস্ত আদ্যোপান্ত অঙ্কন শিল্প! তাই বলি,
টিভি দেখো, তাতে কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু এদের বইগুলো পড়তে ভুলো না। বই পড়লে
কিন্তু মনে রাখার ক্ষমতা বাড়ে। গল্পের বই পড়ার অভ্যাস পাঠ্য বই পড়তে আর তা থেকে
বিষয়বস্তু বুঝতে অনেক সাহায্য করে। তাই বলি, বই পড়ো। আর তার সঙ্গে আমার সেই দাদুর মতো করে বলি
একটা কথা – ‘পড়াশুনার ক্ষতি করে নয়।’
ওঃ - আবার মা ডাকছে। দাঁড়াও সবাই এক মিনিট -
* * *
আমি এসে গেছি। কী করলাম বল তো? বললে
হাসবে। বাড়ির গ্যাসটা শেষ হয়ে গেছিল। মা আসলে নতুন সিলিন্ডার লাগানোর জন্য ডাকছিল।
গেলাম। এক ঝটকায় পুরোনো সিলিন্ডারটা তুলে পাশে রাখলাম। আর একইভাবে এক ঝটকায় ‘নতুন ভর্তি’ সিলিন্ডারটা তুললাম আর তারপর
সেটা জায়গামতো বসিয়ে দিয়ে এলাম। কী ভারি ওটা! অথচ
কী অনায়াসে করে ফেললাম গো কাজটা। ওঃ, বললাম না, আমার বন্ধু যে বাঁটুল! একটা প্রভাব
থাকবে না বন্ধুর? তাই কখনও হয়!
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment