ভ্রমণ:: অন্ধকার - ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়


অন্ধকার
ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়

ক্লাস ইলেভেনে পড়ি৷ মফঃস্বলের এক স্কুল৷ বাংলার মাষ্টারমশাই দিলীপবাবু বেশ রাশভারী৷ টকটকে ফরসা৷ টিকোলো নাক৷ ঘি রঙের পাটভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি গায়ের রঙের সঙ্গে বেশ মানানসই৷ শীতকালে কাঁধে একটা পাট করা শাল পরম যত্নে রাখা৷ শাল জড়াতে কোনোদিন দেখিনি, তা সে যতই ঠাণ্ডা পড়ুক না কেনপণ্ডিত মানুষ, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই৷ সংস্কৃত আর বাংলা সাহিত্যে অবাধ বিচরণ ছিল তাঁর৷ কয়েক হাজার সংস্কৃত শ্লোক তাঁর ঠোঁটস্থ ছিল৷ বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ থেকে হাল আমলের সত্যজিৎ রায় অবধি বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণখনি ছিল তাঁর নখদর্পনে৷ এহেন মাষ্টারমশাই পরীক্ষায় যে কী রচনা লিখতে দেবেন সেটা কারুরই বোধগম্য হচ্ছিল না৷
প্রশ্নপত্র পেয়ে চোখ কপালে ওঠে আর কি; রচনা লিখ ‘রাত্রি’!
এর ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি, কী লিখব কিছুই মাথায় আসছে না৷ রাত্রি মানে যেটা প্রথম আমার মাথায় আসে তা হচ্ছে ঘুম৷ রাত একটু হলেই কখন যে ঘুমোতে যাব, সেটাই আমার একমাত্র চিন্তা থাকে৷ কিন্তু সে তো আর খাতায় লেখা যাবে না৷ আর কী হতে পারে...? ও মনে পড়েছে৷ রাত্রি মানে অন্ধকার৷ আর... আর... অন্ধকার মানে সেই রাত্রি৷ এই মরেচে৷ আর তো কিছু মাথায় আসছে না! সেদিন রচনা কী লিখেছিলুম আর তার জন্য স্যারের কাছে কী বকুনি খেয়েছিলুম, সেটা এই গল্পের বিষয় নয়৷ লজ্জার মাথা খেয়ে সে গল্প না হয় আর একদিন করা যাবে৷ কিন্তু সেই দিন ‘অন্ধকার’ শব্দটা আমার মাথার গভীরে কখন যেন ঢুকে গিয়েছিল, জানতেও পারিনি৷

অনীক রতন সমাদ্দার৷ মাঝখানে ‘রতন’ নামটা ঢুকে যাওয়াতে অনীকের কাছে তার নিজের নাম সেকেলে সেকেলে লাগত৷ তাই নাম জিজ্ঞেস করলে মাঝখানটা উড়িয়ে দিয়ে নাম বলত৷ কিন্তু বিচ্ছু কোনও ছেলে ওর মাঝখানের নাম ফাঁস করে দেওয়াতে সে কী রাগ! যাই হোক, তার ফলে ওর নাম হয়ে যায় ‘রতন’, পরে ওকে খুশি করার জন্য একটু ইংরেজি কায়দায় বলা হতো ‘র‍্যাটান’৷ কালে কালে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে ওকে কেউ অনীক বলে ডাকলে সাড়া দিতে ভুলে যেত৷
র‍্যাটান আর আমি দু’জনেই শিক্ষাজগতকেই কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেওয়ায় মাঝে মাঝেই এদিক ওদিক দেখা হয়ে যেত৷ এইরকম একটা কাজে একবার আমরা গিয়ে পড়লুম তুরায়৷ তুরা হল মেঘালয়ে৷ গুয়াহাটি থেকে যেদিকে গেলে শিলং যাওয়া যায়, তার ঠিক উলটোদিকে অনেক অনেকটা গেলে পাহাড়-জঙ্গল-নদীর চোখভোলানো মনভোলানো সবুজের সমারোহ পেরিয়ে পৌঁছে যাবে তুরায়৷
তুরায় গিয়ে আমাদের মনে সত্যি যেন তুরীয় ভাব জেগে উঠল৷ কারণ কিন্তু অন্য৷
ওখানে থাকতে থাকতেই খবর পেলুম যে এর আশেপাশে নাকি বেশ কিছু গুহা আছে, যাকে ইংরেজিতে বলে cave
ব্যস্, র‍্যাটানের চিরচঞ্চল মনের পাগলামি শুরু হয়ে গেল৷ যখনই দেখা হয়, একটাই কথা, ‘অ্যাই অভি, চল না, চল না... কবে যাবি...? আর মাত্র ক’টা দিনই বা আছি এখানে।’
‘যাব যাব, চিন্তা করিস না৷’
দু’জনে আছি একই হোটেলে৷ ছাদের ওপর একটা সুন্দর ফাঁকা জায়গা আছে, সেখানে গুটিকয়েক চেয়ার টেবিল পাতা৷ সামনে কোনও বাধা নেই৷ সবুজে সবুজে ঢাকা পাহাড়৷ উচ্চতা খুব বেশি নয়৷ কিন্তু যেদিকে চোখ যায়, যতদূর চোখ যায়, পাহাড়ের পর পাহাড়৷ বিকেলের পড়ন্ত সূর্যের আলোয় হরেকরকম সবুজের ওপর সোনালি হলুদের মোলায়েম প্রলেপ৷ বেশ দেখতে লাগে৷ শহর থেকে দূরে কিছুদিনের জন্য এলে মন কেমন যেন উদাস হয়ে যায়৷ শহরের কোলাহল চলে যায় অনেক অনেক দূরে৷ এক নিস্তব্ধ শান্তির গভীরে ডুবে যাই৷
সারাদিনের কাজের পর সবে চায়ে চুমুক দিতে যাব, আবার র‍্যাটানের আকুতি, ‘কী রে, ঠিক হল সব? কবে যাবি? কখন বেরোতে হবে আমাদের?
‘কোথায যাবি? আমি যেন আকাশ থেকে পড়লুম৷
আমার ছদ্ম-অবাক-হওয়া বুঝতে না পেরে ও আরও অসহিষ্ণু৷
‘কী মুশকিল! সেই যে কোথায় কেভ আছে? আর তো মাত্র তিন দিন আছে ফিরে যেতে৷ যাবই বা কবে আর ফিরবই বা কবে?
আমার গম্ভীর মুখ দেখে তার অস্থির ঘোষণা – ‘কেভ না দেখে আমি কোথাও যাব না৷ দরকার হলে ফেরার টিকিট ক্যানসেল করে দেব।’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে৷ শুধু কেভ দেখলেই হবে তো, মানে বাইরে থেকে গুহার ভেতরে একটু মুখ বাড়িয়ে দেখলেই...
‘না না...,’ আমার কথা থামিয়ে র‍্যাটানের আর্তনাদ, ‘ভেতরে তো ঢুকতেই হবে৷ আমি একবার এক কেভের ভেতরে গিয়েছিলুম অনেক কাল আগে৷ তোকে তার গল্প বলব, তাহলেই বুঝবি কীরকম থ্রিলিং! আমরা আবার হারিয়েও গিয়েছিলুম সেই কেভ-এর মধ্যে।’ শেষের কথাগুলো আমাকে সুড়সুড়ি দেবার জন্য৷
‘কিন্তু কেভের ভেতরে ঢুকতে গেলে তো সাজসরঞ্জাম নিয়ে ঢুকতে হবে, মানে নিদেনপক্ষে একটা টর্চ...
‘আরে সে তো নিতেই হবে।’
‘অনেক কেভের ভেতরে নাকি জল থাকে, তা ছাড়া এখানকার কেভে শুনেছি লোকজন বড়ো একটা যায় না... ব্যাপারটা একটু বেশি রিস্ক হয়ে যাচ্ছে না কি? র‍্যাটানকে নিরস্ত করার শেষ চেষ্টা, যদিও আমার ভেতরে উৎসাহটা কিলবিল করে উঠেছে৷
ভেতরে ভেতরে আমি এদিকে খোঁজখবর চালিয়ে যাচ্ছি, সেই গুহা এখান থেকে কত দূর, কীভাবে যাওয়া যায়, কতদিনের ধাক্কা, খাবার-দাবার সঙ্গে নিতে হবে কিনা... র‍্যাটানকে বলিনি, সারপ্রাইজ দেব বলে৷
র‍্যাটান মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে আমার যাবতীয় চিন্তা-ভাবনা-শঙ্কা উড়িয়ে দিল৷
‘কোনও চিন্তা নেই, আমি সব লিস্ট করে রেখেছি৷ কী কী জিনিসপত্র নিতে হবে, খাবার কতটা নেব, সব সব... জাস্ট আধঘন্টার ব্যাপার, একবার খালি বাজারে যেতে হবে।’
‘এত সহজ!? আমার কপট বিস্ময় ও ঠিক ধরতে পারে না৷
‘কিছু চিন্তা করিস না৷ ও আমি একাই ম্যানেজ করে নেব৷ তোকে কোথাও যেতে হবে না, শুধু ওই গুহায় যাবার ব্যবস্থা...
নাঃ, বেচারিকে আর সাসপেন্সে রাখার কোনও মানে হয় না৷
‘সন্ধে ছ’টা নাগাদ একবার বাজারে যাব, একজন হয়তো নিয়ে যেতে পারে আমাদের গাড়ি করে৷ আসলে এখান থেকে ওই কেভে যাবার রাস্তা খুব খারাপ৷ প্রায় একশো কুড়ি কিলোমিটার যেতে হবে, শেষের দিকের রাস্তা নাকি জঘন্য৷
'তা আমি বলে দিয়েছি, যত দূর পারবে আমাদের গাড়ি করে নিয়ে যাবে, তারপর না যেতে চাইলে ওখানেই ছেড়ে দেবে। আমরা হেঁটে বা যা হোক করে চলে যাব৷ ওনার কোনও দায়িত্ব নেই৷ দ্যাখ, রাজি তো? শেষ তিনটে শব্দ আবার একটু ওকে সুড়সুড়ি দেবার জন্য৷
খোঁচাটায় একেবারেই পাত্তা না দিয়ে ওখানেই প্রায় ধেই ধেই করে নেচে ওঠে আর কি র‍্যাটান! চারিদিকে সবুজে ঘেরা তুরার ছোটো-বড়ো পাহাড়ের গায়ে সূর্যাস্তের কমলা হলুদ আলোর ঝিলিক তার চোখেমুখে৷

সন্ধেবেলায় সেই লোকটিকে রাজি করানো হল অনেক কষ্টে৷ কাল একদম ভোর ভোর বেরিয়ে পড়ব আমরা আর কালকেই সম্ভবতঃ ফিরে আসতে পারব...
তারপর আর কী! ঝড়ের বেগে কিছু দরকারি জিনিস, খাবার, টর্চ, কিছু অতিরিক্ত ব্যাটারি ইত্যাদি কিনে রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে একেবারে মাঝরাত্তির থাকতে থাকতে আমরা রেডি৷ গাড়ি মানে একটা লড়ঝড়ে জিপে উঠে বসলুম, ঘড়িতে ঠিক সাড়ে ছ'টা৷ ভোরের আলো সবে ঘুম থেকে উঠে আড়ামোড়া ভাঙছে...
র‍্যাটান ফিস ফিস করে বলল, ‘ওরে, এটা পুরো রাস্তা যেতে পারবে তো? গাড়ীর যা অবস্থা...
‘চুপ করে যা৷ দেখলি তো, অনেক কষ্টে এটা জোগাড় হয়েছে৷ রাস্তা এত খারাপ কেউ যেতেই চাইছে না৷ দেখাই যাক না কত দূর যাওয়া যায়৷ হাঁটতে যখন আপত্তি নেই, কোনও কিছুকেই ভয় নেই।’
‘হ্যাঁ৷ যা বলেছিস৷ হাঁটতে গেলে যদি দিন দুয়েক লেগেও যায়, তাতেও অসুবিধে নেই৷ বরং সুবিধে আছে,’ র‍্যাটানের মুচকি হাসি, ‘ফেরার টিকিট আর আমাদের কষ্ট করে ক্যানসেল করতে হবে না, আপনা-আপনিই ক্যানসেল হয়ে যাবে।’
দু’জনেই হো হো করে হেসে উঠলুম৷ ‘কেয়া হুয়া সাব? ড্রাইভারের ঘাবড়ে যাওয়া প্রশ্ন৷
‘নেহি, কুছ নেহি ড্রাইভারজি,’ কথা ঘোরাবার জন্য বললাম, ‘ইধর তো রাস্তা বিলকুল ঠিক হ্যায়৷ চিন্তা মৎ কিজিয়ে৷ যিতনা দূর যা সকতা চলিয়ে।’
আকাশ পরিষ্কার৷ ভোরের মিষ্টি আলো সবুজ বনানীঘেরা তুরার ছোটো-বড়ো পাহাড়গুলোকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে৷ ঠাণ্ডা নেই বললেই চলে৷ একবার থেমেছিলুম চা খেতে, ফুরফুরে হাওয়ায় ফিকে সবুজ লম্বা গাছ মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে প্রভাতসঙ্গীত গাইছে৷ কুচকুচে কালো পিচের রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে শিলং-এর দিকে৷
এরপর অনেক রাস্তা, যার শেষের দিকটা সত্যি খুব খারাপ, পেরিয়ে ওই গুহার কাছে যখন পৌঁছলুম, প্রায় দুপুর৷

একটা ছোট্টো জনপদ৷ এর কেন্দ্রে একটা ছোট্ট বাজার৷ সেখানে জামাকাপড় চাল ডাল জুতো মশলাপাতি কী নেই! খুব খিদে না পেলেও পরে কখন খাবার জুটবে বা আদৌ জুটবে কিনা, তাই একটা দোকানে ঢুকলুম ‘লাঞ্চ’ খেতে৷
টিনের চাল৷ টিনের দেওয়াল৷ বাইরে একটা কাঠের বেঞ্চ৷ স্টোভে বোধহয় চায়ের জল ফুটছে৷
‘কেয়া মিলেগা? র‍্যাটানের আর তর সইছে না৷ কোনোরকমে নাকে-মুখে কিছু গুঁজে কেভের ভেতর যেতে চায়৷
‘পরোটা অউর ঘুগনি,’ দোকানির উত্তর৷
‘দে দিজিয়ে।’ জবরদস্ত লাঞ্চের মেনু৷
গরম গরম পরোটা কতদিন পরে খাচ্ছি ঘুগনি দিয়ে৷ খাওয়া প্রায় মাঝপথে৷ ‘আণ্ডা খায়েগা? মহিলা দেখি র‍্যাটানের দিকে তাকিয়ে৷
মুখে এক গ্রাস পরোটা পুরে ওর চটজলদি উত্তর, ‘জরুর৷ দে দিজিয়ে।’

আগেই জেনেছিলুম যে গুহার ভেতরে ঢুকতে গেলে একজন লোকাল লোককে নিয়ে ঢুকতে হবে৷ কারণ এই গুহায় খুব বেশি লোকজন আসে না৷ মেঘালয়ের প্রত্যন্ত কোণে পড়ে থাকা বেশ অনুন্নত এই জায়গায় শহুরে সুবিধে না থাকায় বেড়াতে যাওয়ার ম্যাপে এটা পরিচিত নাম নয় সেরকম৷ একদিক থেকে ভালোই৷ ট্যুরিস্টদের উৎপাত থেকে রেহাই৷
গুহার ভেতর থেকে নাকি এক নদী বেরিয়ে আসছে৷ তাই এখানে ঢুকে পড়লে ভিজে জাব হয়ে যেতে হবে প্রথম থেকেই৷ তারপর কত দূর যেতে পারব, সেটা নির্ভর করছে আমাদের গাইড কতটা নিয়ে যাবে আর আমরা কতটা যেতে পারব ওই ঠাণ্ডা জলের স্রোত ভেঙে...
গুহায় ঢোকার পথটি বড়ো চমৎকার৷ কয়েকটা সিঁড়ি দিয়ে উঠে শান বাঁধানো সরু রাস্তা পেরিয়ে আবার কয়েকটা সিঁড়ি নেমে গুহার প্রবেশপথ৷ ঢোকার ঠিক মুখেই ওপর থেকে এক ঝিরঝিরে জলের ধারা জলপ্রপাতের মতো এসে আমাদের অল্প ভিজিয়ে দিল৷ ভাবটা এমন – ‘এসেছ বাছারা, এইবার দ্যাখো, কেমন ভিজে ভিজে গুহার ভেতরে ঘুরে বেড়াতে পার...
তখনও জানি না আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে ভেতরে! ভয়? না ভয় একদমই নেই, কিন্তু উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপছে রীতিমতো৷
গুহায় ঢোকার মুখ বেশ চওড়া৷ একটা ক্ষীণ জলধারা বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে৷ ভাগ্যিস হাফ প্যান্ট এনেছিলুম, পরে বোঝা গেল তাতে কিছু যায় আসে না৷
গুহার ভেতরে এখন আমরা তিনজন৷ সোজা হেঁটে গিয়ে বাঁ দিকে ঘুরতেই চমকে উঠলুম। এ কোথায় এসে পড়লুম? কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না!
এই গুহার ভেতরটা একদম অন্ধকার৷ এখানে আলোর প্রবেশ নিষেধ৷
তিনটে টর্চ জ্বলে উঠল৷ আমার একটা হেডল্যাম্প আছে৷ যেখানে যাই ওটাই সঙ্গে নিয়ে যাই৷ এটার সুবিধে হল যে মাথার সঙ্গে একটা ইলাস্টিক ব্যাণ্ড দিয়ে আটকানো থাকে৷ তার ফলে হাত দুটো ফাঁকা থাকে৷
টর্চের আলোয় দেখি সামনে একটা টানেল চলে গেছে৷ কত দূর জানি না, বোঝা যাচ্ছে না৷ টানেলের ভেতরে আমার কোমর অবধি জল, ওপর দিক ওলটানো বাটির মতো, আমরা চলেছি দেওয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে৷ মাঝে মাঝে পাথরের দেওয়ালে মাথা ঠুকে যায়৷
একটু পরে টানেল চওড়া হয়ে একটা বিশাল ঘরে ঢুকেছে৷ এবার সামনের নদীর ধারা পেরিয়ে অন্য পাড়ে যেতে হবে৷ একই নদী, এঁকেবেঁকে চলেছে৷ আর আমরাও চলেছি কখনও নদীর মধ্য দিয়ে, কখনও নদীর এ পাড় থেকে ও পাড়ে৷ অন্য পাড়ে যাবার সময়ে র‍্যাটান তো একবার উল্টে পড়েই গেল‍! তার সে কী আনন্দ! জামা-প্যান্ট সব ভিজে জ্যাবজ্যাবে৷
জলের স্রোত বেড়েই চলেছে৷ আসলে এখন তো বর্ষাকাল, তাই জলের পরিমাণও খুব বেশি৷ আমাদের ফুর্তি আর ধরে না...

চারিদিক অন্ধকার৷ আলোর একটা ক্ষীণতম রেখাও নেই৷ হঠাৎ কী মনে হল, ‘এই র‍্যাটান, টর্চটা নিভিয়ে দে তো।’
গাইড একটু এগিয়ে গেছে৷ সামনে একটা বাঁক নিয়ে ওকে আর দেখা যাচ্ছে না৷ যদি হারিয়ে যায়, এ জীবনে আর গুহা থেকে বেরোতে পারব বলে মনে হয় না৷ আমি আর র‍্যাটান টর্চ নিভিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লুম৷
অন্ধকার৷ ঘুটঘুট্টি মিশকালো ঘন অন্ধকার৷ এত বিশেষণের বোধহয় দরকার নেই৷ শুধু অন্ধকার বললেই তো হয়৷ এই এত বছর পরে বুঝতে পারলুম যে আমরা কোনোদিন অন্ধকার দেখিনি৷ তাই বলি - অমাবস্যার অন্ধকার, আবছা অন্ধকার, ঘুটঘুট্টি বা ঘন অন্ধকার৷ যে কোনও অন্ধকারের মধ্যে একটা আলোর বিন্দু অন্তত থাকেই, বা আলো-আঁধারির এক হালকা খেলা৷ কিন্তু আজ এই তুরার গুহার অভ্যন্তরে এ কী উপলব্ধি! এ রকম তো কোনোদিন দেখিনি বা বুঝিনি, দেশবিদেশে এত জায়গা ঘুরেও...
যখন টর্চ নিভিয়েছিলুম, আমরা হাত ধরে ছিলুম যাতে কোনোভাবে হারিয়ে না যাই; হয়তো মনের কোণে এক না জানা কোনও ভয় ছিল৷ এখন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আমরা৷ হাত ছেড়ে দিলুম৷ আমি একা৷
গুহায় আমি একা৷ এই গুহার ভেতর থেকে জলের ধারা, এক চঞ্চলা নদী বেরিয়ে আসছে৷ স্রোতের তোড় বেশ ভালোই৷ বর্ষায় তার উচ্ছলতা আরও বেড়েছে৷ অন্ধকারে সে আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে৷ প্রায় কোমর সমান জল৷ কখনও ঢেউ-এর নাচন আমার বুক পর্যন্ত ভিজিয়ে দিচ্ছে৷ কালো রং যে কেমন সেটা এখন বুঝতে পারছি৷
সত্যি কি বুঝতে পারছি? শুনেছি সব রং যেখানে একেবারে মিলে যায় সেটাই কালো৷ এখানে রং কোথায়? আলোই বা কোথায়? আলো যদি নাই থাকে সব রঙের আলো মিশবে কী করে? তাহলে কি আলো না থাকাই হল কালো রং?
অন্ধকার৷ কালো অন্ধকার৷ বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলুম যাতে চোখ একটু সয়ে যায়৷ চোখ সইয়ে নেবার পরে দেখলুম অন্ধকার একই রকম আছে৷ এটাই কি তবে রাত্রি? কিন্তু এই অন্ধকার কি পৃথিবীর বুকে কোথাও দেখা যায়? আচ্ছা, পদার্থবিদ্যার জ্ঞান বলে যে আলো না পড়লে কোনও জিনিস দেখা যায় না৷ তাহলে অন্ধকার দেখব কেমন করে? তা হলে কি এই না-দেখাটাই এক ধরণের দেখা?
সে কী রকম দেখা? সেটাই কি অন্তর্দৃষ্টি? জানি না৷ দার্শনিকদের এই সব গূঢ় তত্ত্ব আমি বুঝি না৷ কিন্তু আজ যা উপলব্ধি করছি সেটা কী?
জানি না৷ কিছু বুঝছি না৷ বোঝার কি সত্যি দরকার আছে? থাক না কিছু না বোঝা কথা৷ দেখা না-দেখার মাঝখানের কোনও স্তরে যদি আমার মন ভেসে বেড়াতে চায়, তাকে বাধা দেওয়ার দরকার কী? সেই কালো নিঃসীম অন্ধকারে, গহনরাত্রির মাঝে আমি বিলীন হয়ে যাচ্ছি...

এখন কিন্তু আমি ‘রাত্রি’ নিয়ে রচনা লিখতে পারব৷
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল

1 comment:

  1. আহা! আবার কবে যাচ্ছেন?

    ReplyDelete