কিডল কমিকসের কিছু কথা
কৌশিক মজুমদার
নিউজপেপার
থেকে বই আকারে কমিক্স প্রথম আত্মপ্রকাশ করল ১৯৩০-এর
দশকে। সে সব বইয়ের টার্গেট অডিয়েন্স ছিল সাত থেকে সতেরো বছর বয়েসি শিশু-কিশোররাই। পাতলা, বাজে
রঙিন কাগজে ছাপানো সে সব বইয়ের দাম হত পাঁচ থেকে দশ সেন্ট। মার্কিন
বাবা-মায়েদের যে কমিক্সের উপর দারুণ কিছু শ্রদ্ধা ছিল, তা
নয়। তাঁরা কমিক্সকে জঞ্জালই ভাবতেন। খুব
প্রগতিশীলরা বড়োজোর ভাবতেন, ‘থাক না। ক্ষতি
তো কিছু করছে না!’
কমিক্সকে সাহিত্যের পদবাচ্য ভাবার কোনও সুযোগই ছিল না। তিরিশের
দশকের মাঝামাঝি যে সব কমিক্স বই প্রকাশ পেত, তার
অধিকাংশই ছিল দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত কমিক্সের সংকলন। তবু
শিশুমহলে তাদের জনপ্রিয়তা ছিল দেখার মতো। ‘ফেমাস ফানিস’ বা ‘পপুলার
কমিক্স’ নামের এই সংগ্রহগুলো পত্রিকার স্ট্যান্ডে আসতে না আসতেই শেষ হয়ে
যেত নিমেষে। কিন্তু সমস্যা বাধল দুই জায়গায় – একে
তো নিউজপেপার সিন্ডিকেট নিজেদের কমিক্সের স্বত্ব দিতে প্রচুর টাকা হাঁকতে লাগলেন, আর
তার চেয়েও বড়ো কথা নতুন সিরিজ বা স্ট্রিপের টান পড়ল। ফলে
কমিক্স প্রকাশকরা শুধুমাত্র বইতে আঁকানোর জন্য দুঃস্থ প্রতিভাবান শিল্পী এমনকি টিন-এজারদেরও
ভাড়া করতে লাগলেন। লাগসই গল্প পাবার জন্য বেছে নেওয়া হল তখনকার নানা রগরগে পাল্প ফিকশনকে। ১৯৩৮
সাল পর্যন্ত কমিক্স বইয়ের বাজার একচেটিয়াভাবে শাসন করত ‘ডিটেকটিভ
কমিক্স’ কিংবা ‘ওয়েস্টার্ন পিকচার
স্টোরি’–র মতো কমিক্স বইয়েরা। বড়োদের কমিক্স
বলতে আলাদা কিছু ছিল না। যা ছিল, তা
হল সেই অশ্লীল ছবিতে ভরপুর ‘তিয়ুয়ানা বাইবেল’। বিখ্যাত
ব্যক্তিদের যৌন জীবনের কার্টুনধর্মী ছবি – মহাত্মা গান্ধী
থেকে চার্লি চ্যাপলিন, কাউকেই রেয়াত করা হত না। বাদ
পড়েনি মিকি মাউসও।
এভাবে আর কতদিন চলত বলা মুশকিল। কিন্তু সব হিসেব উলটোপালটা করে দিল ক্লিভল্যান্ডের সায়েন্স ফিকশনপ্রেমী দুই
কিশোর। সব নিউজপেপার সিন্ডিকেট যখন তাঁদের পাত্তাও দিল না, তখন জেরি সিগেল ও জো সুস্টার নামের দুই
টিন-এজার সরাসরি তাঁদের সৃষ্টি নিয়ে এলেন কমিক্স বইতে। অ্যাকশন কমিক্সের প্রথম সংখ্যায় সুপারম্যানের আবির্ভাব এক কথায় বৈপ্লবিক। এক ঝটকায় গোটা কমিক্স মাধ্যমটিকে সাবালক করে দিলেন সুপারম্যান। শুধু সুপারহিরো ঘরানাই নয়, অন্য সব ঘরানা পুষ্ট হল সুপারম্যানের তীব্র অভিঘাতে। সত্যি বলতে কি, কমিক্স বই হল প্রথম এক বিশাল ইন্ডাস্ট্রি বা মাধ্যম যে মাধ্যমের
মূল ক্রেতা বা উপভোক্তা হল শিশুরা।
শুধুমাত্র শিশুদের জন্য আগে বা পরে অন্য কোনও মাধ্যম এতটা নিবেদিতপ্রাণ হয়নি। কমিক্স শিশুদের মগ্ন চৈতন্যকে ভয়ানক নাড়া দিল - ঠিক
যেমন অনেক পরে গোটা বিশ্বের যুব সমাজকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল রক অ্যান্ড রোল। খুব স্বাভাবিকভাবেই বড়োরা ব্যাপারটাকে ভালোভাবে নিলেন
না। মোড়ল টাইপের মানুষ দেশে দেশে কালে
কালে উপস্থিত। তাঁরা বিধান দিলেন এসব সস্তা চটুল বই
যার নায়ক ডোনাল্ড ডাক কিংবা বাগস বানি-র মতো বিচিত্র প্রাণীরা, শিশুদের
বিন্দুমাত্র উন্নতিতে অপারগ।
ফলে ১৯৫৪-তে রীতিমতো সেনেট আইন পাশ হল।
কমিক বুক অ্যান্ড জুভেনাইল ডেলিনকোয়েন্সি-তে আসামি সোপর্দ হয়ে কমিক্স বই পুড়িয়ে
ফেলার নির্দেশ এল। আমেরিকায় নানা জায়গায় বড়োরা ন্যাড়া
পোড়ার মতো করে বন ফায়ার বানিয়ে দিব্যি উৎসাহে কমিক্স বই পোড়ালেন। ১৯৫৩ সালে যেখানে প্রায় সাড়ে ছশো-রও বেশি কমিক্স বই
নিয়মিত প্রকাশ পেত, যার মাসিক বিক্রি ছিল সত্তর লক্ষ থেকে এক কোটি – ১৯৫৫-তেই তার
প্রায় অর্ধেক কমিক্স বই এই ফতোয়ার ফলে বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। ষাটের দশকে কমিক্স বইতে বৈচিত্র্য দারুণ কিছু ছিল না। তখন কমিক্স কোড অথরিটির রমরমা। তাঁদের কড়া নজর এড়িয়ে পাতাটিও নড়বার জো নেই, চুমু না,
ঠোঁটের ক্লোজ আপ না, হাঁটু না... না, আর না। এদের পাল্লায় পড়ে বেচারা সুপারম্যানের সেই বিখ্যাত চোখ মারা বন্ধ হয়ে গেল। ব্যাটম্যান আর জোকার শিশুদের মতো চু-কিতকিত খেলতে
লাগলেন। ইতিমধ্যে বাজারে টেলিভিশন এসে
কিশোরদের কমিক্সের বাজারটাই নষ্ট করে দিল।
সেই ভাঙা বাজারে একমাত্র টিকে রইল শিশুপাঠ্য কমিক্স,
যাকে ‘কিডল কমিক্স’ বলে। পাতায় পাতায়
কথা না বলা হাঁস, দুষ্টু বেড়াল, বদমাশ কাঠবিড়ালিরা দাপিয়ে বেড়াত। মজার কথা, আজকের কমিক্সপ্রেমী পাঠক গবেষকরাও কিন্তু সে
সব কমিক্সকে খুব একটা দরের মনে করেন না। কার্ল বার্কের ডাক টেলসের আঙ্কল স্ক্রুজ, জন স্ট্যানলির লিটল লুলু আর টাবি
কিংবা ওয়াল্ট কেলির পোগো-কে মিলারের সিন সিটি, ডার্ক নাইট কিংবা স্পিগেলমানের
মাউসের পাশে বসানোর কথা কেউ ভাবতেই পারেন না। কিন্তু এসব শিশুতোষ কমিক্সের প্রভাব যথেষ্ট গভীর। সে-গভীরতা আমাদের চিন্তার বাইরে। ম্যাড ম্যাগাজিন কিংবা জ্যাক কার্বির কমিক্সগুলোর
থেকেও ষাটের দশকের এই কমিক্সদের প্রভাব পরবর্তী কমিক্স আঁকিয়েদের ওপর বেশি পড়েছে। আন্ডারগ্রাউন্ড কমিক্সে এসব চরিত্রদের প্রভাব তো বলে
শেষ করা যায় না। মিকি মাউসের কথা তো আগেই বলেছি,
কিন্তু ক-জন খেয়াল করি জেফ স্মিথের ‘বোন’ কমিক্সের তিন ‘বোন’ প্রায় হুবহু ওয়াল্ট
কেলির পোগো-র খুড়তুতো ভাই? কিংবা আর্ট স্পিগেলমানের ‘মাউস’ পড়তে গিয়ে ভ্লাদেকের
চশমা যে আসলে আঙ্কল স্ক্রুজের চোখ থেকে খুলে নেওয়া, সেটাই-বা কতজন লক্ষ করি? তবে
আদর্শ মানুষ বলে কিছু যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সম্ভব নয় আদর্শ শিশু কমিক্স নামের কোন
চিজ। এমন কোনও কমিক্স বানানো আদৌ সম্ভব
না, যা সব বয়সি শিশুদের জন্যে।
অবশ্য সব বয়সি শিশু একটা কথার কথা।
এক বয়সে শিশু কিছুদিন থাকে, তারপর পরের বয়সে পাড়ি দেয়। একমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেই সব বয়সের শিশু লুকিয়ে
থাকতে পারে। আর ঠিক তাই এসব শিশুতোষ কমিক্সের
পাতা ওলটানো মাত্র আমরা ঠিক সেই বয়সটায় চলে যাই, যে বয়সে কমিক্সটি আমার মন জয়
করেছিল।
মার্কিন কমিক্সের ক্ষেত্রে আদর্শ শিশুপাঠ্য কমিক্সের
স্রষ্টা অনেকেই ছিলেন। কিন্তু
শুধুমাত্র শিশু কমিক্সকে নিয়ে ভাবলে যে চারজন মহীরুহের কথা বলতেই হয়, তাঁরা হলেন
সেলডন মেয়ার, ওয়াল্ট কেলি, জন স্ট্যানলি এবং যার নাম না করলেই নয়, সেই কার্ল বার্ক। কমিক্সের মাধ্যমে শৈশবকে রঙিন করে তুলেছিলেন এঁরা। প্রত্যেকেই ছিলেন একাধারে গল্পকার ও আঁকিয়ে। ফলে কমিক্স মাধ্যমটির সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ করতে সমর্থ
হয়েছিলেন তাঁরা। প্রসঙ্গত জানাই, ঠিক এই ধরনের সুবিধা
ছিল বাংলায় নারায়ণ দেবনাথ কিংবা হিন্দিতে প্রাণ-এর কাছে। গোটা কমিক্সের স্কেচ থেকে ডায়ালগ বা কালারিং অথবা
লেটারিং গোটাটাই একহাতে করায় ফিনিশড কমিক্স যে এক অসাধারণ সামঞ্জস্য পেত, তা বলাই
বাহুল্য। খেয়াল করলে দেখা যাবে প্রতিটি কমিক্সেই
কিছু মিল ছিল। সে-মিল বিষয়ের মিল নয়, গঠন ভঙ্গির
মিল। ঝকঝকে রংচঙা ছবি, ছোটো কিন্তু
দুর্দান্ত এক গল্প, অ্যাডভেঞ্চারের ছোঁয়া, মজার দৃশ্য আর সবচেয়ে বড়ো কথা লোভ,
চাহিদা, ভালোবাসা ইত্যাদি নানা অনুভূতি নিয়ে একেবারে শিশুদের মতো করে তাদের ঠিক পথ
দেখানো।
সেলডন মেয়ারকে আজ খুব কম কমিক্সপ্রেমীই চিনি। বাকিদের কাছে তিনি তো একরকম অজ্ঞাতই। কিন্তু বিশ্ববাসীর মেয়ারের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিত
অন্তত এই কারণে, যে গোটা পনেরো বার যখন সিগেল-সুস্টারের কমিক্স নাকচ করা হয়েছিল,
তখন এই মেয়ার-ই অ্যাকশন কমিক্সের সম্পাদক ভিন সুলিভ্যানের কাছে বার বার
ঘ্যানঘ্যান করতেন একে কমিক্স করার জন্য। মেয়ার না থাকলে সুপারম্যান আদৌ দিনের মুখ দেখত কি না কে জানে! তাঁর নিজের
করা প্রথম বিখ্যাত সিরিজ Scribbly, যা একেবারে প্রথম দিকের একটি সিরিজ যেটা দৈনিক পত্রিকা নয়, সরাসরি কমিক
বুকের জন্য আঁকা। বিষয়টা
অদ্ভুত। নিউইয়র্কের এক হা-ঘরে ছেলের
কার্টুনিস্ট হবার স্বপ্ন পূরণ।
একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যাবে, এ গল্প আসলে এক আত্মজীবনী। কমিক্সের প্যানেলে প্যানেলে মেয়ার আসলে নিজের
সংগ্রামের কথাই লিখে গেছেন, অনেক পরে স্পিগেলমানের মাউস, সত্রাপির পার্সেপলিস কিংবা
আরিতাবার আর্ট অব ফ্লাইং যে কমিক্স মাধ্যমে আত্মজীবনীর ঘরানা চালু করবে, তার
সূচনা কিন্তু মেয়ার করে দিয়েছিলেন সেই ১৯৩৯ সালে। প্রথম দিকে All American Comics-এ স্ক্রিবলি ও লাল টর্নেডো নিয়ে একের পর
এক কমিক্স বানানোর পর, চল্লিশের দশকে মেয়ার শুরু করলেন সেই সিরিজ, যা তাকে তখন
জনপ্রিয়তার শীর্ষে তুলে দেয়।
ফানি অ্যানিম্যাল শীর্ষক বইগুলোর মধ্যে Funny Stuff, Animal Antics, Funny Folks - শিশুদের হাতে
হাতে ঘুরতে থাকে। তিনটি
ইঁদুরকে নিয়ে তিনি কমিক্স লেখেন।
নাম The Three Mouse Keteers. এ ছাড়াও Sugar and Spike কিংবা J. Rufus
Lion-এর গপ্প মজার কমিক্সকে অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল। শেষের স্ট্রিপটিতে খুব সচেতনভাবে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল
কমিক্সের ফোর্থ ওয়াল এবং স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, পরবর্তীকালে MAD ম্যাগাজিনের আঁকিয়েরা মেয়ারকেই সরাসরি
অনুসরণ করেছিল। মেয়ারের
ছবির আরও একটা মজা ছিল, মেয়ারের সবকটা প্যানেল ছিল একেবারে শিশুদের eye level থেকে দেখা। ফলে অনেক আপাত তুচ্ছ জিনিস, যেমন খাটের পায়া, গাম বুট -
দেখা যেত ডিটেলিং-এ। আর বড়োরা
উপস্থিত থাকলেও তাঁদের ঘাড়ের ওপরটা কেটে যেত প্যানেলের ডগায় - ফলে বড়ো আর বুড়োদের
মাথা দেখা যেত না। টম অ্যান্ড জেরি, লুনি টুনস কিংবা
ডিজনির ছোটোদের সিনেমাতেও এই কায়দা বহুবার নকল করা হয়েছে। এ যেন সরাসরি বড়োদের বলে দেওয়া - ‘এ একান্ত আমাদের জগৎ। এতে বড়োদের প্রবেশ নিষেধ।’
বাচ্চা বড়োদের এই যে দুই জগৎ, তাঁদের মেলানোর চেষ্টা
প্রথম করেন ওয়াল্ট কেলি। তাঁর
রূপকথার কমিক্স ‘Prince Robin
and the Dwarfs’ এক অদ্ভুত জাদু জগতের সন্ধান দেয়। রাজপুত্র রবিনের বামন বন্ধুরা তাঁর ইচ্ছেমতো তাঁকে আবার
ছোটো বামন বানিয়ে দেন। তাও রবিন
বড়ো বড়ো দৈত্যদের যুদ্ধে হারিয়ে তাঁর বাবার কাছে প্রমাণ করেন উচ্চতাই সব কিছু নয়। তবে কেলি ১৯৪০-৫০-এর দশকে দারুণ জনপ্রিয় হন ওয়েস্টার্ন
পাবলিশিং-এর ডেল কমিক্স-এর হয়ে মাদার গুজ রাইমস আর রূপকথাকে কমিক্সের রূপ দিয়ে। এ কাজ করতে গিয়ে উনবিংশ ও বিংশ শতকের রূপকথার
ইলাস্ট্রেশন করে যারা বিখ্যাত, যেমন আর্থার র্যাখাম, এডমন্ড ডিউলাক, ওয়ারউইক গবেল,
ওয়াল্টার কেন বা গুস্তাভ ডোরের চিত্র শৈলীকে অবলম্বন করেছিলেন কেলি। অনেকেই হয়তো জানি না, ডিজনির কালজয়ী সব সিনেমা, যেমন
স্নো-হোয়াইট, পিনোচ্চিও বা ফ্যান্টাসিয়া-র অধিকাংশ ছবিই ওয়াল্ট কেলির আঁকা। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত হয় কেলির সব থেকে বিখ্যাত সিরিজ
পোগো। Animal Comics নামে কমিক্স বই সিরিজে সরাসরি প্রকাশ পেয়েছিল
এটি। শুরুতে কিন্তু এই ওপাসামটিকে নিয়ে
কমিক্স ফাঁদার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না তাঁর। ১৯৪১ নাগাদ কেলি ‘Albert takes the cake’ নামে একটি কমিক্স লেখেন যাতে নায়ক
বোম্বাজিন নামে এক নিগ্রো বালক, যার সঙ্গী পোগো নামের ওপাসামটি। আলবার্ট আসলে এক কুমিরের নাম। কিন্তু বছরখানেকের মধ্যেই পোগো ছাড়িয়ে গেল বোম্বাজিনের
জনপ্রিয়তা। কেলিও দেখলেন মানুষের থেকে
জানোয়ারদের নিয়ে কাজ করতেই অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ তিনি। তাই একেবারে পার্শ্বচরিত্র থেকে নায়কে পরিণত হল পোগো। কমিক্সে অবশ্য এমন ঘটনা আরও ঘটেছে। আর্নি বুশমিলারের ফ্রিৎসি রিৎজ স্ট্রিপে থাকা
পার্শ্বচরিত্র ন্যানসি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে যায়, যে মূল স্ট্রিপটি বন্ধ করে ন্যানসির
নামে নতুন স্ট্রিপ চালু করতে হয়েছিল।
শিশু কমিক্সে ‘Funny Animal’-দের প্রভাব বলে শেষ করা যাবে না। শিশুরা স্বাভাবিকভাবেই পশুপাখিদের মানুষের মতো বা Animomorph দেখতে পছন্দ করে। মিকি মাউস নিজে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। তাই কেলি ছাড়াও ড্যান নুনান, উডি গেলমান, ড্যান গর্ডনরা
নানা বিচিত্র ও মজার প্রাণীদের কীর্তিকলাপ এঁকে শিশুদের মন জয় করতেন। তবে তাঁদের সেরা যিনি ছিলেন, তিনি নিঃসন্দেহে কার্ল
বার্ক। বার্কের জীবন বড়ো অদ্ভুত, জীবনের
শুরুতে চেরাই কলে কাজ, রঙের মিস্তিরির কাজ, খচ্চর চালক, কাউবয় - এমন নানা কাজ করে
বছর তিরিশ বয়সে ডিজনি স্টুডিয়োতে ডাক পান। প্রথমে তিনি ছিলেন অ্যানিমেটর।
পরে ডোনাল্ড ডাকের সব গল্পের স্টোরি আর্টিস্ট। ১৯৪২ সালে ডিজনির চাকরি ছেড়ে দিলেন বার্ক। তখন ডোনাল্ড ডাক কমিক্সের স্বত্ব ছিল ওয়ারেন
পাবলিশিং-এর হাতে। তাদের হয়ে পরবর্তী তিরিশ বছর ডোনাল্ড
ডাক সিরিজের সমস্ত কমিক্স একা হাতে সৃষ্টি করতেন বার্ক। তাঁর নামই হয়ে গেছিল, ‘Duck Man’. এই কমিক্স আঁকতে গিয়েই গল্প ও
চরিত্রের প্রয়োজনে ডোনাল্ড ছাড়া আরও কিছু স্থান ও চরিত্রের আমদানি করলেন তিনি। Duckberg নামে এক বিশাল শহরে সব হাঁসেদের বাস। এদের মধ্যেই আছেন আঙ্কল স্ক্রুজ নামের কৃপণ বড়োলোক থুড়ি
বড়ো হাঁসটি। আছেন গ্ল্যাডস্টোন গ্যান্ডার, গাইরো
গিয়ারলুজ কিংবা ম্যাজিকা ডি স্পেল।
এমনকি ডোনাল্ড চরিত্রটিরও আগাপাশতলা পরিবর্তন করলেন বার্ক। ডিজনির ডোনাল্ড চরিত্রটির কাজই ছিল ঝামেলা বাধানো,
অকারণে চিৎকার করা কিংবা অনর্থক পাগলামো। বার্কের হাতে এসে ডোনাল্ডের দায়িত্ব বাড়ল। তাঁর বাড়িতে তিন নতুন সদস্য, তিন ভাইপো (নাকি ভাগনে)
হুই, ডুই আর লুই। আগে ডোনাল্ড যেসব অপকীর্তি করত, সে সব
এখন এরাই করে। বেচারা ডোনাল্ড তাদের সামলাতে
সামলাতে নাজেহাল হয়ে যায়। তাঁর দীর্ঘ
কমিক্স জীবনে বার্ক একটা অদ্ভুত পরীক্ষা শুরু করলেন। তাঁর সেই হাঁসেদের নায়ক রেখেই বলে যেতে থাকলেন জ্যাক
লন্ডন, রবার্ট লুই স্টিভেনসন, জুলে ভার্নের ক্লাসিক গল্পগুলো - একেবারে নিজের মতো
করে। তাঁর কমিক্সে ফিরে ফিরে আসত নানা
অজানা তথ্য, ইতিহাসের কথা, পৌরাণিক কাহিনি। থ্রিলার আর মজার এই অদ্ভুত ককটেলটা বার্কের মতো খুব কমই বানাতে পেরেছেন
অন্যরা। ফলে বার্কের ডাক টেলস যে কোনও
শিশুপাঠ্য বই বা সিনেমার থেকে বেশি উপযোগী ছিল। বিভিন্ন দেশ বা ঐতিহাসিক স্থান-কাল-পাত্রের ডিটেলিং-এ
বার্ক একেবারে নিখুঁত ছিলেন।
ফলে গল্পের সঙ্গে সঙ্গে কোনও স্থান বা দেশের রীতিনীতি পোশাক-আশাক, খাওয়া-দাওয়া
সম্পর্কেও শিশুদের স্পষ্ট ধারণা হয়ে যেত। দুঃখের বিষয়, এত সত্ত্বেও খোদ মার্কিন মুলুকেও বার্ক এখনও তাঁর যোগ্য
সম্মান বা কমিক্স মাধ্যমে এই হিমালয়ান্তিক অবদানের স্বীকৃতি পান না। এখনও লোকে তাঁকে জানে শুধুই এক ‘Good duck artist’ হিসেবে।
জন স্ট্যানলি আরও এক অবহেলিত শিল্পী, জীবনের শুরুতে বহু
কমিক্স তিনি বেনামে এঁকেছেন।
অন্যের সৃষ্টি করা চরিত্র, যেমন উডি উডপেকার, বেগেডি অ্যান, ন্যানসি-র শয়ে শয়ে
প্যানেল আঁকতেন তিনি। শুধুমাত্র
পেটের দায়ে। তবে তাঁকে বিখ্যাত করেছিল ১৯৪৫ সালে
ছোটোদের জন্য আঁকা কমিক্স সিরিজ ‘লিটল লুলু’। এই চরিত্রটিও কিন্তু স্ট্যানলির সৃষ্টি নয়। ১৯৩৫ সালে মারজোরি হেনডারসন বুরেল বিখ্যাত The Saturday Evening Post-এর পাতায়
সিঙ্গল প্যানেল স্ট্রিপ কার্টুন হিসেবে লুলুকে আঁকেন। ছবিটি চমৎকার। একটি বিয়ের আসরে ফুল ছড়াতে ছড়াতে লুলুর যাবার কথা। কিন্তু ফুল না ছড়িয়ে সে ছড়াচ্ছে কলার খোসা। ফলে কনে আর তাঁর বান্ধবীরা চিতপটাং। এই লুলুর আগে সে-জায়গায় নিয়মিত যার কাণ্ডকারখানা বেরোত,
সে-ও আমাদের চেনা। তার নাম হেনরি। বাংলায় যাকে আমরা গাবলু নামে চিনি। জন স্ট্যানলি কমিক্স বইয়ের জন্য লুলুকে নতুন করে
আঁকলেন। তার মধ্যে বেশ একটা ফেমিনিস্ট ভাবও
যোগ হল। ছোটো ছোটো স্ল্যাপস্টিক গ্যাগ আর
মজার এলিমেন্ট মিশিয়ে লুলুকে গড়ে তোলা হল। লুলু প্রায়ই ঢুকে পড়ে ‘No
Girls Allowed’ নামে ছেলেদের ক্লাবে, আর নানান বিপত্তি ঘটায়। পরবর্তীকালে মেলভিন মনস্টার নামেও একটি চরিত্র
বানিয়েছিলেন স্ট্যানলি। শিশুদের হেয়
করাকে নিয়ে মজার মোড়কে স্ট্যানলি যে গল্প শুনিয়েছেন, তার তুলনা হতে পারে একমাত্র
রোয়াল ডালের বিখ্যাত ছোটোগল্পগুলি।
কমিক্স মাধ্যমে এ এক অনন্য সৃষ্টি।
নানা দুষ্টুমিতে ন্যানসি ও লুলুর সমকক্ষ (কিংবা হয়তো
একটু বেশি) হতে পারে ডেনিস দ্য মেনেস।
হাঙ্ক কেচাম নিজের ছেলের আদলে তৈরি করেছিলেন চরিত্রটিকে। প্রথম দিকে সিঙ্গল প্যানেল কমিক্স হিসেবে প্রকাশিত
হলেও পরে আল ওয়াইজমান আর ফ্রেড টুলের হাতে পড়ে নিয়মিত কমিক্স বই আকারে প্রকাশ পেত
ডেনিস। এখানে একটা জিনিস খেয়াল করার মতো। লুলু, ডেনিস বা ন্যানসি (কিংবা আরও পরে কেলভিন অ্যান্ড
হবস, অথবা হাঁদা-ভোঁদা) আমাদের যে পরিবেশের ছবি দেখায়, তাতে অদ্ভুত এক দ্বৈত সত্তা
আছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় এ যেন আমাদের চেনা
পাড়া। কিন্তু নিবিড় পর্যবেক্ষণে পরিষ্কার
বোঝা যায়, কোন পাড়াই হাঁদা ভোঁদার পাড়া হতে পারে না - আবার সব পাড়াই আসলে হাঁদা
ভোঁদার পাড়া। এই যে চেনা পরিবেশে ইউটোপিয়া সৃষ্টি,
এই যে অদ্ভুত এক জাদু বাস্তবতার ছোঁয়া - তা কমিক্স ছাড়া অন্য কোনও মাধ্যমে এভাবে
সম্ভব নয়। অন্তত শিশুদের জন্য তো নয়ই।
কিন্তু সেকথা বড়োদের কে বোঝাবে? যখন কমিক্স কোড অথরিটি
কমিক্সের শ্বাসরুদ্ধ করতে উঠে পড়ে লাগল তখন ডেল কমিক্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট হেলেন
মেয়ার কমিক্স কোডের স্ট্যাম্পকে রেয়াত না করে প্রতি সংখ্যায় বাবা-মায়েদের উদ্দেশে
একটি নোটিশ জারি করল। নোটিশ না
বলে আবেদন বলা ভালো। তাতে
পরিষ্কার লেখা থাকত ‘Dell Comics
are Good Comics’. কথা এবং কাজ এক করার জন্য বিখ্যাত সব আঁকিয়ে,
শিশু মনস্তাত্ত্বিকদের ভাড়া করল ডেল। এর আগে অবধি শিশুদেরও যে আলাদা জগৎ হতে পারে তা কেউ ভাবেনি। নানা জ্ঞানগর্ভ উপদেশমূলক বই দিয়ে ঠুসে দেওয়া হত তাঁদের
পাঠ্য পরিসর। কমিক্স ঠিক এই জায়গাটাকেই ধরতে
চেয়েছিল। শিক্ষার মধ্যে যে visual element থাকে, তাকে ছুঁতে গেলে
কমিক্স ছাড়া উপায়ও ছিল না।
আর শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশের জন্য প্রতিটি অনুভূতি, ভালোবাসা, কারুণ্য, দয়া, মায়া,
ভয়, রোমাঞ্চ – প্রতিটির সমান প্রয়োজন।
তা বুঝেই প্রতি বিষয়ে কমিক্স করতে শুরু করলেন স্রষ্টারা। বাস্তব, অবাস্তব, পরাবাস্তব – কোনও কিছুই আর অধরা রইল
না, বড়োরা অবাক হয়ে দেখল বড়ো আর ছোটো-র মাঝে সূক্ষ্ম তফাতটা জোর করে মুছিয়ে দিতে
হচ্ছে না। শিশুপাঠ্য নিজেই নিজেকে পরবর্তী
স্তরে নিয়ে যাচ্ছে। পাঠ যোগ্যতার বয়স চার ধরলে বয়স বাড়ার
সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের প্রিয় শিশু চরিত্রও বদলে যাচ্ছে আপনা থেকে – হেনরি, লুলু,
ডেনিস, কেলভিন হয়ে কখন সে নিজের অজান্তেই তুলে নিচ্ছে তিব্বতে টিনটিন, তা নিয়ে
বড়োদের অভি সন্দর্ভ লেখার প্রয়োজন নেই।
সাহিত্য শব্দটি আজ ব্যাপকার্থে ব্যবহৃত। যদি তা না হত, তবে শতবর্ষের সেরা উপন্যাসের তালিকায় ওয়াচমেন কিংবা
পুলিৎজার পুরস্কার প্রাপক ‘মাউস’ হত না। ঠিক তেমনই ঠাকুমার ঝুলি বা টুনটুনির বই যেমন সাহিত্যের এক
দিক নির্দেশ করে, তেমনি উটো, পিসিমা, ভজা-গজা সুদ্ধ বাঁটুল দি গ্রেটও ভিজুয়াল
সাহিত্যের এক অন্যতম প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়ায়। শিশুমন কল্পনা করতে চায়।
আর সে-কল্পনা উসকে দিতে জবাব নেই সেই প্রাণ মজানো ছবিদের। ছোটোদের ছবি তাই যতটা সম্ভব অ্যানাটমিক্যাল, বর্ণনা
যথাসম্ভব ডিটেইলড। বাঁটুল পড়েই তো আমরা প্রথম প্যাটন
ট্যাঙ্ক কেমন হবে জানতে পেরেছি কিংবা ভোঁদার হাতেই প্রথম দেখেছি লন মোয়ার। সাহিত্যের কাজ যদি শিশুমনকে আলোকিত করা হয়, তবে সে-কাজ
কমিক্সের মতো সাফল্যের সঙ্গে খুব কম মাধ্যমই করেছে। টিভি বা সিনেমায় হয়তো visual element-টা থাকে কিন্তু সেটা
সেইখানেই শেষ। তাকে
অবলম্বন করে যে কল্পনার উড়ান, সে-সম্ভাবনার বীজটুকু কমিক্সেই প্রোথিত... ফেসবুক কী বলল না বলল কী এসে গেল তাতে?
_____
শীর্ষচিত্রঃ কার্ল বার্কস, অন্য
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment