অ্যাবি জলপ্রপাত |
ভরা বর্ষায় কুর্গে
দেবাদিত্য দাস
কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে বছর
দুয়েক হয়ে গেল, অথচ ঘরের পাশেই ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় হিল স্টেশন “কুর্গ” দর্শন হয়নি
এখনও, ব্যাপারটা যেন মানতে পারছিলাম না। বর্ষায় পাহাড় আরও লাস্যময়ী, আর তাছাড়া
প্রথমবার পাহাড়ি পথে গাড়ি চালানোর এক অজানা উত্তেজনা তো দোসর ছিলই। গতবছর জুলাই
মাসে একটা লং উইক এন্ড দেখে বেড়িয়ে পড়লাম “ভারতের স্কটল্যান্ড” অভিমুখে, মাঝারি
থেকে ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস উপেক্ষা করে।
কুর্গ ব্রিটিশ প্রদত্ত নাম,
আর আঞ্চলিক নাম “কোডাগু”, ব্যাঙ্গালোর থেকে প্রায় ২৭০ কিমি দূরে অবস্থিত পশ্চিমঘাট
পর্বতমালার অন্তর্গত একটি নৈসর্গিক হিল স্টেশন, যার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ “থাডিয়ানডামোল”
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫৭৪০ ফুট উচ্চতায় দণ্ডায়মান।
জাতীয় সড়ক - ২৭৫ ধরে ৩ ঘণ্টা চলার পর দাঁড়ালাম মান্ডিয়া জেলার একটি হোটেলে। ওখানকার
বিখ্যাত ঘিয়ে ভাজা মাসালা দোসা, মেড্ডু বড়া আর ধোঁয়া ওঠা সুস্বাদু ফিল্টার কফি
সহযোগে দ্রুত জলযোগ সেরে ফের রওনা দিলাম কোডাগু জেলার অন্যতম প্রধান শহর মাদিকেরির
পথে। আমাদের থাকার ব্যবস্থা ওখানেই একটি ভিলা হোটেলে। বর্ষার জলে প্রাণবন্ত হয়ে
ওঠা সবুজের সমারোহ চারিদিকে। কিছুটা রাস্তা নাগারহোল জাতীয় উদ্যানের মধ্য দিয়ে
যেতে হয়, যেখানে হঠাৎ করেই হাতি, হরিণ বা অন্য বন্য প্রাণীর দেখা পেলেও পেতে
পারেন। শেষের প্রায় ১৫ কিমি পথ ঘন সবুজের চাদরে ঢাকা পশ্চিমঘাট পর্বতের গা বেয়ে
অবশেষে এসে পৌঁছলাম হোটেলে।
অঝোর ধারায় বৃষ্টি আর তার সঙ্গে
তুমুল ঝোড়ো হাওয়ায় পাহাড়ি গাছগুলো দিশেহারা। ঘন মেঘে আচ্ছন্ন পাহাড়, এতটাই নীচে
মেঘ যা প্রকৃতই শরীর দিয়ে অনুভব করা যায়। ইতস্তত পাহাড়ের গা বেয়ে বৃষ্টির জল নেমে
যাচ্ছে ফল্গু ধারার মতো। হোটেলের এক কর্মচারী বলে গেলেন, গত আট দিনে সূর্যের মুখ
দেখা যায়নি।
দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল,
পাহাড়ে সন্ধ্যা এমনিতেই আগে নামে, তার উপর এই বৃষ্টিতে আর কোথাও বেরোনো সম্ভব নয়
বুঝে গরম কফিতে মনোযোগ দিলাম। সারা রাত চলল হাওয়ার প্রকান্ড দাপাদাপি আর সঙ্গে
জাঁকিয়ে ঠাণ্ডা। পরদিন সকালে অবস্থার সামান্য উন্নতি। ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির দাপট কখনও
কিছুটা কমছে আর এক ঝলক রোদ্দুর উঠে চারিপাশটাকে এক মায়াবী লোকে পরিণত করছে। সময়
নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লাম “অ্যাবি” জলপ্রপাতের দিকে। গাড়ি যেখানে থামাল সেখান থেকে
ঘন কফি বাগানের মধ্য দিয়ে প্রায় দুশো সিঁড়ি নীচে নেমে পৌঁছলাম ভিউ পয়েন্টে। ভরা
বর্ষায় কাবেরীর রুদ্ররূপ চাক্ষুষ করলাম। উদ্ধত জলরাশি প্রকান্ড আস্ফালনে আছড়ে পড়ছে
নীচে আর সেখান থেকে উঠে আসা জলের ধোঁয়াশা চারিদিক আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এ এক
অনির্বচনীয় রূপ যা শুধুমাত্র বর্ষাতেই উপলব্ধি করা যায়।
"রাজার সিট" থেকে দেখা দৃশ্য |
বৃষ্টি অবিরাম হয়েই চলেছে কম
বেশি। এবার গন্তব্য “রাজার সিট”। এটি তৎকালীন কুর্গের রাজার খাস বিশ্রাম ক্ষেত্র।
একটি মনোরম বাগানের মধ্যস্থিত বাঁধানো বসার জায়গা যেখানে বসে রাজা সপরিবারে
সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের স্বর্ণাভ আভায় স্নাত দূরের ছোটো বড়ো পাহাড়গুলির
প্রাকৃতিক শোভা পর্যবেক্ষণ করতেন। আপাতত নীল পাহাড়গুলো মুখ লুকিয়েছে ঘন পুরু মেঘের
চাদরে। ইতিমধ্যে বৃষ্টি আরও জোরালো হয়েছে, তাই অগত্যা ফিরতে হল হোটেলে। হোটেলের
ম্যানেজার বললেন, বৃষ্টির মধ্যে “থাডিয়ানডামোল”, “মন্ডালপট্টি” ইত্যাদি শৃঙ্গগুলি,
যা ট্রেকিং এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত, পর্যটকদের সুরক্ষার জন্য সে সব
পথ ইতিমধ্যেই প্রশাসন বন্ধ করে দিয়েছে। বন্ধ হয়ে
গিয়েছে “দুবারে” হস্তি শিবির যাবার পথ, যা কিছুটা নৌকায় কাবেরী নদী পেরিয়ে যেতে
হয়। এর মধ্যেই সংগ্রহ করে নিয়েছি কুর্গের বিখ্যাত কফি, হোমমেড চকোলেট আর নীলগিরির
সুপ্রসিদ্ধ মশলা পাতি। ছুটি নেই, তাই পরদিন সকালেই বেরিয়ে পড়লাম ব্যাঙ্গালোর
অভিমুখে, একরাশ ভালোলাগা আর মেঘ পিয়নের দেশে আবার ফিরে আসার ইচ্ছেবীজ বুকে নিয়ে।
"নামড্রলিং” মনাস্ট্রি |
গাড়িতেই চটজলদি সিদ্ধান্ত
নিলাম কুশলনগরে “নামড্রলিং” মনাস্ট্রি ঘুরে যাবার। সেই মতো দুপুর একটা নাগাদ এসে
পৌঁছলাম “নিংমা” সম্প্রদায়ভুক্ত তিব্বতীয় বৌদ্ধদের বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাঠশালায়
যেখানে এক সঙ্গে পাঁচ হাজারেরও বেশি “নিংমা” লামারা অধ্যয়ন করেন। সুবিশাল মূল ভবনে
রয়েছে গৌতম বুদ্ধের সুউচ্চ তিনটি স্বর্ণমুদ্রিত মূর্তি যা নিঃসন্দেহে বিষ্ময়ের
উদ্রেক করে। চার দেওয়ালে এবং ছাদে নিখুঁত কারুকার্যে গৌতম বুদ্ধের জীবন কাহিনী এবং
বাণী চিত্রিত রয়েছে যা পর্যটকদের বিষ্মিত করবেই। সেখান থেকে রওনা হলাম
ব্যাঙ্গালোরের উদ্দেশে। দু’পাশে কখনও আখের খেত, কখনও ধানের খেতকে পাশে রেখে গাড়ি ছুটে
চলল তিরবেগে মসৃণ জাতীয় সড়ক ধরে।
স্বর্ণ-মুদ্রিত বৌদ্ধ মূর্তি |
“নিংমা” সম্প্রদায়ভুক্ত এক বৌদ্ধ লামা |
আমরা ফিরে এলেও, কুর্গ ফিরে
পায়নি রোদ্দুর। তার কিছুদিনের মধ্যেই এক নাগাড়ে হতে থাকা বৃষ্টিতে যখন গোটা কেরল
ভাসছে, ঠিক সেই একই সময় কুর্গ সাক্ষী রইল ভয়াবহ পাহাড়ি ধ্বসের। বহু ঘর বাড়ি
বিপর্যস্ত, প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কিছু মানুষ, নষ্ট হয়েছে একাধিক শষ্য খেত আর কফির
বাগান। জল ধারণের উচ্চসীমা পেরিয়ে যাওয়ায় খুলে দিতে হয়েছে অধিকাংশ বাঁধ। আর সেই
জলের তোড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আশেপাশের গ্রামগুলি। যে বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে,
সেখান থেকে স্বাভাবিক জনজীবনে ফিরতে কুর্গবাসীর নিঃসন্দেহে অনেক সময় লাগবে। হয়তো
দ্বিতীয়বার যাব যখন, পালটে যাবে কুর্গের কিছু চেনা জায়গাগুলো। তবু এই মুহূর্তে
মানুষগুলোর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়তো আমাদের সহযোগিতা, প্রার্থনা আর পাশে থাকার
আশ্বাসটুকু। কুর্গ দ্রুত তার স্বমহিমায় ফিরে আসুক এই কামনাই রইল।
_____
ছবিঃ লেখক
No comments:
Post a Comment