ভৌতিক অভিজ্ঞতা
সন্দীপা সরকার
‘ভূতের রাজা দিল বর’ - উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সেই অসাধারণ লিখনশৈলীতে পুষ্ট সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় তৈরি ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমাটির কথা কার না মনে আছে। ভূতের রাজার বরে কী কান্ড কারখানাই না ঘটে গেল গুপি আর বাঘার জীবনে। একেবারে রাজার জামাই হয়ে বসল দু’জনে। এবার অনেকের মনেই এই প্রশ্ন জাগে, ভূত বলে আদৌ কিছু হয়? নাকি সবই আমাদের কল্পনাপ্রসূত মনের ভয় ভীতি থেকে গা ছমছমে ভাব! এই ভূত নিয়ে প্রচুর ছোটোদের-বড়োদের গল্পই বলুন আর সিনেমাই বলুন, তৈরি হয়েছে। হলিউড, বলিউড, টলিউড মাতিয়ে একেবারে হাউসফুল হয়ে সগৌরবে চলছে বেশ কিছু ভৌতিক সিনেমা। ভূত আসলে কী, সে ব্যাপারে আমার একান্ত নিজস্ব ব্যাখ্যা যদি বলি, তা হল - ভূত মানে অতীত। অতীতে যে ব্যক্তি একদিন জীবিত ছিলেন, বর্তমানে তাঁর আত্মার বায়বিক রূপের প্রকাশিত ভাব। আমরা সবাই জানি আত্মার ক্ষয় নেই। কোনও না কোনও রূপে তাঁর পুনর্জন্ম ঘটে। যতদিন না নতুন জন্ম ঘটছে সেটা ঘুরে বেড়ায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপঘাতে মৃত্যু হওয়া অতৃপ্ত আত্মাদের মুক্তি ঘটে না। নিজের মৃত্যুর বদলা নিতে নানারকম কান্ড করে থাকে তারা। বাস্তবে ভূত দর্শন না হলেও সিনেমা বা অন্যদের ভূত দর্শনের কাহিনি অনেকেই শুনেছি। আবার 'আনসলভড মিস্ট্রি'
হিসেবে কিছু ভৌতিক বাড়ির সন্ধানও রিপোর্টারদের ক্যামেরাবন্দি হয়েছে। সে নিয়েও বিতর্ক। কেউ বলেন, ক্যামেরায় ভূতের ছবি আসে না। কারও
দাবি আসে। সে জন্য ভূত আছে না নেই, তারও তর্ক বিতর্কের শেষ নেই।
যে ভূতের ব্যাপারে প্রত্যক্ষদর্শী, সে জানে ভূত বলে সত্যতা কিছু আছে। তেমনি একটা সত্যি ঘটনা বলি। আমার এক পিসির গ্রামে বিয়ে হয়েছিল। যখন ওখানে যেতেন রাতটা পিসির কাছে বিভীষিকা লাগত। মাঝে মাঝে মনে হত কে যেন পিসির নাম ধরে ডাকছে। বাড়ির অন্যান্য সদস্যরাও নানা কান্ডে ভূতের উৎপাতের ভুক্তভোগী ছিলেন। সেই সময় বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি গ্রামে। সন্ধে নামলে যে যার ঘরে ঢুকে পড়তেন। খুব প্রয়োজন না হলে কেউ তেমন বেরোতেন না। পুরুষরা বেরোলেও মহিলারা তো একদমই বেরোতেন না। একবার তো সন্ধেবেলা এলো চুলে বেরিয়েছিল বলে পিসির জা-কে এমন চুলের মুঠি ধরে পাক খাইয়ে ফেলেছিল, তিনদিন বাকরুদ্ধ হয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকেছেন। কলপাড়ে যেতেও ভয় পেতেন। এই গ্রামে অনেকের গায়ে আঁচড়ের দাগ পড়তে, গালে চড় মারার অনুভব পেতে দেখা গেছে। আমার পিসিরও ভূত দর্শন হয়েছিল। পিসির সম্পর্কে খুড়ি শাশুড়ি মারা গেছিলেন যেদিন, তার পরদিন সন্ধের দিকে পিসি বাড়ির সকলের জন্য রুটি বানাচ্ছিলেন। সেই সময় আর এক জা সঙ্গে ছিলেন। হঠাৎ পিসির দিকে একটা হাত এগিয়ে আসে, শাঁখা-পলা পরা। কালো পাড় শাড়ি পরা। ঘোমটা টানা। ঠিক খুড়ি শাশুড়ির মতো কাপড়। শেষ দিন যেটা ওঁর পরনে ছিল। বিধবা হওয়ার পর উনি কাউকে মুখ দেখাতেন না। রুটি খেতে খুব ভালোবাসতেন
উনি। হাত বাড়িয়ে সেই গলার আওয়াজে নাকি রুটি চেয়েছিলেন। পিসির তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া। আর পিসির জা মূর্ছা যান। বাড়ির যাঁরা দেখেননি
তাঁরা এই ঘটনার নানান ব্যাখ্যা দেন, যাঁরা শহরবাসী বিশেষত তাঁরা। যাঁরা ভূতের উপদ্রবের স্বীকার হয়েছিলেন তাঁরা আবার বিশ্বাস করেছিলেন।
এমনি আর একটি সত্যি ঘটনা বলি। আমার মামাদের মুখে শোনা। ওঁরা খুব ছোটো। আমার মামার বাড়িও গ্রামাঞ্চলে। মামার বাড়ির ঠাকুর ঘর সংলগ্ন একটা বেল গাছ ছিল। সেখানে নাকি প্রতিদিন রাত ১২টার পর পা ঝুলিয়ে ব্রহ্মদৈত্যকে বসে থাকতে দেখা যেত। কারও কোনও ক্ষতি করত না। গাছ থেকে বেল খেয়ে ভোরের আগেই মিলিয়ে যেত। আগে গ্রামের বেশির ভাগ লোকের শৌচালয় বলতে মাঠ-ঘাট ছিল। কেউ যদি রাতের বেলা বেল গাছের আশেপাশে শৌচ কর্ম করতে বসত, তাকে বেল ছুঁড়ে মারত। মামার বাড়ির সবাই এটা দেখেছেন। চোর ডাকাতরা ভয়ে মামার বাড়ির ধার ঘেঁষত না।
আরও একটি ঘটনা বলি। আমরা গল্পে পড়ি ভূতের বিয়ে। স্বাধীনতার অনেক আগের ঘটনা, আমাদের পাড়াতুতো এক কাকিমা আছেন, তাঁর ঠাকুমার মা নাকি নিজে ভূতের বিয়ে দেখেছিলেন। মাটির তৈরি কাঁচা বাড়ির পেছন দিকটা বাঁশ বাগান ছিল। সেখানে মধ্যরাতে প্রায়শই ভূত-পেত্নীর বিয়ে হত। রূপকথার গল্পের মতো লাগলেও ঘটনাটা সত্যি। উনি খুব সাহসী প্রকৃতির ছিলেন, জানলা দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ভোর অবধি তেনাদের কান্ডকারখানা দেখতেন।
আরও একটা বাস্তব অভিজ্ঞতার ঘটনাও বলি। ১৯৯৮ সাল, আমার এক দাদা অফিসের কাজে কালিম্পং গিয়েছিলেন। ওখান থেকে অফিসের গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়ে আর নিজস্ব বুকিং করা হোটেলে ফিরতে পারেননি। প্রচন্ড বৃষ্টির জন্য গাছ পড়ে রাস্তা আটকে যায়। সেইসময় ধারে কাছে কোনও হোটেল পাওয়া না গেলে একটি কটেজের গায়ে ‘হোটেল’ লেখা সাইনবোর্ড দেখে দাদা সেখানে রাতটা কাটাতে ঢোকেন। দোতলা কটেজের একতলায় দুটো ঘরের দুটোই ফাঁকা দেখে নিশ্চিন্ত হলেন। একটা ঘর বুক করলেন। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, টান টান করে বিছানা পাতা। তবে ওঁরা জানিয়ে দিল খাবারের কোনও সার্ভিস এঁদের নেই। সঙ্গে থাকা স্ন্যাক্স খেতে খেতে টিভি দেখছিলেন
দাদা। রাত দুটো বেজে যেতে টিভিসহ আলোটাও নিভিয়ে শুয়ে পড়েন, আলো জ্বললে ঘুম আসে না বলে। আলো নেভানোর মিনিট দশের মধ্যে তন্দ্রা এসেছে, এমন সময় গলায় প্রচন্ড চাপ অনুভব হতে থাকে। পাথরের মতো দুটো হাত মনে হচ্ছে ক্রমশ যেন গলাটা টিপে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করেই গলার ঠাকুরের লকেটটা চেপে ধরে ধড়মড়িয়ে উঠে দেখেন, চেয়ারে কালো কোট-প্যান্ট পরা সাদা চামড়ার দু’জন বসে কথা বলছে। কী বলছে বোঝা যাচ্ছে না। তখনও দাদা ওঁদের ভূত বলে ভাবেননি। ভেবেছিলেন কেউ ঢুকেছে চুরির উদ্দেশ্যে। ‘কে - কে আপনারা? আমার গলা টিপছিলেন কেন?’ বলাতে কানে হাসির আওয়াজের সঙ্গে ভেসে এল, ‘ডোন্ট স্লিপ এট নাইট, আদারওয়াইজ উই কিল ইউ ব্রুটালি।’ কথাগুলো
শুনে চোখটা কচলে ভালো করে দেখছেন কঙ্কালে কোট-প্যান্ট পরা। তাই এত সাদা লাগছে। দাদা তখনও ভাবছেন মানুষই হবে, মুখোশ পরা। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঘর খুলে ঢুকেছে। চোর হলে যদি পালিয়ে যায়, তাই চুপি চুপি অন্ধকারে হাতড়ে খাটের সঙ্গে লাগানো স্যুইচটা টিপে দিতেই আলো জ্বলতে দেখেন ঘর ফাঁকা। কেউ নেই। সঙ্গে সঙ্গে দরজার দিকে দেখেন সেটা যেমন বন্ধ করেছিলেন তেমনই আছে। বাইরে বেরিয়ে দেখেন রিসেপশনও ফাঁকা। নীচ তলায় কেউ নেই। ওপরে কেউ ছিল কিনা তা আর দেখেননি। ভয়ে সারা রাত টিভি আর আলো জ্বেলে কাটিয়ে পরদিন সকালে যথারীতি রিসেপশনের লোকটিকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করেন, ‘এখানে কি ভূত আছে? আর কাল রাতেই বা কোথায় ছিলেন? কাউকে দেখতে পাইনি!’ লোকটি কোনও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হিন্দিতে শুধু বললেন, রাস্তা ক্লিয়ার হয়ে গেছে, আপনি চলে যান। দাদাও অপরিচিত জায়গা দেখে কথা না বাড়িয়ে বিল মিটিয়ে অফিসের থেকে দেওয়া গাড়িটা নিয়ে হোটেলে ফিরে যান। পরে
জানতে পারেন যে ওই কটেজটা একটা কবর স্হানের ওপর বানানো ছিল। যাঁরা জানেন, তাঁরা কেউ ওখানে গিয়ে ওঠেন না। অপরিচিতরা উঠলে তাঁদেরও সাহেব-মেম ভূতের দর্শন হয়। শুধু এই কটেজটা বলে না, কালিম্পং-এর অনেক জায়গায় অনেকের ভূতের দর্শন হয়েছে।
এই যে চারটে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে শোনা ঘটনার
বর্ণনা দিলাম, এ থেকে ভূতের অস্তিত্ব একেবারে নেই বলা ভুল। আত্মা অবিনশ্বর। যতদিন না কোনও শরীর পায় নিজের পছন্দমতো, ততদিন বায়বীয় আকারে ঘুরে বেড়ায়। তার ছায়ারূপ ধরা পড়ে কারও কারও নজরে। এই নিয়ে আজও রিসার্চ চলছে। কেউ ভূতের অস্তিত্ব একেবারে নেই এটা বলতে পারেননি। বরং আছে বলেই প্রমাণিত হয়েছে। অনেক সত্যির ওপর ভর করে ভূতের সিনেমাও হয়েছে। হিন্দু-মুসলিম-খ্রীষ্টান সব ধর্মের মানুষই বিশ্বাস করেন ভূতের অস্তিত্ব। বিজ্ঞানও সাপোর্ট করছে ভূতের অস্তিত্ব আছে বলে।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
_____
ছবিঃ সুমিত রায়
No comments:
Post a Comment