বিতর্ক নয়, সত্য অলৌকিক
সংযুক্তা সেনগুপ্ত
।। ১ ।।
কীভাবে কী বলি! সেদিন পড়লাম
কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘স্কন্ধকাটা’। যতই যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা পাই, ভূত
ব্যাপারটিকে আমি অস্বীকার করতে পারি না। কারণ ২০১৫ সালের ২৬শে আগস্ট ভরা ভাদ্রে
আমি ভূতের কাজকারবার দেখেছি। একা নয়, শব্দ পেয়ে ছুটে এসে মেয়েও দেখেছে। আমরা দেখেছি
লম্বা ঠ্যাঙা পা দুপ দুপ করে ফেলে বাথরুম থেকে বেরিয়ে বারান্দার শেষ প্রান্তে গিয়ে
উত্তরদিকে ভ্যানিশ! মনে পড়লেই কেঁপে উঠি। স্পষ্ট দেখেছি, একটা জমকালো ম্যাক্সি
পরা, ম্যাক্সির ছোটো হাতা থেকে বেরিয়ে এসেছে দুটো লতপতে হাত, মাংসহীন ওই ভূতদের
মতো। একটা গামছা দিয়ে ঘোমটা টেনেছে এমনভাবে, মুখ দেখতে পাইনি। যতোটুকু পা দেখেছি,
ওই ভূতের মতো মাংসহীন, হাড় সর্বস্ব! বাপরে কী দাপট! বিশাল একটা লোহার বালতি ভরা জল
রাতে বাথরুমে থাকে। আর বাথরুমের সিমেন্টের তাকে থাকে বড়ো এক মগ ভর্তি জল,
অ্যালুমিনিয়ামের মগ। আসলে রাতে কল খুললে জল মেলে না বলে এই জল ধরে রাখার নিয়ম।
চেতলার পিয়ারিমোহন রায় রোডে প্রায় ১০০ বছরের পুরোনো শরিকি বাড়ি আমাদের। তেতলার
উত্তর-পূর্ব-দক্ষিণের একাংশ আমাদের। তখন ছিলাম হাজব্যাণ্ড, আমি আর মেয়ে বাবুই।
হাজব্যাণ্ড একা একটা ঘরে ঘুমে। ঠিক পাশের
ঘরে বাবুই, আমি। কি আশ্চর্য! তখন মাঝরাত, ঘড়ি-টড়ি দেখিনি। একটা প্রবল দুমদাম আওয়াজে
ঘুম ভাঙতে বিছানায় উঠে বসে দেখি, ছায়ামতো কে যেন বাথরুমের দিকে যায়, হাড্ডিসার
রোগা, ঢ্যাঙা! ভাবলাম, চ্যাঁচাই ‘চোওওর’ বলে। ও বাবা, শব্দ বেরোলো না গলা দিয়ে।
মুহূর্তে শুনি, বাথরুম থেকে ঝপাং ঝপ জলের শব্দ! কে রে বাবা? পায়রা নাকি? ওহো, বলতে
ভুলেই গেছি, পায়রা আমাদের সবসময়ের কাজের মানুষ। সে দোতলার রান্নাঘরের পাশে যে ছোটো
ঘর, সেখানে থাকে ভোঁদার মায়ের সঙ্গে। ভোঁদার মা জা-দেওরের সবসময়ের কাজের মানুষ। সে
যা হোক, জলের আওয়াজে ভেবেছি আমারই চোখের ভুল। নির্ঘাৎ পায়রা, ঠ্যাঙা-লম্বা কেউ না!
উঠে সাহস করে পা টিপে টিপে বাথরুমের দরজার কাছে গেছি, দেখি এক লম্বা হাড্ডিসার
ঠ্যাঙ দিয়ে বিশাল জল ভরা বালতিটা লাথিয়ে ফেলে দিল, পলকে তাক থেকে জলভরা মগটা নিয়ে
হুড্ডুম করে আছড়ে ফেলল বাথরুমে হাড্ডিসার ঝোলা হাত দিয়ে। লোহার জলভরা বালতি আর
জলভরা মগের পড়ার কি বীভৎস বিকট শব্দ! ভয়ে আমার পা’দুটো বারান্দার মেঝেতে সেঁটে গেছে,
ঠকঠকিয়ে কাঁপছি! ‘ও মাম, ঘুমচোখে পড়লে নাকি’, বলতে বলতে বাবুই ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে
এসেছে। ওরে মাগো মা, বাথরুম থেকে শাঁ করে বেরিয়ে ওই শাঁকচুন্নিটা দুপদুপিয়ে বারান্দা
পেরিয়ে উত্তরদিকে ভ্যানিশ! হ্যাঁ, মিলিয়ে গেল। মা আর মেয়ে স্পষ্ট দেখেছি দুজনেই।
হতভম্ব মেয়ে তখন ভয় পেয়ে আমাকে দু’হাতে জাপটে ধরেছে। দুজনেই কাঁপছি ঠকঠক ঠকঠক!
একটু ধাতস্থ হয়ে বাবুই বলল, ‘অত্ত জোর শব্দ, ব্যথা পাওনি তো? ভাবলাম, পড়ে মাথা
ফাটল নির্ঘাৎ! এখন বারো-তেরোদিন এমন রাতদুপুরে একা আসবে না, আমায় ডাকবে, চলো ঘরে।’
বললাম কোনোরকমে, ‘পড়িনি তো! ও লাথিয়ে বালতি ফেলল, মগ ধরে ফেলল।’ আমায় ছেড়ে মেয়ে
বাথরুমে উঁকি দিয়ে বলে, ‘কই বালতি-মগ যেমনকার তেমনি আছে তো। জলভরা পড়লটা কী?
শব্দেই ঘুম ভাঙল তো, আমার! ঘরে চলো, ঘরে।’ বিছানায় বসিয়ে এক গ্লাস জল খাইয়ে মেয়ে ব্যাপার
জানতে চাইতেই হড়বড়িয়ে বলি সব, কেন উঠেছি, কী দেখেছি সব! শেষে বলি, ‘মেয়েছেলেটাকে
তুইও দেখলি তো!’ ও ভয় পাওয়া মুখে বলল, ‘আত্মা এখনও বাড়ির মায়া কাটিয়ে যেতে পারেনি।
সবে দাহ কাজ সারা হল সন্ধের মুখে। ১০১ বার রামনাম করো, আমিও করি। তারপর শুই,
সারারাত টিউব জ্বলুক।’ বললাম, ‘ভয় পাস না, ঘরের মানুষের কোনও ক্ষতি করবে না। কাউকে
কিচ্ছুটি বলিস না বাবুই, ফুলদি এসেছিল!’ — ফুলদি মানে আমার ননদ! একবছর ধরে ভুগে
ভোর-রাতে হার্ট অ্যাটাকে চলে গেছে। তারপর মাঝদুপুরে শ্মশানযাত্রা, সন্ধের পর সবাই
দাহকাজ সেরে ফিরেছে। বাড়িতে অশৌচ লেগে গেছে, তাই সারা বাড়ির
বারান্দা-বাথরুম-চিলেকোঠার আলো বিকেল থেকে রাতভর ১২ দিন জ্বলবে, খুড়িমার নির্দেশ।
ফুলদির বিয়ে হয়নি তো, এ বাড়িতেই দোতলায় দক্ষিণের ঘরে থাকত খুড়িমার সঙ্গে। এ মাঝবয়সে
যা দেখেছি স্বচক্ষে, তাকে মিথ্যে বলি কী করে? আবার একা নই, মেয়েও দেখেছে, বিকট
শব্দে ঘুম ভেঙে ছুটে এসেছে! শুধু বালতি লাথানো আর মগ ফেলাটাই দেখেনি, আমি দেখেছি
ওটা! আর কী অদ্ভুতুড়ে, পরিষ্কার বালতি কাত হতে দেখলাম, মগ পড়তে দেখলাম, বাথরুম জল
থৈ থৈ হতে দেখলাম! অথচ মেয়ে দেখল জলভরা বালতি-মগ যেমনকার তেমনি, বাথরুম শুকনো
খটখট! যেন কিচ্ছু হয়নি, অথচ পড়া-ধরার শব্দেই ঘুম ভেঙেছে মেয়ের, ছুটে এসেছে সে!
আবার সেই ‘ও’-কেও দেখেছে! অ্যাত্ত কাণ্ডের পর বলতে পারি ভূত বলে কিছু নেই?
সাহিত্যিক কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে একবার দেখা হলে বলতাম, ওই উর্মিদের মতো
আমিও নিউটন, ফ্যারাডে, জুল, প্ল্যাঙ্ক পড়েছি। অ্যাভোগাড্রো, ডাল্টন, ল্যাভয়শিয়ার
পড়েছি। ওদের ল জানি। আমি যাদবপুরের ফিজিক্স অনার্স গ্র্যাজুয়েট। তা বলে ২০১৫ সালের
২৬শে আগস্টের পুরো ঘটনাটা নস্যাৎ করতে পারি? হ্যাঁ হ্যাঁ, ২৭ শে হবে। কারণ ফুলদি
চলে গ্যাছে ২৬শে ভোরে, সেদিন মাঝরাতে মানে ইংলিশে ২৭শে আগস্ট যাকে দেখেছি, ওই ছবিতে
দেখা শাঁকচুন্নির মতোই!
আরও বলি, এই যে আষাঢ় পেরোল,
চকোরি। ভূত দেখেছে, ইটাচুনায় বেড়াতে গিয়ে। বলি সে কাহিনি? শুনে যার ইচ্ছে হবে,
সটান চলে যাও ইটাচুনার বিশাল রাজবাড়িতে। কপালে থাকলে দেখতে পাবে। চোখে না দেখলেও,
হয়তো শুনতে পাবে নিঝুমরাতে সবে জন্মানো বাচ্চার ভূমিষ্ঠ মুহূর্তের কান্নার শব্দ!
হয়তো বা শুনবে টক্টক্ টক্টক্ করে কারা যেন একদল কোথায় যাচ্ছে, ওই ঘোড়ার খুড়ের
শব্দ ভাঙছে নিস্তব্ধতাকে! কখনও শোনা যায় আরাধ্য রাধানাথ জিউর মন্দির থেকে মাঝরাতে
ভেসে আসছে গান, ‘হরি হরি...’
‘হরি হরি
বলো সবে/ হরি ছাড়া কে আর ভবে/
এ নাম শুনে তরে যাবে/ শান্তি শান্তি শান্তি পাবে’
এ নাম শুনে তরে যাবে/ শান্তি শান্তি শান্তি পাবে’
— সে নাকি বড়ো মধুময় কণ্ঠ, মায়ায় ভরা। সাহস করে
যদি কেউ ঘর থেকে টর্চ হাতে বেরিয়েছে তো সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় গান। ফের ঘরে
ঢুকে দোর দাও, কানে এসে ঢুকবে হরিনাম! এমন কত কথা, কত কত কথা বহুকাল ধরে শোনা যায়
ওই রাজবাড়িকে ঘিরে। চালু কথা, ওই ২০ বিঘা জমির ওপর গড়ে ওঠা ভুলভুলাইয়া রাজবাড়িতে
ভালোমতোই ভূতের বসত বহু বহুকাল ধরে। তবে আজ অবধি কোনও ভূত কারও ক্ষতি করেনি। ওই যে
চকোরি, ক্লাশ নাইন থেকে হায়ার সেকেণ্ডারি পর্যন্ত মেয়েকে ইংলিশ পড়িয়েছে। মেয়ের সঙ্গে,
আমার সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধু-বন্ধুই! ও অন্য টাইপ মেয়ে, গালগুপ্পি দেওয়ার মানুষ নয়।
সেই শীতের সময় থেকেই বলছে, “জানো তো দিদি, মামাবাড়ির সবার সঙ্গে ইটাচুনার রাজবাড়ি
দেখতে যাব। ছোটোমামা বলছে মজা করে, ‘ওখানে ঘরে বাইরে – আগানে বাগানে নানারকম ভূতের
বাস। খবরদার দলছুট হবি না কেউ।’ ভীষণ নির্জন শুনশান জায়গা নাকি! অমন ভুতুড়ে জায়গা
যা ভালো লাগে আমার, কী বলি! দেখে এসে গল্প বলব। ওখানে ঘুরে এসো।” ভূত শুনেই বুক
ছ্যাঁৎ, আমি বিলক্ষণ ভুত মানি। কিন্তু চকোরিকে বললে আমায় নিয়ে মজা করবে যে। তাই
আলতো করে হাসি ছেড়ে বললাম, “দেখে এসে গল্প বোলো আর মামার কথা মেনে দলছুট হবে না চকোরি।”
মনে ভাবছি, যেখানে ভূতের গন্ধ আমি সেখানে যাই? মেয়েও যেতে চাইবে না। তা শীতে হয়নি,
চকোরিরা গেল এই আষাঢ়ে। এসে শোনাল গল্প আমাদের চিলেকোঠায় বসে। আমাদের বাড়ির চিলেকোঠাটা
মনকাড়া, ঝক্ঝকে তক্তকে। পায়রা কালো জিরে, শুকনো লংকা দিয়ে মুড়ি ভেজে দিয়েছিল, সঙ্গে
পাঁপর ভাজা। খেতে খেতে কথা শুরু, সবটা শোনা। বলে দি, আমাদের বাড়ি পিয়ারিমোহন রায়
রোডে, চকোরির বাড়ি পীতাম্বর ঘটক লেনে – দুটোই চেতলায়। একে অন্যের বাড়ি হাঁটাপথে
জোর কুড়ি মিনিট! হ্যাঁ, ওই যে ইটাচুনা নিয়ে যা কিছু বলছি, সব চকোরির মুখ থেকে শোনা। তো
এভাবে শুরু হয়েছিল কাহিনি...
।।
২ ।।
গুগল সার্চ করে আবিষ্কার
হাওড়া থেকে ব্যাণ্ডেল লোকালে সোওজা ব্যাণ্ডেল। সেখান থেকে অটো নেওয়া হল ছ’খানা, এক
একটার ভাড়া ২৭৫ টাকা। নিয়ে যাবে ফুরফুরিয়ে খন্যান, সেখানেই ওই অদ্ভুতুড়ে অপরূপ
রাজার প্রাসাদ! রাজার বাড়ি সত্যি করে নাকি ওমনিই হতে হয়! আষাঢ় মাস, সকাল আড় ভেঙে বেলায়
পা রেখেছে, তবু কেমন আঁধার! আকাশ কালো মেঘে থমথমে, এই বুঝি নামল বৃষ্টি ঝমঝম। দলে
বাচ্চা-বড়ো সব মিলে ২৬ জন। সবাই খুশিয়াল, আদৌ কখনও এমন পারিবারিক বেড়ানো হয়েছে বলে
তো কেউ মনে করতে পারেনি। মেঠো-ঘেঠো সরু আঁকাবাঁকা পথ, দু’পাশে ঘন বাগান,
আম-কলা-সুপুরি-কাঁঠাল গাছে ভরা সে বাগান! ‘কী গাছ, কী গাছ’ সবাই বলছে দেখে অটোর
ড্রাইভাররাই থেমে গিয়ে বাগানের গাছ চিনিয়ে দিয়েছে। ওই সরু উব্ড়োথুব্ড়ো পথ শেষ
হয়ে একসময় এসে পড়ল হাইওয়ে। সে চওড়া সুন্দর পথ ভেঙে অটো ছুটছে তখন হু হু, যেন
পক্ষিরাজ ঘোড়া! আহা!
অবশেষে ইটাচুনা গ্রাম, থামা
হল রাজবাড়ির বিশাল প্রবেশদ্বারের সামনে। বাইরে থেকে বোঝাই যায় না ভেতরটা এক
ভুলভুলাইয়া। পথ হারানোর সম্ভাবনা পদে পদে, এটা প্রাসাদের মূল দরজা পেরিয়ে ভেতরে
ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই গাইড বাবাজি জানিয়ে দিয়েছিল। তবে দিনের বেলাই কী ছমছ্মে, রাতে
না জানি কী! পৌঁছে থেকেই ছোটোমামির মুখ হাঁড়ি, এমন জায়গায় দু’রাত কাটাতে হবে? ছোটোমামা
দুপুরে কাঁসার থালায় আয়েস করে দুধ শুক্তো মাখা ভাত খেতে খেতে দুম করে বলে, “কতদিন
কাঁসার থালায় ভাত খাইনি। এই না হলে রাজার বাড়ি! শতেক ভূত ছেঁকে ধরলেও আমার গিন্নির
কথায় পরশুর আগে আমি নড়ছি না। এসে থেকেই, ‘কাল ফিরে চলো না গো, ভয় করছে!’ কেন, যখন
টিভিতে ভুতু, হলে ভূতের ভবিষ্যৎ দেখে হাহাহিহি করো, তখন ভয় করে না? আরামসে খেয়ে
ভাতঘুম দাও সবাই, বিকেলে চারপাশ দেখতে হবে না?’ পাশ থেকে মাসিমণি তখন ডালমাখা আঙুল
চাটতে চাটতে বলে, “অনেকের মুখ থেকে অনেক কিছু শুনে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম, ভাবা
যায়, সেই ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দে গড়া এই প্রাসাদ! অ্যাতো বড়ো প্রাসাদ পুরোটা ঝাঁ চক্চকে
রাখা সম্ভব? পোড়ো দিকগুলোর দিকে চাইলে আমারও অস্বস্তি হচ্ছে। বেড়াতে এসে এমন ভয়ে
ভয়ে থাকা ভাল্লাগে না বাপু!”...
যাক, দুপুরের খাওয়া-বিশ্রাম চুকলে
বিকেলে সদলবলে বেরোনো তো হল। আহা, একটা কী টলটলে পুকুর! তার পাশ দিয়ে মাটির কুটিরে
যেতে হয়, ৪টে মাড হাউস, সেখানেও থাকার ব্যবস্থা। কেমন গ্রামের বাড়ি যেন! একটা
শেডের নিচে বসে হাওয়া খেতে খেতে চা-চপ-মুড়িমাখা খাওয়ার ব্যবস্থা! সব হল, সন্ধে
হতেই ঘরে ঢুকে পড়া। ১২টার মধ্যে ১০খানা ঘরে ২৬ জন। বড়োমামার ঘরে সব ছেলেরা ঢুকে
তাসে গল্পে ডুব। মা-বড়োমামি-ছোটোমামি-মাসিমণি এক ঘরে। এক ঘরে সব ভাইবোনেরা। হঠাৎ
কানে আসে বাঁশির করুণ সুর, ‘শাঁওন রাতে যদি’..... দু’লাইন শুনেই ক্লাশ এইটে পড়া
মাসিমণির ছেলে তোতন বলে ওঠে, “ও ব্যাব্যা এই অন্ধকারে বাঁশি কে বাজায়?” সঙ্গে সঙ্গে
ফের বলে, “বাঁশি থামিয়েই জানলা দিয়ে লাফ মেরে ঘরে ঢুকে বলবে, ‘আঁমি বেঁম্ভোদোঁত্তি।
সঁবার ঘাঁড় মঁটকে ঘিঁলু খাঁবো।’ জানলা বন্ধ করো চকোরি দিভাই”। সত্যি অত রাতে কে
বাজায় বাঁশি? রাতের খাবার খেতে বসে জানা গেল, মাসমাইনের বাঁশিওয়ালা আছে। সন্ধে
থেকে একনাগাড়ে অনেকক্ষণ সে নির্জনতার ঢেউ ভেঙে বাঁশিতে একের পর এক সুর তোলে। বাঁশি
রহস্যের সমাধান! কিন্তু ওই দিন সবাই যখন আড্ডা-মজায় মাতোয়ারা, খেয়াল করেনি কেউ, ছোটোমামার
ক্লাশ ওয়ানে পড়া মেয়ে মিঠাই শেষ ঘরের অতিথির মেয়ের সঙ্গে খেলতে চলে গেছে। সে
বাচ্চার নাম কিরণমালা। সে আবার মিঠাইকে একটা ছোট্ট ভাঙা ভাঙা কালচে পাথরের পুতুল
গিফট করেছে, মিঠাই তাকে দিয়েছে জামার পকেটে থাকা হজমোলা। রাতে মিঠাইয়ের পুতুলটা
সকলে দেখে বলেছে, কাল সকালে নতুন বন্ধুর সঙ্গে ভাব করিয়ে দিবি। কী সুন্দর
পুতুল।..... মেসোমণি পুতুলটা নেড়েচেড়ে বলল, “এটা অ্যান্টিক, অনেককালের পুরোনো।
কোথাও হয়তো কুড়িয়ে পেয়েছে বাচ্ছাটা! মিঠাইয়ের মা, যত্ন করে তুলে রাখো গো!” এরপর
রাত তো ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝির ডাক, আরও কতরকম ডাক শোনাতে শোনাতে ঘুম পাড়িয়ে দিল।
পরদিন সকালে জলখাবারে
লুচি-আলুছেঁচকি খেতে খেতে ছোটোমামা বলে, “কই রে মিঠাই, তোর নতুন বন্ধু খেতে নামল না?
ভাব করব যে!” পরিবেশনকারী শুনে হেসে বলল, “আপনারাই ২৬ জন এ প্রাসাদে, আর মাডহাউসগুলো
খালি। আর কোনও অতিথি নেই স্যার। শীতকালে কোনও ঘর পড়ে থাকে না একদিনও। এখন এই প্রাসাদের
দু’টো ঘরও খালি। আপনারা ছাড়া কে আসবে খেতে?” কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শেষ করে ছোটোমামা
মিঠাইকে নিয়ে সোজা ওপরে, “কোন ঘরে বসে কাল খেলেছিস মামণি? নিয়ে চ।” টানা বারান্দা
পেরিয়ে শেষের একটা বন্ধ ঘরের সামনে দাঁড়ায় মিঠাই, “এটা কিরণমালার ঘর। সারা
বছর এখানে থাকে তো! এটাই ওদের বাড়ি। ওর বাবা ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করে বলল।” মনে ভয়ঙ্কর
খটকা নিয়ে তখন সব কিছু চেপে যায় ছোটোমামা। পরে কলকাতায় ফিরে বলেছে, “কে ওই
কিরণমালা? মূল থাকার বাড়ির ১২টা কক্ষ। তার দশটা আমাদের দখলে, রইল বাকি দুই! দু’টোই
ফাঁকা তো কার সঙ্গে খেলল মিঠাই? অতি প্রাচীন পুতুলটিই বা কে দিল?” সত্যি সব যেন
ধোঁয়াটে! পুতুলটাই প্রমাণ মিঠাই মিথ্যে বলেনি। তবে কী? বেশি কাউকে এসব বললে হো হো
করে হাসবে, আর মিঠাইয়ের মা জানলে তো পাগল হবে, তার মেয়েকে ভূত ছুঁয়েছে বলে। কত্ত
যত্ন করে ওই পুতুলটা শো কেসে সাজিয়ে রেখে দিয়েছে! ছোটোমামা কথাগুলো শুধু চারজনকে
বলেছে, যারা কথা চাপতে জানে। ভাগনি চকোরি, তার মা মানে দিদি, মাসিমণি মানে ছোড়দি
আর দাদা মানে বড়োমামা। বড়োমামা বুঝ দিয়েছে, “কী শুনে কী বলেছে ওই একরত্তি মেয়ে,
অত্ত মাথা ঘামালে হয়?” এতো গেল মিঠাইয়ের ব্যাপার! কিন্তু ফেরার আগের দিন ওই চরণবালা?
গায়ের রঙ তামাটে, ধপধপে থান-সেমিজ পরা বুড়ি থুত্থুড়ি, কোমর ঝুঁকিয়ে হাঁটে, একটাও
দাঁত নেই তবু স্পষ্ট কথা!...
।।
৩ ।।
সেদিন যে অমাবস্যা দলের কেউ
জানত না। আগের দিন আকাশ কালো ঘন মেঘে ঢাকা থাকলেও বৃষ্টি পড়েনি। পরদিন সকাল থেকে
টিপটিপ বৃষ্টি। তারমধ্যেই রাজবাড়ির অনেক দর্শনীয় দেখা হয়েছে। কী বিশাল নাচঘরে পুরোনো
আমলের বেলোয়ারি ঝাড়। হাঁ করে দেখতে হয়। ঘোরাঘুরি খাওয়াদাওয়ার পর সবাই যখন আয়েসি
মেজাজে, চকোরি স্মার্ট ফোনটা নিয়ে টানা বারান্দায় শেষ প্রান্তে গিয়ে বসেছিল।
দোতলায়, রবিঠাকুরের গান শুনবে বলে। ভরদুপুরেও যেন এক নিঝুমপুরী! ঝিরঝির বৃষ্টির
শব্দ ছাড়া কোনও শব্দ নেই। দেয়ালের ওপাশের একটা পোড়ো ঘরে বসে কতোগুলো পাখি ভেজা
ডানা থেকে জল ঝাড়ছে ছর্ছর্। চকোরি কী একটা গান শোনা শেষ করে ফের শুনছে, ‘উতলধারা
বাদল ঝরে...’, সে সময় হঠাৎ, “অ মেয়ে, অমাবস্যায় ভরসময়ে কেউ চুল খুলে বারান্দায় বসে
থাকে? গেরো দাও চুলে! তা আসা হয়েছে কোত্থেকে, কোলকাতা?”
হকচকিয়ে চুলটাকে হাতখোঁপা
করতে করতে ঘাড় নেড়েছিল চকোরি। ফের সামনে দাঁড়ানো ফোকলামুখো বুড়ি হেসে বলে, “ওদিকে
আচার শুকুতে দিই তো, দেখতে এসেচি ঠিক আচে কিনা! তিন দিন রোদ পাচ্চে না। তবে
ভালোভাবে জারানো, চরণবালার হাতের আচার নষ্ট হয় না! এই অ্যাত্ত বড়ো পাসাদের সব ঘরে
আমার হাতের আচার নইলে চলে না।”
“কীসের আচার গো ঠানদি? আমি
খুব আচার ভালোবাসি, একটু দেবে?” চকোরি গান শোনা বন্ধ করে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে।
“হোথায় শুকুচ্চে করমচা আর
আমের আচার। করমচাটা ঝাল-টক-মিষ্টি, আর আমেরটা টক-ঝাল। খাবে? রোসো। আচো ক’দিন?”
“কাল জলখাবার সেরেই ফিরে যাব।”
“বেশ, ঘর থেকে ডিবে এনে
সন্ধের পর দিয়ে যাব’খন, ওই সাতটা বাজলেই এখানে চলে এসো, দেব। দেখো, এক মিনিট দেরি
কোরো না। বুড়ো মানুষ, ঠিক সাড়ে সাতটায় রাধানাথ জিউকে স্মরণ করে শুয়ে পড়ি।”
“কোথায় থাকো কোন ঘরে?”
“ওই উত্তরে, এখন যাই, বেলা
পড়ে এল! আর আচারের কথা পাঁচকান কোরো না। দোবো, নিয়ে ঝোলায় ভরবে, বাসায় গিয়ে বের
করবে। এ বছর এ আচার কেউ এখনও পায়নি, তুমিই পোথম! ওই আমার পুতি রাজবাড়ির সব
বেত্তান্ত গুচিয়ে বলতে পেরেচে? পেরায় ২৫০ বছরের পুরোনো এ পাসাদের কত্টুকু ও জানে?
সব তো শোনা এই চরণবালা দাসীর মুখ থেকে। আমি শুনেচি দিশাউড়ির মুখ থেকে। এখন বয়স চার
কুড়ি বারো, বৌ হয়ে এ পাসাদে ঢুকেছি তেরোতে। আমার দ্যাখা কম নাকি! আমরা এ পাসাদের
খাস দাসী গোষ্টি, অনেক সুখ-দুঃখ-কেচ্চাকাহিনির কথা জানি। কিন্তু নুন খেয়েছি তো,
গুনই গাইব বাপু। এই বগী কুন্দনদের পূবপুরুষ কম অত্যেচারী ছিল?”
“ঠানদি, কুন্দন নয়, কুন্ডু।”
“থাম্, জাতে মারাটি কুন্দন।
ওই সাফল্যরাম কুন্দন পাসাদ গড়েচে। আসলে কুন্দন, মুখে ভেঙে ভেঙে হয়েছে কুন্ডু! এবার
যাই। সাতটায় ভুলিস না।”
“ও, ওই যে সব বোঝাচ্ছিল, সে
তোমার পুতি?”
“হ্যাঁ রে দিদি। একা একা থাকিস
না। এখানে চাদ্দিকে তেনারা! ঘরে যা।”...
বিকেল থেকে মুষলধারে বৃষ্টি
নামায় কেউ আর বাইরে বেরোতে পারেনি। চকোরি ভাবছে, আচার পাওয়ার বারোটা! এবার কী মনে
হতে সাতটার খানিক আগে, ‘বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখি’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে সেই
জায়গায়! কানে আসছে নানান সুরে ব্যাঙের গান, বৃষ্টির অপূর্ব ঝম্ঝম্ শব্দ।
বারান্দার আলো টিমটিমে, যেদিকে চোখ যায় কী ভয়ংকর অন্ধকার! ঠিক যেন ‘কোনোখানে
জনমানব নাই’... হঠাৎ, “ধর্, এই আমের ঝাল, এইটে করমচা বাহার! নিয়ে ঘরে যা, উঠতি
বয়েস, ছেলেমানুষ মেয়ে, এখানে দাঁড়াস না।” চকোরি দেখে, ডান হাত একটা বিশাল কচুপাতা
ধরে রয়েছে মাথার ওপর ছাতার মতো করে আর বাঁ হাতে ছোটো ছোটো দুটো আচারভরা শিশি বুকের
কাছে জড়ো করা সোজা হয়ে না দাঁড়াতে পারা মানুষটার। আচারের শিশি দুটো নিয়ে যেই পায়ে
হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে শোনে, “ছুঁসনি বাছা, নেই মানুষকে পেঁন্নাম
করে কেউ? আমি এখন বাতিলের দলে, নেই দলে।”
“তবে দাঁড়াও, তোমার সাথে একটা
সেলফি তুলি,” বলে একটা খিচিক।
“ওটা কী লো?”
“ফটো ঠানদি, এই দেখো,” বলে দু’জনের
ছবিটা দেখাতেই ফোকলামুখে চরণবালার সে কী হাসি খিলখিলিয়ে। “মা লো মা, একালে নিজের
ফুটো নিজে তুলে সাথে সাথে দ্যাখা যায়? কালে কালে কত কী সব ভূতের বাপের ছেরাদ্দ চলেচে!”
এরপর যেদিক থেকে এসেছিল সে, সেদিকেই চলে যায় আর চকোরি আচারের শিশি দুটো দোপাট্টায়
মুড়ে ঘরে! মাথা খারাপ! কাউকে ওই অমৃত দেখায়? কলকাতায় ফিরে ঘরের দরজা বন্ধ করে একা
একা টক্টক! গোল বাঁধল পরদিন ফেরার সময়। যে মানুষটা গাইড হয়ে সব কিছু ঘুরিয়ে
দেখিয়েছিল দু’দিন, তাকে চকোরি বলে, “আপনি তো চরণবালার পুতি, উনি যে আচারের জন্য এই
রাজবাড়িতে বিখ্যাত সে কথা একবারও বলেননি তো? ও আচার কি শুধু এ প্রাসাদের সবার জন্য,
না বাইরেও বিক্রি হয়?” হকচকিয়ে তখন গাইড বলে, “আমার বাবার ঠাকুর্দার মা ছিলেন
চরণবালা দাসী। আচার বহুৎ ধরনের, নানা স্বাদের বানাতে তাঁর জুড়ি এ প্রাসাদে আর
মেলেনি। তিনি দেহ রেখেছেন ৪০ বছরের ওপর হয়ে গেল। দেখিনি, কিন্তু শুনেছি তাঁর হাতের
আচারের মাহাত্ম্য। সে সব আপনি জানলেন ক্যামনে দিদি? তাঁর নামটাই সবাই ভুলে গেছে
তো!”
“না মানে ওই,” বলে চকোরি কথা
ঘুরিয়ে সবার সঙ্গে বাড়ির উদ্দেশে, মনটা কিন্তু ভীষণ খচখচে! বাড়ি ফিরে রাতে ঘুমোবে
কি! একবার ব্যাগ থেকে বার করে আচারের শিশি দেখে তো একবার দেখে চরণবালার সঙ্গে তোলা
সেলফি! সে পাগল পাগল অবস্থা। বাড়ি কেন, যে ইস্কুলে পড়ায় সেখানকার কোনও বন্ধু বা
কাউকেই কিছু বলতে পারছে না। ভাববে মাথা গেছে! শেষে তিন-চারদিন পরে ফোন, “দিদি কাল
তো ছুটি, যাব, একটা জিনিস শেয়ার না করে পারছি না।”
তারপর তো চিলেকোঠায় বসে পরদিন
ওই সব কাহিনি শোনাল। আচারের শিশির ঢাকনা দুটো খুলতেই কী খুশবু! জিভে জল এসে গেছিল
আমার! সুড়ুৎ করে জলটা গিলে বললাম, “ঢাকনা বন্ধ করে সেলফি দেখাও।”...
ও বাবা, কই চরণবালা? দুটো
শিশি হাতে হাসিমুখে চকোরি। উলটোদিকে বসে চকোরি ফিসফিসে, “দিদি, ফোকলামুখে কী
নিষ্পাপ হাসি, সে অতীত, সে ভূত? আমার গায়ে গা, যেন কত আপনজন! সে ৪০ বছরের ওপর নেই?
জাস্ট পাগল হয়ে যাচ্ছি।”
আমি হাসনুহানা মৈত্র, যে নিজে
শাঁকচুন্নি দেখেছি, ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। ভূত অনেককে দেখা দেয় না। ওই
মানুষভূত চরণবালা ফটোতে আছে। আমায় কেন, শুধু চকোরি ছাড়া সে কাউকে দেখা দেবে না।
চকোরিকে কিছু বুঝতে না দিয়ে বললাম, “আমি ছবিটা ডিলিট করলাম।”...
চিলেকোঠার এক কোণে বাবুঘাট থেকে বয়ে আনা গঙ্গাজল বছরভর থাকে। জার থেকে একটু জল এনে
স্মার্টটার ওপর ছিটে দিয়ে বললাম, “তোমার স্মার্ট অশুভ শক্তিমুক্ত হয়ে গেল। এখনও
সন্ধে হতে একটু বাকি। চলো, দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে ব্রীজের ওপর থেকে আচারের
শিশিদুটো আদিগঙ্গায় উত্তরমুখো হয়ে ফেলে, দক্ষিণমুখো দাঁড়িয়ে কেওড়াতলা মহাশ্মশানকে
প্রণাম করে আসি। তারপর দু’জনেই বাড়ি ফিরে গঙ্গাজলের ছিটে নি। ব্যস, দেখবে ভয় উধাও।
প্রত্যেকদিন রাতে ঘুমানোর আগে স্বামী বিবেকানন্দের মুখ স্মরণ করে শক্তি চেও চকোরি,
দেখবে সব ভয়কে জয় করতে পারছ তুমি।”
সেরকমটাই করল চকোরি, এখন
নিত্য স্মরণ করে স্বামীজীকে! ক’মাস হয়ে গেল ঠিকই আছে। কথা হল, ভূত ছিলই, ভূত আছেই,
ভূত থাকবেই। ওই জাতটাকে নিয়ে হাসিতামাশা না করাই ভালো! অতীতকে নস্যাৎ করা যায় না
কক্ষনো।
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment