নাকের
কথা
চিত্ত
ঘোষাল
নাক আমাদের
খুব দরকারি একটা জিনিস। নাক দিয়ে আমরা নিঃশ্বাস নিই, তবে পাই অক্সিজেন, তবে আমরা
বাঁচি। কী বললি বিশে, মুখ দিয়েও নিঃশ্বাস নেওয়া যায়? নিয়ে দ্যাখ না, দশ মিনিট পরে
গলা খর খর করতে থাকবে, শুকিয়ে কাঠ। নাক দিয়ে আমরা গন্ধ পাই। খারাপ গন্ধে ‘অ্যা,
মা গো’ বলে সরে যাই। ভালো গন্ধে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলি – আহ...! আশ্চর্য এই কাজটা
করে নাকের ভেতরে থাকা অলফ্যাকটরি নার্ভ – গন্ধ বোঝে যে স্নায়ু।
থাক ওসব
জ্ঞানের কথা। নাককে আমরা কত ভালোবাসি কী দিয়ে তা বোঝা যায় বলো তো? কথায় কথায়
আমরা নাককে টানি, তাই দিয়ে বোঝা যায় নাকের সঙ্গে আমাদের ভালোবাসা। ধরো, বড়োদের
গল্পগাছা চলছে, তার মধ্যে তুমি হুট করে কিছু বলে বসলে। অমনি বাবা বললেন, অ্যাই, তুই
বড়োদের কথায় নাক গলাস কেন? নাক গলানো বলা হল কেন? নাকের ডগাটা শরীরের মধ্যে সবার
থেকে এগিয়ে থাকে বলে? আজকাল কি সত্যিই নাকের ডগা এগিয়ে থাকে? চাদ্দিকে দ্যাখো
শুধু মোটা আর মুটি। তাদের ভুঁড়িটাই নাকের থেকে এগিয়ে থাকে। তাহলে কেন বলব না,
অ্যাই, বড়োদের কথায় তুই ভুঁড়ি গলাচ্ছিস কেন? বলব না এই জন্যে যে নাককে আমরা
ভালোবাসি, আর চোখা চোখা নাকদের মধ্যে বেশ একটা খোঁচা মারা ভাব আছে।
কাউকে
অহংকারী মনে হলে আমরা বলি লোকটার বড়ো নাক-উঁচু। বলি এই জন্যে যে শরীরের মধ্যে নাকটাই
সবার থেকে উঁচিয়ে আছে। ঘেন্না দেখাতে আমরা নাক সিটকোই, কিন্তু ঘেন্না দেখাতে কি
শুধু নাকই সিটকে যায়? চোখ কোঁচকায় না? ঠোঁট বেঁকে যায় না? তবু নাককে ভালোবাসি
বলে তাকে এক নম্বরে রাখি।
অবাক হয়ো
না যদি বলি আমাদের মান-অপমান থাকে নাকে! তাই যদি না হবে তবে অপমান হলে কেন আমরা
বলি নাক কাটা গেল একেবারে! কাউকে অপমান করতে হলে বলি নাকে-খত দিইয়ে ছাড়ব। কনুই-খত
হতে পারত, হাঁটু-খত হতে পারত, বলি না তো, নাকে-খতই বলি। খুব কষ্ট পাওয়াকে লোকে
বলে নাকের জলে চোখের জলে এক হওয়া। বাধ্য হয়ে কষ্ট বা অপমান সহ্য করতে হলে আমরা
বলি নাক-কান বুজে সহ্য করা। চোখ আর কানের কথা এসেছে বটে, কিন্তু নাকের পরে। দোষ
করলে নাক-মলা খেয়ে বলতে হয়, আর করব না।
কত যে কথা
আছে নাককে নিয়ে। যখন ঠিক করি কোনও ব্যাপারে আর থাকবই না, তখন বলি - এই নাক-মলা
খাচ্ছি, তোমাদের ঝগড়ার মধ্যে আমি আর থাকছি না।
দুঃখের ভান করাকে
বলে নাকে কাঁদা। এটা আমার পছন্দ নয়। ভান করতে নাকের মতো একটা দামি জিনিসকে কেন
টানা হবে? অন্যভাবে বলা যায় না? ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ’-টা তবু মন্দের
ভালো। মানে তো তোমরা জানোই - অন্যের ক্ষতি করার জন্যে নিজের ক্ষতি করা। ন্যাকাও
এসেছে নাক থেকে। এটাও আমার ভীষণ অপছন্দ।
‘নাকানিচোবানি
খাওয়া’-টা আমার বেশ পছন্দ। মানে তোমরা জানো - কোনও কাজ করতে গিয়ে হয়রান হওয়াকে
বলে। কারও নাক-সুদ্ধু মাথা যদি জলে চুবিয়ে ধর, কী অবস্থা হয় তার? হাঁসফাঁস করতে
থাকে না? তাই থেকে কথাটা এল।
নাককে ভালোবেসে
এমনি কত কথার সঙ্গে আমরা তাকে জুড়ে দিয়েছি। হাত-পা-চোখ-কানদেরও বাদ দিইনি। তবে নাকের
মতো অত সম্মান ওদের দিইনি।
এবার নাক
নিয়ে অন্য কিছু কথা। নাকে মেয়েরা নাককড়াই নাকছাবি পরে। তার জন্যে কষ্ট সয়ে নাকের
পাটায় ফুটো করিয়ে নেয় - তাকে বলে নাক ফোঁড়ানো বা নাক বেঁধানো। ছেলেরাও আজকাল
কেউ কেউ নাক-কান বিঁধিয়ে গয়না পরছে। আমার ভারী বিচ্ছিরি লাগে দেখতে। নাকে দড়ি
পরাতে ঘোড়া-গরুরও নাক ফোঁড়ানো হয়। মানতে পারি না এটা আমি। সুন্দর দেখানোর জন্যে
নাক বিঁধিয়ে গয়না পরছ - ঠিক আছে, কিন্তু গরু-ঘোড়াকে কষ্ট দিয়ে তাদের নাক ফোঁড়াচ্ছ
তোমার সুবিধার জন্য - এটা মোটে ভালো লাগে না আমার।
টিকোলো নাক আমাদের
সবার পছন্দ। আমরা বলি চোখা নাক। ভালো বাংলায় উন্নত নাসা - কথাটা এসেছে সংস্কৃত
থেকে। তার মানে, সেই আদ্যি কালেও চোখা নাকের কদর ছিল। থ্যাবড়া নাক, চ্যাপটা নাক, বোঁচা
নাক কেউ পছন্দ করে না। কেউ পছন্দ করে না বলা বোধহয় ভুল হল। চিনে-জাপানিরাও অপছন্দ
করে কি? না বোধহয়। ওদের নাক নিয়ে ভাববার দরকার নেই আমাদের। আমরা আমাদের নাক নিয়েই
ভাবি। আজকাল বোঁচা নাক অপারেশন করে চোখা করে দেওয়া যায়। সেই অপারেশনের নাম
রাইনোপ্লাস্টি। তোমাদের কারও যদি নাক নিয়ে ইয়ে... মানে অসুবিধা থাকে, আমার কাছে
আসতে পার। আমি চোখা করার রাস্তা বলে দেব।
বেশি চোখা
নাকও আবার ভালো নয়। নাক হতে হবে চোখা, কিন্তু মুখের সঙ্গে মানানসই। অতিরিক্ত চোখা
নাকের একজন বিখ্যাত মানুষের কথা বলি। আজ থেকে ঠিক চারশো বছর আগে ফরাসি দেশে জন্মেছিলেন
সাইরানো দ্য বারজারেক (Sirano De Berzerak)। অনেক নাটক আর কাল্পনিক
অভিযানের গল্প লিখেছিলেন তিনি। তাঁকে নিয়েও বই লেখা হয়েছিল। আর একটা কারণেও
বিখ্যাত ছিলেন তিনি। তাঁর ছিল মস্ত বড়ো একটা নাক। অমন নাক কক্ষনো দেখনি তোমরা।
যদি দেখতে চাও নীচের ছবিটা দেখ।
সাইরানো দ্য বারজারেক |
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment