না খাওয়ার
গল্প
ডাঃ
পাঞ্চজন্য ঘটক
সোশ্যাল
মিডিয়াতে আমরা খাওয়া-দাওয়ার নানা পোস্ট দেখি। খাবারের নানা
রকমফের নিয়ে। আমরা যারা সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেকটা সময় দিতে পারি, তারা 'কী খেতে
পারবো?' নিয়ে
চিন্তা বেশি করি। 'খেতে পাব কি?' এই চিন্তা মাথায় আসে না। নিজে থেকে উপোস
না করলে না-খাওয়ার
চিন্তা আমাদের বড়ো একটা নেই। আমার মাঝবয়েস পেরিয়েছে বেশ কিছুদিন। এত বছরে দু’টি
রাতের কথা মনে পড়ছে, খুব খিদে থাকা সত্ত্বেও, খেতে পাইনি। তোমাদের সঙ্গে
ভাগ করে নিচ্ছি তার একটি গল্প - না-খাওয়ার গল্প।
আমরা
ছোটোবেলা থেকে শীতকালে ঠান্ডার জায়গায় বেড়াতে যেতাম। ভিড় কম পেতাম।
ঠান্ডার আমেজ পাওয়া যেত। আর বরফ পড়া দেখার একটা আশা থেকেই যেত। ১৯৭৭ সালের (তখন
আমার ৯ বছর বয়স) ডিসেম্বর মাসের শেষে আমি বাবা-মায়ের সঙ্গে দার্জিলিং বেড়াতে
যাই। মলের
ঠিক ওপরে পেয়ে গেলাম Hotel Ambassador-এর দারুণ সুন্দর একটি ঘর। দার্জিলিঙেই
আমার চায়ে খড়ি হয়। সকালবেলা উঠে বিছানায় আধশোয়া হয়ে মায়ের করা ধোঁয়া ওঠা বেশি করে দুধ-চিনি
দেওয়া দার্জিলিঙ চা খেতে খেতে দেখতাম মলের রঙিন আড়মোড়া ভাঙা।
প্রতিদিনই
ঝকঝকে সোনালি দিন পেলাম। কাঞ্চনজঙ্ঘা মনে হত ছুঁতে পারি, আরেকটু হলেই।
টাট্টু ঘোড়ায় চড়ে চক্কর দিতাম বেশ কয়েকবার। স্বপ্ন-বাস্তব-কল্পনা
কেমন একটা জড়াজড়ি করে থাকত তখন। টাট্টুতে চেপে কখনও নিজেকে ভাবতাম অরণ্যদেব, কখনও ওয়েস্টার্ন ছবির কাউবয়। যাওয়ার দিন এসে
গেল। ছুটি ভালো কাটলেও মা-বাবার একটা আফশোশ – বরফ
পড়া দেখা হল না।
ছুটির
শেষ রাত। বাঁধা-ছাঁদা
সারা। পরের
দিন ব্রেকফাস্টের পর বেরোনো। দার্জিলিঙ স্টেশন থেকে টয় ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি ফেরা। রাতের খাবারের
পর মলে ঘুরে এলাম একটু বাবা-মায়ের সঙ্গে। খুব ঠান্ডা। ফাঁকা মলে এদিক ওদিক ছড়িয়ে
থাকা কয়েকজন মানুষ। দার্জিলিঙ শহরের আলোর মালা। বেশ লাগছিল। ভালো লাগা –
মন খারাপ মেশানো স্বপ্ন দেখেছিলাম নিশ্চয়ই সেই রাতে।
পরদিন
ঘুম ভাঙল মায়ের চিৎকারে। তড়াক করে উঠে দেখি মা বিরাট জানালার পর্দা খুলে ছেলেমানুষের
মতো লাফাচ্ছেন।
আর চেঁচাচ্ছেন - বরফ, বরফ। তোমরা ওঠো শিগগির।
ঘুম-চোখে জানালার দিকে এগিয়ে গেলাম বাবা আর আমি। চারদিক ধবধবে
সাদা বরফে ঢাকা। আর সাদা আকাশ ফুঁড়ে নেমে আসছে সাদা ছেঁড়া ছেঁড়া তুষার টুকরো। স্লো মোশনে যেন। জানালা খুলে
দেওয়া হল। চারদিকে
কোনও আওয়াজ নেই। জানা ছিল না বরফ পড়ার কোনও শব্দ হয় না।
প্রথম
উত্তেজনা কেটে যাওয়ার পর বাস্তবে, আমাদের ফেরত যাওয়ার দিকে নজর দিতে হল। কোনও দোকান
খোলা নেই। হোটেল থেকে আমাদের ব্রেকফাস্ট দিতে পারলেও লাঞ্চপ্যাকে গোটা তিনেক ছোটো কেকের
বেশি কিছু দিতে পারল না। শুনলাম, কিচেন স্টাফ আসেননি। দোকান বন্ধ বলে
এর বেশি কিছু দেওয়া যাবে না। আমরা ওই বরফের ভেতর দু’জন খুব শক্তিশালী
মালবাহকের দারুণ ক্ষমতায় দার্জিলিঙ স্টেশনে এসে পৌঁছোলাম। শুনলাম ট্রেন
ছাড়বে কোনও এক সময়। নিউ জলপাইগুড়ি কখন পৌঁছবে কোনও ঠিক নেই। বাবা খোঁজ নিয়ে জানতে
পারলেন যেভাবে বরফ পড়ে চলেছে, ট্রেন হয়তো পরদিন থেকে বন্ধই হয়ে যাবে।
দুপুর নাগাদ ট্রেন ছাড়ল। কোনও খাবার জোগাড় করা গেল না ওই দুর্যোগে। একটা কাচঘেরা
চেয়ারকারে আমাদের সিট ছিল। চারদিক সাদা বরফে ঢাকা। পাইন গাছের সারি
সেজে আছে তুষারমালায়, যেমন দেখেছি বিদেশী সিনেমায়। আমি খুব মজা
করে ঝিকঝিকে ট্রেনের ভেতর বসে বরফ পড়া দেখছিলাম।
ট্রেন
এগোচ্ছিল হাঁটি হাঁটি পা পা করে। খুব খিদে আর তেষ্টা পেয়েছিল। বিকেলের আগেই
অন্ধকার নেমে এল।
ট্রেনের কামরায় আলো ছিল না কোনও কারণে। অন্ধকারের ভেতর দেখার কিছু আর রইল না।
খিদের হুল ফুটছে সারা শরীর জুড়ে। মা তখন আমাদের সেই সকালে হোটেল থেকে আনা
কেক কয়েকটি ভাগ করে দিলেন। বুঝলাম মা কেকের বেশিরভাগটাই আমাকে দিয়েছেন। নিজের জন্য কিছুই
তেমন রাখেননি। জিজ্ঞেস করলাম – তুমি নিয়েছ মা? মা ব্যস্তভাবে বললেন – হ্যাঁ রে বাবা, তুই
খা তো। কেকের
টুকরো দুটো পেটে যাওয়ার পর খিদে যেন আরও বেড়ে গেল। পাকস্থলী–খাদ্যনালী
এতক্ষণ খিদেয় গুম হয়ে বসেছিল। কেক পেয়ে এবার তারা দাপাদাপি শুরু করে
দিল। আমাদের
সঙ্গে যাচ্ছিলেন দার্জিলিঙের এক বাঙালি পরিবার। তাঁরা এই দুর্যোগের জন্য পুরোপুরি তৈরি
হয়ে বেরিয়েছিলেন।
একের পর এক টিফিন থেকে লুচি-আলুর দম-মিষ্টি, ফ্লাস্ক
থেকে গরম চা বের করে খাচ্ছিলেন। অন্ধকারেও তাদের খানা-পিনা
চলতে থাকল। খাবারের
সুন্দর গন্ধ শরীরে যে এমন জ্বালা ধরাতে পারে – আগে বুঝিনি।
রাত
এগারোটা পার করে টয় ট্রেন কোনোরকমে ধুঁকতে ধুঁকতে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ঢুকল। সেখান থেকে শিলিগুড়িতে
বাবার এক বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল আমাদের। নিউ জলপাইগুড়ি
পৌঁছে দেখি সেখানে বরফের জায়গায় ঝরছে অঝোর বৃষ্টি। আর প্রচন্ড ঝড়। সেই ভিজে শীতের
রাতে কোথাও কোনও গাড়িঘোড়া ছিল না। বাবার বন্ধুর বাড়ির নরম বিছানা আর গরম
খাবারের কোনও আশা সেই রাতে আর রইল না। কোনোরকমে খুঁজে-পেতে গিয়ে উঠলাম ফার্স্ট
ক্লাস ওয়েটিং রুমে। একটু গুছিয়ে বসতেই শরীর জুড়ে আছড়ে পড়ল খিদের ঢেউ। বাবার সঙ্গে
আমি আর মা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম রেলের ক্যান্টিনের দিকে। দেখলাম ক্যান্টিন
খোলা আছে। খুব
আনন্দ হল। এবার
তাহলে খেতে পাব।
দরজা ঠেলে ঢুকলাম। একটা টেবিলে জনাচারেক লোক খাওয়াদাওয়া করছেন। টেবিলে বসতে
যাব, একজন ম্যানেজার গোছের লোক আমাদের হৈ হৈ করে বলে উঠলেন – এখন
কিছু হবে-টবে না।
ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু পাওয়া যাবে না। যান যান এখান
থেকে। বাবা
বোঝানোর চেষ্টা করলেন –
একজন ভদ্রমহিলা আর ৯ বছর বয়েসের ছেলে সারা দিন প্রায় না খেয়ে আছে। যা হোক একটু
কিছু দিন।
জনাচারেক
লোক (হয়তো
ক্যান্টিন বা রেলের কর্মচারী হবেন) বেশ ফেলে ছড়িয়ে ডাল, ভাত, তরকারি, মাংস
খাচ্ছিলেন চোখে পড়ল। ম্যানেজারবাবু কোনও কথাই শুনতে চাইলেন না। বাবা কয়েকবার
ওঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। ভদ্রলোক গললেন না। মা আর আমি বাবাকে
বললাম – প্লিজ
চলো এখান থেকে।
আমাদের খাওয়ার দরকার নেই। বাবার এইভাবে অপমান দেখতে আর ভালো লাগছিল
না। কোনোরকমে
বেরিয়ে এলাম।
বাবা বললেন বাইরে গিয়ে যে ভাবে হোক খাবার নিয়ে আসবেন আমাদের জন্য। বাইরে তখনও দারুণ
ঝড়-বৃষ্টি। রেলের
হলদে আলোয় বাইরের অন্ধকার কেমন ভুতুড়ে লাগছিল। মনে হল না কোথাও
কোনও দোকান খোলা আছে। অচেনা জায়গা। তার ভেতর বাবাকে ছাড়তে মন চাইল না আমাদের। বললাম – চলো
গিয়ে শুয়ে পড়ি।
আমার একদম খিদে নেই। সেই রাতের প্রথম মিথ্যা কথা। ঘরে এসে বসলাম। খিদেতে চোখে
অন্ধকার দেখছিলাম।
মুখ দেখে নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছিল। বাবা জিজ্ঞেস করলেন – সত্যি
বলছ? আমি
সেই রাতের দ্বিতীয় মিথ্যাটা আরও জোরের সঙ্গে বললাম – হ্যাঁ বাবা। একদম সত্যি। পেটটা মনে হয়
ঠিক নেই। বাবা
বুঝতে পারলেন সবই।
কিন্তু কিছু করার ছিল না ওই সময়ে। পরিবারকে খেতে না দিতে পেরে বাবার ভেতর
কী হচ্ছিল ওই বয়েসেও বুঝতে পারছিলাম বেশ। আমরা কোনোরকমে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম
এল না। নানারকম
ভালো ভালো খাবারের ছবি মাথার ভেতরে প্যারেড করছিল। কিছুতেই শরীর-মন
থেকে খিদেটা তাড়াতে পারছিলাম না। খিদেও বোধহয় একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ঘুমের কাছে হেরে
যায়। ঘুমের ভেতরে কি নানারকম খাবারের স্বপ্ন দেখেছিলাম? এতদিন পর আর
মনে পড়ছে না।
হঠাৎ
ঘুম ভাঙল। বাবার
ঠেলায়। জেগে
দেখলাম সকাল হয়ে গেছে। বাবা বললেন – তোমরা ওঠো, ওঠো। অনেক খাবার
নিয়ে এসেছি।
ঘুম-চোখ কচলে দেখলাম –
ধোঁয়া ওঠা কচুরি-তরকারি। আর গরম জিলিপি। কোনোরকমে হাত-মুখ
ধুয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম খাবারের ওপর। বাবার চোখেমুখে আনন্দের ছাপ। আমি জিজ্ঞেস
করলাম - বাবা, খাবে
না? খাও, ঠান্ডা হয়ে যাবে যে! বাবা বললেন – খাবো
রে। আরেকটু
দেখে নি তোর খাওয়া। বড্ডো ভালো লাগছে।
আমাদের
খিদের রাত শেষ হয়ে গিয়েছিল। অনেকের খিদের রাত বড়ো লম্বা হয়...
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment