সোনালি সেই দিনের কথা
জলি নন্দী ঘোষ
ছোটোবেলা মানেই
পড়ায় ফাঁকি,
সিলেবাস ভুলে
অঙ্ক খাতায়
আকাশ-পাহাড়-ঝর্ণা আঁকি;
সরস্বতী পুজোর
আগে কুল খেয়েছি
সেই কথাটি লুকিয়ে
রাখি -
ছোটোবেলা মানে
একটা পপিন্স লজেন্সের জন্য
ভাইয়ের সাথে
খুনসুটি,
ঝগড়া আর চিমটি
কাটাকাটি...
ছোটোবেলার স্মৃতির
ভাঁড়ার ঘরে উঁকি দিলে, এরকম কত যে মজার স্মৃতি তিড়িং-বিড়িং
করে ভিড় জমায় মনের দোরগোড়ায়! কোনটা ছেড়ে
কোনটা বলি! তারই মধ্যে মজার কিছু ঘটনার সোনাঝরা স্মৃতি
ভাগ করে নিলাম প্রিয় ম্যাজিক ল্যাম্পের সঙ্গে।
আমার
বড়ো হয়ে ওঠা যৌথ পরিবারে। দাদু, বাবা-মা, দুই কাকু, দুই কাকিমা, আমরা দু’ভাই-বোন
আর চার খুড়তুতো ভাইবোন একসঙ্গে। খুব আদর পাওয়া, আনন্দ, মজা, হই-হুল্লোড় যেমন
ছিল, বজ্র আঁটুনি টাইপ শাসনও ছিল তেমনই। পান
থেকে চুন খসলেই পেতে হত শাস্তি। শাস্তি
দেওয়ার খুব কমন একটা পদ্ধতি ছিল যেটা বাবা ও দুই কাকু প্রয়োগ করত আমাদের ছ’জনের ওপর। বাইরের
রোয়াকে নিয়ে গিয়ে বাড়িভর্তি লোক, তিন-চারজন কাজের
লোক, বাড়িতে আাসা বাইরের লোক... সব্বার সামনে কান ধরে দাঁড় করিয়ে দিত। আর
মুখে বার বার বলতে হত - “এই কাজ জীবনে
আর করব না”। আমরা স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতাম কান
ধরে আর ওই কথাটা বিড় বিড় করতে করতে, চোখ পিট পিট
করে দেখতাম কে কে দেখছে আমাদের।
সন্ধেবেলায়
এক খাটে ছ’জন একসঙ্গে পড়তে বসতাম। বাবা
পড়াতেন আমাদের। সামনে একখানা ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে। পড়া
শুরু হত অঙ্ক দিয়ে। সব্বাইকে দশটা করে অঙ্ক করতে দিয়ে বাবা
মুখের সামনে পেপার খুলে বসতেন। পেপারের
আড়ালে বাবার মুখ ঢাকা পড়ে যাওয়ামাত্র আমরা এ ওর হাঁটু ঠেলাঠেলি শুরু করে দিতাম। প্রত্যেকের
অভিযোগ, অন্যজন তার চাইতে বেশি জায়গা নিয়েছে বসতে। টেরও
পেতাম না, পেপারের দেওয়ালের ও প্রান্ত থেকে বাবা
সব শুনছেন চুপটি করে। যখন টের পেতাম, ততক্ষণে যারা একেবারে সামনের দিকে বসেছে তারা খান দুই স্কেলপেটা
খেয়ে ফেলেছে স্যাঁট স্যাঁট করে। তারপর, বলাই বাহুল্য... যারা পেটানি খেল তাদের চাপা কান্নার ফ্যাঁচ-ফোঁচ, আর যারা পেটানি খেল না তাদের মাপা হাসির খুক খুক সুরের
মিলিত ধারায় বইত অঙ্ক ক্লাসের বাকি সময়টুকু।
ভাইবোনদের
মধ্যে আমি ছিলাম সবার থেকে বড়ো। তারপর
ভাই। এইটে ওঠার পর আর সবার সঙ্গে নয়। ভাই
আর আমি একটা আলাদা ঘরে পড়তাম। দোতলায়। সেও
এক মজার অভিজ্ঞতা! দু’জনকে নতুন খাতা দিয়ে বাবা বলতেন, কম্পিটিশন হোক। যে আগে
খাতা শেষ করতে পারবে সে পাবে দারুণ একটা উইলসন ফাউন্টেন পেন। ভাই
ছিল অঙ্কের জাহাজ। ঝড়ের গতিতে অঙ্ক করে খাতা ভরিয়ে তুলত
ও। আমি একটু চালাকি করতাম। মাঝে
মাঝে পাতা ছিঁড়ে দিতাম খাতার। তারপর
ভায়ের আগেই খাতা শেষ করে ফেলতাম। বাবা
খুশি হয়ে প্রাইজ তুলে দিতেন আমার হাতে। সারা
বাড়ি ঘুরে বাহবা কুড়িয়ে যেতাম আমি। আমার
তিলে বিচ্ছু ভাই তক্কে তক্কে থাকত কখন শেষ হওয়া খাতাখানা হাতে পায়। শেষমেশ
ও ঠিক ধরে ফেলত আমার কারসাজি আর আমার প্রাইজ কেড়ে নেওয়া হত। তখন, সে বিষম লজ্জার কাণ্ড হত।
ক্লাস
টেন-এ উঠতে বাবা বললেন, আমি নাকি বড়ো
ক্লাসে উঠে গিয়েছি। এবার থেকে ভাইয়ের সঙ্গে এক ঘরে নয়, আমাকে পড়াশোনা করতে হবে একলা ঘরে। সুতরাং
আমার জন্য বরাদ্দ হল নিচ তলার একটি ঘর। প্রথমটা
একটু মন খারাপ হলেও যখন শুনলাম, পড়াশোনা
করতে হবে ভেতর থেকে দরজায় খিল এঁটে, পাছে কেউ না
জ্বালাতন করে... তখন আনন্দের সীমা রইল না! বন্ধ সে ঘরের জানালার ফ্রেমে বন্দি মস্ত এক আকাশ পেলাম। জানালার
বাইরে নীল আকাশ, সবুজ খেত... খেত
পেরিয়ে নদী, নদীর পারে ওই...ই দূরে
রাস্তা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকত। সামনে বই
খুলে রেখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা।
এমনই
এক ছুটির দুপুরে ছবি আঁকার নেশায় পেল আমাকে। অ্যানুয়াল পরীক্ষার
মাত্র দু’দিন বাকি তখন। রং, তুলি, পেনসিল ছড়িয়ে আর্ট পেপারে মনের সুখে আঁকা শুরু হল। জানালার
ঠিক বাইরে ছিল কুমড়ো গাছের মাচা। বড়ো বড়ো - ঘন সবুজ নকশাদার কুমড়ো পাতা আর হলুদ ফুলে ভরে উঠছিল আমার
আঁকার পাতা। দ্রুত হাতে আঁকা চলছিল। ওপর
থেকে বাবার ডাক আসার আগেই আঁকা শেষ করে, ফুঁ দিয়ে রং
শুকিয়ে ছবিখানা চালান করে দিতে হবে বইয়ের তাকের সবচাইতে নিচের বইয়ের তলায়।
আঁকা
যখন প্রায় শেষ, হঠাৎ একটা ফিঙে শিস দিয়ে উঠল মাচার
ওপর। ওর ডাক শুনতে শুনতে... মিঠে হাওয়ার আদরে কখন চোখের পাতায় জড়িয়ে এসেছে ঘুম। হঠাৎ
চটক ভাঙল হেঁড়ে গলার স্বরে... “অ্যাই...
কী রে?” চমকে উঠে সামনে তাকাতেই দেখি জানালার ফ্রেমের
দৃশ্য বদল ঘটেছে। নীল আকাশ গায়েব। সামনে
আমার তিলে বিচ্ছু ভাইয়ের বড়ো বড়ো গোল গোল চোখ আর দাঁত চেপা হাসি। যেন
হাতে-নাতে চোর পাকড়াও করেছে। মুহূর্তে সে
ছুটল বাবাকে ডাকতে।
আমার
বুকের মধ্যে ধক ধক! পরীক্ষার পড়া রিভিশন দেওয়ার সত্যিই অনেক
বাকি তখন। এ সময় লুকিয়ে ছবি এঁকে ধরা পড়লে বাবার
কাছে ভয়ানক শাস্তি জুটবে তা নিশ্চিত।
হঠাৎ
বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। টুলটাকে খাটের ওপর তুলে, তার ওপর দাঁড়িয়ে সদ্য আঁকা ছবিটাকে নিমেষে লুকিয়ে ফেললাম কড়ি-বরগার চওড়া কাঠের ওপরে। রং
তুলি-টুলিও ঝটপট লুকিয়ে পড়ল যথাস্থানে। বালিশের ওপর
বই রেখে গলা ছেড়ে পড়তে শুরু করলাম... “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য... উচ্চ
যেথা...!”
দরজায়
আওয়াজ, সঙ্গে বাবার রাগী স্বর, “দরজা খোলো”। দুরু দুরু বুকে দরজা খুলে সরে
দাঁড়িয়েছি, ভাই সুরুত করে ঢুকে গেল ঘরে। পেছনে
বাবা। আমি তখন মনে মনে ঠাকুরকে ডাকছি। ভেতরে
পা দিয়ে বাবা প্রথমে কটমট চোখে তাকালেন আমার দিকে, তারপর খোলা বইয়ের দিকে। তারপর
ঘরের চারদিকে তাকিয়ে হয়তো তাঁর মনে হল ভাই তাঁকে ভুল খবর দিয়েছে।
বাবা
সবে পেছন ফিরেছেন আর আমি ভাবছি, এ যাত্রা বেঁচে গেলাম! হঠাৎ
চটাস করে আওয়াজ! ওপরে কড়ি-বরগার
খোপে ছিল এক চড়ুই-এর বাসা। তার বাড়ির
উঠোনে উটকো জিনিস দেখে সে খুব বিরক্ত হয়ে ছবিটাকে ঠেলে দিয়েছে বোধহয়, আর সেটা এসে
পড়েছে নিচে, মেঝের ওপর। আমার
তো দম আটকে যাবার দশা। বাবা ঘুরে গেছেন। মেঝের
দিকে তাঁর চোখ। মুহূর্তে আসল ব্যাপার তাঁর কাছে
পরিস্কার হয়ে গিয়েছে। আমার বদমাশ ভাই টুক করে নিচু হয়ে
ছবিটা তুলে বাবার হাতে দিল। ওর মুখে বদমায়েশি
মেশানো হাসি। যেন কী একখানা বড়োসড়ো যুদ্ধ জয় করেছে। ভাবখানা... “কেমন
দিলাম”?
তারপর
আমার যে কী দশা হয়েছিল সেদিন... থাক, সে কথা আর
নাই বা বললাম! পাঠকেরা আন্দাজ করতে পারছেন নিশ্চয়ই।
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment