শঙ্কুর
সংকেত
রাখি পুরকায়স্থ
১৯৬১ সালের কথা। সন্দেশ পত্রিকার সেপ্টেম্বর-নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হল এক
অসামান্য কল্পবিজ্ঞান কাহিনী - ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’। লেখক স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। এই
গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের জগতে খুলে গেল এক নতুন
দিগন্ত। সত্যজিৎ রায়ের জাদু্করী কলমের আঁচড়ে আবির্ভাব ঘটল এক কিংবদন্তি চরিত্রের।
সেই আশ্চর্য চরিত্রটি একজন বিশ্ব বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ও
আবিষ্কারক - নাম ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু। আমাদের কাছে অবশ্য তিনি প্রোফেসর
শঙ্কু নামেই অধিক পরিচিত। দেবাশিষ মুখোপাধ্যায় লিখিত
‘প্রোফেসর শঙ্কু-ফাইল, সত্যজিৎ রায়ঃ তথ্যপঞ্জি’ বইটি পড়ে জানা যায়, এই
গল্পটি লেখার সময় শঙ্কু চরিত্রটি নিয়ে সিরিজ করবার কথা মোটেও ভাবেননি সত্যজিৎ রায়। তাই বলা ভালো, ১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত দ্বিতীয় শঙ্কু-কাহিনি ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও হাড়’ থেকেই যথাযথভাবে শঙ্কু সিরিজের সূচনা ঘটে। অর্থাৎ সেই সময় থেকেই পাঠকের মনের কল্পলোকে প্রোফেসর শঙ্কুর
দুর্ধর্ষ কল্পকাহিনির ধারাবাহিক যাত্রা শুরু। ১৯৬১ থেকে
১৯৯২ সাল পর্যন্ত প্রোফেসর শঙ্কুর মোট ৩৮টি সম্পূর্ণ ও ২টি অসম্পূর্ণ ডায়রি প্রকাশিত হয়েছে। শঙ্কুর জবানিতে দিনলিপির আকারে লিখিত সেই কল্পকাহিনিগুলিতে মিশেছে দুরন্ত অভিযান, গা-ছমছমে রহস্য, দুর্নিবার রোমাঞ্চ
ও বিশ্বভ্রমণের উচ্ছ্বাস!
উশ্রী নদীর তীরে তদনীন্তন বিহারের (অধুনা ঝাড়খণ্ড) গিরিডি শহরের পাকাপাকি বাসিন্দা প্রোফেসর শঙ্কু। বাড়িতে তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী (স্বর্ণপর্ণী গল্প অনুসারে) চব্বিশ বছর বয়সি পোষা বেড়াল নিউটন ও (আর্শ্চজন্তু গল্প অনুসারে) তেত্রিশ বছরের পুরোনো প্রৌঢ় চাকর প্রহ্লাদ। তাঁর পিতা
ত্রিপুরেশ্বর শঙ্কু ছিলেন গিরিডির অপ্রতিদ্বন্দ্বী আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। তিনি
শঙ্কুকে তিলু নামে ডাকতেন। মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে তিনি পরলোক গমন করেন। ‘প্রোফেসর
শঙ্কু ও ভূত’ গল্পে তাঁর অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ বটুকেশ্বর শঙ্কু ও বেরিলি নিবাসী এক খুড়তুতো
ভাইয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্য কোনও নিকট আত্মীয়ের নাম তাঁর ডায়রিগুলিতে খুঁজে
পাওয়া যায় না। বিশ্বের নানান দেশের প্রখ্যাত বিজ্ঞানীরা
তাঁর বন্ধু। তাঁদের মধ্যে বহুবার উল্লিখিত হয়েছে জার্মান নৃতত্ত্ববিদ
উইলহ্যাম ক্রোল ও ব্রিটিশ ভূতত্ত্ববিদ জেরেমি সন্ডার্সের
নাম। তাঁরা দু’জন শঙ্কুর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ও শুভাকাঙ্খী। এ ছাড়া রয়েছেন
প্রতিবেশী অবিনাশ চট্টোপাধ্যায় ও
হিতাকাঙ্ক্ষী নকুড়বাবু। তাঁরা বেশ কয়েকটি অভিযানে শঙ্কুর সঙ্গী হয়েছেন।
ভয়ঙ্কর অভিযানে অকুতোভয়, অথচ আত্মভোলা, এই টাক মাথা, সাদা দাড়িওয়ালা অসীম
প্রতিভাধর বিজ্ঞানী সত্যজিৎ রায় সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে প্রবীণতম। তাঁর জন্মতারিখ ১৬ জুন বলে উল্লিখিত হয়েছে। আবার ১৯৯২ সালে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় প্রকাশিত ‘ড্রেক্সেল আইল্যান্ডের ঘটনা’ গল্পে ১৬ অক্টোবর শঙ্কু ডায়রিতে
লিখেছেন, ‘আজ আমার পঁচাত্তর বছর পূর্ণ হল’। ১৯৯০ সালে পূজাবার্ষিকী
আনন্দমেলায় প্রকাশিত ‘স্বর্ণপর্ণী’
গল্পে
শঙ্কুর
যে
আত্মজীবন কথা
আছে, সেই অনুসারে হিসেবনিকেশ করলে দেখা যাবে তিনি ১৯১১-১২ সাল নাগাদ জন্মেছিলেন। এদিকে আবার ১৯১২ সালেই
প্রকাশিত
হয়েছিল
আর্থার
কোনান
ডয়েলের ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’ - প্রোফেসর চ্যালেঞ্জারের এক আশ্চর্য রোমহর্ষক অভিযান কাহিনি। কালস্রোতে হারিয়ে যাওয়া এক
আদিম
পৃথিবী
দেখে
এসেছিলেন
প্রোফেসর
চ্যালেঞ্জার। নিজের লেখা বাংলা গল্পের ইংরেজিতে অনুদিত বইয়ের
ভূমিকায় ১৯৮৭
সালে সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন, শঙ্কু আসলে ‘mild-mannered
version of Professor Challenger’। কোনান ডয়েলের প্রোফেসর চ্যালেঞ্জার ভীষণ রাগী। সকলেই তাঁকে ভয় পায়। শঙ্কুর প্রথম গল্প ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’-তে শঙ্কুও বেশ বদরাগী ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। চাকর প্রহ্লাদের সামান্য ভুলে, রেগেমেগে নিজের আবিষ্কৃত
স্নাফ-গান বা নস্যাস্ত্র প্রহ্লাদের গোঁফের কাছে প্রয়োগ করেছিলেন শঙ্কু! আরেকদিন
শঙ্কুর বানানো রকেট পড়ে অবিনাশবাবুর মূলোর ক্ষেত নষ্ট হওয়ায় তিনি শঙ্কুর কাছে
পাঁচশো টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়েছিলেন। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে শঙ্কু অবিনাশবাবুর চায়ে
নিজের আবিষ্কৃত ‘দুঃস্বপ্নের বড়ি’ মিশিয়ে দিয়েছিলেন! দেবাশিষ মুখোপাধ্যায় লিখিত ‘প্রোফেসার শঙ্কু-ফাইল’ বইটিতে লেখক অবশ্য দাবি
করেছেন, সত্যজিৎ রায় নাকি একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, শঙ্কু চরিত্রটি সৃষ্টির পিছনে প্রধান প্রেরণা ছিল তাঁর পিতা সুকুমার রায়ের লেখা গল্প ‘হেসোরাম
হুঁশিয়ারের ডায়রি’। অনেকে আবার বলেন, শঙ্কু
চরিত্রে সুকুমার রায় সৃষ্ট ‘নিধিরাম পাটকেল’ চরিত্রটির ছায়াও বর্তমান!
তবে ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ গল্পে শঙ্কু যা
ছিলেন
আর
পরে
যা
হলেন
তার মধ্যে বিস্তর ফারাক। এই ‘অন্য শঙ্কু’-র কথায় ভরা ‘স্বর্ণপর্ণী’ গল্পটি। সেই গল্পে শঙ্কু তাঁর ডায়রিতে প্রথম জীবনের কথা লিখেছেন। ছাত্র হিসেবে শঙ্কু ছিলেন অসাধারণ। সব পরীক্ষাতেই প্রথম
হতেন। গিরিডির স্কুল থেকে মাত্র ১২ বছর বয়সে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ১৪ বছর বয়সে কলকাতার কলেজ থেকে আইএসসি
এবং ১৬ বছর বয়সে ফিজিক্স-কেমিস্ট্রিতে ডবল অনার্স সহ ভালো নম্বর নিয়ে বিএসসি পাস
করেন। তারপর মাত্র ২০ বছর বয়সে কলকাতার স্কটিশ
চার্চ কলেজে অধ্যাপনা
শুরু করেন। পিতার পরামর্শে সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করে শঙ্কুর জীবন দর্শনে আমূল পরিবর্তন আসে। শঙ্কুর বিজ্ঞানবুদ্ধির সঙ্গে মানবিকবিদ্যার মিশেল ঘটে। শুধুমাত্র বিজ্ঞানী নন, শঙ্কু হয়ে ওঠেন একজন স্রষ্টা ও দ্রষ্টা — দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ান,
প্রকৃতিকে
দেখেন, মানুষকে বোঝেন, আর বানিয়ে ফেলেন নানাবিধ যন্ত্র। সেই সব অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি মানব সভ্যতার ভালো চায়। শঙ্কুর ভাবনার মধ্যে গভীর ন্যায়-নীতিবোধ ক্রমশ
স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রোফেসর শঙ্কু বিশ্বে ও বহির্বিশ্বের অনেক বাস্তব এবং কল্পনিক স্থানে গিয়ে অভিযানে অংশ নিয়েছেন। সেই সকল
অভিযানগুলির মধ্যে কয়েকটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য অপরিসীম, আবার কয়েকটিতে মানব সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলী উদ্ঘাটিত হয়েছে। গিরিডি শহরের স্থায়ী বাসিন্দা প্রোফেসর শঙ্কু কর্মসূত্রে
পৌঁছে গিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, জার্মানি, নরওয়ে, সুইডেন, তিব্বত, জাপান, স্পেন, মিশর, বলিভিয়া, ইরাক সহ
পৃথিবীর নানান দেশে আর জড়িয়ে পড়েছেন বিস্ময়কর সব অভিযানে। ভৌগোলিকভাবে উল্লেখযোগ্য
অভিযান চালিয়েছেন হিমালয়, আফ্রিকার বনভূমি,
দক্ষিণ ভারতের
নীলগিরি পার্বত্য বনভূমি, সাহারা মরুভূমি, সমুদ্রের তলদেশ, স্বপ্নদ্বীপ, মানরো দ্বীপ প্রভৃতি কয়েকটি অজানা দ্বীপে, এমনকি পৃথিবীর গণ্ডী পেরিয়ে মঙ্গল গ্রহেও! ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ গল্পে চাকর প্রহ্লাদ, পোষা বেড়াল নিউটন ও তাঁর আবিষ্কৃত রোবট বিধুশেখরকে নিয়ে প্রোফেসর শঙ্কু মঙ্গল গ্রহে যাত্রা করেছিলেন। সেখানে একদল স্থানীয় জীবের তাড়া খেয়ে তাঁরা চলে আসেন
টাফা গ্রহে। ১৯৬৮ সালে সন্দেশের মে-জুন সংখ্যায় প্রকাশিত ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও রক্তমৎস্য’
গল্পে আমরা দেখেছি, জাপানি বিজ্ঞানী হামাকুরা ও তানাকাকে সঙ্গে নিয়ে প্রোফেসর
শঙ্কু
ও
অবিনাশবাবু
সমুদ্রের
তলদেশে
অদ্ভুত
এক
লাল
মাছের
সন্ধানে
অভিযান
করেছিলেন। ডিসেম্বর ১৯৭৩ - এপ্রিল ১৯৭৪ সংখ্যায় সন্দেশে
প্রকাশিত ‘একশৃঙ্গ অভিযান’ গল্পে ইউনিকর্ণ আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে তিব্বতের
বিপদসঙ্কুল অঞ্চলে অভিযান চালান শঙ্কু। সেই অভিযান শেষ হয় স্বর্গীয় সুখে ভরপুর এক কল্পরাজ্যে
(ইউটোপিয়া)। শঙ্কুর মতে, সেটি প্রকৃতপক্ষে হিন্দু পুরাণে বর্ণিত ‘কৈলাস’। ১৯৮০ সালে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় প্রকাশিত
‘নকুড়বাবু ও এলডোরাডো’ গল্পে অতিমানবীয় মানসিক ক্ষমতার অধিকারী নকুড়বাবুকে সঙ্গে
নিয়ে প্রফেসর শঙ্কু ঘটনাচক্রে পৌঁছে গিয়েছিলেন দক্ষিণ আমেরিকার গভীর বৃষ্টিবনে। সেই অভিযানেই কিংবদন্তি সোনার শহর ‘এল ডোরাডো’ খুঁজে বের
করেছিলেন তিনি!
প্রোফেসার শঙ্কু একজন অসামান্য বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবক। তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে কিংবদন্তি
বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং মেঘনাদ
সাহার ছায়া চোখে পড়ে। তাঁর
কর্মক্ষেত্র কলকাতা হলেও গবেষণা ক্ষেত্র গিরিডি। দেবাশিষ
মুখোপাধ্যায় লিখিত ‘প্রোফেসার শঙ্কুর আবিষ্কার’ বইটি পড়ে জানা যায়, সমগ্র শঙ্কু সিরিজে প্রোফেসর শঙ্কুর ৭২টি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের উল্লেখ রয়েছে। তিনি যে কেবলমাত্র নিজস্ব বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও অভিযানের স্বার্থে
এই আবিষ্কারগুলি করেছেন তা কিন্তু নয়, বৃহত্তর মানবতার স্বার্থে তিনি এগুলিকে ব্যবহার
করেছেন বহুবার। সেই সব আবিষ্কারগুলিতে যেমন রয়েছে
অভিনবত্বের ছোঁয়া, তেমনি তাদের নামকরণের ক্ষেত্রেও তাঁর শব্দচয়ন করবার আশ্চর্য ক্ষমতা ও অসামান্য কৌতুকবোধের পরিচয় আমরা পাই।
প্রোফেসর শঙ্কু আবিষ্কৃত ‘অ্যানাইহিলিন পিস্তল’ এমন একটি অস্ত্র যা লক্ষ্য স্থির করে চালালেই
লক্ষ্যবস্তু নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়! ‘স্বর্ণপর্ণী’ গল্পে শঙ্কু তাঁর ডায়রিতে এ
প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘আমার অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ জীবনে আমাকে অনেকবারই চরম সংকটে পড়তে
হয়েছে। আত্মরক্ষার জন্য একটা অস্ত্রের প্রয়োজন, অথচ আমি রক্তপাত সহ্য করতে পারি
না। তাই এই পিস্তল, যা শত্রুকে নিহত না করে নিশ্চিহ্ন করে।’ ১৯৭৯ সালে
পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় প্রকাশিত ‘মহাকাশের দূত’ গল্পে তিনি ডায়রিতে লিখেছেন, ‘সব সুদ্ধ বার দশেক চরম সংকটের
সামনে পড়ে আমাকে এই অস্ত্র ব্যবহার করতে হয়েছে।’ বিশেষত, ১৯৭৬ সালে পূজাবার্ষিকী
আনন্দমেলায় প্রকাশিত ‘শঙ্কুর শনির দশা’ গল্পে তিনি নকল শঙ্কু - ‘শঙ্কু নাম্বার টু’-কে
বিলুপ্ত করতে ‘অ্যানাইহিলিন পিস্তল’ চালিয়েছিলেন। ১৯৮১ সালে
পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় প্রকাশিত ‘শঙ্কুর কঙ্গো অভিযান’ গল্পে প্রমাণিত হয় এই বিশেষ অস্ত্রটি জড় বস্তুর ওপর কাজ
করে না!
‘স্নাফ-গান’ বা
‘নস্যাস্ত্র’ প্রোফেসর শঙ্কুর দ্বারা
আবিষ্কৃত আরেকটি অভাবনীয় অস্ত্র। ঠিক মতো তাক করে প্রতিপক্ষের নাকের নীচে মারতে
পারলেই কেল্লা ফতে! একটানা তেত্রিশ ঘন্টা হেঁচে হেঁচে প্রতিপক্ষের প্রাণ যাবার
যোগাড় হবে! শঙ্কু মূলত তাঁর প্রতিপক্ষকে বোকা বানাতে এই অস্ত্রটি ব্যবহার করতেন।
তবে ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ গল্পে শঙ্কু প্রথমবার তাঁর বোকা চাকর প্রহ্লাদের ওপর রাগ
করে তার গোঁফের কাছে এটি প্রয়োগ করেছিলেন। এতে
যা হওয়ার তাই হল - বেচারা প্রহ্লাদ প্রায় তেত্রিশ ঘন্টা হেঁচেছিল! সেই গল্পের শেষ অধ্যায়ে টাফা
গ্রহের বাসিন্দা পিঁপড়ের মতো দেখতে এক প্রাণীর ওপর রাগ করে প্রাণীটির নাকের ফুটো
তাক করে সেই ‘নস্যির বন্দুক’ মেরেছিলেন শঙ্কু। কিন্তু তাতে
প্রাণীটির কিছুই হয়নি! কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ব্যোমযাত্রীর ডায়রিতে শঙ্কু
লিখেছেন, ‘হবে কী করে? এরা যে এখনও হাঁচতেই শেখেনি!’
প্রোফেসর শঙ্কুর আরেকটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি ‘কার্বোথিন বস্ত্র’। ১৯৬৫ সালের
মার্চ মাসে সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল’ গল্পে
শঙ্কু তাঁর ডায়রিতে লিখেছেন, ‘সেবার গিরিডিতে ঝড়ের মধ্যে আমার বাগানের গাছের
চারাগুলো বাঁচাতে গিয়ে কাছাকাছি একটা তালগাছে বাজ পড়ায় আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেম।
তারপরেই এই জামাটা আবিষ্কার করি এবং ২৪ ঘন্টা পরে থাকি।’ কার্বোথিন বস্ত্র বিদ্যুৎ
অপরিবাহী, তাই এর দ্বারা তৈরী জামা বৈদ্যুতিক শক থেকে সুরক্ষিত রাখে। সেই গল্পে
নরওয়েজীয় শিল্পী গ্রেগর লিন্ডকুইস্টের একটি অদ্ভুত ও নির্মম শখ ছিল। একটি ইলেকট্রনিক
মেশিনের সাহায্যে বিশ্ব বিখ্যাত মানুষদের তিনি ছ’ইঞ্চি লম্বা জ্যান্ত পুতুলে রূপান্তরিত
করতেন। শঙ্কুরও সেই হাল
করতে চেয়েছিলেন তিনি। গেঞ্জির
নীচে পরা কার্বোথিনের পাতলা জামাটা সেদিন তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।
প্রোফেসর শঙ্কু কয়েকটি অত্যাশ্চর্য ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর আবিষ্কৃত সর্বরোগনাশক বড়ি 'মিরাকিউরল'-এর কথা
এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কসৌলির জঙ্গল থেকে সংগৃহীত স্বর্ণপর্ণী বা সোনেপত্তী
নামক একটি আশ্চর্য গাছের হলদে পাতা থেকে 'মিরাকিউরল' নামক ঔষধ আবিষ্কারের কাহিনি আমরা পাই ‘স্বর্ণপর্ণী’ গল্পে। সেখানেই শঙ্কু জানিয়েছেন, ‘মিরাকিউরল’ নামটি
‘মিরাকল কিওর ফর অল কমপ্লেন্টস’ শব্দসমষ্টির ক্ষুদ্র সংস্করণ।
‘অ্যানাইহিলিন’ বড়িও আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। সে ওষুধ ২৭৭টি রোগ নিরাময় করে বলে
জানা যায়। ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ গল্পে তাঁর আবিষ্কৃত দুঃস্বপ্নের বড়ির উল্লেখ পাওয়া
যায়। এ ওষুধ খেলে খুব
হাই ওঠে, তারপর গভীর ঘুম হয় এবং
ঘুমের মধ্যে ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখা যায়। সেই গল্পটিতে
‘দুঃস্বপ্নের বড়ি’ আবিষ্কার প্রসঙ্গে শঙ্কু ডায়রিতে লিখেছেন, ‘মহাভারতের
জৃম্ভণাস্ত্র থেকেই আইডিয়াটা এসেছিল…’। এছাড়াও তিনি আবিষ্কার করেছেন ‘এয়ারকন্ডিশনিং পিল’ যা জিভের তলায় রাখলে শরীর শীতকালে গরম আর
গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা থাকে। এছাড়া রয়েছে ঘুমের অব্যর্থ বড়ি ‘সমনোলিন’, যা যে কোনও
পারিপার্শ্বিক অবস্থায় কাজ করে। বট ফলের রস থেকে শঙ্কু প্রস্তুত করেছেন এক
অসামান্য খাদ্য সম্পূরক -
‘বটিকা-ইণ্ডিকা’। ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ গল্পে মহাকাশ ভ্রমণের সময় খাদ্যের পরিবর্তে
এক মন ‘বটিকা-ইণ্ডিকা’ বড়ি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সেই
গল্পে শঙ্কু ডায়রিতে লিখেছেন, ‘বটিকা-ইন্ডিকার একটা হোমিওপ্যাথিক বড়ি খেলেই পুরো
চব্বিশ ঘন্টার জন্য খিদে তেষ্টা মিটে যায়।’ তাঁর আবিষ্কৃত তৃষ্ণানাশক বড়ির নাম ‘তৃষ্ণাশক বড়ি’। ১৯৬৪ সালে সন্দেশ পত্রিকার
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও ম্যাকাও’ গল্পে তাঁর
আবিষ্কৃত ‘অদৃশ্য হবার ওষুধ’-এর উল্লেখ মেলে। সেই ওষুধ সেবন করলে অন্তত ৫ ঘণ্টা
অদৃশ্য থাকা যায়। ১৯৮৮ সালে শারদীয় সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ডাঃ দানিয়েলির
আবিষ্কার’ গল্পে আমরা পেয়েছি, ইংরেজ লেখক রবার্ট লুই স্টিভেনসনের উপন্যাস ‘ডাঃ
জেকিল অ্যান্ড মিঃ হাইড’ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে শঙ্কু আবিষ্কার করেছিলেন দুটি ওষুধ
- ‘এক্স’ এবং ‘অ্যান্টি এক্স’। ‘এক্স’ ওষুধ খেলে মানুষের ভেতরের হীন প্রবৃত্তিগুলি
বাইরে বেরিয়ে এসে তাকে নৃশংস জীবে পরিণত করে। অ্যান্টিডোট ‘অ্যান্টি এক্স’ ওষুধ
খেলে মানুষ আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে। পোষা বিড়াল নিউটনকে এক ফোঁটা
করে এই ওষুধ দু’টি খাইয়ে তিনি বুঝেছেন পশুদের ওপর এই ওষুধ দু’টি একইভাবে কার্যকর।
শঙ্কু তাঁর পোষা বেড়াল নিউটনের জন্য বানিয়েছেন ‘ফিশ পিল’। ‘ব্যোমযাত্রীর
ডায়রি’ গল্পে মহাকাশ ভ্রমণের সময় নিউটনের জন্য খাদ্যের পরিবর্তে তিনি ফিশ পিল সঙ্গে
নিয়ে গিয়েছিলেন। একটা ফিশ পিল খেলে নিউটনের সাত দিনের খাওয়া হয়ে যায়। সেই গল্পে
মহাকাশ যাত্রার আগে শঙ্কু ডায়রিতে লিখেছেন, ‘কাল ওকে Fish Pill-টা খাওয়ালাম। মহা খুশি। আজ মাছের
মুড়ো আর বড়ি পাশাপাশি রেখে পরীক্ষা করে দেখলাম। ও বড়িটাই খেল।’ পরবর্তীতে আবারও
নিউটনের কথা ভেবে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন ‘মার্জারিন’। এটি এমন একটি ওষুধ যা
বেড়ালের আয়ু বৃদ্ধি করে। ‘স্বর্ণপর্ণী’ গল্পে শঙ্কু ডায়রিতে লিখেছেন, ‘বৃদ্ধ নিউটন
আমার পায়ের পাশে কুন্ডলী পাকিয়ে বসে ঘুমোচ্ছে। ওর বয়স হল চব্বিশ। বেড়াল সাধারণত
চোদ্দো-পনেরো বছর বাঁচে; যদিও কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিশ বছর বেঁচেছে এমনও শোনা গেছে।
নিউটন যে এত বছর বেঁচে আছে তার কারণ হল আমার তৈরি ওষুধ মার্জারিন।’
প্রোফেসর শঙ্কুর কৃতিত্বের ঝোলায় রয়েছে বেশ কয়েকটি সংকর প্রজাতির ফল, যা তিনি বিভিন্ন
ধরনের উদ্ভিদের মধ্যে সংকর প্রজননের মাধ্যমে উদ্ভাবন করেছেন। যেমন, আম ও কমলার
বৈশিষ্ট্যযুক্ত ফল- ম্যাঙ্গোরেঞ্জ (ম্যাঙ্গো+ওরেঞ্জ), যার বাংলা নাম আমলা
(আম+কমলা)। বিশেষ করে আম ও আমলার বৈশিষ্ট্যযুক্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর
সংকর ফল - ম্যাঙ্গোলা উদ্ভাবনের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে সুইডিশ একাডেমি অব সাইন্স
কর্তৃক সাম্মানিক ডক্টরেট প্রদান করা হয়।
এই আদ্যন্ত বাঙালি বিজ্ঞানী বহু বিস্ময়কর যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। সেই
যন্ত্রগুলির অধিকাংশই অদ্ভুত স্বভাব ও বিচিত্র নামের অধিকারী, যা শঙ্কু সিরিজের
গল্পগুলিকে এক অভিনব আনন্দরসে সিঞ্চিত করেছে। ১৯৭২ সালে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায়
প্রকাশিত ‘কর্ভাস’ গল্প পড়ে জানা যায়, পাখি সম্পর্কে অগাধ কৌতূহল থেকেই শঙ্কু আবিষ্কার
করেছিলেন একটি পাখিপড়ানো যন্ত্র, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘অরনিথন’। ঘটনাক্রমে সেই যন্ত্রের সাহায্যে একটি কাক, শঙ্কু যার নামকরণ করেছিলেন ‘কর্ভাস’, শিক্ষিত হয়ে ওঠার সুযোগ পায় এবং নানান মানবীয়
দক্ষতা অর্জন করে। পরবর্তীতে
চিলির রাজধানী সান্তিয়াগো শহরে সারা বিশ্বের পক্ষীবিজ্ঞানীদের একটা সম্মেলনে সেই পাখিটি
শঙ্কুর সঙ্গে যোগ দিয়ে প্রভূত প্রশংসা কুড়োয়। তাঁর আরেকটি অনবদ্য আবিষ্কার ‘লিঙ্গুয়াগ্রাফ’ যন্ত্র,
যা পৃথিবীর যে কোনও ভাষাকে অনায়াসে অন্য ভাষায় অনুবাদ করে। শঙ্কুর আরেকটি অসাধারণ আবিষ্কার ‘রিমেমব্রেন’ যন্ত্র, যা
কোনও ব্যক্তির লুপ্ত স্মৃতি পুনরুদ্ধারে অত্যন্ত কার্যকর। ১৯৭৪ সালে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় প্রকাশিত ‘ডক্টর
শেরিং-এর স্মরণশক্তি’ গল্পে শঙ্কু ডায়রিতে লিখেছেন, ‘ব্রেন বা মস্তিষ্ককে যে
যন্ত্র রিমেম্বার বা স্মরণ করতে সাহায্য করে’। সেখানেই তিনি যন্ত্রটির বর্ণনা দিতে
গিয়ে লিখেছেন, ‘জিনিসটা বাইরে থেকে দেখতে তেমন কিছুই নয়; মনে হবে যেন হাল
ফ্যাশানের একটা টুপি বা হেলমেট। এই হেলমেটের খোলের ভিতর রয়েছে বাহাত্তর হাজার
সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তারের জটিল স্নায়বিক বিস্তার।’ শঙ্কু এই
যন্ত্রটি ব্যবহার করে অস্ট্রিয়ার বিজ্ঞানী ডক্টর হিয়েরোনিমাস শেরিং-এর মস্তিষ্কে
লুকিয়ে থাকা হারানো স্মৃতিতে এক বিপদজনক ষড়যন্ত্রের খোঁজ পেয়েছিলেন। এছাড়াও তাঁর
আবিষ্কারের তালিকায় রয়েছে ‘লুমিনিম্যাক্স’ নামে একটি ছোটো গোলক যা প্রজ্বলিত
অবস্থায় ২০০ ওয়াট শক্তিতে আলো দেয়। ‘স্বর্ণপর্ণী’ গল্পে শঙ্কু ডায়রিতে লিখেছেন,
‘অতি সস্তায় উজ্জ্বল আলো দেবার জন্য লুমিনিম্যাক্স’।
কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে সর্বদাই এমন বহু বৈজ্ঞানিক তথ্য বা অগ্রগতির কথা বর্ণিত
হয়, যার বাস্তব অস্তিত্ব হয়তো সেই সাহিত্য রচনার সময়কালে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু
সেই সাহিত্যগুলির কাল্পনিক বিষয়বস্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভবিষ্যতে কোন একদিন
বাস্তবে রূপান্তরিত হবার উজ্জ্বল সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ থাকে। তেমনই প্রোফেসর শঙ্কুর
আবিষ্কৃত ‘রকেট’ ও ‘রোবট’ আজকের অত্যাধুনিক রকেট ও রোবটের পূর্বসুরী। ‘ব্যোমযাত্রীর
ডায়রি’ গল্পে আমরা দেখেছি, একবিংশ শতাব্দীর যন্ত্রিক মঙ্গল অভিযানের অনেক আগেই শঙ্কু
তাঁর নিজের তৈরি রকেটে চেপে মঙ্গল অভিযানে গিয়ে সফলভাবে মঙ্গল গ্রহের মাটিতে পা রেখেছিলেন। সেই গল্পে শঙ্কু তাঁর ডায়রিতে রকেট প্রস্তুতি
প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘জিনিসটা যে কোনও সাধারণ ধাতু দিয়ে তৈরি হতে পারে না, সেটা
প্রথমেই বুঝেছিলেম। অনেক এক্সপেরিমেন্ট করার পর ব্যাঙের ছাতা, সাপের খোলস আর
কচ্ছপের ডিমের খোলা মিশিয়ে একটা কমপাউন্ড তৈরি করেছি,...’। অবশেষে সেই কমপাউন্ডের সঙ্গে
‘একুইয়স্ ভেলোসিলিকা’ মিশিয়ে তৈরি হয়েছিল রকেট বানানোর ধাতু। পরবর্তীতে শঙ্কুর
মহাকাশ ভ্রমণকালে আমরা দেখেছি সেই রকেট বিপদ বুঝে নিজেই চালু হয়ে মঙ্গল গ্রহ থেকে
উড়ে যায়। এমনকি মহাকাশের গোলাকৃতি এবড়োখেবড়ো জ্বলন্ত পাথরের চাঁইয়ের ফাঁক দিয়ে
সংঘাত বাঁচিয়ে নিজস্ব দক্ষতায় নিজের পথ বেছে নিয়ে বিদ্যুৎবেগে অভীষ্ট লক্ষ্য টাফা
গ্রহে উড়ে যায় সেই রকেট!
প্রোফেসর শঙ্কু আবিষ্কৃত দুটি রোবট - ‘বিধুশেখর’ ও ‘রোবু’। ‘ব্যোমযাত্রীর
ডায়রি’ গল্পে পাঁচ মণ ওজনের বিধুশেখর ছিল শঙ্কুর মহাকাশ অভিযানের সঙ্গী।
বিধুশেখরের সৃষ্টিকর্তা হলেও প্রথমে শঙ্কু ভেবেছিলেন, সে শুধুমাত্র একজন ‘কলকব্জার
মানুষ’। পরে বিধুশেখর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে শুরু করে। সেই গল্পে তাই
শঙ্কু ডায়রিতে লিখেছেন, ‘ও তো আমারই হাতে তৈরি, তাই আমি জানি ওর কতখানি ক্ষমতা।
আমি জানি ওর নিজস্ব বুদ্ধি বা চিন্তাশক্তি বলে কিছু থাকতেই পারে না। কিন্তু
বেশ কিছুদিন থেকেই মাঝে মাঝে এর ব্যতিক্রম লক্ষ করছি।’ ক্রমশ বিধুশেখরের আশ্চর্য
গুণাবলী প্রকাশ পায়। বোঝা যায়, তার তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তি রয়েছে। সেই সঙ্গে
বিপদের পূর্বানুমান করবার এবং শত্রুর সঙ্গে বীরের মতো লড়াই করবার ক্ষমতাও রয়েছে
তার। এছাড়াও সে স্পষ্ট উচ্চারণে চলিত ও সাধু বাংলায় কথা বলে, দ্বিজু রায়ের গান
‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’ গুনগুন করে গায়, মহাভারতের ঘটৎকচ বধের
অংশ আবৃত্তি করে, মহাজাগতিক সৌন্দর্য দেখে সে বলে ওঠে ‘বাহবা, বাহবা, বাহবা!’
শঙ্কু তাই ডায়রিতে লিখেছেন, ‘আমি আগেও অনেকবার দেখেছি যে আমার বৈজ্ঞানিক
বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে আমি যে জিনিস তৈরি করি, সেগুলো অনেক সময়েই আমার হিসেবের বেশি
কাজ করে।’
প্রোফেসর শঙ্কুর দ্বারা সৃষ্ট আরেকটি অভিনব রোবট ‘রোবু’। ১৯৬৮ সালে সন্দেশ
পত্রিকার ফেব্রুয়ারী-মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু’ গল্পে রোবুর
বর্ণনা দিতে গিয়ে শঙ্কু ডায়রিতে লিখেছেন, ‘রোবুর চেহারাটা যে খুব সুশ্রী হয়েছে তা
বলতে পারি না। বিশেষ করে দুটো চোখ দু’রকম হয়ে যাওয়াতে ট্যারা বলে মনে হয়। সেটাকে
ব্যালেন্স করার জন্য আমি রোবুর মুখে একটা হাসি দিয়ে দিয়েছি।’ রোবুকে বানাতে শঙ্কুর
খরচ হয়েছিল মাত্র তিনশো তেত্রিশ টাকা সাড়ে সাত আনা - যা শঙ্কুর ভাষায় ‘জলের দরে
পাওয়া’। রোবু নিজের পরিচয় দেয়, ‘আমি যান্ত্রিক মানুষ। প্রোফেসর
শঙ্কুর সহকারী’। রোবুর গণিতের পারদর্শিতা বিষয়ে শঙ্কু ডায়রিতে লিখেছেন, ‘সাধারণ
যোগ বিয়োগ গুণ ভাগের অঙ্ক কষতে রোবুর লাগে এক সেকেন্ডের কম সময়। এমন কোনও কঠিন
অঙ্ক নেই যেটা করতে ওর দশ সেকেন্ডের বেশি লাগবে।’ ডায়রিতে তিনি আরও লিখেছেন, ‘অঙ্ক
সব রকমই পারে, তবে শেখানো কাজের বাইরে কাজ করে না...’। কিন্তু
‘প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু’ গল্পে শঙ্কুর এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছিল রোবু। সে
এক অপ্রত্যাশিত আশ্চর্য উপায়ে বিজ্ঞানী গটফ্রীড বোর্গেল্ট আবিষ্কৃত, পুরোপুরি স্রষ্টার
অনুরূপ চেহারাবিশিষ্ট, রোবটের হাত থেকে শঙ্কুর প্রাণ বাঁচিয়েছিল।
জাপানের বিখ্যাত ইলেকট্রনিক্স বিজ্ঞানী মাৎসুয়ের পরিকল্পনায়, প্রোফেসর শঙ্কু
সহ পৃথিবীর পাঁচটি মহাদেশের আরও ছয় জন পন্ডিত ব্যক্তির সহায়তায়, এবং জাপানের
ওসাকার নামুরা টেকনলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের জাপানী কর্মীদের সাত বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে,
তৈরি হয়েছিল ‘কম্পু’ নামে এক যান্ত্রিক মস্তিষ্ক। ‘কম্পু’ নামটি শঙ্কুরই দেওয়া।
শঙ্কুর ভাষায় কম্পু একটি ‘প্ল্যাটিনামে আচ্ছাদিত আশ্চর্য সুন্দর মসৃণ গোলক’। ১৯৭৮
সালে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় প্রকাশিত ‘কম্পু’ গল্পে শঙ্কু ডায়রিতে লিখেছেন,
‘আমাদের তৈরি যান্ত্রিক মস্তিষ্কের ভিতর পোরা আছে দশ কোটি সার্কিট, যার সাহায্যে
যন্ত্র কাজ করে। ...এখানে বলে রাখি, আমাদের কম্পিউটার অঙ্ক কষে না। এর কাজ হল
যে-সব প্রশ্নের উত্তর জানতে বিশ্বকোষ বা এনসাইক্লোপিডিয়ার শরণাপন্ন হতে হয়, সেই সব
প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। আরও একটা বিশেষত্ব এই যে, এই উত্তর অন্য কম্পিউটারের মতো
লিখিত উত্তর নয়; কম্পু উত্তর দেয় কথা বলে।’ শঙ্কু ডায়রিতে আরও লিখেছেন, ‘কম্পুর
যেটা ক্ষমতার বাইরে সেটা হল চিন্তাশক্তি, অনুভবশক্তি আর অলৌকিক শক্তি।’ তবে জাপানে
এক প্রচন্ড ভূমিকম্পের পর কম্পু অকস্মাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা লাভ করে এবং শঙ্কুর
ধারণাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে। পরে তাই শঙ্কু ডায়রিতে লিখেছেন, ‘যে-কারণেই হোক,
কম্পু আর সে-কম্পু নেই। মানুষের দেওয়া ক্ষমতাকে সে কোনও অজ্ঞাত উপায়ে অতিক্রম করে
গেছে।’
পোষা বেড়াল নিউটনকে কোলে নিয়ে প্রতিবেশী অবিনাশবাবু এবং নকুড়বাবুর সঙ্গে প্রফেসর শঙ্কু, পেছনে ভৃত্য প্রহ্লাদ |
১৯৭৭ সালে সন্দেশ পত্রিকার এপ্রিল-জুন সংখ্যায় প্রকাশিত ‘শঙ্কুর সুবর্ণ সুযোগ’
গল্পে প্রোফেসর শঙ্কু তাঁর দুই বন্ধু সন্ডার্স ও ক্রোলের সাহায্যে ত্রয়োদশ
শতাব্দীর স্প্যানিশ অ্যালকেমিস্ট মানুয়েল সাভেদ্রার সোনা তৈরির ফরমুলা অনুসরণ করে
একটি অ্যালকেমিক্যাল তরল প্রস্তুত করেছিলেন যা জীবন্ত প্রাণীকে খাঁটি সোনার জড়
মূর্তিতে রূপান্তরিত করে। ১৯৮৬ সালে শারদীয় সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘নেফ্রুদেৎ-এর সমাধি’ গল্পে প্রাচীনকালের মিশরীয়
পুরোহিত ও জাদুকর নেফ্রুদেৎ-এর হিরে প্রস্তুত করবার ফরমুলা অবলম্বন করে শঙ্কু,
তাঁর বন্ধু ক্রোল ও মিশরীয় প্রত্নতাত্ত্বিক ডাঃ আবদুল সিদ্দিকি টানা উনিশ ঘন্টা গবেষণাগারে
কাজ করে তৈরি করেছিলেন এক কৃত্রিম হিরে, যার আয়তন প্রায় বিশ্বখ্যাত কোহিনূর হিরের
সমান! ১৯৮৮ সালে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় প্রকাশিত ‘শঙ্কু ও ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’
গল্পে অষ্টাদশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আবিষ্কৃত মরা-মানুষকে-বাঁচিয়ে-তোলার
ফরমুলায় প্রয়োজন মতো পরিবর্তন করে প্রোফেসর শঙ্কু আবিষ্কার করেন এক নতুন ফরমুলা,
শঙ্কু যার নাম দিয়েছিলেন ‘শঙ্কু-ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন ফরমুলা’। জার্মানির ইনগোলস্টাটে
বন্ধু সান্ডার্স, ক্রোল ও দু’জন স্থানীয় সহকর্মীর সাহায্যে সাড়ে সাত ঘণ্টার
অক্লান্ত পরিশ্রমের পর প্রোফেসর শঙ্কু বিখ্যাত ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডাঃ টমাস গিলেটের
মৃতদেহে প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়েছিলেন!
কখনও আবার প্রোফেসর শঙ্কু পৃথিবীর মাটিতে অচেনা আশ্চর্য প্রাণীর খোঁজ পেয়েছেন।
১৯৮৩ সালে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় প্রকাশিত ‘আশ্চর্যন্তু’ গল্পে চাকর প্রহ্লাদ
প্রোফেসর শঙ্কুকে এনে দিয়েছিল এক বিচিত্র জীব। শঙ্কু সেই ‘আনকোরা নতুন শ্রেণীর জানোয়ার’-টির
নামকরণ করেন ‘ইয়ে’। সেই গল্পে শঙ্কু ডায়রিতে লিখেছেন, ‘বদলে-যাওয়া পরিবেশের সঙ্গে
দ্রুত খাপ খাইয়ে নেবার আশ্চর্য স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে এ-জন্তুর। ...শত্রুকে পরাস্ত
করার অদ্ভুত ক্ষমতা প্রকৃতি এই জানোয়ারকে দিয়েছে’। গোখরো সাপকে আক্রমণের সময় ইয়ের
সাময়িকভাবে তীক্ষ্ণ শ্ব-দন্ত ও তীক্ষ্ণ নখ গজায়। ঠান্ডার প্রকোপ থেকে বাঁচতে ইয়ের
সর্বাঙ্গে হঠাৎ প্রায় তিন ইঞ্চি লম্বা লোম গজিয়ে যায়। কুকুরের আক্রমণ থেকে বাঁচতে
তার মাথা থেকে পা ধবধবে সাদা হয়ে বরফে মিশে যায়। শেষমেশ, লোভী দুষ্ট মানুষের হাত
থেকে বাঁচতে ‘ক্রমবিবর্তনের অমোঘ নিয়ম লঙ্ঘন করে’ আচমকা গজানো দু’টি ডানা মেলে সে
উড়ে যায় আকাশে! ১৯৮৯ সালে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় প্রকাশিত ‘ডন ক্রিস্টোবাল্ডির
ভবিষ্যদবাণী’ গল্পে ১৪৮৩ সাল থেকে ১৪৯০ সালের মধ্যে লেখা ডন ক্রিস্টোবাল্ডির
ভবিষ্যদবাণীর সত্যতা প্রমাণের উদ্দেশ্যে শঙ্কু ও আরও চারজন বিজ্ঞানী পাড়ি
দিয়েছিলেন এক রহস্যময় দ্বীপে। সেখানে মাটির নীচে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন
‘নোভোপলিস’ নামে শহরে থাকে মানুষ থেকে দু’হাজার বছর এগিয়ে থাকা প্রাণী
‘অটোপ্লাজম’। ইচ্ছাশক্তি ও রসায়নের সাহায্যে এই ‘বিকটদর্শন, চোখ-সর্বস্ব, দাঁত-সর্বস্ব,
নখ-সর্বস্ব’ অহিংস প্রাণী প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে গড়ে তুলেছে এক আজব সাম্রাজ্য।
তবে শঙ্কু ডায়রিতে লিখেছেন, ‘আমি অনেক ভেবে একটা সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছি। সেটা হল -
এরা যদি সত্যিই মানুষ না হয়, তা হলে এরা যতই উন্নত প্রাণী হোক না কেন, সুখ দুঃখ
সকাল সন্ধ্যা চন্দ্র সূর্য ফুল ফল রঙ রস খেলাধুলা পশু পাখি নিয়ে মানুষই ভালো’।
গ্রহ-তারায় ভরা এই অনন্ত মহাকাশ সবসময়ই প্রোফেসর শঙ্কুকে আকর্ষণ করেছে। তিনি
বিশ্বাস করেন, পৃথিবীই একমাত্র স্থান নয় যেখানে জীবন আছে, আমাদের সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহেও ভিন্নরূপে
প্রাণের স্পন্দন রয়েছে। তাই ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ গল্পে তিনি ডায়রিতে
লিখেছেন, ‘বাইরের কোনও জগতের প্রতি আমার যেন একটা টান আছে, এই টানটা লিখে বোঝানো
শক্ত’। তবে অন্যান্য গ্রহগুলি বিষয়ে তার আগ্রহ সম্পূর্ণভাবে জ্ঞান আহরণের জন্য। তাই ভিনগ্রহীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে নতুন জ্ঞানের
আলোকে তিনি রোমাঞ্চিত হয়েছেন বার বার। ১৯৭৯
সালে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় প্রকাশিত ‘মহাকাশের দূত’ গল্পে শঙ্কু মিশর অভিযানে গিয়ে
ভিনগ্রহ থেকে আসা একটি পিরামিড আকৃতির ‘অনির্দিষ্ট উড়ন্ত বস্তু’ দেখতে পান। এই অদৃশ্য উন্নত ভিনগ্রহীরা কিন্তু মোটেই ক্ষতিকারক
নয়, বরং তারা মনে করে মানবজাতির অগ্রগতির প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে সঠিক
পথনির্দেশ করা তাদের মহান কর্তব্য। ভিনগ্রহীরা শঙ্কুকে
দিয়ে
গিয়েছিল
‘একটি
দেদীপ্যমান
প্রস্তরখণ্ড’, যার আয়তন একটি
মটরদানার
অর্ধেক। সেই
আশ্চর্য পাথরের
মধ্যে
নাকি
ধরা
আছে ‘মানবজাতির চারটি প্রধান সংকটের সমাধান’ আর ‘পৃথিবীর পঁয়ষট্টি হাজার বছরের ইতিহাস’। শঙ্কু
তাই ডায়রিতে লিখেছেন, ‘রাতের অন্ধকারে যখন বিছানায়
শুয়ে
এটার
দিকে
দেখি, তখন এই অপার্থিব রত্নখন্ড থেকে
বিচ্ছুরিত নীলাভ আলো আমাকে আজীবন অক্লান্ত গবেষণার সাহায্যে মানুষের মনের অন্ধকার দূর
করার
প্রেরণা
জোগায়’। সত্যি কথা
বলতে কী, শঙ্কু তো আজীবন মানুষের মনের অন্ধকার দূর
করতেই
চেয়েছিলেন।
এদিকে ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’
গল্পে প্রোফেসর শঙ্কু যে ভিনগ্রহী প্রাণীদের দেখা পেয়েছিলেন তারা কিন্তু মানুষের
তুলনায় অনেক অনুন্নত। তবে তাই বলে যে তারা অহিংসাকেই পরম ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছে
তা বলা যায় না। মঙ্গল গ্রহে গিয়ে শঙ্কু এক দল আজব মঙ্গলীয় প্রাণীর পাল্লায়
পড়েছিলেন। তারা ‘না-মানুষ, না-জন্তু, না-মাছ’। ডায়রিতে শঙ্কু লিখেছেন, ‘লম্বায় তিন
হাতের বেশি নয়, পা আছে, কিন্তু হাতের বদলে মাছের মতো ডানা, বিরাট মাথায় মুখজোড়া দন্তহীন
হাঁ, ঠিক মাঝখানে প্রকান্ড একটা সবুজ চোখ, আর সর্বাঙ্গে মাছের মতো আঁশ সকালের রোদে
চিকচিক করছে। ...তাদের মুখ দিয়ে সেই বিকট ঝিঁঝিঁর শব্দ – তিন্তিড়ি! তিন্তিড়ি!...’।
প্রায় এক হাজার হিংস্র মঙ্গলীয় সৈন্যের তাড়া খেয়ে শঙ্কু পালিয়ে এসেছিলেন টাফা
গ্রহে। সেখানকার বাসিন্দাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে শঙ্কু ডায়রিতে লিখেছেন, ‘...এরা
আসলে মোটেই মানুষের মতো নয়। অতিকায় পিঁপড়ে জাতীয় একটা কিছু কল্পনা করতে পারলে এদের
চেহারার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যাবে। বিরাট মাথা, আর চোখ, কিন্তু সেই অনুপাতে হাত-পা
সরু - যেন কোনও কাজেই লাগে না’। শঙ্কু এদের ‘মূর্খ’ বললেও এরা কিন্তু শঙ্কুকে খুব
যত্নে রেখেছিল।
বৈজ্ঞানিক বন্ধুদ্বয় জেরেমি সন্ডার্স এবং উইলহেলম ক্রোলের মাঝে প্রফেসর শঙ্কু |
শঙ্কুর সত্য সন্ধানের এই অভিযান শুধুমাত্র যুক্তিবাদী বিজ্ঞানের পরিধির মধ্যেই
সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাঁর অভিযানগুলিতে প্রাকৃত ও অপ্রাকৃতের এক আশ্চর্য মিশেল
চোখে পড়ে। ভূত দেখার ইচ্ছে প্রবল হয়ে ওঠায় শঙ্কু ভূত দেখার যন্ত্র ‘নিও-স্পেকট্রোস্কোপ’ আবিষ্কার করেছিলেন। সেই
যন্ত্রের সাহায্যে বিদেহী আত্মাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। ১৯৬৬ সালে
শারদীয় আশ্চর্য পত্রিকায় প্রকাশিত ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও ভূত’ গল্প পড়ে আমরা জানতে
পারি, ১১৩২ সনে মৃত অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ তান্ত্রিক বটুকেশ্বর শঙ্কুর সঙ্গে কথোপকথন
ও করমর্দন করতে সক্ষম হয়েছিলেন শঙ্কু। ১৯৮৭ সালে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় প্রকাশিত
‘শঙ্কুর পরলোকচর্চা’ গল্পে পরলোকচর্চা করার জন্য শঙ্কু বানিয়ে ফেলেন ‘কম্পিউডিয়াম’। ‘ভূতপ্রেত
প্ল্যানচেট টেলিপ্যাথি ক্লেয়ারভয়েন্স— এ সবই যে একদিন বিজ্ঞানের আওতায় এসে পড়বে এ বিশ্বাস আমার
অনেক দিন থেকেই আছে।’ — ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও ভূত’ গল্পে
শঙ্কুর এই স্বীকারোক্তি অনেকের পক্ষেই
অস্বস্তিদায়ক। শঙ্কুর এই বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ইহবাদী ও প্রত্যক্ষ
যুক্তিবাদীদের বিরোধ অনিবার্য। আসলে এই অবাক করা জগৎকে নানা দৃষ্টকোণ থেকে বোঝার
চেষ্টা করেছেন শঙ্কু। বিস্ময়ের ম্যাজিকই তার কাছে বিজ্ঞানের প্রগতির দিশারি।
তাই তো তিনি ‘আশ্চর্জন্তু’ গল্পে তাঁর ডায়রিতে লিখেছিলেন, ‘এমন কিছু থাকুক যা
মানুষের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করতে পারে, বিস্ময় জাগিয়ে তুলতে পারে’!
আধুনিক মানুষ মনে করে সভ্যতার ইতিহাস বুঝি কেবলমাত্র এগিয়ে যাওয়ারই ইতিহাস। এই
ভাবনারও বিরোধিতা করেন শঙ্কু। শঙ্কুর বিভিন্ন অভিযান মাঝে মাঝেই সুদূর অতীতে হানা
দিয়ে যায়। অতীত সভ্যতার নানা আবিষ্কার আর উপাদানের মুখোমুখি হন তিনি। সেই অতীত
শুধু পাশ্চাত্যের অতীত নয় —প্রাচ্যের
অতীতও। ‘শঙ্কু ও ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ গল্পে জার্মানির ইনগোলস্টাটে
ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের বিশাল গবেষণাগারে দেড়শো বছরের পুরোনো যন্ত্রপাতি ও
ডায়রি দেখে মুগ্ধ, বিস্মিত হয়েছিলেন শঙ্কু। তাই ডায়রিতে
লিখেছিলেন, ‘এতকাল আগে একজন
বৈজ্ঞানিকের দ্বারা এই কীর্তি সম্ভব হয়েছিল। ভাবতেও অবাক লাগে’। ১৯৭০ সালে সন্দেশ
পত্রিকার মার্চ-এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও বাগদাদের বাক্স’ গল্পে চার হাজার বছর আগে জাদুকর-বিজ্ঞানী গেলাম নিশাহি অল্ হারারিৎ-এর তোলা এক চলচ্চিত্র দেখে শঙ্কু তার ডায়রিতে লিখেছিলেন,
‘ধন্য হারুণ-অল্-রশিদের বাগদাদ্! ধন্য সুমেরীয় সভ্যতা! ধন্য বিজ্ঞানের মহিমা! ধন্য গেমাল নিশাহির অল্ হারারিৎ!
আমার এ উল্লাসের কারণ আর কিছুই না –
আজ একটি এমন বৈজ্ঞানিক প্রতিভার পরিচয়
পেয়েছি যার কাছে আমাদের কৃতিত্ব একেবারে ম্লান হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়’। আধুনিক
সভ্যতা প্রাচীন সভ্যতার থেকে অনেক এগিয়ে আছে, এমন না ভেবে শঙ্কু প্রাচীন সভ্যতার
সামনে নত হয়েছেন বারবার। ১৯৬৯ সালের মে মাসে সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত
‘প্রোফেসর শঙ্কু ও কোচাবাম্বার গুহা’ গল্পে, কোচাবাম্বার গুহায় পঞ্চাশ হাজার বছর
বয়সি এক প্রাগৈতিহাসিক গুহামানবকে দেখেছিলেন শঙ্কু — সেই মানুষ আশ্চর্য অফুরন্ত আয়ুর অধিকারী,
‘হাজার হাজার বছর ধরে জ্ঞান সঞ্চয় করে
চলেছে’ সে!
আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী মহলে প্রোফেসর শঙ্কু অত্যন্ত সম্মানিত। বিজ্ঞানী হিসেবে
তাঁর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। সুইডিশ আকাদেমি অফ সায়েন্স তাঁকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেছে। ব্রাজিলের রাটানটান ইনস্টিটিউট থেকে পেয়েছেন ডক্টরেট। নিজেকে তাঁর সময়কালের বিশ্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী বলে
দাবি করেছেন তিনি। ‘মহাকাশের দূত’ গল্পে তিনি ডায়রিতে লিখেছেন, ‘বিজ্ঞানের সব
শাখা প্রশাখায় আমার অবাধ গতি বলে আমি নিজেকে সব সময় বৈজ্ঞানিক বলেই বলে এসেছি,
কোনও একটা বিষয়ে বিশেষজ্ঞতার দাবি করিনি’। ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও বাগদাদের বাক্স’
গল্পে তিনি ডায়রিতে লিখেছেন, ‘পৃথিবীর কোনও একজন বৈজ্ঞানিক এর আগে আর কখনও এতরকম
জিনিস আবিষ্কার করেনি’। ‘স্বর্ণপর্ণী’ গল্পে তিনি ডায়রিতে লিখেছেন, ‘কোনও ভারতীয় বিজ্ঞানী
দেশে-বিদেশে এত সম্মান পেয়েছে বলে তো মনে হয় না। আমার খ্যাতি প্রধানত ইনভেন্টর বা
আবিষ্কারক হিসেবে। এ ব্যাপারে টমাস অ্যালভা এডিসনের পরেই যে আমার স্থান, সেটা
পাঁচটি মহাদেশেই স্বীকৃত হয়েছে’। তবুও শঙ্কু
খ্যাতি এবং সম্পদ সম্পর্কে উদাসীন।
তাই তিনি অনায়াসে বলতে পারেন, ‘বৈভবের প্রতি আমার কোনও আকর্ষণ নেই। আমি মোটামুটি
স্বচ্ছন্দে সাধারণ জীবনযাপন করতে পারলেই খুশি’। আর সে কারণেই যখন তাঁর ব্রিটিশ বন্ধু
জেরেমি সন্ডার্স তাঁকে মিরাকিউরলের জন্য পেটেন্ট নেবার প্রলোভন দেখিয়েছিলেন, শঙ্কু তখন খ্যাতির লোভের উর্ধ্বে উঠে বলেছিলেন,
‘এই ঔষধের ব্যাপারে আমি যদি কিছু করে থাকি, সেটা হল এই গাছটাকে
খুঁজে বের করা। সেটাও সম্ভব হয়েছে কারণ আরেকজন (সাধু টিকরি বাবা) নির্দেশ দিয়েছিল
বলে। আর এর যে গুণ, সে তো প্রকৃতির অবদান। তুমি প্রাইজ দেবে কাকে?’ এমন অসাধারণ
প্রতিভাধর শঙ্কু
একজন নম্র প্রকৃতির মানুষ, যার
মধ্যে ‘একটি
ঋষিসুলভ স্থৈর্য ও
সংযম’ আছে। এই
ঋষিসুলভ বিচক্ষণতায় শঙ্কু তাই ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু’ গল্পে গণিত পারদর্শী রোবট ‘রোবু’ উদ্ভাবনের সম্পূর্ণ
কৃতিত্ব নিতে অস্বীকার করেন। একজন দার্শনিকের মতো, তিনি তার সাফল্যকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন,
‘......কোনও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকেই আমি
সম্পূর্ণ মানুষের সৃষ্টি বলে মনে করতে পারি না। সম্ভাবনাটা আগে থেকেই থাকে, হয়তো
চিরকালই ছিল; মানুষ কেবল হয় বুদ্ধির জোরে না হয় ভাগ্যবলে সেই সম্ভাবনাগুলোর হদিস পেয়ে
সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে নেয়’।
প্রোফেসর শঙ্কু বিশ্বাস করেন,
মানুষের জ্ঞানের পরিধি আজও বড়ো সীমিত। বিজ্ঞানের জগতে মানুষ আজও শিশু। ‘কম্পু’
গল্পে জাপানের ওসাকায় বসে ডায়রিতে তিনি লিখেছেন, ‘বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগেও স্বীকার
করতেই হবে যে, মানুষ যত না জানে, তার চেয়ে জানে না অনেক বেশি’। তাই
শঙ্কু ডায়রিতে লিখেছিলেন,
‘জটিল যন্ত্র তৈরির ব্যাপারে এখনও প্রকৃতির ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি মানুষ।’ তবু
মানুষের লোভের সীমা নেই। শঙ্কু সিরিজের সব গল্পেই আমরা দেখি,
লোভীরা ‘অপর’ মানুষকে, প্রকৃতিকে
নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করতে দখল করতে চায়। ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু’ গল্পে তিনি তাই
ডায়রিতে লিখেছেন, ‘বৈজ্ঞানিকেরা সম্মানের যোগ্য হলেও, তাঁরা সকলেই বিশ্বাসের যোগ্য
নন’। ‘মানুষের সব-জেনে-ফেলার লোভের একটা সীমা থাকা উচিত’ -
‘আশ্চর্জন্তু’ গল্পে ডায়রিতে লিখেছিলেন শঙ্কু।
কিন্তু জানাটা
তো জরুরি। জানার যুক্তিতেই তো অন্যের জুলুম খণ্ডন করা যায়। তাহলে? আসলে শঙ্কু
বলতে চেয়েছেন,
জানার অহমিকা ভালো নয়। যে জানার বাসনা মানবকে দানব করে তোলে, প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে, সেই জ্ঞানের লোভ আর অহমিকা থেকে দূরে থাকা চাই।
শঙ্কু একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। পিতার পরামর্শ মেনে তিনি সারা জীবন
দরিদ্র-নিঃস্ব মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের চেষ্টা করেছেন। তিনি বিজ্ঞান সাধনায়
নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং এইভাবে মানুষের অন্ধকার, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনকে আলোকিত করতে চেয়েছেন।
বিজ্ঞানকে মানব কল্যাণে প্রয়োগ করেছেন আজীবন। তিনি একজন মহান মানবতাবাদী এবং
সভ্যতার শত্রুদের জন্য তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে বহুবার। তিনি 'স্বর্নপর্ণী' গল্পে হিটলারের শাসনের প্রতি ঘৃণা
প্রকাশ করেছিলেন এবং খোলাখুলিভাবে নাজিদের সমালোচনা করেছেন। নিজের জীবনের ঝুঁকি
নিয়ে তিনি একজন জার্মান সংস্কৃত পণ্ডিত হাইনরিখ স্টাইনারকে নিরাপদে জার্মানি থেকে
পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন।
এহেন অতিমানবীয় ক্ষমতার অধিকারী শঙ্কু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, পাশ্চাত্যের মতোই
ভারতীয়রাও বিজ্ঞানে অপার দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম। নানান অভিযানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের
প্রতিভাবান বিজ্ঞানীদের সঙ্গে শঙ্কু্র সাক্ষাৎ হয়েছে, কিন্তু প্রতিবারই শঙ্কুর
প্রতিভার দীপ্তিতে তাঁদের প্রতিভা ম্লান হয়ে গেছে। সব ক্ষেত্রেই
অন্যান্য মহান বিজ্ঞানীদের আবিষ্কারকে শঙ্কুর অভিনব আবিষ্কারগুলি ঔজ্জ্বল্যে
ছাপিয়ে গেছে। তবে ব্যক্তিগত খ্যাতির উর্ধ্বে উঠে শঙ্কু বাংলা তথা ভারতের জন্য স্বদেশ
প্রেম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তাই তিনি ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু’ গল্পে জার্মান প্রকৌশলীদের
তাঁর রোবটটি দেখানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন, কারণ জার্মানদের অন্ধ বিশ্বাস রয়েছে, রোবোটিকসে তাঁদের সঙ্গে অন্য কোনও দেশের
প্রতিভার তুলনাই হয় না। ডায়রিতে তাই শঙ্কু লিখেছেন, ‘রোবু যা করে তা পৃথিবীর আর
কোনও যান্ত্রিক মানুষ করেছে বলে মনে হয় না। ...বাংলাদেশে সামান্য রসদে বাঙালী
বৈজ্ঞানিক কী করতে পারে, সেটা কি বাইরের জগতের জানা উচিৎ নয়? এতে নিজের প্রচারের
চেয়ে দেশের প্রচার বেশি। অন্তত আমার উদ্দেশ্য সেটাই’।
এখন প্রশ্ন হল, প্রোফেসর শঙ্কু আজ কোথায়? ১৯৯২ সালে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায়
তাঁর শেষ দুটি অসমাপ্ত ডায়রি ‘ইন্টেলেকট্রন’ ও ‘ড্রেক্সেল আইল্যান্ডের ঘটনা’
প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর থেকে তাঁর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। ‘ব্যোমযাত্রীর
ডায়রি’ গল্পটি পড়ে জানা যায়, তিনি নাকি বহু বছর ধরে নিরুদ্দেশ। কেউ কেউ আবার বলেন,
তিনি নাকি কী এক ভীষণ এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। আবার এও শোনা যায়,
তিনি আসলে বেঁচে আছেন বহাল তবিয়তে। ভারতবর্ষের কোনও এক অজ্ঞাত অখ্যাত অঞ্চলে গা
ঢাকা দিয়ে চুপচাপ নিজের কাজকর্ম করে চলেছেন। সময় হলেই নাকি আত্মপ্রকাশ করবেন। ‘ইন্টেলেকট্রন’
গল্পে তিনি ডায়রিতে লিখেছেন, নিজের আবিষ্কৃত ইন্টেলেকট্রন নামে বুদ্ধি নির্ধারণ
যন্ত্রটি নিয়ে জার্মানির হামবুর্গে আবিষ্কারক সম্মেলনে যাবার কথা তাঁর। অলৌকিক
ক্ষমতার অধিকারী নকুড়বাবু কিন্তু তাঁকে বিদেশ ভ্রমণের আসন্ন বিপদ বিষয়ে সাবধান
করেছিলেন। নকুড়বাবু তাই শঙ্কুর সঙ্গে বিদেশ যেতে চেয়েছিলেন। শঙ্কু
কি তবে নকুড়বাবুর পরামর্শ না মেনে একা-একাই বিদেশ গিয়ে বিপদে পড়েছেন? ‘ড্রেক্সেল
আইল্যান্ডের ঘটনা’ গল্পে শঙ্কু কি শেষমেশ মৃত বায়োকেমিস্ট জন ড্রেক্সেলের পুত্র
চার্লস ড্রেক্সেলের অনুরোধ রক্ষা করতে প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত সেই নির্জন
দ্বীপে অভিযানে গিয়েছিলেন? সেখানে জন ড্রেক্সেলের অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করতে গিয়ে
তিনি কি বিপদে পড়েছিলেন? আজও আমাদের কাছে এ প্রশ্নগুলির কোনও উত্তর নেই।
উত্তরগুলি একমাত্র প্রোফেসর শঙ্কুই জানেন। আমরা আজও তাই প্রোফেসর শঙ্কুর জন্য অধীর
আগ্রহে অপেক্ষমান।
স্রষ্টা ও সৃষ্টিঃ সত্যজিৎ রায় এবং প্রোফেসর শঙ্কু |
_____
No comments:
Post a Comment