আজব তারা আর্দ্রা
তন্ময় ধর
রাতের আকাশে আমাদের অতি-পরিচিত এক তারার আজব কাহিনি শোনা
যাক। হেমন্তের সন্ধ্যায় পুব আকাশে যে নক্ষত্রময় শিকারী পুরুষ উদিত হয় সে হল
কালপুরুষ (Constellation Orion)। আকাশের আর কোনও নক্ষত্রমন্ডল ঠিকঠাক না চিনলেও সুন্দর
আকৃতি, উজ্জ্বলতা এবং কাহিনির জন্য এই তারকামন্ডলীটিকে আমরা ছোটবেলা থেকেই চিনি। ওই
কালপুরুষের বাঁ কাঁধের রক্তবর্ণ উজ্জ্বল তারাটির নাম আর্দ্রা। গ্রীক
নাম বেটেলগিউজ (Betelgeuse)। পৃথিবী থেকে প্রায় ৬৫০ আলোকবর্ষ দূরে থাকা এই আজব তারকাটির
আজব কথা একটু আলোচনা করা যাক। সূর্যের চেয়ে ২০ গুণ ভারী আর্দ্রার বয়স কিন্তু খুব
বেশি নয়, মাত্র ২০ কোটি বছর। মাত্র বলছি এই কারণেই যে, আমাদের সূর্যের বয়স প্রায়
৪৫০ কোটি বছর। আর ৪৫০ কোটি বছর বয়সেও সূর্য নবীন যুবক তারা; কিন্তু আর্দ্রা ২০ কোটি বছরেই
মৃত্যুপথযাত্রী! কিন্তু কেন তার মৃত্যু? সেটা জানতে গেলে নক্ষত্রের বিবর্তন কাহিনি
অল্প কথায় জেনে নিতে হবে। প্রথমে দেখা যাক, নক্ষত্রের জন্ম হয় কীভাবে? অতিকায় এক
হাইড্রোজেন গ্যাসপিন্ড জমাট বেঁধে তারার জন্ম দেয়। অতিকায় মানে ঠিক কতটা পরিমাণ?
সেই গ্যাসপিন্ডের ওজন কিলোগ্রামে প্রকাশ করতে গেলে ১৬-এর পিঠে ২৮ খানা শূন্য বসাতে
হবে। পৃথিবীতে বসে, চেনা-পরিচিত জিনিসের তুলনা দিয়ে ঐ সুবিশাল বস্তুপিন্ডের ধারণা
করা সম্ভব নয়। ঐ সুবিশাল গ্যাসপুঞ্জ একত্রিত হলে বিপুল অভিকর্ষীয় চাপে তার
কেন্দ্রস্থলে হাইড্রোজেন গ্যাসের নিউক্লিও দহন শুরু হয়। এই নিউক্লিও দহন ব্যপারটা
কি? সরলতম নিউক্লিও দহনে হাইড্রোজেন গ্যাস অন্তত ১,৩৫,০০,০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড
তাপমাত্রায় পুড়ে হিলিয়াম গ্যাস তৈরি করে এবং নির্গত করে আলোকশক্তি। সূর্যের
কেন্দ্রে এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ১,৫০,০০,০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড
তাপমাত্রায় প্রতি সেকেন্ডে ৬০ কোটি টন হাইড্রোজেন পুড়ে হিলিয়াম আর আলো তৈরি হচ্ছে।
প্রায় এই হারেই সূর্য তার হাইড্রোজেন জ্বালানী পুড়িয়ে এসেছে সেই শৈশবকাল থেকে আজ
পর্যন্ত অর্থাৎ গত ৪৫০ কোটি বছর। কিন্তু এর পরেও সূর্যে যে পরিমাণ হাইড্রোজেন জ্বালানী মজুত
আছে তাতে তার হেসে-খেলে আরও ৫০০ কোটি বছর তো চলবেই, ১০০০ কোটি বছরও চলতে পারে।
তাহলে আর্দ্রার এমন মুমুর্ষু দশা কেন? সূর্যের চেয়ে ২০ গুণ
জ্বালানী রয়েছে ওর ঘরে, বয়সও মাত্র ২০ কোটি বছর, অথচ মৃত্যু ওর শিয়রে! কারণ শৈশব
থেকেই আর্দ্রার লাইফস্টাইলটাই আলাদা ছিল। জন্মের সময় আর্দ্রার ভর ছিল আরও অনেক
বেশি – সূর্যের ভরের প্রায় ৩০ গুণ। ওই সুবিশাল ভরের চাপে ওর কেন্দ্রের তাপমাত্রা
হয়ে ওঠে অত্যধিক – প্রায় ৩,০০,০০,০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।
অত তাপে হাইড্রোজেন হু-হু করে পুড়ে সব জ্বালানী শেষ। যেই জ্বালানী শেষ হল অমনি
কেন্দ্র থেকে আলোকশক্তির নির্গমন বন্ধ হল, আর অভিকর্ষীয় বলের চাপে কেন্দ্রীয় অঞ্চল
চুপসে যেতে শুরু করল। কেননা, ওই বহির্মুখী আলোকশক্তিই ঠেলে রেখেছিল অন্তর্মুখী
অভিকর্ষীয় বলকে। এবারে যেই কেন্দ্রীয় অংশ চুপসে যেতে থাকল, অমনি তারকার
বহির্মন্ডলে শুরু হল হাইড্রোজেনের নিউক্লিও দহন যা তারকার বহির্ভাগকে
ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বিশাল থেকে বিশালতর করে তুলতে লাগল। আমাদের পরিচিত আকাশে জ্যেষ্ঠা,
রোহিণী, স্বাতী – সব তারার এখন এই দশা। এই মৃত্যুকালীন দশার নাম লোহিতদানব দশা (Red giant stage)।
অবলোহিত আলোয় আর্দ্রার চারপাশে থাকা নীহারিকা |
আজ থেকে দশ
লক্ষ বছর আগে শেষ হয়ে গিয়েছে আর্দ্রার জীবনের মূল পর্যায়। মৃত্যুকালীন লোহিতদানব
দশাতেও প্রায় গত ৪০০০০ বছর ধরে নিঃস্ব হয়েছে সে। গত ১০০০০ বছরে এক সৌরভর পরিমাণ
জ্বলন্ত গ্যাস হারিয়ে গিয়েছে তার শরীর থেকে। একদল জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিস্তর হিসেব
কষে বলছেন যে, আর্দ্রার সব জ্বালানী শেষ। আমাদের
জীবনকালের মধ্যেই নাকি আর্দ্রা সুপারনোভা বিস্ফোরণে ফেটে পড়তে পারে। যদিও অধিকাংশ
বিজ্ঞানী এত তাড়াহুড়োয় গুরুত্ব দিতে রাজি নন। যাই হোক, আজ-কালের
মধ্যে না হলেও অদূর ভবিষ্যতে সে বিস্ফোরণ হবেই। সুপারনোভা বিস্ফোরণ কী, সেটা একটু দেখা যাক। সুপারনোভা
হল এক ধরনের নাক্ষত্রিক বিস্ফোরণ যার
ফলশ্রুতিতে নক্ষত্র ধ্বংসপ্রাপ্ত
হয় এবং অবশেষরূপে থাকে নিউট্রন তারা কিংবা কৃষ্ণবিবর। সৌরভরের
চেয়ে তিন গুণ বেশি ভরের তারকাদের অভ্যন্তরে হাইড্রোজেনের সংযোজন বিক্রিয়ায় তৈরি হয় হিলিয়াম,
হিলিয়ামের সংযোজনে তৈরি হয় কার্বন এবং সেই
কার্বনের সংযোজনে তৈরি হয় লোহা। লোহা তৈরির মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীণ বিক্রিয়াসমূহের পরম্পরার পরিসমাপ্তি ঘটে, কারণ এর
পরের বিক্রিয়াটি তাপশোষী। এমনই এক সময়ে তারকাটির
অভ্যন্তরস্থ বহির্মুখী চাপ যথেষ্ট পরিমাণ কমে যাওয়ায় এটি আর মহাকর্ষীয় আকর্ষণ
বলকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না, ফলে নক্ষত্রে ঘটে এক প্রচণ্ড
অন্তস্ফোটন (Implosion)। নক্ষত্রটির
বেশিরভাগ ভরই এর কেন্দ্রে সংকুচিত হয়ে পড়ে, আর গ্যাসীয় বাতাবরণটি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন
হয়ে প্রবলবেগে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনাই সুপারনোভা বিস্ফোরণ হিসেবে পরিচিত।
এই ধরনের বিস্ফোরণে বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত হয় এবং সংশ্লিষ্ট নক্ষত্রটি
সাময়িকভাবে পুরো ছায়াপথের চেয়েও বেশি
উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আর্দ্রার সুপারনোভা বিস্ফোরণ হলে দিনের বেলায় আকাশে প্রায়
দু’মাস ধরে দেখা যাবে সেই অত্যন্ত উজ্জ্বল সুপারনোভা। রাতের পূর্ণচন্দ্রকেও
উজ্জ্বলতায় ম্লান করে দেবে সে।
অবলোহিত আলোয় দেখা আর্দ্রার বহিঃস্তরের গহ্বর |
_____
No comments:
Post a Comment