খেলাধুলোর গপ্পো
অপর্ণা গাঙ্গুলী
এখনকার তোমাদের মতো আমাদের ছোটোবেলাটি
বাপু ইঁট-কাঠ-পাথরে বন্দি ছিল না বলতেই হয়। ছিল ফুরফুরে, অবাধ, মুক্ত। এক্কেবারে আকাশের
মতো যাকে বলে।
তা এখন তোমাদেরও তো ভারী মজা, জানি আমি। ঘরে বসে বসে খালি পটেটো চিপস খাও আর মোবাইল বা কম্পিউটার-এ
কেবল ভিডিও গেমস খেলো। অবশ্য পটেটো চিপস পেলে যে একেবারে খেতাম না, সে কথা হলফ করে
বলতে পারব না। তবে যাই বলো,
তোমাদের ওই মগজধোলাই-এর খেলাতে মগজের ব্যায়াম হয় ঠিকই, কিন্তু বাড়ি
বসে শরীরের ব্যায়াম হয় না মোটেই। সেই যে ছোটোবেলাতে ব্রতচারীর সময় শ্রী
গুরুসদয় দত্তর গানে শিখেছিলাম – ‘চল কোদাল
চালাই, ভুলে
মানের বালাই, ঝেড়ে
অলস মেজাজ হবে শরীর ঝালাই। যত ব্যাধির বালাই, বলবে পালাই পালাই, পেতে খিদের জ্বালায়
খাবো দুধ আর মালাই।’ আহা এই গানেই নিহিত আছে আমাদের ছোটোবেলার খেলাধুলোর সেই পরম তত্ত্ব। এসো, আজ তোমাদের কাছে
সেই কথাই বলি।
সে যা হোক, তখন বিকেল বিকেল
আমরা মাঠে খেলতে যেতাম। বেশ দু’আড়াই ঘন্টা খেলেধুলে যখন ঘরে ফিরতাম মনটা এইসা চাঙ্গা হয়ে উঠত
যে পড়তে বসতেও ভালো লাগত তখন। এখনও বুঝি চোখ বুজলেই দেখি ধু ধু সবুজ মাঠ, দূরে যেন ওই
আকাশে মিশেছে।
সেই মাঠে দোলনা,
স্লিপ, ঢেঁকি, ঘূর্ণী সবই থাকত, ইংরেজিতে যাকে
তোমরা আজকাল সুইং, স্লিপ, সিস, মেরি গো রাউন্ড
বলো, সেই
সব আর কি। তা ওসব ছাড়াও ছিল অনেক অনেক খেলুড়ি আর ছিল নানা রকমের খেলা। তা স্মৃতির
চিলেকোঠা খুঁজে আজ এনেছি সেই সব হরেকরকমের খেলার বিবরণ, তোমাদের কথা
মনে করেই। ভালো
লাগলে পড়ে দেখো, দেখবে, মনটা কেমন উধাও
হয়ে গেছে, একঝাঁক-রোদ্দুর-মাখা কোনও সকালবেলার
মাঠে।
তো, যা বলছিলাম।
একটা সহজ খেলার কথা খুব মনে পড়ে। সেই খেলাটির নাম ছিল চেন চেন। সবাই গোল
হয়ে দাঁড়ালে একজন গুনতে শুরু করে।
‘ইনটি পিনটি পাপা
টিনটি
টান
টুন্ টাস,
আগলি
বাগলী বু,
আউট
গোজ ইউ।’
এই বলতে বলতে যার কাছে এসে ছড়া শেষ হল, সে বেরিয়ে গেল। আর যে সবচেয়ে
শেষে থেকে গেল, সেই
হল ক্যাপ্টেন।
এবার কী হল জানো? সেই
ছেলে বা মেয়েটির কাজ হল অন্য সব দৌড়োনো ছেলেমেয়েদের গিয়ে ধরা। একজনকে ধরলেই
সেই দু’জনে হাত ধরাধরি করে ছুটে আবার একজনকে ধরবে, এইভাবে একজন একজন করে চেন বাড়তেই থাকবে। বেশ মজার সেই
হাত ধরাধরি করে সারা মাঠ ছোটাছুটি। তখন আমরা একজোট, একসঙ্গে হৈ হৈ
করে হাসতে হাসতে অন্যদের ধরতে যাচ্ছি, আর তারা ছুট দিচ্ছে। সে এক ভয়ঙ্কর
হল্লাগুল্লার ব্যাপার ছিল। হাতে হাত ধরে কাজ করার, খেলা করার একটা
ভারী মজা আছে।
সবার আনন্দ, হাসিরাশি
সব্বার মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আর হা হা হো হো প্রবল হাসিতে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠছে। স্কুলে যেমন
খেলার ক্লাসে হয়ে থাকে আর কি!
চেন চেনের মতোই আর একটি বেশ সরেস
খেলাও মনে পড়ে জানো। তার ইংরেজি নাম সিট্ এন্ড কুক। বসে বসে রান্না করো। তোমরা বলবে, বাহ রে, এ আবার কোনও
খেলার নাম হতে পারে? কিন্তু
ছিল তো বটেই, অমন
এক খেলা। ওইভাবেই
সবাইকে গুনে গুনে বাদ দেবার পর, যে থাকে সেই হবে চোর। সে ছুটবে সবাইকে ধরতে। আর ধরার আগেই
যদি কেউ বসে পড়ে, ব্যস
আর সে উঠতে পারবে না যতক্ষণ না যারা দৌড়োচ্ছে তাদের কেউ এসে তার মাথা ছুঁয়ে তাকে মুক্তি
দেয়। ব্যস
তখন সে আবার উঠে অন্যদের সঙ্গে ছুটবে। কিন্তু শেষে এমন দেখা যেত, যে তাড়া খেতে
খেতে সবাই বসে যেত। তখন আর কী? তখন আর মাথায় হাত দিয়ে কেউ কাউকে মুক্তি দেবার থাকত না। আর ব্যস, তখন যে চোর সে
মুক্তি পেত। তখন সব থেকে শেষে যে বসেছে, সেই উঠে চোর হত আবার।
এইভাবে কিছুক্ষণ খেলতে খেলতে বড়ো
দিদিরা এসে আমাদের নাম পাতাপাতি খেলার জন্যে ডেকে নিত। মনে করা যাক, দুটি দল আর
দুই দলের দুই রাজা। দুই দলের ছেলেমেয়েদের প্রত্যেককে সেই দলের রাজামশাই একটি একটি করে
নাম দিয়েছে।
তবে অন্য দলের কেউ সে সব নাম কাকে দেওয়া হয়েছে জানবে না। সে নাম হত ফুল
বা ফলের নামে। আবার কখনও-সখনও মজা করে সিনেমার নায়ক নায়িকার নাম রাখা হত।
আর তারপরে যা মজাটা হত না... বলি? দুই দল মুখোমুখি
মাঝে অনেকটা জায়গা ছেড়ে বসে পড়ত। তখন মনে করো ফুলের দল আর ফলের দল এই দুটি দল রয়েছে।
একদিকে বসেছে ফুলের দল আর তার থেকে কিছু দূরে ফুলের দলের মুখোমুখি বসেছে ফলের দল।
ফুলের দলের রাজা ফলের দলের যে
কোনও একজনকে পেছন থেকে চোখ টিপে ধরত জোরে আর ডাকত - সুর করে করে। আয় তো রে আমার
গোওওওলাপ। অমনি যে মেয়ে গোলাপ হয়েছে সে টুক টুক করে উঠে এসে সেই চোখ আটকানো ফলের দলের
সেই জনের কপালে মেরে গেল এক টোকা। ব্যস নাও ঠ্যালা! এবার সেই ফলকে বলতে
হবে কোনজন গোলাপ। ফলের দলের রাজা বা অন্য কেউ কিন্তু তাকে মোটেই সাহায্য করতে পারবে
না। সে কী
করে বলে, তার
চোখ তো বন্ধ করে রেখেছিল ফুলের দলের রাজা। সে বেচারা আমতা আমতা করে বলল – ওই তো নীলিমা। আর অমনি হল না
হল না করে উঠল ফুলের দলের ছেলেমেয়েরা। আসলে গোলাপ তো হয়েছে মলি। কিন্তু সে তো
আর ফলের দলের ছেলেমেয়ের জানার কথা না। তখন ফুলের দল এক পয়েন্ট পেল। এবার চলল ফলের
দলের ডাকাডাকি। রাজা ফুলের একজনের চোখ বেঁধে অমনি ডাকলেন – আয় তো রে আমার আআআআপেল.... কিন্তু এবারে
কী হল, কী
জানি কী করে সে বলে ফেলল কে আপেল –
ওই তো বাবলুl ওইইইই
আপেল। ব্যস তার আনন্দ ব্যাডমিন্টন ম্যাচ জেতার থেকে কম না। তখন সব ফুলের দলের মিলে
সে কি জিঙ্গা লা লা নাচ। ফুলের দলের বাড়ল আরও এক পয়েন্ট আর ফলের দলেরা কেমন যেন মুষড়ে
পড়ল। বলছি না, হৈ হৈ
কান্ড রই রই ব্যাপার সে সব? এবার
সিনেমার নায়কের নাম ধরে ডাকা হল –
আয় তো রে আমার অমিতাভ বচ্চন! অমনি বেঁটে খুঁতখুঁতে বেবি গুড্ডু চলল টোকা মারতে। তার নাম পাতানো
হয়েছে ওই নামেই…
এই সব মনে করছি বসে, এমন সময় আবার
কানে আসে – একটা বাজল, এখনও
কুমির এল না, দুটো
বাজল এখনও কুমির এল না... সবাই
গোল হয়ে ঘুরছে। কিন্তু কুমির তো আসবে পাঁচটায়। আর তাই পাঁচটা বাজল এখনও কুমির… বলতে না বলতেই
সবাই যে যার ডাঙায় উঠে গেল। জলে রইল টুবাই কুমির। আমরা করি কি, এক পা করে জলে
নামিয়েই তুলে নি, আর সেই
ফাঁকে যদি কুমির আমাদের ছুঁয়ে দেয় তবে পরের দানে কুমির হওয়া থেকে কে আটকায়? এই হল কুমির-ডাঙা খেলা। মাঝে
মাঝে এক পা জলে নামিয়ে কুমিরকে রাগাই - বলি, কুমির তোমার জলকে নেমেছি... মজা, নিছক মজা, বন্ধু আর ভাইবোনেরা
মিলে। সে খেলার মজায় এত জন রয়েছে, রয়েছে আনন্দ হাসি গান। একা একা খেলার ভিডিও গেমসে মজা কোথায়?
এমনি করে একবার আই স্পাই খেলা
চলছে। একজন
অমনি গোনার পর চোর হল। সে গোনার ছড়াটি একটু অদ্ভুত। সুর করে বলা
ছড়া – আবন বাবন চৌকি
চাবোন, ওল
ঢোল মামার খোল, ওই মেয়েটি
খাটিয়া চোর। ইশ কী সব কথা,
শেষকালে কিনা খাটিয়া চোর। না না সে সব নয়। এক্ষেত্রে কিন্তু আই স্পাই খেলার চোর।
তা চোর হয়েছে বলে সে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ১০০ গুনবে আর অন্য সবাই যে যার গলিঘুঁজিতে
কোথায় লুকিয়ে পড়বে কে বলতে পারে! ১০০ গোনা হয়ে গেলে পর চোর বেরুবে অন্য
খেলুড়িদের খুঁজতে। আর যাকে প্রথম দেখতে পাবে, তাকে তার নাম ধরে বলবে – আই স্পাই রনি, ইত্যাদি। এই বলার পর, যদি ধরে ফেলতে
পারে তাকে, তাহলে তো আর কথাই নেই। সে তার পরের বার চোর দেবে। ভালো খেলা। তোমাদের ওই
মোটর রেসিং, বাফিফা বা ঐরকম কোনও
খেলার থেকে কোনও অংশে কম দুর্দান্ত নয়।
তা সেবার যা হল, এক আশ্চর্য
ঘটনা। সেবারে ভাগ্যের ফেরে আমি চোর হয়েছি ওই আই স্পাই খেলাতে। আমাদের মামার বাড়ি ছিল
উত্তর কলকাতায় আর সে বাড়িটা, কী বলব, ছিল পর পর পাশের বাড়িগুলোর সঙ্গে ছাদে ছাদে জোড়া। তা এ ছাদ
থেকে তখন আমরা দশটা বাড়ি পেরিয়ে যেতাম ছাদ বেয়ে। প্রতি বাড়ির মাঝেই ছিল ছোটো একটি ব্রিজ
অন্য বাড়িতে যাবার। আমি চোর হয়ে অন্যদের খুঁজতে খুঁজতে কখন যেন ছাদে
চলে এসেছি। তখন বিকেল গড়িয়ে বেশ সন্ধে নামতে চলেছে, যদিও সূর্যদেব তখনও পাটে বসেননি।
আমাদের খেলার সঙ্গী ছিল ব্ল্যাক জুয়েল। সে দেখি আমার থেকে দুই ছাদ পরে ছুটে যাচ্ছে।
আমাকে দেখতে পেয়েই পালাচ্ছে আর কি। ছুটুক না কত ছুটবে, আমি তো ওকে ধরবই।
আমি ছুট লাগালাম আর চেঁচিয়ে বলতে লাগলাম – আই স্পাই ব্ল্যাক জুয়েল। সেও ছুটছে, আমিও পেছনে তাড়া লাগিয়েছি।
এই করে শেষ ছাদে গিয়ে ধরে ফেলব, কারণ ওর পরে আর কোনও বাড়ি নেই। বলব কী, ব্ল্যাক জুয়েল-এর
জামাটা ছুঁয়েছি প্রায়,
তখন সে নিচে যেন লাফ দিল। আমি আর ওকে ধরতে পারলাম না। পরে আমাকে ওই ছাদ থেকে বড়োরা
উদ্ধার করেছিল। আমার তখন নাকি প্রবল জ্বর। আর সেদিন বুঝি ব্ল্যাক জুয়েল খেলতেই আসেনি।
অমনি আরও একবার কানামাছি খেলতে
খেলতে বেশ একটা কিছু ঘটেছিল। কানামাছির ইংরেজি নাম ব্লাইন্ড ম্যান'স বাফ – চোখ বাঁধা অবস্থায়, কানামাছি ভোঁ
ভোঁ, যাকে
পাবে তাকে ছোঁ। আর কিছুই না, তখন বুক ভরে তাজা নিঃশ্বাস নিতাম, ছোটাছুটি করে
মন শরীর দুইই ভালো থাকত আর কারণে অকারণে অনেক অনেক বন্ধু জুটে যেত। তখন চারিপাশটা
তাকিয়ে দেখতাম অনেক বেশি। ফুল ফোটা, ফল পাড়া, সাপের ডিম খোঁজা, পাখির ডাক শোনা
এইসবও ছিল আমাদের সেই খেলাধুলোময় জীবনের অঙ্গ। তখন বুড়ো ঠাকুরদা গাছটার ঝুড়ি ধরে কত
দোল খেয়েছি, বলার
নয়। কোম্পানির বাগানে শেয়ালনি আর তার বাচ্চাদের জোছনা পোহানো দেখেছি চোখ ভরে। ওইসব
সরল যাপনের মধ্যে দিয়ে কখন একটু একটু করে বড়ো হয়েছি, কিন্তু ছেলেবেলার মনটা পড়ে রয়েছে
কাছেই।
আর কী… আর বুড়ি বসন্তী? ক্যাচ ক্যাচ, ক্যাপ্টেন এন্ড
স্মাগলার্স, লুকোচুরি, রুমাল চোর? সে সব কতোই
তো ছিল। সে সব
খেলাধুলোর গপ্পো না হয় আর একদিন বলা যাবে, কেমন?
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment