হারিয়ে যাওয়া
বেড়ালরা
বিভাবসু দে
বেড়াল! হারিয়ে গেছে! কার?
আরে না না বাপু, এ বেড়াল সে বেড়াল
নয়। বাড়িঘরের গুদগুদে, নাদুসনুদুস, আদুরেমুখো পুষ্যি
বেড়ালদের সঙ্গে এদের মোটেই মিল নেই, বরং বাঘ-সিংহরা হল গিয়ে এদের নিকট আত্মীয়। তাহলে
খামোখা এদের বেড়াল বলতে গেলাম কেন? আসলে ব্যাপারটা হল ঘরের পোষা বেড়াল থেকে
শুরু করে বাঘ, চিতা, বনবেড়াল, জ্যাগুয়ার, এমনকী বনের রাজা
সিঙ্গি অবধি, সকলেই
একই পরিবারভুক্ত - যার বৈজ্ঞানিক নাম ফেলিডি (Felidae family)। আর এই পরিবারের
সকল সদস্যকেই এককথায় বলা হয় ফেলিড (Felid) বা ফেলাইন (Feline) - সে বুনো বাঘই
হোক কিংবা ভেজা বেড়াল!
তবে বিজ্ঞানীদের দেওয়া এসব খটোমটো
নামগুলোর বাইরে মোটমাট এরা সবাইই হল বেড়াল - কেউ ছোটো, কেউ বড়ো! ছোটো, মানে পোষা বেড়ালেরা
হল ফেলিস গোত্রীয়; বিজ্ঞানীরা
আদর করে ডাকেন ফেলিস ক্যাটাস (Felis Catus) বলে! কিন্তু আজ 'ফেলিস ক্যাটাস'-দের কথা নয়, আজ বলব ইয়া বড়ো
বড়ো পেল্লাই চেহারার প্রাগৈতিহাসিক সব বেড়ালদের কথা, যাদের দেখলে সিঙ্গিমামারাও ভিরমি খেত!
খেত?
হ্যাঁ, খেত। এখন
আর ওরা নেই। থাকলে একেবারে সিংহ মহারাজের সিংহাসন
টলিয়ে ছাড়ত! আসলে প্রকৃতির নিয়মটাই এমন, এক প্রজাতি সরে গেলে অন্য প্রজাতি এসে
তার শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলে। ঠিক
যেমন শুকনো পাতা ঝরে পড়লে তার জায়গায় আবার গজিয়ে ওঠে নতুন পাতা।
যাই হোক, আপাতত এসব দার্শনিক
ব্যাপার-স্যাপার সরিয়ে রেখে কাজের কথায় আসি। চিতাবাঘ
দেখেছ নিশ্চয়ই? সামনা-সামনি
না হলেও অন্তত টিভির পর্দায় তো সবাইই দেখেছ। চিতাবাঘ
হল বিশ্বের দ্রুততম ধাবক,
যদিও এরা খুব বেশি দূর অবধি দৌড়তে পারে না। মানে
স্বল্প দূরত্ব কিন্তু তীব্র গতি। শুরুটা
তবে এই চিতাদের দিয়েই করি।
চিতা বাঘেদেরই খুব কাছের এক আত্মীয়
ছিল ওরা। আকারে শুধু একটু বড়ো, এই যা। আর তাই
নাম দেওয়া হয়েছে 'জায়েন্ট
চিতা'। বিজ্ঞানীরা
আবার ভালোবেসে ডাকনাম রেখেছেন অ্যাকিনোনিক্স পার্ডিন্যানসিস (Acinonyx pardinensis)। দেখতে-শুনতে
ভদ্রলোক আজকালকার চিতাদের মতোই ছিলেন, শুধু সাইজটা প্রায় ডবল। উচ্চতায়
মোটামুটি আজকের যুগের সিংহদের সমান। যদিও
ওজনটা সিংহের তুলনায় বেশ কমই ছিল - আর সেটা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। মোটাসোটা
ভারিক্কি-মার্কা চেহারা নিয়ে কি আর পঁইপঁই করে চার পা হাওয়ায় তুলে শিকারের পেছনে ছোটা
যায়!
বিজ্ঞানীরা এদের কঙ্কাল থেকে খুঁজেপেতে
যেটুকু জানতে পেরেছেন,
তা মোটামুটি এইরকম - এদের ওজন ছিল প্রায় ৮০ থেকে ১০০ কেজি, দেহের দৈর্ঘ্য
(ল্যাজ বাদে) প্রায় ২০০ সেন্টিমিটার আর শুধু ল্যাজখানাই নাকি ছিল ১৪০ সেন্টিমিটারের। এদের
কামড়ও ছিল আধুনিক চিতাদের চেয়ে অনেক বেশি জোরালো। যদিও
একটা ব্যাপারে কিন্তু এরা পিছিয়ে - গতি! হ্যাঁ, আধুনিক চিতাদের সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতায়
নামলে জায়েন্ট চিতারা হারবে, অন্তত গবেষণা তো তাই বলে। আর তাই
বিজ্ঞানীদের ধারণা, এরা
আসলে ক্ষিপ্রগামী চিতা আর দশাসই চেহারার বাঘ সিংহদের মাঝামাঝি একটি প্রজাতি। এদের
দেহের গঠনও এই মতের সঙ্গে বেশ খাপে খাপে মিলে যায়। এই যেমন
ধরো, এদের
মাথার খুলি, কিংবা
পায়ের মাংসল গড়ন - আধুনিক চিতার তুলনায় মাউন্টেন লায়ন, প্যান্থার অথবা
স্নো-ল্যাপার্ডের সঙ্গেই তার সাযুজ্য বেশি। কিন্তু
দেহের সার্বিক এবং আভ্যন্তরীণ কাঠামো প্রায় অবিকল চিতাদের মতোই।
আচ্ছা, দেহের গঠন-টঠন
না হয় বুঝলাম, কিন্তু হঠাৎ করে ওরা হারিয়ে গেল কেন?
সেটা বুঝতে গেলে আগে যে আরও ক'টা কথা না বললেই
নয়। এই জায়েন্ট চিতারা কিন্তু সময়ের দিক থেকে
অনেকটাই আগেকার জীব। ওদের সেই যুগটাকে
বলা হয় মধ্য প্লেইস্টোসিন (১,২৬,০০০ থেকে ৭,৮১,০০০ বছর আগে) যুগ। সে সময়
জায়েন্ট চিতারা ঘুরে বেড়াত ইউরোপ এবং এশিয়ার বনে-প্রান্তরে - জার্মানি, ফ্রান্স, চিন, এমনকী আমাদের
ভারতেও ওদের কঙ্কাল পাওয়া গেছে। খাদ্যতালিকাও
বেশ সরেস ছিল ওদের - পাহাড়ি ছাগল, সম্বর, বার্কিং ডিয়ার, ইল্ক। কিন্তু
খাদ্য থাকলেই খাদক জোটে। আর একাধিক খাদক
থাকলেই শুরু হয় খাবারের লড়াই, মানে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ। সেই
মধ্য প্লেইস্টোসিন যুগে জায়েন্ট চিতাদের ঠিক পাশাপাশিই ঘুরে বেড়াত তাদেরই আরও কিছু
নিকট আত্মীয় প্রজাতির বেড়াল - মূলত জ্যাগুয়ার এবং ল্যাপার্ড। ব্যস, শুরু হয়ে গেল
শিকারের প্রতিযোগিতা! আগেই বলেছি, জায়েন্ট চিতাদের শরীর ছিল তুলনামূলকভাবে বেশ বড়ো আর দ্রুত ধাবক
হলেও বেশিক্ষণ দৌড়বার সামর্থ ওদের ছিল না। এছাড়াও
আরও কিছু দৈহিক খামতি ছিল যার কারণে ওরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছিল এই বেঁচে থাকবার প্রতিযোগিতায়। আর তারপর
সেটাই হল, যেটা
যুগ যুগ ধরে প্রকৃতির ঝাড়াই-বাছাইয়ের খেলায় হয়ে এসেছে - হারিয়ে গেল জায়েন্ট চিতা।
এবার যাদের কথা বলব তাদের নামের
অর্থটা হেব্বি মজার,
বুঝলে? জেনোস্মাইলাস
হডসোনি (Xenosmilus
hodsonae)।
যাব্বাবা! এতে আবার মজার কী দেখলে? কেমন দাঁতভাঙা
বিটকেল নাম!
হ্যাঁ, সে একটু খটোমটোই
বটে, কিন্তু
মজাটা হল ওটার অর্থে। এদের গোত্রনাম
Xenosmilus শব্দটা
এসেছে গ্রিক শব্দ Xenos,
যার অর্থ হল স্ট্রেঞ্জ বা উদ্ভট আর smile, মানে হাসি! না না, হেসো না, ওই নামের পেছনে
যে আসল রহস্যটা রয়েছে সেটা কিন্তু অতটাও হাসির নয়। আসলে
এরা ম্যাকায়রোডনটিনি (Machairodontinae)
নামে এক হারিয়ে যাওয়া উপ-পরিবার বা সাব-ফ্যামিলির সদস্য। এই পরিবারের
বেড়ালদের বৈশিষ্ট্য হল মুখের দু'পাশে বেরিয়ে থাকা খঞ্জরের মতো বিশাল দুটো রাক্ষুসে শ্বদন্ত বা
ক্যানাইন টিথ - ঘাড়ে কামড়ে ধরলে একেবারে গলা ফুঁড়ে বেরোত!
যাই হোক, এই জেনোস্মাইলাস
ভায়াদের এখনও অবধি শুধু দুটোই ঠিকঠাক কঙ্কাল পাওয়া গেছে - ১৯৮৩ সালে ফ্লোরিডার হেইল
লাইমস্টোন অঞ্চলে। বিজ্ঞানীরা বেশ পরীক্ষানিরীক্ষার পর বুঝতে
পেরেছিলেন যে এরা একটি সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতি, যারা বহু যুগ আগেই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত
হয়ে গেছে। এদের অস্তিত্ব ছিল উত্তর আমেরিকার ইরভিংটোনিয়ান
যুগে (১.৯ মিলিয়ন থেকে ২,৫০,০০০ বছর আগে)। এরা
জায়েন্ট চিতাদের মতো মোটেই দ্রুত ধাবক ছিল না, এদের দেহের গঠনই তার প্রমাণ। দৈর্ঘ্যে
এরা মোটামুটি ১.৭ থেকে ১.৮ মিটার, কিন্তু ওজনে বিশাল! এদের ওজন হত প্রায় ২৩০ থেকে ৪০০ কেজি। দেহ
ছিল বেশ পেশীবহুল, মাংসল
আর পা-গুলো ছিল যথেষ্ট সুগঠিত। তবে
এদের দীর্ঘ শ্বদন্তগুলো ম্যাকায়রোডনটিনি পরিবারের অন্যান্য অনেক সদস্যের তুলনায় অনেকটাই
ছোটো ছিল, একটু
গোলাটেও। মানে ধারালো ছুরির মতো ঠিক চ্যাপটা নয়। এদের
খাদ্যাভ্যাস বা বাসস্থানের ব্যাপ্তি সম্বন্ধে খুব বেশি জানা না গেলেও একটা জিনিস জানা
গেছে যে এরা খুব সম্ভবত পেক্কারি নামক একধরণের মাঝারি আকারের লোমশ শূকর-জাতীয় প্রাণীর
ঘাড় মটকে নৈশভোজ সারতে বেশ ভালোবাসত! ভাবছ কীভাবে জানলাম? আসলে ফ্লোরিডায়
এদের যে দুটো কঙ্কাল পাওয়া গেছে, সেখানে সেগুলোর সঙ্গেই অনেকগুলো পেক্কারির হাড়গোড়ও পাওয়া গেছে। আর সেটা
থেকেই বিজ্ঞানীদের এই ধারণা। তবে
এদের সম্পর্কে খুব একটা বিশদ তথ্য এখনও জানা সম্ভব হয়নি।
আচ্ছা, সুকুমার রায়ের
'হেঁসোরাম
হুঁশিয়ারের ডাইরি'-র সেই
গোমড়াথেরিয়ামের কথা তো নিশ্চয়ই সবার মনে আছে? এবার তাহলে তারই এক দূর-সম্পর্কের ভাই
হোমোথেরিয়ামের (Homotherium
latidens) কথা বলি। এরাও
ম্যাকায়রোডনটিনি সাব-ফ্যামিলিরই সদস্য; মানে বুঝতেই পারছ এদেরও বেশ জাঁদরেল মার্কা
একজোড়া শ্বদন্ত ছিল। এদের ক্যানাইন
দাঁতগুলো জেনোস্মাইলাসদের তুলনায় একটু বড়ো এবং চ্যাপটা গোছের। এদের
বাসস্থান ছিল উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরেশিয়া এবং আফ্রিকা - মানে প্রায় গোটা
পৃথিবী জুড়েই দাপিয়ে বেড়াতেন এরা। আর এদের
সময়কালটাও নেহাত কম ছিল না - প্লাওসিন ও প্লেইস্টোসিন যুগে, প্রায় চার মিলিয়ন
বছর ধরে ছিল এদের রাজত্ব!
এদের দৈহিক গঠন আজকালকার বড়ো বেড়ালদের
থেকে বেশ একটু আলাদাই ছিল। এদের
সামনের আর পেছনের পায়ের দৈর্ঘ্যগত অনুপাতের কারণে এদের দেখতে অনেকটা আজকের যুগের হায়েনার
মতো মনে হত। আসলে এদের সামনের পা-গুলো ছিল খানিকটা
লম্বা আর পেছনের পায়ের জোড়ার জায়গাটা একটু মোটা, ফলে এদের পেছন থেকে কাঁধ অবধি গোটা শরীরটা
একটু তেরছা হয়ে ওপরে উঠত,
ঠিক যেমনটা হায়েনার ক্ষেত্রে দেখা যায়।
তবে বাকি সবদিক দিয়েই এরা খাঁটি
বেড়াল-বংশীয়। হোমোথেরিয়ামদের দৈর্ঘ্য ছিল মোটামুটি
১.১ মিটার, ওজন
প্রায় ১৯০ কেজি। মানে আকার-প্রকারে বর্তমানকালের কোনও
পুরুষ আফ্রিকান সিংহের সমান। যদিও
এদের ল্যাজটি কিন্তু একেবারেই ছোটো ছিল - বিজ্ঞানীরা এদের কঙ্কাল নিয়ে নাড়াচাড়া করে
দেখেছেন, এদের
ল্যাজে তেরোটি কশেরুকা-খণ্ড ছিল, যেটা যে কোনও দীর্ঘপুচ্ছ বড়ো বেড়ালের ল্যাজের প্রায় অর্ধেক!
এদের বাসভূমি ছিল সিংহ বা চিতাদের মতোই খোলা ঘাস আর ঝোপঝাড় ভরা প্রান্তর। এদের
নাসাছিদ্রও চিতার মতোই একটু বড়ো, যা থেকে বেশ বোঝা যায় যে এরা শিকারের পেছনে ছুটেই শিকার করত।
আচ্ছা, কিন্তু এরা দেখতে
ঠিক কেমন ছিল? চিতার
মতো ছোপছোপ না বাঘের মতো ডোরাকাটা?
আসলে এই প্রশ্নের একেবারে পাকা
উত্তর দেবার কোনও উপায় নেই,
কারণ কঙ্কাল দেখে তো আর গায়ের লোমশ কোটখানার রঙ বোঝা যায় না। তবে
বিজ্ঞানীদের ধারণা, যেহেতু এরা একটু ঠান্ডা, বরফ-পড়া অঞ্চলের এবড়ো-খেবড়ো খোলা প্রান্তরে
বা বড়ো বড়ো বুনো ঘাসের মধ্যে থাকত, তাই খুব সম্ভবত এদের গায়ের লোমের রঙ কিছুটা সাদাটে
ধূসরই ছিল। আসলে খোলা ময়দানের রঙের সঙ্গে মিশ খেয়ে
শিকার ধরবার পক্ষে এর চেয়ে ভালো রঙ আর হয় না। ঠিক
যেমন ঘন জঙ্গলে গা মিশিয়ে থাকবার জন্যে বাঘেদের গায়ে থাকে ডোরাকাটা কোট।
এবার প্রশ্ন হল গিয়ে, এই হোমোথেরিয়ামরা
খেত কী? উত্তরটাও
পাওয়া গেছে ওদের হাড়গোড়ের সঙ্গেই। আমেরিকার টেক্সাস অঞ্চলে ফ্রিসেনহান নামক একটি গুহায়
বেশ কয়েকটি হোমোথেরিয়ামের কঙ্কাল পাওয়া গেছিল। কিন্তু
আসল ব্যাপার সেটা নয়। সেই হোমোথেরিয়ামদের
হাড়গোড়ের সঙ্গেই পড়ে ছিল প্রচুর পরিমাণে ম্যামথ এবং ডাইনোথেরিয়াম-এর (হাতির মতো দেখতে
একধরণের প্রাগৈতিহাসিক জীব। মধ্য
মায়োসিন যুগ থেকে প্লেইস্টোসিন যুগের প্রথম দিক অবধি এদের অস্তিত্ব ছিল।) হাড়গোড়। এর থেকেই
গবেষকরা বুঝতে পারেন যে হোমোথেরিয়ামদের আহার্য তালিকায় সাধারণত এসব বড়ো বড়ো স্তন্যপায়ী
জীবেরাই থাকত। আর হোমোথেরিয়ামদের বিলুপ্তির মূলেই ছিল
সেটাই। একসময় যখন এই মহাকায় তৃণভোজীরা সংখ্যায়
কমে যেতে শুরু করল, তখন
হোমোথেরিয়ামদের জীবনেও দেখা দিল খাদ্যসংকট। তাছাড়া
আমেরিকার বেশ কিছু অঞ্চলে এদের আরও কিছু ম্যাকায়রোডনটিনিদের সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে যুঝতে
হচ্ছিল শিকারের তাগিদে। শিকার ফুরিয়ে
আসছিল, কিন্তু
শিকারি নয়! ফলে আস্তে আস্তে এক সময় বাঁচার লড়াইয়ে টিকতে না পেরে হারিয়ে গেল হোমোথেরিয়ামরা।
কেভ লায়ন, ছবিঃ হাইনরিখ হার্ডার |
অনেক তো হল ম্যাকায়রোডনটিনিদের
কথা, এবার
শোনা যাক এমন এক হারিয়ে যাওয়া বেড়ালের গল্প যে বংশগত দিক দিয়ে আধুনিক সিংহের খুবই নিকট
আত্মীয় ছিল। আধুনিক বাঘ এবং সিংহ, দুজনেই প্যান্থেরা
গোত্রীয়। বাঘের বৈজ্ঞানিক নাম হল প্যান্থেরা টাইগ্রিস
টাইগ্রিস আর সিংহ হল প্যান্থেরা লিও। এই প্যান্থেরা
গোত্রেরই আরেকটি শাখা ছিল প্যান্থেরা স্পিলাই (Panthera spelaea)। ঘরোয়া
নাম কেভ-লায়ন, সোজা
বাংলায় অর্থ করলে গুহা-সিংহ। দেখতে-শুনতে
এরা প্রায় সিংহের মতোই ছিল,
কিন্তু এদের মুখে বর্তমান সিংহদের মতো কেশর দেখা যেত না। এই কেভ-লায়নদের
আবির্ভাব ঘটেছিল ক্রোমেরিয়ান ইন্টারগ্ল্যাসিয়াল যুগে, প্রায় ছয় লক্ষ
বছর আগে। সেই সময় থেকে শুরু করে তেরো হাজার বছর
আগে অবধিও এদের দেখা মিলত ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায়। তাহলে
ব্যাপারটা বুঝতে পারছ?
আমাদের আদিম গুহাবাসী পূর্বপুরুষদের সঙ্গে কিন্তু এই প্যান্থেরা স্পিলাইদের মাঝেমধ্যেই
দেখা সাক্ষাৎ হত। আর তার যথেষ্ট নিদর্শনও রয়েছে। ইউরোপের
বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া প্যালিওলিথিক যুগের কিছু গুহাচিত্রে এই প্যান্থেরা স্পিলাই বা
কেভ-লায়নদের দেখা মেলে। ফ্রান্সের শভে
গুহায় (Chauvet
cave) এমনই একটি ছবি রয়েছে, যেখানে দুটো কেভ-লায়ন একসঙ্গে হাঁটছে। সামনেরটি
একটু ছোটো আর পেছনেরটা বড়ো।
এরা আকারগত দিক থেকে যথেষ্ট বড়ো
ছিল। ১৯৮৫ সালে জার্মানির সেইগসডর্ফ অঞ্চলে
একটি কেভ-লায়নের কঙ্কাল পাওয়া যায়, যার কাঁধের উচ্চতা ছিল ১.২ মিটার এবং
মাথা থেকে পেছন অবধি (ল্যাজ বাদে) দৈর্ঘ্য প্রায় ২.১ মিটার বা ৬.৯ ফিট। এদের
কিছু জীবাশ্ম থেকে পাওয়া লোমের ডি.এন.এ পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এদের লোমশ কোটের
রঙটা বেশ একটু ম্যাড়ম্যাড়ে হলদে-সাদা গোছের ছিল, কিন্তু অনেকটাই মোটা আর ভারী। আসলে
ইউরোপের প্রচণ্ড হাড়-জমানো শীত থেকে বাঁচার জন্যে এ ছাড়া আর কোনও উপায়ও ছিল না।
এই কেভ-লায়ন বা প্যান্থেরা স্পিলাইদের
বাসভূমি ছিল বহুদূর অবধি বিস্তৃত। আলাস্কা
থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, মধ্য-ইউরোপ, গ্রেট ব্রিটেন, পূর্ব ইউরোপীয়
সমভূমি, এমনকী
ইউরেশিয়ার উত্তরভাগ অবধি এদের বসবাসের প্রমাণ মিলেছে। সবচেয়ে
প্রাচীন কেভ-লায়ন জীবাশ্মটি পাওয়া যায় রাশিয়ার ইয়াকুটিয়া অঞ্চলে - বয়স ছিল প্রায় ৬২,৪০০ বছর। আর এখনও
অবধি পাওয়া সবচেয়ে কমবয়সী কেভ-লায়ন জীবাশ্মের বয়স হল ১১,৯২৫ বছর - পাওয়া
গেছিল আলাস্কার ফেয়ারব্যাংক অঞ্চল থেকে।
এরা মোটামুটিভাবে খোলা পরিবেশে
থাকতে ভালোবাসত আর নাম থেকে তো স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে এরা গুহাবাসী। আর খাদ্যাভ্যাস? এদের জীবাশ্ম
থেকে পাওয়া হাড়ের কোলাজেন পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে কেভ-লায়নদের খাদ্যতালিকায় সবচেয়ে
বেশি পরিমাণে ছিল বলগা হরিণ, গুহা-ভালুক এবং কেরভিড জাতীয় হরিণ প্রজাতির জীবেরা। এছাড়াও
এরা জায়েন্ট ডিয়ার, রেড
ডিয়ার, বাইসন, লোমশ গণ্ডার
এবং কমবয়সি ম্যামথও শিকার করত। তবে
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যখন অন্যান্য খাদ্য-প্রজাতিগুলো কমে আসতে থাকে বা সরে যেতে থাকে
অন্য জায়গায়, তখন
এই কেভ-লায়নরা খাদ্যের জন্যে প্রায় সম্পূর্ণভাবেই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল বলগা হরিণের
ওপর। কিন্তু প্রকৃতি এখানেও ঘা মারল। বলগা
হরিণের সংখ্যা কমতে লাগল কেভ-লায়নদের বাসভূমির কাছাকাছি অঞ্চলগুলোতে। আর তারই
সঙ্গে জলবায়ুও পালটে যাচ্ছিল আস্তে আস্তে। এক কথায়
এই সব ফ্যাক্টরগুলিই কেভ-লায়ন বা প্যান্থেরা স্পিলাইদের বিলুপ্তির রাস্তা সাফ করে দিয়েছিল।
স্মাইলোডন পপুলেটর, ছবিঃ চার্লস আর নাইট |
হারিয়ে যাওয়া বেড়ালদের তালিকায়
এবার শেষ যার কথা বলব,
সে কিন্তু বেশ বিখ্যাত। এখনও
মনে আছে, ছোটোবেলায়
ডিসকভারি চ্যানেল খুলে বসলে প্রায়ই এদের দেখা মিলত। আসলে
এই খ্যাতির পেছনে মূল কারণ হল, এদের জীবাশ্ম এবং কঙ্কালের প্রাচুর্য। আর তার
চেয়েও একটা দারুণ ফ্যাক্টর ছিল ওদের দাঁত। মুখের
দু'পাশ
থেকে বেরিয়ে থাকা কাটারির মতো বিশাল দুটো শ্বদন্ত।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছ, এরাও ম্যাকায়রোডনটিনি
পরিবারের সদস্য। নাম? বেশ মজাদার! স্মাইলোডন (Smilodon populator)। আসলে
হোমোথেরিয়ামের মতোই স্মাইলোডনটাও একটা গোত্রনাম আর পপুলেটর হল এই স্মাইলোডন গোত্রের
সবচেয়ে বৃহদাকার প্রজাতি। তবে এদের একটা
তুলনামূলক সহজ নামও আছে,
যেটা হয়তো অনেকে শুনেও থাকতে পারো। সেবার-টুথেড
ক্যাট( saber-toothed
cat) বা সেবার-টুথেড টাইগার। নামটার
কারণ যে ওই দাঁত, সে তো
বুঝতেই পারছ। 'saber' শব্দের অর্থই হল ভারী বাঁকানো তলোয়ার, যার একদিকে ধার
থাকে।
প্লেইস্টোসিন যুগে (২.৫ মিলিয়ন
- ১০,০০০
বছর আগে অবধি) প্রায় সমগ্র উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা জুড়েই এদের অবাধ ঘোরাফেরা ছিল। বিভিন্ন
সময়ে আমেরিকা ও ব্রাজিলের বহু জায়গা থেকে পাওয়া এদের জীবাশ্ম তারই প্রমাণ দেয়। সেই
জীবাশ্মগুলির নিরিখে এখনও অবধি স্মাইলোডনদের মোটামুটি তিনটি প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়েছে
- স্মাইলোডন গ্রাসিলিস,
স্মাইলোডন ফ্যাটালিস ও স্মাইলোডন পপুলেটর। এর মধ্যে
প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজাতিটির দেখা পাওয়া যেত উত্তর আমেরিকায়, আর স্মাইলোডন
পপুলেটরের বাসস্থান ছিল দক্ষিণ আমেরিকা।
এই পপুলেটর প্রজাতিটি যে সবচেয়ে
বড়ো, তা তো
আগেই বলেছি। এদের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১২০ সেন্টিমিটার
এবং ওজন ২২০ থেকে ৪০০ কেজি। সেই
তুলনায় গ্রাসিলিস (৫৫ - ১০০ কেজি) ও ফ্যাটালিস (১৬০ - ২৮০ কেজি, এবং দৈর্ঘ্য
১০০ সেন্টিমিটার) প্রজাতি দুটো অনেকটাই ছোটো। এই স্মাইলোডনদের
দৈহিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ছিল মাংসল দৃঢ় শরীর, সুগঠিত পা, ছোটো পায়ের পাতা
এবং সবচেয়ে নজরকাড়া - ওদের বিশাল দুটো ক্যানাইন দাঁত। ম্যাকায়রোডনটিনি
পরিবারে স্মাইলোডনরাই সবচেয়ে লম্বা শ্বদন্তের অধিকারী - দাঁতের দৈর্ঘ্যই প্রায় ২৮ সেন্টিমিটার। মানে, এক ফুটের চেয়ে
মাত্র দুই সেন্টিমিটার কম! ভাবতে পারছ, এই দাঁত যখন শিকারের গলায় বা বুকে গেঁথে
বসত তখন দৃশ্যটা কেমন ভয়ংকর হত?
হোমোথেরিয়ামদের মতোই এদেরও ল্যাজ
বেশ ছোটো ছিল। গায়ের লোমশ আবরণটা ঠিক কেমন ছিল তা যদিও
বৈজ্ঞানিকভাবে এখনও জানা নেই, তবে ছবিতে বা টিভিতে সাধারণত এদের সাদামাটা বা ছোপছোপ আবরণেই
দেখানো হয়। এটা কিন্তু নিছকই কিছু সম্ভাব্য তথ্যের
ওপর গড়ে ওঠা একটি অনুমান।
স্মাইলোডনরাও অন্যান্য প্রায় সব
বড়ো বেড়ালদের মতোই কমবেশি শিকারি ছিল। এদের
জীবাশ্ম এবং হাড়ে সংরক্ষিত বিভিন্ন আইসোটোপ পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে এদের ভোজ্যতালিকায়
প্রচুর পরিমাণে বাইসন (Bison
antiques - এটি
বর্তমান আমেরিকার বাইসনের তুলনায় অনেকটাই বড়ো।) এবং
উট (Camelops) ছিল। পরবর্তীকালে
যখন এই স্মাইলোডনরা উত্তর থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ল, তখন তাদের শিকারেরও
পরিবর্তন ঘটতে লাগল। দক্ষিণ আমেরিকায়
বাইসন এবং উট না থাকায় তাদের মুখ্য শিকার হয়ে উঠল ঘোড়া এবং হাতি জাতীয় কিছু স্তন্যপায়ী
প্রাণী। এছাড়াও এদের শিকার তালিকায় ম্যামথ, অ্যান্টিলোপ, হরিণ, ম্যাস্টোডোন
(হাতির মতো দেখতে একটি বিলুপ্ত প্রজাতি) এবং গ্রাউন্ড শ্লথও ছিল। এমনিতে
স্মাইলোডনরা শিকারি হলেও,
এদের যে প্রয়োজনে মৃতভোজী হতেও বিশেষ আপত্তি ছিল না, তার অনেক প্রমাণই
পাওয়া গেছে। সরাসরি শিকারে অক্ষম হলে অন্যের শিকার
ছিনিয়ে খাওয়া থেকে অন্য শিকারি জীবেদের ফেলে যাওয়া খাদ্যাংশ গ্রহণ, কিছুতেই পিছপা
হত না এরা।
স্মাইলোডন ফ্যাটালিস, ছবিঃ রবার্ট ব্রুস হর্সফল |
আজ থেকে মোটামুটি ১০,০০০ বছর আগে
স্মাইলোডনরা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায়। এদের
বিলুপ্তির মূল কারণ ছিল বড়ো স্তন্যপায়ী জন্তুদের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং ক্ষেত্রবিশেষে
বিলুপ্তি। একদিকে যখন ম্যামথ বা ম্যাস্টোডোনদের
মতো বড়ো কিন্তু ধীর গতির জীবগুলো বিলুপ্ত হয়ে আসছিল তখন তাদের জায়গা ভরিয়ে তুলছিল হরিণের
মতো ছোটো কিন্তু ক্ষিপ্রগামী জীবেরা। স্মাইলোডনরা
অতর্কিত আক্রমণে শিকার বা মৃতভোজনে দক্ষ হলেও, পিছু ধাওয়া করে শিকার ধরার জন্যে তাদের
দৈহিক গঠন মোটেও তেমন উপযোগী ছিল না। এছাড়া
সেই একই সময়ে ওদের আমেরিকান লায়ন (Panthera leo atrox), ডায়ার ওলফ (নেকড়ে
জাতীয় একটি বিলুপ্ত প্রজাতি), হোমোথেরিয়াম ও আরও বেশ কিছু দক্ষ শিকারির সঙ্গেও বাঁচার লড়াই
লড়তে হচ্ছিল। ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছিল স্মাইলোডনরা। আর প্রকৃতির
এই নিষ্ঠুর ময়দানে,
'যোগ্যতমের উদ্বর্তন'-এর এই
দুনিয়ায় যে পিছিয়ে পড়ে,
সে-ই হারিয়ে যায়!
ভাবতেও অবাক লাগে, যারা এক সময়
পৃথিবীর বুকে, বনে-প্রান্তরে, ময়দানে দাপিয়ে
বেড়াত তারা আজ শুধুই কঙ্কাল আর জীবাশ্ম হয়ে আটকে আছে মিউজিয়ামের কাচের বাক্সে। সেই
হারিয়ে যাওয়া বেড়ালরা আর কোনওদিন ছুটে বেড়াবে না আমেরিকার বিস্তীর্ণ ঘাসের ময়দানে, ইউরোপের বরফঢাকা
এবড়ো-খেবড়ো পাহাড়ি প্রান্তরে কিংবা আফ্রিকার শুকনো মাটিতে। প্রতি
মুহূর্তে বদলে যাওয়া প্রকৃতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি ওরা, হেরে গেছে জীবনের
যুদ্ধে। আর তাই একটু একটু করে সময়ের করাল গ্রাসে
তলিয়ে যাওয়াটাই ছিল ওদের ভবিতব্য!
------------------------------------------------------------------
তথ্যসূত্র :-
_____
শীর্ষচিত্রঃ স্মাইলোডন ফ্যাটালিস, ছবিঃ চার্লস আর নাইট
No comments:
Post a Comment