ইতিহাসের ছোঁয়া : কাকাতু দ্বীপ
সুমন মিশ্র
প্যারামাটা
নদীর বিস্তৃত জলরাশির বুক চিরে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে ‘রিভারক্যাট’। ‘ডাক’ নদী যেখানে প্যারামাটা
নদীতে এসে মিশেছে সেই স্থান অতিক্রম করেছি অনেকক্ষণ আগে। তখন নদী পথ ছিল অপেক্ষাকৃত কম
প্রশস্ত, আর জল ছিল শান্ত।
সেই জলে ভেসে বেড়াতে দেখা যাচ্ছিল পেলিকান, সী-গাল ইত্যাদি পাখিদের। এখন নদী ক্রমশ চওড়া হচ্ছে। নদীর বুকে ঢেউ ক্রমশ বাড়ছে, সঙ্গে
বাড়ছে বাতাসে একটা সামুদ্রিক মেছো গন্ধ।
আমরা ক্রমশ এগিয়ে চলেছি সিডনী হারবারের আরও কাছে।
সিডনী
হারবার! যাকে ছাড়া অস্ট্রেলিয়াকে কল্পনা করা যায় না। অস্ট্রেলিয়া বললেই চোখের সামনে
ভেসে ওঠে বর্ষবরণের আতশ বাজি প্রদর্শনী, সিডনী হারবার ব্রিজ আর অপেরা হাউস। এই সবকটাই যে সিডনী হারবারের সঙ্গে
জড়িত!
ঢেউ
যত বাড়ছে সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়ে চলেছে রিভারক্যাট-এর দুলুনি। রিভারক্যাট দুলছে ঠিকই তবে দুর্ঘটনা
ঘটার সম্ভাবনা তেমন নেই। কারণ
এই বিশেষ অবস্থার জন্যই রিভারক্যাট তৈরি।
রিভারক্যাট
আসলে এক বিশেষ ধরনের জলযান।
প্রায় ২৩০ জন যাত্রী পরিবহনের ক্ষমতাসম্পন্ন এই জলযানটি প্রায় সাঁইত্রিশ
মিটার লম্বা এবং গতিবেগ প্রায় বাইশ নটস।
‘প্যারামাটা’ থেকে ‘সার্কুলার কী’ (সিডনীর প্রধান পর্যটন কেন্দ্র, সিডনী
হারবার ব্রিজ আর অপেরা হাউস দুটোই এখানে অবস্থিত) পর্যন্ত ফেরি চলাচলের জন্য এটি ব্যাবহৃত
হয়। এই
জলপথ ‘সিডনী ফেরি সার্ভিস’-এর অন্তর্গত এবং একে ‘প্যারামাটা রিভার ফেরি সার্ভিস’
বলা হয়, যার পোশাকি নাম ‘এফ থ্রি’।
আজ
বাইশে সেপ্টেম্বর দু’হাজার আঠেরো, শনিবার।
অস্ট্রেলিয়ায় শীতের মরসুম প্রায় শেষের দিকে। এমনিতে ঠাণ্ডা অতটা না হলেও
সমস্যাটা সৃষ্টি করেছে হু হু করে বয়ে চলা ঠাণ্ডা সামুদ্রিক হাওয়া। বাতাসের বেগ এতটাই বেশি যে মাঝে
মাঝে ভয় লাগছে ছবি তোলার সময় হাত থেকে ফোন ছিটকে বেরিয়ে না যায়। আমি একটা সোয়েটার আর তার উপরে
একটা হুডি চাপিয়েও রীতিমতো কাঁপছি।
আমার সঙ্গে আছে আরও চার জন।
তাঁদের পুরো নাম না নিয়ে বরং নামটা সংক্ষিপ্ত ভাবে বলা যাক। প্রথম দু’জন হল যথাক্রমে আর.ডি এবং
এম.কে, এঁরা আমার সহকর্মী। বাকি
দু’জন হল আর.ডি–র পরিচিত। তাঁদের সঙ্গে আমার পরিচয় সংক্ষিপ্ত, তাই সেই দু’জন নিজের
মতো গল্প করছিল। আর আমি, আর.ডি আর এম.কে ডেকের সামনের দিকে রেলিং-এ হেলান দিয়ে
গল্প করছি। মাঝে মাঝে একে অন্যকে ছবি তুলে দেওয়ার জন্য আবদার জানাচ্ছি। বলতে
দ্বিধা নেই সে ব্যাপারে উৎসাহটা আমারই বেশি ছিল।
এখন
দুপুর বারোটা ছত্রিশ। আমরা
এখন চলেছি গ্ল্যাডসভিল সেতুর ঠিক নীচ দিয়ে। প্যারামাটা নদীর উপর বিভিন্ন স্থানে যানবাহন
চলাচলের জন্য অনেকগুলো সেতু রয়েছে। এটি তাদের মধ্যে সর্বশেষ এবং সম্ভবত সবচেয়ে
সুন্দর। নদীর এপার থেকে ওপারে একটানা কংক্রীটের ঢালাই–এ তৈরি ধনুকাকৃতি এই সেতুটি আধুনিক
স্থাপত্য রীতির এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
সেতু
পেরিয়ে আর একটু এগোতেই হঠাৎ যেন নদী অনেক চওড়া হয়ে গেল। তার কারণ হল সামনেই কিছু দূরে ‘লেন
কোভ’ নদী এসে প্যারামাটা নদীতে মিশেছে। সামনে শুধু জল আর জল, সঙ্গে প্রবল
সামুদ্রিক হাওয়া। আমাদের
সামনে ডানদিকে রয়েছে ড্রাম্ময়েন ফেরিঘাট, আর সামনে সেই বহু প্রতীক্ষিত দৃশ্য। সামনে
পাশাপাশি দুটো দ্বীপ। তখন নাম
জানতাম না, পরে জেনেছিলাম প্রথমটি স্প্যেক্টাকল দ্বীপ, তার পাশে বাঁ দিকে কাকাতু
দ্বীপ। তার পিছনে উঁকি দিচ্ছে সিডনীর স্কাই লাইন। বড়ো আবছা ভাবে দেখা যাচ্ছে সিডনীর
সর্বোচ্চ ইমারত ‘সিডনী টাওয়ার’ বা ‘সিডনী টাওয়ার আই’-কে। আর কাকাতু দ্বীপের পিছনে বহু দূরে
দেখা যাচ্ছে সিডনী হারবার ব্রিজের শীর্ষভাগ। যা চিরকাল বই, কাগজ আর ইন্টারনেটে
দেখে এসেছি সেই সিডনী হারবার ব্রিজকে স্বচক্ষে প্রথমবার দেখার যে মুগ্ধতা, তাকে
ভাষায় প্রকাশের ক্ষমতা আমার নেই।
প্যারামাটা নদী থেকে দেখা গ্ল্যাডসভিল সেতু |
সকালে
প্রায় সাড়ে এগারোটায় যখন প্যারামাটা ফেরি ঘাট থেকে রিভারক্যাটে উঠেছিলাম তখন ঠিক
ছিল আমরা সোজা যাব ‘সার্কুলার কী’। সেখানে
কিছু সময় কাটিয়ে, দ্রষ্টব্য স্থানগুলো ঘুরে তারপর চলে যাব ‘প্যাডি মার্কেট’, কারণ আর.ডি-র
কিছু কেনাকাটা করতে হবে। প্যাডি মার্কেট হল উপহার কেনার জন্য সিডনীতে সেরা জায়গা। আর.ডি-র দেশে ফিরে যাওয়ার সময় প্রায়
এসে গেছে, হাতে সময় খুব কম, সুতরাং সে আজই প্যাডি মার্কেট যাবে। কিন্তু ড্রাম্ময়েন ফেরিঘাট আসতেই
দলের বাকিরা বেঁকে বসল। কাকাতু দ্বীপের পাশ দিয়ে যখন যাওয়া হচ্ছেই তখন সেখানে একটু
নেমেই দেখা যাক। এমনিতে ফেরি ছাড়া সেখানে যাওয়ার উপায় নেই। আর প্যারামাটা থেকে
সিডনী যেখানে রেলপথে মোটে চল্লিশ মিনিটে পৌঁছানো যায় সেখানে প্রায় দু’ঘন্টার এই
সৌখিন ফেরি যাত্রা আবার কবে হবে বলা মুশকিল। অতএব ঠিক হল আমাদের গন্তব্য প্রথমে
কাকাতু দ্বীপ। তারপর সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আবার ফেরি ধরে চলে যাব সার্কুলার
কী। এই
লেখাতে মূলত আমি আলোচনা করব কাকাতু দ্বীপ সম্পর্কে।
সত্যি
বলতে আমি কাকাতু দ্বীপে নামতে হবে শুনে অবাকই হয়েছিলাম। সিডনীতে আসার আগেই আমি
সেখানকার দ্রষ্টব্য স্থানগুলো সম্পর্কে বেশ কিছু পড়াশোনা করি এবং সেই অনুযায়ী একটা
চেক লিস্টও বানাই। তালিকাটি নিঃসন্দেহে দীর্ঘ ছিল কারণ ঘোরার ব্যাপারে আমার উৎসাহ
চিরকালই বেশি। তবে কাকাতু দ্বীপ আমার সেই তালিকায় ছিল না। নামটাও আগে আমি শুনিনি। দূরে তখন
সিডনী হারবার ব্রিজ ক্রমশ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে আর সেখানে আমরা নেমে পরব
কাকাতু দ্বীপে!! কী আছে এখানে? কাকাতুয়া??
সিডনীর
‘সেন্ট্রাল বিজনেস ডিসট্রিক্ট’ থেকে ১০ কিমি পশ্চিমে প্যারামাটা আর লেন কোভ নদীর সংযোগস্থলে
প্রায় চুয়াল্লিশ একর জায়গার উপর অবস্থিত এই দ্বীপটি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দ্বীপের উচ্চতা
প্রায় আঠেরো ফুট। যোগাযোগের একমাত্র উপায় ফেরি সার্ভিস।
কাকাতু
দ্বীপের ফেরিঘাট দ্বীপের উত্তর পূর্ব কোণে অবস্থিত। সমস্ত আধুনিক যাত্রী পরিষেবা
ব্যাবস্থা সম্পন্ন ফেরি ঘাটে আছে হুইল চেয়ারে ওঠা নামার আলাদা ব্যাবস্থা। আমরা যখন
কাকাতু দ্বীপে নামলাম তখন ঘড়িতে বাজে প্রায় দুপুর একটা। আকাশে কখনও কখনও মেঘ দেখা
দিচ্ছে আবার পরক্ষণেই মেঘ কেটে বেরিয়ে আসছে ঝকঝকে রোদ। সঙ্গে প্রবল হাওয়া। ফেরি ঘাটে
দাঁড়িয়ে সামনেই দেখা যাচ্ছে বিস্তৃত সিডনী ব্রিজ। আমি মুগ্ধ হয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ
করছি, এমন সময় হঠাৎ খেয়াল করলাম দলের বাকিরা আমায় ফেলেই এগিয়ে গেছে। অগত্যা দ্রুত
তাদের পিছু নিলাম।
ফেরিঘাট
থেকে বেরোতেই প্রথমে চোখে পড়ে কাকাতু দ্বীপের প্রবেশ পথ এবং তার সংলগ্ন প্রশাসনিক
দপ্তর। এখানে পর্যটকদের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। এছাড়াও পর্যটকরা
চাইলে এখানে জিনিসপত্র রাখার জন্য লকারও ভাড়া নিতে পারেন।
কাকাতু
দ্বীপে প্রবেশ করে প্রথমেই সামনে পড়ে ‘ভিজিটর সেন্টার’, এখানে দ্বীপ সম্পর্কে
বিভিন্ন তথ্য জানা যায়, এছাড়া দ্বীপে থাকার জায়গা সম্পর্কিত বা পর্যটকদের জন্য
বিভিন্ন ‘গাইডেড ট্যুর’ সম্পর্কিত সমস্ত তথ্য এখানে পাওয়া যায়।
কাকাতু দ্বীপের প্রবেশ পথ |
দু’হাজার
এক সাল থেকে ‘সিডনী হারবার ফেডারেশন ট্রাষ্ট’ এই দ্বীপের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে। যদিও দ্বীপটিতে আগে সাধারণ
মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল না। দু’হাজার সাত সালে এটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া
হয়। পর্যটকরা যাতে পরিবারের সকলকে নিয়ে এখানে ঘুরতে আসতে পারেন তার জন্য বিভিন্ন
রকম ব্যবস্থা এখানে আছে। ইতিহাস মাখা এই দ্বীপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইউরোপীয়
উপনিবেশের সময়কার বিভিন্ন নিদর্শন। কাকাতু দ্বীপ সম্পর্কে জানার এবং ঐতিহাসিক
নিদর্শনগুলি ঘুরে দেখার জন্য কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু গাইডেড ট্যুরের ব্যবস্থা করেছেন।
এর মধ্যে বিশেষভাবে জনপ্রিয় ‘সেলফ গাইডেড ট্যুর’ (মূল্য তিন অস্ট্রেলিয়ান ডলার)
এবং ‘অডিও ট্যুর’ (মূল্য প্রায় পাঁচ অস্ট্রেলিয়ান ডলার। সময় লাগে প্রায় নব্বই
মিনিট। ‘ভিজিটর
সেন্টার’ থেকে ম্যাপ পাওয়া যায় যাতে দ্বীপের দ্রষ্টব্য জিনিসের অবস্থান বলা থাকে।
এছাড়া কাকাতু দ্বীপের বর্ণময় ইতিহাস বলা হয়ে থাকে এই অডিও ট্যুরে)। এছাড়াও আছে ‘হন্টেড হিস্ট্রি
ট্যুর’ (সময় নব্বই মিনিট। সাধারণত যে সমস্ত পর্যটক দ্বীপে রাত্রিবাস করেন তাদের
জন্য এই ভৌতিক ট্যুর), প্রবীণ নাগরিকদের জন্য আলাদা ‘সিনিওর ট্যুর’ এবং সব বয়সিদের
জন্য ‘অন ডিমান্ড হিস্ট্রি ট্যুর’–এর ব্যবস্থা আছে। শেষ দুটির ক্ষেত্রে সময়সীমা এক
থেকে দেড় ঘন্টা এবং কমপক্ষে দশ জন না হলে হবে না।
এবার
সবার আগে এই কাকাতু দ্বীপের ইতিহাসটা একটু আলোচনা করা যাক। কাকাতু দ্বীপের ইতিহাস
বেশ পুরোনো। সিডনীতে ইউরোপীয় উপনিবেশ শুরুর অনেক আগে থেকেই এই দ্বীপে মানুষের
আনাগোনা ছিল। সেই সময় এর পাঁচটা প্রাকৃতিক দ্বীপের মতোই কাকাতু দ্বীপ ছিল সবুজ
অরণ্যে ঘেরা। এখানে এক ধরনের গাছ পাওয়া যেত যার লাল আঠা আদিম জনজাতি (ইওরা জনজাতি)
তাদের মাছ ধরার নৌকা তৈরিতে ব্যবহার করত। তারা এই দ্বীপকে বলত ওয়ারিয়ামাহ। ঘন বন
জঙ্গল থাকার কারণে এই দ্বীপে প্রচুর হলুদ ঝুঁটিওয়ালা কাকাতুয়া বা সালফার ক্রিস্টেড
কাকাতুয়া দেখা যেত। ইউরোপীয়রা এই দ্বীপে পা রাখার পর এখানকার ঘন সবুজ বনানী ধ্বংস
করে। ফলে সালফার ক্রিস্টেড কাকাতুয়ার আনাগোনাও কমে যায়। যদিও মনে করা হয় সেই
কাকাতুয়াদের নাম থেকেই এই দ্বীপের নাম।
সিডনীর
ইউরোপীয় উপনিবেশের সময় মূলত শাস্তিস্বরূপ ইউরোপের দাগী আসামীদের অস্ট্রেলিয়ায়
পাঠানো হত। তাঁদের কাজ ছিল দিনভর কঠোর পরিশ্রম করে সিডনীর পাথুরে এলাকায়
রাস্তাঘাট, বাড়ি, গুদাম এগুলি তৈরি করা। কিন্তু তাদের মধ্যেও যারা আবার অপরাধমূলক
কাজে জড়িয়ে পড়ত তাদের বন্দি করা হত নরফোক দ্বীপের কারাগারে।
সাল
আঠেরোশো উনচল্লিশ। নিউ সাউথ
ওয়েলসের গভর্নর স্যার জর্জ গিপস এই দ্বীপটিকে বেছে নিলেন সিডনীতে অপরাধীদের
দ্বিতীয় দফা শাস্তি প্রদানের জন্য। নরফোক
দ্বীপের কারাগারকে স্থানান্তরিত করা হল এখানে। চারদিক জলে ঘেরা বলে এখান থেকে
বন্দিদের পালানো ছিল বেশ কঠিন কাজ। প্রথম দিকে বন্দিদের কাজ ছিল কয়েদখানা নির্মাণ,
মিলিটারি গার্ডদের থাকার জন্য বাড়ি নির্মাণ, আধিকারিকদের থাকার জন্য বাড়ি নির্মাণ।
পরবর্তীকালে ওই সমস্ত অপরাধীদের দ্বীপে পাথর কাটার কাজে ব্যবহার করা হত। সেই পাথর
ব্যবহার হত সিডনীতে বিভিন্ন নির্মাণকার্যের জন্য।
পরে
আঠেরোশো সাতচল্লিশ সালে দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে শুরু হয় অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ‘ড্রাই
ডক’ - ফিৎজরয় ডক খননের কাজ। সেই কাজ চলে পরবর্তী দশ বছর। কাজে লাগানো হয়
সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের। কোনও রকম আধুনিক ব্যবস্থা ছাড়া শুধুমাত্র সাধারণ কিছু
যন্ত্র দিয়ে এত বড়ো একটা ডক খনন যে কী পরিমাণ অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ তা হয়তো আমরা
কল্পনাও করতে পারি না। এখানে অপরাধীদের জীবন ছিল দুর্বিষহ। তিনশো অপরাধী রাখার ব্যবস্থা
থাকলেও কোনও কোনও ক্ষেত্রে পাঁচশো জনকেও কয়েদ করে রাখা হত।
অবশেষে
আঠেরোশো উনসত্তরে কাকাতু দ্বীপের কারাগার বন্ধ করা হয় এবং বন্দিদের অন্যত্র
স্থানান্তরিত করা হয়। পরে পরিত্যক্ত জেলখানা, গার্ড হাউসগুলো নিয়েই তৈরি হয় অনাথ মেয়েদের
জন্য শিল্প শিক্ষা এবং মেয়ে অপরাধীদের জন্য সংশোধনাগার। যদিও এটা দুর্ভাগ্যের বিষয় যে
কর্তৃপক্ষ সেই সমস্ত অনাথ মেয়েদের সঙ্গে সংশোধনাগারে থাকা মেয়েদের খুব একটা
পার্থক্য করত না। শেষ পর্যন্ত আঠেরোশো অষ্টআশি সালে এই সব অনাথ মেয়েদের
প্যারামাটায় স্থানান্তরিত করা হয়।
ততদিনে
অবশ্য দ্বীপের একাংশে জাহাজঘাটা তৈরি হয়েছে, যা ক্রমে ব্যাপক আকার ধারণ করে। জাহাজ মেরামতি
তো চলছিলই, পাশাপাশি আঠেরোশো সত্তর থেকে আশির মধ্যে এখানে প্রথম জাহাজটি তৈরি হয় (‘এইচ
এম এস হেরাল্ড’)। এই
সাফল্যের ফলস্বরূপ শুরু হয় দ্বীপের দ্বিতীয় ডক নির্মানের কাজ - সাদারল্যান্ড ডক।
আস্ট্রেলিয়ার
অন্যতম জাহাজঘাটা হিসাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই কাকাতু দ্বীপে তৈরি হয় ছোটো বড়ো দেড়শোর
উপর জাহাজ ও নৌকা।
উনিশশো
তেরো থেকে উনিশশো সাতাশ, মানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও তার পরবর্তী বেশ কিছুকাল এই
দ্বীপ চলে যায় ‘রয়্যাল অস্ট্রেলিয়ান নেভি’-র হেফাজতে। তারা এই সময় এই দ্বীপটিকে
তাঁদের নৌঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করে। এই সময় এখানেই অস্ট্রেলিয়ার প্রথম যুদ্ধজাহাজ
তৈরি হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এই দ্বীপ হয়ে ওঠে দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত
মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান জাহাজ সারাই কারখানা। তবে এই সুখের দিনেরও এক সময়
পরিসমাপ্তি ঘটে। ক্রমবর্ধমান বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতার সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরে
সত্তরের দশকে কাকাতু দ্বীপের জাহাজ শিল্প ভীষণ মন্দার মুখোমুখি হয়। অবশেষে উনিশশো বিরানব্বই সালে এই জাহাজঘাটা
বন্ধ হয়ে যায়। শেষ যে জাহাজটি এখানে তৈরি হয়েছিল তার নাম ‘এইচ এম এ এস সাকসেস’। এটি ছিল অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড়ো
নৌ-তরী।
ইতিহাসের
কথা অনেক হল, এবার আবার ফিরে আসি ভ্রমণ অভিজ্ঞতায়। কাকাতু দ্বীপটিকে দু’ভাগে ভাগ
করা যায়। দ্বীপের নিম্নভাগ (লোয়ার আইল্যান্ড) আর দ্বীপের উচ্চ অংশ (আপার
আইল্যান্ড)। আপার আইল্যান্ড আসলে একটা পাথরের টিলা, সেখানেই আগে অপরাধীদের বন্দি
রাখা হত। আমি
প্রথমে লোয়ার আইল্যান্ডটা ঘুরে দেখব বলে ঠিক করলাম। কাকাতু দ্বীপের প্রবেশ পথ দিয়ে
ঢুকেই ডান দিকে চোখে পড়ল একটা কামান রাখা আছে। এই কামানটিরও নিজস্ব একটা ইতিহাস
আছে। কামানটি সতেরশো সাতানব্বই সালে বার্মিংহামে ওয়াকার এন্ড কোং প্রস্তুত করে। এটি
হয়তো ঔনিবেশিক যুগে সিডনীর নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করা হত। তারপর বহুদিন এই
কাকাতু দ্বীপের পিছনে ফিৎজরয় জাহাজঘাটার পাশে পড়ে ছিল। অবশেষে ২২শে মার্চ উনিশশো
ছিয়াত্তরে এটিকে সারাই করে কাকাতু দ্বীপের শিপ ইয়ার্ডে রাখা হয়। শিপ ইয়ার্ড বন্ধ
হয়ে যাওয়ার পর কামানটিকে সেখান থেকে পরবর্তীকালে স্প্যেক্টাকল দ্বীপে নিয়ে যাওয়া
হয়। দু’হাজার সাত সালে যখন কাকাতু দ্বীপ জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হবে ঠিক হল,
তখন নৌ-বাহিনী কামানটিকে আবার কাকাতু দ্বীপে ফিরিয়ে আনে। কামানের পাশে লেখা ছিল যে
এটা হেরিটেজ তকমা যুক্ত এবং এর উপর ওঠা নিষেধ। যদিও শিশু থেকে শুরু করে অনেক পরিণত
বয়স্কদের আমি এর উপর বসে ছবি তুলতে দেখেছি।
সতেরশো সাতানব্বই সালে বার্মিংহামে ওয়াকার এন্ড কোং প্রস্তুত করে এই কামানটি |
কামানটা
যেখানে বসানো সেখান থেকে শুরু হচ্ছে ‘নর্দান অ্যাপ্রন পার্ক’। এটি দ্বীপের উত্তর ভাগে পূর্ব
প্রান্ত থেকে পশ্চিমে অবস্থিত স্লিপওয়ে (এখানে দুটি স্লিপওয়ে আছে। কাকাতু দ্বীপের
জাহাজ ঘাটায় তৈরি বা মেরামত করা জাহাজকে আবার জলে নামানোর জন্য এটা ব্যবহার হত)
অবধি বিস্তৃত। এই
পার্কের পাশ দিয়ে সমান্তরালে চলে গেছে একটা পিচের রাস্তা। রাস্তার দু’পাশের অংশে
ছোটো বড়ো গাছ লাগানো আছে। হাঁটা শুরু করলাম সেই রাস্তা ধরে। একটু এগোতেই চোখে পড়ল পথের
বাম পাশে রাখা বেশ কিছু যন্ত্রাংশ। বিশাল
আকারের এই যন্ত্রাংশগুলো খোলা আকাশের নীচে পড়ে থেকে মরচে ধরেছে। ঠিক তার উলটো দিকে
পথের ডান পাশে সবুজ লন যা ‘নর্দান অ্যাপ্রন পার্ক’-এর অংশ। এই সবুজ জমিতে দেখলাম
অনেকগুলো ছোটো বড়ো তাঁবু। আসলে দ্বীপ পরিচালন সমিতি এখানে ক্যাম্পিং-এর ব্যবস্থা
করেছেন। কাকাতু দ্বীপে পর্যটকরা চাইলে রাত্রিবাসও করতে পারেন। তার জন্য ভিজিটর
সেন্টারে গিয়ে বুকিং করা যায়। সে ক্ষেত্রে কাকাতু দ্বীপের উচ্চ অংশে অবস্থিত
হেরিটেজ বাড়িগুলো অথবা এই ক্যাম্পিং-এর জায়গায় যে তাঁবুগুলো আছে সেখানে থাকা যেতে
পারে। এছাড়াও এই ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড-এ আছে বারবিকিউ-র আলাদা ব্যবস্থা।
এগিয়ে
গেলাম যন্ত্রাংশগুলোর দিকে। এদের নাম ‘দ্যা বিম বেন্ডার’। আসলে এগুলো ‘হিউ স্মিথ প্লেট
বেন্ডিং মেশিন’। ১৯২০
সালে তৈরি এবং প্রায় ১৯৪০ পর্যন্ত ব্যবহৃত হত। জাহাজের কাঠামোয় যে ধাতব পাত ব্যাবহৃত
হত তা বেঁকিয়ে নিতে এই যন্ত্র ব্যাবহৃত হত। আসলে এই পথ, ক্যাম্পিং গ্রাঊন্ড সবই
সেই সময় জাহাজ কারখানার মধ্যে ছিল। যখন এই দ্বীপের জাহাজঘাটা বন্ধ হল, তখন বেশিরভাগ
যন্ত্রাংশ বিক্রি করে দেওয়া হয়, কারখানার বেশিরভাগ অংশ ভেঙ্গে ফেলা হয়। রয়ে গেছে
এই বিম বেন্ডার আর বেশ কিছু ক্রেন।
‘দ্যা বিম বেন্ডার’ |
এগিয়ে
গেলাম আরও। সামনে পড়ল ক্যাম্প ফায়ারের জায়গা। আশেপাশে দ্বীপ কর্তৃপক্ষ ফুলের গাছ
দিয়ে সাজিয়েছেন। কিন্তু সেগুলো দখল করেছে সী-গাল পাখির দল। শুধু কাকাতু দ্বীপেই
আমি একদিনে যত সী-গাল দেখেছিলাম তার দশ শতাংশ-ও সিডনীতে পরের তিন মাসে দেখিনি। কখনও
কখনও মনে হচ্ছিল এটা কাকাতু দ্বীপ না হয়ে সী-গাল দ্বীপ হলে মন্দ হত না। পাখিগুলো
কাছাকাছি আছে কিন্তু প্রত্যেকের বাসা আলাদা। বেশিরভাগ বাসাতেই মা সী-গাল ডিমে তা
দিচ্ছে, আর কোনও মানুষ বাসার কাছাকাছি গেলে গৃহস্বামী তাকে তাড়া করছে। একটা বাচ্চা
মেয়েকে সী-গালে এমন তাড়া করল যে সে কাঁদতে কাঁদতে তার মায়ের পিছনে লুকিয়ে পড়ল। আর
একটা মজার জিনিস, এটা আমি পরেও অনেকবার দেখেছি যে সী-গাল পাখির দিকে হেঁটে এগিয়ে
গেলে সে উড়ে পালায় না বরং সেও হেঁটে পালানোর চেষ্টা করে। আমি যদি হাঁটার গতি
বাড়িয়ে দিই তাহলে সেও হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। অনেকক্ষেত্রে সী-গাল পাখিটাকে দেখে
মনে হয় সে দৌড়ে পালাতে চাইছে, কিন্তু উড়ে সে পালায় না। যেন উড়তে কী করে হয় সে হঠাৎ
ভুলে গেছে।
সী-গালের
কান্ড দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি, এমন সময় দেখি দ্বীপের পশ্চিম প্রান্তের স্লিপওয়েতে
চলে এসেছি। দুটি স্লিপওয়ের একটি খালি পড়ে, অন্যটিতে পুরোনো এক বিবর্ণ সামুদ্রিক নৌকার
কাঠামো রাখা। এ যেন এই দ্বীপেরই ইতিহাসের স্মারক। একসময় যে দ্বীপ গমগম করত
জাহাজঘাটার কর্মচারীদের কলরবে, যে দ্বীপ দেখেছে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রথম অধ্যায়, অপরাধীদের
অসহনীয় জীবন, সে আজ একা। শূন্য বুকে সে বহন করছে অতীতের দীর্ঘশ্বাস। মাঝের পিচের রাস্তা ধরে এগিয়ে
গেলাম। দ্বীপের শেষ প্রান্তে এসে দেখলাম আমার আগেই আর.ডি আর এম.কে সেখানে পৌঁছে
গেছে। আকাশ তখন হালকা মেঘলা, সঙ্গে এলোমেলো হাওয়ায় মন কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল অতীতের
কথা ভেবে।
কাকাতু
দ্বীপের উচ্চ অংশটি উঁচু পাথুরে টিলা। দ্বীপের
নীচের অংশ থেকে খাড়া পাথুরে দেওয়াল উঠে গেছে। সেই পাথুরে টিলার গায়ে অসংখ্য ছোটো
বড়ো গাছ। নীচ থেকে উপরে ওঠার জন্য দুটো খাড়াই কংক্রিটের সিঁড়ি রয়েছে। একটি উত্তরে, অপরটি দক্ষিণে।
ফিরতি
পথ ধরেছি, এমন সময় আর.ডি দেখাল একটা টানেলের প্রবেশ পথ। অন্ধকার, টিমটিমে আলো জ্বলছে
ভিতরে। প্রবেশ পথের মুখে পাথুরে টিলার গা বেয়ে নেমে আসা গাছপালার ডাল, শিকড় এক রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এরকম দুটো টানেল আছে এই দ্বীপে। আমাদের সামনেরটা ‘টানেল ওয়ান’।
যা আপার আইল্যান্ড-এর ভিতর দিয়ে গিয়ে দ্বীপের উত্তর ভাগকে দক্ষিণ
অংশের সঙ্গে যুক্ত করেছে।
অপরটি ‘ডগ লেগ টানেল’ (এই টানেলের আকৃতি অনেকটা কুকুরের পিছনের পায়ের মতো,
তৈরি হয় ১৯৪২ সালে) যা দ্বীপের পূর্ব প্রান্তকে দক্ষিণের সঙ্গে যুক্ত করেছে। দুটি টানেলই তৈরি হয়েছিল মালপত্র সরবরাহের
সুবিধার জন্যে। তবে
‘ডগ লেগ টানেল’ তৈরির আর একটা উদ্দেশ্য ছিল, যাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শত্রু
বিমান হানা থেকে বাঁচা যায়, যদিও সৌভাগ্যক্রমে এই দ্বীপ কখনোই শত্রু আক্রমণের
সামনে পড়েনি।
‘টানেল ওয়ানের’ প্রবেশ পথ |
‘ডগ লেগ টানেল’-এর ভিতরে |
আবার
ফিরে এলাম ‘ভিজিটর সেন্টার’-এর কাছে। এর ঠিক পিছনেই আছে প্রমাণ সাইজের দাবার
বোর্ড। পর্যটকরা এখানে দাবা খেলার আনন্দ উপভোগ করতে পারে। তবে বসে খেলা যাবে না।
কারণ দাবার গুটিগুলো প্রমাণ সাইজের। যদিও হালকা, তবে দান দেওয়ার সময় খেলোয়াড়কে দু’হাতে
তুলে গুটিগুলো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে হয়। দেখতে ভালোই লাগছিল,
কিন্তু হাতে সময় কম। অগত্যা
এগিয়ে গেলাম দ্বীপের পূর্ব পাড়ে। এখানে রয়েছে ‘ইস্টার্ন অ্যাপ্রন পার্ক’। সামনে কোনও বাধা না থাকায় সিডনী
হারবারের সুন্দর দৃশ্য এখান থেকে উপভোগ করা যায়। এখানে আছে একটা বাস্কেট বল কোর্ট।
দূরে বাস্কেট বল কোর্টের আরও দক্ষিণে দেখা যায় পুরোনো জাহাজ কারখানার অংশ।
সেগুলিতেও আলাদা করে গাইডেড ট্যুর হয়। কাকাতু দ্বীপের আপার আইল্যান্ডের পূর্ব দিকের
পাথুরে দেওয়ালে কোনও গাছ গাছালি নেই, বরং পাথর কেটে এই প্রান্তের দেওয়াল বেশ
খাড়াই। এদিকেই ‘ডগ লেগ টানেল’-এর প্রবেশ পথ। এগিয়ে গেলাম সেই দিকে।
টানেলটা
বাঁকানো হওয়ায় দ্বীপের দক্ষিণে এর খোলা মুখ দেখা যায় না। ভিতরে আলোর ব্যবস্থা আছে।
নতুনকে চেনার আনন্দে এগিয়ে চললাম। টানেলের মধ্যে এক জায়গায় একটা সাদা স্ক্রিন
লাগিয়ে কাকাতু দ্বীপের উপর তথ্যচিত্র দেখানো হয়। টানেল পেরিয়ে চলে এলাম দক্ষিণ
প্রান্তে। এখানেই আছে ফিৎজরয় ডক এবং সাদারল্যান্ড ডক। টানেলের মুখ থেকে বেরিয়েই
চোখে পড়ল আপার আইল্যান্ডে যাওয়ার সিঁড়ি।
‘ফিৎজরয় ডক’ |
পরিশ্রান্ত
ছিলাম, তবু উঠে গেলাম সিঁড়ি বেয়ে।
ইতিহাসকে জানার নেশা যে বড়ো সাংঘাতিক নেশা। পাথরের গায়ের ফাটল দিয়ে চুইয়ে পড়ছে
জল, আর তাতেই সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ বড্ড পিছল হয়ে গিয়েছে। সাবধানে উঠে গেলাম উপরে।
কাকাতু
দ্বীপের উপরের অংশ থেকে নীচে তাকালে ফিৎজরয় ডক এবং সাদারল্যান্ড ডক-কে আরও ভালো
ভাবে দেখা যায়। এই দুটো ডককে বলা চলে কাকাতু দ্বীপের হৃদয়। বিশেষত ফিৎজরয় ডককে
দেখলে কল্পনা করা কঠিন যে দেড় শতাব্দী আগে কিছু ছেনি হাতুড়ি আর কিছু বন্দির
অকল্পনীয় পরিশ্রম মিলে তার সৃষ্টি হয়েছিল।
কাকাতু
দ্বীপের এই উপরের অংশকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়। পূর্ব অংশ - যেখানে আধিকারিকরা থাকত, মাঝে কিছুটা অংশ জাহাজের যন্ত্রাদির কারখানা ছিল (যা
পরবর্তীকালে মেয়েদের শিল্প শিক্ষার স্কুল হিসাবেও ব্যবহার হয়) আর পশ্চিম অংশ যেখানে বন্দিদের জন্য কুঠুরি আর মিলিটারি গার্ডদের ব্যারাক ছিল।
প্রথমে
কারখানার মধ্যে উঁকি দিলাম।
বিশেষ কিছু নেই। পুরোটাই
ফাঁকা। যন্ত্রাদি
যা ছিল বিক্রি হয়ে গেছে। গাইড
না থাকলে এখানে অসুবিধা, কারণ ইতিহাসের গল্প ছাড়া এখানে অবশিষ্ট কিছু
নেই। কারখানার
পাশ দিয়ে চলে এলাম ব্যারাকের মাঝে।
এখানে মাঝে একটা খোলা জায়গা, তাকে ঘিরে রয়েছে অনেকগুলো বেলে পাথরের ঘর। গার্ডদের ঘরগুলো ছিল বড়ো।
বন্দিদের জন্য ছিল ছোটো ছোটো পাথরের খুপরি। বলা বাহুল্য এগুলি সবই বন্দিদের তৈরি। চোখে
পড়ল বেলেপাথরের একটা বড়ো বাড়ি যা অন্যগুলোর থেকে আলাদা। এটা ছিল অপরাধীদের জন্য
কোর্ট হাউস। পরবর্তীকালে এইসব বেলে পাথরের বাড়িগুলোর কিছু অংশে অনাথ মেয়েদের থাকার
ব্যবস্থা করা হয়।
‘কনভিক্ট কোর্ট ইয়ারড’ |
‘কনভিক্ট ব্যারাক’ |
আর
একটু এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল কাকাতু দ্বীপের সম্ভবত সবচেয়ে কুখ্যাত স্থান - ‘সলিটারি
কনফাইনমেন্ট সেল’। কাকাতু দ্বীপের পুরোনো ম্যাপ থেকে জানা যায়, এই দ্বীপে ছিল দুটো
‘কনফাইনমেন্ট সেল’, কিন্তু তার হদিশ কারও জানা ছিল না। অবশেষে ২০০৯ সালে আর্কিটেক্ট
লিবি বেনেট-এর উদ্যোগে শুরু হওয়া খনন কার্যে এই দুটি কক্ষের সন্ধান পাওয়া যায়। এই
প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার ছিল অস্ট্রেলিয়ার ঔপনিবেশিক আমল সংক্রান্ত সবচেয়ে
উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার। এই ‘সলিটারি কনফাইনমেন্ট সেল’–এর অবস্থান ছিল অপরাধীদের
জন্য নির্মিত রান্নাঘরের নীচে। সম্ভবত যখন কাকাতু দ্বীপে অপরাধীদের সাজা দেওয়ার
ব্যাবস্থা হয় তখনই এই কক্ষ দুটি নির্মিত হয়েছিল।
কেমন
ছিল এই কক্ষ দুটি? কক্ষগুলো ছিল প্রায় আলো-বাতাসহীন স্যাঁতস্যাঁতে ঠাণ্ডা আর সঙ্গে
ভীষণ অন্ধকার। প্রথম
কক্ষে বাতাস যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল দরজার ফাঁক দিয়ে, আর তার পিছনে অবস্থিত দ্বিতীয়
কক্ষটির বাতাস চলাচল করত কোর্ট হাউসের এক ছোটো ভেন্টিলেটর দিয়ে। কক্ষগুলির প্রতিটা
ছিল আড়াই মিটার লম্বা, প্রায় দেড় মিটার চওড়া আর দুই মিটার উঁচু। বোঝাই যাচ্ছে একজন মানুষের পক্ষে
অপর্যাপ্ত স্থান ছিল সে কক্ষগুলিতে। সাধারণত সাজাপ্রাপ্ত কোনও অপরাধী যদি আবার কোনও
গুরুতর অপরাধ করত তখন তাদের ঠাঁই হত এখানে। কাকাতু দ্বীপের জেলখানা বন্ধ হওয়ার পর
এই কক্ষদুটিও বন্ধ করা হয়। অবশেষে ১৮৯০ সালের আশেপাশে এটিকে বুজিয়ে ফেলা হয়।
‘সলিটারি কনফাইনমেন্ট সেল’ |
এগিয়ে
গেলাম যেদিকে আধিকারিকদের বাড়িগুলো ছিল। এটা দ্বীপের উচ্চ অংশের পূর্ব ভাগে
অবস্থিত। হেরিটেজ তকমাযুক্ত এই বাড়িগুলো সিডনী-র ঔপনিবেশিক যুগের স্থাপত্য রীতির
উদাহরণ। দ্বীপের এই অংশটি মনোরম। বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তা গাছগাছালির
ছাওয়ায় ঘেরা, সঙ্গে পথের ধারে বসার জায়গা আছে। এখান থেকে দ্বীপের নীচের অংশে
ক্যাম্পিং গ্রাঊন্ড আর দূরে সিডনী হারবারের অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
কাকাতু দ্বীপ থেকে সিডনী হারবার |
কাকাতু দ্বীপের ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড |
আমার
কাকাতু দ্বীপে ভ্রমণ এখানেই শেষ হল। তবে শেষ করার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
জানানো আমার কর্তব্য। এক, কাকাতু দ্বীপের যে ইতিহাস আমি বলেছি তা হয়তো আসল
ইতিহাসের সংক্ষিপ্তসার, কিন্তু তার থেকেই কিছুটা বোঝা যায় যে এই দ্বীপ
অস্ট্রেলিয়ার ঔপনিবেশিক ইতিহাস, সামরিক ইতিহাস এবং অর্থনৈতিক ইতিহাসের প্রবহমান
ধারার সাক্ষী। আর তারই স্বীকৃতিস্বরূপ ইউনেস্কো ২০১০ সালে তাঁদের চৌত্রিশতম
অধিবেশনে অস্ট্রেলিয়ার আরও দশটি জায়গার সঙ্গে এটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা
করে।
দুই,
কাকাতু দ্বীপ শুধু পর্যটকদের আকর্ষণ করে তাই নয়, বেশ কিছু বিখ্যাত হলিউড সিনেমার
শুটিং এখানে হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২০০৮ সালে তৈরি হলিউড তারকা হিউ
জ্যাকম্যানের ‘এক্স-মেন অরিজিনসঃ উলভারিন’ এবং ২০১৪ সালে তৈরি আঞ্জেলিনা জোলি-র ‘আনব্রোকেন’।
তিন,
এই তথ্যটা খাদ্যপ্রিয় বাঙালির জন্য। কাকাতু দ্বীপে নিজেরা বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে
গিয়ে পিকনিক যেমন করা যায় তেমনই প্রয়োজনে খাবার কিনে খাওয়ারও ব্যবস্থা আছে। এই
দ্বীপে দুটি রেস্তোরাঁ আছে। প্রথমটি দ্বীপের উত্তরে ‘ভিজিটর সেন্টারের’ কাছে, নাম
‘সোসিয়েট ওভারবোর্ড’। এখানে
জলখাবার ও দুপুরের খাবার পাওয়া যায়। দ্বিতীয়টি ‘মেরিনা ক্যাফে এন্ড বার’ যা ‘ফিৎজরয়
ডক’-এর পাশে অবস্থিত।
ফিরে
এলাম ‘ভিজিটর সেন্টারের কাছে’ যেখানে দলের বাকিরা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। এবার ফিরে
যাওয়ার পালা। দূরে দেখতে পাচ্ছি প্যারামাটা নদী দিয়ে এগিয়ে আসছে পরবর্তী
‘রিভারক্যাট’। ফেরিঘাটে
পৌঁছোতে তার বড়োজোর আর মিনিট পাঁচেক লাগবে। অর্থাৎ বিদায়লগ্ন উপস্থিত। মন আরও কিছু
সময় কাটাতে চাইলেও হাত-পা বাঁধা। যেতেই হবে। অথচ কী আশ্চর্য, যখন এসেছিলাম তখন
ভাবছিলাম কী হবে এখানে এসে, আর এখন ভাবছি কেন এত তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হবে। এখানেই
হয়তো কাকাতু দ্বীপের বিশেষত্ব। শেষবারের মতো ভালো করে দেখে নিলাম অস্ট্রেলিয়ার
অন্যতম ঘটনাবহুল ইতিহাসের সাক্ষী কাকাতু দ্বীপকে। যার প্রতিটা পাথর ইতিহাসের গল্প
বলে, তাকে নিঃশব্দে কথা দিলাম যে ভাগ্যে থাকলে আবার আসব ফিরে।
_________________
তথ্য
সূত্রঃ
১।
নিজস্ব ভ্রমণ অভিজ্ঞতা
২।
কাকাতু দ্বীপের অফিসিয়াল ওয়েব পেজ
৩।
‘সিডনী হারবার ট্রাস্ট’-এর অফিসিয়াল ওয়েব পেজ
৪। কাকাতু দ্বীপের ‘সেলফ গাইডেড
ট্যুর’-এর ম্যাপ
৫। কাকাতু দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে পর্যটকদের
সুবিধার্থে রাখা তথ্যাবলি, যা ‘সেলফ গাইডেড ট্যুর’ এবং ‘অডিও গাইডেড ট্যুর’-এর অংশ
৬।
উইকিপিডিয়াতে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য
৭।
বিভিন্ন ট্র্যাভেল ব্লগ
_____
ছবিঃ লেখক
No comments:
Post a Comment