লালদিঘি, ১৮৭৮ |
লালদিঘির লালবাজার
চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়
গ্রাম কলকাতা তখনও খানা, ডোবা, গভীর বন-এর আড়ালে ডুবে আছে। সুন্দরবন
বিস্তৃত আজকের ঝাঁ চকচকে ধর্মতলা অবধি। এই গ্রামে
তখন মৃতদের ভরসা শেয়াল আর শকুন। জীবিতদের
ভরসা দারিদ্র্য। খাদ্যের বিচার নেই, ভালোমন্দের বোধ নেই। ধোঁয়া
হচ্ছে মশা তাড়ানোর ওষুধ। তার ওপর নিত্য
চুরি, ডাকাতি। ধীরে
ধীরে ব্রিটিশদের ছায়া পড়ল গঙ্গার জলে। একটা ছোটোখাটো
দুর্গও তৈরি হল। ব্যাবসা বাণিজ্য বাড়তে লাগল। কিছু
কিছু হোগলা পাতায় ছাওয়া ঘর তৈরি হল। কিছুটা করে বন কেটে মানুষের বসবাস শুরু হল।
অবশ্য তখন লালদিঘির পাড়ে শেঠ আর বসাকদের রমরমিয়ে ব্যাবসা চলছে।
১৭৫৬। নবাব সিরাজদৌল্লা এলেন
কলকাতা অভিযানে। গুঁড়িয়ে দিলেন ইংরেজদের তৈরি কেল্লা। কলকাতা বিজয় সেরে ফিরে যেতে
না যেতেই এক বছরের ভেতর ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল। পলাশীর প্রান্তরে সিরাজদৌল্লার
পরাজয় সূচিত করল বঙ্গে এক নতুন অধ্যায়ের। রবার্ট ক্লাইভ প্রথমেই যে কাজটা করলেন সেটা
হল, সিরাজের আক্রমণের ভয়ে যে সমস্ত মানুষজন কলকাতা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল,
তাদের ফেরাতে লাগলেন। কারণ প্রজা না থাকলে রাজ্য শাসন কীভাবে হবে! দ্বিতীয়ত,
ক্লাইভ এখানে বসবাসকারী নেটিভদের সঙ্গে একটা যোগসূত্র তৈরি করতে উদ্যোগ নিলেন আর
সবচেয়ে দ্রুত যেটা করলেন সেটা হচ্ছে, গ্রাম কলকাতাকে আস্তে আস্তে শহর কলকাতা করে
তোলবার প্রয়াস নিলেন। মূলত লালদিঘিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে লাগল নতুন হোয়াইট টাউন।
ওই লালদিঘির পাশে একটা ছোট্ট
পুকুর ছিল। তারই পাড়ে ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কালিকোপ্রিন্টারদের কোয়ার্টার।
১৭৭৬ সালে টমাস লানস কেরানিদের থাকার জন্য উনিশটা পৃথক অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করেন
রাইটার্স বিল্ডিং নাম দিয়ে। তার পাশেই ছিল পাদরি বেলামি সাহেবের বাড়ি। আরও একটু
এগোলে কোম্পানির আস্তাবল। আস্তাবলের গায়েই লাগোয়া হাসপাতাল। আর হাসপাতালের পরই ছিল
বারুদঘর। তারপরেই গোরস্থান। এটাই হোয়াইট টাউনের শেষ সীমা। লালদিঘির পশ্চিমে দুটি
রাস্তা চলে গেছে, ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট আর কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট। ওখানেই ছিল হলওয়েল
সাহেবের বাড়ি। এখন যেখানে সেণ্ট অ্যাণ্ড্রুজ গির্জা, তার সামনের রাস্তাটা তৈরি হয়
১৭৭১ সালে ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট নাম দিয়ে। আর ১৭৫৮ সাল নাগাদ তারই পাশের
রাস্তাটার নাম ছিল কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট। সেখানে একটি বিশেষ মন্ত্রণাগ্রহ ছিল
যেটা ১৮০০ সালে ভেঙে ফেলা হয়। লালদিঘির একটু উত্তর-পূর্ব কোণ চেপে তৈরি লন্ডনের
বিখ্যাত সেন্ট মার্টিন-ইন-দ্য-ফিল্ড চার্চের অনুকরণে সেন্ট জনস চার্চ। এরই পেছনে
ছিল পর্তুগিজ আর আর্মেনিয়ান টোলা।
ওদিকে লালদিঘির সামনের থেকে
একটা রাস্তা সোজা পূর্বদিকে চলে গেছে। সাহেবদের ভাষায় অ্যাভেনিউ টু ইংলন্ড।
রাস্তাটি গিয়ে মিশেছে বউবাজার বা বৈঠকখানা বাজারে। সেকালের নামকরা বেনিয়ান
বিশ্বনাথ মতিলাল তাঁর এক ছেলের বউয়ের জন্য কিনে দেন ওই বাজারটি। সেই থেকে নাম বউবাজার।
আর এই রাস্তার ওপরেই লালদিঘি থেকে মাত্র কয়েক পা হাঁটলেই বিখ্যাত লালবাজার।
আসলে লালদিঘি আর লালবাজার এই
দুটো নাম নিয়েই বিতর্কের শেষ নেই। ইতিহাস যেমন বলে যে অধুনা মেটকাফে হল ছিল শেঠদের
বাড়ি, তাদের বাড়ির বউদের দোলের দিনের আবির খেলায় লাল হয়ে যেত দিঘির জল, সেই থেকে
নাম লালদিঘি। মতান্তরে কেউ বলেন কলকাতা গ্রামের জমিদার বেহালার সাবর্ণ চৌধুরীদের কাছারি বাড়ি ছিল ওখানে। তাদের বাড়ির
বউরা নাকি দোলের দিন দিঘির জলে স্নান করতেন। কিন্তু সে সময়ে যখন যানবাহনের কোনও
সামান্যতম সুবিধে ছিল না, সে সময় বেহালা অঞ্চল থেকে লালদিঘিতে বাড়ির বউরা এসে
দোলের দিন আবির খেলে স্নান করতেন এই যুক্তি কতটা গ্রহণযোগ্য, ইতিহাস সে বিষয়ে
নীরব। এই দোল পূর্ণিমায় সাবর্ণ চৌধুরীদের বিখ্যাত শ্যামরায়ের মন্দিরে দোল উৎসবে
ছড়ানো হত আবির আর ফাগ। কাছেই বসত মেলা আর বাজার। তাই থেকে নাম লালবাজার। মতান্তরে
অনেকগুলি তথ্য আছে। লালদিঘির কাছে শেঠদের বাড়ির ঠাকুর রাধাকৃষ্ণের নামে দুটো
বাজারও আছে। একটু উত্তর দিকে গেলে রাধাবাজার। দোল উৎসবের মাতন সেখানেও ছিল। লালদিঘির
উলটোদিকে মিশন রো-তে একটি খুব পুরোনো চার্চ ছিল, ওল্ড মিশন চার্চ (সিরাজের আক্রমণে
এটিও গুঁড়িয়ে যায়)। গির্জার টকটকে লাল রংয়ের ছায়া পড়ত দিঘির জলে। সেই থেকে নাকি
লালদিঘি ও লালবাজার। এমনও শোনা যায় ইংরেজ কোম্পানির প্রথম কেল্লার রঙও ছিল লাল।
সেই লালের ছায়া পড়ত ওই জলে। কলকাতাবিদ শ্রীপান্থ লিখেছেন – ‘ইতিহাসে অনুল্লেখিত
তৃতীয় জন যার নাম পালকিওয়ালা। সোয়ারি সাহেবরা ছিলেন ওদের কাছে লাল মানুষ বা রাঙা
মানুষ। সুতরাং তারা যখন লাল, তখন তাদের হাট কি কখনও নীলবাজার হয়!’ আবার শেষোক্ত মত
জানা যায় যে কলকাতার এক বাসিন্দা লালমোহন বসাক নাকি ওই দিঘি খনন করিয়েছিলেন। তাই তাঁর
নামে দিঘি আর বাজার।
লাল গির্জা (ওল্ড মিশন চার্চ), পুরনো ফোর্ট উইলিয়ম কেল্লা, কলকাতা, ১৭৭৪ |
নামের উৎপত্তি যাই হোক,
লালবাজার সে সময়ের সবচেয়ে ব্যস্ত অঞ্চল ছিল। এই লালবাজারেই গড়ে উঠেছিল কলকাতার
প্রথম জেলখানা, ‘মেয়র’স কোর্ট’। হেড কনস্টেবল
মাইকেল গ্রেস-এর লালবাজার। কলকাতার প্রথম লাল পাগড়ি। সাল ১৭৮৫।
এই লালবাজারের পুলিশ হেড
কোয়ার্টার গড়ে ওঠার আগে একটু তাকিয়ে দেখা যাক অতীতে। ৬ই
ফেব্রুয়ারি ১৭০৪। পুরোনো কেল্লায় ইংরেজদের একটি মিটিং-এ
সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে এই গ্রামটিতে চুরি ডাকাতি বন্ধ করার জন্য একটি দল গঠন করা
হবে। এক জন হেড পিওনের অধীনে থাকবে পয়ঁতাল্লিশ জন পিওন, দু’জন সুবেদার ও কুড়ি জন
গোয়ালা। এক বছরের ভেতরেই হেড পিওনের পদ বদলে হল কোতোয়াল আর পিওনরা হল পাইক, যারা
বল্লম হাতে সশস্ত্র থাকবে। ১৭২০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি র্যালফ শেলডনকে
কলকাতার প্রথম জমিনদার হিসেবে নিয়োগ করে। এই জমিনদারদের কাজ ছিল নগর ও ফৌজদারী - দুটি
বিভাগের দেখভাল করা। পরবর্তীতে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে থেকে ডেপুটি জমিনদার নিয়োগ
করা হয়। প্রথম ব্ল্যাক জমিনদার হলেন নন্দরাম সেন ও দ্বিতীয় জন গোবিন্দরাম মিত্র।
পরবর্তীতে তিন জন দেওয়ান পদের সৃষ্টি করা হয়। এক জন
রাস্তার ও পুকুরগুলির দেখভাল করবে, অন্য জন খাজনা আদায় করবে, তৃতীয় জন পুলিশের কাজ
দেখবে। ১৭২০-তে জমিনদারদের কাছাড়ি, নগর পুলিশি ব্যবস্থা-সহ উঠে এল নর্টন বিল্ডিং-এ।
অধুনা টোবাকো হাউস, ২৩নং লালবাজার স্ট্রিটে।
রবার্ট ক্লাইভের অধরা কাজ শেষ
করতে উদ্যোগী হলেন পরবর্তী স্যার ওয়ারেন হেস্টিংস। এই ওয়ারেন হেস্টিংসের বিশিষ্ট
বন্ধু ছিলেন জন পামার নামের এক বিশিষ্ট ধনী ইংরাজ। কিন্তু অপরিমিত জীবন যাপনে তার
আর্থিক সংকটের সময়ে বন্ধু ওয়ারেন হেস্টিংস কিনে নেন তাঁর বাড়িটি এবং স্থায়ীভাবে
সেই বাড়িটিতেই গড়ে ওঠে পুলিশের হেড কোয়ার্টার। এই বাড়িটি আদতে ছিল জন প্রিন্সেপ-এর।
তিনি চার্লস ক্রোমেলিন নামে এক ব্যবসায়ীকে সেটি বিক্রি করে দেন। ক্রোমেলিনও চার্লস
ওয়েসটনকে বাড়িটি বিক্রি করেন। সেখান থেকে বাড়িটির মালিক হন জন পামার। ১৭৮৫ সালে সেই
লালবাজারে প্রথম হেড কনস্টেবল হয়ে আসেন মাইকেল গ্রেস। শ্রীপান্থর বিবরণে জানা যায়,
গ্রেস সাহেবের লালবাজার যে-কলকাতার পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স তার লোকসংখ্যা ছিল চার
লক্ষের ওপর। কিন্তু লাল পাগড়ি ছিল মাত্র চারজন। মাইকেল ফ্ল্যাডিন, টমাস সিম্পসন ও জন
রূপ। এরা কনস্টেবল। গ্রেগ হেড কনস্টেবল। তাঁদের ওপরওয়ালা হলেন কলকাতার শেরিফ।
পামার-এর বাড়ির উলটো দিকেই
ছিল সাবেক কয়েদখানা। লম্বায় একশো ফুট আর চওড়ায় চল্লিশ ফুট একখানা বাড়ি। ভিতরে ছিল
পুকুর। কয়েদিরা সেখানেই কাপড় কাচত, স্নান করত। গরমের দিনে পুকুরের ধারে সাহেব
কয়েদিরা নিজেদের খরচায় সারি সারি ছাউনি তুলত। লালবাজারের কয়েদখানায় একটা অসুবিধে
ছিল, মেয়ে আর পুরুষের জন্য এখানে স্বতন্ত্র কোনও ব্যবস্থা ছিল না। ১৭৮৩ সালে
বেঙ্গল গেজেটের বিখ্যাত সম্পাদক জেমস অগাস্টাস হিকিকেও এই কয়েদখানায় বন্দি জীবন
যাপন করতে হয়েছে। এছাড়া আরও দুটি কয়েদখানা ছিল তখনকার কলকাতায়। একটি উত্তর
কলকাতায়, হরিণবাড়ি আর দ্বিতীয়টি বিরজি কয়েদ, এখন যেখানে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।
১৮৫৬ সালের ১লা নভেম্বর চিফ
ম্যাজিস্ট্রেট এস ওয়াওচোপ হলেন কলকাতার প্রথম পুলিশ কমিশনার। তাঁর আগে যারা ছিলেন
তাঁরা সব সুপারিটেন্ডেন্ট। তারও আগে হেড কনস্টেবল। লালবাজারের এই অঞ্চলটি কলকাতার
অতীতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসগুলোকে বুকে আঁকড়ে ধরে আছে। ভাবা যায়, এই
লালবাজারেই ১৭৮০ সালে গড়ে ওঠে কলকাতার সবচেয়ে সেরা ট্যাভার্ন। লন্ডন ট্যাভার্ন।
অনেকে এটাকে হারমনিক ট্যাভার্নও বলত। তৎকালীন কলকাতার সবচেয়ে এলিট মানুষরা এখানে
আসতেন। মজলিস হত। এমনকি স্বয়ং মিসেস ওয়ারেন হেস্টিংস সেখানকার একজন পেট্রন ছিলেন। ১৭৮৫
সালের জানুয়ারি মাসে এই লন্ডন ট্যাভার্নেই স্যার ওয়ারেন হেস্টিংসকে তাঁর
বিদায়কালীন ‘address of Thanks’ প্রদান করেন সেকালের
কলকাতার মহামান্য নাগরিকরা। পরতে পরতে ইতিহাসের সাক্ষী আজও তার স্বমহিমায় দৃপ্ত।
লালদিঘি, ছবিঃ জেমস বেইলি ফ্রেজার, ১৮২৬ |
_____
Very very interesting
ReplyDeleteনন্দরাম সেন "ব্ল্যাক জমিন্দার" ছিলেন না, তিনি দু'দফায় 'কলকাতার রাজস্ব আদায়কারী' বা Receiver of Calcutta Revenues-এর সহকারী অর্থাৎ "ব্ল্যাক ডেপুটি" লেন। ১৭১৭ সালে ৯ম মোগল সম্রাট ফররুখসিয়ারের ফরমান পাওয়ার পর ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী ১৭২০ সালে 'কলকাতার রাজস্ব আদায়কারী' পদটার নতুন নামকরণ করে "জমিন্দার" বা জমিদার বলে। ততদিনে নন্দরাম তাঁর "ব্ল্যাক ডেপুটি" হিসাবে করা কুকর্মের জন্য হাজতবাস করছেন। গোবিন্দরাম মিত্রই ছিলেন প্রথম এবং সম্ভবত একমাত্র কলকাতার মাস মাইনের চাকরি করা "জমিন্দার"দের সহকারী এবং তাঁর সবার উপর ছড়ি ঘোরানোর স্বভাবের জন্য "ব্ল্যাক জমিন্দার" হিসাবে পরিচিত হন।
ReplyDelete"১৭২০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি র্যালফ শেলডনকে কলকাতার প্রথম জমিনদার হিসেবে নিয়োগ করে" উক্তিটি ভুল। শেলডন ১৭০৫ সালে প্রথম 'কলকাতার রাজস্ব আদায়কারী' বা Receiver of Calcutta Revenues ছিলেন।
ReplyDelete