সুপারহিরো:: জয়গড়ের বাহাদুর - রাখী আঢ্য

   

জয়গড়ের বাহাদুর
রাখী আঢ্য

বিশ্বসাহিত্যে কমিকস-এর জন্ম বলতে মোটামুটি ১৯২০-র দশককেই ধরা হয় কমিকসের হাত ধরে সুপারহিরোদের জন্ম তো আরও পরে কিন্তু আজ তোমাদের যে ভদ্রলোকের, থুড়ি সুপারহিরোর গল্প বলতে চলেছি তিনি বাঙালি না হলেও আপামর বাঙালির কাছে একজন আদ্যোপান্ত ঘরের ছেলে, যার নানা কীর্তিকাহিনি মিশে আছে আমাদের প্রায় প্রত্যেকেরই ছোটোবেলার বইয়ের ফাঁকে, একাকী দুপুরে বা রোমাঞ্চকর স্বপ্নে
সময়টা মার্চ ১৯৬৪ বিখ্যাত পাবলিশার্স গ্রুপ ‘দি টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ এবং ‘বেনেট, কোলম্যান এন্ড কোং’ বাজারে নিয়ে এলেন এক নতুন সিরিজ 'ইন্দ্রজাল কমিকস' ঝকঝকে ছাপা, রোমাঞ্চকর গল্প, পরিচ্ছন্ন ড্রয়িং এসবের মেলবন্ধন এক নিমেষে মন কেড়ে নিল আপামর ভারতীয় পাঠককুলের ইন্দ্রজাল কমিকস প্রথম ৩২টি সংখ্যা ছিল শুধুমাত্র ফ্যান্টম বা বেতালের গল্প নিয়ে তারপর আস্তে আস্তে বইয়ের পাতায় উঠে আসতে থাকে জাদুকর ম্যানড্রেক, ফ্ল্যাশ গর্ডন বা বাজ সয়ার-এর মতো কমিক সুপারহিরো চরিত্রগুলি আর বাংলা ভাষায় ইন্দ্রজাল কমিকস-এর প্রথম আগমন জানুয়ারি ১৯৬৬-তে
সবই ঠিক ছিল কিন্তু ধীরে ধীরে কোথায় যেন তাল কাটছিল ফ্যান্টম, ম্যানড্রেক, টারজান এরা সবাই সুপারহিরো, কিন্তু ওই যে ঘরোয়া ঘরোয়া গন্ধ সেটাই যেন পাওয়া যাচ্ছিল না টাইমস গ্রুপ-এর বিখ্যাত কার্টুনিস্ট ও ইন্দ্রজাল কমিকস-এর অন্যতম রূপকার আবিদ সূর্তীর কাছে প্রস্তাব গেল এমন এক সুপারহিরো সৃষ্টির যে কিনা হবে আপাদমস্তক ভারতীয় সময়টা ডিসেম্বর, ১৯৭৬ আমেরিকায় তখন তৈরি হয়েছে বাহাদুর ফ্যান ক্লাব নামে এক প্রবল জনপ্রিয় সুপারহিরো ফ্যান ক্লাব অন্যদিকে কিছুদিন আগেই ভারতে মুক্তি পেয়েছে 'শোলে' সিনেমাটি তাকে নিয়ে উন্মাদনা তখন চরমে অমিতাভ বচ্চনের ৬ ফুটিয়া অ্যাংরি ইয়ং ম্যান ইমেজ তখন সমস্ত ভারতীয় কিশোর তথা যুব সমাজের কাছে একটা আইকনের মতো মধ্যপ্রদেশের চম্বল তথা সেখানকার ডাকাতদের গল্প তখন লোকের মুখে মুখে ফিরছে আর এইসবেরই মেল বন্ধনে আবিদ তথা ইন্দ্রজাল কমিকস বাজারে নিয়ে এলেন গেরুয়া পাঞ্জাবি আর ব্লু জিনস-এ, মার্শাল আর্টে পারদর্শী আর ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুলওয়ালা এক আপাদমস্তক সুঠাম ভারতীয় সুপারহিরোকে - 'বাহাদুর - দ্য ব্রেভ ম্যান' ইন্দ্রজাল কমিকস-এর নতুন সংখ্যা 'লাল ইটের বাড়ি'- (#২৬৭) হাত ধরে ১৯৭৬ থেকে ১৯৯০-এর মধ্যে বাহাদুর-এর মোট ৭৫টি কমিকস প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে প্রথম ১২টি মিঃ সূর্তী লিখেছিলেন ও শেষ ৬৩টি মিঃ  জগজিৎ উপল কমিকসগুলি ইলাস্ট্রেট করেন গোবিন্দ ব্রাহ্মণানিয়া ও পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র প্রমোদ ব্রাহ্মণানিয়া
'আমি বাহাদুরকে একদম ভারতীয় সুপার হিরো বানাতে চেয়েছিলাম,’ মিঃ সূর্তী পরবর্তীকালে এক ইন্টারভিউতে বাহাদুর ও তার পোশাক সম্পর্কে চর্চা করতে গিয়ে বলেছিলেন, 'তাই বাহাদুরের গেরুয়া পাঞ্জাবি যা ভারতীয়ত্বের প্রতীক নীল জিনস পাশ্চাত্য ঘরানার পোশাক হলেও ভারতীয় সমাজের অগ্রগতির পরিচয় বহন করে'

 

বাহাদুরের জন্মের প্রেক্ষাপট রচনা হয়েছিল তৎকালীন কুখ্যাত চম্বল এবং সেখানকার ডাকাত দলকে ঘিরে 'লাল ইটের বাড়ি' থেকে জানা যায় বাহাদুর হল চম্বলের তৎকালীন কুখ্যাত ডাকাত ভৈরব সিং-এর পুত্র বাহাদুর-এর মাতৃ পরিচয় জানা যায় না ডাকাত ভৈরব সিং-কে মারার পর পুলিশ চিফ বিশাল কিশোর এবং অনাথ বাহাদুরকে নিজের কাছে রেখে মানুষ করেন কিশোর বাহাদুর প্রতিজ্ঞা করে যে সে তার বাবার মৃত্যুর বদলা নেবে, কিন্তু পরবর্তীকালে বিশালের পিতৃস্নেহ ও ভরণপোষণ বাহাদুরকে ফিরিয়ে আনে অন্ধকার থেকে আলোর পথে জন্ম হয় ছোট্ট শহর জয়গড়ের রক্ষাকর্তা এক সুপারহিরোর পরবর্তীকালে আমরা দেখি বাহাদুর তার বাবার সঞ্চিত গুপ্তধন তিনটি পর্যায়ে উদ্ধার করে মানুষের কাজে লাগায় এই অভিযানগুলির নাম 'জয় গড়ের গুপ্তধন' (V ২১, #১১), 'বাহাদুর ও অদৃশ্য রক্ষাকারী' এবং 'মরুভূমির বিভীষিকা' (V ২১, #৪১)
বাহাদুর সিরিজের চতুর্থ গল্প 'সাদা ভূতের আড্ডা' (#২৮৪)-তে আমরা প্রথম পাই বাহাদুরের বান্ধবী বেলাকে তন্বী, সুশ্রী, মার্শাল আর্টে পারদর্শী বেলা পিপলীর শেঠ শিবরামের পুত্রী শিবরামকে বাহাদুর ডাকাতের হাত থেকে বাঁচানোর সময় সেই যে বেলার সঙ্গে বাহাদুরের বন্ধুত্ব হয়েছিল, সে বন্ধুত্ব অটুট থাকে বাহাদুর সিরিজের শেষ গল্প 'সাপুড়ের টোপ' (V ২৯, #) (১৯৯০) পর্যন্ত 'সাপুড়ের টোপ' গল্পে শেষ পর্যন্ত বাহাদুর জীবনসঙ্গিনী রূপে বেছে নেয় বেলাকেই



বাহাদুরের বহু অভিযানই জয়গড় এবং তার পারিপার্শ্বিক-কে ঘিরে অবশ্য গল্পের প্রয়োজনে বাহাদুর কখনও গিয়েছে জঙ্গল, কখনও পাহাড়, কখনও বা মরুভূমিতে মুম্বাই থেকে শিখে এসেছে কুংফু একদিকে ক্যারাটে, অন্যদিকে কুংফু - এই দুইয়ের মিশেলে একসময় বাহাদুর অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল অবশ্য মাঝে মাঝে ইচ্ছা করেই হার স্বীকার করেছে পরিস্থিতির প্রয়োজনে এবং বৃহত্তর জয়ের খাতিরে, আর এইখানেই বাহাদুরের গল্পের বাস্তবতা 'নিয়তির অভিশাপ' (V ২৪, #১১) অভিযানে বাহাদুর মোকাবিলা করে সত্যি ভূতের
কিশোর জীবন অতিক্রম করার পরে পরেই দুষ্টের দমনের জন্য নিজেকে পূর্ণরূপে নিয়োজিত করে বাহাদুর জয়গড়ে গড়ে তোলে নাগরিক সুরক্ষা দল (Citizen Security Force) শুধু দমনকার্যই নয়, অপরাধীকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার কাজটাও সমানভাবে করেছে এই সিএসএফ বাহাদুর সিরিজের আর এক বর্ণময় চরিত্র এবং বাহাদুরের বিশ্বস্ত অনুচর লাখান একসময় ডাকাত সর্দার ছিল পরবর্তীকালে সে পুলিশের হাতে আত্মসমর্পণ করে এবং বাহাদুরের সঙ্গে যোগ দেয় এ ছাড়াও বাহাদুরের গল্পে বারে বারে ফিরে এসেছে পুলিশ কমিশনার বিশাল, গ্রাম প্রধান মুখিয়া এবং বৃদ্ধ সুখিয়া, যে নিজে একসময় কুখ্যাত ডাকাত শয়তান সিং-এর অনুচর ছিল ইন্দ্রজাল কমিকসের অমর সৃষ্টি ফ্যান্টমের বিখ্যাত নেকড়ের মতোই আমরা পাই বাহাদুরের বিশ্বস্ত পাহাড়ি নেকড়ে ছমিয়াকে
কিছুটা গল্পের খাতিরে এবং কিছুটা সময়ের সঙ্গে তাল রাখতেই শেষ দিকে দশ-বারোটি অভিযানে বাহাদুরকে আমরা পেয়েছি আরও আধুনিক রূপে লম্বা চুল কেটে ছোটো হয়, পরিধানে গেরুয়া পাঞ্জাবির পরিবর্তে আসে গেরুয়া রঙের ফুল টি শার্ট এবং নীল জিনস ১৯৯০-এ বাহাদুরের শেষ অভিযান পর্যন্ত তার এই পোশাকই বজায় ছিল
এপ্রিল ১৯৯০ কোনও এক অজ্ঞাত কারণে টাইমস অফ ইন্ডিয়া চিরতরে বন্ধ করে দিল ইন্দ্রজাল কমিকস-এর প্রকাশনা শেষ হল ফ্যান্টম, ম্যানড্রেক, বাহাদুরের মতো কমিকসের জগতের বর্ণময় সুপারহিরোদের মনকাড়া অভিযানগুলি আজ আর বাচ্চারা হয়তো ইন্দ্রজাল কমিকস পড়ে না কিন্তু আমরা যারা মধ্যবয়সি, তাদের ছেলেবেলাটা কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই আটকে আছে স্কুলের বইয়ের ফাঁকে লুকানো ইন্দ্রজাল কমিকসে, যেখানে কেউ নিজেকে ভাবতাম ফ্যান্টম, কেউ ম্যানড্রেক, কেউ বা বাহাদুর, অথবা কেউ বা ডায়না অথবা বেলা
বহু পুরোনো এবং দুষ্প্রাপ্য হওয়ার জন্য বাহাদুরের সব ক’টি অভিযানের নাম জোগাড় করা সম্ভব হল না তবু চেষ্টা করেছি প্রকাশকাল নির্বিশেষে একটা তালিকা বানানোর বাহাদুরের বাকি অভিযানগুলির নাম পাঠকরা অবশ্যই যোগ করতে পারেন -
) লাল ইটের বাড়ি
) কালো মেঘের ছায়া
) মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা
) সাদা ভূতের আড্ডা
) অথৈ জলের গুপ্তধন
) নন্দী নদীর সেতু
) রক্ত লোলুপ নেকড়ে
) জয়গড়ের গুপ্তধন
) নীলগিরির আতঙ্ক
১০) কালো ছায়ার রহস্য
১১) শিকারগড়ের নেকড়ে
১২) লাল পাহাড়ের রহস্য
১৩) বাহাদুর ছেলেধরার দল
১৪) রাজধানী এক্সপ্রেস
১৫) মরু শয়তানের পিছনে
১৬) চম্বলের রাজসিং
১৭) মুন্ডুহীন প্রেত
১৮) সোনালী মিশর
১৯) শয়তানের ছোট্ট সাকরেদ
২০) ড্রাগনের নিঃশ্বাস
২১) আঁধারের অভিশাপ
২২) সবুজ বনের দুঃস্বপ্ন
২৩) মাঝসাগরের বিস্ফোরণ
২৪) কেউটের জিভে বিষ
২৫) গোখরোর ফণা
২৬) পান্থশালায় ঝড়
২৭) মরুভূমির বিভীষিকা
২৮) অপরাজেয় বাহাদুর
২৯) আলোর পথের পথিক
৩০) রক্তে রাঙা অর্জনগড়
৩১) সূর্যোদয়ের পরে
৩২) বীরাঙ্গনার অভিমান
৩৩) নরকের হাতছানি
৩৪) রক্তলোলুপ চিতা
৩৫) নিয়তির অভিশাপ
৩৬) রক্তাক্ত প্রতিশোধ
৩৭) প্রতিহিংসার আগুন
৩৮) উপত্যকার আহ্বান
৩৯) অভিশপ্ত নিঃশ্বাস
৪০) শিকারী নেকড়ে
৪১) পাপের বীজ
৪২) বিষের ধোঁয়া
৪৩) মুখোশধারী রাজকুমারী
৪৪) কালো ছায়ায় হাতছানি
৪৫) গুপ্তধনের অভিশাপ
৪৬) মুখোশের মায়া
৪৭) অপরাধের স্রোত
৪৮) প্রেতাত্মার ক্রোধ
৪৯) বজ্রের কবলে
৫০) শান্তির দূত বাহাদুর
৫১) বাহাদুরের অভিযান
৫২) রক্তঝরা রাত
৫৩) শয়তানের ছোট্ট সাগরেদ
৫৪) সোনালি মিনার
৫৫) চম্বলের রাজসিং
৫৬) কলিঙ্গ তটের কাহিনি
৫৭) অর্জনপুরার হত্যাকান্ড
৫৮) বাহাদুর অদৃশ্য রক্ষাকারী
৫৯) নীল সাগরে দুর্বিপাক
৬০) সাপুড়ের টোপ

 
 
_____
(ছবি সূত্রঃ কিছু ইন্টারনেট, কিছু নিজস্ব সংগ্রহ থেকে)

2 comments:

  1. খুব সুন্দর তথ্যবহুল একটি লেখা হয়েছে। বাহাদুর আমার খুব প্রিয় চরিত্র। বেশ ভালো লাগলো পড়ে। আপনাকে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  2. প্রথম ৩২তি একটু দেখবেন প্লীজ, কেবল বেতাল নয় - আমার কাছে ১১ নম্বর আছে - রত্নদ্বীপ| এছাড়াও ক্লাসিক্স এবং রুপকথা নিয়েও কিছু কিছু সংখ্যা আছে প্রথম দিকে|

    আর বাহাদুরের ড্রেস : পরবর্তিতে গেরুয়া নয়, গোলাপী টি শার্ট এসেছিলো|

    ReplyDelete