ভৌতিক:: চাকর - স্নেহা অধিকারী কর


চাকর
স্নেহা অধিকারী কর

তখন আমি অনেক ছোটো। এই সিক্স কি সেভেন-এ পড়ি। আমাদের বাড়ি ছিল তখন দুর্গাপুরে। বাড়ি বললে ভুল হবে। বাবা ডি ভি সি-তে কর্মরত ছিলেন। সেই সূত্রে আমরা একটা বড়ো বাসা পেয়েছিলাম। বিশাল বড়ো ডি ভি সি’র বাসায় আমরা বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতামমা আমি বাবা ভাই ঠাকুমা।
আমাদের বাড়ির সামনে ও পেছনে ইয়া বড়ো এক বাগান ছিল। আর বাড়ির পেছন দিকটায়, ঠিক বাগানটা যেখানে শেষ হয়েছিল, তারপরেই, কাজের লোকদের থাকবার জায়গা। এই কাজের লোকগুলো ছাড়া আমার মায়ের ও ঠাকুমার একেবারেই চলত না। এত বড়ো বাড়ি, তাকে ঘষা মাজা, রোজ পরিষ্কার করা - এ কি চাট্টিখানি কথা! শুধু বাড়িই বা বলি কেন। বাগান দেখভাল করা, ঠাকুমার হাজার কাজকম্মও তো ছিল। তাই কাজের লোক না থাকলে বেশ অসুবিধেই হত।
রোজ মা হাঁকত, “এই জবার মাআআআআ - আমার রসুনগুলো বেটে দাও”। অথবা, “জবার মা, আমার কাচা জামা-কাপড়গুলো ইস্ত্রি হল না, পড়েই রইল?”
ঠাকুমাও ডাকত, “খেয়ালি রে... ও খেয়ালি, আমার পূজার ফুল কই রে?” আর সন্ধে হলেই খেয়ালিকে দিয়ে পা টেপাত।
কাজের লোক বলতে একটা পরিবার থাকত ঐ পেছন দিকের আউট হাউসে। বুড়ো তপন, তার ছেলে কেজো, ছেলের বউ জবা, নাতি খোকা আর নাতনি খেয়ালি। আমার পিসিই এনে দিয়েছিল এদের। বড্ড ভালো লোক ছিল ওরা। কাজেকর্মে জবা নিপুণকেজো বাগানের দেখভাল করত আর বাবার গাড়ি  ধুয়ে-মুছে সাফ করে দিত রোজ। ঠাকুমা তো খেয়ালি বলতে অজ্ঞান। খেয়ালি ঠাকুমার ভালোই খেয়াল রাখত
তা একবার তপন বুড়ো এসে ছুটি চাইল ঠাকুমার থেকে। দেশের বাড়ি যাবে, মেজো ছেলের মেয়ের বিয়ে। যেতে তো হবেই। ঠাকুমা ছুটি দিল। কয়েকটা দিন একটু অসুবিধে হবে ঠিকই, কিন্তু কী আর করা!
ঠিকে কাজের লোক খোঁজা শুরু হয়ে গেল। এত সহজে কি আর পাওয়া যায়! কারুর তো এত্ত পয়সার খাই যে ঠাকুমা বলল, “দূর দূর...। এর চেয়ে বউমা নিজেই করে নাও কয়েকটা দিনএত টাকার খাই! বাপ রে বাপ!”
এরকমই অবস্থা যখন, তখন একদিন একটা ব্যাপার ঘটল।
ডিসেম্বর-এর শীত। ভালোই ঠাণ্ডা ভাব বাতাসে। দুপুরের দিকটায় মা একটু ঘুমিয়ে গেছিল বারান্দায়। বাইরে সুন্দর রোদ উঠেছে। আমরা খেলছিলাম সামনের বাগানে। ঠাকুমা গেছিল পাশের রতন দিদার বাড়ি আড্ডা দিতে। বাবা অফিসে। নিঝুম দুপুরে দূরে ফেরিওয়ালার ডাক। রাস্তায় তেমন কেউ নেই। কয়েকটা কুকুর ল্যাদ খেয়ে শুয়ে জিরোচ্ছিল
হঠাৎই কোথা থেকে একটা ছোট্ট, বেঁটেখাটো, কালো কুচকুচে চেহারার লোক এসে আমাদের গেটে হাঁক দিল। প্রায় ধড়মড়িয়ে উঠে মা তো গেল বেজায় চটে।
“কে ভাই তুমি? এমন হাঁক-ডাক করছ দুপুরে। কী চাই?” বলল মা।
লোকটা লাজুক লাজুক মুখে, একটু বিনয়ের সুরে একটু থেমে থেমে বলল, “মা আমি ঐ মানে... কাজের খোঁজে। আপনারা লোক খুঁজতিছেন শুনলুম... তাই... তাই আ... আমি... ।”
আমরা বেশ অবাক। কে রে বাবা, চিনি না জানি না। হঠাৎ কাজের খোঁজে এখানেই বা এল কেন? জানল কেমন করে আমাদের লোকের দরকার? একে তো কোনোদিন পাড়ায় দেখিনি!
প্রশ্ন করতেই আবার সেই লাজুক মুখে লোকটা বলল, “ঐ আমাকে পিসিমা পাঠালেন যে - আপনাদের রানি পিসিমণি... বললে গণেশ, ওদের লোক দরকার, তুই যা দিকি... তাই আমি”পিসিমা মানে আমাদের পিসি –রানি পিসি। এই রানি পিসিই আমাদের আগের লোকটাকে জোগাড় করে দিয়েছিল। কিন্তু পিসি জানল কেমন করে আমাদের লোকের দরকার।
তখন কিন্তু এত মোবাইল ফোন-এর চল ছিল না। মা একটু চুপ করে থেকে কী যেন ভাবল। পিসি ক’দিন আগেই আমাদের বাড়ি ঘুরতে এসেছিল তখনই মা হয়তো বলেছিল কাজের লোকের কথা। পিসির অনেক বড়োলোক বাড়িতে বিয়ে হয়েছিল। বিশাল বাড়িতে কাজের লোকের ছড়াছড়ি ছিল তাদের। তাদেরই কাউকে হয়তো পাঠিয়ে দিয়ে থাকবে।
যাই হোক, অনেক ভেবেচিন্তে, ঠাকুমা আসার পর গোলবৈঠক করে সেই কালো কুচকুচে লোকটাকে রাখা হল আমাদের ঠিকে কাজের লোক হিসেবে।

প্রথম প্রথম মা তো ভেবেই পাচ্ছিল না এই ছোটোখাটো, রোগা লোকটা কেমন করে এত বড়ো বাড়ির এতগুলো কাজ সামলাবে! বহুবার তাকে জিজ্ঞেসও করা হল, “ভাই তুমি পারবে তো?”
উত্তরে শুধু লাজুক হেসে লোকটা মাথা নেড়েছিল। কিন্তু তখন কি আর জানতাম আমরা, কপালে কী লেখা আছে!
ক’দিনেই গণেশ নামক লোকটা কাজে পটু হয়ে গেল। মা যা বলে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কি জাদু মন্ত্রবলে নিমেষেই করে ফেলে সে। মা তো খুবই খুশি। ঠাকুমার পান সেজে রাখা থেকে ঠাকুরের ফুল তোলা, গরম জল করা থেকে বাগানের ফুলে জল দেওয়া, সবই সে নিমেষে শেষ করে। গোটা বাড়িটা কী সুন্দর গোছগাছ করে রাখে সব কিছু, ধুয়েমুছে এক্কেবারে ঝকঝকে তকতকে করে রাখে সে।
প্রথম প্রথম সন্দেহ হয়নি। কিন্তু ধীরে ধীরে কেমন যেন মনে হতে লাগল।
মা ঠাকুমা প্রায়ই বলাবলি করত। কী’করে ও সব কাজ নিমেষে করে ফেলে? অথচ একটুও হাঁপায় না? সন্দেহ দানা বাঁধল একটি খুব আশ্চর্য ব্যাপারে
আমার জন্মদিন ছিল সেদিন। জানুয়ারি মাস। প্রবল ঠাণ্ডায় হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি লেগে যায়। সেদিন সকাল থেকেই অনেক কাজ, মা প্রায় পাগল পাগল। দুপুরের পর লোকজন আসবে। খুবই অল্প লোকজন, তবুও তাদের জন্যে রান্না তো করতে হবে। আমার জন্মদিনের কেক তখনও আনা হয়নি। তখন তো আর এখনের মতো বাড়িতে দিয়ে যেত না।
মা গণেশকে বলে গেল রান্নার আয়োজন করতে। কেক নিয়ে ফিরেই মা হাত লাগাবে। একা এতগুলো রান্না লোকটা পারবে না।
সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। ঠাকুমাও মন্দিরে পূজা দিতে গেছে আমার নামে। ভাই ঘরে টিভি দেখছে। আমি আর মা বেরোলামআধঘণ্টার ব্যপার। কেক নিয়েই এসে পড়ব জলদি।
কিন্তু কেক এনে যা দেখলাম তাতে আমি মা ভাই ঠাকুমা - সকলের চোখ কপালে। আধা ঘণ্টার ভেতরে প্রায় পঁচিশ জনের রান্না খতম!! পোলাও, চিলি চিকেন, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, চাটনি, পাঁপড়, ফিশ কাটলেট... সব হয়ে গেছে!
মা হাঁ মুখ করে গণেশকে বলল, “তুমি... এত কিছু... কী করে এত তাড়াতাড়ি... মানে আমি যখন গেলাম কিছুই... হয়নি... ।” গণেশ কিন্তু সেই লাজুক মুখেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। শুধু একটু হেসে বলল, “মা... এ আর এমন কী, হয়ে গেল আর কি।”
কেউ কিছুই বললাম না। সেদিন রান্না খেয়ে সবাই দুর্দান্ত বলেছিল ঠিকই, কিন্তু মা আর ঠাকুমার রাতের ঘুম উড়ে গেছিলকিছুতেই একটা লোকের পক্ষে একা এতজনের রান্না, তাও প্রায় এত কম সময় করে ফেলা সম্ভবই নয়। মা আর আমি যখন বের হই, তখন কিচ্ছু হয়নি, এমনকি কুটনো কোটাও না। তাহলে কি লোকটা জাদু জানে?
এরপর চুপিচুপি কিন্তু গণেশের ওপর মা চোখ রাখতে শুরু করল। চুপচাপ লোকটা, রোগা, কালো, মাথাটা ইয়া বড়ো টাক। শুধু সরু একটা গোঁফ ছিল তার। পরনে ধুতি ও একটা সাদা পাঞ্জাবিভারি সাদামাটা গ্রামের লোক ছিল সে। কিন্তু মুখে সব সময় কেমন একটা হাসি হাসি কৌতুক ভাব। যেন ঠাট্টা করত আমাদের নিয়ে। মাকে অবাক করে দুই বালতি কাপড় সে পনেরো মিনিটে কেচে আনত, বিশাল চারটে ঘর ঝাঁটিয়ে মুছে ফেলত প্রায় দশ মিনিটে। ঘর যে নোংরা কোনোমতে ঝাঁটানো তা নয়, একেবারে ঝকঝকে। ছাদ থেকে কাপড় জামা আনত যেন হাওয়ায় ভর করে, গাছ ভরতি ফুল আর মগডালের ফল কেমন করে যে পাঁচ মিনিটে পেড়ে আনত কে জানে! বাজারে এই যেত এই আসত, কিন্তু পুরো ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে। একটুও হাঁপাত না কিন্তু। বাজার আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় আধঘণ্টার রাস্তা। রিকশায় গেলেও, বাজার করে আসতে প্রায় একঘণ্টা তো লাগেই - পনেরো মিনিট লাগে না নিশ্চয়ই।
কথাটা বাবার কানে গেলেও, হাজার লক্ষ করেও ব্যাপার বোঝা গেল না।
বোঝা গেল কিছুদিন পর। বুড়ো তপন তার পরিবার নিয়ে ফিরে এল যেদিন, তার আগের দিনই গণেশ হাওয়া। কোথায় যে গেল, কাউকে কিছু বলেও যায়নি। অনেক খুঁজেও কিন্তু তাকে পাওয়া গেল না। পুলিশে ব্যাপারখানা জানানো হবে ঠিক হলএবং জানানো হলও। বাবা মা আমরা সকলেই খুব চিন্তিত। একটা লোক বেমালুম হাওয়া কী করে হয়! সে এমন তো ছিল না। যেখানেই যেত, মা বা ঠাকুমাকে বলেই যেত। তার কোনও বিপদ হল না তো?!
নাহ! বিপদ হয়নি। বিপদ হয়েছিল যখন আমরা টের পেলাম ব্যাপারটা।
রানি পিসি এল আমাদের বাড়ি ঘুরতে। জানুয়ারি মাসের শেষ তখন। মা গণেশের কাণ্ড জানাতেই পিসি তো থ!
পান মুখে পিসি গোল্লা গোল্লা চোখ কপালে তুলে বলল, “কী বলিস রে বীথি? আমি পাঠিয়েছি কাকে??”
মা তো আরও থ। বলল, “দিদি, আরে তুমি যে আমায় লোক পাঠালে... আরে ঐ গণেশ গো। কালো কুচকুচে বেঁটে লোকটা...”
“দূর, কে কালো লোক রে। আমি কাউকে তো পাঠাইনি। তুই বললি বলে ঠিক করছিলাম কাউকে পাঠানো যায় নাকি।”
থমথমে পরিবেশ।
পাশেই ঠাকুমা আর রতন দিদা বসেছিল। আর দিদার পা টিপছিল তার চাকর মেয়েটা ননি। ননি কিন্তু ভয় ভয় চোখে একবার আমাদের দিকে তাকিয়েই মুখ নামিয়ে নিয়েছিল। এরকমই যখন আমাদের মধ্যে কথা চলছে, কেউ বুঝতে পারছে না ব্যাপারখানা কী, ননি তখন ভয়ে ভয়ে বলল, “কাকিমা, একটা কথা বলব?”
সব্বাই তাকাল ওর দিকে। ও কী বলবে? মা বলল, “কী রে, তুই কী বলবি আবার?”
ননি আরও একবার সভয়ে গোল বৈঠকে বসা ঠাকুমা পিসিমা মা’দের দিকে তাকিয়ে বলল, “কাকিমা... তোমাদের ঐ গণেশ কিন্তু একটু... মানে মানুষ না...।”
ঠাকুমা তো ক্ষেপে গেল, “আং বাং কী বলিস রে ননি! মানুষ না? মানেটা কী... যা ইচ্ছে...!”
ননি কিন্তু বলেই চলল, “ঠাকুমা, আমি নিজের চক্ষে যা দেখেছি, তা অস্বীকার করতে পারি না যে।”
মা আবার বলল, “কী দেখেছিস? কী হয়েছে বল?”
“আমি তোমাদের পেছনের বাগান দিয়ে কুলের আচার নিয়ে আসছিলাম। দিদা আমায় পাঠিয়েছিল তোমাদের দিতে। তা বেড়া টপকাতে যাব, দেখি কিনা তোমাদের গণেশ জবা গাছের ফুল তুলছে।”
একটু হাঁপ নিয়ে ননি আবার বলতে শুরু করল, “জবা গাছে ভর্তি ফুল। একদম মগডালে এত্ত বড়ো একখানা জবা ফুটেছিল। গণেশ... গণেশ... কাকিমা... ওর হাতটা দেখি ইয়া লম্বা হয়ে গেল! টুক করে মগডালের ফুলটা পেড়ে আনল গো। আমি ভয়ে আর এগোইনি। ভূত...!”
সবাই গোল্লা চোখ করে শুনছিল। ননির কথা শেষ হতেই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। ঠাকুমা তো ধমকে দিল ওকে। কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। ননি বলতে লাগল, “ঠাকুমা আমি নিজের চোখে... আমি দেখেছি...” ইত্যাদি ইত্যাদি।
যে যার বাড়ি গেল চুপচাপ। কারও মুখে কথা নেই। শুকনো মুখে ঠাকুমা ঠাকুরের সামনে বসলপিসিমা পান মুখে মা’কে বোঝাতে লাগল ননি ভুলভাল দেখেছে।
কিন্তু যতই যাই হোক, মনের সন্দেহটা যে ঠিক সেটা আমরা সকলেই জানতাম। ওরকম আশ্চর্য ক্ষমতা আমরা নিজেরাও তো টের পেয়েছিলাম। তাহলে কি সত্যি গণেশ ভূত? তার রহস্য আজও জানি না। আজ আমরা ওই বাড়িতেও থাকি না। অনেক বছর কেটে গেছে।
কিন্তু গণেশ ও তার অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডের মীমাংসা কিন্তু কেউ করতে পারিনি আমরা।।
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল

1 comment: