আমার ছোটোবেলা:: ছেলেবেলার গল্প - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়


ছেলেবেলার গল্প
পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

স্মৃতি সততই সুখের – এটাই চিরাচরিত কথা, কিন্তু দুঃখের স্মৃতিও থাকে। তবে প্রায়শঃই আমরা তা ভুলে থাকতে চেষ্টা করে, সুখের স্মৃতিকেই আঁকড়ে ধরে থাকি। আজ যেমন লিখতে বসামাত্রই ছোটোবেলার কত কথা মনের মাঝে ভিড় করে এল। ছোটোবেলার নরম মনে স্মৃতিগুলো এতো গভীরভাবে বসে যায়, তাদের আমরা বৃদ্ধ বয়সেও ভুলতে পারি না। নিজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, মধ্য বয়সের স্মৃতি অনেক হারিয়ে গেছে, কিন্তু বাল্যস্মৃতি ভারাক্রান্ত মনে এখনও স্মরণে আসে।
এখনকার সঙ্গে আমাদের ছোটোবেলার পরিবেশের অনেক পার্থক্য ছিল। তখন না ছিল প্রাচুর্য্য, না ছিল ছোটোদের স্বাধীনতা। আজ যখন পিছন ফিরে তাকাই তখন বর্তমান জগতের একটি শিশুর সঙ্গে আমাদের অমিল সহজেই চোখে পড়ে। অনাবিল সরলতা তখন ছিল একটি বৈশিষ্ট্য। সামান্য উপহারেই খুশি হতাম আমরা, কারণ আমাদের চাহিদা ছিল না বললেই চলে।
ছোটোবেলার ছবি দেখতে যেমন ভালো লাগে, তেমনি মাঝে মাঝেই ছোটোবেলার স্মৃতি হাতড়াতেও মন চায়। অনেক চরিত্র, অনেক ঘটনা, এমনকি খাদ্যবস্তুর স্বাদও বিশেষ বিশেষ ঘটনাকে মনে করিয়ে দেয়। মনে পড়ে রথের মেলার কথা। বাবা আমাদের নিয়ে যেতেন রথের মেলায়। সে সব কী আনন্দের দিন ছিল! আমরা কিছু চাওয়ার আগেই পেয়ে যেতাম মাটির সরায় কাঠি লাগানো গাড়ি, মাটির বেহালা, মাটির পুতুল আর পাঁপড় ভাজা। এসব স্মৃতি অমলিন।
আমাদের ছোটোবেলায় পুজোর আগে খবরের কাগজের দু’পাতা জুড়ে বেরোত ‘বাটা’-র বিজ্ঞাপন। সে সময় ‘বাটা’-র দোকানে জুতো কিনতে যাওয়ার আনন্দ আজও যেন অনুভব করতে পারি। নতুন জুতো হওয়ার সঙ্গে বাড়তি পাওনা ছিল কাগজের টুপি ও বেলুন। এসব স্মৃতি কি ভোলার! জামা কাপড়ের বাহুল্য আমাদের একেবারেই ছিল না। পুজোয় একটা জামাই হত, কিন্তু তা নিয়ে কোনও আক্ষেপ ছিল না। পুজোর সব ক’টা দিনই বাবা-মা’র সঙ্গে ঠাকুর দেখতে বেরোতাম, আর সব থেকে আনন্দ হত নবমীর দিন, কারণ সেদিন আমরা দেশের বাড়িতে যেতাম। নবমী মানেই মায়ের বিদায়বেলা আসন্ন, মন তাই হয়ে ওঠে ভারাক্রান্ত। কিন্তু সে বয়সে এ বোধ ছিল না, তার থেকে বেশি আনন্দ ছিল দশমীর সন্ধ্যায় গ্রামে দল বেঁধে লোকের বাড়ি গিয়ে প্রণাম করে মিষ্টি নেওয়া। কখনও কখনও বিসর্জন দেখতেও যাওয়া হত। গ্রামে তখনও বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি, তাই যে কোনও অনুষ্ঠানেই আমাদের দেশের বাড়িতে হ্যাজাকের আলো জ্বলত। বিজয়া দশমীতেও সেই ব্যবস্থা হত এবং অতিথি-অভ্যাগতে বাড়ি ভরে যেত। এসব এখন শুধুই স্মৃতি। সে বাড়ি এখনও আছে, তার এখন সম্পূর্ণ অন্য চেহারা।
আর একটা ঘটনাও খুব মনে পড়ে, তখন আমি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি। বেশ ভারী অসুখ করেছিল আমার, প্রায় তিন মাস স্কুল যেতে পারিনি, বিশ্রামে ছিলাম। সে সময় সকলের আমায় নিয়ে যে উদ্বেগ, তা আমার আজও মনে পড়ে।
আমরা থাকতাম বেহালায়, বেহালা তখন শহরতলি। সেখান থেকে আমরা চলে এলাম মধ্য কলকাতায় সি.আই.টি রোডে। আমি তখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি, মন ভীষণ খারাপ হয়ে গিয়েছিল আবাল্য বন্ধুদের ছেড়ে আসতে। তখনকার দিনে তো এখনকার মতো যোগাযোগ রাখার এত সুযোগ ছিল না, তাই কোথায় হারিয়ে গেল তারা! আজও আমি একলা অবসরে তাদের কথা ভাবি। অপরদিকে, কলকাতার নতুন স্কুলে এসে আমার সেখানে মানিয়ে নিতেও বেশ কিছুদিন সময় লেগেছিল।
বাবা-মা কেউই আজ আর ইহজগতে নেই, প্রতিনিয়ত তাদের অনুপস্থিতি মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। অনেক ঘটনা স্মৃতিতে আসে, তখন ভাবি এ কি সত্যিই ঘটেছিল না কল্পনা – সঠিক উত্তর দেবার লোক আর কেউ নেই।
আমাদের ছেলেবেলায় টি ভি ছিল না, মোবাইল ফোন ছিল না, আমাদের মনের খোরাক জোগাত বই। ‘সন্দেশ’, ‘শুকতারা’ নিয়মিত আসত আমাদের বাড়িতে। কে প্রথম বই পড়বে, তা নিয়ে চলত ঝগড়া। পুজোয় জামা একটা হলেও বই আসত অনেক, উপহারও পেতাম। একজন প্রতিবেশী কাকু ছিলেন, তিনিও পুজোতে আমাদের বই উপহার দিতেন। তিনি আমাদের খুব স্নেহ করতেনতার কোথাও নেমন্তন্ন থাকলে আমরা দুই ভাই-বোন বিনা আমন্ত্রণে নির্দ্বিধায় চলে যেতাম তাঁর সঙ্গে। বাবা-মা দু-একবার আপত্তি তুললেও কাকু শুনতেন না। তিনিও আজ ইহজগতে আছেন কিনা জানি না! আর ছিলেন এক ঠাকুমা ও দাদু – নিজের ঠাকুমা-দাদুকে আমি দেখিনি, কিন্তু এঁদের কাছে সে স্নেহের স্পর্শের ছোঁয়া পেয়েছি। এঁরা সবাই কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন, আজকের দিনে এ দৃশ্য বোধহয় কিছুটা বিরল।
ছুটির দিনে বিকেলে বাবা নিয়ে যেতেন আউট্রাম ঘাটে। বেহালার বাড়ি থেকে হাঁটতে হাঁটতে যেতাম, ফিরতাম ট্রামে। তখন ট্রাম চলত খুব, আর এই ট্রামে চড়াটা ছিল ভীষণ আনন্দের।
একসময় কে. এফ. রেলওয়ে ছিল, ছোটো ট্রেন চলত সে লাইনে। ট্রেন বন্ধ হয়ে যাবার পর পুরো জায়গাটা একটা পরিত্যক্ত ভূমির মতো পড়ে ছিল। ট্রেন ছিল, স্টেশন ছিল, কিন্তু সবই পরিত্যক্ত। ওটা হয়েছিল আমাদের খেলার জায়গা। আমরা বন্ধুরা মিলে ট্রেনের এ কামরা থেকে ও কামরায় লুকোচুরি খেলতাম। সব থেকে মজার কথা, এই কামরাতেই রোদ, ঝড়, বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে গরু-বাছুর আশ্রয় নিত।
এই সব নানা স্মৃতিতে এখন মন ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে, ইচ্ছে করে সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে। আবার তখন বাবা-মা’র কথা না শুনে যে সব কাজ করেছি, তাঁর জন্য এখন আক্ষেপ করি, আবার নিজেদের সন্তানরাও যেন সে ভুল না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখি। ছোটোবেলার যে সব আকাঙ্খা তখন পূরণ হয়নি তাও নিজেদের সন্তানদের মধ্যে দিয়ে আমরা পূরণ করতে চাই।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছেলেবেলার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে প্রথমে বলেছেন,
“বয়স তখন ছিল কাঁচা, হালকা দেহখানা
ছিল পাখির মতো, শুধু ছিল না তার ডানা।
------------------------------------------
নানারকম ধ্বনির সঙ্গে নানান চলাফেরা
সব দিয়ে এক হালকা জগৎ মন দিয়ে মোর ঘেরা -
ভাবনাগুলো তারি মধ্যে ফিরত থাকি থাকি
বনের জলে শ্যাওলা যেমন, মেঘের তলে পাখি।”
_____
ওপরের ছবি কলকাতা-ফলতা রেলওয়ের, সূত্র আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment