বিজ্ঞান:: টেকনোলজি ও ভবিষ্যতের চাঁদ - দেবব্রত দাশ


টেকনোলজি ও ভবিষ্যতের চাঁদ
দেবব্রত দাশ

একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের একেবারে শেষভাগে পৌঁছে সবার হাতে হাতে ঘুরছে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ স্মার্টফোন পশ্চিমে সুদূর আমেরিকার লস এঞ্জেলস থেকে পুবে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড, যেখানেই থাক না প্রিয়জন, আন্তর্জালের জাদুস্পর্শে স্মার্টফোনের আলোকিত স্ক্রিনে তার স্থিরচিত্রই শুধু নয়, চলমান ছবিও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে মুহূর্তে দূরত্বের বাধা অতিক্রম করে মানুষটা এক লহমায় সামনে এসে দাঁড়ায়, পারস্পরিক কথাবার্তাও চলে স্বচ্ছন্দে অথচ, আমরা যদি পেছন ফিরে তাকাই... শতাব্দীর একেবারে শুরুতে... খুব বেশি সময় আগে নয়... ২০০২ কি ০৩, তখন আমাদের দেশের বাজারে সবে এসেছে মোবাইল ফোন... তারপর দশ-এগারো বছরের মধ্যেই দুনিয়াজুড়ে টেকনোলজিতে ঘটে গেল বিপ্লব, শুরু হয়ে গেল স্মার্টফোনের রমরমা সৌজন্যে স্টিভ জোভস এবং তাঁর সমগোত্রীয় জনাকয় বিশেষজ্ঞ কম্পিউটার-বিজ্ঞানী।
আজ সঙ্গে স্মার্টফোন থাকার অর্থ, হাতের মুঠোয় সমগ্র দুনিয়া বোতাম টিপলেই নিউজ আপডেট, বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে, মুহূর্তে চলে আসে নজরে। কোনও একটা তথ্য এখনই চাই, তো বই বা ঢাউস এনসাইক্লোপিডিয়ার দরকার নেই আর, 'গুগল'-সার্চ করলেই স্ক্রিনে ফুটে উঠবে তথ্য, 'GPS' জানান দেবে সেই মুহূর্তের অবস্থান ঠিক কোথায় এবং গন্তব্যস্থলের নাম টাইপ করে দিলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে একেবারে সঠিক নিশানায় এছাড়াও 'GPS' দিনভর... রাতভর... ঘণ্টায় ঘণ্টায় জানান দিয়ে চলবে - পারদ কোন্ তাপমাত্রা ছুঁয়েছে, বায়ুদূষণ কোন্ পর্যায়ে আছে... সব... সব তথ্য চোখের সামনে তুলে ধরবে যুগের 'ম্যাজিক ল্যাম্প'
আরে... কী আশ্চর্য! এত গুণকীর্তন করেও স্মার্টফোনের অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথাটাই বলে উঠতে পারিনি এখনও! এই ফোনের দৌলতেই ভারী ভারী ক্যামেরা বয়ে নিয়ে বেড়ানোর প্রয়োজনই পড়ছে না আর ফোনে লাগানো ১৩ মেগাপিক্সেল ক্যামেরায় পথেঘাটে চলতে ফিরতে সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনার স্থির ছবি কিংবা, ইচ্ছে হলে চলমান ছবিও তুলে ফেলা যায় শুধু অন্যের ছবি কেন, নিজেই নিজের ছবিও তোলা সম্ভব স্মার্টফোনে লাগানো খুদে আর একটি লেন্সের দৌলতে এবং 'সেলফি' নামেই পরিচিত এই পদ্ধতি
নবীন প্রজন্ম এখন স্মার্টফোন বাদ দিয়ে জীবন ভাবতেই পারে না, আর সেজন্যেই প্রবন্ধের শুরু ফোন দিয়েই করেছি, কিন্তু তারা কি একবারের জন্যেও ভেবে দেখেছে - টেকনোলজির এমন রমরমা বিদ্যুতের অভাবে মুহূর্তে মুখ থুবড়ে পড়বে? শুধু স্মার্টফোন কেন, আধুনিক জীবনযাত্রায় যে সব জিনিস ব্যবহারে আমরা অভ্যস্ত, সবগুলিই বিদ্যুৎ-নির্ভর কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলব? - টি.ভি, রেডিও, রেফ্রিজারেটর, মাইক্রো ওয়েভ ওভেন, .সি, অ্যাকোয়া গার্ড, এল..ডি-ল্যাম্প, ফ্যান, ঘড়ি, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মায় খেলনা পুতুল... সব 'টাই বিদ্যুৎ ছাড়া অচল বিদ্যুৎবিহীন জীবন আমরা আজ ভাবতেই পারি না, ভাবতে চাইও না
বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেছেন কোন্ বিজ্ঞানী, এটা জানার ইচ্ছে হচ্ছে নিশ্চয়ই পাঠকবৃন্দের জবাবে জানাই, কোনও একজন বিজ্ঞানী কৃতিত্বের দাবীদার হতে পারেন না, অনেক অনেক জনের নাম জড়িয়ে রয়েছে বিদ্যুৎ-আবিষ্কারের সঙ্গে
৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন গ্রিসের অধিবাসীগণ অ্যাম্বারের (fossilized tree resin) সঙ্গে পশম (fur) ঘষে দেখেছিল, এই দুটি বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করছে আসলে, ওই গ্রিকরা সেই সময়েই আবিষ্কার করেছে স্থির বিদ্যুৎ (static electricity)
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গবেষক প্রত্নতাত্ত্বিকগণ এমন কিছু পাত্র আবিষ্কার করেন, যেগুলির ভিতরে ছিল তামার পাত, যা দেখে ওঁরা অনুমান করেন - প্রাচীন রোম নগরে আলো জ্বালানোর জন্যে ওই পাত্রগুলিই আসলে, আদ্যিকালের প্রথম ব্যাটারি একই রকমের বস্তু পাওয়া গিয়েছিল বাগদাদের ধারেকাছে, যা থেকে প্রমাণ হয় যে, প্রাচীন পারসিকগণও রোমানদের মতো আলো জ্বালানোর কাজে ব্যবহার করত ওই ব্যাটারি
১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ পদার্থবিদ উইলিয়াম গিলবার্ট স্থির তড়িৎ বোঝাতে ব্যবহার করেছিলেন ল্যাটিন শব্দ 'electricus' এবং এর কয়েক বছর পরে আর এক ইংরেজ বিজ্ঞানী টমাস ব্রাউন বেশ কয়েকটা বই লিখে ফেললেন গিলবার্টের অনুসরণে কাজ করতে গিয়ে এবং সর্বপ্রথম ব্যবহার করলেন 'electricity' শব্দটি
১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বজ্রগর্ভ মেঘের ভিতর ঘুড়ি উড়িয়ে পরীক্ষা চালিয়ে বিদ্যুতের অস্তিত্ব টের পান এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, মেঘের মধ্যে বিদ্যুৎ-চমক (lightning) আর বিদ্যুৎ-স্ফুলিঙ্গ আসলে অভিন্ন
ইতালিয়ান পদার্থবিদ আলেজান্দ্রো ভোল্টা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে বললেন যে, রাসায়নিক বিক্রিয়া বিদ্যুৎ-উৎপাদনে সক্ষম এবং সে পথে এগিয়ে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে বানিয়ে ফেললেন 'voltaic pile', যা একটানা তড়িৎ-প্রবাহ দিতে পারে আর তাই কাজে ভোল্টাই প্রথম ব্যক্তি হিসেবে কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন
এরপর ১৮৩১- মাইকেল ফ্যারাডে যখন ইলেকট্রিক ডায়নামো তৈরি করলেন, তখন থেকেই টেকনোলজিতে বিদ্যুতের ব্যবহার বাস্তবায়িত হল ফ্যারাডের এই আবিষ্কার আমেরিকান টমাস আলভা এডিসন এবং ব্রিটিশ জোসেফ সোয়ান, এই দুই বিজ্ঞানীর সামনে আলোর দরজা খুলে দিল দু'জনেই নিজের নিজের দেশে ১৮৭৮ সালে 'incandescent filament bulb' আবিষ্কারে সফল হলেন
পরবর্তীকালে এডিসন সোয়ান, দু'জনে মিলে 'ফিলামেন্ট ল্যাম্প' তৈরির এক যৌথ কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত করেন এবং এডিসন D.C (Direct Current) ব্যবহার করে ১৮৮২- সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্ক শহরে স্ট্রিট-ল্যাম্প জ্বালিয়ে সর্বপ্রথম রাস্তা আলোকিত করলেন
পরে অবশ্য আমেরিকান আবিষ্কারক এবং শিল্পপতি জর্জ ওয়েস্টিংহাউস মোটর ব্যবহার করে উৎপন্ন করলেন A.C (Alternating Current) ওয়েস্টিংহাউস, তেসলা এবং আরও কিছু বিজ্ঞানী তাঁদের কাজ দিয়ে আমেরিকান সোসাইটি-কে বোঝাতে সক্ষম হন যে, বিদ্যুতের ভবিষ্যৎ নিহিত আছে A.C ব্যবহারে, D.C-তে নয়
বিদুৎ-ব্যবহারে আজ আমাদের অবস্থান যে জায়গায়, তার জন্যে অবদান রয়েছে আর যে সব বিজ্ঞানীর, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন স্কটিশ আবিষ্কারক জেমস ওয়াট, আন্দ্রে অ্যাম্পিয়ার এবং গণিতজ্ঞ পদার্থবিদ জর্জ ওম
কিন্তু বিশ্বব্যাপী বিদ্যুতের বিপুল চাহিদা ভবিষ্যতে মিটবে কীভাবে? কেন-না, কিছু বিকল্প-ব্যবস্থা থাকলেও বিদ্যুতের সিংহভাগ উৎপাদিত হয় তাপবিদ্যুৎ হিসেবে আর তার জন্যে প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণ ফসিল-ফুয়েল কয়লা, যার ভাণ্ডার  নিঃশেষিত হতে আর খুব বেশি দেরি নেই আশার কথা শুনিয়েছেন ইসরো- (ISRO) বিজ্ঞানী শিবথানু পিল্লাই খুব নিশ্চয়তার সঙ্গে ২০১৭ থেকেই তিনি বলে আসছেন যে, আগামী দশ হাজার বছর ধরে পৃথিবীকে বিদ্যুৎ জোগাবে আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী চাঁদ
কেমন করে তা সম্ভব, সে আলোচনায় ঢোকার আগে বর্তমান বিকল্প ব্যবস্থা কী কী রয়েছে, সেটা জানাই প্রধান তিনটি ব্যবস্থা হল :- ) পরমাণু চুল্লির সাহায্যে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন ) নদীর জলের সাহায্যে টারবাইন ঘুরিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ) সোলার প্যানেলের সাহায্যে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন
সোলার প্যানেলের সাহায্যে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা বিশ্বজুড়ে চালু হয়েছে বটে এবং সে তালিকায় আমাদের দেশের নাম থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় উৎপন্ন বিদ্যতের পরিমাণ যৎসামান্য। জলবিদ্যুতের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা উনিশ বিশ
বিশ্বের বহু দেশ পরমাণু চুল্লিতে (nuclear reactor) ফিউশন-পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ-উৎপাদন করে কিন্তু সঙ্গে 'radioactive waste' অর্থাৎ, 'তেজষ্ক্রিয় বর্জ্য' তৈরি হওয়ার ফলে দুর্ঘটনা ঘটার মারাত্মক ঝুঁকি থেকে যায়, যেমনটা ঘটেছিল বিগত শতাব্দীর আশির দশকে সোভিয়েত রাশিয়ার চেরনোবিল পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে। তেজষ্ক্রিয় বিকিরণের ফলে মারা গিয়েছিল বহু মানুষ আর একদল বেঁচে থেকেও শারীরিক মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল
এবার আসা যাক চাঁদের প্রসঙ্গে চাঁদ জোগান দেবে পরমাণু বিদ্যুৎ, অথচ থাকবে না বিপদের সামান্যতম আশঙ্কাও
হেঁয়ালি মনে হচ্ছে? খোলসা করে বলি তাহলে পরমাণু চুল্লিতে ব্যবহারের জন্যে চাঁদ সরবরাহ করবে Helium-3, যা কিনা আদৌ তেজষ্ক্রিয় নয় কী? আবার ধাক্কা? চাঁদে বায়ুমণ্ডলই নেই, তো Helium-3 চাঁদ পেল কোথা থেকে?
জবাব দেওয়ার আগে বলি, হিলিয়াম এমন একটি মৌল, যার পরমাণুর নিউক্লিয়াসে রয়েছে দু'টি প্রোটন আর দু'টি নিউট্রন কিন্তু, Helium-3- পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকে দু'টি প্রোটনের সঙ্গে একটি মাত্র নিউট্রন, তার মানে এটি হিলিয়ামের আইসোটোপ, যা তেজষ্ক্রিয় নয় আর সেজন্যেই 'ফিউশন রিঅ্যাক্টর'- Helium-3 ব্যবহার করে বিদ্যুৎ-উৎপাদনে কোনও ঝুঁকিই নেই
এবার যা বলব, তাতে চমকে ওঠারই কথা বায়ুমণ্ডল নেই বলেই চাঁদের ধুলোয় রয়েছে Helium-3 আর পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডল থাকার দরুনই Helium-3 উৎপন্ন হচ্ছে না আসলে, হচ্ছে কী - সূর্য থেকে আমাদের গ্রহের দিকে প্রতিনিয়ত ছুটে আসছে যে 'সোলার উইন্ড', তা প্রতিহত হচ্ছে বায়ুমণ্ডল আর পৃথিবীকে ঘিরে থাকা চৌম্বক ক্ষেত্রের জন্য কিন্তু 'সোলার উইন্ড' চাঁদে অপ্রতিহত গতিতে পৌঁছে চন্দ্রত্বকে (moon crust) তৈরি করছে Helium-3 এবং সেই কারণেই চাঁদের ধুলোয় অফুরান এই মৌলটি, অন্তত প্রতি বিলিয়নে ওজন হিসেবে রয়েছে ১৩ অংশ, অর্থাৎ, 13 ppb বা, 13 parts per billion by weight
শিবথানু পিল্লাই বলেছেন - চাঁদের ধুলো Helium-3 সমৃদ্ধ বলে চাঁদ থেকে এই মৌলটিকে সংগ্রহ করে পৃথিবীতে নিয়ে আসতে পারলেই মুশকিল আসান তবে, আনার আগে চাঁদের ধুলোকে ৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করে নিষ্কাশিত Helium-3 'স্পেস-শাটল'- বয়ে নিয়ে আসতে হবে পৃথিবীতে আগামী ১০,০০০ বছর ধরে হিলিয়ামের এই আইসোটোপটিই জোগান দিয়ে যাবে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ
Helium-3- আর্থিক মূল্য পিলে চমকে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট বছর কয়েক আগে এক টনের বাজার-দর ছিল বিলিয়ন ডলার, এখন নিশ্চয়ই আরও অনেক বেড়েছে তার মানে, চন্দ্রপৃষ্ঠ হল গিয়ে 'সাত রাজার ধন এক মানিক'-এর ডাম্পিং গ্রাউন্ড
মনে পড়ে যাচ্ছে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘হে মহাজীবন’ কবিতার শেষ তিনটি লাইন, যেখানে তিনি বাস্তবের কঠিন মাটিতে দাঁড়িয়ে দেখছেন গদ্যময় চাঁদকে ‘কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,/ ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়:/ পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।।’
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল

1 comment:

  1. বেশ তথ্যপূর্ণ চমৎকার প্রবন্ধ।

    ReplyDelete