গল্প:: ব-এ বিহঙ্গ - শরণ্যা মুখোপাধ্যায়


- বিহঙ্গ
শরণ্যা মুখোপাধ্যায়

।। এক।।

অ্যাই বেদো, বেদো! কানে যাচ্ছে না কথা! থাম বলছি
নিচ থেকে হুড়ুম পিসি তুমুল চেঁচাচ্ছে বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতেই শুনতে পাচ্ছিলাম তার মানে আজ সকালে আবার শুরু হয়েছে এই বেদোটাকে নিয়ে এবার হয় রাঁচি না হলে কাশী (না না সেই হুপিংওয়ালাটা নয়) চলে যেতে হবে দেখছি
বারো ঘর এক উঠোনওয়ালা বাড়িটার উঠোনের ঠিক মধ্যিখানে হুড়ুম পিসি দাঁড়িয়ে আছে মুখখানা সেই আকাশ থেকে মিষ্টি পড়ার সময় হাল্লা রাজার সৈন্যদের মুখের মতো হাওয়া গরম বুঝতে আমার মতো অঙ্কে বরাবর ১০০- ৯৯ পটিয়সের বেশি দেরি লাগল না কিন্তু আজকের ইস্যুটা কী? সেটা জানতে হবে আগে আমাদের খুনখুনে খোকাদাদুর পাঁজরের মতো সিংহদরজা দিয়ে বেদোর প্রিয় মেনিটার মতো টুকুস করে ডান দিকের সিঁড়িটা নিয়েছি কি নিইনি, হুড়ুম পিসির গলায় খাম্বাজ খোলতাই হল
ওই ড্যাকরা! তুইই যত নষ্টের গোড়া চুপি চুপি ওদিকে কী করতে যাচ্ছিস! এদিকে আয়!”
ইয়ে, পিসিমা, আমি তো বেদোইয়ে মানে বিহঙ্গকে ডাকতে এসেছিলাম একটা নতুন কেসের ব্যাপারে…”
ওরে ওরে
খাম্বাজ রাগ এক মুহূর্তে গলে মল্লার হয়ে গেল
তা এতক্ষণ এটা বলবি না বাবা!”
যাচ্চলে! বলার সুযোগ দিলে কই! বলতে গিয়েও ঢোক করে কথাটা নিম-বেগুন মার্কা গিলে নিলুম মা-পিসিমাদের মুড আর বেদোর কেরিয়ার, দুটোরই কোনো কূলকিনারা নেই কখন যে সাপ-লুডোর মতো উঠবে আর কখন যে নাগরদোলার মতো নামবে, সে দেবা জানন্তি কুত এই, ইয়োরস ট্রুলি!
যা বাবা যা, তাড়াতাড়ি বল গে যা এক মাসের ওপর কেসছাড়া হয়ে ছেলেটা পেগলে আছে আর বেশি দেরি হলেশিবশম্ভু শিবশম্ভু!”
এই সব ধুপধাপ পেরিয়ে দোতলায় উত্তরের ঘরটায় পৌঁছতে না পৌঁছতেই একটা শেয়াল কেঁদে উঠল কোথায় যেন! যাক্কলা! শুভ কাজে কী সব অশুভ শব্দ রে বাবা! ‘ক্যা ক্যা কং কংশুনে কানে আঙুল দিয়ে জলদি বেদোর ঘরে ঢুকেছি কি ঢুকিনি, দেখি শব্দটা ওখান থেকেই আসছে
বেদো এস্রাজ বাজাচ্ছে!
অ্যাই বেদো, এখুনি থাম
টয়েং!
আমার বাজখাঁই গলা শুনেই যন্তরটা এক কথায় চুপ করে গেল এক বিছানা বইপত্র, ছবি আঁকার জিনিস, স্বরলিপির খাতা ইত্যাদির মাঝখানে জ্যান্ত স্বরস্বতীর পুং ভার্সন হয়ে বেদো বসে আছে গায়ে এখনও সেই এক সপ্তাহ আগে যে ফতুয়াটা পরা ছিল, সেটাই মাথার চুলে দুটো পালক ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে মনে হয় কালও পায়রাদের খাওয়াতে ছাদে গিয়েছিল
বল রে পোনা!”
ওই সরু, ন্যাকা গলায় আমার প্রাঞ্জল নামটার এই দুর্গতি শুনলেই ভেতরটা কেমন তেলেভাজা ছাড়ার আগের কেলে কড়াইয়ের তেলের মতো করতে থাকে কিন্তু না শান্তি শান্তি মাথা ঠান্ডা না রাখলে ওকে নিয়ে বেরোনো যাবে না এখন
বল বল, চুপ করে থাকিস না এই বসন্ত প্রাতে হঠাৎ কী বার্তা এনেছিস, খুলে বল, করিসনি ছল হে ভ্রাতা!”
কাব্যি রাখ কেসের খবর এনেছি
মা গো! কেস!”
দু-হাতের তালুতে দু-গাল চেপে ধরে বেদো আশ্চর্য হবার একটা নকশা ফুটিয়ে তুলল মুখে!
হ্যাঁ, মাননীয় বিহঙ্গ বাঁড়ুজ্জে! কেস সকাল থেকে ডুমুরতলা থানার ওসি তিনবার কল করেছে তোকে না পেয়ে শেষে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত করছে! ফোন তুলিস না কেন হতচ্ছাড়া!”
আর ফোন! এই বসন্তকালে সব চুরি, ডাকাতি, খুনখারাপি কে দেখে ভাই!” টেনে টেনে সেই এক সুরে ঘেউ করল বেদো
! তাই না! আচ্ছা! কী দেখে তাহলে?”
তুই দেখবি ভাই?”
হ্যাঁ রে ভাই দেখা ভাই!”
আয় তবে!”
আশ্চর্য আমার টোনকাটাটা একফোঁটা ধরতে পারল না! লোককে পুলিস এত মান্যি করে কেন! কেমন গোয়েন্দা!
ওই দেখউত্তরের খড়খড়ি খুলে একটু দূরে নিজের লম্বা লম্বা আঙুলগুলো পুকুরপাড়ের গাছগুলোয় গোদা এঁচোড়গুলোর দিকে দেখাল
একটু তরিবৎ করে আদা, পেয়াজ আর কুঁচোচিংড়ি দিয়ে রাঁধলে না! উফ, একথালা ভাত এখনই উঠে যেত রে!”
আরে! রাখ তোর কুঁচোচিংড়ি! ওদিকে ইনস্পেকটর গণেশ গুঁই গাঁইগুঁই করছেন সেইটে আগে দেখ
গণেশ দাদা পেটটি নাদা, পেটে কেন সিঁদুর/ কলা বউ নাম রেখেছেন, পায়ের তলায় ইঁদুর!”
যত আজেবাজে কথা, তোকে কী বললাম আমি! এখনই থানায় চল তোকে ডাকছেন স্যার কিছু দেখাবেন কেস জটিল
আরে এত সকালে বেরোলে কী হবে জানিস!”
না, জানি না জামা কই তোর!”
পরিপাটি আলনা ঘেঁটে একটা ভদ্রস্থ শার্ট বাছলাম আমি একমাত্র বিছানা বাদ দিলে গোটা ঘরে একচুল ধুলোও কেউ দেখাতে পারবে না সেদিক দিয়ে বাবু পারফেক্ট
এত রোদে বেরোলে আমার সানবার্ন হয়ে যাবে মাথা ধরবে হে বিষ্ণু!”
মাথা ধরলেও কিছু করার নেই জারুলপুরের চৌধুরী বাড়ির কেস
কী কেস? কেন কেস?”
ন্যাকামো রাখ সেগুলো বলার জন্যই তোকে যেতে ডেকেছে চৌধুরী বাড়ির ছোটোকন্যা থানায় এসে বসে আছেন নিজের জিনিস না নিয়ে তিনি নড়বেনই না কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছেন
অহ ফোলা চোখ! পাফি আইস! মোটে ভালো না একটু শশা আর আলুর রস যদি যত্ন করে…”
আরে রাখ তোর শশা আর আলু এদিকে গুঁইমশাইয়ের তালু গরম হয়ে যাচ্ছে জলদি চল
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই পুরোনো কাঠের সিঁড়িতে ধপধপ আওয়াজ পাওয়া গেল আমাদের গুঁইবাবুর একশো সের থাবা, ইয়ে পায়ের পাতা ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না
দেখ! গুঁইমশাই চলেই এসেছেন বাড়ি অবধি
গুঁইমশাই, আসুন আসুন আস্তাজ্ঞে বস্তাজ্ঞে হোকঝটপট জানলা থেকে সরে এসে জোড় হাতে বৈষ্ণব বিনয়ে দরজার সামনে দাঁড়াল বেদো
আপনি সরলে তবে তো ঢুকতে পারবগলদঘর্ম হয়ে গুঁইমশাই ঘরে ঢুকে ধপাস করে বেদোর বিছানায় নিজের বপু ছড়িয়ে দিলেন
একটু জল বলি? সঙ্গে অল্প টল?” হাতের কিম্ভূত একটা ভঙ্গি করল বেদো মুখে সরল হাসি টল-টা কী, সেটা আমি জানি শীত কিংবা বসন্ত, গুঁইমশাই-এর একমাত্র পছন্দ পিসিমার হাতের এলাচ চা আর ডবল ডিমের মামলেট ওঁর ঘাড় নাড়ার অপেক্ষা না করেই পিসিমাকে এত্তেলা দিতে বেরিয়ে গেলাম আমি এখন কেসচর্চা হবে কতক্ষণ কে জানে! ইঞ্জিনে তেল না দিলে গাড়ি চলবে কী করে

।। দুই।।

কোথায় গেল বলুন তো? গত পরশুও ছিল ছাদের ঘরে আমি নিজে গিয়ে জলপানি দিয়ে এসেছি আই লাভড হার সো সো মাচ প্লিজ কিছু করুন বেদোবাবু!”
আহা, আহা কাঁদবেন না তমালিকা দেবী এত কাঁদলে শরীর থেকে প্রয়োজনীয় মিনারেলস সব বেরিয়ে যাবে যে! সোডিয়াম, পটাসিয়াম কমে আসবে, তখন আবার…”
আমার কড়া চোখ দেখে নিজেকে সামলাল বেদোনা, ইয়ে বুঝতে পারছি তো শেষবার যেন ওকে কে দেখেছিল?”
আমি
চৌধুরীদের ড্রয়িং রুমে বড়ো সভা বসেছে চৌধুরী সাহেবের বড়োছেলে, বউ, বড়ো নাতি গুল্লু, ছোটো মেয়ে, বড়ো জামাই, পুরোনো কাজের লোক, চৌধুরী সাহেব নিজে, বেদো, আমি আর গুঁইমশাই এই জন মিলে জোর চর্চা চলছে চা আর টা- চলে এসেছে সঙ্গে
কাজের লোক কেতন কোণ থেকে হাত তুলল
আচ্ছা আপনি বেশ বেশ তা কখন দেখেছিলেন?”
গত পরশুদিন সকালেই খেতে দিতে গিয়েছিলাম যখন
আচ্ছা, তারপর তাহলে আর দেখেননি
না সারা বাড়ি, এমনকি গোটা এলাকাও তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে
আচ্ছা, কে আবিষ্কার করলেন যে নিজের বাসায় নেই?”
আমি!”
বড়ো ছেলের বউ ঊর্মি হাত তুলেছে
সারাদিনই তো চেঁচাত রাতে ঘুম হত না ওই ডাকের জন্য পরশু শনিবার ছিল অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম গুল্লুর কোচিং ছিল চারদিকটা কী শান্ত পেয়েছিলাম! উফ সেটা দেখেই তো…”
আচ্ছা, আচ্ছা ওই শান্তি দেখেই আপনি অশান্তির আভাসটা পেয়ে গেলেন, তাই না?”
মানে, কী বলতে চাইছেন আপনি?”
মা না না ভুল বুঝবেন না প্লিজ আমি বলতে চাইছি ঘুম না হওয়া খুব খারাপ চামড়া খারাপ হয়ে যায়, লিভারে প্রবলেম হয় শরীর-স্বাস্থ্যের জন্য সাউণ্ড স্লিপ খুব দরকার কিন্তু ঘুমের সময় কেবল সাউণ্ডই যদি স্লিপ করতে থাকে, তাহলে তো দারুণ সমস্যা, তাই না
আশ্চর্য কথা বলেন তো আপনি, দেখুন…”
আস্তে আস্তে বউমা, আমাকে একটু কথা বলতে দাও দেখুন বিহঙ্গবাবু, ময়না আমাদের খুবই কাছের ছিল ফ্যামিলি মেম্বার বলতে পারেন ফাল্গুন মাস পড়েছে দোল আসছে আমাদের রাধাগোবিন্দের পুজোয় এখানে বড়ো করে উৎসব হয় জানেন নিশ্চয়ই মেলা বসে তার একটা বড়ো আকর্ষণ কিন্তু ময়না আগে অনেক কিছুই হত এখন ব্যাবসার অবস্থা খারাপ, সময় ডাউন চলছে, চারিদিকে মন্দা তাও উৎসবের আগে ময়নাকে খুঁজে পাওয়া জরুরি দোলের আর পাঁচদিন বাকি আছে তার মধ্যে এই কাণ্ড লক্ষণ আমাদের জন্য মোটে ভালো নয় আপনাকে যে করেই হোক এই এক সপ্তাহের মধ্যে ময়নাকে খুঁজে দিতেই হবে
আমি নিশ্চয়ই চেষ্টা করব স্যার আপনাদের ফ্যামিলির কত নামডাক শুনেছি ইন ফ্যাক্ট আপনাদের মেলায় আমি নিজেও এসেছি ময়ূর নাচও দেখেছি! সেই ময়না আজ আমাদের মধ্যে নেই! হা হুতাশন!”
চটাৎ করে নির্ভুল লক্ষ্যে ঠিক সময়ে কপালে বসা মশাটা মারল বেদো
ভুরু কুঁচকে তাকালেন চৌধুরী মশাই “‘আমাদের মধ্যে নেইমানে!”
না না, ভুল বুঝবেন না প্লিজ মানে এই মুহূর্তে আমাদের মধ্যে নেই কিন্তু থাকবে মানে পাওয়া যাবে নির্ঘাত না পেয়ে যাবে কোথায়? ময়নাকে কে কিডন্যাপ করল, কারা করল সব খুঁজে বার করা আজ জাতির দায়িত্ব আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে জাতি জানতে চায়…”
গলা কাঁপিয়ে যাত্রার দলের নায়ক সাজাটা বন্ধ কর বেদো সবাই দেখছে
আমার চাপা ধমকানি শুনে বেদো গলা খাঁকারি দিল দু-বার তারপর ফিরল বড়ো জামাইয়ের দিকে
স্যার, আপনি কী কাজ করেন?”
সেটা কি খুব ইমপর্ট্যান্ট মিঃ বিহঙ্গ?”
আরে না না স্যার জাস্ট রুটিন কোশ্চেন আপনি কি এখানেই থাকেন, ইয়ে মানে…”
দেখুন মিঃ বিহঙ্গ আপনি যদি আমাকে হাউজ হাজব্যান্ড মানে ঘরজামাই ভেবে থাকেন তাহলে ভুল করছেন আমি কিন্তু…”
মা, ছি ছি তা কেন, আমি আসলে…”
জয় আমাদের এই মেলা আর উৎসবের জন্য এখানে ক’দিন এসে আছে আমার বড়ো মেয়ে এখন রাজ্যের বাইরে আমাদেরই ব্যাবসার কাজে আসতে পারেনি তাই বাবাজীবন এসেছেন বোঝা গেল মিঃ গোয়েন্দা?”
একদম স্যার একদম আর তুমি? গুল্লুবাবু? কোন ক্লাস হল তোমার?”
ধমকানি শুনে তেড়িয়ে মেড়িয়ে বাচ্চাটার দিকে নজর দিল বেদো
ক্লাস ফোর
ফোর! ওরে বাবা, সে তো অনেক বড়ো ক্লাস অনেক বই পড়তে হয়? হ্যাঁ? সায়েন্স? লিটারেচার?”
ঘাড় নাড়ল গুল্লু
তবে আমার ভালো লাগে সোসাল সায়েন্স পড়তে
বেশ বেশ তা তুমি দেখেছ ময়নাকে? ভাব ছিল ওর সঙ্গে?”
ছিল তো ময়না আর রায়ান দুজনের সঙ্গেই আমি কত…”
আহ, গুল্লু বেশি কথা কে বলতে বলেছে তোমাকে? যতটুকু জিজ্ঞেস করা হচ্ছে ততটুকুই বল
বাবার ধমকানি খেয়ে গুল্লু চুপ করল
ইয়ে, রায়ান কে ছিল চৌধুরী মশাই?”
ওর জোড়া কিছুদিন আগে সে চলে গেছে
ওহো স্যাড ভেরি স্যাড
ঠিক আছে স্যার আমি তো মোটামুটি সবই শুনলাম এখন একবার ময়নার থাকার জায়গাটা দেখা যায়? আর যদি একখানা ছবি পাওয়া যেত, দুজনেরই

।। তিন।।

কী বুঝছেন মশাই? পাঁচদিনের মধ্যে আজ দু-দিন পার হয়ে গেল আপনি ফোনও ধরেন না, আর এদিকে…”
হেস্তনেস্ত হয়ে বেদোর ঘরে ঠিক দু-দিন পরে সন্ধের মুখে মুখে ঢুকলেন গুঁইমশাই
রাধামাধব! আসুন আসুন আজ পিসিমা মালপো বানিয়েছেন দুটো হুকুম দিই?”
আরে রাখুন আপনার মালপো আগে বলুন…”
আপনি এত উতলা কেন হচ্ছেন বলুন তো গুঁইমশাই? আমাদের এই ডুমুরতলা কি অতই ফেলনা জায়গা? আমাদের অনাথ করে না গেলেই কি নয়?”
গুঁইমশাই-এর চোখ দুটো গোলগোল হয়ে বেরিয়ে আসে আর কি!
মানে! কিন্তুআপনি কী করে…”
আরে ওঁদের লিখিত অভিযোগ তো নেই রে বাবা? আর যে অভিযোগ লিখিত নয়, তার জন্য আপনি এত উতলা হচ্ছেন কেন? তাহলে নিশ্চয়ই আপনি আশা করছেন যে চৌধুরীমশাই আপনার বদলিটা এবার সোর্স খাটিয়ে কলকাতায় করিয়ে দেবেনঅ্যাঁ! তো দিনের আলোর মতো সহজ ব্যাপার গুঁইমশাই!”
না, মানে হ্যাঁ কিন্তু, মানে আপনি জানলেন কী করে যে অভিযোগ লিখিত নয়?”
আরে গুঁইমশাই একটু তো খবর রাখুন আইনের লোক আপনি ময়ূর আমাদের জাতীয় পাখি তার ওপর সিডিউল ওয়ান প্রাণী মানে যাকে বলে বিশেষ সংরক্ষণের আওতায় থাকা প্রাণী কী করে লিখিত অভিযোগ করবে, যে বাড়ি থেকে মিসিং!”
এই রে! তাহলে! মানে আপনি বলছেন যে…”
আর শুনুন চৌধুরী মশাইকে অত জপিয়ে লাভ নেই, বুঝলেন ভদ্রলোকের হাঁড়ির হাল ব্যাবসায় অনেক লস খেয়েছেন কাল মার্কেটে গিয়ে খোঁজ নিলাম বড়ো কানেকশনগুলো ওঁর হাতছাড়া আপাতত মনে হয় বদলিটা আর করাতে পারবেন না বুঝলেন?”
যাহ! ফ্যানটা আরেকটু জোরে করুন না মশাই
একদম একদম আপনি ঠান্ডা হোন
না, সে তো ঠিকই আছে কিন্তু চৌধুরী মশাইকে যে আমি কথা দিলাম যে…”
আচ্ছা, ময়ূরের নাম ময়না কে রাখে গুঁইমশাই? রাধামাধব!”
সত্যি তো! আর শুধু ময়না কেন? রায়ান? যার কথা গুল্লু বলল?”
আরে রায়ানকে ওরা বছরখানেক আগেই ছেড়ে দিয়ে এসেছে ওই রানিরহাটের দিকে ওদিকে ময়ূরদের একটা ফার্মিং আছে চন্দননগরে আমার মামাবাড়ি না? সেখান থেকেই খোঁজ নিয়ে জানলুম
ওটা যে রায়ান সেটা কীভাবে বুঝলেন?”
ধুর মশাই আপনি যেন কী! আরে রায়ানের বয়স হয়ে গিয়েছিল পেখম ঝরে যাচ্ছিল রোগ ধরেছে খরচ টানতে না পেরে আর মার্কেটে দাম না পেয়ে বড়ো জামাই দাতাকর্ণ হয়ে রানিহাটে গিয়ে ময়নাকে ছেড়ে এসেছিলেন শ্বশুরমশায়ের কথায় কটা বাড়িতে ময়ূর থাকে বলুন দেখি! রোজ রোজ কে ময়ূর দান করতে যাবে!”
হুম বুঝলাম কিন্তু একটা কথা বলুন ময়না কোথায় গেল? তা হলে কি বড়ো জামাই-…”
আরে রোক-কে রোক-কে সোসাল সায়েন্স, বুঝলেন সোসাল সায়েন্স
মানে!”
রাধাগোবিন্দ! আপনি দেখছি আমার গলাটাই ধরিয়ে দেবেন বকিয়ে বকিয়ে তার ওপর সিজন চেঞ্জের সময় ইস রাতে না কার্ভল প্লাস দিয়ে গার্গল…”
নিকুচি করেছে আগে বলুন ময়না…”
মোর ময়না গো… আহা, সলিলবাবুর গান!
থামবি বেদো! রহস্যটার শেষ অবধি কী হল বল শিগগির
আমার ধমকানি না খেলে বেদো ওর বেদোমি করেই যাবে, আমি জানি দিকে গল্প প্রায় শেষের দিকে সে আমি গত দু-দিনে ওর ছোটাছুটি দেখেই বুঝেছিলাম
আরে বাবা তোরা কেউ সোসাল সায়েন্স পড়িসনি? এই মার্চ মাস ওদের মেটিং টাইম সে সময়েই রায়ানকে দূরে করে দিয়েছিল ওরা ময়না তাই তো চেঁচাত এদিকে চৌধুরী মশায়ের কাছে ময়না লক্ষ্মী সম্ভবত আসার পর ব্যাবসায় লাভ হয়েছিল তাছাড়া মেলায় কিছু খেলাও দেখাত, যতদূর মনে হয় সব মিলিয়ে চৌধুরী মশাই ময়নাকে ছাড়তে রাজি হতেন না ময়না হারিয়ে যায় শনিবার দুপুরে শনিবার দুপুরে কার স্কুল থাকে না? কে রায়ান আর ময়নার বন্ধু ছিল? তার মুখচোখ দেখেছিলিস তোরা সেদিন?”
এবার আমাদের চোখ বড়ো বড়ো হবার পালা!
বলিস কী বেদো! ওই বাচ্চাটা! একা একটা ক্লাস ফোরের বাচ্চা…”
ডোণ্ট আণ্ডারএস্টিমেট দি পাওয়ার অফ বাচ্চা, পোনা গুল্লু খুবই স্মার্ট ছেলে সেদিন ওর কোচিং- তিনজন অ্যাবসেন্ট ছিল আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি ওরা সাধারণত রেগুলার তাই একদিন না আসায় খোঁজ পড়েনি কাল ওর স্কুলের শেষে একটু গল্প করতেই সুন্দর করে বলে দিল আমাকে একা নয় ওর দুই বন্ধুও আছে সঙ্গে ওরা জানে ফার্মিং ছাড়া এভাবে ময়ূর পোষা যায় না খেলানোও যায় না আর তার চেয়ে বড়ো কথা হল ওরা বন্ধুত্ব ব্যাপারটা বোঝে রায়ানকে ছেড়ে ময়না খুব মনমরা হয়ে গিয়েছিল ভালো খেত না পিসেমশাইয়ের সঙ্গে সেবারে রায়ানকে ছাড়তে গিয়েছিল তো ওর স্কুল থেকে মাত্র দুটো স্টেশন কিনা দ্বিতীয়বার যেতে তাই প্রবলেম হয়নি শুধু একটাই ব্যাপার, ওরা এবারে ফার্মের দরজার কাছে ময়নাকে ছেড়ে চলে এসেছিল, পাছে কেউ দেখতে পেয়ে যায় আমি কাল গিয়ে বলে এসেছি যাতে ওদের দুজনকে একসঙ্গে রাখা হয় আর কোথা থেকে এল, সে তো কেউ জানেই না তাই নিয়ে আর কথা বলে লাভ নেই
অ্যাঁ! তার মানে তুই আর ওকে…”
বেদো তেড়েমেড়ে উঠে পড়ল
ধুর বাবা রায়ান ময়নাকে পেয়ে গেছে চৌধুরীমশাই নতুন ময়না খুঁজে নেবেন ’খন এদিকে আমার বসন্তকাল চলে যাচ্ছে একটু এঁচোড় চিংড়ি কেউ এখনও খাওয়াল না গো পিসিমা…!”
হতভম্ব গুঁইমশাই আর অশ্বডিম্ব আমাকে ফেলে বেদো পিসিমার কাছে কাল সকালের মেনুর জন্য দরবার করতে হন্তদন্ত-বেরিয়ে গেল
----------
ছবি – সুকান্ত মণ্ডল

1 comment: