গল্প:: শুভেন্দু স্যারের পক্ষীরাজ - বুম বোস


শুভেন্দু স্যারের পক্ষীরাজ
বুম বোস

সে প্রায় অনেক কাল আগের কথা। যখনকার কথা তখন আমি আজকের মতো এমন ধেড়েবুড়ো ছিলাম না। আমিও তখন তোমাদের মতোই ছোটো ছিলাম। বেহালা হাই স্কুলে ক্লাস এইটে পড়তামতবে এই পড়তাম কথাটায় বিস্তর গলদ আছে।
প্রত্যেকদিন সকালে মায়ের ডাকে ঘুম থেকে উঠে ঢুলুঢুলু চোখে পড়তে বসতাম ঠিকই, কিন্তু সে পড়ার বেশিরভাগটাই জানলার বাইরে দিয়ে রোদ ঝলমলে আম বাগানের লতায় পাতায় মিশে হারিয়ে যেত। মাথায় সিকিভাগও ঢুকত না। তারপর যথারীতি মায়ের মুখঝামটা শুনে পড়াশোনা সব ডকে তুলে চান খাওয়া সেরে ইস্কুল চলে যেতাম।
ইস্কুলে ফুটবল, ইস্কুল থেকে ফিরে পাড়ার মাঠে ক্রিকেটখেলা ছাড়া তখন জীবনে আর কিছুই ছিল না। তাই পড়াশোনায় কোনোমতে উতরে দেওয়ার জন্য বাবা-মা ভরসা করতেন প্রাইভেট কোচিংয়ের মাস্টারমশাই বা দিদিমণিদের উপর।
তেমনই এক মাস্টারমশাই ছিলেন শুভেন্দু স্যার। আমরা স্কুলের কয়েকজন দলবেঁধে ওঁর কোচিংয়ে বাংলা আর ইতিহাস পড়তে যেতাম
স্যারের সরু গোঁফ, আর ঘাড় অবধি লম্বা চুল দেখে অনেকেই তাকে বাংলা সিনেমার রাগি ভিলেনদের সঙ্গে তুলনা করলেও, তিনি মানুষটি ছিলেন খুবই শান্ত এবং মিষ্টি ভীষণ রেগে না গেলে বা কেউ খুব বড়োরকমের কোনো দুষ্টুমি না করলে স্যার কোনোদিন কাউকে কড়াভাবে বকতেন না।
আমাদের ছোটোবেলায় যে সমস্ত শিক্ষক শিক্ষিকারা ইস্কুলে পড়াতেন, প্রাইভেট টিউটর হিসেবেও তাদেরই রমরমা ছিল। তবে শুভেন্দু স্যার কিন্তু কোনো ইস্কুলেই পড়াতেন না, তাই তার কোচিংটিও ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে কোনোমতে চলছিল।
যদিও কোচিং বলতেই চট করে যে ছবি আমাদের মাথায় আসে এটি ছিল তার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদাবেহালার ব্রহ্মসমাজ রোডের একটি এক-কামরার ছোট্ট ঘরে ভাড়া থাকতেন স্যারসেখানেই সকাল বিকেল মিলিয়ে বড়োজোর দশ-বারোজন ছেলেমেয়ে পড়তে যেততাই সেই অর্থে পসার যাকে বলে তা স্যারের কোনোদিনই ছিল না
তবে তা নিয়ে স্যারকে কক্ষনো দুখ বা বিলাপ করতে দেখিনিউপরন্তু স্যারের মাইনেও ছিল অন্যান্য কোচিংয়ের তুলনায় অনেক কমজিজ্ঞেস করলে বলতেন, “কী করব বাপ এত পয়সা নিয়ে? তিনকুলে আমার কেউ কোত্থাও নেই, একগাদা টাকা জমিয়ে কি চিতায় নিয়ে যাব!” স্যারের কথা শুনে আমরা হেসে উঠতাম
স্যারের নিজের বলতে একটা মোটর বাইক ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তবে ওই বাইকটা ছিল স্যারের প্রাণ, প্রচণ্ড ভালোবাসতেন তিনি ওটাকে। নাম দিয়েছিলেন পক্ষীরাজ।
রোজ দু-বেলা নিজের হাতে মুছতেন বাইকটাকে, মাসে একবার শ্যাম্পু দিয়ে ধুতেন। এমন যত্নে রাখতেন যে দেখে মনে হত এক্কেবারে ঝাঁ চকচকে নতুন।
প্রায়শই আমাদের গল্প করে বলতেন যে কীভাবে তিল তিল করে টিউশনির টাকা জমিয়ে ইনস্টলমেন্টে তিনি ওই বাইকটি কিনেছিলেন। বাইকটির প্রসঙ্গ উঠলেই স্যারের চোখ দুটো খুশিতে নেচে উঠত।
তিনি মাঝে মধ্যেই একটা কথা বলতেন, আজও সেই কথা আমার মনে লেগে আছে।
বলতেন, “আজ যা তোর কাছে রয়েছে তা হয়তো অন্য একজন পেলে বর্তে যেতআবার যা অন্যের কাছে আছে, তা তুই পাওয়ার জন্য ছটফট করছিস। সবকিছু একজীবনে পাওয়া যায় না রে। আর না পাওয়া গেলেও তাতে অসুবিধে তো কিছু নেই। যেটুকু আছে সেটুকু নিয়েই ভালো থাকতে জানতে হবে, ভালো থাকা শিখতে হবে।
স্যার যে খালি মুখেই বলতেন তা কিন্তু নয়। তাঁর ওই স্বল্প সামর্থ্যের মধ্যেই তিনি তাঁর ছাত্রছাত্রীদের যথেষ্ট সাহায্য করতেন। কারোর কোনো বই কেনা বাকি, তিনি কিনে দিতেন। কারোর ইস্কুল ব্যাগ বা ড্রেস ছিঁড়ে গেছে, কিনতে পারছে না, তিনি ব্যবস্থা করে দিতেন। তাঁর এই দিলদরিয়া স্বভাবের জন্য সকলেই তাঁকে খুব ভালোবাসত, শ্রদ্ধা করত।

যাই হোক, অল্প পড়াশোনায় এবং অনেকখানি খেলাধূলায় সময়টা কেমন যেন তিরের বেগে কেটে যাচ্ছিল। দেখতে দেখতে বছরটা প্রায় শেষ হয়ে এল।
ফাইনাল পরীক্ষার তখন আর মাস দুয়েক বাকি, একদিন পড়তে গিয়ে দেখি স্যারের মাথায় চিন্তার ভাঁজকারণ জিজ্ঞেস করতে বললেন, ফটিকের শরীরটা বড্ড খারাপ রে সঞ্চয়, ভালো ডাক্তার না দেখালে সারবে না
ফটিক আমাদের সঙ্গেই কোচিং-এ পড়ত, মাথা ভালো তবে বাড়ির অবস্থা তেমন সচ্ছল নয়স্যার তাই ওকে ফ্রিতেই পড়াতেন আর সেটা আমাদের ফটিকই বলেছিলতো সেই ফটিক যে বিগত এক সপ্তাহ ধরে পড়তে আসছে না সেটা আমরা সকলেই জানতাম কিন্তু তা নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামাইনিযাই হোক, স্যারের থেকে শুনলাম ওর চিকিৎসার জন্য বেশ কিছু টাকার দরকার কিছুক্ষণ ইতস্ততভাবে পায়চারি করার পর আবার পড়ানোয় মনোযোগ দিলেন স্যার
সেদিন পড়া শেষ করেই স্যারের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে আমরা ছুটেছিলাম ফটিকের বাড়ি। সেখানে গিয়ে ওর করুণ অবস্থা দেখে আমার চোখদুটি ছলছল করে উঠল।
ওদের ছোট্ট এক কামরার ঝুপড়ি ঘরের এককোণে একটি তক্তপোশের উপর চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে ফটিক। ওর মা মাথার কাছে বসে জলের বাটি থেকে বারবার ওর কপালে জলপট্টি দিচ্ছেন। ঘরের আরেক কোণে একটি স্টোভের উপর গরম ভাত ফুটছে।
আমরা ঘরে ঢুকতেই ওর মা তাকালেন আমাদের দিকে। ওই ক্লান্ত দু-চোখে যে তিনি কতখানি কান্না ধরে রেখেছেন তার কোনো হিসেব পাওয়া গেল না।
ফটিকের মায়ের কাছ থেকেই আমরা জানলাম যে ফটিকের ডেঙ্গু হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে একবার চিকিৎসা করানো হয়েছিল, কিন্তু সাময়িক সুস্থতার পর নাকি জ্বর আবার ফিরে এসেছে। এখন ভালো ডাক্তার বদ্যি না করলে ওর সেরে ওঠা খুব মুশকিল।
আমরা আর দাঁড়ালাম না, কিংবা বলা যায় দাঁড়াতে পারলাম না। নিরুপায় হয়ে এক প্রকার পালিয়েই এসেছিলাম সেখান থেকে।
এরপর বেশ কয়েকদিন ফটিককে নিয়ে কোনো কথা হল না, স্যারও কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না।
দিন দশেক পর ফটিক ফিরল সুস্থ হয়ে ওকে দেখে আমরা সকলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলাম। সবাই মিলে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ওকে।
আমাদের কাণ্ড দেখে স্যার বললেন, “ওর শরীর এখনও যথেষ্ট দুর্বল, ওকে তোরা শান্তিতে বসতে দে।সত্যিই, মাত্র কয়েকদিনের অসু্খেই ছেলেটার শরীর ভেঙে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছিল।
যাই হোক, ফটিক কোচিং-এ ঢুকেই স্যারকে ফট করে একটা প্রণাম করল। তারপর চুপচাপ এসে বসল আমাদের পাশে। পড়ার মাঝেই ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন আছিস এখন?”
ফটিক বলল, “ভালো। তবে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছিল রে, স্যার টাকা দিয়ে সাহায্য না করলে এ জন্মে আর বেঁচে ফেরা হত না।
কথাটা শুনে আমরা অবাক হয়ে গেলাম। ফটিকের মুখেই শুনলাম যে ওর চিকিৎসায় নাকি বেশ অনেক টাকাই খরচ হয়েছে। কিন্তু স্যারের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে আমরা সকলেই অবগত ছিলাম, তাই এতগুলি টাকা তিনি কোত্থেকে জোগাড় করলেন তা আমরা কেউই বুঝে উঠতে পারলাম না।

এরপর চলে এল সরস্বতী পুজোর দিন। স্যার প্রত্যেকবার ছোটো করে পুজো করতেন ওঁর বাড়িতে। সেবারেও তার ব্যতিক্রম হল না। আমরা সকলে হই হই করে রঙবেরঙের পাঞ্জাবি পরে স্যারের বাড়িতে গেলাম। ভক্তিভরে মায়ের পায়ে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে, মায়ের কাছ থেকে পরীক্ষার পাস নম্বরটুকু চেয়ে নিলাম।
তারপর খানিক ফল-প্রসাদ খেয়ে, স্যারকে বিদায় জানিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সেখান থেকে। সবাই মিলে ঠিক করলাম যে এইবার দল বেঁধে ইস্কুলে যাবভাবনা মতোই বাজারের মোড়ে অটো স্ট্যান্ডে পৌঁছোতেই একটা মারাত্মক ধাক্কা খেলাম আমরা।
অবাক চোখে দেখলাম যে পাড়ার সুদখোর মহাজন বিলাস সরকারের বড়ো ছেলে রমেন, হলুদ পাঞ্জাবি উড়িয়ে, স্যারের পক্ষীরাজে চড়ে, বাজারের মোড়ে নিদারুণ কেত মারছে। সেই দৃশ্য দেখে সবটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল আমাদের কাছে।
তাহলে ফটিকের প্রাণ বাঁচাতে নিজের সাধের পক্ষীরাজ বলি দিয়েছেন স্যার! মানুষ এমনটাও পারে!
সেদিন, সেই মুহূর্তে অপার শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে গেছিল আমার। বুঝেছিলাম যে স্যার মোটেই গরিব লোক নন, বরং তার মতো ধনী লোক গোটা এলাকায় আর কেউ ছিল না।
----------
 ছবি - সুজাতা চ্যাটার্জী

1 comment:

  1. খুব সুন্দর লাগলো। নিজেও বেহালায় থাকি কাজেই গল্পের প্রেক্ষাপট জেনে আরো ভালো লাগলো।

    ReplyDelete