গল্প:: গুবলু - উর্বী রায়


গুবলু
উর্বী রায়

আমার আমলকীর কৌটোটা আবার হাওয়া হয়ে গেছে…!! কোথায়? কোথায় সে মক্কেল ডাকো তাকে আজ নিয়ে তিনবার হাওয়া হল!”

মোবাইল স্ক্রিনে চোখ বোলাচ্ছিল পিহা, তখনই ঠামের গলার আওয়াজ কানে এল
এই রে! গুবলুই নিশ্চয় আমলকীর কৌটো সরিয়েছে নতুন কিনে আনা আমলকীর কৌটোটা সবে ভেঙেছিল ঠাম কাল রাতে টা টাবলে তাহলে ঠামের কৌটোটা নিয়েই পালিয়েছে ও! কী যে করে পিহা এখন! ঠাম তো আর গুবলুর কথা জানবে নাবকুনিটা পিহাকেই খেতে হবে

এই হয়েছে এক জ্বালা এমনিতে তো পিহা একাজ-সেকাজের জন্য সারাক্ষণ বকা খেতেই থাকে, তার উপর গুবলুর বকুনিটাও এখন যোগ হয়েছে
পরশুদিন, ব্যাঙ্গামামা মাইসোর পাক নিয়ে এল দু-বাক্স মা বাক্স ধরে ফ্রিজে রেখে দিয়েছিল পিহা ভেবেছিল নতুন খাবার দেখে গুবলু হয়তো ধরবে না ও বাবা! পরদিন মাম্মাম সবাইকে ভাগ করে দেওয়ার সময় প্যাকেট খুলে দেখে একটা বাক্স-র অর্ধেক খালি ব্যস, সবার রক্তচক্ষু পিহা-র উপর পিহা কী করে বোঝাবে এটা ওর কাজ নয়!!

এমনি বিনা দোষে আরও কত কী যে ঘটে চলে পিহা-র জীবনে, তা ঈশ্বরই জানেন শুধু আর জানে গুবলু
বছরখানেক আগেও গুবলু ছিল না ওর জীবনে গতবছরবিশ্বকর্মা পুজোর রাত এখান-ওখানে কয়েকটা নেমন্তন্নের পাশাপাশি অনেকে বাড়িতে এসেও প্রসাদ, খাবারের প্যাকেট দিয়ে যায় পিহাদের সব খাওয়া হয়ে ওঠে না, তাই ফ্রিজ ভরতি খাবার থেকে যায় সে-রাতেও ছিল পিহা রাত জেগে পরদিনের ক্লাস টেস্টের পড়া করছিল আর ফ্রিজের খাবারগুলোর কথা ভাবছিল - কখন যে সকাল হবে, পরীক্ষাটা দিতে যাবে আর ফিরে এসেই বিরিয়ানিটা খাবে হঠাৎই কানের কাছে কে যেন বলে উঠল, “বিরিয়ানিটা আমি খেয়ে নিয়েছি, লুচি-মাংস, ক্ষীরকদম আর রাবড়ি পুরো শেষ বাকি আছে ফ্রাইড-রাইস চিলি চিকেনের প্যাকেটটাপেটটা আইঢাই করছে বলে ওটা আর খাচ্ছি না আচ্ছা চলি…”
পিহা চমকে উঠলকী সব শুনল ও? ভুল শুনল নিশ্চয়ই ঢুলছিল নাকি? তাই-ই হবে

পরদিন সকালে হুলুস্থুল কাণ্ড! ঠাম-মাম্মাম দুজন মিলে খেয়াল-টপ্পা চালাচ্ছে ঠাম প্রমাণ করার চেষ্টা করছে মাম্মাম নাকি খাবারগুলো রাতে ফ্রিজে ঢোকাতে ভুলে গেছেতাই বিড়াল সব খেয়ে নিয়েছে এদিকে মাম্মাম বোঝানোর চেষ্টা করছে, বিড়াল বিরিয়ানি খায় নালুচিও নাআর ঘরও মুছতে পারে না, যেখানে খায়, এঁটো পড়ে থাকে একটু হলেও সে সব ঠাম শুনছে না
পরীক্ষার তাড়া থাকায় পিহা বেরিয়ে গেছিল, তাই আর এন্ড রেজাল্ট জানা হয়নি তবে আগের রাতে যে ও ভুল শোনেনি, সেটা নিশ্চিত হওয়া গেছিল

পরেরদিন রাতে ইচ্ছে করেই পিহা জেগেছিল, গতরাতের মতো কিছু হয় কিনা দেখবে কিন্তু কিছুই হল না সে-রাতে এরপর সপ্তাহখানেক কেটে গেছে পিহা ভুলেই গেছিল ব্যাপারটাসেদিন পুজোর কেনাকাটা করে ফেরার পথে মাম্মাম-বাবাই রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিয়ে এসেছিল সবার জন্য রাতে খাওয়ার পর মাম্মাম একটা রুমালি রুটি আর চিকেন কষা রেখে দিয়েছিল পিহাকে পরদিনের টিফিনে দেবে যদিও ও খুব বায়না করেছিল ওইটুকু তখনই খাবে বলে, ওর বায়নাকে পাত্তা দেওয়া হয়নি রাতে গভীর ঘুমের কারণে পিহা আর কিছু টের পায়নি পরদিন সকালে আবার সেই কাণ্ড! খাবার নেই! এবার সন্দেহের তির পিহার দিকে পিহাকে রাতে খাবার সময় ওটা খেতে দেওয়া হয়নি বলে নির্ঘাত মাঝরাতে উঠে চুপি চুপি খেয়ে নিয়েছে! কী মুশকিল! পিহা কে খেল, কখন খেল - এর বিন্দুবিসর্গও জানে না, অথচ ওকে বকুনি দিচ্ছে সবাই
নাহ্‌! চোরটাকে না ধরলেই নয়! পিহা আন্দাজ করেছে, ভালোমন্দ খাবার হলেই চোর আসছে ডাল-ভাত-সবজি রাখা থাকলে আসেনি
খানিক ভাবনা-চিন্তার পর চোরকে ধরার একটা প্ল্যান মাথায় এসেছে ওর

এরপর যেদিন মাম্মাম মাটন বিরিয়ানি করল, সেদিন পিহা চুপি চুপি এক বাটি তুলে রেখেছিল মাম্মামের চোখ বাঁচিয়ে তারপর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ও সেটাতে খুব করে লঙ্কাগুঁড়ো মিশিয়ে ফ্রিজে রেখে ঘাপটি মেরে শুয়ে রইল রাত দেড়টা হবে হয়তোএমন সময় পিহার কানে কানে আবার – “বিরিয়ানি আছে বুঝি? খেতে গেলাম, খুব খিদে পেয়েছেশুনেই পিহা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ফ্রিজের কাছে এল দেখল ফ্রিজের দরজা নিজে থেকেই খুলে গেল, বিরিয়ানির বাটিটাও একা একাই বেরিয়ে এল আর একটু পরেই পিহার কানের কাছে চিঁ চিঁ করে সে কী চিৎকার… “উঃ আহঃ... মাগো.... জ্বলে যাচ্ছে….পিহা এগিয়ে এল, বলল, “কে তুমি? আমাদের খাবার চুরি করে খাও কেন? আর তোমাকে দেখা যাচ্ছে না কেন? তুমি ইনভিসিবল না কি?”
আগে একটু জল দাও, তারপর বলছি
পিহা জলের বোতল এগিয়ে দিল নিমেষে বোতলটা পুরো ফাঁকা
জল খেলে এবার বলো
কী নিষ্ঠুর গো তুমি এই পুঁচকে ভূতের সাথে এরকম কেউ করে?”
তুমি ভূত?”
না তো কী? মানুষ হলে দেখতে পেতে না?”
তুমি ঘাড় মটকাও না?”
ওসব তোমাদের গপ্পে হয় আমরা মানুষের ক্ষতি করব কেন? আমরা নিজেরাও তো মানুষ! শুধু পাস্ট টেন্সে
ও বাবা, ইংলিশও জানো দেখছি
পড়েছিলাম তো ক্লাস ফোর অবধি সেগুলো মনে আছে এখনও
তাহলে পড়ার চাপে বুঝি হঠাৎ ভূত হয়ে গেলে! এই জন্য আমিও পড়তে চাই না কে জানে বাবা! কবে ভূত হয়ে যাব!”
পড়তে পড়তে কেউ ভূত হয় নাকি?”
তাহলে? আমি ভূত হব না তো?”
আরে, তুমি খামোকা ভূত হতে যাবে কেন? তোমার কি বাসে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে নাকি?”
সে কী! তোমার হয়েছিল?”
হ্যাঁ তো মামার বাড়ি থেকে ফেরার পথে আমাদের বাস আর পাশের বাসটা কী রেষারেষি! হঠাৎ একসময় পাশের বাসটা আমাদেরটাকে উলটে দিল আমি ছোটো তো, ছিটকে পড়ে গেলাম, মাথায় লাগল, ওখানেই ভূত হয়ে উড়ে গেলাম
ইশ্‌! কী কষ্ট তোমার মা-বাবা?”
বাড়িতেই আছে আর বোলো না আমি ভূত হওয়ার পর খাওয়া-দাওয়া ছেড়েই দিয়েছে একটু ডাল-ভাত খায় কি খায় না! আমি ওসব খেতে পারি বলো! তাই তো অন্য জায়গায় খাবারে খোঁজে যাই
আমাদের বাড়ির খোঁজ পেলে কী করে শুনি
সে অনেক গল্প, আরেক রাতে বলব না হয় খেতে তো দিলে না, তারপর যা ঝাল খাওয়ালে আমাকে, দু-দিন মাথা ঘুরবে আমি যাই এখন
সরি ভূত, তোমাকে ধরব বলেই তো... না হলে কেউ ইচ্ছে করে ঝাল মেশায়!”
ভূত আবার কী? আমি কি তোমাকে মানুষ বলে ডাকছি?”
তাহলে কী বলব?”
গুবলু, আমার নাম গুবলু
বেশ গুবলু তুমি আরেকদিন এসো, ভালো ভালো জিনিস খাওয়াব
সে তোমাকে ডাকতে হবে না, আমি নিজেই চলে আসব আজ আসি টা টা
বাই বাই

সেই থেকে গুবলুর সঙ্গে পিহার ভাব হয়ে গেছেআগে মাঝেমধ্যে আসত এখন তো রোজ রাতেই আসে ওর মতো মহাপেটুক পিহা কাউকে দেখেনি ভালোমন্দ রান্না খাবার তো আছেই, চকোলেট, আইসক্রিম, পেস্ট্রিও রাখার জো নেই দেখতে পেলেই খেয়ে নেবে রোজ ভালো খাবার থাকে না তবে পিহার সঙ্গে দেখা করতে ও রোজই আসে একদিন ঠামের নস্যির কৌটো থেকে চকোলেট ভেবে নস্যি খেয়ে নিয়েছিল, তারপর দু-দিন পাত্তা নেই তিনদিনের দিন এসে বলল, আমাশা হয়েছিল
পিহা ভেবে পায়নি, ভূতের আবার আমাশা কী করে হতে পারে!
আজকাল পিহার সঙ্গে গল্পও করে অনেকসারারাত কোথায় কোথায় যায়, কী কী খায়, কাদের সঙ্গে দেখা হয়, সব বলে পিহাকে টুকটাক হোমওয়ার্কেও সাহায্য করে গুবলু না থাকলে পিহার ফাঁকা ফাঁকা লাগে

কাল ষষ্ঠী কাল বাবাই-মাম্মাম একটা অর্ফানেজের বাচ্চাদের খাওয়াবে ঠিক করেছে সবই ঠিক আছে যারা খাবারের অর্ডার নিয়েছে, তারা বলেছে রান্না খাবার সরাসরি ওখানে পৌঁছে দেবে, শুধু বাচ্চাদের আইসক্রিমের প্যাকেটগুলো একটু আগেরদিন পিহাদের ফ্রিজে এনে রাখতে হবে একথা শুনেই পিহার মাথায় হাত আইসক্রিম রাখলে তো সেগুলো গুবলুর হাত থেকে বাঁচানো যাবে না! বেচারা গুবলু বিরিয়ানি আর আইসক্রিম ভীষণ ভালো খায় পেলে ছাড়বেই না কী করবে পিহা?

এর মধ্যে আবার এই আমলকী কেলেঙ্কারি
কাল রাতে গুবলু কোথা থেকে নাকি চিংড়ির মালাইকারি খেয়ে এসেছিল এসে বলল, অ্যাসিড হয়ে মুখে স্বাদ পাচ্ছে না পিহা কী কুক্ষণে তখন বলে ফেলেছিল, এরকম হলে মা আমলকী দেয় পিহাকে শুনেই গুবলু টা টাবলে হাওয়া পিহা আর মাথা ঘামায়নি, ঘুমিয়ে পড়েছিল সকালে ঠামের এই চিৎকার
আজকে তাও তো ঠামের আমলকীর উপর দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কালকে কী হবে!
বড্ড চিন্তা হচ্ছে গুবলুকে বোঝানো যায় কিন্তু ব্যাপারটা যে আইসক্রিমের! রাতে এসে ফ্রিজ ভরতি আইসক্রিম পেয়ে গুবলু তো সব সাফ করে রেখে দেবে কী করবে পিহা এখন! বাবাই-মাম্মাও তো বিপদে পড়বে কাল সকালে এতগুলো আইসক্রিম জোগাড় হবে কী করে? বাচ্চাগুলো কি আইসক্রিম খাবে না?
পিহা বুঝতে পারছে না কী করা উচিত গুবলুর কথা বাড়িতে বলে দেবে? কিন্তু কেউ তো বিশ্বাসই করবে না!
রাতে চিন্তায় অস্থির হয়ে রইল পিহা আর বেশি চিন্তায় আবার ওর ঘুম পেয়ে যায় পরীক্ষার আগের রাতের মতো তাই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে টের পায়নি

যাক, খুব সুন্দরভাবে মিটেছে সব ছোটো ছোটো বাচ্চাগুলো কী খুশি পুজো শুরুর দিনই এমন খাবারের আয়োজন দেখে!
নাহ্‌, আইসক্রিম নিয়ে কোনো অসুবিধা হয়নি গুবলু একটা আইসক্রিমও ছুঁয়ে দেখেনি

রাত্রিবেলা বসে বসে ওর অপেক্ষা করছিল পিহা ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না কী হল!
আমাকে হ্যাংলা ভাবো নাকি! বাচ্চাগুলোর জন্য রাখা আইসক্রিম আমি কেন খাব?”
এই তো, এসেছেন গুবলুবাবু
পিহা বলল, “হ্যাংলা না তো কী? আমাদের খাবারগুলো তো সব চেটেপুটে খেয়ে নাও
সে তোমাদেরটা খাওয়া যায় তোমরা তো চাইলেই কিনে খেতে পারবে ওরা তো তা পারবে না!”
পিহা অবাক হয়ে গেল! ভূত হয়েও এসব ভাবে গুবলু! বাচ্চাগুলোর জন্য এত দয়া!
কী ভাবছ? অতগুলো আইসক্রিম দেখে আমার কিন্তু খুব লোভ লেগেছে কালকে আমার জন্য একটা আইসক্রিম কিনে রেখে দেবে বলে দিলাম
পিহা হাসল গুবলুর মতো মানুষগুলোও যদি এভাবে ভাবত…!
----------
ছবি - সুজাতা চ্যাটার্জী

No comments:

Post a Comment