গল্প:: সেই আশ্চর্য পাখিটা - প্রদীপ কুমার দাস


সেই আশ্চর্য পাখিটা
প্রদীপ কুমার দাস

বিস্তর চিন্তাভাবনা করে প্ল্যানটা ঠিক করেছিল বুবাই। অবশ্য ওর সঙ্গে প্রাণের বন্ধু রাজাও ছিল সর্বক্ষণ। বাঁশের কঞ্চি কেটে আনাড়ি হাতে তৈরি করেছিল একটা খাঁচা। চৌকো বাক্সর মতো, চারপাশে কঞ্চির খোঁচা বেরিয়ে আছে। দেখতে মোটেও ভালো নয়। অবশ্য ওরা এর চেয়ে ভালো বানাবেই বা কী করে? দুজনেই তো খুব ছোটো, রামকৃষ্ণ আদর্শ বিদ্যাপীঠের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র।
কিছুদিন আগে তাদের স্কুলের শিক্ষক রামরতনবাবুর কাছে ওরা এই পাখিটার কথা শুনেছিল। রামরতনবাবুর অগাধ জ্ঞান। ছাত্র পড়াতে পড়াতে অনেক মজার মজার গল্প বলেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের কত খবর দেন। তা তিনি সেদিন পড়াতে পড়াতে এই গাইয়ে পাখিটার কথা বলেছিলেন। পাখিটা দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি সুরেলা তার ডাক। কী একটা গালভরা নামও বলেছিলেন। অতশত মনে নেই বুবাইয়ের। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বুবাই দেখতে পেল তার পড়ার টেবিলের পাশের জানালাটায় বসে আছে একটা অদ্ভুত সুন্দর পাখি। ছোটো একটা চড়ুই পাখির সাইজ। গায়ে লাল হলুদ কমলার ছিটে। গলার কাছটা নীল। তাদের বাড়ির বাগানে ফিঙে টুনটুনি বুলবুলি অনেক রকম পাখি আসে। কিন্তু এই পাখি সে আগে কখনও দেখেনি। পাখিটাকে দেখেই বুবাইয়ের কেন জানি মনে হল এটাই রামরতনবাবুর বলা সেই পাখিটা। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই পাখিটা ডেকে উঠল। যেন কোনো রাখাল ছেলের হাতে ধরা বাঁশির মিষ্টি সুর। বুবাইয়ের মনে আর কোনো সন্দেহ রইল না। এটাই সেই পাখি! প্রথমে তার খুব আনন্দ হল এই ভেবে যে তাদের ক্লাসে সেই প্রথম পাখিটাকে দেখল। এখন স্কুলে গিয়ে সবার সামনে জাঁকিয়ে গল্প করতে পারবে। কিন্তু পরমুহূর্তে মনে হল যদি বন্ধুরা তার কথা বিশ্বাস না করে? যদি প্রমাণ চায়? বিশেষত অর্ণবকে বিশ্বাস নেই। অর্ণব নিজে বড়ো বড়ো কথা বলে। কিন্তু অন্যরা কিছু বলতে গেলে সে পাত্তাই দেয় না। বুবাই যদি এই পাখিটার গল্প করে সে হয়তো হেসেই উড়িয়ে দেবে। সবচেয়ে ভালো হয় রাজাকে পাখিটা দেখাতে পারলে। তাহলে কেউ আর অবিশ্বাস করতে পারবে না।
সেদিন স্কুলে গিয়েই সে রাজাকে পাখিটার কথা বলেছিল। রাজা শুনে প্রথমে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু তারপর একদিন দুপুরে বুবাইদের বাড়ির ছাদে রাজাও পাখিটাকে দেখতে পেল। রাজারও মনে হয়েছিল এটাই সেই পাখি। তখন দুজনে মিলে এই প্ল্যানটা বানিয়েছিল। বাঁশের কঞ্চি জোগাড় করে আনাড়ি হাতে তারা তৈরি করেছিল খাঁচাটা। আজকে তার প্রথম ব্যবহার।
পাখি কীভাবে ধরতে হয় সেটা জানা না থাকলেও তাদের প্ল্যানটা ভালোই। খাঁচার ভিতরে ছড়ানো থাকবে পাখিদের প্রিয় চাল-গমের দানা। খাঁচার দরজা খোলা থাকবে। একটা লম্বা সরু সুতো সেই দরজায় বাঁধা থাকবে। সুতোর অপর প্রান্ত থাকবে দূরে আড়ালে বসে থাকা দুই বন্ধুর হাতে। পাখি দানা খেতে খাঁচায় ঢুকলেই হ্যাঁচকা টানে দরজা বন্ধ করে দিতে হবে।
খাঁচায় সেদিন পাখিটা নাও ঢুকতে পারত অথবা অন্য কোনো পাখিও ঢুকতে পারত। কিন্তু কী আশ্চর্য! বুবাইরা খাঁচাটা রাখার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ছাদের কার্নিশ থেকে পাখিটা নেমে এল। আর অদ্ভুত শান্তভাবে ধীরে ধীরে এসে ঢুকল খাঁচার ভিতরে। রাজাকে দড়ি টানতেও হল না। তার আগেই বুবাই দৌড়ে গিয়ে বন্ধ করে দিল খাঁচার দরজাটা।
সে কী উল্লাস দুজনের! প্রথমে তারা বিশ্বাসই করতে পারছিল না এত সহজে পাখিটাকে ধরা গেছে। দুজনে আনন্দে ধেই ধেই নাচ শুরু করল। ঠিক সেই সময়ে মা ছাদে উঠে এলেন। ধমকের সুরে বললেন, বুবাই, রাজা - এই ভরদুপুরে ছাদে কী করছ তোমরা?
মায়ের প্রশ্নটা বুবাইয়ের কানেও গেল না। উত্তেজনায় হাঁপাতে হাঁপাতে খাঁচাটা তুলে ধরে বলল, মা দেখো আমরা কী ধরেছি!
পাখিটাকে দেখে মাও রাগ ভুলে গেলেন। অবাক হয়ে বললেন, এটা কী পাখি রে? কী সুন্দর দেখতে! তোরা নিজেরা ধরলি?
হ্যাঁ মা, আমি আর রাজা দুজনে মিলে ধরেছি। পাখিটার নাম জানি না। কিন্তু পাখিটা যখন ডাকবে দেখবে কী সুন্দর ওর গান।
তাই নাকি! মা দুজনের মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিলেন, দারুণ ব্যাপার তো! কিন্তু এখন নীচে চল। পাখিটাকে জল-টল খেতে দে।
কিন্তু বুবাই আর রাজার ইচ্ছে পূর্ণ হল না। ওরা এত কষ্ট করে পাখিটাকে ধরল, কত যত্নআত্তি করল কিন্তু পাখিটা আর ডাকে না। বুবাই করুণ স্বরে জিজ্ঞেস করল, তোর কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে বল? আমরা সব ব্যবস্থা করব। ওর চোখদুটো ছলছল করে উঠলতারপর কী মনে করে বলল, বুঝেছি, তুই এই পচা খাঁচাটায় থাকতে চাস না, তাই না? ঠিক আছে কালকেই আমি বাবাকে বলব তোর জন্য একটা দোলনা লাগানো খাঁচা আনতে।
নতুন খাঁচা এল। কিন্তু পাখিটার বন্ধ মুখ খুলল না। ডাকা তো দূরের কথা, পাখিটা ভালো করে দানাপানিও খেল না। বুবাই আর রাজা দুজনেরই তাই মন খারাপ।
সেদিন স্কুলে স্যারের ক্লাস নেওয়ার সময় বুবাই বার বার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। রামরতনবাবু তা লক্ষ করলেন। বকাঝকা করা তাঁর অভ্যাস নয়। তিনি বুবাইকে বললেন, কী ব্যাপার রাজর্ষি, পড়ায় মন দিচ্ছ না কেন? শরীর খারাপ নাকি?
বুবাই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, না স্যার।
তাহলে?
স্যারের গলায় এমন একটা অভয় ছিল যাতে বুবাই চুপ করে থাকতে পারল না। ধরা গলায় সে পাখিটার কথা বলল। তারপর বলল, আমরা পাখিটার এত যত্ন নিচ্ছি অথচ ও আর ডাকে না কেন স্যার?
রামরতনবাবু ব্যাপারটা মোটেই হালকাভাবে নিলেন না। বললেন, ভাববার কথাই বটে। ঠিক আছে, আজ স্কুল ছুটির পর আমি তোমার বাড়ি গিয়ে পাখিটাকে দেখব। এখন বোসো।
স্কুল ছুটির পর বুবাই আর রাজা স্যারকে বাড়িতে নিয়ে এল। খাঁচার দোলনায় ঘাড়ে মুখ গুঁজে পাখিটা বসে। চোখদুটো বোজা। দাঁড়ের উপরে দুটো ছোটো বাটিতে ভেজানো ছোলা আর জল রাখা আছে। বুবাই কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, দেখুন স্যার। সকালে স্কুল যাওয়ার আগে এগুলো দিয়ে গেছি। কিন্তু পাখিটা কিছুই খায়নি।
রামরতনবাবু খাঁচা আর পাখিটা খুঁটিয়ে দেখলেন। তারপর বললেন, চলো তো খাঁচাটা নিয়ে একবার ছাদে যাই।
ছাদে এসে রামরতনবাবু একটা অদ্ভুত কাজ করলেন। খাঁচার দরজাটা খুলে দিয়ে পাখিটাকে হুস হুস করে তাড়া দিলেন। তাড়া খেয়ে পাখিটা প্রথমে খাঁচার দরজার কাছে এগিয়ে গেল। তারপর ছোট্ট ডানা দুটো মেলে উড়ে গিয়ে বসল ছাদের কার্নিশে। একবার মাথা ঘুরিয়ে বোধহয় বুবাইদের দেখল। তারপর একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে পাশের বড়ো পেয়ারা গাছটার ডালে গিয়ে বসল।
বুবাই আর্তনাদ করে উঠল, এ কী করলেন স্যার! পাখিটাকে ছেড়ে দিলেন!
রামরতনবাবু বললেন, হ্যাঁ। খাঁচাটা পাখির ঘর নয়। ওর ঘর ওই বাগানে গাছের উপরে। তোমাকে কেউ যদি ধরে নিয়ে গিয়ে একটা ঘরে বন্দি করে রাখে এবং মন্ডামিঠাই খেতে দেয় তুমি কি সেসব খেতে পারবে? পাখিটাও তাই তোমার দেওয়া ছোলা-জল খায়নি। আসলে মানুষের মতোই সমস্ত জীবজন্তু স্বাধীন থাকতে চায়। কিন্তু আমরা মানুষরা তাদের ধরে ধরে খাঁচায় পুরে রাখি। আমরা যতই তাদের যত্নআত্তি করি না কেন তারা কখনোই তাতে খুশি হয় না যতটা হয় উন্মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে থাকলে। বুঝেছ?
বুবাই আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই হঠাৎ কানে ভেসে এল একটা অদ্ভুত সুরেলা মিঠে সুর। বুবাই অবাক হয়ে দেখল পাখিটা আবার ডাকছে। আর সেই ডাক ছড়িয়ে পড়ছে বাগানের গাছপালা, বাড়ির ছাদ থেকে দূরের প্রান্তরে প্রান্তরে।
----------
ছবি – লাবণি চ্যাটার্জি

No comments:

Post a Comment