গল্প:: খয়েরওয়াড়ার ডুয়েল - অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়


খয়েরওয়াড়ার ডুয়েল
অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

প্লেনে যেতে যেতে এই প্রথম বৃষ্টি দেখল অনির্বাণ কলকাতা থেকে ওড়বার সময়ও আকাশ ছিল ঝকঝকে পরিষ্কার কিন্তু অল্প কিছু সময় যেতে না যেতেই আকাশ ভেঙে নামল বৃষ্টি কাচের জানালা দিয়ে সে বাইরেটায় তাকিয়েছিল হু হু হাওয়াতে প্লেন উড়ে চলেছে, আর শন শন করে বৃষ্টির রেখাগুলো কাচ বেয়ে উলটোদিকে ছুট লাগিয়েছে মাধ্যাকর্ষণের বালাই নেই কাচের জানালাতে বৃষ্টির ফোঁটারা সব যেন বা স্বচ্ছ, স্ফটিকেরই মতো হালকা পেনসিলে একেকটা করে আলপনা এঁকে দিয়ে যাচ্ছিল অনির্বাণের বুকুনের জন্য একটু একটু মনখারাপ করছিল বেচারা এলে পরে কত খুশি হত কিন্তু এখন বুকুনের পরীক্ষা কাজেই বুকুন আর বুকুনের মাকে কলকাতায় রেখে আসতে হয়েছে কলকাতার নামজাদা কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক অনির্বাণ এবারে তাই একলাটিই চলেছে নাগপুরের উদ্দেশে সেখানেমধ্যযুগ থেকে আধুনিক ভারতের ইতিহাস তৎসম্পর্কিত কিছু অজানা ঐতিহাসিক ঘটনাশীর্ষক একটি কনফারেন্সে তার একটি গবেষণাপত্র পাঠের কথা রয়েছে কনফারেন্স বা সম্মেলনের আহ্বায়ক সদাশিব চৌধুরী দীর্ঘদিন মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা কিন্তু দিল্লির জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম ফিল করার সময়েই অনির্বাণের সঙ্গে তার পরিচয় এর আগে অনেকবার করেই সে অনির্বাণকে বলেছে তাদের এই কনফারেন্সটায় আসার জন্য কিন্তু একবার পোল্যান্ড, আরেকবার দিল্লিতে জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ার কারণে অনির্বাণ কোনোবারেই এসে উঠতে পারেনি এবারে তাই সদাশিব রীতিমতো হুমকি দিয়ে তাকে চিঠি লিখেছিল বন্ধুবিচ্ছেদের হুমকিটা এই বয়সে এসেও ভালোই কাজ করেছে কলেজ থেকে সপ্তাহখানেকের ছুটি পেতেও অনির্বাণের সমস্যা হয়নি শুক্র-শনি-রবি তিনদিনের কনফারেন্স, তারপর সদাশিব নাকি নাগপুর থেকে কাছেই কোনো একটা জায়গাতে ঘুরতে নিয়ে যাবে তাকে জায়গাটার নাম সে বলেনি শুধু বলেছে, “দিন কয়েকের ছুটি ভোগের জন্য আদর্শ সঙ্গে থাকবে পুরোনো ইতিহাসের চমকএর বেশি আর কিছু সে ভাঙতে চায়নি অনির্বাণও রাজি হয়ে গেছে নতুন জায়গাতে বেড়াতে যেতে পারলে কেই বা আর সেই সুযোগকে ছাড়তে চায়? তার উপরে আবার যদি বা তারই সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অজানা নতুন কোনো ইতিহাসেরই খবর... প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরে বৃষ্টি দেখতে দেখতে এই সবকিছুই ভাবছিল অনির্বাণ প্লেন এখন মেঘের উপরে উঠে গিয়েছে, আর সে বৃষ্টি দেখতে পাচ্ছে না
এয়ারপোর্টেই সদাশিব অনির্বাণের জন্য অপেক্ষা করছিল বন্ধুকে দেখতে পেয়েই সহাস্যে তাকে জড়িয়ে ধরল সেএকটুও পালটাসনি তুই,” অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে সদাশিব, “চল গাড়িতে ওঠ যে হোটেলে কনফারেন্স, সেখানেই তোর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে; আর এদিকে আরেকজন ব্যক্তিও আমাদের সফরসঙ্গী হতে চলেছেন আশা করি তোর আপত্তি থাকবে নাগাড়ির ডিকিতে সুটকেসটা তুলতে তুলতে অনির্বাণ জবাব দেয়, “বাপ রে! তুই যে নামতে না নামতেই মেল ট্রেন ছুটিয়ে দিলি আপত্তি কেন থাকবে? বরং নতুন লোকের সঙ্গে আলাপ করতে আমার বেশ ভালোই লাগবে কি নাম তাঁর শুনি?” অনির্বাণ জিজ্ঞেস করেএডওয়ার্ড গ্রাহাম, ওরফে গ্রাহাম এডওয়ার্ডস, ভদ্রলোক নিজেই রসিকতা করে তাঁর নামটিকে এভাবে উলটিয়ে-পালটিয়ে বলেন রসিক মানুষ, আর তারই সঙ্গে ইতিহাসের আজব সমস্ত জিনিসের সংগ্রাহক সেই সূত্রেই এই কনফারেন্সের মাধ্যমে ওঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ সম্মেলনে উনি একটা ছোটো প্রেজেন্টেশনও দেবেন, ওনার আশ্চর্য সংগ্রহের বিশেষ কিছু জিনিসের উপর তারপর নিজে থেকেই খোঁজখবর নিচ্ছিলেন আশেপাশের কোনো ছোটোখাটো জায়গায় ঘুরতে যাওয়া যায় কিনা সেই বিষয়ে দেখলাম এদেশের ভূগোল সম্পর্কেও কিঞ্চিৎ জ্ঞানগম্যি রয়েছে কাজেই তাঁকেও আমরা আমাদের দলে ভিড়িয়ে ফেললাম, ঠিক কাজ করিনি?” সদাশিব দম নিতে থামে অনির্বাণ মাথা নেড়ে হাসে আবারআমার কোনো আপত্তিই নেই এই বিষয়ে,” দুই বন্ধুতে গাড়িতে উঠে বসে বাইরে নাগপুরের ঝকঝকে রোদ; চকচকে রাস্তা বেয়ে গাড়ি চলতে শুরু করে

*                   *                   *

পরদিন থেকেই শুরু হয়ে গেল কনফারেন্স প্রথম দিন সকালেই মূল অনুষ্ঠানের দ্বিতীয়ার্ধে অনির্বাণের বক্তৃতার ব্যবস্থা ছিল তাই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যেতেই তাকে সরাসরি মঞ্চে ডেকে নেওয়া হল অনির্বাণ বলতে শুরু করল
ডুয়েল, অর্থে দ্বন্দ্বযুদ্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাসে সেই মহাভারতের সময়কাল থেকেই এটি প্রচলিত ভীমের বিপরীতে দুর্যোধন, অথবা পরবর্তীতে বিজয়নগর অন্যান্য একাধিক নগরসাম্রাজ্যের ইতিহাসেও আমরা একাধিক সময়ে এমন দ্বন্দ্বযুদ্ধের উল্লেখ পেয়ে থাকি পোর্তুগিজ পর্যটক বারবোসা অথবা লোপেজ দ্য কাস্তানেদা প্রমুখের রচনা থেকে আমরা বিশেষ করে এই বিজয়নগর সাম্রাজ্যেরই একাধিক ডুয়েল-সম্পর্কিত কাহিনিকে জানতে পারি কিন্তু আজ আমরা খাস কলকাতার বিষয়ে আলোচনা করব,” অনির্বাণ সকলের দিকে তাকায়, “১৭ই আগস্ট ১৭৮০ সাল কলকাতার আলিপুরে মুখোমুখি দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন এমন দুই ব্যক্তি, সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাস যাঁদেরকে মনে রেখেছে এমন দুই ব্যক্তিই আধুনিক যুগের সমস্ত রীতিনীতি, নিয়মকানুনকে কার্যত অস্বীকার করে সেদিন মেতে উঠেছিলেন ডুয়েলের উন্মত্ততায় তাঁদের নাম যথাক্রমে ওয়ারেন হেস্টিংস ফিলিপ ফ্রান্সিস, দুজনেই সেই সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উচ্চপদে আসীন
আশেপাশের গাম্ভীর্যকে ভুলে, অনির্বাণ ক্রমশ তন্ময় হয়ে সেই ইতিহাসের কথা বলে চলতে থাকে বাংলার বড়োলাট ওয়ারেন হেস্টিংস, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেঙ্গল সুপ্রিম কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিস, দুজনের মধ্যকার বৈরিতা, প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধে হেস্টিংসের ভূমিকা নিয়ে ফ্রান্সিসের মন্তব্য, সবশেষে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বানএই সবই যেন শ্রোতাদের মনে ছবির মতোই ভেসে উঠতে শুরু করে বেলভেডিয়ার এস্টেটের পশ্চিম অংশে সেই গাছে ঘেরা গলিপথ, ১৭ই আগস্টের ভোর ডুয়েলের পরিণতিতে হেস্টিংস অবশ্য অক্ষত ছিলেন, ফ্রান্সিসের আঘাতও মোটেই গুরুতর ছিল না কিন্তু দুজনের সেই তিক্ততার অবসান ঘটেনি কোনোকালেই ১৭৮০ সালের সেই ডুয়েলে সেকেন্ড হিসেবে দুজনের তরফে দায়িত্ব পালন করেছিলেন যথাক্রমে কর্নেল পিয়ার্স কর্নেল ওয়াটসন আশ্চর্যের বিষয় হল উত্তর কলকাতার দমদম অঞ্চলে, সেন্ট স্টিফেন্স স্কুল-চত্বরে এখনও সেই কর্নেল পিয়ার্সেরই স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ দেখা যায় এভাবেই এ-সমস্ত ইতিহাসের অস্তিত্ব ছড়িয়ে থাকে আমাদেরই চারপাশে, শান্তিতে, নিস্তব্ধতায় অনির্বাণের বক্তব্য শেষ হলে পরে সমস্ত অডিটোরিয়াম জুড়েই যেন একটা নীরবতার রেশ থেকে যায় কিছুক্ষণ তার অব্যবহিত পরেই অবশ্য হাততালিতে কোলাহলে হলঘর ফেটে পড়ে এমন অজানা একেকটি ঘটনাকে জানতে, তার একেকটি নিদর্শনকে চিনে নিতেই তো এই সম্মেলন হাসিমুখে অনির্বাণ পোডিয়াম থেকে নেমে আসে সদাশিব ওর হাতদুটোকে ধরে জোরে ঝাঁকিয়ে দেয়
মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতেই অনির্বাণের সঙ্গে গ্রাহাম এডওয়ার্ডসের আলাপ হয়ে গেল একই টেবিলে খেতে বসেছিল ওরা তিনজন সদাশিবই ওর সঙ্গে গ্রাহামের আলাপ করিয়ে দেয় গ্রাহাম এডওয়ার্ডস সহাস্যে অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে বলেন, “ওয়েল প্রফেসার, আমার মনে হয় কাল আমার প্রেজেন্টেশনের সময়েও কিন্তু সেখানে বিশেষ করে আপনারই জন্য উৎসাহ বোধ করার মতো কিছু জিনিস থাকবে আমি কিন্তু আপনাকে এক্সপেক্ট করব কালঅনির্বাণ মাথা নাড়ে, “নিশ্চয়ই থাকব তাছাড়া আমরা তো একই সঙ্গে ছুটি কাটাতে চলেছি কাজেই আলাপ এবং বিস্ময়ের পর্ব চলতেই থাকুকগ্রাহাম দরাজ ভঙ্গিতে হেসে ওঠেন খাওয়াতে মন দেন অনির্বাণের মেজাজটা বেশ ফুরফুরে লাগছিল তখনও সে জানে না আরও কী নতুন বিস্ময় ওর জন্য এই ছুটিতে অপেক্ষা করে রয়েছে
গ্রাহামের সংগ্রহ রীতিমতো উল্লেখযোগ্য পরদিন গ্রাহামের বক্তৃতা শুনতে শুনতে অনির্বাণের এমনটাই মনে হচ্ছিল নিজাম থেকে শুরু করে হোলকার, এমনকি কলকাতার কাছেই বাঁশবেড়িয়া অঞ্চলের বেশ কিছু পুরোনো মধ্যযুগীয় পোড়ামাটির প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ভদ্রলোক বেশ যত্নের সঙ্গেই তাঁর এই সংগ্রহের বিষয়টি দেখেন তা বেশ বোঝা যাচ্ছিল একটু একটু খারাপও লাগছিল অবশ্য তার তাদের নিজেদেরই দেশের এই সমস্ত অমূল্য সম্পদ একজন বিদেশি কিনা যত্ন করে গুছিয়ে রাখছেন, সংগ্রহ করে বাঁচিয়ে রাখছেন, অথচ নিজেদের দেশেই কিনা এর বিপরীতে এ-সমস্ত ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার তেমন কোনো প্রচেষ্টাই নেই অনির্বাণ মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠিক তখনই চমকটা আসে মঞ্চের উপর গ্রাহাম হঠাৎ বলে ওঠেন, “দর্শকাসনে আমার গবেষক-বন্ধু অধ্যাপক অনির্বাণ রয়েছেন তিনি গতকাল আড়াইশো বছর আগেকার কলকাতায় ঘটে যাওয়া এক আশ্চর্য ডুয়েলের বিষয়ে আপনাদেরকে জানিয়েছেন তখনই ভেবেছিলাম আমার সংগ্রহের এই শেষতম নিদর্শনটির বিষয়ে আপনাদের জানাব আপনাদেরও নিশ্চয় সেটিকে ভালো লাগবেগ্রাহামের নির্দেশে সুদৃশ একটি কাঠের বাক্সকে মঞ্চের উপরে নিয়ে আসা হয় অবাক বিস্ময়ে সেই দিকে তাকিয়ে থাকে অনির্বাণ
ওগডন অ্যান্ড বার্টন,” বলে ওঠেন গ্রাহাম এডওয়ার্ডস, “হ্যাঁ, সেই বিখ্যাত ওগডন অ্যান্ড বার্টন, এককালে ডুয়েলিং পিস্তল তৈরিতে যাঁদের খ্যাতি ছিল সারা পৃথিবীতে সেই ডুয়েলিং পিস্তল সবসময়তেই জোড়াতে জোড়াতে তৈরি করা হত কেবল তাইই নয়, সেগুলির প্রযুক্তিও হত সেই সময়কার বাজার-চলতি যে সমস্ত পিস্তল অথবা অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র, তাদের চেয়েও অনেকগুণে ভালো আধুনিক রিকয়েলিং, অর্থাৎ কিনা গুলি ছোঁড়ার পর পিস্তলের যে পিছনের দিকে সরে আসা বা তার ধাক্কা মারার যে প্রবণতা, ডুয়েলিং পিস্তলগুলিতে তার মাত্রা অনেক কম হত হাতলগুলি হত কাঠের তৈরি, চকচকে পালিশ থাকত না, যাতে কিনা প্রতিপক্ষের চোখে আলো পড়ে তা কোনোরকম বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে না পারে সেই সময়কার তুখোড় ডুয়েল-পিস্তল বানানেওয়ালাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন এই ওগডন অ্যান্ড বার্টন, দ্যুর্স এগ, ম্যান্টন অথবা মর্টিমার প্রভৃতি নির্মাতারা আপনারা যে পিস্তলদুটিকে দেখছেন, সে দুটির নির্মাতা হলেন ওই ওগডন এবং বার্টন সাহেব ১৭৯৪ সাল নাগাদ তাঁদের দুজনের পার্টনারশিপে এই কোম্পানি খোলা হয়েছিল শোনা যায় আমেরিকার কুখ্যাত বার-বনাম-হ্যামিলটনের ডুয়েলেও তাঁদেরই তৈরি পিস্তল ব্যবহার করা হয়েছিলসকলেরই দৃষ্টি এখন মঞ্চের বিশাল পর্দার উপরে স্থির
পিস্তলের মতো দু-খানি পিস্তল বটে মেহগনি অথবা আরও দামি কোনো কাঠের সুন্দর কাজ করা হাতল দু-খানি, সরু লম্বা দু-খানি নল, গানপাউডারের বাক্স, বন্দুক পরিষ্কারের জন্য কিছু যন্ত্রপাতি, ফ্লিন্টলক প্রযুক্তিতে তৈরি জিনিস অনির্বাণ বিস্ময়ে প্রায় অভিভূত হয়ে পড়েছিল একবার কি সে হাতে করে নিয়ে ছুঁয়ে দেখতে পারবে পিস্তলদুটিকে? মনে মনে সে ভেবেই রাখল অনুরোধটা একবার হলেও গ্রাহাম সাহেবকে সে করে দেখবে বক্তৃতার পর বিস্ময়ে তার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল তখন গ্রাহাম সাহেব বলে চলেছেন, “এই পিস্তলদুটি সেই ওগডন বার্টন সাহেবের কোম্পানির অন্যতম শেষ দুটি নির্মিত পিস্তল বলে মনে হয় কারণ এর পিছনে তৈরির তারিখ হিসেবে লেখা রয়েছে মার্চ ১৮০২, আমরা জানি ১৮০৩ সালে ওগডন সাহেব এই পেশা থেকে অবসর গ্রহণ করেন ১৯৭৫ সালে কায়রোতে এক পুরোনো অস্ত্র ব্যবসায়ীর কাছ থেকে আমি এই পিস্তলদুটিকে সংগ্রহ করি সে আমাকে বলেছিল আদতে নাকি এই পিস্তল ভারতবর্ষেরই কোনো এক প্রাদেশিক রাজ্য থেকে সে কোনোভাবে জোগাড় করতে পেরেছিল কিন্তু সঠিক সেই ইতিহাসকে এখনও অবধি কেউ খুঁজে বের করতে পারেনি হয়তো ডক্টর অনির্বাণ,” তিনি মঞ্চ থেকে অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে একটু হাসেন, “তিনিই এর আসল ইতিহাসকে খুঁজে বের করতে পারবেনগ্রাহামের বক্তৃতা শেষ হয়, তিনি পোডিয়াম থেকে নেমে আসেন হাততালিতে আবারও তখন হলঘর ফেটে পড়েছে

*                   *                   *

সোমবারের সকাল
কনফারেন্স গতকালই শেষ হয়েছে আজ সকালেই ওরা তিনজন রওনা হয়ে পড়েছে খয়েরওয়াড়ার অভিমুখে গতকাল রাতেই প্রথম সদাশিব ওদের সকলকে জায়গাটার নাম জানিয়েছে এই অঞ্চলে এমন একই নামের কেবল একটি নয়, দুটি আলাদা জায়গার অস্তিত্ব রয়েছে প্রথম জায়গাটি মহারাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সেখানে মনোলিথিক যুগের বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে এছাড়াও আদিবাসী গোণ্ড প্রজাতিরও বেশ কিছু আদিম সমাজ সভ্যতার নিদর্শন সেখানে পাওয়া গিয়েছে কিন্তু সেই খয়েরওয়াড়াতে যাওয়ার উদ্দেশ্য ওদের নয় ওরা চলেছে মধ্যপ্রদেশ-মহারাষ্ট্র সীমান্তের দিকে, নাগপুর-ছিন্দওয়াড়ার রাস্তাতে স্বাধীনতার আগে এই ছিন্দওয়াড়াও ছিল এক প্রাদেশিক স্বশাসিত রাজ্য খয়েরওয়াড়া তারই পাশের এক ছোট্ট জনপদের নাম গাড়িতে যেতে যেতেই সদাশিব ওদেরকে সেকথা বলছিল এককালে নাকি এই খয়েরওয়াড়াও আলাদা রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেত পরে অবশ্য ছিন্দওয়াড়ার দেওয়ানবাহাদুর এখানকার সর্বেসর্বা হয়ে উঠলে পরে, তাঁরই এস্টেট হিসেবে এই অঞ্চল মান্যতা পেয়ে আসে কিন্তু নামে দেওয়ান হলেও, খয়েরওয়াড়ার মানুষ সেই দেওয়ান বা তাঁর পরিবারের লোকজনকে প্রায় রাজারই সমান সম্মান দিয়ে আসত এমনটাই ছিল তাঁদের প্রতাপ স্বাধীনতার আগে অবধি দেওয়ান চন্দ্রকান্ত সিংহকে রাজা চন্দ্রকান্ত বলেই এলাকার মানুষ সম্বোধন করত এখন তাঁর ছেলের রাজত্ব রাজত্ব অবিশ্যি নামেই, তাহলেও নব্বই-ঊর্ধ্ব রাজাবাহাদুর’, দেওয়ান সূর্যকান্ত সিংহকেও এলাকার মানুষ যথেষ্টই সমঝিয়ে চলে সেই দেওয়ান সূর্যকান্তের বাড়িতেই নাকি ওদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে প্রস্তাবটা শুনে রীতিমতো চমকিয়ে উঠেছিল অনির্বাণ নাগপুর-ছিন্দওয়াড়ার রাস্তাতে গাড়ি ছুটে চলেছে দু-পাশে শুষ্ক প্রান্তর একেবারে উঁচুনীচু ঘাট, পাহাড় ছোটো ছোটো উপত্যকা রাস্তার দু-পাশে ঘন জঙ্গল তেমনটা নেই কিন্তু গাছপালার প্রাচুর্য রয়েছে খুব দূরে একেকসময়ে পাহাড়ের গায়ে, বা উপত্যকার অংশে ঘন জঙ্গল দেখা যাচ্ছে ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে গাড়ির জানালাগুলোকে ওরা নামিয়ে নিয়েছে এয়ারকন্ডিশনিংয়ের বিশেষ দরকার পড়ছে না গ্রাহাম সাহেবও বেশ উপভোগ করতে করতে চলেছেন এরই মধ্যে অনির্বাণও তার সাধ পূরণের সুযোগ পেয়েছে ওগডন-বার্টনের সেই পিস্তলদুটিকে একটিবার হাতের মধ্যে করে নিতেই সারা গায়ে কেমন যেন একটা অনুভূতি হয়েছিল তার মনে হয়েছিল যেন সেই কত যুগ আগেকার সময়, কোনো মন্ত্রবলে হঠাৎ তার দু-খানি হাতের ভিতরে এসে ধরা দিয়েছে বেশ ভারী সেগুলি এখনও তেল চকচকে হয়ে রয়েছে কার্তুজ বা টোটা আছে কিনা তার জানতে ইচ্ছে করছিল তবুও সেসব আর জিজ্ঞেস করল না অনির্বাণ ওদের গাড়ি এখন ছোট্ট একটা নদী পার হয়ে চলেছে দুপুরের কাছাকাছি অনেক দূরেকার মাঠে কিছু গবাদি পশু নিয়ে কোনো এক বৃদ্ধ চরাতে চলেছে অনির্বাণের ভারী ভালো লাগছিল সবকিছুই
প্রাসাদোপম বাড়িটাকে দেখলে পরে এখনও সম্ভ্রম জাগতে বাধ্য দেওয়ান ওরফে রাজা সূর্যকান্তের কোনো সন্তানাদি নেই ওঁর মৃত্যুতেই এই বংশের ধারা বিলুপ্ত হবে সর্বক্ষণের সেক্রেটারি হিসেবে জগদীশ বলে একজন আছেন তিনিই সিংহদরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে অনির্বাণ-সদাশিবদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন এই জগদীশের সঙ্গেই সদাশিবের কথাবার্তা হয়েছিল সম্মেলনের সময় প্রদর্শনীর অংশ হিসেবে এই রাজপরিবারেরও কিছু টুকিটাকি ব্যবহার্য জিনিস, ঐতিহাসিক নিদর্শন, ইত্যাদিকে সদাশিবেরা ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন রাজা সূর্যকান্ত সানন্দে সম্মতি প্রদান করেন সেই জিনিসগুলিকে ফিরিয়ে দিতেই এভাবে ওদের এখানে আসা সেই সুযোগেই দু-রাত্তিরের জন্য রাজ-আতিথেয়তা উপভোগের সুযোগ
রাজা সূর্যকান্তের সঙ্গে ওদের দেখা হল বিকেলে ততক্ষণে জগদীশের কল্যাণে ওদের এই বাড়ির ট্রফিরুম, আরও অন্যান্য কিছু ঘর, ঐতিহাসিক সমস্ত তৈলচিত্র, সূর্যকান্ত চন্দ্রকান্তের ব্যবহার করা বেশ কিছু পুরোনো সামগ্রী ইত্যাদি সমস্ত কিছুকে দেখা হয়ে গেছে এককালে যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ঔদ্ধত্যে এই বংশের মানুষেরা এই এলাকাকে শাসন করেছেন সে আর আলাদা করে বলে দিতে হয় না সূর্যকান্তের চেহারাতেও সেই আভিজাত্য এখনও স্পষ্ট নব্বই পেরিয়েও কথা বলার ভঙ্গি, গলার জোর, শরীরের নড়াচড়া সবকিছুই আশ্চর্য রকমে সাবলীল গ্রাহাম সাহেব তো বলেই ফেললেন, “আপনাকে দেখে কিছুতেই নাইন্টি এ্যাবাভ বলে মনে হয় না ইউ হ্যাভ ট্রিমেণ্ডাস পার্সোনালিটি ইনডিড!” সদাশিব, অনির্বাণও অবাক বিস্ময়ে রাজপরিবারের এই শেষতম মানুষটিকে দেখে নিচ্ছিল অনেক কথা বললেন তিনি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজপরিবারের মর্যাদা খর্ব, কিন্তু এলাকার মানুষের ভালোবাসা, দেশের যুবক-যুবতিদের মধ্যে আধুনিক মানসিকতার কুপ্রভাব, কিন্তু তারাও এখন বিদ্যায়-বুদ্ধিতে কতখানি এগিয়ে গিয়েছে, সেই প্রসঙ্গইত্যাদি নানা বিষয়কে নিয়েই আলাপ চলছিল অনির্বাণ দেখছিল, নব্বই পেরিয়েও মানুষটি অসম্ভব রকমে ঋজু, পেটানো চেহারা, পাকানো গোঁফ, ধবধবে সাদা হয়ে গেলেও হাওয়াতে তা অল্প অল্প দুলছে সব মিলিয়ে বেশ একটা রাশভারী অস্তিত্ব বটে রাতের খাওয়া-দাওয়ার সময় অবধি অবশ্য তিনি আর বসলেন না অল্প কিছু সময় আগেই ধীরে ধীরে উঠে চলে গেলেন জগদীশই এখানকার সব ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছেন দোতলায় বিশাল করিডরের একেবারে একপ্রান্তে সূর্যকান্তের ঘর তারই পাশের ঘরে থাকেন জগদীশ চাকরবাকর, খানসামা-বেয়ারারা সকলেই থাকে নীচতলায় অন্যপ্রান্তে পাশাপাশি দু-খানি ঘর সেই দুটি ঘরেই যথাক্রমে অনির্বাণ, সদাশিব আর গ্রাহাম সাহেবের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে পালঙ্কে শুয়ে শুয়ে অনির্বাণ আর সদাশিব গল্প করছিল পাশের ঘর থেকে অবশ্য গ্রাহাম সাহেবের তরফে কোনো আওয়াজই আর পাওয়া যাচ্ছে না ভদ্রলোক বোধহয় সারাদিনের ধকলের পর পেটে মোগলাইখানা পড়তে না পড়তেই ঘুমিয়ে পড়েছেন দু-চোখ জুড়ে ওদেরও ঘুম নেমে আসছিল কখন যে গল্প করতে করতে দুজনে ঘুমিয়ে পড়েছে, কারোরই খেয়াল নেই চকিতে দুজনেরই ঘুম ভাঙল কানফাটানো গুলির শব্দে অন্ধকার সেই মঞ্জিল যেন বা থরথর করে কেঁপে উঠল হঠাৎ
জানালার কাছেই দেয়ালে পিঠ দিয়ে সূর্যকান্ত চিৎ হয়ে পড়েছিলেন মাথাটা একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে রক্তের ধারা দেয়াল বেয়ে নেমে এসেছে সেই দৃশ্য বেশিক্ষণ তাকিয়ে দেখা যায় না গ্রাহাম সাহেব একবার মাত্র দৃশ্যটা দেখেইওহ্‌ গড!” বলে বেরিয়ে গেলেন অনির্বাণ আর সদাশিবও সেই দৃশ্যকে তাকিয়ে দেখতে পারছিল না কিন্তু উপায় নেই শোকে জগদীশ যেন কেমন পাথরের মতো হয়ে গেছেনএখন তো আর কিছুই করার নেই,” মৃদুস্বরে বলে অনির্বাণ, “কাল সকালেই পুলিশকে খবর দিতে হবেজগদীশ একবার অস্ফুটে বলেন, “কেই বা বাবুকে এইভাবে খুন করবে! কেন!” তিনি চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন আওয়াজ শুনে নীচতলা থেকেও কাজের লোকেরা সব একে একে উপরে উঠে আসতে শুরু করেছে কান্নার রোল পড়ে গেল সদাশিবের কাঁধে হাত রেখে অনির্বাণ তাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসেকী মুশকিলেই না পড়া গেল বল!” সে শিউরে ওঠে একটিবার, “ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ, তবুও এভাবে” “বন্ধ ছিল না,” জবাব দেয় অনির্বাণ, “বন্ধ থাকে না বলেই ধারণা আমার বয়স্ক মানুষ, দরকার হলে যাতে জগদীশকে ডাকতে পারেন সে জন্য দরজা ভেজানো থাকলেও বন্ধ থাকে না এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত,” একটা শ্বাস ফেলে অনির্বাণ, “অত ভেবে আর কোনো লাভ নেই এখন ভোর প্রায় হয়েই এসেছে পৌনে চারটে বাজে একটুক্ষণ বিশ্রাম করে নেওয়া যাক বরং কাল সকাল থেকে তো,” সে আর কথাটা শেষ করল না

*                   *                   *

সকাল
একরাত্তিরের মধ্যেই সমস্ত সফরের চেহারাটা যে এভাবে পালটিয়ে যাবে, স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি অনির্বাণ প্রাথমিক পুলিশি জেরার পাট মিটতে মিটতে দুপুর গড়িয়ে গেল দেহ ওরা নাগপুরে নিয়ে গিয়েছে সেখানেই সূর্যকান্তের দেহের পোস্ট-মর্টেম করা হবেভারী ক্যালিবারের কোনো আগ্নেয়াস্ত্র থেকেই গুলিটা ছোঁড়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে,” তদন্তকারী অফিসার সুরেশ বাঘেল এমনটাই জানিয়েছেন যদিও গুলি মাথার সামনে দিয়ে ঢুকে মাথা ফুঁড়ে জানালা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে কার্তুজের খোলটাকেও উদ্ধার করা যায়নি এমনিতে সুরেশ বাঘেল যথেষ্টই সহযোগিতা করে চলেছেন কেবল পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট না আসা অবধি ওদের এখন খয়েরওয়াড়া ছাড়া নিষেধ এই সবকিছুর ভিতরেও দুপুরে জগদীশ কোনোমতে সকলের জন্য সামান্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন রাতে স্থানীয় একটি হোটেল থেকেই সকলের খাবার আসবে আশেপাশের স্থানীয় মানুষেরাও খবর পেয়ে ভিড় জমাতে শুরু করেছিল, কিন্তু সুরেশ বাঘেল তাঁর পুলিশফোর্স দিয়ে সেই সব মানুষজনকে আপাতত হটিয়ে দিয়েছেন বেলা পড়ে এসেছে প্রায় সাড়ে তিনটের কাছাকাছি সময় এখন প্রাসাদোপম সেই বাড়িটার সামনে, বাগানে ঘাসের উপর চেয়ার পেতে ওঁরা জনে বসে আছেন ওঁরা বলতে জগদীশ, সদাশিব, অনির্বাণ গ্রাহাম সাহেব একটু হাঁটতে বেরিয়েছেন ওই ভদ্রলোককে দেখেও ভিতরে ভিতরে বেশ একটু ভয় পেয়ে গিয়েছেন বলেই মনে হচ্ছে জগদীশই এর মধ্যে হঠাৎ বলে ওঠেন, “আপনারাও একটু হেঁটে আসুন না স্যার ভালো লাগবে বড়োবাবু থাকলে উনিই তো সব বলে-টলে দিতেন, কোথায় যাবেন, কীভাবে যাবেন, কোন জিনিসটা আপনাদের ভালো লাগবে এখন তো,” জগদীশের গলা কেঁপে ওঠে পর মুহূর্তেই তিনি নিজেকে সামলিয়ে নেন, “ওই পিছনের দরজার দিকে জঙ্গলের ভিতর একটা সুঁড়িপথ চলে গেছে ওই পথ ধরে গেলেই ছোটো একটা ঝরনার কাছাকাছি পৌঁছোনো যায় আপনারা দেখে আসতে পারেন ভালো লাগবেসদাশিব অনির্বাণের দিকে তাকায় সেও মাথা নাড়ে অনির্বাণ বলে, “বেশ তাহলে ঘুরেই আসি একটু আপনিও?” জগদীশ দু-পাশে মাথা নাড়েন, “আমি একটু এইখানেই থাকি বরং একটু নিজের মতো,” গলাটা আবারও তাঁর ভারী হয়ে এসেছে
ঝরনা বলতে খুব ছোটোও নয় মোটামুটি চল্লিশ ফুট উঁচু তো হবেই সটান নীচে পাথরের উপর জল আছড়িয়ে পড়ছে জায়গাটা যথেষ্ট নির্জন একটা টিলার উপর ওপাশে গ্রামের দিক থেকেও একটা পায়ে চলা পথ এসে এই টিলার উপরে শেষ হয়েছে রোদের তাপ এতটুকুও নেই শুধু জলপড়ার শব্দ নির্জনতা অনির্বাণ আর সদাশিব একেবারে ঝরনার উপরটায় এসে দাঁড়াল বেশ নীচে ফেনা দেখা যাচ্ছে একটা ছোটো প্রাকৃতিক কুণ্ড মতো সেখানে তৈরি হয়েছে তারপর একটা নালার মধ্যে দিয়ে জল বেরিয়ে যাচ্ছে নীচে কোথাও দু-একটা পাখি ডাকছে এই সময় গ্রাহাম এডওয়ার্ডসকে অনির্বাণই প্রথম দেখল ভদ্রলোক নিশ্চিত করেই গ্রামের পায়ে চলা পথ দিয়ে এখানে এসেছেন সুঁড়িপথ দিয়ে এলে ওরা আরও আগেই টের পেত দেখতে দেখতে তিনি জলের একেবারে ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন সদাশিবই পিছন থেকে ডেকে ওঠে হঠাৎ, “অত কাছে যাবেন না স্যার! পা পিছলোলেই বিপদ!” গ্রাহাম ওদের দিকে ফিরে তাকান কেমন যেন একটা শূন্য দৃষ্টি পরক্ষণেই আবার সেই পুরোনো উজ্জ্বলতা ফিরে আসে সহাস্যে বলেন, “না না, মাথা খারাপ নাকি এমনিই দেখছিলাম বেশ সুন্দর এই জায়গাটা অনেকটা শান্তওরা দুজনেও মাথা নেড়ে সায় দিল সূর্য ওদের পিছনে পশ্চিমে ঢলে পড়েছে হাওয়াটাও যেন হঠাৎই ঠান্ডা শিরশিরে হয়ে আসে কেমনএবারে ফিরতে হয়,” বলে ওঠে অনির্বাণ ওরা তিনজনে বাড়ির পথে এগোল
সেই রাত্তিরেই আশ্চর্য এক ঘটনা ঘটে গেল যার জন্য অনির্বাণ প্রস্তুত ছিল না একেবারেই

*                   *                   *

অনেক রাত পালঙ্কে শুয়ে শুয়েও ঘুম আসছিল না তার অনির্বাণ পাশ ফিরে দেখল, পাশের বিছানাতেই অকাতরে ঘুমোচ্ছে সদাশিব শরীরে দুশ্চিন্তার লেশমাত্র নেই অনির্বাণ উঠে বসল একটু হেঁটে আসবে? নাকি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াবে কিছুক্ষণ? এখানকার প্রায় সমস্ত ঘরেরই সঙ্গে একটি করে ঝোলানো বারান্দা রয়েছে সেখানে গিয়েই কি কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আসবে? বাইরের হাওয়াতে এতটুকুও কি স্বস্তি মিলবে তার? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে উঠেই পড়ল অনির্বাণ দরজা খুলে বারান্দাটায় গিয়ে দাঁড়াল হাওয়া দিচ্ছে না তবুও চারপাশে কেমন যেন একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব এখানকার আবহাওয়াটাই বোধহয় এমন ঠিক সেই সময়ই পাশে দাঁড়ানো লোকটার দিকে নজর পড়ল তার প্রাথমিক চমকে - ভয়ে বিস্ময়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল অনির্বাণ এত রাত্তিরে কেই বা তাদের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে? পরনে রাজকীয় ঝলমলে পোশাক, কিন্তু বিষণ্ণ মুখ ক্লিষ্ট অবয়ব অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে লোকটা বলল, “নমস্কার আমার নাম চন্দ্রকান্ত, ওই সূর্যকান্ত আমারই সন্তান ভবিতব্যের হাত থেকে ওর ভি রেহাই মিলল নাঅনির্বাণ চমকিয়ে মানুষটার দিকে তাকায়
মৃত্যুর এতকাল পরেও রাজা চন্দ্রকান্তের বয়স এতটুকুও বাড়েনি
সেই একই আভিজাত্য, অথচ ঠিক যেন সেই আগেকারই মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসক; ঔদ্ধত্য উন্নাসিক মানসিকতা, রাগ অহংকারযেন এতটুকুও বা বদল হয়নি কোনো কিছুর তাঁকে দেখে অনির্বাণের এমনটাই মনে হচ্ছিল সে নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে কেবল সেই অজানা ইতিহাসের বৃত্তান্তকে শুনে যাচ্ছিল সময়ে সময়ে তারও গায়ে কেবল শিরশিরিয়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল একেকবার
আমার নাম চন্দ্রকান্ত এই খয়েরওয়াড়া অঞ্চলে আমারই রাজ চলত আমার উপরে কখনও কেউ কথা বলবে এমনটা আমি স্বপ্নেও কোনোদিন বিশ্বাস করতে পারিনি কিন্তু পাপ কারোকে ছাড়ে না বুঝলে প্রফেসার?” কোনোভাবে চন্দ্রকান্ত যে অনির্বাণের পেশাগত পরিচয়টাকেও সঠিকভাবে জেনে ফেলেছেন বুঝতে অসুবিধা হয় না সে কিছু না বলে চুপ করে থাকে চন্দ্রকান্ত বলে চলেনগোলমালটা প্রথম সূরযই বাঁধিয়েছিল কেন যে মীরাবেন আর সুমেধার ইস্কুলটার দিকে ওর কুনজর পড়েছিল দুই তুতো বোন, মীরা আর সুমেধা কোথা থেকে যেন এই খয়েরওয়াড়াতে এসে গান্ধিবাবার অনুপ্রেরণাতে মেয়েদের ছোটো একটা স্কুল খুলে বসেছিল সালটা ১৯৪৬ সারা দেশজুড়ে এমনিতেই গরম আবহাওয়া তখন তারই মধ্যে সূরযের মীরাবেনকে ভালো লেগে গেল ওর বয়স তখন ১৬, মীরার বয়স আরও বছর তিন কি চার বেশি হবে সূরযের থেকে একদিন রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আকথা-কুকথা কী যেন সে বলে ফেলেছিল, মীরাবেন মাথা নীচু করে চলে যাচ্ছিল পাত্তাও দিত না কেউ এমন সময় ডাক্তার স্টিফেনসন, বিলিতি ডাক্তারকিন্তু কী কারণে যেন সেও এই অগতির গতি খয়েরওয়াড়াতে এসে পসার ফেঁদে বসেছিল, সেও যাচ্ছিল ওই পথ দিয়েই চড় মেরে সূরযকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল পরে জেনেছিলাম ব্যাটার শরীরে আইরিশ রক্ত দুঁদে গোঁয়ারের জাত রাগটা তখন থেকেই পুষে রেখেছিলাম এরও কিছুদিন পর,” চন্দ্রকান্তের যেন এতটুকুও ক্লান্তি বোধ হচ্ছে না, এমনভাবেই তিনি বলে চলেন, “এরও কিছুদিন পর, ছোটোলাট এলেন ছিন্দওয়াড়ার এস্টেটে খানাপিনা হল, স্ফূর্তি হল অথচ ছোটোলাটের সামনেই আমাকে বেমালুম পাত্তা দিল না ওই ডাক্তার স্টিফেনসন উলটে বলে বসল আমি আর আমার ছেলে নাকি ক্রিমিনাল, মেয়েদের অপমান করি মাথা গেল গরম হয়ে কলার ধরে টেনে নিয়ে গেলাম বাথরুমের ভিতর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলাম, পুরুষমানুষ হলে লড়ে যাও দেখি একসপ্তাহ পর দিন ঠিক হল বোধহয় সেদিন ওরও নেশাটা বেশি হয়ে গিয়েছিল বাজিটা যে সত্যিই মেনে নেবে, আমি ভাবতেও পারিনি
বন্দুক জোগাড়ের দায়িত্ব আমি নিলাম,” চন্দ্রকান্ত অনির্বাণের দিকে তাকান, “আমারই সংগ্রহে ছিল অমন একখানি ডুয়েল পিস্তলের সেট, খাস ইংল্যান্ড থেকে আনানো সূরয হল আমার সেকেন্ড স্টিফেনসনও কোথা থেকে যেন তারই এক বন্ধুকে ধরে নিয়ে এল সেও প্রায় ভবঘুরে একজন, কোথায় না কোথায় সব ইতিহাসের পুরোনো জিনিস, পুতুল, তলোয়ার, খেলনা, ঘড়ি, বাক্সইত্যাদির খোঁজ নিয়ে বেড়ায় ভোর পাঁচটায় আমাদের বাড়ির পিছনে, ওই টিলারই উপরে আমরা চারজনে গিয়ে হাজির হলাম দাঁড়ালাম, মাথা নীচু করলাম পিছিয়ে গেলাম, কুড়ি পায়ের হিসেব গুলি চলল একবার কি দু-বার নয়, তিনবার ফায়ারিংয়ের আওয়াজ শোনা গেল ডাক্তারের গুলি আমার গায়েও লাগেনি আমার গুলিও আমি ফসকে ছিলাম সূরযই রাগের মাথায়,” চন্দ্রকান্ত চুপ করে যান
ডাক্তার ওখানেই শেষ,” অনির্বাণ ভয়ে বিস্ময়ে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছেডাক্তার ওখানেই শেষ দেহ কীভাবে লুকোব বুঝে উঠতে পারছিলাম না,” চন্দ্রকান্ত আবারও বলতে শুরু করেন, “কিন্তু ঈশ্বর সহায় পরদিন থেকেই দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক গণ্ডগোল শুরু হল আঁচ এসে পড়ল এই খয়েরওয়াড়াতেও পয়সা খাইয়ে গুন্ডা লাগালাম মীরা-সুমেধার ইস্কুলবাড়িটাকেও জ্বালিয়ে দেওয়া গেল স্বাধীনতার পরে অবিশ্যি কংগ্রেসের ছেলেরা এসে আবারও একটা স্কুল খুলেছিল কিন্তু আমার বিরুদ্ধে কেউ একটি কথাও বলেনি মীরা আর সুমেধাকেও ভুলে গেল সবাই সূরয আজীবন এই পাপের সাজা ভোগ করেছে আমিও তাই,” এবারে যেন চন্দ্রকান্তকে একটু ক্লান্ত বলে মনে হয়
কেন একথা বলছেন?” সাহস করে এই সময়েই প্রশ্নটা করে ফেলে অনির্বাণ
আর কেন,” চন্দ্রকান্ত অল্প হাসেন, “স্বাধীনতা এল, আমার চোখের দৃষ্টি চলে গেল অন্ধ হয়ে বেঁচে রইলাম আরও দশ বছর সূরয বিদেশে গেল, ফেল করে ফিরে এল বিয়ে দিলাম সংসার টিকল না আবারও বিয়ে করল, অ্যাক্সিডেন্ট সূরয কেবল বেঁচে রইল নিয়তির পরিহাসেই মানুষ আমাদের থেকে সরে গেল না কিন্তু অতিরিক্ত কোনো ভালোবাসাও দিল না বদলে দিল কেবল অনুকম্পা, সহানুভূতি, দয়া আমরা কেবল অর্থলোভী হয়ে বেঁচে রইলাম তারপর আমি চলে গেলাম সূরয বেঁচে রইল এই নব্বই বছর বয়স অবধি এসে, যেন বা গুলি খেয়ে অপঘাতে মরারই জন্য বেঁচে রইল,” চন্দ্রকান্ত চুপ করে যান হঠাৎ
আর ডাক্তার স্টিফেনসনের সেই সেকেন্ড ছিলেন যিনি, তাঁর কী হয়েছিল বললেন না?” অনির্বাণ আবারও প্রশ্ন করে ফেলে চন্দ্রকান্ত বিরক্ত চোখে তার দিকে তাকান, “আমি কী করে জানব তার কী হয়েছিল শুনেছি তো সে সবকিছুর পর মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিল ওই ঝরনার মাথা থেকেই লাফ দিয়ে পড়ে সে আত্মহত্যা করেছিল দেহ পাওয়া যায়নি তার
কি নাম ছিল সেই সেকেন্ডের?” অনির্বাণ জিজ্ঞেস করে উত্তরটা আগে থাকতেই সে আন্দাজ করতে পেরেছিল তারও বুক বেয়ে কেন জানি একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে হঠাৎ

*                   *                   *

ওঠ, ওঠ শিগ্‌গিরি,” সদাশিবকে ধরে ঝাঁকাতে থাকে অনির্বাণ, “পাশের ঘরে যেতে হবে আমাদের, এখনইঘুমচোখে ধড়মড় করে উঠে বসে সদাশিব, “কী হয়েছে কী? এই ভোররাত্তিরে এভাবে ডাকছিস কেন রে ভাই?” চোখ কচলাতে কচলাতে সে জিজ্ঞেস করে হুড়মুড়িয়ে কোনোমতে সমস্ত গল্পটাই সদাশিবকে শুনিয়ে দেয় অনির্বাণ, “আমার বিশ্বাস এই গ্রাহাম এডওয়ার্ডস সেই মিস্টার এডওয়ার্ডসেরই বংশধর, যিনি কিনা ডাক্তার স্টিফেনসনের সেকেন্ড ছিলেন ওই ডুয়েলের সময় প্রথম নামগুলো তো চন্দ্রকান্ত কারোরই মনে করতে পারেননি কিন্তু এডওয়ার্ডস পদবি যখন মিলে গিয়েছে তখন এই গ্রাহাম সাহেব তাঁর বংশধর না হয়েই যান না তাছাড়াও,” অনির্বাণ আরও মনে করতে চেষ্টা করে, “খুনটা হয়েছে ভারী ক্যালিবারের আগ্নেয়াস্ত্রে, যা কিনা ওই ডুয়েল পিস্তলেরই সমতুল সব মিলে যাচ্ছে সদাশিব, দোহাই ওঠ তুই এবারসদাশিব সত্যিই এবারে চোখ-টোখ মুছে ভালো করে বাবু হয়ে বিছানার উপর উঠে বসে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করে তারপর জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু এভাবে একজন খুনিকে, একা আমরা দুজন,” আমতা আমতা করে সে বলতে যায় অনির্বাণ বলে ওঠে, “কিন্তু তাই বলে কি আমরা চেষ্টাও করব না, সকালে গিয়ে যদি দেখি পাখি উড়ে গেছে?” সে টান মেরে সদাশিবকে বিছানা থেকে তুলে আনে, “ওঠ শিগ্‌গির আমরা এখনই যাই হতে পারে যিনি খুন হয়েছেন তিনিও যথেষ্ট পরিমাণেই দোষী, কিন্তু এদেশে বা কোনো দেশেই, এখন আর আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ারও কোনো অধিকার কারোর নেই সদাশিব আমাদের যে ওঁকে ধরতেই হবেসে সদাশিবের হাত ধরে টানতে টানতে ঘরের বাইরেটায় নিয়ে আসে
আশ্চর্যের উপর আশ্চর্য, গ্রাহাম সাহেবের ঘরের দরজাটা হাট করে খোলা পড়ে রয়েছে ভিতরে বিছানা শূন্য, কেবল সাদা চাদরের উপর রাখা রয়েছে সেই পিস্তলের বাক্স অনির্বাণ একলাফে ঘরে ঢুকেই প্রথম সেই বাক্সটাকে হাতে তুলে নেয় এক ঝটকাতে বাক্স খুলে ফেলে পিস্তল দুটোকে বের করে আনে নাকের কাছে নিয়ে এসে ঘ্রাণ নেয় কীসের তারপর বাঁহাতের পিস্তলটাকে সদাশিবের দিকে বাড়িয়ে দেয়, “শুঁকে দেখ টাটকা বারুদের গন্ধসদাশিব আর কোনো প্রশ্ন করতে পারে না ওরা দুজনে গ্রাহামের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে সকাল না হওয়া অবধি এখন আর ওদের কিছুই করার নেই
সুরেশ বাঘেল পুলিশ নিয়ে চলে আসেন সকাল আটটার সময় তাঁর কাছ থেকেই খবর পাওয়া যায় নাগপুরের কনফারেন্সে প্রদর্শিত সমস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলিকেই নাকি গতকাল গ্রাহাম এডওয়ার্ডস স্থানীয় একটি মেয়েদের স্কুলে দান করে এসেছেন বলা বাহুল্য এটিই সেই কংগ্রস কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত স্কুল, গত সত্তর বছর ধরে যেটি এখানকার গরিব-দুঃস্থ মেয়েদের প্রয়োজনে, শিক্ষার উন্নতিকল্পে কাজ করে এসেছে গ্রাহাম নাকি বলেছেন, এই সমস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলিই নাকি আদতে তাঁর এক পূর্বপুরুষের সংগ্রহ এগুলি বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া যাবে, তা যেন ওই স্কুলেরই উন্নতিকল্পে ব্যয়িত হয় এছাড়াও ময়নাতদন্তের রিপোর্টের ভিত্তিতে আরোই নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, কোনো ভারী ক্যালিবারের আগ্নেয়াস্ত্রের ভোঁতা অথচ বড়ো আকারের বুলেটের আঘাতেই সূর্যকান্তের মৃত্যু হয়েছে কাজেই সুরেশ বাঘেল একেবারে পরোয়ানা সঙ্গে করেই এনেছেন অনির্বাণ অবশ্য চন্দ্রকান্তের প্রেতাত্মার বিষয়ে তাঁকে কিছু বলে না এই কাজের পিছনে গ্রাহামের মোটিভ সম্পর্কেও সুরেশের যে ধারণা পরিষ্কার নয়, সে বুঝতে পারে কেবল সে বলে রাত্তিরে তার হঠাৎ হওয়া সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রাহামের ঘরে হানা দেওয়ার ঘটনা, যাকে সে অতিরিক্ত ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়ার সুফল হিসেবেই চালিয়ে দেয় ক্যালিবারের গল্পটাও বেশ মিলে যায় এখানে সুরেশ অল্প হাসেন, তারপর গোটা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখার নির্দেশ দেন নিজেও তিন-চারজন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির পিছনের সেই সুঁড়িপথ বেয়ে তিনি রওনা হন সেই ঝরনার অভিমুখে ওদিক দিয়েও তো গ্রামের রাস্তা বেয়ে হাইওয়েতে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে অনির্বাণ, সদাশিবও তাঁর সঙ্গী হয় সময় দ্রুত গড়িয়ে চলেছে
তারা প্রায় ঝরনার কাছ অবধি এসে পড়েছে কুলকুল শব্দ শোনা যাচ্ছে কনস্টেবলেরা এগিয়ে যায় সদাশিবেরও ঠিক এই সময়তেই একটা ফোন এসে পড়ে হঠাৎ সে তাদের থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে কনস্টেবলদের মধ্যে একজন হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে বাকিরাও ওর দিকে ছুটে গিয়েছে সুরেশ বাঘেলও ছুট লাগিয়েছেন অনির্বাণ এগোচ্ছে ফোনটা কেটে দিয়ে ছুটে এসেছে সদাশিব মুখ বাড়িয়ে তারা যেন তাদের সামনেকার দৃশ্যটাকেই ভালোভাবে বুঝে নিতে চেষ্টা করে সদাশিব ফিশফিশ করে অনির্বাণকে কিছু বলছে অজানা জিগ- পাজলের সমস্ত টুকরোগুলোই যেন বা তখন একটি একটি করে, ঠিক সেই মুহূর্তে - নির্দিষ্ট জায়গাতে পড়তে শুরু করেছে অবাক বিস্ময়ে বিভোর হয়ে চেয়ে থাকে অনির্বাণ সদাশিব বলে চলেছে, “একটাও ছবি ওঠেনি, গ্রাহামের পুরো সেশনটা জুড়েই ওই ঘটনা ভিডিয়োতেও কোথাও গ্রাহাম নেই কনফারেন্সের একটা ছবিতেও গ্রাহাম এডওয়ার্ডসকে দেখা যাচ্ছে না!” অনির্বাণেরা মাথা বাড়িয়ে আবারও দেখতে চেষ্টা করে চল্লিশ ফুট নীচুতে, সেই ঝরনারই তলায়, ভেজা স্যাঁতসেঁতে পাথরের উপরগ্রাহাম তো নয়, পড়ে আছে ধবধবে সাদা, অকৃত্রিম, ঝকঝকে হাড় বিশিষ্ট আস্ত মানুষের একটি কঙ্কাল কেবল... অনির্বাণ সদাশিবকে নিয়ে একপাশে সরে আসে খয়েরওয়াড়াতে তাদের তখন আর একমুহূর্তও থাকার ইচ্ছে নেই
----------
ছবি - উপাসনা কর্মকার

No comments:

Post a Comment