ম্যাজিক ল্যাম্প:: জুলাই ২০২১

ষষ্ঠ বর্ষ।। তৃতীয় সংখ্যা।। জুলাই ২০২১
আমার গল্প সংখ্যা
-----------------

প্রচ্ছদঃ শুভশ্রী দাস
--------

সম্পাদকীয়:: জুলাই ২০২১


ম্যাজিক ল্যাম্পের প্রিয় বন্ধুরা,

কেমন আছ সবাই? বেজায় গরম, প্যাচপেচে বৃষ্টি আর ভাইরাসের প্রকোপ। এই সময় ঘরে বসে বসে মুখ ভার? একদম চিন্তা নেই...
এসে গেছে ম্যাজিক ল্যাম্পের আমার গল্প সংখ্যা
এই অভিনব সংখ্যায় লেখকরা তোমাদের জন্য তুলে ধরেছেন তাঁদের জীবনের নানা মজার অভিজ্ঞতার গল্প, কখনও ভৌতিক, কখনও তা রহস্যময়। আসলে যে কোনো গল্পের মধ্যেই কিছুটা আমার গল্পমিশে থাকে, তাই নয় কী? বাড়িতে দাদু, জেঠু, ঠাকুমারা যখন গল্পের ঝুলি খুলে বসেন তখন শুনতে কী মজাই না লাগে, কিন্তু এখন দেখো তাঁরা রয়েছেন কত্ত দূরে। তুমিও তাদের কাছে সবসময় যেতে পারছ না। তাই মন খারাপ না করে এই সংখ্যার গল্পগুলো পড়ে ফেলো। আর আমাদের অবশ্যই জানাও কেমন লাগল এই সংখ্যা।
এই সংখ্যায় আমাদের সবার প্রিয় শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক অনীশ দেবের উদ্দেশে জ্ঞাপিত হয়েছে শ্রদ্ধাঞ্জলি। উনি যে এত তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন আমরা কেউই ভাবতে পারিনি। ওঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়েছেন পত্রভারতীর শ্রীমতি চুমকি চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্যিক শ্রী অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী, সাহিত্যিক শ্রী সৈকত মুখোপাধ্যায়। এসো, আমরা অনীশ দেবের কিশোরপাঠ্য বইগুলো পড়ে ফেলি। তার মাধ্যমেই ওঁকে আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধাটুকু জানাই।
এই সংখ্যার মিষ্টি প্রচ্ছদটি এঁকেছেন শিল্পী শুভশ্রী দাস। অলংকরণ শিল্পী যাঁরা ছবি এঁকেছেন তাঁরা হলেন অতনু দেব, সুমিত রায়, সুকান্ত মণ্ডল, সুজাতা চ্যাটার্জী, নচিকেতা মাহাত, সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী, শ্রীময়ী এবং আমিও এক-দুটি ছবি এঁকেছি।
ভালো থেকো বন্ধুরা। অন্যদের ভালো রেখো। নিয়মিত বই পড়ো।
ইতি,
জিনি
----------
ছবি - জিনি

গল্পের ম্যাজিক:: সেমসাইড - প্রতীক কুমার মুখার্জী


সেমসাইড
প্রতীক কুমার মুখার্জী

ঝোঁকের বশেই গড়াতে থাকা বাসটা থেকে এক লাফে নেমে পড়েছিলাম - অনেকটা ছোটোবেলার কমিকসের পাতায় দেখা টারজানের ভঙ্গিতে! কিন্তু আদতে যে টারজান নই আমি - সেটা মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম। আর একটু হলেই পায়ে পায়ে জড়িয়ে কুমড়ো গড়ান গড়াবার দুরবস্থা হয়েছিল আর কি! এক বাস লোকের কটাক্ষপাত ও কনডাক্টরের কৌতুকে ভরা ইশারাটা - ভাগ্যিস বর্ধমান-চিত্তরঞ্জন সুপার এক্সপ্রেস বাসের সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুত অপসৃত হয়ে আমাকে ধাতস্থ করে তুলল!
এক হাতে আলগোছে ঝুলিয়ে রাখা বেগুনি-সবুজের কারিকুরি করা মাঝারি সাইজের ব্যাকপ্যাক, আর মনে সহযাত্রীর উপকার করার প্রবল বাসনা নিয়ে অপরিসর রাস্তাটার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। বুক ভরে দম নিয়ে উল্কাগতিতে (আমার আন্দাজে) ছুটতে শুরু করেছিলাম। ছেলেটাকে ধরতেই হবে - যার জিনিস তার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে, তবে আজ বাড়ি ফেরা। ছোটো থেকে শিখে এসেছি যে প্রাণের চেয়েও বড়ো হল কর্তব্য!
প্রথমে বেশ জোরেই ছুটছিলাম আমি। বড়ো রাস্তার উপর দিয়ে অনেকবার বাসে করে যাতায়াত করলেও, এ রাস্তায় আগে কখনও ঢুকিনি। যেখানে বাস থেকে নেমেছিলাম, সেই মোড়ের মাথায় গুটিকয়েক চা-সিগারেটের দোকান আর চটের উপর হাতে গোনা কয়েকরকমের সবজিপাতি নিয়ে বসেছিল দু-চারটে মানুষকিন্তু তারপর যত এগোচ্ছি, খাপছাড়া গজিয়ে ওঠা দু-চারটে পাকা বাড়ি ছাড়া সেভাবে জনবসতি বিশেষ চোখে পড়ছে না। রাস্তাটা দিয়ে বাস কিংবা গাড়িও চলে না, মাঝেমধ্যে দু-একটা মোটর সাইকেল, ভ্যান রিকশা আর সাইকেলের আনাগোনা বড়োজোর। পথচারীর সংখ্যাও বাড়ন্ত।
ছুটতে ছুটতে দম ফুরিয়ে গিয়েছিল আগেই। তাই হাতের ফুলো ফুলো ব্যাগটা নিয়ে জোর পায়ে হেঁটে চলেছিলাম। যে ছেলেটা তার ব্যাগটা সিটে ছেড়ে দিয়ে হঠাৎ করেই ভিড় বাসটার থেকে নেমে গিয়েছিল, তার টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না কোথাও। যদিও বাস থেকে নেমেই জোরে দৌড়োতে শুরু করেছিল, তাও এটুকু সময়ের মধ্যে সে নজরের বাইরে চলে যেতে পারে না। ব্যাপারটা বুঝে ভিড় ঠেলে বাস থেকে নামতে যদিও আমার দেরি হয়েছিল, তাও এটুকু সময়ের মধ্যে কোথায় উবে গেল সে?
গোড়ার কথায় আসা যাক। নইলে তোমরা যে কিছুই ভালো করে বুঝতে পারছ না, সেটা আমার কাছে বেশ পরিষ্কার। বাবার চাকরির সূত্রে আমরা দুর্গাপুরের বাসিন্দা। আমাদের পৈতৃক বাড়ি আসানসোলে আর মামারবাড়ি ডিসেরগড়ে। অনেক ছোটো বয়স, প্রায় সিক্স-সেভেনে পড়ার সময় থেকেই আমার এই লাইনে অহরহ যাতায়াত। জানলার পাশে বসে বসে চারিদিক দেখতে দেখতে মামারবাড়ি যাওয়া-আসা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। স্বাভাবিকভাবেই এই লাইনের প্রতিটি স্টপেজ আমার প্রায় মুখস্থ - যদিও রাস্তায় কখনও নামিনি আমি, একমাত্র বাস খারাপ হওয়া বাদে।
আজও সকালে দুর্গাপুর স্টেশন থেকে বর্ধমান-চিত্তরঞ্জন রুটের মা ভৈরবীবাসটা ধরেছিলাম আমি। এই বাসটা যেহেতু চিত্তরঞ্জন যায়, তাই নিয়ামতপুর স্টপেজে নেমে ডিসেরগড়ের মিনিবাস ধরে মামারবাড়ি পৌঁছোবার কথা ছিল আমার। কিন্তু দুর্গাপুর ছাড়িয়ে গোপালমাঠ পৌঁছোতেই এই বিড়ম্বনা।
বাসের মধ্যে বসে চারপাশের লোকজনের দিকে খুঁটিয়ে দেখা আমার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। হবে না কেন - মাথার মধ্যে গিজগিজ করছে ফেলুদা তোপসে, রিপ কার্বি, ফ্ল্যাশ গর্ডন, বেতাল থেকে শুরু করে দস্যু মোহন, দীপক চ্যাটার্জী, ম্যানড্রেক, লোথার থেকে টারজানের প্রতিটি চালচলন। তাই চোখে পড়েছিল তিনটে সিট আগে বসা ছেলেটার দিকে। কোলে একটা গোলগাল ব্যাকপ্যাক নিয়ে বসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে - যেন সে প্রবল অস্বস্তিতে রয়েছে। বিহ্বল দৃষ্টিতে আশেপাশের মানুষের দিকে নজর রাখছে সে। দেখে ভদ্রবাড়ির ছেলে বলেই মনে হচ্ছিল আমার।
এর মধ্যে কনডাক্টর হঠাৎ গোপালমাঠ গেটে আসেন!’ বলে হুঙ্কার ছাড়তে, ছেলেটা চোখের নিমেষে উঠে পড়ে ব্যাগটাকে সিটে রেখেই, ভিড় ঠেলে বাসের দরজার দিকে এগিয়ে গেল তড়িঘড়ি। আমি বরাবর শেষের সিটের জানলার পাশে বসার দরুন বাসের ভিতরটা পুরোপুরি দেখতে পাই। কয়েক মুহূর্ত পরেই দেখতে পেলাম ছেলেটা কনডাক্টরের বগলের ফাঁক গলে তিড়িং করে বাসের দরজা থেকে লাফিয়ে মাটিতে নেমেই তিরবেগে গোপালমাঠ স্টপেজের একমাত্র সরু পিচের রাস্তা ধরে অদৃশ্য হয়ে গেল!
তারপর কীভাবে কী হয়েছে সে তো তোমাদের আগেই বলেছি। এরপর কী হল এবার মন দিয়ে শোনো।
হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, এমন সময়ে কিছু দূরে একটা ছোটো কলোনি দেখতে পেলাম। জায়গাটা আস্তে আস্তে চওড়া হয়ে আসছে, সামনের বাঁদিকে একটা সেকেন্ডারি স্কুল দেখা যাচ্ছে, আর তার সামনে বেশ বড়োসড়ো একটা মাঠ। মাঠের চারদিকে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা জায়গাটাকে আরও সুন্দর করে তুলেছে। পাশেই আবার একটা ক্লাব! উলটোদিকে একটা ছোটো ডোবার পাশে গুটিকয়েক দোকানি নিত্যপ্রয়োজনীয় শাকসবজি নিয়ে বসেছে। পাশে একটা নড়বড়ে চায়ের দোকান। সেখানে নানা বয়সের লোক সকালের আড্ডায় মশগুল। বুঝলাম এই এলাকার যাবতীয় নাড়িনক্ষত্রের খবর পাওয়া যাবে এখান থেকেই।
হঠাৎ দোকানের বেঞ্চের উপর দিয়ে চোখ ঘুরে যেতে চমকে উঠলাম! ভিড়ের ফাঁকফোকর দিয়ে এক ঝলক দেখতে পেলাম আমার হারানিধিকে! আরে, ওই তো সেই সবুজ-কালো চেক জামা পরা ছেলেটা! সকলের সঙ্গে বসে দিব্যি চা খাচ্ছে মাটির ভাঁড়ে ফুঁ দিতে দিতে - আরেক হাতে ধরা লেড়ো বিস্কুট! পরম নিশ্চিন্তে সে বসে রয়েছে বেঞ্চে এক পা তুলে - কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপমাত্র নেই!
তার দিকে এক পা এগোতেই আমার ডান কাঁধে একটা ওজনদার হাতের ভর অনুভব করলাম - এই যে ভাই, এক মিনিট এদিকে এসো দেখি!” গলার টোনটা বিশেষ বন্ধুত্বপূর্ণ মনে হল না কোনোভাবেই!
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি গাঁট্টাগোট্টা এক পালোয়ান চেহারার মানুষ, যিনি আমার কাঁধের উপর তাঁর স্নেহেরহাত রেখেছেন। কিন্তু আমার যেন মনে হতে লাগল যে ওই হাত কাঁধ ছেড়ে দিয়ে পরমুহূর্তে আমার ঘাড় চেপে ধরার জন্য নিশপিশ করছে। আমি কাঁপা কাঁপা স্বরে, “হ্যাঁ কাকু, বলুন!” বলতে বলতে লক্ষ করলাম, চায়ের দোকানে জমে থাকা ভীমরুলের চাকের মতো ভিড় থেকে একটি দুটি করে লোক টুপটাপ খসে পড়ে পায়ে পায়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে! ক্রমে তারা চারদিক থেকে আমাদের ঘিরে ফেলল। আমার অবস্থা তখন জাঁতাকলে পড়া ইঁদুরকেও লজ্জা দেবে!
তাদের ভাবগতিক মোটেই ভালো লাগেনি আমার, কারণ কয়েকজনকে দেখেছিলাম মাছের দোকানের পাশে বসে থাকা লোভী বিড়ালের মতো জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে চাটতে, আর দু’হাতের থাবা ঘষতে ঘষতে এগোচ্ছিল আমার দিকে। শেষে যখন চায়ের ভাঁড় ফেলে, বেঞ্চ টপকে সেই সবুজ জামাও বেপরোয়াভাবে আমার দিকে এগিয়ে এল, তখন বুঝলাম আমি মোটেই সংবর্ধনা পেতে যাচ্ছি না এই মুহূর্তে! আরও বুঝলাম, এটা সম্পূর্ণ এক গট আপ গেম!
প্রথমেই আমার হাত থেকে ব্যাকপ্যাকটা ছিনিয়ে নেওয়া হলযে ভদ্রলোক আমার উপর ভরকরেছিলেন, তিনি বাঁশফাটা গলায় চিৎকার করে বললেন, “হ্যাঁ রে, এই ব্যাগটাই তো?” ভিড়ের আশি ভাগ মানুষ সায় দিতে, উনি ব্যাগটা দুটি ছেলেকে দিয়ে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিলেন। তারপর সম্পূর্ণভাবে মনোযোগ দিলেন আমার উপরে। অনাবশ্যকভাবে তাঁর চোয়ালের হাড়গুলি নিষ্পেষিত হচ্ছিল, চোখে এক নিদারুণ রাগের চাউনি!
কোথায় থাকা হয়?
দুর্গাপুরে, বিধাননগরে!”
কী করা হয় - কাজকর্ম না পড়াশোনা?”
আমি ক্লাস টেনে পড়ি কাকু - পরের বছর আই সি এস সি দেব
বাহ্! খুব ভালো! এ তো ছাত্র রে! তা বাবা, পুলিশের খোচর-টোচর নও তো? বাবা কী করেন? বাড়িতে কে কে আছেন?” টের পেলাম কাঁধের উপর থেকে ভারী হাতটা সরে গেছে। সেই হাত এখন আমার জামার উশকোখুশকো কলারটা ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত।
আমি মামারবাড়ি যাচ্ছি - ডিসেরগড়! বাবা ডিপিএলে কাজ করেন। বাড়িতে বাবা, মা ও আমি থাকি!” ভদ্রভাবে উত্তর দিলাম।
এবার ভিড়ের মধ্যে একটা মৃদু গুঞ্জন শুরু হতেই অনুভব করলাম আমার সম্বন্ধে এদের প্রতিক্রিয়ার আমূল পরিবর্তন ঘটছে। সেই বাজখাঁই কাকু কাঁধে একটা হাত রেখে আমাকে চায়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে বসালেন যত্ন করে - তাঁর মুখের তেরিয়া ভাবটাও কোন ভোজবলে অদৃশ্য হয়ে গেছে। ভিড়টাও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আবার সেখানেই ফিরে এল।
আমার জন্য চা, কেক আর ওমলেট অর্ডার করা হলততক্ষণ চলতে লাগল প্রশ্নের বৃষ্টিধারা।
একে চেনো?” কালো-সবুজ চেক শার্টকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করা হলআমি না বলতে পরবর্তী প্রশ্ন উড়ে এল, “তাহলে এর পিছনে ছুটছিলে কেন তুমি?”
আমি দম নিয়ে তাদের পুরো বৃত্তান্তটুকু বলতে, একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল ভিড়টার মধ্যে। কেউ হতাশভাবে মাথা নেড়ে মুখে শব্দ করে বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগল। কেউ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচার অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে থাকল। বাকিরা কেউ আপশোশের প্রতিক্রিয়ায় গম্ভীর হয়ে বসে পড়ল। বাজখাঁই কাকু (পরে জেনেছিলাম তাঁর নাম ভবানীপ্রসাদ) শুধু প্রত্যেকের দিকে তাকিয়ে নিলেন একবার করে, তারপর প্রখর দৃষ্টি দিয়ে সবুজ জামাকে ফালা ফালা করে দিয়ে বললেন, “ভিতুর ডিম কোথাকার, তুই আস্ত একটা রামছাগল!” তারপর শরীর কাঁপিয়ে অট্টহাসি করে উঠলেন।
ঠিক তখনই চায়ের দোকানের মালিক আমার সামনে কালচে ঘন তিন ফুটের চা, এক ফালি কেক আর একটি ধোঁয়া ওঠা কড়মড়ে ওমলেট এনে হাজির করল।
তারপর বেঞ্চে বসে খেতে খেতে প্রায় আধ ঘন্টা ধরে শুনতে হল এক হাড় বদমাশ হুলো বেড়ালের গল্প। সেই বজ্জাত বেড়াল কীভাবে গোপালমাঠের ওই বিশেষ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে রীতিমতো আতঙ্কের বাতাবরণ সৃষ্টি করে তুলেছে। লোকজনের বাড়ি থেকে খাবার-দাবার, মাছ ইত্যাদি চুরি করা - সে তো গড়পড়তা সমস্ত বেড়ালই করে থাকে, তাতে নতুনত্ব কই? এ হুলো সকলের কান কাটে!
বাজখাঁই কাকু বলতে থাকেন, “মাঝেমধ্যেই সে নিজের মনে যেখানে সেখানে লাফিয়ে ওঠে! সেই সমস্ত দুরূহ জায়গা থেকে পথচলতি মানুষের উপর নখদাঁত বাগিয়ে লাফিয়ে পড়ে। আসবাবপত্রের উপর আঁচড় কেটে সেগুলিকে নষ্ট করে, তারপর কথা নেই বার্তা নেই, মাতালের মতো টলতে টলতে এসে দমাদ্দম মাথা ঠোকে দেয়ালে। সঙ্গে মুখে এক ভূতুড়ে ডাক! গ্রামের ভীতু মানুষ এসব দেখে অজানা আশঙ্কায় প্রমাদ গোনে” উনি থামতে আরেকজন শুরু করেন, “সেদিন হঠাৎ সে রায়বাবুর বাড়ির তেতলা থেকে এমনভাবে মাটিতে লাফিয়ে পড়েছে, যে কোনো লোক ভাববে তাকে উপর থেকে কেউ ফেলে দিয়েছে জোর করে। কিছুক্ষণ মড়ার মতো পড়ে থেকে, আশেপাশে ভিড় জমা করে, হঠাৎ করে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে গটগটিয়ে বিদায় নিয়েছে। পাড়াগাঁ তো, ধর্মভীরু মানুষজন লুকিয়ে-চুরিয়ে অপদেবতার কথাও বলাবলি শুরু করেছে। রাতবিরেতে অদ্ভুতুড়ে আওয়াজ ভেসে আসে এখান ওখান থেকে। লোকে ভয় পেয়ে একযোগে লাঠিসোঁটা নিয়ে বেরিয়ে খুঁজতে খুঁজতে দেখে পালের গোদা হল এই বিশেষ হুলোটাই
পাড়ার পূজারি ঠাকুর এবার খেই ধরলেন, “বেশ ক’দিন ধরে গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে পাখির আধখাওয়া ডানা, অর্ধেক চিবোনো মুরগির ঠ্যাং, মাছের শিরদাঁড়া, আরও সমস্ত এঁটো, রক্তমাখা অপবিত্র জিনিসপত্র পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে, যেন ইচ্ছে করে গ্রামের মানুষের পিছনে লেগেছে ওই হুলো। তা ছাড়া, দুধ চুরি, মাছ সাবাড় করা ইত্যাদি ইত্যাদি তো লেগেই আছে। গ্রামের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওকে অনেকবার গ্রামছাড়া করতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি
ক্লাবের ছেলেরা বলল, “লাঠিসোঁটায় ভয় পাওয়ানো যায়নি, চকোলেট বোমায় কাজ হয়নি। রবি বলে এক ডানপিটে ছোকরা একবার ওর ল্যাজে টিন বাঁধতে গিয়ে এমন কামড় খেয়েছে, যে সে আর এসবের ত্রিসীমানায় থাকে না। মা ষষ্ঠীর বাহন বলে এখনও পর্যন্ত তার খাবারে বিষ মেশায়নি কেউ, কিন্তু সবাই তালে তালে আছে কবে এই অসভ্য মার্জারের ভবলীলা সাঙ্গ হবে!”
ভবানীপ্রসাদ আবার শুরু করলেন, “এই অঞ্চলটা রীতিমতো পাড়াগ্রাম, তাই এখানে বিশ্বাসী অবিশ্বাসী অনেক মানুষ এই বেড়ালকে অশুভ আত্মার দূত হিসেবে কল্পনা করে রীতিমতো সন্ত্রস্ত অবস্থায় দিন গুনছেন। এর আগে একবার তাকে ধরে, বস্তাবন্দি করে কাছের রেল স্টেশনে ছেড়ে আসা হয়েছিল, কিন্তু দু’দিনের ভিতর সে কেমন করে আবার গ্রামে ফিরে আসে
“এই তো সেদিন মন্ডলবাড়িতে নাতির অন্নপ্রাশন উপলক্ষ্যে মোক্ষদা মাসি কলপাড়ে বসে ইয়া বড়ো এক দশ কিলো কালবাউশের সঙ্গে আঁশবটি নিয়ে উত্তমমধ্যম কুস্তি করছে! আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা রয়েছে নানারকমের সাবান, গায়ে ঘষার ধুধুলের খোসা, গামছা মেলা আছে এখানে সেখানে। বাড়ি ভর্তি কুটুম, কলঘরে জায়গা পাওয়া দুষ্কর!”
এই পর্যন্ত বলে এদিক-ওদিকে তাকিয়ে এক গোলগাল তরুণকে বেছে নিলেন তিনি, “আরে ছোটো মন্ডল, তুমি তো আছই এখানে, বাকিটা রসিয়ে বলো দেখি!”
ছোটো মন্ডল শুরু করল, “যেই না মোক্ষদা মাসি মাছটাকে বাগিয়ে ধরে কাটতে শুরু করেছে, পাশের গামলা ভরতে শুরু করেছে পুরুষ্টু দেড়শো-দুশো গ্রামের মাছের টুকরোয় - কোথায় ছিল হুলোটা! চোখের পলকে পাঁচিল থেকে নেমে এসে এক কামড়ে এক পিস মাছ, আর এক থাবায় একটা বিশাল ল্যাজের টুকরো নিয়ে আবার পাঁচিলের উপরে। সবাই হায় হায় করে ওঠার আগেই ব্যাপারটা ঘটল - বেড়ালটার সুতীব্র আর্তনাদে চারদিক তোলপাড় হতে লাগল! ব্যাটা বেড়াল হিসেবে বিশাল একটা গন্ডগোল করে ফেলেছে!
“বেড়াল সম্প্রদায়ের কাছে হুলোর এই কাণ্ড যথেষ্ট কলঙ্কময়! সে থাবায় করে মাছ তুলে এনেছে সত্যি, কিন্তু যেটাতে কামড় বসিয়েছে সেটা হল বিষ তেতো কালচে সবুজ এক ইয়াবড়ো মার্গো নিম সাবান! তারপর এক অশান্তি শুরু হল - হুলোর কান্নায় গ্রামের মানুষ আর ঘুমোতে পারে না! একে সাবান, তায় তেতো, তার উপর আবার ধারালো দাঁতগুলো আমূল চেপে বসেছে সাবানের ভিতর! সে এক দৃশ্য বটে! হাত-পা দিয়ে আঁচড়ে আঁচড়েও সেই সাবানের হাত থেকে নিষ্কৃতি নেই হুলোর! আর তার সঙ্গে উদ্ভট সুরে কান্না! গ্রামের মানুষ স্বস্তি পেতে ভুলে গেল হুলোর অত্যাচারে!”
মূলস্রোতে ফিরে এলেন ভবানীপ্রসাদ, “এই ঘটনার পরে চার-পাঁচ দিনের জন্য হুলো কোথায় যেন চলে গিয়েছিল সবাইকে শান্তি দিয়ে। কিন্তু যখন ফিরল তখন একেবারে টেররহয়ে ফিরল। গ্রামের লোক অতিষ্ঠ হয়ে পুলিশের কাছে, দমকলের কাছে অসহায়ভাবে ছোটাছুটি শুরু করেও কোনো সুরাহা পেল না! এরপর বাধ্য হয়েই তারা হুলোর জন্য কড়া করে ঘুমের ওষুধ মাখিয়ে খাবার সাজিয়ে রেখেছিল জায়গায় জায়গায়। প্রথম দু’দিন কাজ না হলেও, তৃতীয়দিনে শিকার টোপ গিলল। তারপর...”
এবার দুয়ে দুয়ে চার করার চেষ্টায় আমি মাঠে নামলাম, “তারপর ওকে ঘুম পাড়িয়ে, ওই ব্যাকপ্যাকে ঢুকিয়ে, ওই ছেলেটাকে দিয়ে বাসে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, এই তো? আমার জন্য সমস্তটা ভেস্তে গেল!”
কে বলেছে ভেস্তে গেছে?” পাশ থেকে সিড়িঙ্গে মতো এক বুড়ো ফুট কাটল, “তুমি তো বাপু মামারবাড়ি চলেছ! বাসে করেই যাবে - আমাদের কাজটা যখন তোমার পাকামিতে গুবলেট হতেই বসেছিল, এর সুরাহা তোমাকেই করতে হবে!”
আমি প্রবলভাবে আপত্তি করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তারপর চারদিকে তাকিয়ে যা দেখলাম, তাতে ব্যাপার মোটেই সুবিধের মনে হল না! সবাই দেখি সরু সরু চোখ করে নিষ্পলকে আমার দিকে তাকিয়ে। একটু আগে পাওয়া জামাই আদরের লেশমাত্রও দেখা যাচ্ছে না কারও চোখে-মুখে!
আমি আর কিছু বলার সাহস করি? এখন যদি টেনে একটা দৌড় লাগাই, বড়ো রাস্তা পৌঁছোতে পৌঁছোতে গণপিটুনিতে মারা যেতে পারি! তাই অসহায়ভাবে দু’হাত বাড়িয়ে অমায়িকভাবে বললাম, “কই, দিন আমাকে ব্যাগটা! আমাকেই কাজটা করতে হবে, নইলে আপনারা তো আর ছেড়ে দেবেন না!”
তা ছেড়ে ওরা দিয়ে গেল আমাকে, একেবারে বড়ো রাস্তা পর্যন্ত রীতিমতো শোভাযাত্রা করে ছেড়ে গেল। আরেকটা বর্ধমান-চিত্তরঞ্জন সুপার ফাস্ট বাসে ব্যাগশুদ্ধ উঠিয়ে দিয়ে তবে ক্ষান্ত দিল!
আমি সেই ব্যাগবন্দি, ঘুমন্ত মার্জারশ্রেষ্ঠকে ভয়ে ভয়ে কোলে নিয়ে নিয়ামতপুর পর্যন্ত এসে, ব্যাগটাকে কোনোরকমে লোকচক্ষুর আড়ালে সিটের নিচে নামিয়ে রেখেই বাস থেকে নেমে পড়েছি! রাস্তায় উলটোদিকের মোড়ে ডিসেরগড়ের মিনিবাস হাঁক পাড়ছে - বাসটা স্টার্ট দিয়ে রেখেছে, তার মানে এখুনি ছেড়ে যাবে সেটা!
কিন্তু পিছনে ও কীসের চিৎকার! শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল আমার!
ও ভাই, তোমার ব্যাগটা! এই ছেলেটা, ব্যাগটা ফেলে গেছিস! আরে ও দাদা, নিজের ব্যাগটা ফেলে দিয়ে চললেন কোথায়?” লোকজনের পায়ের শব্দ ও গলাবাজি বেড়েই চলেছে যে! জোর পায়ে হাঁটতে হাঁটতেই দিব্যি বুঝতে পারছি, ব্যাগটা ফেরত দিতে দু-একজন আমার পিছু নিয়েছে! হুঁ হুঁ বাবা, প্রাণের চেয়েও বড়ো হল কর্তব্য!!
রাস্তাটা পেরিয়ে গেছি কোনোরকমে! ডিসেরগড়ের মিনিটা গড়াতে আরম্ভ করে দিয়েছে! চেনা কনডাক্টর হাত বাড়িয়ে ডাকছে, “চলে এসো ভাইগ্না! জলদি চলে এসো!”
আমি উল্কাবেগে (এবার সত্যি করে) ছুটতে শুরু করলাম - এই বাসটা আমি কিছুতেই মিস করতে পারব না!
----------
ছবি - অতনু দেব

গল্পের ম্যাজিক:: যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা - বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়


যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা
বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

ছোটোরা যে ভাবনা-চিন্তা করে কতরকম মজার খেলা তৈরি করতে পারে, তার কোনো শেষ নেই আমিও যখন ছোটো ছিলাম তখন মজার মজার খেলার চিন্তা-ভাবনা আমার মাথাতেও আসত
ছোটোবেলায় আমার প্রিয় বন্ধু ছিল টাকলু নামটা শুনেই বোঝা যাচ্ছে টাকলু আসলে একজনের ডাকনাম ভালো নামটা আপাতত উহ্যই থাক ডাকনামেই মূল গল্পটা বলি
আমার-টাকলুর সেই ছোটোবেলায় টিভিতে রামায়ণ দেখাত বলাই বাহুল্য, বড়োদের সঙ্গে আমরা ছোটোরাও সেই টিভি সিরিয়াল দেখবার সুযোগ পেতাম রাম-রাবণের যুদ্ধে উড়ন্ত তিরের বৃষ্টি দেখে আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিল যদি আমিও বেশ এমন একটা যুদ্ধ করতে পারি কিন্তু যুদ্ধটা করব কার বিরুদ্ধে? মনে পড়ল টাকলুর কথা সেই আমার প্রিয়তম বন্ধু, আবার সেই আমার নিকটতম শত্রু তার সঙ্গেই ঝগড়া, মারামারি, আবার বন্ধুত্ব, ভালোবাসা
তির-ধনুক দিয়ে যুদ্ধের কথাটা এক বিকেলে টাকলুকে জানালাম টাকলু খানিক মাথা চুলকে জিজ্ঞেস করল, “যুদ্ধটা করবি ঠিক আছে, কিন্তু যুদ্ধের জায়গাটা কোথায় হবে? আমি কিন্তু লঙ্কা অবধি গিয়ে যুদ্ধ করতে পারব না বাড়ি থেকে অতদূর যাওয়ার অনুমতি দেবে না
আমি ওকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললাম, “কোনো চিন্তা নেই যুদ্ধটা আমাদের এই বিল্ডিঙের সামনের মাঠেই হবে এবং সকালের জলখাবার খেয়েই যুদ্ধ শুরু করে দেব দুপুরের আগেই যুদ্ধ শেষ
আমার কথা শুনে টাকলু কিছুক্ষণ ভাবল তারপর বলল, “ঠিক আছে, তাহলে যুদ্ধ করব তবে আমার একটা শর্ত আছে
“কী শর্ত?
“আমি রাম হব, তুই রাবণ
এখন, ভিলেন হতে কোনো শিশুই চায় না তার ওপর আবার এই খেলার পরিকল্পনা আমারই আমি রাবণ হতে যাব কোন দুঃখে? আমি সরাসরি মুখের উপর বললাম, “উঁহু, হবে না আমি রাম আর তুই রাবণ
টাকলু সঙ্গে সঙ্গে মুখ বেঁকিয়ে বলল, “তাহলে যুদ্ধ করব না
টাকলু এমনিতে আমার সঙ্গে প্রচুর মারপিট করলেও, সে যে এমনভাবে যুদ্ধ ছেড়ে শান্তিকামী হয়ে যাবে, এটা আমি ভাবতেও পারিনি কিন্তু কী আর করা যাবে! আমি রাবণ কোনোভাবেই হব না
দু’জনের মতের মিল যখন হল না, তখন আর যুদ্ধ হবে কীভাবে? সেদিনের মতো যুদ্ধ করার প্রস্তাব ভেস্তে গেল

কিন্তু রামায়ণের যুদ্ধের ফন্দিটা আমার মাথার মধ্যে কেমন ইঁদুরের মতো দৌড়ে দৌড়ে বেড়াতে লাগল কয়েকদিনের মধ্যে আমি একটা বুদ্ধি বের করে ফেললাম টাকলুকে বোঝালাম যে যুদ্ধের আগে কিংবা যুদ্ধ চলাকালীন কেউই রাম নয় বা রাবণ নয় যে যুদ্ধে হেরে যাবে সেই রাবণ, আর যে জিতবে সে রাম টাকলু কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “হুম তাহলে যুদ্ধ করতে পারি
ব্যস, আমাদের যুদ্ধ করার মানসিকতা ফাইনাল হয়ে গেল এবার অস্ত্র জোগাড় করার পালা আমি আর টাকলু মিলে অস্ত্র খুঁজতে বের হলাম আমাদের ফ্ল্যাটের পাশেই ছিল গাড়ির গ্যারেজ সেই গ্যারেজের পেছনে পড়ে থাকত অনেক পুরোনো লোহালক্কড় সেখানে যে বেশ কিছু লোহার তার ছিল সেটা আমি আগেই দেখেছিলাম ঠিক হল বাঁকা তারগুলোকে সোজা করে, সেগুলোয় কাপড় বা কাগজ জড়িয়ে সেগুলো দিয়ে তির তৈরি হবে এমন লোহার তার টাকলু নিল দুটো, আমিও নিলাম দুটো এবার ধনুক তৈরির পালা একটা বড়ো লোহার তার বাঁকিয়ে তাতে সুতো জড়িয়ে ধনুক তৈরির চেষ্টা হল কিন্তু আমাদের চেষ্টাটা বিশেষ সফল হল না জড়ানো সুতো বার বার খুলে খুলে আসছে
অবশেষে অনেক ভেবে ঠিক হল যে আমরা রেডিমেড ধনুক কিনে নেব কিন্তু ধনুক কোথা থেকে কেনা যাবে? সেটা আমার বা টাকলুর কারুরই জানা নেই বাধ্য হয়ে আমার মাকে জিজ্ঞেস করলাম অবশ্য আমাদের রামায়ণের যুদ্ধের পরিকল্পনার কথাটা পুরোপুরি চেপে গেলাম
মা বলল, কলকাতার সল্টলেকের কাছেই আছে ছোটোদের খেলার জায়গা বিধান শিশু উদ্যান সেখানে একজন ফেরিওয়ালা তির-ধনুক বিক্রি করে বটে
আমি নাচতে নাচতে মায়ের হাত ধরে বিধান শিশু উদ্যানে গেলাম ভাগ্য ভালো ছিল দেখলাম সেই ফেরিওয়ালা তির-ধনুক আর বাচ্চাদের বিভিন্ন খেলনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার কাছ থেকে একটা ধনুক আর তিনটে তির কেনা হল লোকটার কাছে রাক্ষসের মুখোশও ছিল কিন্তু আমি তো রাবণ হতে চাই না অগত্যা... মুখোশ বাদ

এরপর যুদ্ধের দিনক্ষণ ঠিক হল টাকলুদের ফ্ল্যাট ছিল একতলায় আমি জানতাম টাকলু কোন ঘরে থাকে নির্দিষ্ট দিনে আমি নিচে বেরিয়ে হাঁক দিলাম, “টাকলু, আমি তির-ধনুক নিয়ে রেডি তুই তোর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে আয় যুদ্ধ শুরু করি
কথাগুলো বলছি আর উত্তেজনায় আমার রক্ত টগবগ করছে সত্যি কি কোনোদিন ভেবেছিলাম যে আমিও একদিন রামায়ণের মতো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করব! আমার তির বাতাসে সাঁই সাঁই করে উড়ে শত্রুকে আঘাত করার জন্য ছুটবে!
আমার এই ভাবনাচিন্তার মাঝখানে টাকলু একটা বিরাট বড়ো পুঁটলি নিয়ে ওর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এল আমার খুব কৌতূহল হল কী আছে পুঁটলিতে?
তা পুঁটলি থেকে যা বেরোল, তাতে আমার চক্ষু চড়কগাছ টাকলুর কাছে দুটো সরু সরু লোহার তির, একটা রাংতা জড়ানো বিশাল মোটা তির এবং পাঁচটা কাঠের তির বেশ বড়ো সাইজের একটা খেলনা ধনুক তার সঙ্গে আবার একটা বড়োসড়ো গদা! টাকলু তো মহা শয়তান ছেলে দেখছি নিজেকে শান্তিকামী বলে দেখিয়ে গোপনে গোপনে বিপুল অস্ত্র মজুত করেছে! এদিকে আমার দুটো সরু লোহার তির আর তিনটে কাঠের তির
যুদ্ধ করার আগেই মনমরা হয়ে গেলাম যাই হোক, আমরা লোহার তির দিয়ে যুদ্ধ শুরু করলাম তির যদি কারোর গায়ে লেগে যায় তাহলে বিপক্ষের এক পয়েন্ট দু’জনেই এক-দুই-তিন করে গুনে তির ছুড়লাম লোহার তিরগুলো কিছুটা বাতাসে গিয়েই গোঁত্তা খেয়ে পড়ে গেল ব্যাপারটা যে ঠিক টিভিতে উড়ন্ত তিরের মতো হল না, সেটা দেখে আমরা দু’জনেই খুব হতাশ হলাম আবার দ্বিতীয়বারের জন্য তির ছোড়াছুড়ি হল এবারেও তিরগুলো মাঝপথেই ধপাস করে পড়ে গেল টাকলু এবার নিজের মোটা তিরটাকে ধনুকের সুতোয় বসিয়ে সুতোটা পেছন দিকে টানতে শুরু করল আমি ভয় মেশানো গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “ওটা কী রে?
টাকলু নির্বিকারভাবে জবাব দিল, “ব্রহ্মাস্ত্র
টাকলুর উত্তর শুনে আমার শিরদাঁড়া পর্যন্ত কেঁপে উঠল ভাবলাম, ব্রহ্মাস্ত্র তো ভয়ানক জিনিস আমি তো কোন ছার, আমাদের আশেপাশের সবকিছুও তো ওতে ধ্বংস হয়ে যাবে
আমি টাকলুকে ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এটা তুই বানালি কীভাবে?
টাকলু একটা দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, “অনেক মাল-মশলা দিয়ে বানিয়েছি
আমি এবার সত্যিই ভয় পেলাম ওকে বললাম, “ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করিস না চারপাশে আগুন-টাগুন লেগে যেতে পারে বিটকেল কাণ্ড হবে
টাকলু মহা বিচ্ছু ছেলেদের মতো বলল, “বেশ করব, ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করবই
তারপরেই সেই ঘটনা আমার মনে হল আমার মরতে আর বেশি দেরি নেই অবশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আতঙ্কে নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই আর কয়েক মুহূর্ত পরেই ব্রহ্মাস্ত্র এসে আমায় মেরে ফেলবে
টাকলু গায়ের সমস্ত জোর প্রয়োগ করে ধনুকের ছিলায় টান দিয়ে ব্রহ্মাস্ত্রকে আমার দিকে ছুড়ে দিল খুব সম্ভবত আমার অবস্থা দেখে ব্রহ্মাস্ত্রর মায়া হয়েছিল তাই তিনি বাতাসে এতটুকুও না উড়ে টাকলুর থেকে সামান্য দূরে মাটিতে ঠং-ঠং শব্দ করে পড়ে গেলেন
নিজের সেরা অস্ত্রের এই পরিণতি দেখে টাকলু রীতিমতো খেপে গেল এবং আমি পরবর্তী তিরটা টাকলুর দিকে নিক্ষেপ করার জন্য দ্বিগুন উৎসাহী হয়ে উঠলাম বেপরোয়া টাকলু এবার শরসন্ধান ছেড়ে গদা হাতে তুলে নিল তারপর রে রে করে আমার দিকে গদা হাতে তেড়ে এল
আমি টাকলুকে সতর্ক করলাম, “টাকলু, খবরদার কাছে আসবি না আমি তোর মাথা লক্ষ্য করে তির ছুড়ব কিন্তু
টাকলু খিক খিক করে হাসতে হাসতে বলল, “লাগুক মাথায় তির তবু আমি তোকে গদার বাড়ি মারব
গদার আঘাত সাঙ্ঘাতিক হতে পারে ভয়ে আমি তির-ধনুক নিয়ে কাঁপছিলাম
ঠিক সেই সময় স্বর্গের দেবীর মতো আমায় রক্ষা করলেন টাকলুর মা একতলার ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে তাঁর গলার স্বর ভেসে এল, “আবার দুধ, বিস্কুট না খেয়ে খেলতে যাওয়া হয়েছে! টাকলু, কোথায় তুই? শিগগির এসে খেয়ে যা বলছি
টাকলু নিজের মা-বাবাকে ভালোই ভয় পায় সে ছুটতে ছুটতে দাঁড়িয়ে পড়ল তারপর পেছনে ফিরতেই যাচ্ছিল, কিন্তু তার দুষ্টু বুদ্ধি যাবে কোথায় বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ গদাটা সজোরে আমার দিকে ছুড়ে দিল ভাগ্যিস আমি প্রস্তুত ছিলাম পটাং করে সরে গেলাম একপাশে প্লাস্টিকের গদা আমার ডান কাঁধের কয়েক ইঞ্চি দূর দিয়ে বেরিয়ে গেল
গদা, ব্রহ্মাস্ত্র সবই বিফলে গেল দেখে টাকলু বিমর্ষ মুখে দুধ আর বিস্কুট খেতে চলে গেল আমি এগিয়ে গেলাম গদাটার দিকে সে বেচারি আমায় আঘাত না করতে পেরে ভারী পানসে মুখে মাটিতে পড়েছিল আমি তার ধুলো ঝেড়ে তাকে নিজের ঘাড়ে তুলে নিলাম নিজের ভেতর বেশ একটা হনুমান-হনুমান ভাব এল
এমন সময় টাকলুর গলার স্বর শোনা গেল, “এই খবরদার, আমার গদায় হাত দিবি না বলে দিলাম তাকিয়ে দেখি, টাকলু এর মধ্যেই দুধের গ্লাস হাতে কখন একতলার ফ্ল্যাটের জানলায় এসে দাঁড়িয়েছে আর আমার উদ্দেশে চেঁচামেচি করছে
আমি বললাম, “বেশ করব হাত দেব তির-ধনুক নিয়ে যুদ্ধ হওয়ার কথা ছিল, তুই গদা ব্যবহার করবি কেন? যুদ্ধের নিয়মের বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য তোর গদা বাজেয়াপ্ত করা হল
টাকলু আবার চেঁচাল, “আমার গদা আমার বাড়িতে রেখে যা বলছি!
আমি নিজের ফ্ল্যাটের দিকে দৌড়োতে দৌড়োতে বললাম, “কাল বিকেলের আগে পাবি না
এইভাবে রাম-রাবণের যুদ্ধে একজন দুধ-বিস্কুটের জন্য রণক্ষেত্র ত্যাগ করায় এবং অন্যজন শত্রুপক্ষের গদা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ায় যুদ্ধ অমীমাংসিত শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হল
----------
ছবি - সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী