ম্যাজিক ল্যাম্প:: এপ্রিল ২০১৯

চতুর্থ বর্ষ।। তৃতীয় সংখ্যা।। এপ্রিল ২০১৯
বিশেষ প্রবন্ধ সংখ্যা


প্রচ্ছদঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
_____

সম্পাদকীয়:: এপ্রিল ২০১৯


ম্যাজিক ল্যাম্পের প্রিয় বন্ধুরা,

ভালো আছ তো সবাই? বেজায় গরম পড়েছে তাই না? আমি কিন্তু বৃষ্টি আনার মন্ত্র জানি কী বিশ্বাস হচ্ছে না তো? আরে ম্যাজিক ল্যাম্পের জিনি তো সবই পারে
তোমরা কী জানো, আমাদের প্রাচীন বৃষ্টির দেবতার নাম কী? যার কাছে অনেক যুগ আগে মানুষ বৃষ্টি চাইত? তিনি হলেন পর্জন্য কী জানতে না তো?
এরকম অনেক অজানা কথা তোমরা জানতে পারবে এবারের ম্যাজিক ল্যাম্পে। কারণ, এই সংখ্যাটা হচ্ছে বিশেষ প্রবন্ধ সংখ্যা কী ভাবছ? প্রবন্ধ মানেই একগাদা সিরিয়াস সিরিয়াস লেখা, গম্ভীর মুখ করে পড়তে হয় আরে না না, ম্যাজিক ল্যাম্পের এই সংখ্যার প্রবন্ধগুলো এক্কেবারে আলাদা এখানে যেমন বিজ্ঞানের অদ্ভুত সব জিনিসের কথা আছে, সেরকম ভূতেদের নানা সত্যিকারের ঘটনা আছে বিশ্বাস করা না করা তোমার ওপর আবার অনেকে নিজেদের প্রিয় সুপার হিরো চরিত্রের খুঁটিনাটি নিয়ে লিখেছে
ছোটোদের ভালো ভালো সিনেমা নিয়েও রয়েছে আলোচনা আছে পুরোনো কলকাতার গল্প চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কলমে, প্রাচীন কালের ব্যাবসা বাণিজ্যের কথা রবীন্দ্রনাথ হালদারের কলমে হিমালয় অভিযানের কথা, ছোটোবেলার মজার মজার সব গল্প বঙ্কিম পুরস্কারপ্রাপ্ত বর্ষীয়ান সাহিত্যিক শ্রী চিত্ত ঘোষাল লিখেছেন নাক নিয়ে বড়ো মজার একটি লেখা।
তাহলে দেরি না করে পড়তে শুরু করে দাও আর আমাদের জানাও কেমন লাগল এবারের এই অন্যরকম সংখ্যাটা
ভালো থেকো ভালোবাসা নিও
ইতি,
জিনি
_____

প্রবন্ধ:: রহস্য যখন দানা বাঁধে - অনন্যা দাশ


রহস্য যখন দানা বাঁধে
অনন্যা দাশ

গার্গী রায় আর তার ষোলো বছরের মেয়ে রিয়া জুলাই মাসের শেষে প্রচন্ড গরমের এক দিনে প্যারিসে এসে পৌঁছলেন। বেশ কিছু দিন ধরেই ইউরোপ ট্যুর করে বেড়াচ্ছেন মা ও মেয়ে। রিয়ার বাবা অনেক দিন আগে গত হয়েছেন, তাই মা-মেয়ে মিলেই সব জায়গায় যায় ওরাএদিকে ছুটি প্রায় শেষ, তাই বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে, কিন্তু গার্গী দেবীর শরীরটা তেমন ভালো বোধ হচ্ছিল না বলে উনি ঠিক করলেন প্যারিসে দু’দিন বিশ্রাম করে তারপর রওনা হবেন।
প্যারিসে সব সময় প্রচুর ভিড়। ট্যুরিস্টে শহর ভর্তি। তাও ভাগ্যক্রমে রিয়া চেষ্টা করে একটা ভালো হোটেলই জোগাড় করে ফেলল থাকার জন্যে। ওদের ঘরটাও ভারি সুন্দর। জানালা দিয়ে পাশের একটা পার্ক দেখা যাচ্ছে। হালকা হলুদ দেওয়ালের রঙ, নীল কার্পেট আর সুন্দর সাদা রঙের আসবাবপত্র।
গার্গী দেবীর শরীরটা এতটাই খারাপ লাগছিল যে উনি ঘরে ঢুকেই বিছানায় শুয়ে পড়লেন। ওনাকে দেখে এমন দুর্বল আর ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল, রিয়া ভয় পেয়ে হোটেলের ডাক্তারকে ডেকে পাঠাল। রিয়া ফ্রেঞ্চ জানে না মোটেই, ভাগ্য ভালো ডাক্তার ভালো ইংরেজি জানতেন।
গার্গী দেবীকে পরীক্ষা করে ডাক্তার বললেন, “তোমার মা’র তো বেশ গুরুতর অসুখ। কাল সকালেই ওনাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। আপাতত উনি ঘুমোন, আমি তোমাকে কয়েকটা ওষুধের নাম লিখে দিচ্ছি। তুমি হোটেলের গাড়িটা নিয়ে চলে যাও। আমার বাড়িতেই আমি রুগি দেখি, সেখানে বেশ কিছু ওষুধের স্যাম্পেল আছেআমার স্ত্রী সেগুলো তোমাকে দিয়ে দেবেন। ওষুধগুলো বেশ দামি, তুমি এই বিদেশ বিভুঁইয়ে কোথায় খুঁজতে যাবে,” বলে ডাক্তার নিজের স্ত্রীকে ফোন করে ফ্রেঞ্চে কী সব বলে রিয়ার হাতে একটা প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিলেন।
হোটেলের ম্যানেজার ভদ্রলোক রিয়ার জন্যে একটা ট্যাক্সি ডেকে দিলেন। ড্রাইভারকে ফরাসি ভাষায় কিছু বলে দিলেন। রিয়াকে বললেন, “ও ইংরেজি জানে না, তবে তোমার কোনও অসুবিধা হবে না। আমি ওকে সব বুঝিয়ে দিয়েছি। ও ঠিক তোমাকে ডাক্তারের বাড়িতে নিয়ে যাবে আর আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। বেশি দূর নয় মোটেই।”
ড্রাইভার রিয়াকে নিয়ে চলল। প্রথম থেকেই রিয়ার মনে হচ্ছিল লোকটা বড্ড আস্তে আস্তে চালাচ্ছে। ওর স্থির বিশ্বাস লোকটা একই পথ দিয়ে ওকে বেশ কয়েকবার নিয়ে গেল। ওর ধৈর্যের বাঁধ যখন প্রায় ভেঙ্গে যাচ্ছিল তখন শেষমেশ ডাক্তারের বাড়ির সামনে গাড়িটাকে দাঁড় করাল লোকটা।
ডাক্তারের স্ত্রী ওকে প্রায় দশ মিনিট বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে তবে দরজা খুললেন। তারপর রিয়াকে ডাক্তারের চেম্বারে বসিয়ে রেখে উনি হাওয়া হয়ে গেলেন। রিয়া বসে বসে ভাবতে লাগল, “এত সময় কেন নিচ্ছেন উনি? একটু তাড়াতাড়ি করতে পারছেন না? প্লিজ তাড়াতাড়ি করুন!” এদিকে ভিতর থেকে ক্রমাগত ফোন বাজার শব্দ আসছে। কারা সব কথা বলছে। একবার রিয়ার মনে হল ডাক্তারের গলাও শুনতে পেল! কী হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছিল না রিয়া। ওষুধগুলো খুঁজে বার করতে ওনার প্রায় এক ঘন্টার ওপর লেগে গেল।
ফেরার পথে ড্রাইভারটা যেন আরও মন্থর গতিতে চালাচ্ছিল। একটা রাস্তা থেকে আবার আরেকটা রাস্তা। রিয়া ওষুধগুলোকে শক্ত করে ধরে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে পিছনের সিটে বসেছিল। সব কিছুতে এত বেশি সময় লাগছে কেন?
হঠাৎ ওর মনে হল গাড়ির ড্রাইভার একেবারে উলটো দিকে চলেছে।
রিয়া ওকে জিজ্ঞেস করতে চেষ্টা করল, কিন্তু লোকটা কোনও উত্তর দিল না। রিয়া দেখল, এ তো মহা বিপদ। একটা লাল বাতিতে গাড়িটা যখন থামল, তখন সে চট করে দরজা খুলে নেমে পড়ে ছুটে পালাল।
কিছু দূর গিয়ে ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক মহিলাকে ধরল সে। হোটেলের নাম ঠিকানা দিয়ে কী করে সেখানে পৌঁছতে হবে জিজ্ঞেস করল। সেই মহিলা আবার ইংরেজি জানতেন না, তবে দুয়েকজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করতে তাদের মধ্যে একজন ইংরেজি জানা লোক বেরিয়ে পড়ল। সত্যিই রিয়াকে নিয়ে ড্রাইভার উলটো পথেই যাচ্ছিল!
শেষমেশ যখন হোটেলে পৌঁছল রিয়া তখন সন্ধে প্রায় হয়ে গেছে। রিসেপশনে গিয়ে রিয়া বলল, “আমার নাম প্রিয়াঙ্কা রায়। আমি আর আমার মা রুম ৫০৫এ আছি। আমার ঘরের চাবিটা চাই।”
লোকটা হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকাল, তারপর খাতায় কী একটা দেখে-টেখে বলল, “না, ওই ঘরে তো অন্য এক দম্পতি রয়েছেআপনি ঠিক হোটেলে এসেছেন তো?” বলে সে পাশে দাঁড়ানো অন্য একজনকে সাহায্য করতে লাগল। রিয়া ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করল। অন্যজন চলে যেতে সে রিসেপশনের লোকটাকে বলল, “দেখুন, আমরা আজ সকালেই এখানে এসে উঠেছি। আপনিই আমাদের ওই ঘরটা দিয়েছিলেন, ভুলে গেলেন?”
এবার লোকটা এমন করে ওর মুখের দিকে তাকাল যেন ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে, তারপর বলল, “দেখুন আপনি ভুল করছেন। এই শহরে অজস্র হোটেল, আপনি নিশ্চয়ই অন্য কোনও হোটেলে উঠেছেন, কারণ আমি আপনাকে কোনোদিন দেখিইনি। আমার স্থির বিশ্বাস, আপনি ভুল হোটেলে চলে এসেছেন।”
রিয়া ওকে ফাইল দেখতে বলল। ওরা ঘরে যাওয়ার আগে ওদের দিয়ে একটা ফর্মে সই করানো হয়েছিল, সেই ফর্মটা খুঁজতে বলল, কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না। লোকটা আবার বলল, “ম্যাডাম, আপনি ভুল হোটেলে চলে এসেছেন!”
রিয়া তখন বুদ্ধি করে বলল, “আপনাদের হোটেলের ডাক্তার আমাকে চিনবেন। উনি আমার মা’র চিকিৎসা করছিলেন। উনিই আমাকে ওষুধের স্যাম্পেল আনতে ওনার বাড়ি পাঠিয়েছিলেন। দয়া করে ওনাকে একবার ডেকে পাঠান।”
ডাক্তারবাবু লবিতে এলেন। রিয়া ওনাকে দেখে বলল, “এই যে ডাক্তারবাবু, মা’র জন্যে যে ওষুধগুলো আনতে বলেছিলেন সেগুলো নিয়ে এসেছি। আপনার স্ত্রী দিলেন।”
ডাক্তার ভ্রু কুঁচকে বললেন, “আমি তো আপনাকে আগে দেখিইনি। আপনি নিশ্চয়ই ভুল হোটেলে ঢুকে পড়েছেন!”
রিয়া হোটেলের ম্যানেজারকেও ডেকে পাঠাল, যিনি ওর জন্যে গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তিনিও ওকে দেখে চিনতে পারলেন না, বললেন, “আপনি মনে হয় ভুল হোটেলে ঢুকে পড়েছেন। যাক, আমাদের ঘর খালি আছে। আমি আপনাকে একটা ঘর দিয়ে দিচ্ছি, আপনি সেখানে গিয়ে একটু বিশ্রাম করুন।”
“আমি আমাদের ঘরটা দেখতে চাই!” রিয়া চিৎকার করে বলল, “রুম নং ৫০৫!”
ওরা তখন ওকে ৫০৫-এ নিয়ে গেল। ওমা, ঘরটা একেবারেই অন্যরকম। দুটো খাটের বদলে একটা বড়ো খাট। আসবাবপত্র সব কালচে রঙের, সাদা নয়। কার্পেটটা সবুজ, নীল নয়, দেওয়ালের রঙ বরং নীল। আলমারিতে অন্য কার জামাকাপড় রাখারিয়াদের ঘরটা হাওয়া আর সঙ্গে ওর মা-ও!
রিয়া এবার কেঁদে ফেলল, “নাহ, এই ঘরটা তো নয়! আমার মা কোথায়? তাকে কী করেছ তোমরা?”
ওরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল, তারপর ম্যানেজার লোকটা বলল, “আপনি ভুল হোটেলে চলে এসেছেন ম্যাডাম!” ঠিক বাচ্চাদের সঙ্গে যেভাবে বড়োরা কখনও কথা বলে তারা দুষ্টুমি করলে, সেই রকম ভাবে।
রিয়া এবার পুলিশের কাছে গেল। তাদের বলল, “আমার মা, আমাদের জিনিসপত্র, ঘর, সব কিছু হাওয়া হয়ে গেছে!”
“আপনি ঠিক জানেন আপনারা ওই হোটেলেই উঠেছিলেন?” পুলিশের লোকজন জিজ্ঞেস করল।
রিয়া এমব্যাসিতে গেল সাহায্যের জন্যে। তারাও ওই এক কথাই বলল, “আপনি ঠিক জানেন ওই হোটেলেই আপনারা উঠেছিলেন?”
রিয়ার মনে হল, বুঝি বা ওর মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে!
“আপনি একটু বিশ্রাম নিন ম্যাডাম!” ওরা বলল, “তাহলে হয়তো আপনার সব মনে পড়ে যাবে!”

#             #             #             #

আসলে রিয়ার মনে পড়ার মতো কিছু ছিল না, এমন কিছু ঘটেছিল যা ও জানত না।
রিয়ার মা’র কী হয়েছিল?
ডাক্তার রিয়ার মা-কে দেখেই বুঝেছিলেন, মারাত্মক ছোঁয়াচে একটা রোগ হয়েছে ওনার। এক ধরনের প্লেগ যা ভয়ঙ্কর সংক্রামক এবং খুব দ্রুত মহামারীর আকার নিতে পারে।
উনি ভাবলেন, যদি লোকে জানতে পারে যে প্যারিসের বুকে একটা হোটেলে ওই রোগ দেখা গেছে তাতে অস্বাভাবিক ভীতির সৃষ্টি হবে লোকের মনে। ওই হোটেলে তো আর কেউ থাকতে চাইবেই না, এমনকি প্যারিস থেকে লোক পালাবে দলে দলে। হোটেলের মালিকরা কী চাইবেন ডাক্তার জানতেন। ব্যাপারটা জানাজানি হলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। হোটেলের মালিকদের লক্ষ লক্ষ টাকার লোকসান হবে। তাই উনি ঘটনাটাকে ধামা চাপা দেওয়ার জন্যে যা যা করা উচিত তাই করলেন।
রিয়াকে পথ থেকে সরিয়ে ফেলার জন্যে ওকে শহরের অন্যদিকে পাঠিয়ে দেওয়া হল হাবিজাবি ওষুধ আনার চক্করে। উনি যেমনটা ভেবেছিলেন ঠিক তাই হল, রিয়া চলে যাওয়ার একটু পরেই গার্গী দেবীর মৃত্যু হল। ওনার দেহটাকে দ্রুত পুড়িয়ে ফেলা হল, আর একদল লোক যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের ঘরটার চেহারা পালটে ফেলল। সব কিছু অন্য রকম হয়ে গেল।
রিসেপশনের লোক এবং হোটেলের ম্যানেজারকে বলে দেওয়া হল, তারা যেন রিয়াকে না চেনার ভান করে, আর অন্যরা যারা জানল তাদেরও বলা হল কেউ মুখ খুললেই তার চাকরি যাবে।
শহরে আতঙ্ক যাতে না ছড়ায়, তাই পুলিশের কর্তারা এবং অন্যরাও কিছু করলেন না। রিয়ার মা আর ওদের ঘরটা যেন মিলিয়ে গেল প্যারিসের বুক থেকে।

#            #            #            #

এইমাত্র যে গল্পটা তোমরা পড়লে সেটার নামহয়তো মনে পড়বে’ এবং সেটা অ্যালভিন শোয়ার্টজের (এপ্রিল ২৫, ১৯২৭ মার্চ ১৪, ১৯৯২) লেখা গল্পমে বি ইউ উইল রিমেম্বার’-এর অনুবাদ অ্যালভিন শোয়ার্টজ কিশোর এবং অল্পবয়সি পাঠকদের জন্যে প্রাচীন উপকথা, লোককথা ঘেঁটে গল্প লিখতে ভালোবাসতেন, যাতে তারা সেই সব গল্প জানতে পারে। নিজের পছন্দ মতো একটু-আধটু বদলও অবশ্য উনি করে দিতেন।
এই গল্পের আরেকটা সংস্করণ আছে, যাতে রিয়া আর ওর মা আলাদা আলাদা ঘরে ছিলরাতে গার্গী দেবীর মৃত্যু হয়। ওনার দেহটা সরিয়ে ফেলে রাতারাতি ঘরটার চেহারা পালটে ফেলা হয়। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে রিয়া মা-কে দেখতে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করে – তখন তাকে বলা হয় যে সে তো একাই এসে হোটেলে উঠেছিল, ওর সঙ্গে কেউ ছিল না!
অনেকদিন পর কোনও এক বন্ধুর, বা আত্মীয়র বা রিয়ার নিজেরই ওই হোটেলের কোনও এক কর্মচারীর সঙ্গে দেখা হয় এবং সে কিছু টাকার বিনিময়ে সত্যি কথাটা বলে।
এই গল্পের ওপর একটা সিনেমা হয়েছে – ‘সো লং অ্যাট দা ফেয়ার’ (১৯৫০) এবং দুটো উপন্যাসও লেখা হয়েছে, তার মধ্যে একটা ১৯১৩ সালে! তার মানে তখন থেকেই সবাই জানত এই গল্পটার কথা। ১৯১১ সালে এই সত্যি ঘটনাটি বেরিয়েছিল লন্ডনের ‘ডেইলি মেলে’ এবং ১৮৮৯ সালে ডেট্র্যেটের ‘ফ্রি প্রেসে’।
তাহলে বুঝতেই পারছ, রহস্য গল্পের প্রতি মানুষের টান চিরকালের যদিও বলা হয়, রহস্য গল্পের সাহিত্য অন্য ধরনের ইংরেজি সাহিত্যের তুলনায় অনেকটাই শিশু অবস্থায়, কারণ তার জন্ম মোটে ২০০ বছর আগে। পৃথিবীর শহরগুলোতে লোকসংখ্যা বাড়তে অপরাধও বেড়ে চলে এবং পুলিশ যখন সক্রিয় হতে শুরু করে তখনই জন্ম নেয় রহস্য এবং রহস্যের সমাধান করার প্রয়োজন সত্য ঘটনা থেকে গল্প লেখা শুরু হয় মানুষের মনোরঞ্জনের জন্যে। মানুষের মধ্যে পড়াশোনার চল বাড়তে তাদের চিন্তা করার ক্ষমতা বাড়ে এবং নানা রকমের ‘প্লটের’ চিন্তা তার মাথায় আসতে থাকে। প্রথম প্রথম রহস্য গল্পে ‘সুপার স্লিউথ’ বা ডিটেকটিভ ব্যাপারটা ছিল না। সেটা পরে আসে। তবে একটা ধারা সব রহস্য কাহিনীর মূল মন্ত্র, তা হল দুষ্টের দমন এবং সত্যের জয়।
১৭৪৮ সালে ভল্টেয়ার তার জাদিগ লেখেন। সেটাকেই অনেকে প্রথম রহস্য গল্প বলে। এর পর আসেন ই টি এ হফম্যান (১৭৭৬ - ১৮২২) যিনি জার্মান ভাষায় রহস্য, ফ্যান্টাসি মেশানো লেখা লিখতেন, এডগার অ্যালেন পো (১৮০৯ - ১৮৪৯) যাঁকে ডিটেকটিভ গল্পের জনক বলা হয়, উইল্কি কলিন্স (১৮২৪ - ১৮৮৯) যাঁর লেখা ‘মুনস্টোন’ বা উওমান ইন হোয়াইট’ আজও বিখ্যাত, ইত্যাদি।
১৮৬৬ সালে ফরাসি লেখক এমিল গাবোরিয়ো লিখেছিলেন ‘লাফ্যার লারুজ’এটাই ছিল ওনার প্রথম ডিটেকটিভ উপন্যাস। এই উপন্যাসেই উনি নিয়ে আসেন একজন অ্যামেচার ডিটেকটিভ আর এক তরুণ পুলিশ অফিসারকে। সেই পুলিশ অফিসার ওনার শেষের দিকের উপন্যাসগুলোর নায়ক ছিল।
শার্লক হোমসের জনক স্যার আর্থার ইগ্নেশিয়াস কোনান ডয়েল (২২ মে ১৮৫৯ - ৭ জুলাই ১৯৩০) ছিলেন একজন স্কটিশ ডাক্তার, কিন্তু তাঁর লেখার হাত ছিল অসাধারণ, আর সেই সঙ্গে মানানসই কল্পনাশক্তি। ওনার তৈরি চরিত্র শার্লক হোমস পৃথিবীবিখ্যাত। তাকে নিয়ে সিনেমা, নাটক, মিউজিয়াম কী না হয়েছে! ১৮৮৭-এ হোমসকে প্রথম সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন কোনান ডয়েল, কিন্তু হোমসের মতন ডিটেকটিভ আজও মেলা ভার! আর কত রকম পেঁচালো কেস তার। হোমসের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার সঙ্গে বন্ধু ওয়াটসনের সাধারণ বুদ্ধি কিন্তু অপরিসীম বন্ধু প্রীতি কার না ভালো লাগে? ওনার অসাধারণ সব লেখার জন্যে আর্থার কোনান ডয়েলকে ১৯০২ সালে নাইটহুড দিয়ে ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়
১৯২০ থেকে ১৯৩০ সময়টাকে বলা হয় ডিটেকটিভ উপন্যাসের স্বর্ণযুগ। এই সময় প্রচুর রহস্য গল্প লেখক-লেখিকারা উঠে আসেন, যাঁদের নাম আজও আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। এই সময় চারজন মহিলা লেখিকা জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছিলেন, তাঁদের বলা হত ‘কুইন্স অফ ক্রাইম’ – আগাথা ক্রিস্টি, ডোরোথি এল সেয়ার্স, নাইওউ মার্শ, মার্জারি অ্যালিংহ্যাম। আগাথা ক্রিস্টি (১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৯০ - ১২ জানুয়ারি ১৯৭৬) তাঁর ডিটেকটিভ এরকিউল পোয়রো কে নিয়ে ৩৩টি উপন্যাস এবং ৫৪টি বড়ো গল্প লেখেন। বয়স্ক মহিলা গোয়েন্দা জেন মার্পেলকে নিয়ে লেখেন ১২টি উপন্যাস। এ ছাড়াও রয়েছে অনেকগুলো উপন্যাস, যেখানে নায়ক নায়িকা হিসেবে হয় টমি টাপেন্স রয়েছে বা একদম আনকোরা কেউ যে/যারা বুদ্ধির জোরে দুম করে একটা রহস্যের সমাধান করে ফেলছে। আগাথা ক্রিস্টির বেশ কিছু রহস্য উপন্যাস আজও বেস্ট সেলার লিস্টে থাকে।
শিশু-কিশোরদের জন্যে সুন্দর রহস্য গল্প লিখেছেন এনিড ব্লাইটন (ওনার অনেকগুলো রহস্য অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ আছে – ফ্যাটির দল [ফাইভ], ফেমাস ফাইভ, সিক্রেট সেভেন ইত্যাদি) ফ্র্যাঙ্কলিন ডব্লু ডিক্সন আর কারোলিন কীন ছদ্মনামে বেশ কিছু লেখক কিশোর-কিশোরীদের জন্যে রহস্য গল্প লিখেছেন তাঁদের লেখা হার্ডি বয়েজ ও ন্যান্সি ড্রিউইয়ের উপন্যাস আজও বেশ জনপ্রিয়
ইংরেজি সিনেমায় রহস্যের বিপ্লব ঘটান অ্যালফ্রেড হিচকক (১৩ আগস্ট ১৮৯৯ - ২৯ এপ্রিল ১৯৮০)। ওনার তৈরি সিনেমা ‘সাইকো’, ‘দ্য রোপ’, ‘রিয়ার উইন্ডো’, ‘ভার্টিগো’, ‘সাউথ বাই সাউথ-ওয়েস্ট’ ইত্যাদি রহস্য সিনেমায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
বাংলায় প্রথম মৌলিক ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখেছিলেন পাঁচকড়ি দে। এনার বেশির ভাগ লেখাই উপন্যাস। ডিটেকটিভ গল্প উনি বেশি লেখেননি। উনি প্রধানভাবে অনুকরণ করেছিলেন ইংরেজ লেখক উইল্‌কি কলিন্স এবং ফরাসি লেখক এমিল গাবোরিয়োকে। বাংলাভাষায় নতুন ধারায় ডিটেকটিভ গল্প-কাহিনী পাঠকদের সামনে নিয়ে আসেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩২)ওনার গল্পের নায়ক সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে তো আজও মাতামাতি হয়। শখের ডিটেকটিভ হিসেবে ব্যোমকেশের মতন শ্রী সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদাও (প্রদোষ চন্দ্র মিত্র) প্রচন্ড সফল। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এদের দু’জনেরই মোক্ষম হাতিয়ার। বলা বাহুল্য ব্যোমকেশ আর ফেলুদাকে নিয়ে অজস্র সিনেমা হয়েছে এবং হয়েই চলেছে। জনপ্রিয় মহিলা গোয়েন্দা বলতে তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গার্গী বা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মিতিনমাসি আর টুপুর।
এখন তো ইংরেজি বাংলা সব সাহিত্যেই রহস্য গল্পের ছড়াছড়ি। প্রচুর মামা, কাকা, দাদারা কোমর বেঁধে দলে দলে রহস্য অনুসন্ধানে নেমে পড়েছেন পাঠকদের কৌতূহলের খিদে মেটাতে!
‘হুডানিট’ (হু ডান ইট থেকে সংক্ষিপ্ত করা) হল রহস্য গল্প লেখার সবচেয়ে জনপ্রিয় পন্থা। এই রকম কাহিনিতে প্রথমেই অপরাধটাকে বেশ ফলাও করে দেখানো হয়। কারা সাসপেক্ট, তাদের অ্যালিবাই, মোটিভ, কী ক্লু, সেই সব নিয়ে আলোচনা করা হয়। এবং তদন্তটাকে এমনভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় যাতে অপরাধী কে সেটা যেন একদম না বোঝা যায়। অপরাধীর পরিচয় এবং তার ওই অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কারণ আমরা জানতে পারি একদম শেষ পরিচ্ছেদে টানটান উত্তেজনায়।
রহস্য গল্প আরেক রকম ভাবে লেখা হয়ে থাকেসেখানে অপরাধীকে আমরা আগেই চিনে ফেলি। জেনে যাই সে কেন কুকীর্তিটা করেছিল। গল্পটা চলতে থাকে তাকে কী ভাবে ধরা হল সেই নিয়ে। এখানেও জমজমাট উত্তেজনার ঘাটতি হয় না।

রহস্য গল্প পাঠকরা পছন্দ করে, এই ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যেতে সব রকম গল্পে রহস্য ঢুকে পড়েছে - কল্প বিজ্ঞানে রহস্য, ফ্যান্টাসি গল্পে রহস্য, মেডিকাল ফিল্ডে রহস্য, ঐতিহাসিক রহস্য। যতদিন ছোটো বড়ো সবার মনের মধ্যে অজানাকে জানার কৌতূহল, আর জটিল জট ছাড়ানোর আনন্দ থাকবে ততদিন রহস্য গল্প থাকবে, আর থাকবে শার্লক হোমস বা ফেলুদার মতন ডিটেকটিভরা সত্যের প্রতীক হয়ে, আমাদের অন্ধকারে পথ দেখিয়ে আলোর দিকে নিয়ে যাবে।

                                   

রহস্য গল্প পড়তে ভালো লাগে কেন?
পাঠকরা কী বলে?


দেবাঞ্জন দেব (উত্তরপাড়া চিলড্রেন্স ওন হোম, দ্বাদশ শ্রেণি)
ছোটোবেলা থেকেই রহস্য ব্যাপারটা আমায় চুম্বকের মতো টানে একটা অন্য ধরনের উত্তেজনা বোধ করি রহস্য গল্প পড়ার সময় অন্ধকার একটা রাস্তা যার চারিদিকে রহস্যের ছড়াছড়ি, একসময় অন্ধকার কেটে ভোর হয় তারপর রহস্যের কুয়াশা সরে গিয়ে পরিস্কার রাস্তা দেখা যায় টানটান উত্তেজনার সঙ্গে বুদ্ধির কৌশলে রহস্যকে কিস্তিমাত করে রহস্য সমাধান করার পদ্ধতি অসাধারণ লোভনীয় আমার কাছে


তন্ময় বিশ্বাস (আসানসোল)
থ্রিল, কোষে শীতল স্রোত, টান টান উত্তেজনা। এই একই প্রশ্নের, এই একই উত্তরগুলো সেই কবে থেকে চলে আসছে। এতদিনে বোধহয় এক্সপায়ার ডেটও পেরিয়ে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উত্তরগুলো বদলে বদলে যায়, প্রশ্ন তো সেই একই থাকে। পৃথিবী চরম সংসারী (স্থির)? নাকি ভবঘুরে? সেই বছর গোনার আগে থেকে প্রশ্নটা আসছে। উত্তর কি এক আছে? হ্যাঁ, সত্যি বড্ড বাজে বকছি কারণ, রহস্য গল্প কেন পড়ি, তার উত্তর আমারও জানা নেই। সব ভালো লাগার কারণ খুঁজতে নেই। আর ওই টান টান উত্তেজনা, এক নিঃশ্বাসে পড়ে যাওয়া, গায়ের লোম খাড়া করে দেওয়া - ওই সব থোড় বড়ি খাড়া উত্তর দিতে একদম ইচ্ছে করছে না। জাস্ট ভালো লাগা। রহস্যের মধ্যে ঢুকে পড়া। নিজের মগজটাকে একটু দৌড় করানো, আর গোয়েন্দার আগে ক্রিমিন্যালকে ধরে ইয়ে ইয়ে করে লাফানো ! ব্যস, আর কী? আর কিছু থাকলেও জানি না। সব ভালো লাগার কারণ খুঁজতে নেই!


শ্রীপর্ণা ব্যানার্জী (ডালাস, টেক্সাস, ইউ এস এ)
অজানা যে কোনও জিনিস মানুষকে খুব আকর্ষণ করে... কিছু ঘটনা যেটা অজানায় ঢাকা, সেই কৌতূহল খুব আকর্ষণের বিষয় এই কারণেই রহস্য গল্প বাচ্চা থেকে শুরু করে যে কোনও বয়সের মানুষকে খুব টানে, আমাকেও


রাজর্ষি সরকার (কাটোয়া)
রাইকেনবাগ ফলস, দুটি মানুষ – ধ্বস্তাধ্বস্তি – একজন প্রফেসর মরিয়র্টি, অন্যজন – না, বলার আর দরকার নেই, অন্যজন বিশ্ববিশ্রুত শার্লক হোমস। ....২২১বি বেকার স্ট্রিট হোক, বালিগঞ্জের ২৭ রজনী সেন রোড বা হ্যারিসন রোড, এই ঠিকানাগুলি বলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে এক একটি চরিত্র। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার মধ্যে গোয়েন্দা গল্পের পাঠকসংখ্যা বা জনপ্রিয়তা সর্বদাই তুঙ্গে। হিসেব করে দেখা গেছে এডগার অ্যালান পো থেকে শুরু করে ১৯২০ পর্যন্ত ইংরেজি ভাষায় লেখা হয়েছে ১৩০০ মতো গ্রন্থ, কিন্তু ১৯২১ থেকে ১৯৪০  পর্যন্ত আট হাজার ডিটেক্টিভ ফিকশন।রহস্য উপন্যাসের এই ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কারণ কী? অনেকসময় আমরা দেখি আপাত নিরীহ একজন কিন্তু গোয়েন্দা গল্পের একনিষ্ঠ পাঠক। যতই অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে ততই বাড়ছে রুদ্ধশ্বাসে গল্প পড়ার আগ্রহ। আসল কথা হল আমাদের সকলের মধ্যেই নায়ক বা রক্ষাকর্তা বা ত্রাতা হওয়ার সুপ্ত বাসনা থাকে। তাই যখন আমরা অপরাধের খবর পাই, মনে হয় ঘটনার তদন্ত করে অপরাধীকে সনাক্ত করি, কিন্তু আমরা অধিকাংশ সাধারণ মানুষ, সাধ থাকলেও সাধ্য নেই, তাই আমাদের ইচ্ছাপূরণের জন্যই সৃষ্টি হয় কতগুলি প্রতীকী চরিত্রের হোমস, এরকুল পোয়ারো, ফেলুদা, ব্যোমকেশ, কিরীটী প্রমুখ। বাংলা সাহিত্যে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, পাঁচকড়ি দে, ব্যোমকেশ, ফেলুদা থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের মিতিন মাসি বা অর্জুন - গোয়েন্দার প্রজন্মের বা তদন্ত পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটলেও আজও বর্তমান সময়ের সাহিত্যিকবৃন্দ গোয়েন্দা কাহিনি রচনায় ব্যাপ্ত আছেন। প্রশ্ন করা হয়ে থাকে গোয়েন্দা গল্প কেন পড়ি এবং কী লাভ হয়? পড়ার প্রধান কারণ হল আমরা উৎকন্ঠা রোমাঞ্চ রহস্য প্রভৃতির স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে ভালোবাসি। মন নিয়ে এই ছেলেখেলা, এই অনাবিল আনন্দ লাভই উদ্দেশ্য। দ্বিতীয়ত পাঠকবর্গের মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য অপরাধ করলে শাস্তি অবশ্যম্ভাবী এই নীতিকথা দৃঢ়ভাবে গেঁথে দেয় গোয়েন্দা কাহিনি। গোয়েন্দা কাহিনি কখনোই একতরফা হয় না, এখানে সবসময়ে গোয়েন্দা ও অপরাধীর মধ্যে চলে বুদ্ধির দ্বৈরথ। গল্পের উত্তেজনায় সহজেই নিজেকে গোয়েন্দা চরিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে অনুসন্ধানে লেগে পড়িতেমনই গোয়েন্দা গল্প অবশ্যই শিক্ষনীয়, যেমন ফেলুদার গল্প পড়েই আমরা জানি রাজস্থান, বেনারস থেকে শুরু করে লন্ডনের বর্ণনা, তেমনই আমরা জানতে পারি বাদ্যযন্ত্র বেহালার ইতিহাস থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ের চমকপ্রদ তথ্য। ফেলুদার ফোটোগ্রাফিক মেমোরি হোক বা ব্যোমকেশ-এর পর্যবেক্ষন শক্তি, সব ক্ষেত্রেই আমরা একজন আদর্শ রোল মডেলকে পাই রহস্যের যথাযথ সঠিক ব্যাখা না পেলে কখনোই মন শান্ত হয় না এবং গোয়েন্দা যে সত্যের জয়ধ্বজা বাহক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একবার শার্লক হোমসের মৃত্যু ঘটলেও পাঠকদের চাপে তাকে লেখক ফিরিয়ে আনেন বাধ্য হয়ে। মানুষের মনে চিরসবুজ থাকবে এই গোয়েন্দারা, না হলে বয়স তো কেবলমাত্র সংখ্যার মারপ্যাঁচ। শেষে লালমোহন বাবুর ভাষায় বলতেই হয় ‘পাঠক মনে এদের সর্বদা আনাগোনা, কে বলবে এরা কেবল স্রষ্টার কল্পনা?’
_____

প্রবন্ধ:: নাকের কথা - চিত্ত ঘোষাল


নাকের কথা
চিত্ত ঘোষাল

নাক আমাদের খুব দরকারি একটা জিনিস। নাক দিয়ে আমরা নিঃশ্বাস নিই, তবে পাই অক্সিজেন, তবে আমরা বাঁচি। কী বললি বিশে, মুখ দিয়েও নিঃশ্বাস নেওয়া যায়? নিয়ে দ্যাখ না, দশ মিনিট পরে গলা খর খর করতে থাকবে, শুকিয়ে কাঠ। নাক দিয়ে আমরা গন্ধ পাই। খারাপ গন্ধে ‘অ্যা, মা গো’ বলে সরে যাই। ভালো গন্ধে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলি – আহ...! আশ্চর্য এই কাজটা করে নাকের ভেতরে থাকা অলফ্যাকটরি নার্ভ – গন্ধ বোঝে যে স্নায়ু।
থাক ওসব জ্ঞানের কথা। নাককে আমরা কত ভালোবাসি কী দিয়ে তা বোঝা যায় বলো তো? কথায় কথায় আমরা নাককে টানি, তাই দিয়ে বোঝা যায় নাকের সঙ্গে আমাদের ভালোবাসা। ধরো, বড়োদের গল্পগাছা চলছে, তার মধ্যে তুমি হুট করে কিছু বলে বসলে। অমনি বাবা বললেন, অ্যাই, তুই বড়োদের কথায় নাক গলাস কেন? নাক গলানো বলা হল কেন? নাকের ডগাটা শরীরের মধ্যে সবার থেকে এগিয়ে থাকে বলে? আজকাল কি সত্যিই নাকের ডগা এগিয়ে থাকে? চাদ্দিকে দ্যাখো শুধু মোটা আর মুটি। তাদের ভুঁড়িটাই নাকের থেকে এগিয়ে থাকে। তাহলে কেন বলব না, অ্যাই, বড়োদের কথায় তুই ভুঁড়ি গলাচ্ছিস কেন? বলব না এই জন্যে যে নাককে আমরা ভালোবাসি, আর চোখা চোখা নাকদের মধ্যে বেশ একটা খোঁচা মারা ভাব আছে।
কাউকে অহংকারী মনে হলে আমরা বলি লোকটার বড়ো নাক-উঁচু। বলি এই জন্যে যে শরীরের মধ্যে নাকটাই সবার থেকে উঁচিয়ে আছে। ঘেন্না দেখাতে আমরা নাক সিটকোই, কিন্তু ঘেন্না দেখাতে কি শুধু নাকই সিটকে যায়? চোখ কোঁচকায় না? ঠোঁট বেঁকে যায় না? তবু নাককে ভালোবাসি বলে তাকে এক নম্বরে রাখি।
অবাক হয়ো না যদি বলি আমাদের মান-অপমান থাকে নাকে! তাই যদি না হবে তবে অপমান হলে কেন আমরা বলি নাক কাটা গেল একেবারে! কাউকে অপমান করতে হলে বলি নাকে-খত দিইয়ে ছাড়ব। কনুই-খত হতে পারত, হাঁটু-খত হতে পারত, বলি না তো, নাকে-খতই বলি। খুব কষ্ট পাওয়াকে লোকে বলে নাকের জলে চোখের জলে এক হওয়া। বাধ্য হয়ে কষ্ট বা অপমান সহ্য করতে হলে আমরা বলি নাক-কান বুজে সহ্য করা। চোখ আর কানের কথা এসেছে বটে, কিন্তু নাকের পরে। দোষ করলে নাক-মলা খেয়ে বলতে হয়, আর করব না।
কত যে কথা আছে নাককে নিয়ে। যখন ঠিক করি কোনও ব্যাপারে আর থাকবই না, তখন বলি - এই নাক-মলা খাচ্ছি, তোমাদের ঝগড়ার মধ্যে আমি আর থাকছি না।
দুঃখের ভান করাকে বলে নাকে কাঁদা। এটা আমার পছন্দ নয়। ভান করতে নাকের মতো একটা দামি জিনিসকে কেন টানা হবে? অন্যভাবে বলা যায় না? ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ’-টা তবু মন্দের ভালো। মানে তো তোমরা জানোই - অন্যের ক্ষতি করার জন্যে নিজের ক্ষতি করা। ন্যাকাও এসেছে নাক থেকে। এটাও আমার ভীষণ অপছন্দ।
‘নাকানিচোবানি খাওয়া’-টা আমার বেশ পছন্দ। মানে তোমরা জানো - কোনও কাজ করতে গিয়ে হয়রান হওয়াকে বলে। কারও নাক-সুদ্ধু মাথা যদি জলে চুবিয়ে ধর, কী অবস্থা হয় তার? হাঁসফাঁস করতে থাকে না? তাই থেকে কথাটা এল।
নাককে ভালোবেসে এমনি কত কথার সঙ্গে আমরা তাকে জুড়ে দিয়েছি। হাত-পা-চোখ-কানদেরও বাদ দিইনি। তবে নাকের মতো অত সম্মান ওদের দিইনি।
এবার নাক নিয়ে অন্য কিছু কথা। নাকে মেয়েরা নাককড়াই নাকছাবি পরে। তার জন্যে কষ্ট সয়ে নাকের পাটায় ফুটো করিয়ে নেয় - তাকে বলে নাক ফোঁড়ানো বা নাক বেঁধানো। ছেলেরাও আজকাল কেউ কেউ নাক-কান বিঁধিয়ে গয়না পরছে। আমার ভারী বিচ্ছিরি লাগে দেখতে। নাকে দড়ি পরাতে ঘোড়া-গরুরও নাক ফোঁড়ানো হয়। মানতে পারি না এটা আমি। সুন্দর দেখানোর জন্যে নাক বিঁধিয়ে গয়না পরছ - ঠিক আছে, কিন্তু গরু-ঘোড়াকে কষ্ট দিয়ে তাদের নাক ফোঁড়াচ্ছ তোমার সুবিধার জন্য - এটা মোটে ভালো লাগে না আমার।
টিকোলো নাক আমাদের সবার পছন্দ। আমরা বলি চোখা নাক। ভালো বাংলায় উন্নত নাসা - কথাটা এসেছে সংস্কৃত থেকে। তার মানে, সেই আদ্যি কালেও চোখা নাকের কদর ছিল। থ্যাবড়া নাক, চ্যাপটা নাক, বোঁচা নাক কেউ পছন্দ করে না। কেউ পছন্দ করে না বলা বোধহয় ভুল হল। চিনে-জাপানিরাও অপছন্দ করে কি? না বোধহয়। ওদের নাক নিয়ে ভাববার দরকার নেই আমাদের। আমরা আমাদের নাক নিয়েই ভাবি। আজকাল বোঁচা নাক অপারেশন করে চোখা করে দেওয়া যায়। সেই অপারেশনের নাম রাইনোপ্লাস্টি। তোমাদের কারও যদি নাক নিয়ে ইয়ে... মানে অসুবিধা থাকে, আমার কাছে আসতে পার। আমি চোখা করার রাস্তা বলে দেব।
বেশি চোখা নাকও আবার ভালো নয়। নাক হতে হবে চোখা, কিন্তু মুখের সঙ্গে মানানসই। অতিরিক্ত চোখা নাকের একজন বিখ্যাত মানুষের কথা বলি। আজ থেকে ঠিক চারশো বছর আগে ফরাসি দেশে জন্মেছিলেন সাইরানো দ্য বারজারেক (Sirano De Berzerak)। অনেক নাটক আর কাল্পনিক অভিযানের গল্প লিখেছিলেন তিনি। তাঁকে নিয়েও বই লেখা হয়েছিল। আর একটা কারণেও বিখ্যাত ছিলেন তিনি। তাঁর ছিল মস্ত বড়ো একটা নাক। অমন নাক কক্ষনো দেখনি তোমরা। যদি দেখতে চাও নীচের ছবিটা দেখ।

সাইরানো দ্য বারজারেক
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল

প্রবন্ধ:: খেলনার জাদুকর অরবিন্দ গুপ্তা - শেলী ভট্টাচার্য


খেলনার জাদুকর অরবিন্দ গুপ্তা (পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত)
শেলী ভট্টাচার্য

বহু করতালির স্বতঃস্ফূর্ত শব্দকে ক্রমশ বাড়িয়ে তুলে সাদামাটা ঢিলেঢালা খাদি পাঞ্জাবির সঙ্গে সাদা পায়জামা পড়ে স্টেজে উঠে এলেন মানুষটিতাঁর সদাহাস্যময় মুখে বুদ্ধিদীপ্ত চাউনি দেখে কেন জানি এমনিতেই শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে ষাটোর্ধ বয়সের নির্ভার ক্লান্তিহীন প্রশান্ত চেহারা অচিরেই বিপরীতে বসে থাকা অনেক মানুষের মনকে শান্ত করে দেয় যেন মনে হয় অতি সাধারণের মধ্যেও এক চরম অসাধারণত্ব লুকিয়ে আছে এই মানুষটির মন ও মস্তিষ্কে
নিজের বক্তব্য রাখার শুরুতে উনি দিলেন নিজের ক্ষুদ্র বিনয়ী পরিচয় তারপর হাতে একটি ডেট ক্যালেন্ডার নিয়ে লেগে পড়লেন নিজ মহৎ কাজে ক্যালেন্ডারটিতে বারোটি পাতায় ছকটানা খোপে বড়ো বড়ো করে লেখা আছে বছরের এক একটি মাসের তারিখ, সঙ্গে এক পাশ দিয়ে সাপ্তাহিক দিনের সূচিকা উনি খুব সহজেই এক একটি তারিখের চারপাশের দিনপঞ্জি দিয়ে বোঝাতে লাগলেন এক একটি জটিল অঙ্কের সহজতর সূত্র প্রথমে চার ঘরের ম্যাট্রিক্স দিয়ে, তারপর তা বড়ো হতে হতে বারো ঘরে গিয়ে পৌঁছাল এরপরেও উনি সারাটা মাসের তারিখগুলোকে নিয়ে যোগ আর গুণ করে যেন যাদুবলে সারাটা হলঘরের দর্শকদের নিমেষের মধ্যে বুঝিয়ে দিলেন কঠিন কঠিন সব অঙ্কের মারপ্যাঁচ শেষের দিকে ওঁর প্রশ্নগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গেই হলঘরের সবাই সমোচ্চারে দিচ্ছিল সঠিক উত্তর সে সাফল্যে উনি সহাস্য বদনে বলছিলেন, মাথা ভীষণ দামী একটি স্থান সে জায়গাটাকে অযথা কোনও অপ্রয়োজনীয় তথ্যের ভিড়ে নষ্ট করতে নেই তাকে যুক্তি আর বুদ্ধির জোরে শাণিত করে সংক্ষেপে শেখাতে হয় মেরিট ও মেমরিকে সচল রাখার সূত্রাবলীগুলো, যাতে কোনো কিছু শেখার জন্য ক্ষণিক সময় ব্যয় হয়, কিন্তু শেখাটা হয় শক্তপোক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী তবেই সেই শিক্ষাটা মস্তিষ্কে আজীবন জীবন্ত থাকে
এরপর দর্শকদের মধ্যে একজন উঠে দাঁড়িয়ে বিনীতভাবে ওঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ওঁর এ কাজে অনুপ্রেরণার শুরুটা ঠিক কী ছিল? শ্রদ্ধেয় অবাঙালি প্রফেসর অরবিন্দ গুপ্তা তখন মৃদু হাসিমুখে জানালেন, বিবিধ বিদেশি লেখক ও বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম রবি ঠাকুরের বিখ্যাত রচনা ‘তোতা কাহিনি’-র ক’টা লাইন হিন্দীতে তুলে ধরে সে কাহিনির মূল ভাবটি তিনি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করলেন এখানে সেটিকে সুবিধার্থে বাংলায় লিখছি আমি...

‘রাজা বলিলেন, 'একবার পাখিটাকে আনো তো দেখি'
পাখি আসিল সঙ্গে কোতোয়াল আসিল পাইক আসিল ঘোড়সওয়ার আসিল রাজা পাখিটিকে টিপিলেন, সে হাঁ করিল না, হুঁ করিল না কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খসখস গজগজ করিতে লাগিল
বাহিরে নববসন্তের দক্ষিণ হাওয়ায় কিশলয়গুলি দীর্ঘনিশ্বাসে মুকুলিত বনের আকাশ আকুল করিয়া দিল।’

উনি বললেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই রচনার মধ্যে রাজার এক পাখিকে শিক্ষাদানের গল্প শুনিয়েছিলেন, যাকে সোনার খাঁচায় রেখে রকমারি জাঁকজমকে পিষ্ট করে দিয়ে শিক্ষাদানের রুক্ষ প্রকৃতিতে জ্ঞানপাঠ দেওয়ার প্রয়াস চলছিল একের পর এক পুঁথির পাতা পাখিটাকে সবলে গলাধঃকরণ করানো হচ্ছিল, যেন তেন প্রকারেণ জ্ঞানী করে তোলার জন্য কিন্তু আদতে সেই সমস্ত আয়োজনকারীরা কেউ পাখিটার মানসিক বা দৈহিক স্বাস্থ্যের প্রতি কোনো নজর দিতেই পারেনি সবার চোখ ছিল তার পারিপার্শ্বিক উন্নতিসাধনে এই উপমাটির মধ্য দিয়ে কবি সেই সময়েই জনসমক্ষে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন এক বৃহৎ সমস্যার সূত্রপাতকে, যে সমস্যা প্রতিটি শিশুর শৈশব হতে ওর বয়সের সমহারে বেড়ে উঠতে থাকে তা হল, মুখস্তনির্ভর শিক্ষার বোঝা, যার ভারবাহক হয়ে সে শিশু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এক সময় নুয়ে পড়ে, উন্নত শিরে জ্ঞানেন্দ্রিয় গড়ে সর্বসমক্ষে দাঁড়াতে পারে না অথচ এর কারণ চোখে পড়ে না কারও আমাদের সমাজ বাচ্চাদের শিক্ষিত করতে বড়ো বড়ো বিদ্যালয়ে পাঠায়, বড়োসড়ো সিলেবাসকে বুঝুক না বুঝুক... একরকম জবরদস্তি চেপেচুপে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্যাক করে দেয় তাদের মস্তিষ্কের মূল্যবান মেমরি ব্যাগে তারপর সেই প্যাকিং ব্যাগকে টেনে হিঁচড়ে চলতে চলতে কখনও ভেতরের জিনিসগুলোই নষ্ট হয়ে যায়, আবার কখনও সেই ভারবাহী শিশুটি নুয়ে পড়ে মনে ও শরীরে শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হল শেখানো, বোঝানো, জানানো সেই শিক্ষার ধারা যুক্তিবিহীন বোঝা বাড়ানোতে পরিণত হলে তো শিশু শৈশবের মতো সুন্দর সময়টাকে নষ্ট করেই ফেলবে বিরক্তিতে.... নিরানন্দ জীবনযাপনে
এই  কথাগুলোকে উল্লেখ করে প্রফেসর গুপ্তা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকলেন সম্ভবত ওঁর মনও শিশুদের ব্যথায় ব্যাকুল হয়ে উঠল সেই ক্ষণিক সময় তারপর আবার নিজ আবিষ্কারের যাদু নিয়ে ফিরে এলেন আপন ছন্দে একটি সাধারণ প্লাস্টিক স্ট্র-কে দিয়ে অনায়াসে গড়ে তুললেন একটি বাঁশি, যা হতে সৃষ্ট উঁচু নিচু শব্দের কম্পাঙ্কগুলোকে উনি এক এক করে স্ট্র-টিকে কাঁচি দিয়ে কেটে ছোটো করার সঙ্গে সঙ্গে সহজতম বৈজ্ঞানিক ভাষায় ব্যাখ্যা করতে লাগলেন এইভাবেই একের পর এক সহজ দৃষ্টান্ত তুলে ধরে উনি শেখালেন আরও অনেক সাধারণ খেলনা তৈরির পদ্ধতি, যা আমরা অনায়াসেই আমাদের অব্যবহার্য জিনিস দিয়ে গড়ে তুলতে পারি এমনকি শিশুরাও নিজ হাতে সেগুলো বানিয়ে ফেলতে পারে আনন্দ সহযোগে আর প্রতিটি খেলনা তৈরির পাশাপাশি হাতেকলমে শিখে নিতে পারে এক একটি গুরুগম্ভীর বিজ্ঞানের থিওরিকে

এমনভাবেই শিশুদের সরল শৈশবকে শিক্ষণকার্য ও আনন্দদানের ভারসাম্যে বাঁচিয়ে রাখার পণ নিয়েছিলেন এই মহান ব্যক্তিত্ব অরবিন্দ গুপ্তা ১৯৫৩ সালে চতুর্থ সন্তান হয়ে তাঁর জন্ম হয়েছিল এমন এক পিতা-মাতার ঘরে, যারা কখনও স্কুলের মুখই দেখেননি স্কুলজীবনে অসাধারণ সাফল্যের পর অরবিন্দ গুপ্তা পাঁচ বছরের জন্য IIT কানপুরে শিক্ষালাভ করেন তারপরে সেখানেও তিনি নিজের অসামান্য বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন (১৯৭৫)
অরবিন্দ গুপ্তা জানান, আমি কানপুরে শিক্ষাবস্থায় যতটা না সিলেবাস থেকে শিখেছি, তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু শিখেছি আমার বন্ধুদের সঙ্গে গড়ে তোলা ওয়ার্কিং মডেলগুলো থেকে এই কানপুরে পড়াশুনা করাকালীন, অরবিন্দ গুপ্তা মেসের স্টাফের বাচ্চাদের পড়াতেন তাদের স্কুল যাওয়ার সামর্থ্য না থাকায় অরবিন্দ গুপ্তাকে পেয়ে ওরা আনন্দিত ও উপকৃত হয়েছিল
এরপর উনি পেশাগতভাবে পুনের Telco-র মতো নামি সংস্থায় ট্রাক কনস্ট্রাকশনের প্রোজেক্টে যুক্ত হন কিন্তু দু’বছরের মাথায় উনি পড়াশুনার জন্য এক বছরের ছুটি নিয়ে গ্রাম্য শিশুদের বিজ্ঞানের গোড়ার পাঠ শেখাতে লেগে পড়েন (১৯৭৮) এই উদ্দেশ্যে অরবিন্দ গুপ্তা মধ্যপ্রদেশের হোসাঙ্গাবাদ জেলার আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় কিছু কম খরুচে বিজ্ঞান শিক্ষার পদ্ধতি নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলেন যে পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হয় চার পাশের সহজলভ্য জিনিসপত্র এরপর অরবিন্দ গুপ্তা কেরালা চলে গিয়ে ওঁর পথপ্রদর্শক লাউরিয়া বেকারের সঙ্গে কাজ করেন লাউরিয়া তখন স্থানীয় সহজলভ্য জিনিসপত্রের দ্বারা গরীব মানুষদের জন্য নূন্যতম খরচে মাথার ছাদ গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন কেরালা থেকে ফিরে এসে অরবিন্দ পুনরায় Telco-তে যোগদান করেন কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই উনি অনুভব করেন ওঁর জীবনের লক্ষ্য শুধুমাত্র রুটিরুজিগত পেশাদার হওয়া নয় তখনই তিনি কোম্পানিতে পদত্যাগপত্র জমা দেন আর সাগদলে গিয়ে দুনু রায়ের সঙ্গে দু’বছর কাজ করেন ১৯৮৪ সালে উনি দিল্লীতে এসে নিজ কাজের উপর বই লেখা শুরু করেন ওঁর সকল বইতে উনি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় ও অব্যবহার্য জিনিসপত্রগুলোকে কীভাবে শিশুদের জন্য বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারায় তৈরি আনন্দদায়ক খেলনায় চক্রাকারে রূপ দেওয়া যায়, তা সহজভাবে ব্যাখ্যা করেন এই প্রসঙ্গে অরবিন্দ গুপ্তা বিদ্যালয়ের পুঁথিগত শিক্ষাপদ্ধতি আর নিজ হাতে প্রকৃতির কোলে সৃষ্ট সহজ সরল নিগূঢ় শিক্ষাপদ্ধতির তফাৎ বোঝাতে একটি ইন্টারভিউতে বলেন যে, It has been made out to be a bookish affair in our schools - something in which you have to mug up definitions and formulae and spit them out in exams. But this is patently untrue. For children, the whole world is a laboratory. We have forgotten the task of bringing children closer to nature. If you can show them that scientific principles such as the laws of motions, or the principles of geometry exist in familiar daily-use objects around them, then they internalise science better and relate it to their daily lives."
অরবিন্দ গুপ্তার প্রথম লেখা Matchstick models and other science experiments বইটি বিভিন্ন সুনামযুক্ত বিজ্ঞানগোষ্ঠী দ্বারা ১২টিরও বেশি ভাষায় অনুবাদিত হয়, আর দেশে বিদেশে পাঁচ লাখের বেশি এই বইয়ের কপি বিক্রি হয় কিন্তু অরবিন্দ গুপ্তা এই বই বিক্রির জন্য কোনও রয়ালটি নেননি উনি সে প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ওঁর জীবনগত দৈনন্দিন চাহিদা স্বল্প, যা উনি নিজেই মিটিয়ে ফেলতে পারবেন সারা ভারতের প্রায় ২০০০টি স্কুলে উনি সহজ পদ্ধতিতে বিজ্ঞান শেখানোর জন্য ওয়ার্কশপ করেন সমাজের যে সমস্ত অন্ধকারাবৃত কোণে শিশুদের কাছে স্কুলের পাঠ পৌঁছায় না, সে সকল জায়গায় গিয়ে অরবিন্দ গুপ্তা নিজের ধ্যানধারণার আলোকে সম্পূর্ণ বিলিয়ে দেন দেশের ভবিষ্যৎ গড়ার মতো হিতকর কাজে অরবিন্দ গুপ্তার ওয়েব সাইটে (http://arvindgupta.com) ছোটো ভিডিও ক্লিপিংসের মধ্য দিয়ে উনি গৃহস্থালির অব্যবহার্য জিনিসের দ্বারা সহজ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে একশোরও বেশি খেলনা তৈরি করার পদ্ধতি ধাপে ধাপে দেখিয়েছেন। সেই ভিডিওগুলো কপিরাইটের বাধাকে উপেক্ষা করেই সবার দেখার জন্য লোড করে রেখেছেন প্রফেসর গুপ্তা এছাড়াও ওঁর লেখা বইগুলোর পি ডি এফ-ও উনি লোড করে রেখেছেন নিজের এই ওয়েবসাইটে, যাতে বহু লোক উপকৃত হন আর ওঁর সৃষ্টির যাদুর ছোঁয়ায় বহু শিশু বিজ্ঞানকে অনায়াসেই খেলার ছলে আপন করে নিতে পারে
সাদামাটা খাদি পাঞ্জাবি পরিহিত লম্বা বুদ্ধিদীপ্ত সদাহাস্যমুখী মানুষটি এভাবেই পুরানো ক্যামেরার রিলের রোল ক্যান, খালি বাক্স, সাইকেলের ব্যবহৃত টিউব, দেশলাই কাঠি ও বাক্স, পুরানো খবরের কাগজ, বল পেনের রিফিলের মতো সহজলভ্য জিনিসগুলোকে ব্যবহার করে মুহূর্তের মধ্যে দু’হাতের যাদুবলে খেলনা তৈরি করে ফেলেন সাইকেলের সরু টিউবের সঙ্গে দেশলাই কাঠি সহযোগে উনি সহজে বানিয়ে ফেলেন ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বহুভুজের গঠন পুরানো খবরের কাগজকে ফোল্ড করে মিনিটের মধ্যে উনি বানিয়ে ফেলেন উড়ন্ত পাখি, সাঁতারু মাছ, হেলিকপটার, প্লেন আরও কত কিছু ওঁর এই স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগগুলোর ছোঁয়া পেয়ে দরিদ্র পরিবারের শিশুরা নিজ হাতে এই খেলনাগুলোকে বানিয়ে নিজেদের শৈশবকে আনন্দময় করে তুলতে পারে অনায়াসেই, আর পাশাপাশি বিজ্ঞানের ছোঁয়া পেয়ে নিজেদের সমৃদ্ধও করতে পারে অরবিন্দ গুপ্তার এই মহৎ উদ্যোগকে সম্মান জানাতে ভারত সরকার ২০১৮ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসে ওঁর হাতে তুলে দেন পদ্মশ্রী পুরস্কার আর দেশে ও বিদেশে অরবিন্দ গুপ্তার পরিচয় গড়ে ওঠে টয় মেকার বা টয় ইনভেনটর নামে উনি পুরস্কার প্রাপ্তির পর একটা ইন্টারভিউতে হাস্যমুখে বলেছিলেন, I believe that the best thing that a child can do with a toy is break it and try to see how it works. Encourage the child to break his or her toys.
_____