গল্প:: অশরীরী - শিশির বিশ্বাস


অশরীরী
শিশির বিশ্বাস

সেদিন শনিবার সন্ধে থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি পথে মানুষও কম আমাদেরশনিবারের আসর-এ উপস্থিতি জনাকয়েক মাত্র আসর তাই কিছুতেই যেন জমে উঠছে না সামনে পুরোনো খবরের কাগজের উপর ডাঁই করা মুড়ি-চানাচুর আর গরম তেলেভাজা মুড়ির ফাঁকে কাগজের আধপাতা জোড়া এক তন্ত্রসাধকের ছবি বিজ্ঞাপনে হরেক গুণকীর্তন সেই সূত্রেই মুড়ি হাতে তন্ত্র, তন্ত্রসাধক নিয়ে খুচখাচ কথা চলছে, রাধাকান্তদা বললেন, “কথা কী জানিস, প্রকৃত তন্ত্রসাধক কখনোই এমন ঢক্কানিনাদ করেন না
রাধাকান্ত চৌধুরী ওরফে রাধাকান্তদা প্রবীণ মানুষ জমিয়ে গল্প বলতে জুড়ি নেই নিমেষে সবাই হই হই করে উঠলাম, “কেন? কী করে জানলেন?
“অন্তত আমি যাঁকে জানতাম তাঁকে কখনও এসব করতে দেখিনি শোন, বলি তাহলে রাধাকান্তদা প্রায় থম হয়ে গেলেন এরপর শুরু করার আগে গল্প গুছিয়ে নেবার প্রস্তুতি অগত্যা আমরাও তাঁর কাছে ঘেঁষে এলাম বেচারা, আজ যারা বৃষ্টির কারণে আসেননি, তাদের কথা ভেবে কিছু দুঃখই হল রাধাকান্তদা রোজ তো আর মুখ খোলেন না
যাই হোক, মিনিট কয়েক থম হয়ে থেকে রাধাকান্তদা আমাদের উপর সামান্য চোখ বুলিয়ে নিয়ে শুরু করলেন, “গোড়াতেই বলে রাখি, তান্ত্রিকের প্রসঙ্গ উঠলেও আসলে সুন্দরবনের গল্প সেই সত্তরের দশকের গোড়ার দিকের কথা সুন্দরবনে বেড়াতে যাওয়া তখন মোটেও সহজ ছিল না ভটভটি চালু হয়নি তখনও যেতে হত দাঁড় টানা নৌকোয় শুধু সময় নয়, অনেক খরচের ব্যাপারও ছিল তবু যে যেতে পেরেছিলাম, সে ধনঞ্জয়দা মানে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর দৌলতে তখন শেয়ালদায় যে মেসে থাকতাম, উনি দিনকয়েক আমার রুমমেট ছিলেন
“বছর চল্লিশ বয়সের ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য কিছুটা সৃষ্টিছাড়া গোছের মানুষ সৌম্য চেহারা গাল ভর্তি দাড়ি কপালে মস্ত সিঁদুরের ফোঁটা ফি-অমাবস্যায় তারাপীঠ নয়তো অন্য কোনো শ্মশানে ছুটতেন ভদ্রলোক যে তন্ত্রচর্চা করেন, বুঝতে দেরি হয়নি কিন্তু উনি কখনও নিজমুখে বলেননি একদিন অনেক চেষ্টায় যেটুকু বের করতে পেরেছিলাম, সে প্রায় চমকে দেবার মতোই ব্যাপার ছেলেবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে অমাবস্যার রাতে গ্রামের এক নির্জন শ্মশানে রাত কাটিয়েছিলেন তারপর ব্যাপারটা কেমন নেশার মতো পেয়ে বসেছিল তাঁকে তেমন কোনো শ্মশানের খোঁজ পেলেই ধাওয়া করতেন ওই সময় ওঁদের বর্ধমান জেলার এক নির্জন শ্মশানে অমাবস্যার রাতে হাজির হয়েছেন, দেখেন অন্ধকারে ভুঁড়ো এক শেয়াল খানিক আগে নেভা এক চিতা হাঁটকাচ্ছে কৌতূহলে এগিয়ে গেছেন, চমকে উঠলেন শেয়াল কোথায়! সামনে দাঁড়িয়ে জটাজূটধারী বিকট দর্শন এক সাধু
“সেই রাতে আর কী ঘটেছিল, উনি সব বলেননি তবে সেই থেকে প্রতি অমাবস্যার রাতে নির্জন শ্মশানে বসে গুরুমন্ত্র জপ করা শুরু করেন
“এক সওদাগরি অফিসে কাজ করতেন উনি এজন্য মাসে কয়েক দিন অফিস কামাই হতই পুরো মাইনেও পেতেন না তবে বিয়ে-থা করেননি বাড়িতে কিছু পাঠিয়েও চলে যেত পরে জানতে পেরেছিলাম, কলকাতায় তার কিছু গুণমুগ্ধ ভক্তও আছেন
“রুমমেট হবার কারণে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর সঙ্গে কিছু বাড়তি ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল দাদা বলতাম উনি অবশ্য অন্যদের মতো আমাকেও বাবাজি বলে ডাকতেন একদিন বললেন, বাবাজি বেড়াতে যাবে? সুন্দরবন?
“আগেই বলেছি, সুন্দরবন বেড়াতে যাওয়া তখন সহজ ছিল না সে কথা বলতে উনি একে একে খুলে বললেন সব
“কলকাতায় ওঁর এক পরিচিত ব্যক্তি মহাদেব চৌধুরীর ইচ্ছে হয়েছে সুন্দরবনে বেড়াতে যাবেন জমিদার পরিবারের মানুষ জনাকয়েক কাছের বন্ধু ছাড়াও ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যকেও সঙ্গে নেওয়ার ইচ্ছে অনুরোধ ফেলতে পারেননি তিনি কিন্তু প্রায় দিন পনেরো একা তাদের সঙ্গ দেওয়া বিড়ম্বনা বুঝে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তার নিজের এক পরিচিতকেও নিতে হবে সঙ্গে মহাদেব চৌধুরী এক কথায় রাজি ধনঞ্জয়দা এজন্য আমাকেই বেছেছেন নিখরচায় এমন লোভনীয় ট্যুর, রাজি হয়ে গেলাম ধনঞ্জয়দা না ভাঙলেও পরে বুঝেছিলাম, মহাদের চৌধুরী তার একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত
“ক্যানিং থেকে সার্ভিস লঞ্চে সোনাখালি সেখানে নদীর ঘাটে প্রস্তুত বড়ো এক বোট যাত্রী বলতে আমরা সাত জন এছাড়া দাঁড়ি আর হালি (যিনি নৌকোর হাল ধরেন) পাঁচ জন সোনাখালি থেকে তিন দিনের মাথায় এসে পৌঁছলাম গাজির খালের কাছে এর মধ্যে ভাটায় খালের ধারে চরতে আসা কয়েক পাল হরিণ আর বানর ছাড়া অন্য কিছু চোখে পড়েনি তবে আয়োজনের ত্রুটি ছিল না সেই সঙ্গে সদ্য ধরা নদীর টাটকা মাছের নানা পদ সময়টা যে বেশ কাটছিল, তা বলাই বাহুল্য সেদিন ওই গাজির খালেই ঘটনার সূত্রপাত
সামান্য দম নিয়ে রাধাকান্তদা ফের শুরু করলেন, “সেদিন গাজির খালে যখন পৌঁছলাম, পড়ন্ত বিকেল খালের সামান্য ভিতরে বড়ো এক কেওড়া গাছ কাছেই ভাঙাচোরা এক ইটের স্তূপ বহু পুরোনো বসতির চিহ্ন এমন ধ্বংসাবশেষ সুন্দরবনে নাকি অনেক স্থানেই আছে
“সে যাই হোক, দাঁড়ি-মাঝিদের সর্দার হালি বৃন্দাবন সেই কেওড়াগাছের কাছে বোট ভেড়াতে বলল আলো তখন দ্রুত পড়ে আসছে অথচ বড়ো একটা কাজ বাকি দুপুরেই জ্বালানি কাঠ ফুরিয়ে গেছে বোট নোঙর হতেই বৃন্দাবনের নির্দেশে চারজন দাঁড়ি কাঠ জোগাড় করতে নেমে গেল
“জল-জঙ্গলের দেশ সুন্দরবনের সৌন্দর্যের সত্যিই তুলনা নেই একটা অন্য মাদকতাও আছে সেই সঙ্গে যখন মনের কোণে উঁকি দেয়, অদূরে ওই যে নিতান্ত নিরীহ হরেক গাছের মেলা, সেখানে প্রতি পদক্ষেপে ওঁত পেতে আছে মৃত্যু, তখন ভিতরে একটা অন্য অনুভূতি জাগে মাত্র দুদিনে সেই অনুভূতি ভালোই টের পেয়েছিলাম বলা যায়, পেড়েও ফেলেছিল আমাকে যাই হোক, পড়ন্ত বিকেলে সূর্য তখন পাটে বসেছে অদূরে খালের মুখে প্রায় দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল নদী সেদিকের আকাশে মুঠো মুঠো আবিরের ছোঁওয়া বোটের ভিতর মহাদেব চৌধুরী সঙ্গীদের নিয়ে তাসে মেতে উঠেছেন পার্টনারের ভুলচুক নিয়ে তর্ক ভিড়ে পড়েছেন ধনঞ্জয়দাও আমার কিন্তু ভালো লাগছিল না তাই উঠে এসেছিলাম বোটের ছাদের উপর ভিতরের গুমোট থেকে বেরিয়ে চমৎকার বাতাসে আরামে পা ঝুলিয়ে সূর্যাস্তের সেই চমৎকার দৃশ্যর দিকে বিভোর হয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম খেয়াল নেই হঠাৎ বোট সামান্য দুলে উঠতে সংবিৎ ফিরে এল
“ভাটার টানে জল তখন দ্রুত নেমে যাচ্ছে যেখানে নোঙর ফেলা হয়েছিল, সেখানে এখন শুধুই কাদা নোঙরের ফলাগুলো বেরিয়ে পড়েছে কমে আসা জলের টানে আমাদের বোট ভেসে এসেছে খালের প্রায় মাঝখানে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি দাঁড়িদের একজন খালের সেই নোঙরের কাছে দাঁড়িয়ে দড়ি টেনে বোট পাড়ের দিকে নিচ্ছে খোলা বড়ো নদীর ওদিকে যথেষ্ট আলো থাকলেও সরু খালের ভিতর আলো তখন যথেষ্টই কমে এসেছে তার উপর ডালপালা ছড়ানো সেই কেওড়া গাছের দরুন জায়গাটা প্রায় অন্ধকার তাই মানুষটার মুখ সেভাবে দেখা যাচ্ছিল না তবে দাঁড়িদের মতোই পরনে আধময়লা খাটো ধুতি খালি গা জ্বালানি কাঠ ভাঙতে চার জন দাঁড়ি একসঙ্গে জঙ্গলে ঢুকেছে একসঙ্গেই ফেরার কথা কিন্তু কী কারণে লোকটা একা ফিরে এল, বুঝে উঠতে পারলাম না ডেকে জিজ্ঞাসা করতে যাব, লোকটা ততক্ষণে দড়ি টেনে বোট কাছে এনে লম্বা পায়ে সামনের কাদা পার হয়ে এক লাফে উঠে পড়েছে আমাকে কথা বলার সময় না দিয়ে দ্রুত ঢুকে পড়ল পিছনে দাঁড়ি-মাঝিদের থাকার জায়গার দিকে
“প্রায় হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে আছি, অদূরে জঙ্গলের দিক থেকে ছুটে আসা এক ঝলক হিমেল বাতাসে সারা শরীরে প্রায় কাঁটা দিয়ে উঠল তাড়াতাড়ি বোটের ছাদ থেকে নেমে ঢুকে পড়লাম ভিতরে সবাই তাস খেলায় ব্যস্ত পাশে বসে ব্যাপারটা ভাবার চেষ্টা করছি, বাইরে মানুষের আওয়াজে টের পেলাম, দাঁড়িদের বাকিরা কাঠ নিয়ে ফিরে এসেছে মাথা থেকে চিন্তাটা মুহূর্তে নেমে গেল বুঝতে বাকি রইল না, কাঠ ভাঙতে যাওয়া চার জন দাঁড়ির একজন সামান্য আগে পৌঁছেছে অযথাই ভাবছি আমি
“ওদিকে কাঠ নিয়ে ফিরতেই বৃন্দাবনের নির্দেশে উনুন জ্বেলে ফেলা হয়েছে খানিক পরেই মস্ত থালা ভর্তি গরম তেলেভাজা আর মুড়ি পৌঁছে গেল হাতে হাতে চায়ের কাপ সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল তাই নিয়ে জ্বালানি কাঠ ফুরিয়ে যেতে দুপুরের পরে পেটে কিছু আর পড়েনি প্রায় গোগ্রাসে খাচ্ছিল সবাই ব্যতিক্রম ধনঞ্জয়দা কিছুক্ষণ ধরেই ঘন ঘন নাক টানছিলেন তিনি মুখে একটা বেগুনি পুরেও জানলা দিয়ে থুঃ করে বাইরে ফেলে বললেন, কেমন একটা পচা গন্ধ পাচ্ছ না বাবাজিরা?
“শুনে সবাই তো অবাক গরম তেলেভাজা আর ক’দিন ধরে এই মুড়িই খাচ্ছি উত্তরে মাথা নাড়লাম সবাই তেমন কোনো গন্ধ কেউই পাচ্ছিলাম না ধনঞ্জয়দা কিন্তু কিছুই খেলেন না ভোজন-পর্ব শেষ হতে জায়গাটা পরিষ্কার করে দিয়ে গেল কিন্তু ধনঞ্জয়দা থামলেন না তার সেই একই কথা, পচা গন্ধ মাঝিদের ডেকে খবর নিলেন, বোটে পচা মাছ রয়েছে কিনা শুনে বৃন্দাবন তো হাউমাউ করে উঠল, বালাই ষাট কত্তা সকালে ধরা মাছ সেই দুপুরেই শেষ হয়ে গেছে কাঠ ভাঙতে যাবার জন্য বিকেলে আর মাছ ধরাও যায়নি রাতে তাই ডিমের ডালনা হবে পচা মাছ কোত্থেকে আসবে!
“গোড়ায় ব্যাপারটাকে অনেকেই তেমন পাত্তা দিইনি কারণ আমরা কেউই কোনো গন্ধ পাচ্ছিলাম না কিন্তু মহাদেব চৌধুরী উড়িয়ে দিলেন না এই ক’দিনেই বুঝেছি, ধনঞ্জয়দাকে যথেষ্ট মান্য করেন তিনি হাত জোড় করে বললেন, ঠাকুরবাবা, আপনি আছেন বলেই এই বিভূঁই দেশে আসতে ভরসা পেয়েছি মনে হচ্ছে, খুব দুশ্চিন্তায় রয়েছেন!
“উত্তরে ধনঞ্জয়দা ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললেন, না-না, তেমন কিছু নয় বাবাজি তবে বলি কী, রাতে এখানে বোট না রেখে অন্য কোথাও যাওয়া হোক
“মহাদেব চৌধুরী তৎক্ষণাৎ বৃন্দাবনকে ডেকে পাঠিয়ে সেই নির্দেশ দিলেন বৃন্দাবন অভিজ্ঞ মাঝি শুনে হাত কচলে বলল, আজ্ঞে কত্তা, রাত কাটাবার জন্য জায়গাটা কিন্তু ভালো আগেও অনেকবার বোট নিয়ে থেকেছি এখানে তা ছাড়া রাতে বড়ো নদীতে বোট নোঙর করলে ডাকাতের নজরে পড়ার সম্ভাবনা
“মহাদেব চৌধুরী কিন্তু সে কথায় কর্ণপাত করলেন না বৃন্দাবনের পাশে চার জন দাঁড়িও তখন উপস্থিত তাদের একজন সত্য বলে উঠল, কত্তাবাবু যখন বলছেন, তাই করো মামা
“অন্ধকার ইতিমধ্যে ঘন হয়ে উঠেছে সরু খালের দুপাশে অবিশ্রান্ত ঝিঁঝির কোরাস নোঙর তুলে দুজন দাঁড়ি লগি মারতে শুরু করল কিন্তু বোট কিছুমাত্র নড়ানো গেল না মহাদেব চৌধুরী নিজেই তদারক করছিলেন বললেন, কী বৃন্দাবন, বোট কাদায় বসে গেছে নাকি?
“বৃন্দাবনের কপালে তখন ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, কিছুই তো বুঝতে পারছি না কত্তা! খালে জল যা আছে, বোট তো মাটিতে আটকে যাবার কথা নয়!
“লগি হাতে সত্য সমানে চেষ্টা করে যাচ্ছিল হঠাৎ বলল, মামা, আমি বরং জলে নেমে ঠেলার চেষ্টা করি সুবিধা হতেও পারে
“সত্যর কথায় বোটের সবাই প্রায় হতবাক রাতের অন্ধকারে সরু খালের দু’পাশে ব্যাঘ্ৰ অধ্যুষিত ঘন জঙ্গল দুহাত দূরেও নজর করা যায় না এই অবস্থায় এমন প্রস্তাব ভাবা যায় না বৃন্দাবন অবশ্য সত্যর প্রস্তাব পত্রপাঠ নাকচ করে দিল মহাদেব চৌধুরীও বললেন, খানিক পরেই যখন জোয়ার শুরু হবে, ঝুঁকি নেবার দরকার নেই সহজেই তখন বোট সরিয়ে নেওয়া যাবে
“মহাদেব চৌধুরী বললেও বৃন্দাবনের মুখে কোনো ভাবান্তর হল না চিন্তিত মুখে অল্প মাথা নাড়ল শুধু
“বৃন্দাবনের চিন্তার কারণ যে কী, বুঝলাম ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই জোয়ার শুরু হয়ে খালের জল তখন অনেকটাই বেড়েছে বোট সরিয়ে নেবার জন্য প্রথমে দাঁড়, তারপর লগি মেরে চেষ্টা হল কিন্তু কোনো লাভ হল না বোট এক চুলও নড়ল না ব্যাপার দেখে সবার মধ্যে তখন রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে ভৌতিক কাণ্ড ছাড়া একে আর কী বলা যায়! ওদিকে ধনঞ্জয়দার নাকে পচা গন্ধ ক্রমশই বাড়ছে সইতে না পেরে নাকে রুমাল বেঁধে নিয়েছেন ঘন ঘন জলের ঝাপটা দিচ্ছেন
“সন্ধের সেই ব্যাপারটা নিয়ে তারপর আর মাথা ঘামাইনি আমি হঠাৎ মনে হল, যত সামান্যই হোক, ধনঞ্জয়দাকে জানানো দরকার মনস্থির করে তাঁকে একান্তে ডেকে খুলে বললাম সব শুনে রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন তিনি চাপা গলায় বললেন, বাবাজি, এতক্ষণে কিছুটা যেন পরিষ্কার হল মনে হচ্ছে, তুমি যাকে দেখেছ, তিনি অন্য কিছু যত চেষ্টাই হোক, এই রাতে বোট আর একচুলও নড়বে না সামনে ভয়ানক বিপদ
“আতঙ্কে প্রায় হিম হয়ে আসছিল শরীর কোনোমতে বললাম, এমন ভাবছেন কেন দাদা? চার জন দাঁড়ির কেউ একজন হয়তো আগেই চলে এসেছিল
“আমার কিন্তু তেমন মনে হচ্ছে না বাবাজি বৃন্দাবনকে একবার ডাকো দেখি খবরদার অন্য কেউ যেন জানতে না পারে
“বোটের ছাদের একধারে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম বাকি সবাই নিচে ইশারায় বৃন্দাবনকে ডেকে এনে ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে প্রায় ফিসফিস করে বললাম, একটা প্রশ্ন আছে বৃন্দাবন ভালো করে ভেবে জবাব দেবে
“কী, কী কথা দাদাবাবু? রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে উত্তর দিল বৃন্দাবন
“কাঠ নিয়ে চার জন দাঁড়ি কি একসঙ্গে ফিরেছে? নাকি কেউ একজন আগে এসেছে, পরে বাকি তিন জন?
“তা কেন দাদাবাবু! কাঠ নিয়ে চার জন তো এক সঙ্গেই ফিরে এল তারপর গুপি আর ছিদাম গেল উনুন ধরাতে ভূষণ আর সত্য তেলেভাজার জন্য বেগুন, পেঁয়াজ আর বেসন নিয়ে বসল কিন্তু কেন বলুন তো?
“না, এমন কিছু নয় বৃন্দাবন পাশে ধনঞ্জয়দা বললেন, অযথা চিন্তা কোরো না
“বৃন্দাবন কিন্তু থামল না বিষণ্ণ গলায় বলল, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না কত্তা! এমন আগে কখনও হয়নি জায়গাটা ভালো বলেই বোট নোঙর করেছিলাম বড্ড ভয় করছে এখন
“না-না, ভয় পেয়ো না আমরা তো আছি ধনঞ্জয়দা সামান্য মাথা ঝাঁকালেন, তবে একটা কথা, এসব যেন পাঁচকান না হয় ঘুণাক্ষরেও যেন কেউ জানতে না পারে
“মাথা নেড়ে বৃন্দাবন চলে গেল ধনঞ্জয়দা বললেন, বাবাজি, তোমাকেও ওই একই কথা বলছি এসব কাউকে বলার দরকার নেই তাতে বিপদ আরও বাড়বে আর একটা কথা, রাতে একটু জেগে থাকার চেষ্টা কোরো
“রাতে আর রান্নাবান্না হল না মহাদেব চৌধুরীর নির্দেশে মুড়ি মাখানো হল সঙ্গে সদ্য প্যাকেট খোলা সেরা চানাচুর কিন্তু দেখা গেল খিদে কারও প্রায় নেই এক-আধ মুঠোর বেশি কেউই মুখে তুলল না আর ধনঞ্জয়দা তো কুটোটিও দাঁতে কাটলেন না রাত দশটা বাজতে বললেন, আপনারা শুয়ে পড়ুন সবাই বোটের ছাতে জেগে থাকছি আমি অযথা চিন্তা করবেন না
“মহাদেব চৌধুরী ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, তা কী করে হয় ঠাকুরবাবা! এই রাতে খোলা ছাদে জেগে থাকবেন! সমানে হিম পড়ছে! আমিও বরং সঙ্গে থাকি
“একদম নয় বাবাজি ধনঞ্জয়দা মৃদু ধমকে উঠলেন, সঙ্গে যখন আছি, কাজটা আমাকেই করতে দিন
“মহাদেব চৌধুরী আর কথা বাড়ালেন না বিছানা পাতা হতে শুয়ে পড়লাম সবাই মার্চ মাস পড়ে গেলেও, এই সময় রাতে এদিকে ভালোই ঠাণ্ডা হয় রাত সামান্য বাড়লেই হিম পড়তে শুরু করে গায়ে মোটা একটা কম্বল জড়িয়ে ধনঞ্জয়দা টর্চ আর ছাতা হাতে উপরে চলে গেলেন
“রাতে কেবিনের ভিতর অন্য সময় একটা হ্যারিকেন থাকলেও আজ দুটো হ্যারিকেন জ্বেলে দেওয়া হয়েছে ঘরে আলো থাকলে এমনিতেই আমার ঘুম আসতে চায় না তাই সুবিধাই হয়েছিল তবু যথাসম্ভব সতর্ক ছিলাম, কিছুতেই যেন চোখে ঘুম না আসে রাত তখন অনেক বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন সামান্য ঘুমের ভাব চলে এসেছে হুঁশ নেই, চাপা গোঁ-গোঁ আওয়াজে সেটা ছিঁড়ে গেল কান খাড়া করতেই বুঝতে পারলাম, আওয়াজটা বোটের ছাতের উপর থেকে আসছে গায়ের চাদর সরিয়ে উঠে বসেছি, শুনতে পেলাম, চাপা হিংস্র গলায় কেউ গজরাচ্ছে, সেঁই থিঁকে সঁমানে গোঁন্দ আঁর গোঁন্দ! আঁজ তোঁরে নিঁকেশ
“কথা শেষ হতে পেল না আচমকা ছাতের উপর দুম-দাম শব্দে ধস্তাধস্তির আওয়াজ প্রবল দাপাদাপিতে ছাত মচমচ করে উঠল চিৎকার করে বালিশের তলা থেকে টর্চ বের করে দরজা খুলে ছুটলাম সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতেই টর্চের আলোয় দেখি ধনঞ্জয়দা উঠে বসে হাঁপাচ্ছেন ঘাড়ের উপর ক্ষতস্থান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে খানিক দূরে প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে বোটের দাঁড়ি সত্য আলো ফেলতেই সে লাফিয়ে উঠে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল মুহূর্তের জন্য হলেও দেখতে পেলাম, তার দুই কশ বেয়ে গড়িয়ে নামছে কাঁচা রক্তের রেখা ওই দৃশ্য দেখে আতঙ্কে আমার হাত থেকে টর্চ খসে পড়ল ততক্ষণে তিরবেগে সাঁতরে পাড়ে উঠে সত্য ঢুকে পড়েছে জঙ্গলের ভিতর
“আমার চিৎকারে ইতিমধ্যে অন্যরা ছুটে এসেছে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ধনঞ্জয়দাকে নিয়ে ধরাধরি করে নিচে নিয়ে যাওয়া হল তাঁকে সত্যি কথা বলতে কী, আমি তখনও প্রায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় কয়েকজন ঘিরে ধরলেও ধাতস্থ হতে সময় লাগল তারপর সব কথা বললাম তাদের বৃন্দাবন পাশেই ছিল চমকে উঠে বলল, তাই তো, সত্যকে তো দেখছি না! বলতে বলতে ছুটে বেরিয়ে গেল সে অন্যদের নিয়ে সারা বোট তন্নতন্ন করে খোঁজা হল পাওয়া গেল না তাকে
“মহাদেব চৌধুরী বললেন, বৃন্দাবন, দেখ তো বোট ছাড়তে পারো কিনা আর থাকা যায় না এখানে কলকাতায় ফিরে যাব
“শুনে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল বৃন্দাবন, আমি তো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না কত্তা! সত্য আমার আপন ভাগনে সে এমন কী করে হবে? দাদাবাবু ভুল দেখেননি তো?
“ধনঞ্জয়দা ইতিমধ্যে কিছু সামলে উঠেছেন ক্ষতস্থানে ওষুধপত্র লাগানো হয়েছে মহাদেব চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ব্যস্ত হবার দরকার নেই বাবাজি বিপদ কেটে গেছে পচা গন্ধও আর নেই সকালটা হতে দিন
“এরপর বাকি রাতটা যে কীভাবে কেটেছিল, তা আর বলার নয় দারুণ আতঙ্কে প্রায় হিম হয়ে রয়েছে সবাই খালের দুপাশে ঘন জঙ্গল, আবছা চাঁদের আলোয় থমথম করছে দূর থেকে হঠাৎ ভেসে আসা দু-একটা অচেনা আওয়াজ রাতের অন্ধকার যে কী ভয়ানক হতে পারে, সেই টের পেলাম প্রথম! ওদিকে সঙ্গীদের নিয়ে বৃন্দাবন সেই থেকে মাথায় হাত দিয়ে থম হয়ে রয়েছে কারও মুখে কথা নেই ব্যতিক্রম শুধু ধনঞ্জয়দা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন
“এইভাবেই রাত ভোর হল এক সময় ঘুম ভাঙতে ধনঞ্জয়দা বৃন্দাবনকে ডেকে বললেন, চিন্তা কোরো না বাবাজি তোমার কথাই ঠিক জায়গাটা ভালো বলেই ভয়ানক বিপদে পড়েও উদ্ধার পাওয়া গেছে এক কাজ করো, যে পথে গতকাল ওরা কাঠ কাটতে গিয়েছিল, সেই জায়গাগুলো খুঁজে দেখে এসো একবার
“নির্দেশ পেয়ে সঙ্গীদের নিয়ে বৃন্দাবন চলে গেল দারুণ উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম আমরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে এল ওরা সঙ্গে সত্যর অচৈতন্য দেহ গায়ে ধুম জ্বর রাতে মুখে যে রক্তের দাগ দেখেছিলাম, তার চিহ্নমাত্র নেই গতকাল যে গাছ থেকে ওরা কাঠ কেটেছিল, সত্য তারই নিচে পড়েছিল অদ্ভুত ব্যাপার হল, দেহটার চারপাশে বাঘের টাটকা পায়ের দাগ বোঝা যায়, প্রাণীটা অনেকবার চারপাশ দিয়ে পাক খেয়েছে, কিন্তু স্পর্শ করেনি
“দেরি না করে বোট ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল সেই দণ্ডেই পথে কোনো বিপদ আর হয়নি ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠছিল সত্যও দুদিন পরে নিরাপদেই বোটে ক্যানিং পৌঁছে কলকাতা ফিরে এসেছিলাম
রাধাকান্তদা থামলেন বাইরে তখন বৃষ্টির তেজ আরও বেড়েছে মেসের ঘরে আমরা কয়েকজন তখন নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছি সেদিকে এক ঝলক চোখ বুলিয়ে উনি বললেন, “এ গল্প কিন্তু এখানেই শেষ তবে বুঝতে পারছি, মেলা প্রশ্ন উঁকি দিতে শুরু করেছে সবার ভিতরে সেদিন আমারও তাই হয়েছিল কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও অসুস্থ ধনঞ্জয়দাকে কোনো প্রশ্ন করা সম্ভব হয়নি কলকাতা ফিরে উনিও আর মেসে ওঠেননি মহাদেব চৌধুরী তাঁকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন মানুষটির সঙ্গে দেখা হয়েছিল মাসকয়েক পরে মেসে একদিন আমাদের খোঁজখবর নিতে এসেছিলেন সেই রাতের ঘটনা সম্পর্কে প্রশ্ন করতে গোড়ায় পাশ কাটিয়ে বলেছিলেন, পুরনো কাসুন্দি না ঘেঁটে ভুলে যাওয়াই ভালো বাবাজি
“সোজা কথায় উত্তর মিলবে না বুঝে ফস করে বললাম, ঠিক আছে দাদা কিন্তু একটা প্রশ্নের অন্তত জবাব দিন সে রাতে ওই ভয়ানক কাণ্ডের পরেও সকালে কী করে বৃন্দাবনকে বললেন, জায়গাটা ভালো?
“ভালো নয়?
“দুহাত কপালে ঠেকিয়ে চোখ বুজে মিনিটখানেক স্থির হয়ে রইলেন উনি তারপর অল্প হাসলেন, তাহলে শোনো বাবাজি মহাদেব চৌধুরীর মতো তোমরাও ভেবেছিলে নিজের ক্ষমতার জোরেই সেদিন রক্ষা পেয়েছিলাম তা নয় সেদিন অন্ধকার রাতে বোটের ছাতের উপর ঠায় বসে থাকতে থাকতে সামান্য তন্দ্রা মতো এসেছিল, আক্রমণকারী সেই সুযোগেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমার উপর মুহূর্তে ঘাড়ের পাশে চেপে বসেছিল ধারালো দুই সারি দাঁত গোড়ায় আমি হয়তো তার লক্ষ্য ছিলাম না কিন্তু পচা গন্ধে বোটে তার উপস্থিতি টের পেয়ে যেতে কিছু অসুবিধা করে দিয়েছিলাম অবশ্যই তাই হয়তো তার আক্রোশের লক্ষ্য হয়ে উঠেছিলাম এত শ্মশানে গোরস্থানে রাত কাটিয়েছি এমন ভয়ানক অবস্থায় কখনও পড়িনি! মৃত্যু যখন দোরগোড়ায়, তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো ক্রমশ চেপে বসছে হঠাৎ কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর প্রচণ্ড আঘাতে ছিটকে ফেলে দিল
“আবছা হলেও চাঁদের আলো ছিল তবু চেষ্টা করেও দেখতে পাইনি তাঁকে শুধু বুঝতে পারছিলাম, অশরীরী কোনো ব্যক্তির সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই করছে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়া সত্যর দেহধারী সেই আক্রমণকারী পরিণতি তো দেখতেই পেয়েছ
“ধনঞ্জয়দার সেই কথায় আরও গুলিয়ে গেল ভিতরে তাড়াতাড়ি বললাম, কোন অশরীরী?
“যাকে তুমি সেই সন্ধ্যায় বোটে উঠতে দেখেছিলে
“সে অশরীরী কোথায়! অবাক হয়ে বললাম, নিজের চোখেই তো দেখতে পেলাম তাকে, জলজ্যান্ত একটা মানুষ লাফ দিয়ে বোটে উঠল!
“হ্যাঁ, তখন দিনের আলো কিছু ছিল, তাই দেখতে পেয়েছিলে তবে অশরীরী অপদেবতা হলেও উনি কিন্তু বোটে উঠেছিলেন আমাদের রক্ষা করার জন্যই তাই তখন কোনো গন্ধ পাইনি সেটা নাকে এল, যখন দ্বিতীয় জন সত্যর দেহ ধরে বোটে উঠল
“তাহলে উনি তো পরেও বোটে উঠতে পারতেন আমার সাক্ষাতে উঠবেন কেন? ফের প্রশ্ন করলাম
“তখন সন্ধ্যা নেমেছে বাইরে রাস্তায় আলোর রোশনাই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ধনঞ্জয়দা হাতদুটো বুকের কাছে নিয়ে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইলেন তারপর সামান্য বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, বাবাজি, এই সন্ধের সময় ওসব বেশি আলোচনা না করাই ভালো তবু জানতে চাইলে তাই বলি, সেই বিকেলে যে গাছ থেকে ওরা কাঠ কেটেছিল বিপদ ছিল সেখানেই সম্ভবত গাছে উঠেছিল সত্য গাছ থেকে নামার পর তাই সে আর সত্য ছিল না, অন্য কিছু সত্যর সেই দেহধারী বোটে একবার এসে পড়লে তুমি যাকে দেখেছিলে তার পক্ষে আর বোটে ওঠা সম্ভব হত না সেক্ষেত্রে সেই রাতে বোটে আরও ভয়ানক কিছু যে ঘটত, তাতে সন্দেহ নেই
----------
ছবি – সুকান্ত মণ্ডল

2 comments:

  1. বেশ গা ছমছমে। উপভোগ করলাম।

    ReplyDelete
  2. ক্লাসিক অলৌকিক গল্প। বেশ ভয়ের ...

    ReplyDelete