
হিটলারের
হুইস্পার
পূর্বা
মুখোপাধ্যায়
(১)
আমার ছেলে
হারিয়ে গেছে। কেউ তাকে দেখে থাকলে যোগাযোগ করুন।
নাম -
হিটলার
স্বভাব -
গম্ভীর
বয়স - ৭ বছর
ধবধবে সাদা
নাকের নীচে
স্পষ্ট কালো গোঁফ
দিশি বেড়াল
হলেও পার্শিয়ানের মতো লোম ও মোটা ল্যাজ…
চোখের জলে
ভাসতে ভাসতে রুচিরা মাসি ড্রাফট টাইপ করছিলেন। ছাপা হয়ে কিছু পোস্টার হবে। পাড়ায়
পাড়ায় আটকে দেবে পার্টির রন্টু। আর বাকিটা খবরের কাগজের সঙ্গে যাবে, লিফলেট। মাখন
কাগজওয়ালার দায়িত্ব সেটা।
গত পরশু
থেকে হিটলার লিখোঁজ। রুচিরা মাসির আদরের বেড়াল। বাড়িতে শোকের ছায়া। রান্নাবান্না
বন্ধ। মেয়ে দীপাবলি কোনো রকমে ভাত আলুসেদ্ধ, ম্যাগি-ট্যাগি
দিয়ে চালাচ্ছে। রুচিরা মাসি তো কিছু মুখেই তুলছে না। বাড়ি বাড়ি ফোন আর হোয়াটস্যাপ
তুমুল অ্যাকটিভ। হ্যাঁ রে, খোঁজ পাওয়া গেল? কী রে, ফিরল? বেড়াল
তো ঠিক চিনে ফিরে আসবে, দেখিস… এসব উদ্বিগ্ন
জিজ্ঞাসা ছাড়াও আছে আড়ালের বার্তা - বাড়াবাড়ি, ন্যাকামো, ঢং
ইত্যাদি বিশেষণ।
মিচকে মহিলা
সম্প্রদায়ের প্রেসিডেন্ট মোনালিসা মাইতি সকাল এগারোটায় বাড়ির সক্কলে আপিসে কলেজে
রওনা হবার পরে চিকেনের ঝোল আর আলু পোস্ত নামিয়ে শোকপ্রকাশক একটা ম্যাটাম্যাটা
কালারের সালোয়ার চাপিয়ে এসে মেসেজগুলো মৌখিক ডেলিভার করে দিল। আগে হলে রুচিরা মাসি
তেড়ে গিয়ে কমন হোয়াটস্যাপ গ্রুপে নাম না করে অগ্নিবর্ষী বাক্যবাণে সব ক’টাকে দিতেন
এক্কেবারে শেষ করে। কিন্তু মাসি সত্যিই ভেঙে পড়েছেন; দু-কাপ চা
(ওই চায়ের ওপরেই বেঁচে আছেন) টেবিলে নামিয়ে সোফায় এলিয়ে পড়লেন। বললেন, “মোনু, এদের তো যায়নি, যার যায় সেই বোঝে। এরা কী বুঝবে রে
ভালোবাসার! বিষ্টিতে রাস্তার কুকুর বেড়াল ফ্ল্যাটের সিঁড়িতে এসে শুলে তাড়িয়ে দেয়!
এরা মানুষ!”
মাছ পিন্টু
খোঁজ নিতে ফোন করে দুপুরবেলা, বাজার শেষে
- “দিদি, মাছ
লাগবে না?”
খোঁজ নেয় নিজের স্বার্থেই। বুকটা ফেটে যায় মাসির। অনেক প্যাখনা ছিল ছেলের; হিটলারী।
পাঁচ-ছ’ইঞ্চি
মাপের পোনা হতে হবে। অন্য কিছুই চলবে না। একবার বাটা দিয়েছিল। এক কেজি মাছ কাজের
মেয়ে সুখীকে দিয়ে দিতে হল ধরে। শুঁকেই মুখ ঘুরিয়ে, হাত ঝেড়ে
গিয়ে পাঁউরুটি হয়ে বসে রইল পেটে কিল মেরে। একদিন অন্তর অন্তর দু-কেজি মাছ আসত।
রাত্তির বেলা ফোন হত – ‘পিন্টু, কাল মাছ দিস।’ পিন্টু বলত, ‘হ্যাঁ
দিদি।’ সন্ধেয় পেমেন্ট চলে যেত গুগল পে-তে। ওরও লস বই-কি! ফ্রীজারটা খুলে দেখে
রুচিরা মাসি,
দিনের হিসেবে মাছ কাটা, কৌটো ভরে রাখা এখনও। মাথা, পাখনা, পেটের
পটকা সব ফেলে কেটে রাখা নিজের হাতে। নইলে ছেলে মুখেই তুলত না যে।
(২)
দিন সাতেক
হয়ে গেল। সব পোস্টার সাঁটা হয়ে গেছে। লিফলেট বিলিও। তাও খোঁজ নেই। সন্ধেবেলায় বেল।
“আন্টি, আমি
অরিত্র। হিটলারের জন্য আমি, মানে আমরা সবাই খুব ফিল করি। কিছু
কথা ছিল এ ব্যাপারে…”
অরিত্র ঘরে
এসে গুছিয়ে বসে জানায়, যে তার এক পরিচিতের একজন পরিচিত অ্যানিমাল
হুইস্পারার আছে।
“সেটা আবার
কী?”
“আন্টি, এরা
অবলা পশুদের সঙ্গে কম্যুনিকেট করতে পারে। সাধারণত ওদের শরীর খারাপ-টারাপ হলে অনেক
সময় এদের সাহায্য নেওয়া হয়। ওরা তো ঠিক বলতে পারে না কী অসুবিধে হচ্ছে! এরা পশুদের
ভাষা বুঝতে পারে, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ইত্যাদি।”
রুচিরা মাসি
তো হাঁ। এরকমও হয়?
“হ্যাঁ, হয়
আন্টি। তবে বিরল ক্ষমতাসম্পন্ন এই সারিকা মালহোত্রা। দিল্লিতে থাকেন। কিন্তু আপনি
যদি হিটলারের ছবি আর ওর সব ডিটেইলস ওকে দেন, ও কানেক্ট
করে নেবে, সে হিটলার যেখানেই থাক, যে
অবস্থাতেই…
খারাপ খবর কিছু থাকলেও… মানে ইয়ে…”
রুচিরা
মাসির মাথা তখন একেবারে খারাপ। “এও হয়! আমি জানতে পারব? যত খারাপ
খবরই হোক,
সয়ে নেব,
তাও জানব তো! সে আছে। বা নেই… তোমার ভালো হোক বাবা অরিত্র, তুমি
নম্বরটা দাও,
আমি যোগাযোগ করব।”
অরিত্র অবাক
হয়ে দেখে আশাবরী ফ্ল্যাটের ফাইভ সি-র রুচিরা সেনরায়কে। ইনিই একবার অরিত্রকে কী
বকাটাই না দিয়েছিলেন রাস্তার কুকুরটাকে লাথি মারার জন্য! বলেছিলেন, ‘তুমি
তো এইটুকু একটা পুঁচকে ছেলে। আমার চেহারাটা দেখেছ? আমি যদি
তোমায় অমন একটা জোরসে লাথি মারি?’ উনি ভুলে
গেছেন। অরিত্র ভোলেনি৷ নম্বর দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে আসে৷
নম্বর আসে।
রুচিরা মাসি হিটলারের গোটা দশেক ছবি আর পুঙ্খানুপুঙ্খ ডিটেইলস পাঠিয়ে দিয়ে অনেক
দিন পর গরম ভাত, মাখন আর আলুসেদ্ধ দিয়ে মেখে দু-গরাস মুখে পুরে শুতে যান। সারিকা
মালহোত্রার ফি পাঁচ হাজার টাকা, জি পে।
পাঁচ দিন পর
খবর আসে -
হিটলার আছে।
ভালোই আছে। জানিয়েছে সেই যে, প্রচুর কাজ আছে তার, তাই
সেখানেই থাকবে। বাড়ি ফেরার ইচ্ছে নেই। তবে বাড়ির ওই মধ্যবয়সি মহিলার প্রতি তার
একটাই কথা, বড্ড ডমিনেটিং, আর সবার ব্যাপারে নাক গলানো স্বভাব।
নিজেকে পালটানো দরকার। সারিকার ইংরেজি মেসেজে - টেল হার টু মাইন্ড হার ওন বিজনেস।
(৩)
পুরোটা
শান্তি নয়, তবে এইটুকু যে সে ভালো আছে, এটাই অনেক। অনেকদিন পরে শান্তিতে চোখ
বুজেছিলেন রুচিরা মাসি। উঠতে দেরিই হয়ে গিয়েছিল। এমনিতে তো
এই গত সাত বছর ঠিক পাঁচটায় ম্যাঁও অ্যালার্মে উঠতে হত। তাকে খেতে দেওয়া। তারপর
বারান্দার দরজা খুলে দেওয়া। ক্যাট প্রুফের জাল ঘেরা বারান্দায় বসে সে রাস্তা দেখত
আর কাক চড়াইদের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি। এ ক’দিন সব বন্ধ। তাও সেই পাঁচটাতেই ঘুম ভেঙেছে।
হিটলারের খাবার পাত্রটা ফাঁকাই পড়ে। বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন রুচিরা মাসি। ক্ষণে
ক্ষণে নিচে তাকিয়েছেন, পায়ের কাছে কেউ কি বসে! বন্ধু কাক চড়াইগুলোও এসে গোল বাধায়
- ওদের নিত্য ঝগড়া মিস করে বোধহয়। পাখিদের দানা দিয়ে ঘরে চলে আসেন রুচিরা সেনরায়।
ফাঁকা ঘরে - কেউ আর মাছ চায় না।
আজ ঘুম ভাঙল
কন্যে দীপাবলির আর্ত কণ্ঠে। হুড়মুড় করে
উঠে এসে দেখেন বাইরের ঘরের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে দীপু বারবার ডেকে যাচ্ছে – “মা, ও
মা দেখবে এসো,
দেখবে এসো।”
দেখে দরজার
বাইরে বসে হিটলার। বিধ্বস্ত। রোগা হাড় হয়ে গেছে। ধবধবে গায়ে কালো ছোপ। জিভ বের করা
- হাঁপাচ্ছে। দরজা থেকে ঘরে ঢোকার শক্তিটুকুও নেই যেন। দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নেন
রুচিরা মাসি। হিটলারের মাম্মাম। যদিও হিটলার এ নামে ডাকেনি কখনও৷ কিন্তু সবাই
জানে।
এরপর প্রথমে
জল, তারপর মাছ সেদ্ধ। ভাগ্যিস মাছগুলো ফেলে দেননি। এরপর প্যারাভেট নির্মলকে ডেকে
স্পট অন। কত পোকা গায়ে নিয়ে এসেছে কে জানে! সন্ধেবেলা ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট।
ফুল চেক আপ। আশাবরীর ফাইভ সি ফ্ল্যাট আবার সুরে বাজে। ডিনারের জন্য বিরিয়ানির
প্যাকেট নিয়ে ঢোকেন সেনবাবু, আর রসমালাই।
(৪)
খাওয়াদাওয়া
সেরে সব যে যার ঘরে। বসার ঘরের সোফায় এসে বসেন রুচিরা মাসি। হিটলার বক্স জানলায় ওর
প্রিয় আসনে। একটা বিছানা কিনে ওর জন্য ওখানে পেতে দেওয়া হয়েছিল। বড়ো রাস্তাটা দেখা
যায়। হিটলার দেখে। রাত্তিরের অন্ধকারেও বাইরে চেয়ে থাকে। শীতের রোদে ওখানেই ঘুমোয়।
দক্ষিণের বাতাসে গা জুড়োয়।
তখন ঝিমোচ্ছে।
দুর্বল। কী রোগা হয়ে গেছে!
ঠিক আছে, ঘরের
ছেলে ঘরে তো ফিরেছে। দু-দিন ভালো করে পেট ভরে খেলেই আবার আগের মতন হয়ে যাবে। এক
সপ্তাহ পর আবার ডাক্তারের কাছে চেক আপ।
কী মনে হতে
অরিত্রর নম্বরটা ডায়াল করেন রুচিরা মাসি। সারিকা
মালহোত্রা যাই বলুক, ছেলেটা উপকার করতে তো এগিয়ে এসেছিল।
বেশ
কিছুক্ষণ বাজার পর ধরল অরিত্র। “হ্যাঁ বলুন, রুচিরা
আন্টি, সারিকা
তো বলেছে ভালো আছে হিটলার। আবার মন কেমন করলে কন্ট্যাক্ট করবেন। ফিজ-টা
একটু বেশি। আপনার কাছে কী আর এমন! আদরের হিটলারের জন্য।” পেছনে খুব
হইহল্লা।
“তুমি
কি বাইরে?”
“হ্যাঁ
আন্টি, একটা
পেমেন্ট পেয়েছি,
তাই বন্ধুদের ট্রিট দিতে…”
“আচ্ছা, পরে
কথা হবে।”
কেমন যেন
অস্বস্তি হয় রুচিরা মাসির। মেসেজ করেন সারিকা মালহোত্রাকে। স্ক্রিনে ফুটে ওঠে - এই
নম্বরটি এখন উপলব্ধ নয়। পরে চেষ্টা করুন। অর্থাৎ সাময়িকভাবে বন্ধ।
হিটলারের
দিকে তাকান রুচিরা। ডাকেন - বাবাইটা, আর একটু খাবি? আমার
কাছে শুবি আজ?
কষ্ট হচ্ছে তোর? সারিকা মালহোত্রা যে বলল তুই ভালো আছিস? এই
তার নমুনা?
হিটলার
তাকায় - ভালো ছিলাম? দেখে তাই মনে হচ্ছে তোমার?
স্পষ্ট শুনলেন
রুচিরা মাসি। হিটলার কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আস্তে আস্তে চোখ বুজল।
ফ্যাসফ্যাসে গলায় অস্ফুটে ম্যাঁও বলল একবার।
রুচিরামাসি
আবার শুনলেন - যে যা বলে বিশ্বাস কর কেন তুমি?
হিটলার
সামনের পায়ের ওপর মুখ রেখে শুল। তাহলে কি আমি হিটলারের হুইস্পার শুনতে পাচ্ছি? - রুচিরা
মাসি ভাবেন।
----------
ছবি - মেটা এআই
No comments:
Post a Comment