ফুলটুসি আর রমাকান্ত
ঈশানী রায়চৌধুরী
রমাকান্ত
পাঁচিলের ওপরে গ্যাঁট হয়ে বসে এক চোখ বন্ধ করে অন্য চোখটা আধখোলা রেখে আশেপাশের সব
কিছু নজরে রাখছিল। এই দুপুরবেলাটাই তার একটু বিশ্রামের সময়। সকাল থেকে নিঃশ্বাস
ফেলার ফুরসত থাকে না মোটে। বাড়িতে সমানে
একতলা থেকে তিনতলা টহল দিয়ে বেড়াতে হয়। এ তল্লাটের সে-ই হল সর্দার। বাড়িতেও
তার খুব রোয়াব। ওই যে বড়ো বাগানঘেরা তিনতলা লাল বাড়ি, ওইটে এই অঞ্চলের সবচেয়ে অবস্থাপন্ন
সরকারদের পৈত্রিক ভিটে। দু-পুরুষ আগের যা বোলবোলাও ছিল, এখন অতটা নেই বটে; কিন্তু
যতটুকু যা পড়ে আছে, তাতে তালপুকুরে ঘটি ডোবালে এখনও চাট্টি মণিমুক্তো উঠে আসবে।
রমাকান্ত এই বাড়িরই পুষ্যিপুত্তুর। মানে চারপেয়ে পুষ্যিপুত্তুর। চোখ
ফুটে ইস্তক দেখে আসছে সকলেই তাকে মাথায়, থুড়ি কোলে তুলে রেখেছে। আসলে
তার মা তারাসুন্দরী ছিল এ বাড়ির কর্তামার কোলের খুকি। মাছের দাগা, দুধের সর ছাড়া
তারাসুন্দরী কোনো দিন অন্য কিছু মুখেই তোলেনি। রমাকান্ত তারই খোকা।
রমাকান্তর তিনটে দিদিও ছিল বটে; একটা জন্মেই মরে গেল আর দুটোকে এই বাড়ির দুই মেয়ে
তাদের শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে গেল। রয়ে গেল রমাকান্ত, তারাসুন্দরীর কোল
আলো করে। তারপর একদিন কী একটা কঠিন রোগে তারাসুন্দরী পট করে চোখ বুজল। তখন
রমাকান্ত খুবই ছোটো; টালুমালু করে হাঁটে। এমনকি তখন কেউ বুঝতেও
পারেনি যে বড়ো হলে তার এমন চামরের মতো লেজ হবে, ফরসা নধর তেল-চুকচুকে চেহারা হবে,
গোঁফের বাহার হবে।
যত
দিন যেতে লাগল, ততই পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল, যে এই বাড়িটা রমাকান্তরই বাড়ি; সে
ক্ষমাঘেন্না করে দু-পেয়ে মানুষদের থাকতে দিয়েছে! আসলে কর্তামায়ের নামেই তো সব
বিষয়আশয়; তাই তাঁর পেয়ারের হুলো রমাকান্তই সর্বেসর্বা। এমনকি
তার কোনো ছোট্ট ডাকনাম পর্যন্ত নেই! ‘রমাকান্তওও...’ বলে হাঁক পাড়লে এবং সেই সময়ে
তার মেজাজ-মর্জি ভালো থাকলে তবেই সে হয় হেলতে দুলতে এসে হাজির হয় আর নয়তো দূর থেকে
‘ম্যাও’ বলে সাড়া দেয়। পরলোকগত কর্তাবাবুর লাল
টুকটুকে ভেলভেটে মোড়া আরামকেদারাটা এখন রমাকান্তর সিংহাসন। সে রাজার মতো সেখানে
যখন-তখন ইচ্ছেসুখে শুয়ে বসে থাবা চাটে। কর্তা-মা ঝকঝকে কাঁসার বাটিতে ঘন
দুধে গোবিন্দভোগ চালের ভাত মেখে তার সামনে উবু হয়ে বসে সাধ্যসাধনা করে তাকে খাওয়ান। তাঁর
ফচকে ছোটো নাতি অবশ্য বলে, ঠাম্মা নাকি রমাকান্তকে ভুলিয়ে ভালিয়ে খাওয়ানোর জন্য
তাকে লালকমল-নীলকমলের গল্পও শোনান! এই ঠাট্টাতামাশা রমাকান্তর কানেও এসেছে। সেই
থেকে বিলটুর ওপরে বেজায় রাগ তার। সে তাই তক্কে তক্কেই ছিল। একদিন
যেই না বিলটু কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে নিজের ঘরের দরজা ভেজিয়ে চুপি চুপি সিগারেটে টান
দিয়েছে, অমনি রমাকান্ত কর্তামার আঁচল ধরে করুণ গলায় মিউ মিউ করতে করতে তাঁকে টেনে
নিয়ে এসেছে ওই ঘরে। তারপর আর কী! কর্তামাকে তো এই বাড়ির সকলে যমের মতো ডরায়। বিলটু
বকুনির তোড় সামলাতে না পেরে বন্ধুদের সামনে নিজের কান ধরে ক্ষমা চেয়ে তবে নিষ্কৃতি
পায়।
রমাকান্ত
বাড়ির ছেলেপুলের স্বঘোষিত চারপেয়ে অভিভাবক বলা যেতে পারে। তার নাম ‘কর্তামার
গুপ্তচর’। এখন তো এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, যে সন্ধেবেলা মা-কাকিমারা যখন
একসঙ্গে বসে টিভি সিরিয়াল দেখেন, ছেলেপুলেদের পড়ার ঘরে পাহারায় থাকে রমাকান্ত। কেউ
নিজেদের মধ্যে হা হা হি হি করুক বা চুলোচুলি করুক, প্রথমে সে রাগি গলায় জবরদস্ত
একটা ‘ম্যাও’ বলে। তাতে না থামলে আড়মোড়া ভেঙে দুলকিচালে ঘর থেকে বেরিয়ে টিভির
ঘরের দিকে রওনা দেয়। অর্থাৎ গিয়ে ‘ম্যাও ম্যাও’ করে নালিশ করবে যে ছেলেপুলেরা
ফাঁকি মারছে। মা-কাকিমারা অমনি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে কারও কানে আড়াই প্যাঁচ
দেবেন, কারও পিঠে স্কেল ভাঙবেন। দু-চারবার উত্তম-মধ্যম খাওয়ার পরে
এখন ছেলেপুলেরাও সমঝে গেছে; তারা রমাকান্তকে বিশেষ ঘাঁটায় না।
এবার
আমরা ফুলটুসির কথা জানব। ফুলটুসি থাকে এ পাড়ার বস্তিতে। তার মা মরে গেছে ফুলটুসির
জন্মের ঠিক পরেই। বাবা তাকে পাড়াতুতো কাকা-কাকির সংসারে জিম্মা করে দিয়ে সংসার
ছেড়ে বিবাগী হয়ে গেছে। মাকে মোটে মনেই পড়ে না ফুলটুসির। বাবাকে যেটুকু মনে আছে,
সেও আজকাল কেমন কুয়াশার চাদরে মোড়া আবছামতো। কাকা-কাকি দু-চক্ষে দেখতে
পারে না তাকে। দু-বেলা দু-মুঠো খেতে দেয়,
বছরে চারখানা জামা-ইজের আর একজোড়া হাওয়াই চটি, ব্যস! জামা, চটি ছিঁড়ে গেলে
সেফটিপিন ভরসা। বস্তির ভেতরে একটা বিনে-পয়সার
ইস্কুল আছে, সেটাতে পর্যন্ত এখন আর যেতে দেয় না। তাও কান্নাকাটি করে বছর
দুই গিয়েছিল বটে ফুলটুসি; বাংলা হরফ, সহজ যোগ বিয়োগ, নামতা শিখেছিল। কিন্তু
যেই কাকিকে ডেকে দিদিমণি বলল যে তার মাথা নাকি কাকির দুই ছেলেমেয়ের মাথার থেকে ঢের
ভালো, ফুলটুসি কেমন সব চটপট শিখে নেয়; অমনি কাকির গোঁসা হল খুব। কাকাকে
দিয়ে ছুতো করে মার খাওয়াল ফুলটুসিকে, একটা গোটা বেলা ভাত খেতে দিল না। পষ্ট
বলে দিল, খেতে গেলে খেটে খেতে হবে। এখন তাই ফুলটুসি কাগজ-কুড়ুনি হয়েছে। রোজ
সকালে বাসি রুটি একডেলা আখের গুড় দিয়ে গিলে ঢকঢক করে জল খেয়ে ফুটিফাটা ঝোলা নিয়ে
কাগজ কুড়োতে বেরোয়। দুপুর একটা পর্যন্ত কাগজ কুড়িয়ে ঘরে এসে দুটো ডাল-ভাত খায়। খুব
কপাল ভালো থাকলে এক দলা আলুসেদ্ধ বা একটু ঘ্যাঁট তরকারি। তারপর
আবার কিছুক্ষণ কাগজ কুড়িয়ে বেড়ানো। সন্ধের পরে কাকির হাতে হাতে কাজ করে,
রাস্তার টিপকল থেকে খাবার জল নিয়ে আসে, কাকা জনমজুর খেটে ফিরলে তার হাত-পা টিপে
দেয় আর তারপর রাতে রুটি-তরকারি খেয়ে শুয়ে পড়ে। শুলেও কিন্তু ঘুমোয় না সে।
অন্ধকারে ছেঁড়া মাদুরে শুয়ে তেলচিটে বালিশে মাথা রেখে কত কিছুই যে ভাবে! না-দেখা
মায়ের কথা, অল্প-দেখা বাবার কথা, ইস্কুলের কথা, ভালো ভালো খাবারের কথা, নতুন
চুড়ি-ক্লিপ-টিপের পাতার কথা... এই সব।
ফুলটুসির
বয়স এখন দশ। সে জানে, জন্মদিনে কেক-পায়েস-বেলুন-নতুন জামা হয়; কিন্তু জানে
না তার নিজের জন্মদিন কবে! তার খুব লেখাপড়া করতেও ইচ্ছে করে! কাগজ কুড়োয় তো! ছেঁড়া
খবরের কাগজ, ঠোঙা, বইয়ের পৃষ্ঠা... যাতেই কিছু না কিছু হরফ লেখা আছে বাংলায়, সেটা
কচি কচি হাতে টানটান করে মেলে দিয়ে আঙুল দিয়ে দিয়ে বানান করে করে পড়ে আর তারপর তা
ঝোলায় ফেলে। তাদের বস্তির লাগোয়া একটা পুরোনো খবরের কাগজ, খাতা বই,
শিশিবোতল বিক্রির দোকান আছে। হরেন
নামের সেই দোকানিকে ‘মেসো’ বলে ডাকে ফুলটুসি। কাজের ফাঁকে অবসর পেলে
ওখানে বসে কাগজপত্র, খাতা-বই নাড়াচাড়া করে। মলিন ফ্রক আর
সেফটিপিন লাগানো হাওয়াই চটি পরা, একমাথা কোঁকড়া চুলে ঘেরা ডাগর চোখের ফুলটুসিকে
বস্তির সকলে খুব ভালোবাসে; তবে তার মুখরা কাকি, বদমেজাজি কাকা আর হিংসুটে
ভাইবোনদের ভয়ে কেউ সেই ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারে না।
রমাকান্ত
খুব ভালো করে চেনে ফুলটুসিকে। দুপুরটা বাড়ির ছেলেপুলে ইস্কুল-কলেজে
থাকে, কর্তা-মা খেয়েদেয়ে পালঙ্কে গা এলিয়ে একটু জিরোন, কর্তামার দুই ছেলের বিরাট
ব্যাবসা... তাঁরা নিজেদের আপিসে থাকেন, বউমারা যে যার ঘরে দিবানিদ্রা দেন।
রান্নার ঠাকুর বেরোয় গলিতে, দেশোয়ালি ভাইদের সঙ্গে তাস খেলতে আর গুণ্ডিপান খেতে। কাজের
মাসি মোক্ষদা ভরপেট ভাত খেয়ে চিলেকোঠায় আঁচল পেতে ফুরফুর করে নাক ডাকে আর সেই
সুযোগে বামুনঠাকুরের পিছু পিছু রমাকান্ত বেরোয় রোঁদে। তার
সময় বাঁধা আছে রোজ দুপুর দুটো থেকে চারটে। আর
তাই সে খুব ভালো করে জানে ফুলটুসিকে। রমাকান্তকে দেখতে পেলেই ফুলটুসি দৌড়ে
এসে তাকে আদর করে, গলার নিচটায় চুলকে দেয়। আরামে চোখ বুজে আসে
রমাকান্তর। খুকির প্রাণে খুব মায়াদয়া! একদিন হরেন ফুলটুসিকে একটা সাদা
মিষ্টি মিষ্টি দুধ আইসক্রিমের মাঝারি মাপের কাপ কিনে দিয়েছিল। আইসক্রিম খেয়ে ফুলটুসি কাপটা
ধরেছিল রমাকান্তর সামনে। কাপের ভেতরে জিভ বুলিয়েই রমাকান্ত বুঝেছিল ইচ্ছে করেই ফুলটুসি
খানিকটা আইসক্রিম তার জন্য রেখে দিয়েছে! সত্যি, কর্তা-মা ছাড়া রমাকান্তকে এত ভালো
আর কেউ বাসে না!
ফুলটুসির
কপাল মন্দ! সেদিন কাগজ কুড়োতে গিয়ে বিচ্ছিরি বৃষ্টি নামল। ঘরে
ফিরে আসতে হল খালি ঝোলা নিয়ে। এসে দেখল কাকির মুখ তোলো হাঁড়ি। ভাইবোন
দু’জনেই অঙ্ক পরীক্ষায় ফেল করেছে। ইস্কুল থেকে বলেছে মাস্টার রাখতে। সে কি
অত সহজ নাকি? মাস গেলে মাইনে গুনবে কে? কথায় কথা বাড়ে। তখনই
কাকি বলল, ফুলটুসির জন্য সংসারের খরচ বেড়ে গেছে। তারপর ভাইকে আর বোনকে
জিজ্ঞেস করল, “কী আঁক কষতে পারিসনি?” তখন ওরা মিনমিন করে বলল, “সাত নয়ে কত হয় বলতে
পারিনি আর চার বারোং কত, সেটাও পারিনি।” ফুলটুসির মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “তেষট্টি
আর আটচল্লিশ।” ব্যস! কাকি চুলের মুঠি ধরে গুমগুম করে মেরে, জোরে জোরে কান
মুলে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বার করে দিতে দিতে বলল, “দূর হয়ে যা! আর যেন এদিকপানে না
দেখি। বেশি পণ্ডিত হয়েছিস, না?” তখন ভাই বলে দিল, “মা, ফুলটুসি তো
কাগজ কুড়োতে গিয়ে সময় নষ্ট করে ছেঁড়া কাগজ আর ঠোঙা পড়ে! হরেন মেসোর দোকানে গিয়ে
বসে থাকে পুরোনো বইয়ের ছবি দেখার জন্য!” অমনি কাকি ফুলটুসিকে চেঁচিয়ে বলে দিল, “কক্ষনো
এ ঘরমুখো হবি নে আর। যেখেনে দু-মুঠো জুটবে, সেখেনেই যা!”
ফুলটুসির
এত কান্না পাচ্ছিল! সে ফ্রকের খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে পায়ে চটিজোড়া গলিয়ে গলি থেকে
বেরিয়ে এল। কোথায় যাবে, জানে না। ভরদুপুর তখন, পেটের ভেতরটা
খিদের চোটে পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে। হরেন মেসোর দোকানটাও বন্ধ।
রাস্তার টিপকল থেকে কয়েক আঁজলা জল খেয়ে ফুলটুসি গিয়ে বসে পড়ল ওই পাঁচিলটার গা
ঘেঁষে; যে পাঁচিলে রমাকান্তর দুপুরের রাজপাট।
রমাকান্ত
পাঁচিলের ওপরে বসে চারদিকে নজর রাখছিল। ফুলটুসিকে অমন ছুটে এসে ধপাস করে বসে
পড়তে দেখে ভারী অবাক হল সে। খালি হাতে কেন? ঝোলাটা কোথায় গেল?
রমাকান্ত ফুলটুসিকে খুবই নেকনজরে দেখে। শুধু আইসক্রিম খাইয়েছে বলেই নয়
কিন্তু। সে খেয়াল করে দেখেছে মেয়েটার পড়াশুনোয় মতিগতি খুব। আহা,
ইস্কুলে যেতে পারে না বেচারি! ওদিকে রমাকান্তর বাড়ির ছেলেপুলেগুলোকে দ্যাখো! সুযোগ
পেলেই ফাঁকিবাজি। ফুলটুসির মুখটা খিদের চোটে শুকিয়ে গেছে, তার ধুলোমাখা গালে
চোখের জলের আঁকিবুঁকি। পাঁচিল থেকে লাফিয়ে নামল রমাকান্ত। ফুলটুসির কোলে উঠে বসে তার
হাতে লেজ বুলিয়ে বুলিয়ে ম্যাও ম্যাও করল; যার মানে হল, ‘আমি আছি তো, তোমার বন্ধু!’
ফুলটুসি রমাকান্তকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল, “আমাকে ঘর থেকে বার করে দিয়েছে! কোথায়
থাকব আমি? রাস্তায়? হরেন মেসোর ঘরে গেলে আবার কাকি ওদের সঙ্গে ঝগড়া করবে আর আমাকে
আবার মারবে!”
রমাকান্ত
মনে মনে মতলব ভাঁজছিল। না না, ফুলটুসির ব্যবস্থা তাকেই করতে হবে! অত বড়ো তিনতলা বাড়ি
থাকতে ফুলটুসি কেন রাস্তায় থাকবে? সে মনে মনে ছক কষে ফুলটুসির কোলেই গ্যাঁট হয়ে
বসে রইল। আজ ফুলটুসির একটা কিছুমিছু ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত সে আর বাড়িতেই
ফিরবে না!
সাড়ে
চারটের সময় চায়ের টেবিলে বসে কর্তামার খেয়াল হল রমাকান্ত নিখোঁজ।
বামুনঠাকুর আমতা আমতা করে বলল রমাকান্ত দুপুরে তার সঙ্গেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল
বটে; কিন্তু তারপর যে কোথায় গেল, কেন ফিরল না... সে বলতে পারবে না। চা
খাওয়া মাথায় উঠল কর্তামার। মোক্ষদাকে নিয়ে নিজেই বেরোলেন বাড়ি
থেকে। গেট থেকে বেরিয়ে ডানদিকে ঘুরতেই... ও মা, ওই তো তাঁর রমাকান্ত!
একটা ছোটো মেয়ের কোলে শুয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে! মেয়েটাও ঘাড় কাত করে রয়েছে,
চোখ বোজা, চোখের কোলে জল শুকিয়ে রয়েছে।
কর্তামা
ডাক দিলেন, “রমাকান্ত!”
খুকি
ধড়মড় করে উঠে সোজা হয়ে বসল। রমাকান্ত চোখ খুলে আবার চোখ বুজে
ফেলল কারণ তার বাড়ি ফেরার কোনো ইচ্ছেই নেই!
কর্তামা
জিজ্ঞেস করলেন, “অ খুকি, তুই কোথায় থাকিস?”
মোক্ষদা
তো পাড়ার গেজেট; সব খবর রাখে। সে বলে উঠল, “ও কর্তামা, এ তো পাশের
বস্তির ফুলটুসি! আহা গো, বেচারির বাপ-মা নেই। একজনের ঘরে থাকে। সে তো
একমুঠো ভাত দিলে তার বদলে দশটা কিল চড় মারে! জানো কর্তামা, মেয়েটার খুব বুদ্ধি গো!
বিনেপয়সার ইস্কুলে যেত; সেটাও সইল না ওর সেই কাকির। ছাড়িয়ে নিল;
এখন কাগজ-কুড়ুনি হয়েছে! অবিশ্যি তা সইবে কেন! নিজের ছেলেমেয়ে দুটো তো বুদ্ধির
ঢেঁকি কিনা! দুইয়ের ঘরের নামতা পর্যন্ত পারে না! কিন্তু এই ফুলটুসি, তুই এখানে
কেন? ঝোলা কই?”
ফুলটুসি
ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, “ও দিদা, আমাকে ঘর থেকে দূর করে দিয়েছে কাকি। বলেছে
থাকতেও দেবে না, ভাতও দেবে না।”
রমাকান্ত
ফুলটুসির কোল থেকে লাফিয়ে নেমে কর্তামার পায়ে লুটিয়ে পড়ে করুণ গলায় বলল, ‘ম্যাও।’
কর্তামা কী বুঝলেন, কে জানে! রমাকান্তকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, “কী রে, ফুলটুসিকে
আমার কাছে রেখে দেব? ইস্কুলে যাবে, লেখাপড়া শিখবে, সকলের সঙ্গে বাড়ির মেয়ের মতো
থাকবে!” মোক্ষদা এক গাল হেসে বলল, “খুব ভালো হবে গো কর্তামা, মেয়েটার একটা হিল্লে
হবে তাহলে! আহা, বড়ো দুঃখী গো!”
রমাকান্ত
প্রথমে একটু অভিমানী গলায় বলল, ‘ম্যাও।’ কর্তামা ঠিক বুঝে ফেললেন, বললেন, “হ্যাঁ
হ্যাঁ, ফুলটুসি রোজ তোর সঙ্গে কত খেলা করবে! ও তো সব্বার আগে তোর বন্ধু!”
এতক্ষণে
আহ্লাদে আটখানা হয়ে গরগর করতে করতে রমাকান্ত বলে উঠল, ‘মিয়াঁও, মিয়াঁও, মিয়াঁও।’ তার
মানে, ‘ঠিক বলেছ, ঠিক বলেছ!’
কর্তামা
হাসিমুখে ফুলটুসির দিকে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলেন, “উঠে আয় ফুলটুসি। আজ
থেকে আমাদের বাড়িটা তোরও বাড়ি! কাল-পরশুই ভালো ইস্কুলে তোর ভর্তির ব্যবস্থা করব। তার
আগে আজ সন্ধেবেলা বেরিয়ে জামা-জুতো, ক্লিপ, ফিতে সব কিনতে হবে তো!”
রমাকান্ত
একবার ভাবল কর্তামার ভুলটা ধরিয়ে দেয়। মানে বাড়িটা তো কর্তামাদের নয়, ওটা
তো রমাকান্তরই বাড়ি; সে বাড়িতে কর্তামারা সক্কলে থাকে, এই যা! তারপর ভাবল, থাক গে!
কারণ আজ থেকে ওটা আর তার একার বাড়ি নয়। ওটা রমাকান্ত আর ফুলটুসি, দু’জনেরই
বাড়ি।
ফুলটুসি
কর্তামার হাত আঁকড়ে ধরে উঠে দাঁড়াল। এক রাশ কোঁকড়া চুলে ঘেরা তার টুলটুলে
মুখখানি তখন আর চোখের জলে ভেজা নয়; জোছনার আলোয় মাখামাখি হয়ে থাকা আর একই সঙ্গে শেষ
রাত্তিরের শিশিরে ভেজা সদ্যফোটা পদ্মফুলের মতোই সুন্দর লাগছিল।
----------
ছবি - শ্রীময়ী
কি সুন্দর লাগল যে গল্পটা। রমাকান্ত আর ফুলটুসি দুজনেই ভালো থাক।
ReplyDeleteসুনৃতা
অজস্র ধন্যবাদ, সুনৃতা
ReplyDeleteআপনারা আছেন, তাই ভরসাও আছে। পুজো ভাল কাটুক।
ReplyDeleteআপনারা আছেন, তাই ভরসাও আছে। পুজো ভাল কাটুক।
ReplyDeleteআন্তরিক ধন্যবাদ। পুজো ভালো কাটুক আপনাদেরও।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগল। শারদ শুভেচ্ছা আপনাকে।
ReplyDeleteধন্যবাদ। আপনাকেও শারদ শুভেচ্ছা।
ReplyDeleteখুব সুন্দর। শেষটায় চোখে জল চলে এল। ❤️❤️❤️
ReplyDeleteঅজস্র ধন্যবাদ। শারদ শুভেচ্ছা রইল।
ReplyDeleteবিচক্ষণ রমাকান্ত বাবুকে মন চার পেয়ে বলে মানতে চাইছে না! দুপেয়েদের সাথে চারপেয়েদের সখ্যতার কাহিনী জমে উঠুক! ধন্যবাদ ঈশানীদি রমাকান্ত ফুলটুসির সাথে আলাপ করিয়ে দেবার জন্যে।
ReplyDeleteরমাকান্ত খুব খুশি হবে ওর প্রশংসা শুনে। ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা।
ReplyDeleteKhub valo laglo.. ramakanto khub valo.. oke onek valobasa janalam
ReplyDeleteরমাকান্ত আহ্লাদে আটখানা। পুজোর শুভেচ্ছা রইল।
ReplyDeleteআহা কি মিষ্টি গল্প
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো। রমাকান্ত আর ফুলটুসির বন্ধুত্ব অটুট থাকুক সারা জীবন। এমন সুন্দর মন কজনের হয়?
ReplyDelete