কাটমুণ্ডু নগরে
দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
জে জে আমাদের আনা ছবিগুলো মন দিয়ে দেখছিলেন। দেখতে দেখতে বললেন, “এই কাজ তো কাটমুণ্ডুদের। দুটো হাতে ছ’টা করে বারোটা আঙুল তো ওদেরই থাকে।”
আসলে কিছু লোককে এই শহরেই গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। কেন করা হয়েছে কেউ বুঝতে পারছে না।
স্যার বললেন, “শোনো, বুনোকে বলে দিচ্ছি, তোমরা আজ রাতেই কাটমুণ্ডু নগরের উদ্দেশে বেরিয়ে যাও। ওরা তো বেশ শান্ত বলেই জানি। এরকম হিংস্র কাজ ওরা করছে কেন সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”
তোমরা যারা আমাদের কথা এখনও জান না তাদের বলে দিই, আমি অপরাজিতা নন্দী প্যারাসাইকোলোজি নিয়ে রিসার্চ করছি আর তিমি বাবু আমার সতীর্থ। আমাদের গাইড হলেন আমাদের স্যার, ভূত তত্ত্ব, প্রেত, পিশাচ তত্ত্ব, তন্ত্র বিদ্যা-আদি যিনি গুলি খেয়েছেন সেই জে জে, ডক্টর জানকী মোহন জোয়ারদার।
তিমি বাবুর সঙ্গে কাটমুণ্ডু নগরে যাচ্ছি শুনে মা-র তো উৎসাহের শেষ নেই। বলেই দিল, “ওরে অপু, ওখান থেকে আমার জন্য একটা কাটা মুণ্ডু নিয়ে আসবি।” আমি মায়ের এই বিচিত্র দাবি শুনে একসঙ্গে আশ্চর্য ও বিরক্ত হয়ে বললাম, “মা, কী যে বল, কাটমুণ্ডু মানেই তো মুণ্ডু নেই। মুণ্ডুহীন কবন্ধদের দেশ।”
“কী ভালো, বল অপু।”
“ভালো? এতে আবার ভালোর কী দেখলে?”
“এসব করোনা ইত্যাদি হওয়ার চান্স নেই তো।”
আমি চোখ উপরে তুলে মনে মনে আমার অসমসাহসী ও বুদ্ধিমতী মাতৃদেবীকে প্রণাম করলাম। তিমি বাবু আজ রাতেই বুনোকে বলে রেখেছেন গাড়ি রেডি রাখতে। এ পথ তো আবার জনমানুষের পথ নয়। সাধারণ মানুষে এই নগরীর সন্ধান কী করে পাবে।
তখন রাত দশটা। মায়ের হাতের ডাঁটা পোস্ত (ডাঁটা বেশি, আলুহীন) চিবিয়ে চোয়াল ব্যথা করে প্রায় যখন কাঁদার উপক্রম তখনই গাড়ির আওয়াজ শুনতে পেলাম। মা দেখি যাওয়ার সময় একটু কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে, “মুণ্ডুটা?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ মা, আমার মুণ্ডুটার কিচ্ছু হবে না। তুমি এত চিন্তা কোরো না।”
“না, বলছিলাম পারলে একটা… সাজিয়ে রাখব।”
“উফফ” বলে গটগট করে বেরিয়ে গেলাম। গাড়িতে উঠে বসতেই তিমি বাবু বললেন, “অপরাজিতা, এত দেরি কেন বল তো? সাজুগুজু কেউ দেখবে না ওখানে।”
“সে তো জানি। চোখই নেই তা দেখবে কী করে?”
“ওদের চোখ নেই, তোমাকে কে বলল?”
“যা বাবা, মুণ্ডু না থাকলে চোখ থাকবে কী করে?”
“দেখতেই পাবে কী করে,” বলে তিমি বাবু বুনোর দিকে আড়চোখে চেয়ে হাসলেন।
বুনো মুণ্ডু ঘুরিয়ে বলল, “আরে, ওদের চোখদুটো থাকে ওদের বুকের ওপর। কিন্তু বেশ দুর্বল। মানে সামনে কিছু একটা যাচ্ছে ওরা অনুভব করতে পারে। তবে ওদের হাত আর পা বেশ শক্তিশালী। মুখ বলতে যা বোঝো তা ওই ওদের শরীরেই বসানো। অদ্ভুত রকম দেখতে ওদের।”
“ওদের ব্লেমাইজ বলা হয়। ওরা আছে কি নেই তাই নিয়ে অনেক ধন্ধ আছে। অনেক প্রাচীন পুঁথিপত্রে ওদের কিছু ছবি পাওয়া যায়। আলেকজান্ডারও নাকি একবার ওদের দেখা পেয়েছিলেন। তবে স্যার না বললে আমি জানতেও পারতাম না যে ওরা সত্যি সত্যি আছে।” তিমি বাবু বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন। মনে হল একটু চিন্তাতেই আছেন। এই কাটমুণ্ডুরা যে আমাদের সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করবে কে জানে। প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারব তো? সামনে আবার পুজো।
দ্বীপের মধ্যে পথ হারিয়ে
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আমাদের গাড়ি এসে থামল কাটমুণ্ডু নগরে। জায়গাটা একটা দ্বীপের মতো। চারদিকে সমুদ্র।
“এই দ্বীপটার নাম ডুনডেয়া। আন্দামানেরই একটা দ্বীপ।” তিমি বাবু পকেট থেকে একটা ম্যাপ বের করলেন। আমার হাতে একটা ছোট্ট বল দিয়ে বললেন, “এটা তোমার পকেটে রাখো। তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য আর তোমার সুরক্ষার জন্য এটা দরকার। আমার কাছেও একটা আছে।”
তারপর বুনোকে বললেন, “বুনো, এখন তুমি যাও। দরকার হলে তোমাকে ডাকব।”
বুনো অদৃশ্য হল আমাদের চোখের সামনে থেকে।
তিমি বাবু আমার দিকে ফিরে বললেন, “অপরাজিতা, আমাদের কিন্তু খুব সতর্ক থাকতে হবে। আমি ম্যাপ দেখে দেখে ওরা যেখানে থাকে সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করছি। তোমার কাজ হবে আমাকে ফলো করা। মানে শুধু অন্ধ হয়ে ফলো করা নয়। আমার পেছনে যাতে কেউ উড়ে এসে জুড়ে না বসে সেই দিকে নজর রাখা।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “বা রে, তাহলে আমার দিকে কে নজর রাখবে? আমার যদি কোনো বিপদ হয়!”
তিমি বাবু সে কথা গা করলেন না। দিব্যি তড়বড়িয়ে সামনে হেঁটে চললেন।
সামনে জঙ্গল আরও ঘন হতে শুরু করল। আর সূর্যও প্রায় ডুবতে বসেছে। আমার কেমন গা ছমছম করতে লাগল। আত্মরক্ষার জন্য হাতে একটা কিছু থাকলে ভালো হত। ওদিকে তিমি বাবুর ক্রমাগত হাঁচি আরম্ভ হয়েছে। বিপদের গন্ধ পেলেই যেটা শুরু হয়। হঠাৎ মনে হল আমার পায়ের তলার মাটি আলগা হয়ে সরসর করে সরে যাচ্ছে। আমি ক্রমাগত নিচে তলিয়ে যেতে লাগলাম। এ যে এক অন্ধকার সুড়ঙ্গ! “তিমি বাবুউউউউ…” চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু কিছু করার নেই। সুড়ঙ্গের মধ্যে গুঁড়ি মেরে মেরে বেশ কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম শরীরটাকে ঠেলে ঠেলে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। ভেতরে সাপ, বিছে কতকিছুই তো থাকতে পারে।
খচমচ করে কী একটা পায়ের উপর দিয়ে চলে গেল।
“বাবা রে” বলে পা ছুঁড়তেই আবার মাটি সরে গিয়ে নিচে পড়তে লাগলাম সরসর করে। এবারে একেবারে নিচে। একটু একটু আলো দেখা যাচ্ছে। জলের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। পাশ দিয়ে একটা জলধারা বয়ে যাচ্ছে। একটা বিশাল গুহা।
জায়গায় জায়গায় মশাল জ্বলছে। দুটো তিনটে দরজা রয়েছে। এগিয়ে গিয়ে একটা দরজার কাছে আসতেই চোখে পড়ল একটা অদ্ভুত মুণ্ডুহীন অবয়ব আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। অমনি আমার মুখে হাত দিয়ে এক ঝটকায় কে আমাকে অন্ধকারে টেনে নিল। ঘুরে দেখলাম তিমি বাবু।
আমি উত্তেজিত হয়ে অনেক কিছু বলার চেষ্টা করতেই তিমি বাবু মুখে আঙুল দিয়ে বললেন, “একদম চুপ করে থাকো। কাটমুণ্ডুরা পাহারা দিচ্ছে। তোমার গায়ে ভুরভুর করে কীসের গন্ধ উঠছে বল তো? পারফিউম নাকি?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ, কেন?”
“ওরা গন্ধ পায়। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হলেও গন্ধ পেয়েই ধরে ফেলতে পারে।”
বলতে না বলতেই অন্ধকারের মধ্যে খপ করে তিমি বাবুকে দু’হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলেছে এক কাটমুণ্ডু।
তিমি বাবু রুদ্ধস্বরে কিছু বলার চেষ্টা করলেন। আমি শুধু শুনলাম, “কু…”
কান নেই তো ওদের ‘কু’ করব কেমন করে? তারপর অতিকষ্টে বুঝলাম কাতুকুতু দিতে বলছেন। ততক্ষণে তিমি বাবুর দম প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছিল। কাতুকুতু দিতেই সে তিমি বাবুর গলা ছেড়ে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এল। আমি পড়ি কি মরি করে দৌড়োতে শুরু করলাম, অনেকগুলো সুড়ঙ্গপথ, তার একটার ভেতর দিয়ে। খানিকক্ষণ দৌড়োতেই আমার গলা শুকিয়ে গেছে। নিজের জ্যাকেটটা খুলে ছুঁড়ে ফেললাম। কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম। আর কোনো পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি না, তবে সুড়ঙ্গের ওপর দিকে একটা ক্ষীণ আলোর দেখা পেলাম। সামনে পাথরের ওপর পাথর চাপিয়ে একটা সিঁড়ি করা আছে, তার ওপরে গোলাকার একটা গর্তের মুখ থেকে ওই আলোটুকু আসছিল। গর্তটার মুখে একটা পাথর চাপা দেওয়া। অনেক চেষ্টার পর পাথরটা সরল।
বাইরে আসতেই দেখি এ এক অন্য জগৎ। এখানেও কাটমুণ্ডুরা রয়েছে, কিন্তু তারা বেশ হাসিখুশি। মারমুখো মোটেই না। রাস্তায় তারা হাসছে, গল্প করছে, গান গাইছে। হাতের ইশারায় বেশিরভাগ কথা বলছে তারা।
কী ব্যাপার বুঝলাম না। আমাকে দেখে একজন আমার দিকেই এগিয়ে এল।
ব্রুটো
আমি কী করব ভাবছিলাম, অমনি সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, “আরে তুমি এখানে? তোমাকেই খুঁজছিলাম। আমাকে জে জে পাঠিয়েছেন। আমার নাম ব্রুটো। আমি কাটমুণ্ডুদেরই একজন।”
আমি পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম সেই বলটা এখনও আমার পকেটে রয়েছে। হয়তো এর মাধ্যমেই ব্রুটো আমাকে খুঁজে পেয়েছে।
“এই জায়গাটা?” আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।
“এটাই তো আমাদের শহর। কিন্তু তোমার সঙ্গে আরেকজনেরও তো আসার কথা ছিল। উনি কোথায়?”
“তিমি বাবু তো নিচে। আমরা ভীষণ বিপদের মধ্যে পড়েছিলাম।”
“সর্বনাশ! নিচে মানে পাতালে তো ভয়ঙ্কর সব কাণ্ডকারখানা চলতে থাকে। তোমরা সেখানে গেলে কী করে? তুমি আমার সঙ্গে এসো, আগে কিছু খাওয়া যাক। তোমার নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে।”
“কিন্তু তিমি বাবু?”
“হ্যাঁ, ওঁকে খোঁজার চেষ্টা করছি। আগে চলো কোথাও গিয়ে বসে কিছু খেয়ে নিই।”
এই কাটমুণ্ডু ব্রুটো ভীষণ ভদ্র। কাটমুণ্ডুরা যে ভয়ঙ্কর, এই প্রথম এই ধারণা ভাঙল আমার।
“আমরা নিজেদের মধ্যে বেশিরভাগ কথা হাতের ইশারাতেই বলি। কিন্তু আমি যেহেতু অনেকবার তোমাদের জগতে আসাযাওয়া করেছি তাই আমি অনেকগুলো ভাষা জানি।”
আমি অবাক হয়ে সব কিছু দেখছিলাম। ছোটো ছোটো গাছ আর উই ঢিপির মতো বাড়ি। তাতে গোল গোল জানলা। রাস্তায় টিমটিমে আলোয় বেশ মায়াময় পরিবেশ। কাটমুণ্ডুরা গাছের বাকল দিয়ে তৈরি একরকম পোশাক পরে। পা হাত সবই অনেকটা মানুষেরই মতো। শুধু পায়ের আঙুল চারটে চারটে। পা পেশীবহুল ও বড়ো বড়ো নখ আছে। হাতও তাই। কিন্তু ব্রুটোকে আর আমার ভয় লাগছিল না। ব্রুটো রেস্তোরাঁর মালিককে ডেকে কিছু একটা দিতে বলল। সে দিয়ে গেল দেখলাম মাটির পাত্রে। কী একটা পানীয় মিষ্টি মিষ্টি খেতে। মৌরির মতো গন্ধ।
“তুমি কাঁকড়া খাও নাকি?”
আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, “মাছ খাই।”
ব্রুটো আবার লোকটাকে ডেকে কী যেন বলল।
লোকটা গোল গোল কিছু বড়ার মতো ভাজা দিয়ে গেল। সঙ্গে একটা স্যুপ।
“ওটা মাছের ডিমের। আর স্যুপটা খেয়ে দেখো। এখানে ছোটো ছোটো একরকমের ফুল হয়। নাম ‘উলি’। সেই ফুলের স্যুপ।”
খেয়ে কিন্তু বেশ ভালো লাগল। ডিমের বড়াটা নোনতা আর স্যুপটা টক মিষ্টি। তিমি বাবু থাকলে অবশ্য এসব ছুঁয়েও দেখতেন না। উনি যা খুঁতখুঁতে। শুঁকেই রেখে দিতেন।
ব্রুটো বলছিল, “এখানে এক দল আমার মতো কাটমুণ্ডুরা একেবারে আলাদারকম আচরণ শুরু করেছে। ওরা পাতালে থাকে। আসলে মানুষের ওপরে ওদের খুব রাগ।”
“রাগ কেন?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
“মানুষেরা এই দ্বীপে এলে আমাদের শিকার করে যে। সেই থেকে আমরা লুকিয়ে থাকতে শুরু করেছি। মানুষদের পক্ষে চট করে আমাদের আস্তানা খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয় এখন।”
“হ্যাঁ, তা তো বুঝতেই পারছি। তবে তোমাদের সবাই খারাপ নয়।”
“তা তো নয়ই। আসলে আমাদের মধ্যে কয়েকজনকে সম্মোহন করা হয়েছে। তারপর ঐসব কাজে লাগানো হয়েছে। আমার ধারণা। তোমার সঙ্গীটিকেও নিচে তাই করা হবে। তারপর উনিও ওদের মর্জিমতো কাজ করবেন।”
“তা এসব করছে কে?”
“তা তো আমি জানি না। আমাদের থেকেও ভয়াল, করাল নিষ্ঠুর কেউ।”
ব্রুটো অনেক কিছু বলছিল, কিন্তু আমার কানে কিছু ঢুকছিল না। ততক্ষণে বেশ ড্রাম ইত্যাদি অনেক কিছু বাজিয়ে একদল কাটমুণ্ডু নাচ গান শুরু করেছে সমুদ্রের ধারে। আমার বেশ মজা লাগছিল। ওরা আগুনের ধারে ধারে ঘুরে ঘুরে সবাই মিলে নাচ করছিল। তালি দিয়ে দিয়ে।
আমিও টেবিল ছেড়ে ঐদিকে এগিয়ে গেলাম। ওদের সঙ্গে মজা করে নাচ করতে লাগলাম। কোথায় এসেছি কেন এসেছি কোনো কিছুই যেন আর মনে আসছে না। শুধু তালে তালে নেচে যাচ্ছি।
তারপর চোখের সামনে সব যেন মিলিয়ে যেতে লাগল।
(সম্মোহন)
যখন চোখ খুললাম, দেখলাম আমার সামনে এক লম্বা লাইন। বহু কাটমুণ্ডু সেখানে দাঁড়িয়ে। মনে হচ্ছে ওরা সবাই জয়ধ্বনি দিচ্ছে। সবাই বলছে, “জয় শক্তিশালী মহারাজ ব্রুটোর জয়।”
“সামনের সিংহাসনে ব্রুটো বসে আছে। বুকের কাছে থাকা ওর চোখ দুটো লাল। আগে তো এরকম ছিল না! এবং মাঝ বরাবর একটা তিন নম্বর চোখও আছে, যেখান থেকে আলো বেরোচ্ছিল ঠিকরে।”
ব্রুটো সবাইকে সরে যেতে বলল, তারপর আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “আমি যা বলব তাই তুমি করবে।”
আমার ভীষণ রাগ হল। মুখে বললাম, “মিথ্যেবাদী ব্রুটো। আমি তোমাকে ভালো ভেবেছিলাম।”
ব্রুটোর প্রথমে চুপ করে কিছু ভাবল। তারপর হা হা করে হাসল।
তারপর দু’জন কাটমুণ্ডুকে ডেকে বলল, “যাও সামনে ওই আগুনের কুণ্ডে ঝাঁপ দাও।”
ওরা দু’জনে, “জয় পাতাল সম্রাট ব্রুটোর জয়” বলতে বলতে ঝাঁপ দিয়ে দিল ওই আগুনের সমুদ্রে।
ব্রুটো আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “এবার তোমার পালা। জে জে বুঝতে পারবে ওর ছাত্র-ছাত্রীদের ব্রুটোর বিরুদ্ধে পাঠালে ব্রুটো তাদের কী হাল করে।”
আমার হাত, পা দুটোই বাঁধা রয়েছে। আমি ছটফট করে উঠলাম। কিন্তু কোনো লাভ হবে না বুঝতে পারছি।
ব্রুটো ডাকল, “তিমির। তিমির।”
দেখি তিমি বাবু এসে উপস্থিত হয়েছেন। ব্রুটোকে অভিবাদন করে বললেন, “জয় পাতাল সম্রাট ব্রুটোর জয়।”
তিমি বাবুর চোখ দেখে আমি ঘাবড়ে গেলাম। ব্রুটোর মতোই লাল।
ব্রুটো বলল, “তিমিরকে মারব না। ওকে দিয়ে জে জে-কে মারার ব্যবস্থা করব। তোমার ওপরেও আর কিছু মুহূর্ত পরেই আমার সম্মোহন কাজ করবে। কিন্তু তোমাকে বাঁচিয়ে কোনো লাভ নেই।”
ব্রুটো তিমি বাবুর দিকে ঘুরে বলল, “তিমির, ওকে নিয়ে গিয়ে ওই অগ্নিকুণ্ডে ফেলে দিয়ে এসো।”
তিমি বাবু আমার দিকে এগিয়ে এলেন। তারপর পাঁজাকোলা করে তুলে ফিসফিস করে বললেন, “আমার পকেটে একটা গান আছে, ওটা বার করে ব্রুটোর বুকের মাঝ বরাবর তাক করে চালাও। তোমার হাত বাঁধা নেই। সম্মোহনের কারণে মনে হচ্ছে, কিন্তু তোমাকে পুরোপুরি সম্মোহন করতে পারেনি।”
আমি খেয়াল করলাম, তাই তো! তিমি বাবুর পকেট থেকে গানটা বের করে সুইচ টিপতেই তীব্র আলোর তরঙ্গ ব্রুটোর বুকে গিয়ে ধাক্কা খেল।
ব্রুটো উলটে পড়ল।
তিমি বাবু চিৎকার করে উঠলেন, “পালাও, একদম বাইরে বুনো দাঁড়িয়ে আছে।”
ছুটতে ছুটতে বাইরে এসে দেখি বুনো দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি নিয়ে।
ভেতরে অনেকের কোলাহল চিৎকারের মধ্যে বুনো গাড়ি ছেড়ে দিল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ব্যাপারটা কী হল বলুন তো!”
তিমি বাবু আমাকে বললেন, “তোমার পকেটে যে বলটা আছে ওটা দেওয়ার উদ্দেশ্য শুধু তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা ছিল না। ওটার সংস্পর্শে যে থাকবে তার ওপর কোনো সম্মোহন কাজ করবে না। তাই তোমার ওপর ওই ব্রুটোর সম্মোহন পুরোপুরি কাজ করেনি।
“তুমি যখন পালিয়ে গেলে তারপর কী হল বলছি। তোমার পেছনে দৌড়োতে যাব, অমনি ওরা চার-পাঁচজনের দল এসে আমাকে ধরে ফেলল। ওরা আমাকে মেরেই ফেলত। কিন্তু ব্রুটোর আদেশে ওরা আমাকে মারল না। চ্যাংদোলা করে নিয়ে গেল ব্রুটোর কাছে। ততক্ষণে পকেট হাতড়ে বুঝেছি বলটা গুহার মধ্যে কোথাও পড়ে গেছে। আর আমি সম্মোহন এড়াতে পারব না।
“তারপর আমাকে ব্রুটো বশ করে ফেলেছিল, অন্য কাটমুণ্ডুদের মতোই। ওর সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য হচ্ছে ওর বুকের মধ্যে একটা তৃতীয় চোখ আছে, যেটার দ্বারা ও এটা করতে পারে। সেই চোখটা সবসময় দেখা যায় না। সেই চোখটাকে নষ্ট করার জন্য তোমাকে ওই গানটা চালাতে বললাম। এখন ও আর পাঁচজন কাটমুণ্ডুদের মতোই। বিশেষ ক্ষমতা হারিয়েছে।
“তোমাকে অগ্নিকুণ্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য ধরে তুলতেই আমার সম্মোহন কেটে গেল, কারণ বলটা তখনও তোমার পকেটে।”
আমি নিশ্চিন্ত হয়ে বললাম, “যাক! এবার তাহলে আর কাটমুণ্ডুরা এখানে এসে মানুষদের মারবে না।”
তিমি বাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “কে বলতে পারে! ব্রুটোর মতো শয়তান এখনও যখন বেঁচে আছে। তবে একটা জিনিস এখনও আমার কাছে রহস্য।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “কোনটা?”
“এত ডায়েটিং করছ, তবু এত ওজন! পঁয়ষট্টি বা সত্তর তো হবেই কম করে। বাব্বা, কোমরটা গেছে।”
বুনো ঘাড় ঘুরিয়ে খিক খিক করে হেসে উঠল।
----------
ছবি - স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
দ্বৈতা, তোমার এ গল্পের তুলনা নেই, যতবার তিমিবাবু, অপরাজিতা আর বুনোকে নিয়ে তোমার কাহিনি পড়ি, ততবারই নতুন করে মুগ্ধ হই! আসলে, তুমি হাস্যরস মেশানো এমন এক বিচিত্র রূপকথার জগতে বিচরণ করিয়ে আনছ পাঠকদের,যে তাদের সে আনন্দধারায় ভেসে যাওয়া ছাড়া উপায়ই নেই! অনবদ্য...অসাধারণ এই শারদ উপহারের জন্যে তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আর আন্তরিক শুভেচ্ছা।
ReplyDeleteThanks
Deleteসুন্দর গল্প। এই লাইনটা দেখো। বোধহয় দিয়ে হবে। ব্রুটো বলল, “তিমিরকে মারব না। ওকে "দিকে" জে জে-কে মারার ব্যবস্থা করব।
ReplyDeleteঠিক করে দেওয়া হয়েছে। ধন্যবাদ।
DeleteKhub valo laglo...darun
ReplyDelete