হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা — রাপানুই
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
সপ্তদশ শতকের কথা। প্রশান্ত
মহাসাগর জুড়ে তখন ইংল্যান্ড আর স্পেনের মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করার
প্রতিযোগিতা চলছে। কেউ সরকারি টাকায় অভিযান চালায়, তো কেউ বড়োলোকের অর্থে।
মহাসাগরের বুকে বিভিন্ন দ্বীপ খুঁজে বেড়ানো খুব সোজা কথা ছিল না। প্রতি মুহূর্তে
মৃত্যুর হাতছানি। ঝড়ে জাহাজ ডোবে, তো কখনও আবার জলদস্যুদের পাল্লায় পড়ে জীবন বলি
দিতে হয়।
তাই বলে কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগর
জুড়ে দুর্ধর্ষ নাবিকদের নতুন নতুন দ্বীপ আবিষ্কারের নেশা একটুও কমত না। এদের
অনেকেরই পুরোনো পেশা ছিল জলডাকাতি। ইংল্যান্ড, স্পেন, ফ্রান্স সব উন্নত দেশের
সরকারি তহবিল থেকে খরচ করে দক্ষ জলদস্যু-নাবিকদের অনেককে পাঠানো হত প্রাকৃতিক
সম্পদের খোঁজে। সেই রকম এক নাবিক ছিল ইংল্যান্ডের এডওয়ার্ড ডেভিস।
১৬৮৭ সাল। প্রশান্ত মহাসাগরে জাহাজ
ভাসিয়ে ডেভিসের দলবল পড়ল ঝড়ের কবলে। তখন পালতোলা জাহাজে দাঁড় বইতে হত। প্রবল
সামুদ্রিক ঝোড়ো হাওয়ায় ডেভিসের জাহাজ ভেসে গেল ভিন্ন দিকে। ঝড় থেমে গেলে দিশেহারা
নাবিক ডেভিস দেখল— একটু দূরে যেন বালুকাবেলা চিকচিক করছে। সাগরে মাঝে মাঝে মরীচিকা
দেখা যায়, মনে হয় ডাঙা— কিন্তু আসলে হয়তো সবটাই দৃষ্টিভ্রম। যাই হোক, ডেভিস দূরবিন-টুরবিন
লাগিয়ে, চোখ কচলে নিয়ে দেখল— সত্যি সত্যি এক দ্বীপ, পিছনে তার কালো ন্যাড়া পাহাড়। দ্বীপের
চারিদিকে চক্কর লাগিয়ে জাহাজ ফিরে গেল। কিন্তু
দ্বীপে নেমে জাহাজ-যাত্রীদের কেউ দেখার চেষ্টা করল না, সেখানে আদৌ কোনো মনুষ্য-বসতি
আছে কিনা। আসলে সেই সময়ে প্রশান্ত মহাসাগরে অনেক নতুন নতুন দ্বীপ আবিষ্কার হয়েছে,
যেখানে হিংস্র অধিবাসীদের হাতে প্রাণ যাবার ভয় ছিল।
ডেভিসের অভিযানের পর প্রশান্ত
মহাসাগরের এই অদ্ভুত দ্বীপের কথা অজানা থাকল না। ভূতুড়ে দ্বীপকে লোকে বলত ‘ডেভিস
ল্যান্ড’। কিন্তু সেই দ্বীপের অস্তিত্ব যেন রইল কল্পনার
দুনিয়ায়, অনেকদিন পর্যন্ত কেউ সাহস করেনি সেখানে অভিযানে যেতে।
১৭২২ সালে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ
কোম্পানির জেকব রোগেভিন হল্যান্ড থেকে বেরিয়ে পড়ল ডেভিস ল্যান্ডের খোঁজে। নয় মাস
সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অবশেষে সেই দ্বীপ খুঁজে পেয়ে তিন বার চক্কর লাগিয়ে, জাহাজ নোঙর
ফেলল।
কিছুক্ষণ পর দ্বীপের কৌতূহলী এক বাসিন্দা
সাঁতার কেটে জাহাজে এসে হাজির। তার গায়ের
রঙ বাদামি। জাহাজিদের সঙ্গে সে স্প্যানিশ মেশানো এক অদ্ভুত
ভাষায় কথা বলে। এরপর আরও মেয়ে-পুরুষ দলে দলে এল ছোটো ছোটো ডিঙি নৌকোয়। তাদের পরনে
কাপড় নেই দেখে জাহাজিরা নিজেদের কিছু পোশাক তাদের দিয়ে দিতে তারা তো মহাখুশি।
পরদিন যা ঘটল, তা ভয়াবহ। জাহাজের
১৩৭ জন নাবিকের প্রায় সবাই ছোটো ছোটো নৌকো ভাসিয়ে দ্বীপে নেমে পড়ল। দ্বীপের কয়েক
হাজার আদি বাসিন্দা গান বাজনা আর নাচ দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন শুরু করল। কেউ ঘরের মুরগি
নিয়ে আসে, তো কেউ কিছুটা শস্য। বিনিময়ে তারা অভিযাত্রীদের কাছ থেকে উপহার পেল
আয়না, ছুরি, কলম ইত্যাদি।
হয়তো নাবিকদের বন্দুক দেখে তাদের উৎসাহের
আতিশয্য একটু বেশিই হয়ে গিয়ে থাকবে। কেউ কেউ সেই বন্দুক ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করতে
শান্ত নিরিবিলি দ্বীপে প্রথম বারুদের ধোঁয়া উড়ল। জাহাজি বন্দুকবাজেরা চালাল গুলি। দশ-বারোজন অধিবাসী মরল
গুলি খেয়ে। আরও হিংসা ছড়ানোর আগে দলনেতা জেকব রোগেভিন নাবিকদের জাহাজে ফিরিয়ে নিয়ে
দ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হল।
এরপর অর্ধেক শতাব্দী কেটে গেল।
১৭৭০ সালে ফিলিপ গঞ্জালেস স্পেন থেকে লোকলস্কর নিয়ে চলল ডেভিস ল্যান্ড-এ। দ্বীপের মানুষের সঙ্গে গঞ্জালেস খানিকটা বন্ধুত্ব করতে
পেরেছিল। ছয় দিন দ্বীপে কাটিয়ে তারা স্পেনে ফিরে এল। গঞ্জালেস জানতে পেরেছিল
স্থানীয় লোকে এই দ্বীপকে বলে – রাপানুই। এই অভিযানের ফলে স্পেন এই দ্বীপের উপর পুরোপুরি
আধিপত্য কায়েম করল।
চার বছর পর বিখ্যাত ব্রিটিশ
অভিযাত্রী ক্যাপ্টেন জেমস কুক রাপানুইতে এলেন। কিন্তু তার সঙ্গে যে সমস্ত মানুষ
এল, তারা সঙ্গে করে নিয়ে এল নানা রকম রোগ। দ্বীপের মানুষের সঙ্গে ইউরোপে জন্ম
নেওয়া সেই সব ভাইরাসদের আলাপ পরিচয় তো ছিল না, তাই দ্বীপের মানুষেরা দলে দলে নানা
অসুখে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে লাগল। স্মল পক্স বা বসন্ত রোগেই বেশি প্রাণ চলে
গিয়েছিল। অভিযাত্রীরা মাতৃভূমিতে চম্পট দিয়ে পালিয়ে বাঁচল।
কুক-এর অভিযানের পর সব উন্নত
দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হল সেই দ্বীপে পাড়ি দেবার। তবে খুব তাড়াতাড়ি তারা
বুঝে গেল যে সেখানে না চাষ-আবাদ হয়, না পাওয়া যায় অন্য প্রাকৃতিক সম্পদ। এমনকি
সেখানে খাবার পরিষ্কার জলেরও অভাব। অভিযাত্রী দলের এক পাণ্ডা তো তার ডায়েরিতে লিখে
রাখলেন, “এখানে খাবারদাবার আর জলের অভাব, শুধু দেখা যায় পাল পাল ইঁদুর।”
পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় উপনিবেশ
স্থাপন করতে মেলা লোকের দরকার হল। ইউরোপিয়ান দেশগুলো সারা পৃথিবীতে চষে বেড়াতে
লাগল মানুষ ধরবে বলে। আফ্রিকা থেকে যখন দাস আনা শুরু হল, তখন রাপানুই-বা আর বাকি
থাকে কেন? তাদেরও জাহাজ বোঝাই করে চালান দেওয়া হতে লাগল অন্য দেশে।
সভ্য দুনিয়ার হাতে রাপানুই-এর এই লাঞ্ছনার
কালো অধ্যায় শেষ হতে অনেক সময় লেগে গেল। উনবিংশ শতাব্দীতে ধীরে ধীরে দাস প্রথা
বিলুপ্ত হতে লাগল। পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাস তখন বদলের দিকে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ
চিলে রাপানুই-এর দখল নিল। প্রধানত প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে নৌ-ঘাঁটি তৈরি করা আসল উদ্দেশ্য হলেও শান্তির পর্যায়ে শুরু হল ঐতিহাসিক আর
প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা। উঠে এল এক অজানা দেশের প্রাচীন ইতিহাস। রাপানুই-এর মানুষের মুখে মুখে যে সব গল্প চালু ছিল, সব
জুড়ে দেখা গেল— হাজার বছর আগে রাপানুই-তে ছিল এক উন্নত মানবসভ্যতা, প্রকৃতির বদলে
যার অবক্ষয় হয়।
রাপানুই-তে সভ্য দুনিয়ার
বিশেষজ্ঞরা এলেন। এই দ্বীপে অদ্ভুত সব পাথরের মূর্তির দিকে তাদের নজর পড়ল,
লুটেরাদের যার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। কোনো কোনো মূর্তি সমুদ্রের ধারে
দাঁড়িয়ে, আবার কোনো মূর্তির শুধু মাথা জেগে আছে মাটিতে। শুরু হল প্রত্নতাত্বিক
খননকার্য। দেখা পাওয়া গেল অনেক অনেক মূর্তির। গুণে দেখা গেল, ৮৮৭টা মূর্তি দ্বীপের
বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে। অনেক মূর্তি মাটির নিচে থেকে পাওয়া গেল। এক একটা মূর্তি ওজনে
কয়েকশো টন। একটা উঁচু প্লাটফর্মের মতো জায়গায় সারিবদ্ধ মূর্তি পাওয়া গেল সমুদ্রের
ধার ঘেঁষে। স্থানীয় লোকেরা মূর্তিগুলোকে বলে –‘মোয়াই’।
প্রথম প্রথম অনেকে বলল— দ্বীপের
অনুন্নত সামান্য সংখ্যক মানুষের কম্ম নয় এই সব অসাধারণ মূর্তি বানানো। নিশ্চয়ই গ্রহান্তরের মানুষ এসে বানিয়েছে।
তখন দ্বীপের জনসংখ্যা হাতে গোনা—
কয়েকশো মাত্র। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল সব অজানা গল্প। উঠে এল অপরূপ এক
সভ্যতার কাহিনী— যেন রূপকথা। সভ্য
দুনিয়ার মানুষ জানতে পারল রাপানুই-এর হাজার বছর পুরোনো বিলীন হয়ে যাওয়া সভ্যতার কথা।
ভূতাত্বিক গবেষণা জানাল, রাপানুই
দ্বীপের জন্ম হয়েছিল আগ্নেয়গিরি থেকে। প্রশান্ত মহাসাগরে যত দ্বীপ দক্ষিণ আমেরিকার
পুবদিক ঘেঁষে আছে, তাদের বেশিরভাগই পৃথিবীর নিচে টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষের কারণে
জন্ম নেওয়া আগ্নেয়গিরির মাথা তোলার কারণে সৃষ্ট।
পাথরের তৈরি মূর্তিগুলোকে কারা বানিয়েছিল,
আর কী ছিল তাদের উদ্দেশ্য— এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নেমে পড়লেন কিছু পণ্ডিত
মানুষ।
কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করার প্রায়
হাজার খানেক বছর আগে প্রথম এই দ্বীপ খুঁজে পেয়েছিলেন পলিনেশিয়া অঞ্চলের ক্ষমতাশালী
এক দলপতি হতু মাতুয়া। তখন পৃথিবীর বুকে ছোটো ছোটো দল পাকিয়ে বাস করত মানুষ। সেই
দলগুলোর মধ্যে লড়াই ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ঘরোয়া এক যুদ্ধে হেরে গিয়ে হয়তো দেশ ছেড়ে পালিয়ে ছিলেন
হতু মাতুয়া। দুই বিশাল নৌকোয় মানুষ, পালিত পশু আর গাছপালা নিয়ে তিনি বেরিয়ে
পড়েছিলেন নতুন দেশে ভাগ্য গড়ে তোলার জন্য। সমুদ্রের
তুফান থেকে যাতে নৌকোডুবি না হয়, সেজন্য দুই নৌকোর মধ্যে যোগাযোগ রাখা হয়েছিল বাঁশ
আর কাঠ দিয়ে (এমন নৌকোর দেখা এখনও মেলে রাপানুই-এর বিভিন্ন স্থাপত্যকলায়)। তারপর
রাপানুই-তে সেই দল ঘর বাঁধে। তাদের সন্তান সন্ততি হয়, বাড়তে থাকে জনসংখ্যা।
আগ্নেয়গিরিরির পাথর খোদাই করে তারা বানায় সব বিশাল বিশাল মূর্তি। প্রতিটি মূর্তি
একই ধরনের দেখতে লাগলেও, খুব মন দিয়ে লক্ষ করলে বোঝা যায় প্রতিটি মূর্তির মধ্যে
খুব সূক্ষ্ম ফারাক আছে। খুব সম্ভব এক একজন দলপতি মারা গেলে রাপানুই-এর মানুষেরা
তাদের মূর্তি বানিয়ে রাখত স্মরণ করার জন্য।
পাথর কেটে মূর্তি বানানোর উপায় বেশ
কঠিন ছিল। কারণ ওই অঞ্চলে তখনও লোহা বা অন্য ধাতুর ব্যবহার শুরু হয়নি। তারা
প্রস্তর যুগেই আটকে ছিল সম্ভবত, কারণ লোহার তৈরি কোনো অস্ত্র দ্বীপে খুঁজে পাওয়া
যায়নি। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা জানিয়েছেন, আগ্নেয়গিরিতে এক ধরণের শক্ত কাচ পাওয়া যায় প্রাকৃতিকভাবে। লাভা যখন হঠাৎ করে ঠাণ্ডা হয়, তখন লাভার কেলাস থেকে এমন
কাচ তৈরি হয়। সেই
কাচ-পাথর দিয়ে কারিগরেরা পাথর কাটত। পাহাড়ের উপর, মূর্তির পাশে এমন ধরনের কাচ
ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাওয়া গেছে। এক একটা মূর্তি তৈরি হতে
মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর লেগে যেত।
রাপানুই-তে এক লম্বা প্লাটফর্মের
উপর একের পর এক মূর্তি সারিবদ্ধভাবে পাওয়া গেছে সমুদ্রের পাড়ে, যাদের দেহের সামনের
ভাগ দ্বীপের দিকে ঘোরানো। কেন এইভাবে রাপানুই-এর
বাসিন্দারা এমন করত? গবেষকদের মত – যাতে মৃত ব্যক্তির আত্মা দ্বীপের মানুষদের দিকে
সদা সতর্ক নজর রেখে তাদের সুরক্ষা দিতে পারে, সে জন্যই এই কঠিন কাজ তারা করত।
মূর্তি বানিয়ে ফেলার পর শুয়ে থাকা
সেই মূর্তি সমুদ্রের পাড়ে কীভাবে তারা টেনে নিয়ে আসত? কয়েকশো টন ওজনের মূর্তিগুলো
কীভাবে টেনে আনা হত? তখন তো কোনো ক্রেন আবিষ্কার হয়নি, যে যন্ত্র দিয়ে টান দিলেই
গড়গড়িয়ে মূর্তি চলে আসবে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গা। গবেষণায় জানা গেছে — পাথর
কেটে যে মূর্তি বানানো হত, তা শায়িত অবস্থায় থাকত। মূর্তি বানানো হয়ে গেলে তাকে
সোজা করে তুলে ধরতে হত দড়ি দিয়ে বেঁধে। তারপর সেই মূর্তি টেনে নিয়ে যাওয়া হত
সমুদ্রের ধারে। প্রশ্ন এল— শোয়া অবস্থায়ও তো
টেনে নিয়ে এসে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যেত। রাপানুই-এর মৌখিক লোককাহিনি শুনলে
জানা যায়— তাদের পূর্বজদের এই মূর্তি নাকি হেঁটে হেঁটে সমুদ্রের পাড়ে চলে আসত। মূর্তির
সশরীরে চলে বেড়ানোর ক্ষমতা বৈজ্ঞানিকদের পক্ষে মেনে নেওয়া মুশকিল। তাই তারা নানা
গবেষণা করে একটা সিদ্ধান্তে এলেন।
একই ওজনের মূর্তি তৈরি করে সেই
মূর্তি অনেক মানুষ লাগিয়ে দড়ি দিয়ে টেনে দেখে যা জানা গেছে, তার সম্ভাব্য উপায় হল—
মূর্তিগুলোর পায়ের নিচের দিকের অংশ ইচ্ছে করেই সামান্য অবনত করে রাখা হত, যাতে
দড়ির টানে মূর্তি সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে না পড়ে। তারপর কাঠের গুঁড়ির রোলার বসিয়ে
দেওয়া হত মূর্তির পায়ের তলায়। দড়ি দিয়ে বাঁধা হত মূর্তির উপরের অংশ, তারপর অনেকে
মিলে টান দিলেই মূর্তি এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেত। যাতে টানার পথ
পিচ্ছিল হয়ে কম বল প্রয়োগ করতে হয়, সেজন্য রাপানুই-এর লোকেরা গাছের পাতা বা
পামগাছের আঠা ব্যবহার করে মূর্তির ভিত পিচ্ছিল করত।
মূর্তি টানাটানি করতে গিয়ে যে
বিপত্তি ঘটত না, তা নয়। রাপানুই-এর জমিতে সামনের দিকে মুখ থুবড়ে থাকা এক মূর্তি
জানান দেয়— একবার পড়ে গেলে আর সেই মূর্তি ওঠানো কষ্টকর ছিল।
কেন উধাও হয়ে গেল হুতু মাতুয়া-র
হাতে গড়া সেই অনবদ্য সাম্রাজ্য? কেউ বললেন মহামারি, কেউ বলে – হতু মাতুয়ার
বংশবৃদ্ধি হয়ে ছোটো ছোটো দল সৃষ্টি হয়, তাদের মধ্যে প্রবল যুদ্ধের কারণে বহু মানুষ
মারা যায়। আবার কেউ বলে খরা হয়ে চাষ-আবাদ বন্ধ হয়ে গিয়ে খাবারের অভাব দেখা দেয়। এক
সময়ে আফ্রিকার গভীর জঙ্গল থেকে পাড়ি দেওয়া মানুষেরা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে
পড়ে। কোথাও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে মানুষ সভ্য হতে থাকে, কিন্তু
বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে
রাপানুই-এর সভ্যতা।
বর্তমানে ১৬৩ বর্গ কিলোমিটার
আয়তনের এই দ্বীপে প্রায় আট হাজার মানুষ বসবাস করেন, যাদের অর্ধেকের বেশি
রাপানুই-এর আদি বাসিন্দাদের বংশধর। চিলের অধীনে এই দ্বীপের মানুষেরা আধুনিক
দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেও নিজেদের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রেখেছেন তাদের গান, নাচ ও
শিল্পকলায়। বর্তমানে এই দ্বীপ ‘ইস্টার আইল্যান্ড’ নামে পরিচিত।
তথ্যসূত্রঃ
1. Lost world and Mysterious Civilization,
Easter Island, Ronald A Reis, Chelsa House, 2012
2. Easter Island, A Stone Age Civilization
of Pacific, Alfred Metraux (translated in English by Michael Bullock, Andre
Deutsch), 1957
----------
ছবি - আন্তর্জাল
ভালো, তথ্যসমৃদ্ধ লেখা...
ReplyDeleteধন্যবাদ 😊
Deleteচমকপ্রদ লেখা।
ReplyDelete