চৌকস চূর্ণী
রাখী নাথ
সুবিশাল সিংহতোরণের ভাঙাচোরা
অস্তিত্বটুকু রয়ে গেছে কেবল। সেই
ধংসস্তূপ পেরিয়েই মোরাম বিছানো নিঝুম রাস্তা। অলস দুপুরের সাদা ফুরফুরে মেঘ বিশাল
সরকারবাড়ির ছাদের কার্নিশে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। আমাদের গাড়িটা বাড়ির
প্রধান দরজার কাছে এসে থামতেই দেখলাম, বাবার ছেলেবেলার বন্ধু সুদীপকাকু আর
তার স্ত্রী আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে বেরিয়ে এসেছেন।
প্রায় একশো বছরেরও বেশি পুরনো
এই জমিদার বাড়িটার সর্বত্রই অযত্নের চিহ্ন স্পষ্ট। অনেক
জায়গাতেই চুনসুরকির বেরঙা বাস্তবতা দাঁত খিঁচিয়ে চেয়ে রয়েছে। বটপাকুড়ের শেকড় ছড়িয়ে
রয়েছে বাড়ির নানা ফাটল জুড়ে! আর হবে নাই বা কেন? হাসনাবাদের সরকারবাড়ির একমাত্র
সন্তান সুদীপকাকু কর্মসূত্রে থাকেন পশ্চিমবঙ্গের বাইরে। যে কয়েকঘর শরিক এখানে আছে,
তারাও নিজেদের আখেরটা গোছাতে পারলেই খুশি হয়। তাই
শেষপর্যন্ত সুদীপকাকুরা সবাই মিলে ঠিক করেছেন, বাড়িটা এবার বেচেই দেবেন। এই
ফেব্রুয়ারির মধ্যেই বাড়িটা হাতবদল হয়ে যাবে। আর তাই কাকু বাবাকে অনুরোধ করেছিলেন, এই
পুজোর ছুটিতে অন্তত একবার যেন সপরিবারে এখানে এসে ঘুরে যাই আমরা।
সুদীপকাকু আর কাকিমার
অন্তরঙ্গ আথিতেয়তায় প্রথমেই মুগ্ধ হয়েছিলাম। অবাক হয়ে দেখলাম, এই সুবিশাল
অচেনা বাড়ির অজানা চৌহদ্দিও যেন কতদিনের চেনাজানা বন্ধুর মতো দু’হাত বাড়িয়ে আমাদের
কাছে টেনে নিয়েছে। বেলা গড়িয়ে এসেছিল। গাছের ডাবের
জল দিয়ে তৃষ্ণা মিটিয়ে একেবারে সটান প্রবেশ করলাম আমরা খাবার-ঘরে। বিশাল
মার্বেলপাথরের ডাইনিং টেবিলে বসে কাঁসার থালায় ভাতের পাহাড় ভাঙতে ভাঙতে একবার তো
আমার মনে হল, আমার
তিনদিনের খোরাকি একদিনেই উপুড় করে দেওয়া হয়েছে আমার থালায়! বাপরে বাপ! ডাঁটা দিয়ে
শুক্তো থেকে শুরু করে কালোজিরে বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল, কী নেই সেখানে! ইয়াব্বড়ো
বড়ো কাঁসার জামবাটিতে উপচে পড়েছে সাত-আট রকমের পদ, যার অর্ধেকেরই নাম আমার জানাই
নেই!
সুদীপকাকু খেতে খেতে বলছিলেন, স্বদেশি
আন্দোলনের সময় তাঁর প্রপিতামহ হরিনারায়ণ বর্তমান বাংলাদেশের সাতক্ষীরা থেকে এখানে
এসে এই বিশাল বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। বললেন, বিকেলবেলায় আমাদের সকলকে বাড়ির পেছনের
বাগানে নিয়ে যাবেন। যদিও বাগান বলতে নাকি এখন কিছুই আর
অবশিষ্ট নেই, আছে
খালি আগাছার জঙ্গল। অবশ্য কিছুদিন আগেও নাকি বাগানে আম, জামরুল, কাঁঠাল, লিচু – সবই হত। এককালে
মাছে উপচে পড়ত এমন মজা পুকুরও রয়েছে একখানা।
সুদীপকাকুর কোনও ছেলেমেয়ে
নেই। আমি একা একা বোর হচ্ছি দেখে একবার বললেন, ছাদের চিলেকোঠার ঘরে নাকি ডাঁই করে
রাখা আছে নানাধরনের রঙবেরঙের ঘুড়ি। ছেলেবেলায়
তাঁর বাবা রাজনারায়ণের নাকি ঘুড়ির বড্ড নেশা ছিল। সেসব
সযত্নে রাখা আছে চিলেকোঠার ঘরে। বিকেলবেলায় আমাকে সেসব দেখাবেন।
কলকাতা থেকে এতটা পথ আসার
ক্লান্তিতে দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই যখন বিছানায় আরামে আত্মসমর্পণ করেছে, আমি কিন্তু
তখন ছটফটে চোখে ঘুমহীন উত্তেজনায় এপাশ ওপাশ করে চলেছি। মাথার
ওপর বিশাল উঁচু সিলিং থেকে ঘটাং ঘটাং করে দুলে চলেছে একখানি মান্ধাতা আমলের পাখা। আশ্বিনের
গুমোট দুপুরে তাতে গরম কমার থেকে যেন বিরক্তি বাড়ছিল আরও বেশি! একবার উঁকি মেরে
দেখলাম, ওপাশ
ফিরে অকাতরে ঘুমিয়ে পড়েছেন মা। গলার কাছে চিক চিক করছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কী মনে
হতে চুপি চুপি বেরিয়ে এলাম ঘরের বাইরে। খানকয় পায়রা
একনাগাড়ে আপনমনে বকবকম করে চলেছে বারান্দায় পাক দিতে দিতে। ঘুলঘুলি
থেকে দুটি চড়াইও দেখলাম উঁকি মেরে আমাকে একবার দেখে নিয়ে খড়কুটোর অঞ্জলি ছড়িয়ে দিয়ে
ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল কোথায় জানি।
আমাদের ঘরখানির পরেই তালা
দেওয়া আরও দুটি ঘর, তার
পাশেই পলেস্তারা খসে পড়া ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি। ঘুড়ি আমার বড়ো প্রিয়। কলকাতায় আমাদের
অ্যাপার্টমেন্টের চিলতে ছাদে সেভাবে ঘুড়ি ওড়ানো যায় না। তবে রাঁচিতে মাসির বাড়ি
গিয়ে একবার ঘুড়ি উড়িয়েছিলাম। সে বড়ো মজার
জিনিস, ডানা মেলে উড়ে যাওয়া মেঘজঙ্গলেরও ওপারে । যখন দমকা হাওয়ায় হাতের সুতোয় টান
পড়ে, ড্যাবড্যাবিয়ে
চেয়ে খিলখিলিয়ে হাসতে থাকা ঘুড়িটার সঙ্গে সঙ্গে আমিও উড়তে থাকি ভারহীন হয়ে - ঠিক যেন
মায়ের তটস্থ পাহারা ফাঁকি দিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে একেবারে লেকের মাঝখানটিতে চলে
যাওয়া, তারপর যখন মায়ের খেয়াল হয়, প্রবল চিৎকারে ঘুড়ির গুটোতে থাকা সুতোয় হ্যাঁচকা
টান পড়ে, আমিও
ফরফর করতে করতে বাধ্য ঘুড়ির মতো লেকের সিঁড়ির কাছটিতে ফিরে আসি।
সিঁড়ির একধারে চিলেকোঠার
ছোট্ট ঘরটার ভেজানো দরজায় আলগা চাপ দিতেই ক্যাঁচ করে দরজাটা খুলে গেল। প্রথমে
কেমন জানি একটু ভয় ভয় করল আমার। না বাবা, নীচে নেমে
যাই, বিকেল হলে না হয় সবার সঙ্গে এখানে আসব। কিন্তু কী যেন অদ্ভুত এক আকর্ষণ আমায় চুম্বকের
মতো টেনে নিয়ে এল ঘরের চৌকাঠে। এক পা এক পা করে ঘরে ঢুকলাম। কেমন যেন ভ্যাপসা একটা
গন্ধ। একটা মোটে জানালা, তাও
বন্ধ। এককোণে একটা ভাঙাচোরা বহু পুরনো চৌকি। ঝুলে
ভরা দেওয়ালের আরেকটা কোণ জুড়ে দেখলাম সত্যি সত্যি ডাঁই করা আছে নানাধরনের ঘুড়ি, মাঞ্জা
দেওয়া লাটাই। ধুলো আর ঝুল জমে রয়েছে তার ওপরে
বিস্তর। আমি এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে উঁকি মারছিলাম। ঘরের দেওয়াল জুড়ে ছোটো ছোটো
চারটে কুলুঙ্গি। সেই কুলুঙ্গির প্রত্যেকটিতে একটা করে
মাটির ঘোড়া। আচ্ছা, ডানদিকের
কুলুঙ্গির ঘোড়াটা একটুখানি নড়ে উঠল না? ধুস, কী যা তা ভাবছি আমি! মাটির ঘোড়া আবার
নড়তে পারে নাকি? কিন্তু
না ,ঐ
তো, ঘোড়াটা মাথা নাড়াচ্ছে যেন!
আমার হঠাৎ কেন জানি না মনে হল
ঘরে আমি একা নই। ঘাড়ের কাছে যেন গরম নিঃশ্বাস পড়ল কার! চমকে পেছনে
তাকালাম। কই, কেউ তো নেই! নীচে ফিরে যাব ভেবে
ঘুরতে গেছি, পায়ে
বাজল কী জানি। দরজা দিয়ে উঁকি মারা বিকেলের তেরছা আলোয়
তাকিয়ে দেখলাম, ঝুরঝুরে
পুরনো খাতার মতো একটা কিছু। খুব সাবধানে ধুলো ঝুল মাখা ছেঁড়াখোঁড়া পোকায় কাটা
খাতাটা হাতে তুলে নিলাম আমি। প্রথম
পাতাটা ওলটাতেই দেখলাম খুদে খুদে নীল কালিতে যেন কীসব লেখা –
‘সে বহুবছর আগের কথা।
দেবহাটার মেলায় হারিয়ে যাওয়া পিতামাতাহীন একটি চারবছরের মুসলিম মেয়েকে বাড়িতে এনে
সন্তানস্নেহে বড়ো করছিলেন কাদম্বরীদেবী নামের এক নিঃসন্তান হিন্দু বিধবা। মেয়েটি
তাঁর নামটাই খালি বলতে পেরেছিল, ফাহমিদা। তখন স্বদেশী
আন্দোলনের গরম ছোঁয়ায় উত্তপ্ত চারদিক। বঙ্গভঙ্গের দোলাচলে টালমাটাল বাঙালির
অস্তিত্ব। নতুন প্রদেশ মুসলমানদের জন্য অনেক বেশি চাকরির
সুযোগ তৈরি করবে, ব্রিটিশদের এই প্রচারে প্রভাবিত হয়ে বহু উচ্চ ও মধ্যবিত্ত
শ্রেণীর মুসলমান স্বদেশী আন্দোলন বিরোধী হয়ে উঠেছেন। তাই রসুল, দীন মোহাম্মদের
মতো স্বদেশী আন্দোলনে বিশ্বাসী মুসলমান নেতাদের আন্তরিক আবেদন সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গে
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দিয়েছে। এই উত্তপ্ত
পরিস্থিতিতে সেখানকার দাঙ্গাকারীরা তাঁর কাছ থেকে শিশুটিকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা
করবে এই ভয়ে কাদম্বরীদেবী এসে জমিদার হরিনারায়ণের শরণাপন্ন হলেন। কাদম্বরীদেবী আর
তার শিশুকন্যাকে আশ্রয় দিলেন জমিদার হরিনারায়ণ।
‘জমিদার হরিনারায়ণের এই বাড়ি, বাড়ির ঐ
ঠাকুরদালান,
বাড়ির পেছনের বাগান - এসবই কিন্তু তখন বিপ্লবীদের নিরাপদ ঠিকানা। বাগানের গা ঘেঁষে
উঠে আসা এক গুপ্ত সিঁড়ি বেয়ে এই ঘরে সভা করতেন সুবোধ মল্লিক, অমরেন্দ্রনাথের
মতো কত শত বিপ্লবী মানুষ। এই চিলেকোঠার ঘরের নিচে ছিল এক চোরকুঠুরি, স্বদেশী
আন্দোলনের অন্যতম কর্মসূচী হিসেবে বিলিতি পণ্যের বিকল্প হিসেবে এই কুঠুরিতে তৈরি হত
তাঁতবস্ত্র। স্বদেশী আন্দোলনের শেষদিকে, বর্তমান বাংলাদেশের দেবহাটায় ‘ব্রিটিশ-বিরোধী
চরমপন্থী আন্দোলন’-এ নেতৃত্বদানকারী
হীরেন নামক এক বিপ্লবী ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে এসে তাঁর শরণাপন্ন হলে
তাঁকেও আশ্রয় দিয়েছিলেন জমিদার হরিনারায়ণ। কিন্তু কোনওভাবে কোনও এক বিশ্বাসঘাতকের
কাছ থেকে দাঙ্গাকারীরা সেই খবর পেয়ে যায়। আশ্বিনের এক ঝড়জলের রাতে, একদল
দুষ্কৃতী হানা দেয় এই হাসনাবাদে। সেই দুর্যোগের রাতে হরিনারায়ণ, তাঁর
স্ত্রী পদ্মাবতী আর বিপ্লবী হীরেনকে একদল দুষ্কৃতী এসে নৃশংসভাবে খুন করে যায়।
সৌভাগ্যবশত, তাঁদের
ছেলে থুড়ি সুদীপের ঠাকুর্দা ছোট্ট দেবনারায়ণ তখন কলকাতায় মাসির বাড়িতে বেড়াতে
গিয়েছিলেন। কিন্তু কাদম্বরীদেবী আর তার শিশুকন্যাকে হরিনারায়ণ কোথায় লুকিয়ে
রেখেছিলেন তা দুষ্কৃতীরা কোনওভাবেই জানতে পারেনি, খুঁজেও পায়নি। আসলে তাঁরা লুকিয়ে
ছিলেন এই চোরকুঠুরিতেই। অবশেষে একসময় সকলের অজ্ঞাতসারে সেই চোরকুঠুরিতেই দমবন্ধ
হয়ে তাঁরা...!
‘সেই অভিশপ্ত দিনটির পর থেকেই
সব কেমন যেন ছন্নছাড়া হয়ে গেছিল। বাপ-মা হারা দেবনারায়ণ কলকাতায় মাসির কাছে বড়ো
হয়ে অবশেষে সেখানেই থিতু হয়ে গেলেন। বাড়ির দেখাশুনো করতে লাগলেন হরিনারায়ণের এক
কাকা। তিনিও বাড়িটার তেমন যত্নআত্তি করতেন না। উলটে বাড়ির
দামী বস্তুগুলো দেবনারায়ণের অজান্তেই এক এক করে বিক্রি করে দিতে শুরু করলেন। বারো
ভূতে লুটেপুটে খেতে লাগল জমিদার হরিনারায়ণের সাধের সম্পত্তি।’
গল্পটা এখানেই শেষ। ঝুরঝুরে খাতার
প্রায় খুলে আসা প্রতিটি ছেঁড়া পাতাই আমি হাঁচিপাঁচি করে উল্টেপাল্টে দেখলাম। হলদে
হয়ে যাওয়া অব্যবহৃত খাতা একটা। কিন্তু চোরকুঠুরি সম্বন্ধে কোথাও আর কিচ্ছুটি লেখা
নেই। শুধু শেষ পাতায় চার লাইনের ছোট্ট একখানি ছড়া
ছাড়া।
“জানালার চার শিক,
ডান টান দাও ঠিক।
বাজি পেটে চাবি বলে,
সিঁড়ি নামে হেলেদুলে!”
একবার মনে হল ছুট্টে নিচে
গিয়ে দেখাই সবাইকে খাতাটা। তারপর
ভাবলাম, ছোট্ট ঐ গল্পটার সঙ্গে যদি এই ছড়াটার কোনও যোগাযোগ না থাকে তাহলে খামোকা
লোক হাসানো হয়ে যাবে। এমনিতেই মা রোজ বকে আমায়, “গুচ্ছের রহস্যগল্প পড়ে পড়ে তুই
এখন গোড়ালিজলেও রহস্য খুঁজে বেড়াস!”
সুতরাং, আমার তেরো বছরের
অপরিপক্ক বুদ্ধিতে একটু পাক মেরেই দেখি না! যদি পাঁক ঘেঁটে কিছু খুঁজে বার করতে
পারি! আচ্ছা, ‘জানালার চার শিক’ মানে কী? আমি এক পা এক
পা করে এগিয়ে গেলাম জানালাটার কাছে। খড়খড়িওলা
দুটি পাল্লাই বাইরের দিকে। জানালায়
তো দেখি ছ’খানা শিক। তাহলে চার শিক বলছে কেন? জানালাটা
খোলার চেষ্টা করলাম আমি। জানালার ছিটকিনিটা নড়বড়েই ছিল। একটা
পাল্লাও দেখি ভাঙা ছিল - একটু ঠেলাঠেলি করতেই জানলার ভাঙা পাল্লাটা খটাস করে
বাইরের দিকে খুলে গিয়ে ভেঙে ঝুলে পড়ল।
‘ডান টান’ মানে কী? এটা কি
তবে চা-টার মতো কোনও কিছু? ‘ডান টান’ আবার কী ঠিক দেবে? জানালার চার শিকে ‘ডান টান’... কী মনে হতে ডানদিক থেকে ঠিক ঠিক গুণে গুণে
চার নম্বর শিকটা ধরে নাড়ানাড়ি করতে শুরু করলাম আমি। অন্য লোহার শিকগুলোর তুলনায়
এটাকে কেমন যেন একটু নড়বড়ে মনে হল আমার।
আচ্ছা, তা না হয় হল।
এবার ‘বাজি পেটে চাবি’ মানেটা কী? বাজি শব্দটা দিয়ে বাক্যরচনা করেছি আমি বহুবার।
বাজি মানে, বাজি রাখা হতে পারে, বাজি মানে আতসবাজি হতে পারে, বাজি মানে... বাজি
মানে ঘোড়া হতে পারে! তবে কি ঘোড়ার পেটে চাবি পাওয়া যাবে - এই বাজি রাখা হচ্ছে?
ঘোড়া... ঘোড়া... আরে, চারটে কুলুঙ্গিতে রাখা চারটে টেরাকোটার ঘোড়া... তার মানে কী!
যে ঘোড়াটাকে দেখে মনে হচ্ছিল আমায় দেখে ঘাড় নাড়ছে, সেটাকে বাদ দিয়ে অন্য তিনটি
ঘোড়া একজায়গায় জড়ো করলাম। নাহ, ঘোড়াগুলোকে বেমক্কা ঝাঁকিয়েও কোনও ফল হল না। এগুলোর
পেটে কিছু থাকলে ভেঙে তবে দেখতে হবে। আর সেটা করার
আগে সুদীপকাকুর অনুমতি চাই। একটু দমে গেলাম আমি। সাহস করে একবার ভূতুড়ে ঘোড়াটার
দিকেও হাত বাড়ালাম। ভয়টা ভেঙে যেতে দেরি হল না। ধুস,
স্রেফ সাধারণ মাটির ঘোড়া একটা! এখন আমার মনে হচ্ছে, তখন নিশ্চয়ই আমার কোনও ভুল
হয়েছিল। মোটেও ওটা আমায় দেখে মাথা নাড়ায়নি!
সে যাক গে, ‘সিঁড়ি নামে
হেলেদুলে’ মানে কী? আচ্ছা, নীচে কি কোনও সিঁড়ি আছে? না হলে সিঁড়ি নামবে বলা হচ্ছে
কেন, উঠবে না কেন? কিন্তু একি! আমার দুই হাতের টানে দেখি ডানদিক থেকে চার নম্বর
শিকখানি হঠাৎই কেমন যেন ওপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে। যা ব্বাবা!
আমার পিলে চমকে দিয়ে জানালার ঠিক নীচেই মেঝেটা যে একদিকে বসে যেতে শুরু করেছে! আমি
তড়াক করে লাফিয়ে সরে এলাম নিরাপদ দূরত্বে। চুনসুড়কির
এক চারকোণা স্লাইড দেখি ধীরে ধীরে হেলে যাচ্ছে নীচের দিকে।
বিচ্ছিরি ধুলো ধোঁয়ার মাঝেই আমার বিস্ফারিত চোখের সামনে ভেসে উঠেছে একখানি সিঁড়ি।
সেই সিঁড়ি নেমে গেছে চোরকুঠুরির দরজার দিকে! সেই দরজায় বিশাল বিশাল চারখানা তালা
ঝোলানো। উফফ, কেমন যেন মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল আমার। আমি...
আমি..!
“চূর্ণী, অ্যাই চূর্ণী, এখানে কী
করে এলি তুই?”
মা বাবার উদ্বিগ্ন চেঁচামেচিতে
আচমকা ঘোরটা কেটে গেল আমার। চোখ কচলে
চেয়ে দেখলাম, চারদিকে
ঘুটঘুটে অন্ধকার। কী একটা বিচ্ছিরি ভ্যাপসা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল আমার। দেখি
তিনচারটে বড়ো বড়ো টর্চের আলো ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার চারদিকে। আর
আমার মুখের উপর ঝুঁকে পড়েছে মা, বাবা, সুদীপকাকু আর কাকিমার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারাগুলো!
“চিলেকোঠার এই চোরকুঠুরিটার কথা আমি কানাঘুষোয়
শুনেছি অনেকবার। কিন্তু বরাবর গল্পকথা ভেবেই উড়িয়ে
দিয়েছি...” সুদীপকাকুর
বিস্ময়-বিহ্বল গলার স্বর আমার কানে গেল। আমার মাথাটা কেমন ভার হয়ে আছে। একশো
বছরেরও বেশি সময় ধরে বদ্ধ থাকা এই চোরকুঠুরিতে আমি যে কীভাবে প্রবেশ করলাম সেটা
আমার কিছুতেই মনে পড়ছে না! কুঠুরির দমবন্ধকরা বিষাক্ত বাতাসেও যে এতক্ষণ আমি সুস্থ
আছি, সেটা রীতিমতো আশ্চর্যই বটে। মা বলল, ঘুম থেকে উঠে আমাকে দেখতে না পেয়েই
শোরগোল পড়ে গেছিল। শেষে খুঁজতে খুঁজতে এই চিলেকোঠার ঘরে
উঁকি মেরেই সুদীপকাকু হতবাক হয়ে দেখেন, রাক্ষসের মতো হাঁ করে চেয়ে আছে এই অন্ধকার
কুঠুরিটা। সঙ্গে সঙ্গেই তড়িঘড়ি সব্বাইকে ডাক দিয়ে নিজে নেমে আসেন কাঠের সিঁড়ি বেয়ে।
চোখে পড়ে এককোণায় অচেতন হয়ে আমি পড়ে আছি। সেই সঙ্গে চোখে পড়ে কুঠুরিভর্তি বহু
অমূল্য তাঁত, রেশম
বস্ত্রসামগ্রীর গাঁটরি, ভাঙা তাঁতের অবশিষ্টাংশ, মানুষের হাড়গোড়!
মায়ের হাত ধরে উঠে বসতে গিয়ে হঠাৎ
কী যেন আমার হাতের ধাক্কায় মাটিতে পড়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। চমকে উঠে চেয়ে দেখলাম,
মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে টেরাকোটার চারটে ঘোড়ার ভাঙা কিছু টুকরো। আর ঘোড়াগুলোর
ভাঙা টুকরোগুলোর মধ্যে আজ এই এতকাল পরেও টর্চের আলোয় চকচক করে চলেছে চোরকুঠুরির
চারটি তালার চারটি চাবি! চিলেকোঠার প্রতিটি কুলুঙ্গিতে রাখা প্রতিটি টেরাকোটার
ঘোড়ার মধ্যে লুকোন ছিল একটি করে চাবি। তার মানে, চোরকুঠুরির দরজার সবসুদ্ধু মোট চারটি
তালার চারটি চাবি! কী ভয়ানক কান্ড! আচ্ছা, চাবিগুলো যদি এই মাত্তর সদ্য সদ্য ঘোড়ার
পেট থেকে আত্মপ্রকাশ করল, তাহলে এই কুঠুরির দরজার চারখানা ভারি ভারি তালা তখন কে
খুলে দিয়েছিল আমায়!
তবে সবথেকে অবাক করা ব্যাপার
হল এই যে, তন্ন তন্ন করে খানাতল্লাশি করেও বাড়ির কোত্থাও কিন্তু সেই আদ্যিকালের পুরনো
ছেঁড়া খাতাটার টিকিটিও খুঁজে পাওয়া গেল না!
_____
ছবিঃ সুমিত রায়
অনেক দিন পর রাখীর কাছ থেকে একটা বেশ ভালো আর রোমাঞ্চকর গল্প পাওয়া গেল পুজোর উপহার হিসেবে! হেব্বি লাগল।
ReplyDeleteঅনেক অনেক ধন্যবাদ,সত্যি অনুপ্রাণিত হলাম। এই অনুপ্রেরণাটুকুই সম্বল হোক চলার পথে
Deleteখুব সুন্দর লাগলো গো।
ReplyDeleteতুমি পড়েছ জেনে ভারি ভাল লাগল,অজস্র ধন্যবাদ
Deleteহেঁয়ালিপূর্ণ রহস্য গল্পের ধারায় এক অভিনব সংযোজন ।
ReplyDeleteলেখিকা-কে অভিনন্দন ।
চমৎকার অলংকরণের জন্য শ্রী সুমিত রায়-কেও ।
আন্তরিক ধন্যবাদ,প্রাণিত হলাম দাদা।এই শুভেচ্ছাটুকুই পাথেয় আমার
Deleteঅজস্র ধন্যবাদ
ReplyDelete