গল্প:: মিত্রবাবুর প্রতিভা - সত্যজিৎ দাশগুপ্ত


মিত্রবাবুর প্রতিভা
সত্যজিৎ দাশগুপ্ত

খুব বেশিদিনের কথা নয় পাড়ার মোড়ে সেনগুপ্ত বাড়িতে ভাড়া থাকত অরবিন্দ লোকে অবশ্য ওকে ওর উপাধি বা টাইটেল, ‘মিত্রনামেই চিনত বন্ধুরা ওকে ডাকতমিত্রবলে ছোটোদের কাছে ও ছিলমিত্রদা আবার যাদের সঙ্গে সম্মানের সম্পর্ক, তাদের কাছে ও ছিলউনি’, মানেমিত্রবাবু
তো এই মিত্রর চরিত্রটাও ছিল ভারী অদ্ভুত রেগে গেলে সরাসরি প্রকাশ করত না ঘুরিয়ে কথা বলত নিজেকে অনেক উঁচু জায়গায় রাখত মনে করত, আর পাঁচটা মানুষের থেকে ওরস্ট্যান্ডার্ডঅনেকটাই ওপরে অবশ্য সেটার কারণটা যে কী, সেটা কেউ জানত না মনে হয় ও নিজেও সেটা জানত না! আর সেই কারণেই একবার পাড়ার এক বয়স্ক মানুষ ওকেতুমিবলে সম্বোধন করায় ও যারপরনাই রেগে গিয়ে বলেছিল, “কী! আপনি আমায় তুমি বললেন! আমিতুমি’! তাহলে শুনুন আমি যদিতুমিহই, তাহলে আপনি একটাতুই’!”
যাকে অপমান করার জন্য ও কথাটা বলেছিল, সেই নিরীহ মানুষটা এই কথাটার মানে বুঝেছিল কিনা জানি না, কিন্তু আশেপাশের লোকজন ওর এই কথা শুনে মাথা চুলকাচ্ছিল
মিত্রর আচার আচরণও ছিল চোখে পড়ার মতো রোজ সকাল সাতটা পঞ্চান্ন মিনিটে অফিস বেরোত কোনোদিন আটটা যেমন হয়নি, তেমনই সাতটা পঞ্চাশেও কেউ তাকে কখনও রওনা হতে দেখেনি বেরোনোর সময় রোজ সকালবেলা ও একটা সিগারেট ধরাত ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করতে করতে সিগারেটটা মুখে দিত কিন্তু সেটা না ধরিয়ে মুখে নিয়েই হেঁটে আসত মোড়ের মাথা পর্যন্ত আর তারপর কেন জানি না ডানদিক আর বাঁ দিকে একবার করে দেখে নিয়ে প্যান্টের সাইড পকেট থেকে পেছন পকেট, সব হাতড়ে শেষে জামার বুক পকেট থেকে দেশলাই বের করত আর তারপর সিগারেটে আগুন দিত ওর এই প্রথমে প্যান্টের পকেট হাতড়ে দেশলাই না পেয়ে শেষমেশ জামার বুক পকেটে সেটার পাওয়া ছিল নিত্যকার ঘটনা! যদিও ব্যাপারটা রহস্যময়
মিত্রর ইংরেজিপ্রীতি ছিল অতি জনপ্রিয় যেখানে সেখানে ইংরেজি বলাটা যেন ছিল ওর জন্মগত অধিকার! ডাক্তার থেকে মুটে মজুর, সবার সঙ্গেই চালিয়ে যেত পাল্লা দিয়ে অবশ্য সে ইংরেজি যে কতটা ঠিক, সে কথা বলে তর্ক বাড়িয়ে লাভ নেই তবে সেবার একটা জিনিস সবাই দেখেছিল যে একবার এক সাহেবের সঙ্গে ইংরেজি বলার সময় সাহেব যেমন ওর কথা বুঝতে পারেনি, তেমন মিত্রও সেই সাহেবের কথা বুঝতে পারেনি!
তো এই মিত্র একবার একজনকে ইংরেজি বলা শেখাচ্ছিল সে বেচারি সবে পাড়ার কোনো এক বাংলা স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে এবার কলেজে ভরতি হবে কিন্তু সেখানে নাকি লোকে ফট ফট করে ইংরেজি বলে! তাই তাকেও ইংরেজি শিখতে হবে তাই মিত্র তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল
তাকে মিত্র প্রথম দিন বোঝাচ্ছিল যে কেউ যদি তাকে জিজ্ঞাসা করে, তুমি কী করো, তাহলে প্রথমে নাম বলার পর তাকে বলতে হবে যে সে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে আর সেইমতো সেটা ইংরেজিতে হবে অনেকটা এই রকম -
- হ্যালো, মাই নেম ইজ অমুক রায় আই অ্যাম কমপ্লিটেড ক্লাস টুয়েলভ -
ক্লাস চলছিল মিত্রর ঘরে ঠিক সেই সময় ওর ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন ওর বাড়িওয়ালা সেনগুপ্তবাবু ভদ্রলোক একটা কলেজে ইংরেজি পড়ান খুব স্বাভাবিকভাবেই মিত্রর এই আশ্চর্য ইংরেজি ওনার কানে আলপিনের মতো ফুটল চলে যেতে গিয়েও থাকতে না পেরে উনি ঘুরে গিয়ে মিত্রর জানালার সামনে মুখটা এনে বার দুয়েক ইতস্তত করে বললেন, “মিত্র ভায়া, ওটাআই অ্যাম কমপ্লিটেড ক্লাস টুয়েলভহবে নাকিআই হ্যাভ কমপ্লিটেড ক্লাস টুয়েলভহবে, সেটা আরেকবার ভেবে দেখলে ভালো হত না?”
ইংরেজি প্রফেসরের এই অগ্নিবাণ কিন্তু মিত্রকে টলাতে পারল না একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে ও বলল, “না কাকাবাবু, আমি ঠিকই বলেছি ওটাআই অ্যাম কমপ্লিটেড ক্লাস টুয়েলভ’-ই হবে
কিন্তু বাবা, আই অ্যাম কমপ্লিটেড হয় না আই হ্যাভ কমপ্লিটেড - মানে আই এর পর ডু ভার্ব-এর পাস্ট টেনস –”
হ্যাঁ মানছি ডু ডিড ডাই, টেনসের সব জেনেই বলছি আসলে আপনি হয়তো জানেন না, অক্সফোর্ডে একটা রুল এসেছে তারপর থেকে হয় আজকাল অ্যাম হচ্ছে কাকাবাবু
নাকটা আগেই কোঁচকানো ছিল এবার মুখটাও হাঁ হয়ে গেল তারপর সেটা কোনোরকমে সামলে নিয়ে একটা ঢোঁক গিলে ভদ্রলোক বললেন, “অক্সফোর্ড!” তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে খুব ক্ষীণভাবে পরাজয়ের স্বরেবলে মাথা নাড়তে নাড়তে কী যেন ভাবতে ভাবতে চলে গেলেন
তো সেই মিত্র একবার ভাবল, অফিস থেকে ফিরে অযথা সে সময় নষ্ট করছে তাই সে তার এই অমূল্য সময়টা মানুষ তৈরির কাজে লাগাবে মানে সে এবার ছাত্র পড়াবে আর সেইমতো কোথা থেকে যেন একটা ক্লাস সেভেনের ছাত্র জোগাড়ও করে ফেলল তাকে সে সায়েন্সে সাহায্য করবে মানে জীবন বিজ্ঞান, জড় বিজ্ঞান আর অংক আর সেই জন্য সে একটা সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর কিনে ফেলল
মিত্র ক্লাস সেভেনের ছাত্র পড়াচ্ছে শুনে পাড়ার এক বিশেষজ্ঞ, যে কিনা আবার মিত্রর গুণগ্রাহী (কারণ জানা যায়নি - মিত্রর ব্যক্তিত্ব নাকি তাকে মোহিত করেছিল!) মিত্রকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “তা মিত্রবাবু, ক্লাস সেভেন কেন? তোমার তো নাইন টেন পড়ানো উচিততাতে মিত্র বলেছিল, “তা তো উচিতই, আমার উঁচু ক্লাসের পড়াই সহজে মাথায় ঢোকে, বুঝলেন? কিন্তু বেসটা শক্ত হবে সেভেন থেকেই
তা শুনে পাশ থেকে এক ফাজিল ছেলে নাকি বলেছিল, “মিত্রদা, তুমি কি তোমার নিজের বেস শক্ত করছ নাকি?”
তাতে, মিত্র একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেছিল, “যেটা জানো না, সেটা নিয়ে পাকামো কোরো না বুঝলে? কত ছাত্র ছাত্রী আমার হাতে স্টার পেয়েছে জানা আছে?”
সেটা শুনে ছেলেটা প্রথমে কিছু বলেনি পরে একটু তফাতে গিয়ে চেঁচিয়ে বলেছিল, “স্টার পেয়েছিল নাকি স্টার হয়ে গেছিল?”
মিত্র অবশ্য ছেলেটার ওই সস্তা মজাকে তেমন পাত্তা দেয়নি কারণ তার মতে সে তার লেভেলের না অবশ্য ছেলেটা চলে যেতে মিত্রর সেই ভক্ত একটা বোকার মতো প্রশ্ন করে বসল
কিন্তু মিত্রবাবু, ক্লাস সেভেনের বাচ্চা পড়ানোর জন্য আপনি সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর কিনেছেন, মানে এমনি ক্যালকুলেটরেও তো –”
আঃ,” প্রায় একটা ধমক দিয়ে মিত্র বলল, “এর একিউরেসির কোনো ধারণা আছে আপনার?”
না মানে,” থতোমতো খেয়ে ভক্ত বলল, “সেভেনের অংক, মানে ওতেও দুয়ে দুয়ে চার আর মুখে মুখেও তোআর তাছাড়া সেভেনের অংক কষতে ক্যালকুলেটর –”
মিত্র অবশ্য এর উত্তর দিল না শুধু তাচ্ছিল্যের চোখে একবার ভক্তর দিকে চাইল ভগবানের চাউনির উত্তর ভক্তর ছিল না তাই বেচারা চুপ মেরে গেল
বেশ কিছুদিন পরের কথা একদিন অফিস থেকে ফেরার সময়, পাড়ার এক ছেলে ওকে দেখে বলল, “কী মিত্রদা, এবার কিছু একটা করুন
কী ব্যাপারে?” ছেলেটার কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করল মিত্র
ছেলেটা তখন ওর ডান হাতের তর্জনীটা মিত্রর পেটের দিকে তাক করে বলল, “আরে মধ্যপ্রদেশ যে হারে বাড়ছে, দুদিন পর তো –”
কিছু একটা বাজে মজা করতে চেয়েছিল ছেলেটা, কিন্তু কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে ওকে মিত্র সেখানেই থামিয়ে দিল তারপর এতটুকু অপেক্ষা না করে বাড়ির পথে না গিয়ে সোজা গেল ওর আরেক ভক্ত বাবাই-এর বাড়িতে বাবাই টেবিল টেনিস প্লেয়ার রোজ সকালে দৌড়োতে যায় ঠিক করল, পরের দিন থেকেই মিত্রও বাবাই-এর সঙ্গী হবে
যেমন ভাবা তেমন কাজ কথা দিয়ে তা নড়চড় করে না মিত্র পরের দিন সকাল ঠিক ছটায় হাফ প্যান্ট, গেঞ্জি আর কেডস পরে বাবাইদের বাড়ির সামনে পৌঁছে গেল কিন্তু মাঠে বাবাই-এর সঙ্গে তাল মেলাতে পারছিল না পৌনে এক পাক মেরেই বেচারা হাঁপাতে হাঁপাতে মাঠের পাশে বসে পড়ল
তা দেখে বাবাই জিজ্ঞাসা করল, “কী হল গো মিত্রদা?”
কিছু না রে,” হেসে মিত্র বলল, “তোর বয়সে এই মাঠ আমার কাছে কোনো ব্যাপার ছিল না এক টানে আটটা মেরে দিতাম রেতারপর কী একটা ভেবে নিয়ে বলল, “আসলে ওই খেলতে গিয়ে হ্যামস্ট্রিং-এ চোট লেগেছিল তো, তাই
ও তাই?” চোখ গোল গোল করে বাবাই বলল, “তোমার হ্যামস্ট্রিং-এ চোট?”
হ্যাঁ রে,” মাঠে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে বাঁ গালে হেসে বলল, “ছোটোবেলাটা তো মাঠেই কেটেছে রে সেবার চোটটা না লাগলে আজ অন্তত বেঙ্গল তো খেলেই ফেলতাম
কী খেলতে তুমি?” মিত্রদার নতুন রূপটা এই প্রথম সামনে এল বাবাই-এর ও ধপ করে বসে পড়ল মিত্রদার পাশে
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিত্র বলল, “ক্রিকেট আমার লাইফ ছিল কত দিন স্বপ্ন দেখেছি, কপিল দেবের সঙ্গে ইন্ডিয়ার হয়ে বোলিং শুরু করছি
অ্যাঁ –” মুখ দিয়ে অদ্ভুত একটা আওয়াজ বেরোল বাবাই-এরতুমি ফাস্ট বোলার ছিলে?”
হুঃ,” একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মিত্র বলল, “রীতিমতো এরিয়ানসের হয়ে খেলতাম রে
ওরেবাব্বা! এরিয়ানস!” বাবাইয়ের চোখ কপালে উঠল
তাহলে আর বলছি কী! কত কিছু করার ছিল জীবনে! ট্যালেন্ট ছিল জানিস! কিন্তু –” বলে আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল মিত্র তারপর বলল, “সেদিনের কথা এখনও মনে পড়ে জানিস?”
কোন দিনের কথা গো?”
সেদিন ছিল রবিবার ভোরে উঠে মাঠে গেছি এরিয়ানস-এ খেলি তখন সৌরভের দাদা স্নেহাশিসের মিডল উইকেট উড়িয়েছি আগের ম্যাচে পরের ম্যাচগুলোতে আরও উইকেট নিতে হবে তাই প্রাণপণে প্র্যাকটিস করছি নেটে একটা ডেলিভারি করেছি, এমন সময় একটা হাত পেছন থেকে আমার কাঁধে পড়ল আর তার সঙ্গে একটা গলা, ‘বহত ট্যালেন্টেড হো বেটা –’
সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘোরালাম আর কানে বাজতে শুরু করল একটা বিজ্ঞাপন, “পামোলিভকা জবাব নেহি!”
পামোলিভ, মানে তুমি –”
বাবাই ততক্ষণে কথা হারিয়েছে মিত্র তখন একটা একপেশে হাসি হেসে বলল, “হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছিস হাতটা আর কারও না, ছিল কপিল দেবের!”
সেদিনের ওই মাঠে গল্প বলার দিন থেকে তারপর মিত্রকে আর পাড়ায় দেখা যায়নি
আসলে মিত্ররা মাঠের যেখানে বসে কথা বলছিল, তার হাত পাঁচেক দূরেই বসেছিল এখানকার তৎকালীন বিখ্যাত পাঁচু গুণ্ডা সে ওখানে বসে আয়েস করে চা খাচ্ছিল আর মিত্রর কথা শুনছিল কিন্তু কপিল দেবের কথাটা ওর কানে যেতেই বেচারা একটা বিশাল হেঁচকি খেল শ্বাসনালিতে চা ঢুকে সে কী অবস্থা! কাশতে কাশতে বেচারার হৃৎপিণ্ড মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাবার জোগাড়! শেষমেশ বাবাই আর মিত্র, দুজন মিলেই ওকে সামনে পিজিতে নিয়ে গেছিল বটে, কিন্তু সামান্য সামলে নেবার পরেই পাঁচু গুণ্ডা মিত্রকে সাবধান করে দিয়েছিল যে, সে বাড়ি ফিরে যদি আর মিত্রকে পাড়ায় দেখে, তাহলে তার একদিন কী মিত্রর একদিন মিত্র অবশ্য বলেছিল যে ও কাউকে ভয় পায় না, কিন্তু কারও সঙ্গে সে অযথা ঝামেলায়ও জড়াতে চায় না কারণ ও রেগে গেলে শেষমেশ পাঁচুরই ক্ষতি তাই সে এ পাড়া ছেড়ে চলে গেছিল আর তারপর থেকে আর কেউ মিত্রকে দেখেনি
----------
ছবি - সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী

No comments:

Post a Comment