গল্প:: মাটি চাপা দ্বীপ - পুষ্পেন মণ্ডল


মাটি চাপা দ্বীপ

পুষ্পেন মণ্ডল


কী রে, তুইও চললি নাকি?”

হ্যাঁ দাদা, আমিও উঠে পড়লাম তোমাদের সঙ্গে।

খুব ভালো!”

ঝোঁকের মাথায় সৌম্য হঠাৎ করেই বন্ধুদের সঙ্গে উঠে বসেছে লরিতে। তাদের ক্লাব থেকে ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছে সুন্দরবন এলাকায়। বহু মানুষ বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত। চাল, ডাল, চিঁড়ে আর নিত্যপ্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস, তিরপল ইত্যাদি সংগ্রহ করা হয়েছে। বন্ধুরা সবাই ত্রাণ দিতে যাচ্ছে শুনে সৌম্য নিজেকে সামলাতে পারল না। বড়ো লরির অর্ধেকটা ভর্তি হয়ে গেছে মালপত্রে। বাকি অংশে ওরা বসেছে। সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ। তাই লরির মাথায় বড়ো তিরপল চাপিয়ে দিয়েছে খালাসি। মালপত্র নিয়ে প্রথমে যাবে সুন্দরবনের একটি জেটিতে। সেখান থেকে ট্রলারে করে নদীপথে যাত্রা। গন্তব্য সুন্দরবনের একটা ছোট্ট দ্বীপ। প্ল্যানটা পুরোপুরিভাবে সৌম্য জানেও না। তবুও মনের মধ্যে একটা উত্তেজনা কাজ করছে তার। আগের দিন সারা রাত ভালো করে ঘুম হয়নি। মন বলছে, এই বিপদের দিনে ওই অসহায় মানুষগুলোর পাশে যদি দাঁড়াতে না পারে, তাহলে নিজের মনুষ্যত্বের পরিচয় কী রইল। বুলবুল, আয়লা, তারপর ইয়াশ। পরপর তিন বছর তিনটে বড়ো ঝড় গেল সুন্দরবনের উপর দিয়ে। মানুষগুলোর জীবন সব ছারখার হয়ে গেছে। যা ছবি দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন নিউজ চ্যানেল আর কাগজের পাতায় তাতে গা শিউরে উঠছে। অবশ্য সরকার খুবই তৎপর ছিল বছর। উপকূলবর্তী এলাকা থেকে বেশির ভাগ মানুষকে সরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল নিরাপদ স্থানে। যাতে মানুষের জীবনহানি কম হয়

মণিদা ক্লাবের হেড। তিনি জানালেন, প্রায় চারশো থেকে পাঁচশো লোকের খাবার-দাবার আর তিরপল সংগ্রহ করা গেছে। এগুলি নিয়ে গিয়ে সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত দ্বীপে সাহায্য করা হবে। দ্বীপটার নাম শুনে ভারি অদ্ভুত লাগল সৌম্যর। ‘মাটি চাপা দ্বীপ’ লরি ছুটছে সকালের ফাঁকা রাস্তায়। মাঝে মাঝে গর্তে পড়ে লাফিয়ে উঠছে। মণিদা ঝাঁকুনি খেয়ে মুখটা বিকৃত করে জানাল, “মানুষগুলোর অবস্থা খুব খারাপ। বুঝলি সৌম্য। গতকাল আমার সঙ্গে ওদের গ্রামের একটা ছেলের ফোনে কথা হয়েছে। জানাল, একটা মাটির বাড়িও আস্ত নেই। বেশিরভাগ লোকই দ্বীপ ছেড়ে পালিয়েছে। যারা আছে, আধপেটা খেয়ে দিন কাটাচ্ছে।

পরিস্থিতিটা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে সৌম্য। দক্ষিণবঙ্গের বেশ কিছু এলাকা সমুদ্র উপকূল লাগোয়া হওয়ায়, ঝড়-ঝঞ্ঝা লেগেই থাকে। এদের জীবন-জীবিকা যে শহুরে মানুষদের থেকে কতটা আলাদা তা বাইরে থেকে বোঝা খুব মুশকিল। মণিদার কথা শুনে সৌম্য মাথা নাড়ল। কী বা করার আছে! প্রকৃতির কাছে মানুষ তো চিরকালই অসহায়। ভূতাত্ত্বিকরা বলছেন, সমুদ্রতলের জল বাড়ছে। আগামী পঞ্চাশ বছরে নাকি সুন্দরবন পুরোটাই তলিয়ে যাবে বঙ্গোপসাগরের নিচে। আপাতত সরকার থেকে তাদেরকে যতটা পারছে সাহায্য করছে। অসহায় মানুষগুলোর কথা ভেবে ওদের মতো অনেক ক্লাব আর স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাই এগিয়ে গেছে সাহায্য নিয়ে

মনোজদা নদীর পাড়ে নেমে চুকচুক করে আওয়াজ করে মাথা নেড়ে মন্তব্য করল, “আজকের আবহাওয়াটা খুব একটা সুবিধার নয়।সৌম্য দেখল, পুরো আকাশ মেঘে ঢাকা। বৃষ্টি কখনও থামছে, আবার জোরে আসছে। আর সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। একটি ট্রলার-এর ব্যবস্থা করে রেখেছিল মণিদা। লরি লাগানো হল একদম নদীর তীরে। সেখান থেকে সবাই মিলে মাথায় করে খাবারের প্যাকেট আর ত্রাণসামগ্রীগুলি বয়ে নিয়ে গিয়ে চাপানো হল ট্রলারে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জেটি ছাড়ল ওরা। জল কেটে এগিয়ে চলেছে মোহনার দিকে। উলটো দিক থেকে আসা ঝড়ো হাওয়া এলোমেলো করে দিচ্ছিল তার চুল। খোকন, মনোজদা, রমেন, বাবুয়া, মণিদা, অরূপ এরা সবাই সারা বছর বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু এদের সবার মধ্যে একটা গুণ হল মানুষের বিপদে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তে জানে। আজকে যেমন নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী সবাই লড়ে যাচ্ছে ওই অচেনা অজানা দ্বীপের মানুষগুলির পাশে দাঁড়ানোর জন্য। ঘণ্টা-খানেক লাগল ক্রমাগত ঢেউয়ের পাহাড় টপকে ওরা এসে পৌঁছোল একটি ভেসে যাওয়া দ্বীপের সামনে। মাটি-চাপা। সর্বত্র থৈ থৈ করছে জল। যেন কোনো মহাদানব দ্বীপটিকে খামচে খেয়ে নিয়েছে চারিদিক থেকে। এদিকে মাথার উপরে মেঘটা ক্রমশ ঘন হচ্ছে। যে কোনো সময়ে আবার বৃষ্টি নামবে।

ওই দেখ, কত লোকের ভিড়!” কথাটা শুনে ঘুরে তাকাল সৌম্য। মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তন্ময় হয়ে গিয়েছিল। ভিড় দেখে দূর থেকে মনে হল, শুধু কালো কালো মাথা। কয়েকশো লোক ভিড় করে আছে নদীর পাড়ে। ওরা যে ত্রাণ নিয়ে আসছে ফোনের মাধ্যমে সে খবর পৌঁছে গেছে। তাই ওরা কাতারে কাতারে হাজির হয়েছে নদীর কূলে। বৃদ্ধ, বৃদ্ধা আর নর-নারীর আকুল আর্তি। সৌম্য নিজের চোখের জল লুকাতে পারছে না আজকে। কেন যেন শুধু মনে হচ্ছে এই গ্রামটা তার খুব চেনা। কোথায় যেন দেখেছে এই দৃশ্য। কোনো দিন স্বপ্নের মধ্যে দেখেছে কি?

মনোজদা মন্তব্য করল, “দ্বীপের তট বলে আর কিছু নেই, না আছে কোনো বাঁধের চিহ্ন!”

রমেন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, “কী অবস্থা রে বাবা! লোকগুলো এখানে বেঁচে আছে কী করে?”

সত্যিই তাই। এত কষ্টের মধ্যে মানুষ যে কী করে বেঁচে থাকে, সেটা ভেবেই সৌম্যর বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে দলা পাকিয়ে উঠছিল। ট্রলারটা কোনোরকমে জলের শেষে গিয়ে দাঁড়াতেই সবাই হইহই করে দৌড়ে এল। হাত বাড়িয়ে চিৎকার করতে শুরু করল ওরা, আমাকে দাওআমাকে দাও…! সৌম্য লক্ষ করল তাদের পরনে শতচ্ছিন্ন শাড়ি নতুবা একটা লুঙ্গি, পুরুষদের ঊর্ধ্বাঙ্গ ফাঁকা। মণিদা তাদেরকে বোঝাতে হিমশিম খাচ্ছিল যে, “তোমরা হুড়োহুড়ি কোরো না। সবার জন্যই আমাদের কাছে খাবার আছে। সবাই পাবে।ওদের মধ্যে থেকেই একটি জোয়ান ছেলেকে ডেকে দায়িত্ব দেওয়া হল। প্রত্যেকে লাইন করে দাঁড়াল। এক একজনের হাতে তুলে দেয়া হল ত্রাণসামগ্রীর প্যাকেট, তিরপল, জলের বোতল ইত্যাদি। পুরো ব্যাপারটা মিটতে বেশি সময় লাগল না। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কাজ শেষ। ফিরে যাওয়ার আগে সৌম্য বলল, “চল, একবার গ্রামটা ঘুরে দেখি।

মোহনার উদ্দাম জল তখন ঢেউয়ের আকারে আছড়ে পড়ছে নরম মাটির উপর। প্রতি মুহূর্তে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে ‘মাটি চাপা দ্বীপ’ শোঁ শোঁ করে কানে আসছে বাতাসের আওয়াজ। আকাশে কালো মেঘ জমছে ক্রমশ। যে কোনো মুহূর্তে আবার বৃষ্টি হবে। মণিদা নির্দেশ দিল, “এখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না রে সৌম্য। আকাশের অবস্থা দেখেছিস?”

দেখেছি মণিদা। তবুও একটা অনুরোধ রাখো। এতদূর থেকে এলাম আমরা। একটু গ্রামের ভিতরটা ঘুরে আসব না? ত্রাণ দেওয়াটাই তো সব নয়। ফিরে গিয়ে এদের কথা তুলে ধরতে হবে শহরের মানুষদের কাছে। নিজের চোখে না দেখলে কী করে বলব?” অনুরোধ করল সৌম্য

সৌম্যর কথাটা সবার মনে ধরল। দলনেতা মণিদা মাথা নাড়তে সৌম্য জুতো খুলে হাতে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল গ্রামের উদ্দেশে মাটির বাঁধ যেটা ছিল, জলের তোড়ে ভেঙে গেছে। মিশেছে পলির সঙ্গে। প্যাচপ্যাচে কাদা। তার ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওরা চার-পাঁচজন বন্ধু পৌঁছোল গ্রামের ভিতরে। চারপাশে চোখ দিয়ে তাজ্জব বনে গেল ওরা। গাছগুলো সব ভেঙে উলটে পড়ে আছে। পথঘাট বলতে কিছুই নেই। পড়ে রয়েছে শুধু বাড়িগুলোর ধ্বংসাবশেষ। বেশিরভাগ বাড়িই ছিল মাটির তৈরি। আর জলের তোড়ে মাটি গলে গিয়ে বাঁশ-কাঠ বেরিয়ে পড়েছে। যেন এক একটা কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে। আমাজনের পিরানহা মাছের কথা বইতে পড়েছিল সৌম্য। যারা নাকি কয়েক মুহূর্তের মধ্যে একটা আস্ত ঘোড়াকে জলে পেলে নিমেষে শেষ করতে পারে, পড়ে থাকে শুধু হাড়। তেমনই বাড়িগুলোর শুধু কঙ্কালসার চেহারাটা দাঁড়িয়ে আছে। মানুষগুলো সব অসহায়। জুলজুল করে দেখছে ওদের দিকে। বেশির ভাগই জেলে। গভীর সমুদ্রে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে তারা। ঝড়ের বীভৎস তাণ্ডব যেন তাদের নির্বাক করে দিয়েছে। ভেঙে দিয়েছে মাছধরা নৌকা। জাল ছিঁড়ে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে ছড়িয়ে আছে

একটি বৃদ্ধ মানুষকে দেখে এগিয়ে গেল সৌম্য। জিজ্ঞেস করল, “আপনারা কতজন আছেন এখানে? তিনি প্রথমে থতোমতো হয়ে চুপ করে রইলেন। উত্তর দিলেন বেশ কিছুটা পরে, “এখন বেশি নেই। ঝড়ের আগে সরকার থেকে সব লোক তুলে নিয়ে চলে গেছে। আমরা ক’জন ছিলাম। ঝড়ের তাণ্ডব দেখেছি নিজের চোখে সৌম্য আবার জানতে চাইল, “জল কতদূর উঠেছিল? তিনি হাত উঁচু করে জানালেন, “একতলা ঘর সব ডুবে গিয়েছিল। ঝড় আর বড়ো বড়ো ঢেউ গ্রামের মধ্যে ঢুকে তছনছ করে দিয়েছে

“গ্রামে একটাও বাচ্চা দেখছি না কেন? জানতে চাইল সৌম্য। বৃদ্ধ ভেজা গলায় উত্তর দিলেন, “বাচ্চা আর মেয়েদের সরকার তো আগেই নিয়ে চলে গেছে। ওদের জীবন নাকি বেশি দামি এখন তো পড়ে আছি আমরা কিছু বুড়ো-বুড়ি আর কয়েকজন জোয়ান লোক

শুনে খুবই কষ্ট হচ্ছিল সৌম্যর। ভাবছিল যারা শহরের পাকা বাড়িতে থেকে অভ্যস্ত তারা কি এই পরিবেশ কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবে? বন্ধুরা সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়েছিল এদিক ওদিক। সৌম্য মোবাইলে ছবি তুলতে তুলতে এগিয়ে যাচ্ছিল গ্রামের ভিতর দিকে। যত এগোচ্ছে চোখে পড়ছে তত করুণ দৃশ্য। খেয়াল ছিল না যে অন্য বন্ধুরা তখন আর কেউ আশেপাশে নেই। হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় দেখল বেশ কিছু ভিজে বই-খাতা পড়ে আছে। কী ব্যাপার! আগ্রহ নিয়ে সৌম্য এগিয়ে গিয়ে বইগুলো হাতে নিল। পাতা উলটে দেখল, ক্লাস সেভেনের সরকারি স্কুলের বই। বন্যার জলে ভেসে গিয়েছিল। পরে হয়তো কেউ সেগুলো কুড়িয়ে পেয়ে শুকাতে দিয়েছে রোদে। এখনও পুরোপুরি শুকিয়ে ওঠেনি। বইগুলো রেখে আবার সে এগিয়ে গেল

গ্রামের শেষ প্রান্তে একটি ছেলে সৌম্যর দিকে পিছন ফিরে বসে আছে। বছর দশেক বয়স হবে মনে হয়। মাটির মধ্যে সে যেন কিছু খুঁজছে। সৌম্য এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল তার কাছে। হাতে ধরা ক্যামেরা, তাতে মুভি হচ্ছে। “কী নাম তোমার? দূর থেকেই একটু গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল সৌম্য। কিন্তু ছেলেটা মনে হয় শুনতে পেল না। আবার প্রশ্নটা পুনরাবৃত্তি করল ও। কিন্তু না, এবারেও সে উত্তর দিল না কিছু। আশ্চর্য! সৌম্য আরও একটু এগিয়ে গেল তার দিকে। ছেলেটা কি কালা? শুনতে পায় না! হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেটা ছুটতে শুরু করল। এক-পলক ঘুরে তাকিয়েছে সৌম্যর দিকে। মুখটা কী করুণ! কী মিষ্টি দেখতে! মুখটা যেন কোথায় দেখেছে সে! কিন্তু ওদিকে কোথায় যাচ্ছে? ওদিকে তো কোনো বাড়ি নেই। শুধু কিছু গাছপালা আর জঙ্গল আছে। তাও ভেঙে গেছে বড়ো গাছগুলো

“কোথায় যাচ্ছ তুমি? আমার কাছে চকলেট আছে, তুমি খাবে? সৌম্য চিৎকার করল। কিন্তু ছেলেটা শুনতে পেল না। সৌম্য দৌড়াচ্ছিল ওর পিছনে। একটা আড়াআড়ি ভাঙা গাছের গোড়ায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ছেলেটা। বিশাল বড়ো একটি শিমুল গাছ ভেঙে পড়েছে। গাছটার নিচে চাপা পড়ে আছে একটি মাটির ঘর। ছেলেটা মুখে কিছু বলল না, শুধু আঙুল তুলে দেখাল বাড়িটার দিকে। সৌম্য যেন আটকে গেছে মাটির সঙ্গে ছেলেটা কী দেখাতে চাইছে ওকে? সে এক পা, এক পা করে এগিয়ে গেল সেই ভাঙা বাড়িটার দিকে। একটা অজানা শিহরণ খেলে গেল শিরদাঁড়া দিয়ে।

বাড়িটা যেন কোনো দানবের পায়ের চাপে মিশে গেছে মাটিতে। টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়া টালি আর বাঁশের গোড়ায় আরও কতগুলো বই! সৌম্য এগিয়ে গেল। ওই বইগুলোর জন্যই কি ছেলেটা ডেকে আনল তাকে? আহা রে! বেচারা হয়তো পড়তে চায়! কিন্তু তার বইগুলো সব জলে ভেসে গেছে। যদি সম্ভব হয়, সৌম্য তাকে সব নতুন বই কিনে দিতে পারে। ছেলেটার আঙুল তুলে দেখানো জায়গাটাতে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসল সে। বইগুলো হাতে তুলে নিল। ক্লাস ফাইভের অঙ্ক, বাংলা, ইংরেজি বই। জলের মধ্যে থেকে সেগুলো ভিজে তুলতুল করছে। পড়ার অযোগ্য!

হঠাৎ চোখে পড়ল কয়েকটা আঙুল উঁকি দিচ্ছে বাঁশের ফাঁকে মাটির নিচ থেকে। একটা হাত! কাদার মধ্যেই ধপাস করে বসে পড়ল সে। একটা বাচ্চা ছেলের হাত! ছেলেটা মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে! চিৎকার করে সৌম্য ডাকছে তার বন্ধুদের, “মণিদা, খোকন, রমেন, বাবুয়া... এদিকে আয়... তোরা তাড়াতাড়ি আয় এখানে... একটা বাচ্চা চাপা পড়ে আছে! কিন্তু তার কথা কেউ শুনতে পেল না। কারণ তার চারপাশে ওরা কেউ নেই। সৌম্য একাই গিয়েছিল সেখানে। মাটি থেকে উঠে চিৎকার করে পিছন দিকে দৌড়োতে শুরু করল সে গ্রামে ফিরে আরও লোকজনকে ডেকে নিয়ে গেল সৌম্য। সবাই মিলে হাত লাগিয়ে বাচ্চার শরীরটাকে কাদার মধ্যে থেকে বের করল ওরা। শরীরটা পচতে শুরু করেছে। তার মুখটা চেনা যাচ্ছে না। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে সৌম্য সরে এল সেখান থেকে

গ্রামের এক বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে জানালেন, “ছেলেটা তার মায়ের সঙ্গে একলা থাকত এই গ্রামের শেষে। ওর মা এক অন্য জাতের ছেলেকে বিয়ে করেছিল বলে গ্রামের মোড়লরা তাকে একঘরে করে রেখেছিল। তাই গ্রামের বাইরে একটা কুঁড়ে তৈরি করে ছিল তারা তিনজনে। কিন্তু ছেলেটার বাবাকে গতবছর বাঘে খেয়েছে। সে মধু আনতে গিয়েছিল ঘন জঙ্গলের মধ্যে। যেদিন ঝড় আসবে তার আগেরদিন সরকারি লোক এসেছিল গ্রামের লোকজনকে ডাকতে। কিন্তু গ্রামের বাইরে এখানে যে একটা কুঁড়েঘর রয়েছে খেয়াল করেনি তারা। ছেলেটার মা হয়তো তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু জলের তোড়ে ভেসে গেছে মা। ছেলেটা চাপা পড়ে গেছে ভাঙা কুঁড়েঘরটার নিচে

বৃষ্টি শুরু হল। সৌম্য পিঠের ব্যাগ থেকে রেনকোটটা বের করে চাপিয়ে নিল গায়ে। মণিদা তাড়া দিচ্ছে সবাইকে ফিরে আসার জন্য। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়তে সে জিজ্ঞাসা করল বৃদ্ধাকে, “ঐ বাচ্চা ছেলেটা কোথায় গেল? যে এখানে ডেকে আনল আমাকে?

বৃদ্ধা লাঠি ঠুকে ঠুকে হাঁটছিলেন, কথাটা শুনে থমকে গিয়ে জানালেন, “এ দ্বীপে তো আর কোনো বাচ্চা নেই!

নেই মানে! সৌম্য ঘোরের মধ্যে টলতে টলতে এসে উঠে পড়ল ট্রলারে। ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে ট্রলার ছাড়ল। সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। তার চুলগুলোকে উড়িয়ে দিচ্ছে। উড়ছিল সৌম্যর হাতে ধরা ক্লাস ফাইভের অঙ্ক বইয়ের ভিজে পাতা। বইটা সে ফেলে আসতে পারেনি সেখানে। বইয়ের দ্বিতীয় পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ছেলেটির নিজের নাম। হাতের লেখাটা সৌম্যর খুব চেনা। হুবহু তার নিজের ছোটোবেলার মতো মোবাইলটা হাতে নিয়ে পাশে বসে মণিদা ছবিগুলো দেখছিল ট্রলারের ছাউনির মধ্যে। শেষের ভিডিওতে গিয়ে চোখটা আটকে গেল সৌম্যর। আবার রিওয়াইন্ড করতে বলল। বার বার দেখল, কিন্তু ছবিটার মধ্যে কোনো বাচ্চা ছেলে নেই। আশ্চর্য!

----------

ছবি - লেখক

ম্যাজিক ল্যাম্প 

No comments:

Post a Comment