পরশুরামের রিক্সা
চুমকি চট্টোপাধ্যায়
চন্দবাড়িতে আজ উৎসবের মেজাজ। বাড়ির কর্তা সক্কাল সক্কাল বাজারে ছুটেছেন যদি
এক-আধটা ইলিশ জোটে। ছোটোকর্তা জলখাবারে কচুরি জিলিপি এনেছেন। বড়োকর্তা বলেছেন, রাতে তিনি বিরিয়ানি
স্পনসর করবেন। বড়োগিন্নি, ছোটোগিন্নির হাসি আর ধরে না। তানিয়াও বেশ খুশি। সে তো হল।
কিন্তু কারণটা কী?
কারণটা হল, চন্দবাড়িতে নতুন গাড়ি এসেছে। টয়োটা
ইনোভা। মুক্তো রঙা গাড়িটা ওদের বাড়ির নিচেই
দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও যেতে হলে এতদিন ওরা হয় বাস নয় ট্যাক্সি করে যেত। ছোটোখাটো দূরত্বে রিক্সাই ছিল মূল বাহন। কিন্তু মুশকিল হত ঠাম্মিকে নিয়ে। ওদের
অঞ্চলে এখনও হাতে টানা রিক্সা চলে। বেশ উঁচু এই রিক্সাগুলোতে ঠাম্মির উঠতে খুব কষ্ট হয়। অনেকদিন
ধরেই বিস্তর আলাপ আলোচনা চলত, যে একটা গাড়ি না হলে আর
চলছে না।
চন্দবাড়ির ছোটো ছেলে শুভ্র চন্দের মেয়ে
তানিয়া। ওর স্কুল বাস আসে কিছুটা দূরে বড়ো রাস্তার মোড়ে। হেঁটে যে যাওয়া যায় না তা নয়। তবে আটটায় স্কুল কিনা, তাই বেশ সকালেই তৈরি হতে হয়। হেঁটে গেলে একটু আগে বেরোতে হবে। তার ওপর আছে পিঠে পাঁচ কিলোর বোঝা। তাই পরশুরামের রিক্সা করেই
তানিয়া বাস স্ট্যান্ডে যায়। মাস মাইনের বন্দোবস্ত আছে।
তানিয়ার জ্যাঠতুতো বড়োদিদির
বিয়ে হয়ে গেছে। জ্যাঠতুতো দাদাও বাইরে চাকরি করে। মাঝে মাঝে আসে। এখন বাড়িতে সাতজন
মানুষ থাকে। কোথাও যেতে হলে সবাই যাতে এক সঙ্গে যেতে পারে তাই গাড়ির লোন নিয়ে বড়ো গাড়িই কেনা হয়েছে। সাতজন ধরে যায় এই গাড়িতে।
শুধু রিক্সা করে বাস স্ট্যান্ডে গেলেই তো হল না! বাস যে রোজ ঘড়ি ধরে আসে তা তো নয়। কোনওদিন যেতে না যেতেই এসে যায়, কোনওদিন আবার তীর্থের কাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাক। আগে
শীতলামাসি যেত তানিয়ার সঙ্গে। শীতলামাসির শরীর খারাপ হওয়াতে কাজ ছেড়ে দিয়েছে। এখন
তানিয়া একাই যায়। তানিয়ার বাবা একটু একটু ভয় পান। কিন্তু মা বলেন, “ছোটো থেকে একটু ছেড়ে দিলে ভয় কেটে যায়, আত্মবিশ্বাস
বাড়ে। এই তো সামান্য রাস্তা। কিচ্ছু অসুবিধে নেই। একাই যাক।”
পরশুরাম কিন্তু মোটেই তানিয়াকে একা ছেড়ে দিয়ে চলে আসে না। যতক্ষণ না স্কুল
বাস আসে, ও দাঁড়িয়ে থাকে। তানিয়া তো কত বলেছে, “তুমি চলে যাও, পরশুরামকাকা। তোমার লস হয়ে যাবে।
আমি ওয়েট করছি। কোনও প্রবলেম হবে না।”
কিন্তু পরশুরামের এক কথা, “না
খুকুমণি, তুমাকে বাসে তুলে আমি চলিয়ে যাব। ফাঁকা ইস্ট্যান্ডে
তুমাকে একা ছেড়ে যাব না।”
তানিয়ার স্কুল ছুটি হয় দুটোর সময়। বাস যখন নামায় তখন তিনটে বেজে যায়। জ্যাম
থাকলে আরও দেরি হয়। সেই সময় বাস স্ট্যান্ডে অনেক লোকজন থাকে। অন্য রিক্সাও থাকে।
তানিয়া কিন্তু জানে বাস থেকে নেমেই পরশুকাকাকে ও দেখতে পাবে। এই সময়ের কাছাকাছি
কোনও সওয়ারিই ও নেয় না। খুকুমণিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তবেই ওর স্বস্তি।
তানিয়াকে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছনো ছাড়াও যখনি তানিয়ার মা,
জেম্মা কাছাকাছি দোকান বাজার গেছে, পরশুরামকে আগে থেকে বলে রাখলেই ব্যস, নো
চিন্তা! ঠিক সময়মতো এসে ঘণ্টা নাড়বে টুং টুং টুং...। অন্য
কেউ পাঁচগুণ ভাড়া দিতে চাইলেও যাবে না ও।
বর্ষার সময় দু-একবার যা কাণ্ড হয়েছে! তানিয়া স্কুলে গেছে ভালোভাবেই। ও মা, বেলা
সাড়ে বারোটা থেকে সেই যে বৃষ্টি নামল, একঘণ্টা পর থামল
রাস্তাগুলোকে নদী বানিয়ে। তানিয়ার কিন্তু চিন্তা নেই। ও জানে পৃথিবী ডুবে গেলেও
পরশুকাকা আসবে ওকে নিতে।
তানিয়া রিক্সায় যেতে যেতে কত কথাই না বলে পরশুরামের সঙ্গে। দাদুর কাছে শোনা
পরশুরামের কুঠারের গল্পও বলেছে ওকে।
“জানো পরশুকাকা, এটা তো কলিযুগ। এর আগের আগের যুগের
নাম ছিল ত্রেতাযুগ। সেই যুগে ঋষি জমদগ্নি আর রেণুকার ছেলের নাম ছিল পরশুরাম। বিষ্ণুর অবতার ছিল এই পরশুরাম। সে সময় ক্ষত্রিয়রা
ব্রাহ্মণদের খুব বিরক্ত করত বলে পরশুরাম হাতের কুঠার দিয়ে একুশবার ক্ষত্রিয়দের
মেরে শেষ করেছিল। কুঠার বোঝ তো? অ্যাক্স যাকে বলে। বুঝেছ
তো? আরে, গাছ
কাটে গো! এই গল্প আমার দাদু বলেছে।”
“হাঁ হাঁ, বুঝিয়েছি খুকুমণি।”
খুশি হয়ে বলতে থাকে তানিয়া, “সেই পরশুরাম তার মাকে কুঠার দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলেছিল। তাই ওর বাবার
অভিশাপে সেই কুঠার ওর হাতে আটকে গেছিল। কিছুতেই খুলত না। এই তোমার হাতে যেমন
রিক্সার ডান্ডি আটকে থাকে সারাদিন, তেমনি।”
“রাম রাম, খুকুমণি। হামি কিন্তু এত্ত পাপ কাজ
করি নাই। ছেলে মাকে মারিয়ে ফেলল, সে কেমন ছেলে? জাহান্নুমে গরম তেলে ওকে ভাজবে গো, খুকুমণি।”
হাসিতে ফেটে পড়ে তানিয়া। ওর পরশুকাকার সারল্য আনন্দ দেয় ওকে।
* * *
একজন ড্রাইভারের ব্যবস্থাও করা হল। বাড়ির লোকেরা, বিশেষ করে ঠাম্মি, জেম্মা, মা -
এদের বেরনো মুশকিল হচ্ছিল। কে নিয়ে যাবে? এক রবিবার আর ছুটির দিন ছাড়া তো সবাই
অফিসে। বাপ্পা পাশের পাড়াতেই থাকে। বাড়ির বড়োরা আলোচনা করে ঠিক করল, সকালবেলা বাপ্পা এসে
তানিয়াকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসবে। আবার বিকেলে স্কুল থেকে নিয়ে আসবে। মধ্যের
সময়টুকুতে যার যার দরকার, তারা বেরোবে।
“তানি, তোর টেনশন কমে গেল। পরীক্ষার সময় বাস
ঠিক সময় আসবে কি না ভেবে
পাগল হতিস। এখন থেকে আর চিন্তা রইল না। আমিও নিশ্চিন্ত হলাম।” তানিয়ার মা বললেন।
তানিয়ারও এই কথাটা মনে হয়েছে। তাছাড়া রোজ একটু সময়ও বাঁচবে। আর, একটু দেরি করে বেরনো যাবে। কিন্তু মনের ভেতর কোথায় একটা যেন কাঁটা বিঁধছে।
অস্বস্তি হচ্ছে। পরশুরামকাকার জন্যে কি? বাবা তো বলল, “ওর জন্যে
কোনও চিন্তা নেই। ওর বরং রোজগার
বাড়বে। কত সওয়ারিকেই তো নিতে পারত না তানিকে সময়মতো দেওয়া-নেওয়া করতে গিয়ে।”
আজ প্রথম গাড়িতে চড়ে স্কুলে যাচ্ছে তানিয়া। ওর বাবাও যাচ্ছেন সঙ্গে। বাস
স্ট্যান্ড পেরনোর সময় তানিয়া দেখতে পেল পরশুকাকা রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা
যেন করুণ। বুকটা মুচড়ে উঠল তানিয়ার। চোখ ভরে এল জলে। একটুও ভালো লাগছে না গাড়ি করে
স্কুলে যেতে। ভাড়া নয় পরশুকাকা পেয়ে যাবে, কিন্তু
কী সুন্দর গল্প করতে করতে যেত যে ওরা, তার কী হবে?
স্কুল থেকে গাড়িতে করেই ফিরল তানিয়া। আসার সময় পরশুকাকাকে দেখতে পায়নি ও।
মুখটা ভার হয়ে আছে।
“কী তানি-মা, মুখ
ভার কেন? কাল রেজাল্ট বেরোবে তো?”
জেম্মা জিগ্যেস করেন, “আজ কেমন লাগল গাড়িতে যাতায়াত করে?”
“ভালো না,” বলেই ঘরে
চলে আসে তানিয়া।
আজ রেজাল্ট বেরিয়েছে। সেকেন্ড হয়েছে তানিয়া। মাত্র দু’নম্বরের জন্যে। বাড়ি ফিরছে গাড়িতে। রিক্সা স্ট্যান্ডে দেখতে পায় দাঁড় করানো
রিক্সার পাদানিতে উদাসভাবে বসে আছে পরশুকাকা। কাকা কি তানিয়ার কথা ভাবছে? পরশুকাকার দেশের গল্প, ধর্মের গল্প, কিছুই তো আর শোনা হচ্ছে না।
বাড়িতে সবাই খুব খুশি। দাদু বললেন, “ভালো করে লেখাপড়া শিখলে কী হয় জানো,
দিদিসোনা? যেখানেই যাও না কেন, সম্মান
পাবে। শাস্ত্রে আছে, স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে। মানে হল, তুমি যদি
ধনবান রাজা হও তাহলে যে রাজ্যের রাজা, সে রাজ্যের লোক
তোমাকে মানবে, পুজো করবে। কিন্তু তুমি যদি বিদ্বান হও
তাহলে গোটা বিশ্ব তোমাকে পুজো করবে।”
বাবা, মা, জেঠু, জেম্মা সব্বাই অনেক আদর করল তানিয়াকে। রাত্রের মেনু ঠিক
হয়ে গেল, টুং ফাং-এর মিক্সড চাউ আর গার্লিক চিকেন। তানিয়ার পছন্দের খাবার।
“বল, কী নিবি,” মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বাবার প্রশ্ন।
“আমি গাড়ি করে স্কুলে যাব না। পরশুকাকার রিক্সা করেই যাব, আগের মতো।”
সবাই থমকে যায় মেয়ের কথা শুনে। বলে কী? ওর মা বলেন,
“কেন রে? গাড়িতে তো তাড়াতাড়ি পৌঁছে
যাচ্ছিস স্কুলে, আরামেও যাচ্ছিস। তাহলে?”
“বাবা জিগ্যেস করেছে, আমি কী
নেব। আমি এটাই চাই। এটাই আমার প্রাইজ। না দিলে দিও না। আমার আর কিচ্ছু চাই না।”
দৌড়ে সেখান থেকে চলে যায় তানিয়া।
* * *
টুং টুং করে বাজছে আঙুলে জড়ানো ঘণ্টা। পরশুরামের রিক্সায় খিল খিল করে হাসছে
তানিয়া।
“পরশুকাকা, তুমি শিগগির শিগগির গাড়ি চালানো শিখে
নাও। তাহলে আমাদের গাড়িটা তুমিই চালাবে। তোমারও আর কষ্ট করে হাতে রিক্সা টানতে হবে
না। আর, অনেক বেশি টাকা পাবে। আমিও তোমার সঙ্গে গল্প করতে করতে স্কুলে যেতে পারব।”
“ঠিক হি তো বলিয়েসো,
খুকুমণি। হামার ভি ভালো লাগছিল না। খুকুমণি আসিয়ে গেছে, হামি ভি খুশ। ইকটা কথা হোলো, হামি যদি
ডেরাইভিং শিখে লি, তাহলে হামার এ রিস্কাটার কী হবে খুকুমণি! যোবে থেকে হামি কাম করছি, ই রিস্কাই তো হামাকে
খাবিয়েছে। ইকে তো ছাড়তে পারব না গো।”
ঠিকই তো! পরশুকাকার প্রাণ তো রিক্সাটাই। একে
ছেড়ে তো থাকতে পারবে না কাকা। ভেবেচিন্তে বলে তানিয়া, “তাহলে
তোমার রিক্সায় চড়েই আমি আসব, যাব। তোমাকে আর
ড্রাইভিং শিখতে হবে না। ওই তো বাস আসছে।”
পরশুকাকাকে টা টা করতে গিয়ে দেখে কাকা একটা কাগজের ঠোঙা হাতে নিয়ে ওর দিকে
তাকিয়ে আছে।
“এটা তুমার জন্যে আনিয়েছি,
খুকুমণি। লিট্টি।”
লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলে পরশুরাম।
হেসে কাকার হাত থেকে ঠোঙা নিয়ে বাসে উঠে যায় তানিয়া। টিফিন ব্রেকে ঠোঙা
খুলে একটা বের করে কামড়ে মন্দ লাগে না।
লিট্টি আগে কখনও খায়নি। বন্ধুদের ভাগ করে দিয়ে
পরশুকাকার গল্প বলে তানিয়া। আজ খুব খুশি ও।
পরশুকাকার রিক্সায় চেপে বাড়ি ফিরছে তানিয়া।
“তোমার লিট্টিগুলো খুব ভালো খেতে,
পরশুকাকা। থ্যাঙ্ক ইউ! জানো, আমি ক্লাসে সেকেন্ড হয়েছি। আর তুমি
আমাকে সব থেকে ভালো প্রাইজ, ওই, মানে
পুরস্কার দিয়েছ। আমি বন্ধুদেরও দিয়েছি।”
“পেরাইজ হামি দিলাম কই, খুকুমণি! হামার খেমতা কী আসে তুমাকে দেব যে? সে হামার দেশে একঠো গরিব আদমি ছিল। তার ছেলে ভালো লিখাপড়া করল...”
টুং টুং ঘণ্টি আর দিলখোলা গল্পের মধ্যে দিয়ে পেরিয়ে যায় পথ। ওদের খুশিতে
রামধনু ওঠে আকাশে, অকারণেই। ভাঙাচোরা রাস্তা হয়ে যায়
মখমলের। যেন পক্ষীরাজে চেপে চলেছে রাজকুমারী, সারথি
কলিযুগের পরশুরাম।
_____
অলঙ্করণঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
'কাবুলিওয়ালার' ফ্লেভার পেলাম যেন অনেক দিন পর।মন ভাল করা গল্প।
ReplyDeleteআহা! সহজ কথায় কত কঠিন গল্প বলা হল, অথচ কী মন-ভরানো স্টাইলে। সেলাম।
ReplyDeleteকৈশোরের সারল্যতার সহজ সরল ছবি সুন্দর কথায়
ReplyDeleteখুব ভালো লাগল। সত্যি।
ReplyDeleteউফফ কি মিষ্টি সরল জীবনের গল্প। মন ভালো করা,।
ReplyDeleteখুব ভাল লাগল। ছোটবেলার রিক্সা করে স্কুল যাওয়া মনে পড়ে গেল।
ReplyDeleteগল্পটা কিন্তু খুব মিষ্টি।
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteখুব ভালো লাগল চুমকিদির গল্পটা ...
ReplyDeleteভারি মিষ্টি গল্প ❤
ReplyDeleteএকরাশ মুগ্ধতা শুধু।
ReplyDeleteএকি তানিয়ার গল্প না আমাদের চুমকি দিদির, এই হল ম্যাজিক ল্যাম্পের ম্যাজিক
ReplyDeleteএকি তানিয়ার গল্প না আমাদের চুমকি দিদির, এই হল ম্যাজিক ল্যাম্পের ম্যাজিক
ReplyDeleteভীষণ ভালো লাগলো
ReplyDelete