অদিতি সরকার
“দূর, একটা পদের থাকার জায়গা পর্যন্ত
খুঁজে পাওয়া যায় না,”
বিক্রম স্ক্রিনের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত স্ক্রোল করে নামতে নামতে গজগজ করছিল। “আজকের দিনেও
আদ্ধেক হোটেলের কোনও ওয়েবসাইটই নেই। সেই পুরনো দিনের চিন্তা নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে
যাচ্ছে। এভাবে চলে না, দূর দূর।”
জিষ্ণু বিক্রমের কাঁধের ওপর
দিয়ে ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করছিল।
“কেন, এই যে এটা? বেশ ভালো তো,” একটা রঙচঙে পাঁচতলা ইট-সিমেন্টের স্তূপের দিকে আঙুল দেখাল
জিষ্ণু।
“মাথা খারাপ!” বিক্রম এককথায়
উড়িয়ে দিল। “এসব জায়গা আমাদের জন্য নয়।”
“তা বটে,” জিষ্ণু
গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ে। “ওখানে
থাকতে গেলে শুধু থাকাটাই হবে। খাওয়ার পয়সা আর থাকবে না।”
“এইসব হোটেলের গপ্পো আমি খুব ভালো
জানি,” স্ক্রিন
থেকে চোখ না সরিয়েই জবাব দেয় বিক্রম। “বাইরে যে চা খাবি দশ টাকা কাপ, এখানে
ঢুকলেই সেটা এক লাফে তিনশো টাকা। পোষাবে না রে, ভাই।”
“এটাও বেশ কিন্তু।” জিষ্ণু
আরেকটা ছবির দিকে আঙুল দেখায়। সত্যিই সুন্দর জায়গাটা। প্রচুর গাছপালা, সুইমিং পুলও
দেখা যাচ্ছে।
“বেশ তো বটেই, কিন্তু রেটিং দেখেছ
চাঁদু? ফোর স্টার। আমাদের মতো ব্যাকপ্যাকিং বাইকার দেখলে সিকিউরিটি
গেট থেকেই তাড়িয়ে দেবে। বাজেট হোটেল খোঁজো বন্ধু, বাজেট হোটেল। আরে দাঁড়া দাঁড়া, এটা একবার দ্যাখ তো!” হালকা চালে
কথা বলতে বলতে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠে বিক্রম। তার সামনে স্ক্রিনজোড়া ছবিটায় বড়ো
বড়ো গাছে প্রায় ঢাকা পড়ে যাওয়া একটা পুরনো দিনের সাহেবি বাংলো। কালচে হয়ে আসা লাল
টালির ছাদ ঢেকে ঝাঁপানো বুগেনভিলিয়া। সামনে ছড়ানো একটু অগোছালো লন। পেছনে আবছা
নদী দেখা যাচ্ছে। “বিউটিফুল,
না!”
“একটু পুরনো মতন লাগছে না? কীরকম ফাঁকা ফাঁকা। খেয়াল করে দ্যাখ, দেওয়ালের রঙটঙ সব চটে গেছে। মালিক
নজর দেয় না মনে হয়। সার্ভিস ভালো হবে না এখানে, আমি শিওর।” জিষ্ণুর
গলায় খুঁতখুঁতে ভাব লুকোনো থাকছিল না। “আরও কয়েকটা খুঁজে-টুজে দেখতে পারিস তো। বেটার কিছু থাকে যদি?”
“বেটার খুঁজতে গেলে পকেট পারমিট করবে
না। তাতে উইক-এন্ডের বাজার। সঙ্গে একদিন এক্সট্রা ছুটি। পিলপিল করে ট্যুরিস্ট আসবে,
ভাইয়া। তাদের পকেট আমাদের তুলনায় হাজারগুণ গরম। ফটাফট কড়ি ফেলবে আর টপাটপ ভালো
ভালো হোটেলের ভালো ভালো রুমে সেট হয়ে যাবে।”
“কিন্তু এই জুন মাসে
করবেট পার্ক তো এখন বন্ধ। আবার সেই অক্টোবরে খুলবে। এখনও এত ট্যুরিস্ট হবে বলছিস?” জিষ্ণু অবাকই হচ্ছিল বিক্রমের কথা শুনে।
“আরে, সব গেট বন্ধ না।
ঝির্না গেট সারাবছর খোলা থাকে। কোর এরিয়ায় নিয়ে যায় না ঠিকই, কিন্তু ট্যুরিস্ট
নিয়ে পঁচিশটা গাড়ি রোজ জঙ্গলে ঢোকে। আর তাছাড়া আমাদের মতো পাগল কি কম আছে নাকি
দুনিয়ায়? অফ সিজন বলে ট্যুরিস্ট কম হবে এমনটি ভেব না, বাছা।” বিক্রম
হাসতে হাসতে বলে। “দেখিই
না এটা কেমন। রেটে পুষিয়ে গেলে মন্দ কী। একরাতের তো মামলা।” বিক্রম
কীবোর্ড ট্যাপ করতে করতে বলে। তারপর কীরকম চমকে গিয়ে আবার ট্যাপ করে। “কী হল বল তো
ব্যাপারটা? এইমাত্র দেখলাম তো। এইখানেই ছিল না ছবিটা?”
“বেশি পিছিয়ে গেছিস মনে হয়,” জিষ্ণু
স্ক্রিনের দিকে না তাকিয়েই জবাব দেয়।
“উঁহু। এখানেই ছিল। পরিষ্কার মনে আছে।
জাস্ট উড়ে গেল।”
“তাহলে বোধহয় পুরো ভর্তি হয়ে গেছে। আর
বুকিং নেবে না। সাইট থেকে সরিয়ে দিয়েছে।”
“যাহ্, সে আবার হয় নাকি? দু’মিনিটের
মধ্যে? কী
যে বলিস তার ঠিক নেই।”
“আচ্ছা বেশ,” জিষ্ণু কাঁধ
ঝাঁকায়, “আমি
কী বলছি শোন। ওসব ওয়েবসাইট-ফাইট ছাড়। এদেশে ওসব চলে না। বরং আমার প্ল্যানটা অনেক
বেটার। একদম ভোর ভোর দিল্লি থেকে বাইক নিয়ে স্টার্ট করবি, বুকিং-টুকিং ছাড়াই।
সোজা ধিকুলি।
কতক্ষণ লাগবে, ঘণ্টা পাঁচেক? না হয় ধর ছ’ঘন্টাই হল, রাস্তায়
ব্রেকফাস্ট-টেকফাস্ট করে। তাও দেখবি বারোটা সাড়ে বারোটার
মধ্যে পৌঁছেই যাব। ধিকুলি থেকে করবেট পার্কের গেটের মধ্যে যে জায়গাটা পছন্দ হবে,
ঢুকে জিজ্ঞেস করব। ঠিক আছে? দরে পোষালে, ওখানেই নাইট হল্ট। ওকে? পরের দিন ওখান থেকে রানিখেত, ইচ্ছে হলে আলমোড়া। ডিল?”
বিক্রম হাই ফাইভ করার জন্য
ডানহাতটা তোলে। “ডিল। নেহাতই কিছু
না জুটলে আশেপাশের গ্রামের কাউকে ধরে-টরে রাত্তিরটা ওদের কারও কুঁড়েঘরেই থেকে
যাব, কী বলিস?”
ভোর সাড়ে চারটের সময় চেনা দিল্লির
আকাশকেও অন্যরকম লাগে। রাস্তাগুলোকেও। পাতলা সরের মতো আলোমাখা আকাশের নিচে ন্যাশনাল
হাইওয়ে নাইন ধরে বিক্রমের বাইক হু হু করে উড়ে যাচ্ছিল।
ওরা ধিকুলিতে ঢুকল বেলা সাড়ে
এগারোটা নাগাদ। কাশীপুরের কিছু আগে একটা অ্যাক্সিডেন্টের জন্য প্রায় চল্লিশ মিনিট
দেরি না হলে আরও আগেই পৌঁছে যেত হয়তো। যে উৎসাহ নিয়ে বেরিয়েছিল সেটা অবশ্য এতক্ষণে
কিছুটা কমে এসেছিল ওদের। রাস্তার ডানদিকে কোশি নদীর ধার ঘেঁষে পরপর অনেকগুলো
রিসর্টই রয়েছে, কিন্তু কোনওটাই ওদের পকেটের মাপের নয়। তবুও বিক্রম প্রত্যেকটার
রিসেপশনে ঢুকে ঢুকে জিজ্ঞাসা করছিল, যদি অফ সিজন বলে কিছু ছাড়-টাড় পাওয়া যায়।
ছাড় ছিলও কয়েকটাতে। কিন্তু ছাড়ের পরে যে অঙ্কটা থাকছিল সেও ওদের সাধ্যের বাইরে।
“কী রে, শেষপর্যন্ত গ্রামেই যেতে হবে নাকি?” জিষ্ণু
হেলমেটের তলা দিয়ে আঙুল চালিয়ে মাথা চুলকোয়।
“দাঁড়া না। কিছু না
কিছু ঠিক জুটে যাবে।”
বিক্রমের মনোবল এখনও অটুট। “এখানে কি শুধু বড়লোকরাই বেড়াতে
আসে নাকি?”
“কিন্তু এই গরিবের যে
পেটে ছুঁচোর পল্টন প্যারেড করছে!”
বিক্রম উত্তরে কী একটা বলতে
গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল। “ওটা কী দ্যাখ তো?”
“কোনটা?”
“আরে, ওই যে একটা
সাইনবোর্ড মতন। দেখতে পাচ্ছিস না?” বিক্রম রাস্তার ধার ঘেঁষে
বাইক থামায়।
ততক্ষণে জিষ্ণুও দেখতে পেয়েছে
বোর্ডটা। রাস্তার পাশেই একটা মোটা শালের খুঁটিতে আটকানো সাদা রঙ করা কাঠের চৌকো
বোর্ড। তাতে কালো দিয়ে একটা তিরচিহ্ন আঁকা। তিরের মুখ বাঁদিকে। তার তলায় পুরনো
স্টাইলের রোমান হরফে বড়ো বড়ো করে লেখা, কুপার্স লজ। গুড ফুড, কমফর্টেবল
অ্যাকোমোডেশন।
“কী রে? দেখবি নাকি একবার ট্রাই মেরে? ভালো খাবার, আরামের
আস্তানা?” বিক্রম বাইকে স্টার্ট দিতে দিতে জিষ্ণুর দিকে
তাকায়।
“চল। এতগুলো যখন
দেখলাম, এটাও না হয় দেখেই নিই একবার।” জিষ্ণু লাফিয়ে বিক্রমের পেছনে চড়ে বসে আবার।
একটু এগিয়েই একটা সরু গলিমতো
পাওয়া গেল বাঁদিকে, বড়ো রাস্তা ছেড়ে এঁকেবেঁকে নেমে গেছে। বাইক ঘুরিয়ে গলিতে
নামার সঙ্গে সঙ্গে হাইওয়ে ধরে ছুটে চলা গাড়ির একটানা গর্জন, মাঝবেলার ঝাঁঝালো গরম
যেন নিমেষে শূন্যে মিলিয়ে গেল। অদ্ভুত শান্ত নৈঃশব্দ্য ওদের ঘিরে ফেলেছিল। শুধু বিক্রমের
বাইকের শব্দ ছাড়া আর কোনও আওয়াজই নেই কোথাও।
একটু এবড়োখেবড়ো পাথুরে
রাস্তা, কিন্তু দু’ধারে বিশাল বিশাল গাছ ছায়া করে রেখেছে একেবারে। দেখলেই বোঝা যায়
গাছগুলোর বয়স অনেক। ঠান্ডা সবজেটে সুড়ঙ্গটার ভেতর দিয়ে সাবধানে, সামান্য লাফাতে
লাফাতে চলছিল বিক্রমের বাইক। প্রায় মিনিট তিনেক চলার পর একটা কাঠের গেটের সামনে
এসে ঝপ করে রাস্তাটা ফুরিয়ে গেল। গেটের পাশেই পাঁচিলে গাঁথা পাথরের ফলকে বড়ো বড়ো
করে লেখা, কুপার্স লজ।
গেটটা অবশ্য খোলাই ছিল। নুড়ি
ফেলা রাস্তা ধরে ওরা ভেতরে ঢুকে এল। আলোছায়ার জাফরিকাটা লনের ওপারে ঢালু ছাদের
বাংলো প্যাটার্নের হাত-পা ছড়ানো বাড়িখানা দুপুরের রোদে ঝলমল করছিল।
“আরে! এটাই সেই
রিসর্টটা না? ওই যে, ওয়েবসাইটে দেখেছিলাম? যেটা উড়ে গেল?” বিক্রমের বিস্ময় ছিটকে বেরোয়।
“তা জানি না। তবে
জায়গাটা সত্যি দারুণ। এবার গরিবের কপাল কী বলে দেখা যাক।” জিষ্ণু
পেতলের গুল বসানো প্রাচীন চেহারার কাঠের দরজাটার দিকে যেতে যেতে হাসে। “কথা বলতে তো ক্ষতি নেই।”
আমলকি গাছের ঝিরঝিরে ছায়ায়
বাইক দাঁড় করিয়ে ওরা দু’জন এগোয়। মধ্য-জুনের দুপুরের বাতাস যেন ভেজা কম্বলের মতো ভারী। গলিটার
মতোই এখানেও চারদিক অদ্ভুত চুপচাপ।
দরজাটা জিষ্ণুর আঙুলের আলতো
ছোঁয়াতেই নিঃশব্দে মসৃণভাবে খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে কিন্তু ওরা অবাক হয়ে গেল। বাইরে
থেকে বাড়িটাকে দেখতে যেমন স্বাধীনতার আগের যুগের নমুনা মনে হচ্ছিল, ভেতরটা
একেবারেই তার উলটো।
ওরা ভাবছিল সেই আদ্যিকালের
মোটা মোটা ফার্নিচার, গদি বসে যাওয়া সোফা-টোফা দিয়ে সাজানো একটা অন্ধকার ঘর গোছের
কিছু দেখবে। কাচ আর স্টিলের ধারালো আধুনিক আসবাব, সিলিং থেকে ঝরে পড়া লুকোনো
স্পটলাইটের আলো, দেওয়ালজোড়া এলসিডি টিভি - এসব ওরা একেবারেই আশা করেনি।
“নাহ্,” জিষ্ণু হতাশ মাথা নাড়ে। “এখানেও হল না।”
“কেন?”
“দেখতেই তো পাচ্ছিস।
এখানকার রেট আরও চড়া হবে।”
“কিন্তু গেল কোথায় সব? একেবারে শুনশান। কেউ থাকে-টাকে না নাকি?”
বলতে বলতেই বাড়ির ভেতরের
দিকের কাচের দরজা ঠেলে একজন ঢুকে এল। লম্বা রোদে পোড়া পেটানো চেহারা। পরনে একটা
হাতকাটা গেঞ্জি আর জঙ্গলছাপ ট্র্যাক প্যান্ট। বিক্রমদের থেকে বড়োই হবে কিছুটা।
“গুড আফটারনুন, গুড
আফটারনুন। সরি, আমি একদম টের পাইনি আপনারা এসেছেন। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে?”
“না, এই তো। এটা, মানে
হোটেল তো?” বিক্রম সোজা কাজের কথায় আসে।
“ঠিক হোটেল বলা যায়
না।”
এইটুকু শুনেই জিষ্ণু পেছন
ফিরছিল।
ভদ্রলোক হাঁ হাঁ করে উঠলেন। “আরে, ও কী?
কী হল? চললেন কোথায়?”
“আপনি যে বললেন হোটেল
নয়। সরি, দুপুরবেলা এসে বিরক্ত করলাম।”
“আরে, দাঁড়ান। কথাটা
শেষ তো করতে দিন। ওহো, আমার পরিচয়টাই তো দেওয়া হয়নি। কর্নেল অরবিন্দ নেগি,
রিটায়ার্ড।” একটা চওড়া পাঞ্জা একে একে ওদের দু’জনের হাতদুটো
ঝাঁকায়। “কুপার্স লজ আমার বাড়ি। কিন্তু একা একা এত বড়ো
বাংলো নিয়ে কী করব বলুন। তাই কিছু ঘর ভাড়া দিই। একরাত থেকে
একবছর, যেমন যে চায়। তবে হ্যাঁ, ভাড়াটে পছন্দসই হলে তবেই।”
জিষ্ণু হাসে এবার। “আমরা কি একরাতের জন্য আপনার পছন্দসই ভাড়াটে হতে পারি?”
কর্নেল নেগি তক্ষুনি উত্তর
দেন না। তীক্ষ্ণ দুটো হালকা বাদামি চোখ খুব ভালো করে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত জিষ্ণু
আর বিক্রমকে খুঁটিয়ে দেখে বেশ কিছুক্ষণ। বিক্রমের অস্বস্তি হচ্ছিল ওভাবে দাঁড়িয়ে
থাকতে। কিছু একটা উলটোপালটা বলে ফেলার আগেই নেগির ঠোঁট নড়ল।
“পারেন।”
“কিন্তু, আপনার রেটটা?”
কর্নেল নেগি যে ভাড়াটা বললেন
সেটা শুনে দু’জনেরই বুক খালি করে স্বস্তির শ্বাস পড়ল।
“আসুন, ভেতরে আসুন।
পেছনের ঘরটায় আমি থাকি। বাকি সব ঘরই আজ খালি। যেটা পছন্দ বেছে নিন। তবে আমি
সাজেস্ট করব ওই কোণের ঘরটা। কোশি নদী একেবারে পাশ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে প্রায়।
আনপ্যারালেলড ভিউ।”
“ইয়ে, এখানে
খাবারদাবারের ব্যবস্থা, মানে...” জিষ্ণু ইতস্তত করে। “আপনি একা থাকেন বলছিলেন।”
“একা থাকি। তার মানে
কি একাই সব করি? কাজের লোকজন গ্রাম থেকে আসে, কাজ সেরে চলে
যায়। ভয় নেই, খেতে পাবেন। উইদাউট এনি এক্সট্রা চার্জ। লাঞ্চ করবেন তো?” ওদের উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলতে থাকেন নেগি, “তবে
হ্যাঁ, এবেলা হয়তো একটু কষ্ট হবে। আপনারা আসবেন জানা ছিল না তো। সেভাবে রান্না
কিছু হয়নি। রাজমা-চাওল চলে?”
“দৌড়য়।” জিষ্ণু একমুহূর্ত সময় নেয় না জবাব দিতে।
শুধু রাজমা-চাওল নয়, তার
সঙ্গে অতীব সুস্বাদু একটা তরকারিও ছিল নানারকম সবজি মেশানো। শেষপাতে সেমাইয়ের
পায়েস। বেশিই খাওয়া হয়ে গেল।
“এখন শুবি নাকি, হ্যাঁ
রে?” জিষ্ণুর আকাশপাতাল হাই তোলা দেখে ঘাবড়ে যাচ্ছিল
বিক্রম।
“হুঁ, একটু গড়াই। যা
খাওয়া হল। তুই গেলে যা, ছবি-টবি তোল গে, যা।”
“তাই যাব। এখন শুলে আর
দেখতে হবে না। নেগি-স্যারকে দেখতে পেলে একটু ধারে-কাছের ভালো স্পট নিয়ে আইডিয়া
পাওয়া যেত।” ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বার করতে করতে বলে বিক্রম।
কর্নেল নেগিকে অবশ্য আশেপাশে
কোথাওই দেখা গেল না। বিক্রমও আর ডাকাডাকির চেষ্টা করেনি। হয়তো বিশ্রাম নিচ্ছেন
ভদ্রলোক। একাই বাংলোর চারদিকে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলে যাচ্ছিল সে। অদ্ভুত নীল আকাশ,
অনেক ওপরে উড়তে থাকা নিঃসঙ্গ চিল, চারদিকের ঝিম ধরা নির্জনতা তাকে আচ্ছন্ন করে
ফেলছিল আস্তে আস্তে। এত ভালো একটা জায়গা পেয়ে যাবে থাকার জন্য এটা তার কল্পনাতেও
ছিল না।
রাতে খাওয়ার টেবিলে নেগি এলেন
আবার। উনিই দরজায় টোকা দিয়ে ডেকেছিলেন খেতে, সাড়ে আটটা নাগাদ। তখন লক্ষ করেনি,
এখন বিক্রমের চোখে পড়ল ভদ্রলোকের কপালে, গালে গভীর কয়েকটা কাটা দাগ। সবথেকে বড়ো
দাগটা বাঁ-কানের তলা দিয়ে নেমে গলা বেয়ে শার্টের কলারের আড়ালে ঢুকে গেছে।
যুদ্ধক্ষত। চোখ সরিয়ে নিতে নিতে মনে মনে ভাবে বিক্রম। প্রচন্ড কৌতূহলকে চেপে নেয়
সে। প্রথম পরিচয়েই কাউকে এসব জিজ্ঞাসা করা অভদ্রতা।
এবেলা মুরগি হয়েছে। দুর্ধর্ষ
স্বাদ। জিষ্ণু কোনওদিকে না তাকিয়ে মন দিয়ে খেয়ে যাচ্ছিল। নেগির কথায় মুখ তুলে
তাকাল।
“আপনারা কি ন্যাশনাল
পার্কে ঢুকবেন কাল? তাহলে কিন্তু পারমিট করাতে হবে রামনগর
থেকে।”
“না। এই মুহূর্তে
জঙ্গল দেখার খুব একটা ইচ্ছে নেই। আমরা আসলে জাস্ট একটা রোড ট্রিপে বেরিয়েছি।
সেভাবে ঠিক বাঘ-টাঘ দেখতে নয়।” বিক্রম জবাব দেয়।
“ওকে দেন। কখন বেরোবেন
তাহলে?”
“যতটা সকাল সকাল পারা
যায়।”
“গুড। আমিও আর্লি
রাইজার। তবে কাল আমারও একটু বেরোনো আছে। এক কাজ করবেন। যদি আমি না থাকি, রুমের চাবিটা
লাউঞ্জেই রেখে দেবেন বরং।”
“আর আপনার বিলটা? এখনই ক্লিয়ার করে দিই তাহলে?” বিক্রম চেয়ার ছেড়ে
উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে।
“আরে, না না। চাবির
সঙ্গেই রেখে দেবেন। কেউ নেবে না।” নেগি হাত নাড়েন। বিক্রমের
আবার চোখে পড়ে, চওড়া কবজি ঘিরে শুকনো বাদামি কাটা দাগ। “ওকে
দেন, জেন্টলমেন, এনজয় ইয়োরসেলভস। গুড নাইট।”
“আপনি খেলেন না?” জিষ্ণু ভদ্রতা করে।
“আমার খাওয়া হয়ে গেছে,
থ্যাঙ্কস।
আসলে অনেকদিনের অভ্যেস, সন্ধে-সন্ধেয় খেয়ে নিই। একটু সুপ-টুপ হলেই হয়ে যায়
আমার, বেশি লাগে না। ইউ পিপল ক্যারি অন।” মাথাটা অল্প ঝুঁকিয়ে
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন কর্নেল নেগি।
উঠতে উঠতে একটু বেলাই হয়ে
গিয়েছিল। বেরোতে বেরোতে সেই সাতটা বাজল। কর্নেল নেগিকে কোথাওই দেখা গেল না। কাজের
লোক-টোকও কেউ এসে পৌঁছয়নি।
“কী আর করা। উনি যেমন
বললেন অমনিই করি তাহলে? টাকা আর চাবি এই টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে যাই?”
“আর তো কোনও উপায়
দেখছি না। কে কখন আসবে তাও জানি না। অপেক্ষা করতে গেলে বেলা গড়িয়ে দুপুর হবে তো।”
বিক্রম চকচকে পালিশ করা
টেবিলে একরাতের ভাড়াটা রাখে। পাঁচশো টাকার চারটে নোট। কী ভেবে আরও একটা পাঁচশো
টাকার নোটও রেখে দেয়। এত ভালো সার্ভিসের জন্য কৃতজ্ঞতা। চকচকে পেতলের চাবিটা
দিয়ে চাপা দিয়ে দেয় টাকাগুলো। ভালোই হয়েছে কর্নেল নেগি নেই। থাকলে হয়তো বাড়তি
টাকাটা দিতে দিতেন না।
“রইল তাহলে। চল,
বেরিয়ে পড়ি।”
রানিখেত পৌঁছতে মোটামুটি
ঘণ্টা তিনেক লাগল ওদের। ছবির মতো সুন্দর ছোট্ট পাহাড়ি শহর। বিক্রম সাধ মিটিয়ে ছবি
তুলছিল। সাধারণ ট্যুরিস্ট স্পটে যাওয়ার ঝোঁক ছিল না ওদের দু’জনের একজনেরও।
এ-রাস্তা ও-রাস্তায় শুধু উদ্দেশ্যহীন ঘোরা, আর ছবি তোলা। এখান থেকে আবার কৌশানি
যাওয়ার প্ল্যান।
জিষ্ণুকে সকাল থেকেই একটু
আনমনা দেখছিল বিক্রম। দুপুরে সর্দারজির ধাবায় বসে খেতে খেতে প্রশ্নটা করেই ফেলল
তাই। “কী হয়েছে রে তোর? শরীর খারাপ লাগছে?”
জিষ্ণু একবার তাকিয়েই চোখ
সরিয়ে নিল। “কৌশানি না গেলে তুই কি খুব রাগ করবি?”
“মানে? সেই প্ল্যানই তো ছিল।” মুখে গ্রাস তুলতে গিয়ে থেমে
যায় বিক্রম।
“না আসলে, ওই কুপার্স
লজটা বড্ড ভালো ছিল কিন্তু, বল। স্পেশালি রান্নাটা।”
“কী বলতে চাইছিস ঠিক
করে বল তো দেখি, পেটুকরাম।”
জিষ্ণু লজ্জা পেয়ে হাসে।
“আসলে, ভাবছিলাম, আজ
রাতটাও ওখানেই কাটিয়ে কাল ওখান থেকেই দিল্লির জন্য রওনা দিলে হত না? আবার কৌশানি-টৌশানি কী দরকার? গায়ে অলরেডি ব্যথা হয়ে গেছে তো।”
“মন্দ বলিসনি কিন্তু।
খুব রেস্টফুল, নেগি-স্যারের বাংলোটা। এত ভালো ঘুম কবে লাস্ট ঘুমিয়েছি মনেই নেই।
ঠিক হ্যায়, কৌশানি রইল পরের বারের জন্য।”
সাইনবোর্ডটা কিছুতেই খুঁজে
পাচ্ছিল না ওরা।
“এইরকম জায়গাতেই তো
ছিল!” জিষ্ণু একটু বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিল।
“উলটোদিকে দেখছিস কেন,
রাস্তার ওধারে? ওপর থেকে নামছি না?” হাওয়া বিক্রমের কথা
উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
“আরে, ওধারেই তো
দেখছি। নেই, দ্যাখ।”
“বেশি নিচে চলে এসেছি
বোধহয়। খেয়াল করিনি, পেছনে রয়ে গেছে হয়তো। দাঁড়া, ওই চায়ের দোকানটাতে জিজ্ঞেস
করি।”
কর্নেল নেগির নাম বলাতে প্রৌঢ়
দোকানদার সহ উপস্থিত বাকি খদ্দেররাও চুক চুক শব্দ করে মাথা নাড়ল। “জরুর চিনতাম সাব। বড়ো ভালো লোক ছিলেন।”
“ছিলেন? ছিলেন মানে?” বিক্রম অবাক হয়ে তাকায়।
“নেগি-সাব আমাদের
দেশেরই লোক ছিলেন তো। গাঢ়ওয়ালি রাজপুত। অকেলা আদমি, শাদি-টাদি করেননি। ফৌজ থেকে রিটায়ার
করে ওই কুপার-সাহেবের পুরনো বাংলোটা কিনে অনেক খরচা করে সাজিয়েছিলেন। কে জানত, ওই
বাংলোতেই একদিন অমনভাবে শেষ হতে হবে। মিলটারিতে অত জঙ্গ লড়ে যার কিছু হল না, তার
হল কিনা নিজের গাঁওয়ে ফিরে।” চা ঢালতে ঢালতে দুঃখিত মাথা
ঝাঁকায় দোকানি।
“কী বলছ ভাই, আমরা তো
কিচ্ছু বুঝতে পারছি না!”
“হাঁ, সাব। আমরাও
বুঝিনি। রুম ভাড়া দিতেন তো। অনেক দেখেশুনেই দিতেন। তাও তো চুক হয়ে যায় বাবুজি, হয়
না, বলুন?”
ওদের হতবুদ্ধি চোখের সামনে
দোকানের বাকি খদ্দেররা ঘন ঘন মাথা নাড়ে ওপর নিচে। “সচ বাত। চুক
হয়ে যায়।”
“তিনটে ঘর ভাড়া
দিয়েছিলেন নেগি-সাব। তিনটে ছেলে এসেছিল। মনে অন্য ধান্দা ছিল ওদের। কর্নেল-সাব
জানতেন না। এত বড়ো বাংলো, ওরা ভেবেছিল অনেক টাকাপয়সা আছে। লুটতে এসেছিল ওরা। রাতে
নিজের ঘরে ঘুমিয়েছিলেন সাহেব। দোর খোলাই ছিল, কিছু সন্দেহ তো
করেননি। ওরা বিছানাতেই কুপিয়ে কুপিয়ে শেষ করে দিয়েছিল লোকটাকে।”
“কী, বলছ কী? আমরা তো...” জিষ্ণুর হাতে চাপ দিয়ে থামিয়ে দেয়
বিক্রম।
“ধরা পড়েনি কেউ?”
“তখন পড়েনি। অন্য
একটা ডাকাইতির কেসে গিরফতার হয়েছিল পুরা গ্যাং। তখন বলেছিল।
ওই তো আগে ডানদিকে গলি। কেউ যায় না আর কুপার-সাহেবের বাংলোতে। খন্ডহর হয়ে পড়ে
আছে।”
“কিন্তু, আমরা যে...” আবার জিষ্ণুকে থামায় বিক্রম।
“কবেকার কথা বলো তো
ভাই এসব?”
“এটা অংরেজির কী মাস,
বাবু? জুন তো? পাঁচ সাল পহলে এইসি এক
জুন মাহিনাতেই হয়েছিল এই কান্ড। জুনের চৌবিস কি পচ্চিস তারিখ।” চাওয়ালা আঙুলে হিসেব করে বলে।
“আজ ছাব্বিশে জুন।” জিষ্ণু খুব আস্তে বলে।
বিক্রম আর কোনও কথা বলে না।
নিঃশব্দে দু’কাপ চায়ের দাম চুকিয়ে বাইকে চড়ে বসে।
হ্যাঁ। এই গলিটাই। কিন্তু
গতকালের সেই সবুজ সুড়ঙ্গ কোথায় গেল? হাইওয়েতে ছুটে চলা
গাড়ির অবিশ্রাম শব্দ সমানে ধাক্কা মারছিল কানে। ভাঙাচোরা গর্তে ভরা রাস্তা। খুব কষ্ট
করে চালাতে হচ্ছিল বাইক। দু’ধারের গাছগুলোর বেশিরভাগই মরা। যেগুলো
বেঁচে আছে সেগুলোরও অবস্থা ভালো নয়। প্রবল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে রাস্তার শেষে পৌঁছে ওরা
দেখল একটা ভাঙা গেট, যার একদিকের পাল্লা কবজা থেকে ভেঙে ঝুলছে। পাথরের ফলকে লেখা
নামের রঙ অনেকটা মুছে এলেও এখনও পড়া যাচ্ছে অবশ্য।
“আমি তো কিচ্ছু বুঝতে
পারছি না। এসব কী? কী ব্যাপার এগুলো?”
জিষ্ণুর গলা থরথর করে কাঁপছিল।
বিক্রম কোনও উত্তর দেয় না। শ্যাওলামাখা
নুড়িবিছানো আগাছাঢাকা পথ মাড়িয়ে সে তখন যাচ্ছিল পালিশহীন কাঠের দরজাটার দিকে।
তার চোয়াল শক্ত, কপালে ভাঁজ। অনেক কিছুই চোখে পড়ছিল তার। দরজার গায়ে বসানো পেতলের
গুলগুলো, অযত্নে কালচে। ছাদের টালি খসে গেছে অনেক জায়গায়। বুগেনভিলিয়ার শুকনো কঙ্কাল ঝুলছে ভাঙা টালির
ওপর।
“কোথায় যাচ্ছিস,
বিক্রম? কী পাগলামি করছিস! ঢুকিস না ভেতরে।” জিষ্ণু আবারও
আতঙ্কিত চিৎকার করে ওঠে।
বিক্রম কিচ্ছু শুনছিল না।
দরজাটা একটু ঠেলতে হল, কিন্তু খুলল। শব্দ হল ক্যাঁচক্যাঁচ, মেঝেতে ঘষটে গেল ঝুলে
পড়া পাল্লা, তবুও খুলল।
জিষ্ণু পেছন পেছন এসেছিল
বিক্রমের। বিস্ফারিত চোখে চারদিক দেখছিল সে। ঝুলে ভর্তি দেওয়াল, একটা ছেঁড়া সোফা
আর একটা পা ভাঙা টেবিল ছাড়া আর কোনও আসবাব নেই কোত্থাও। একটা দমবন্ধ স্যাঁতসেঁতে
গন্ধ ভেতরে।
টেবিলটার সামনে পাথরের
মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিক্রম।
“বিক্রম?” জিষ্ণু খুব সাবধানে কাঁধে হাত রাখে।
আস্তে, খুব আস্তে পেছনে ফেরে
বিক্রম। “আমরা এসেছিলাম। এসেছিলাম আমরা।”
“মানে?”
হালকা কাঁপতে থাকা ডানহাতটা
জিষ্ণুর চোখের সামনে তুলে ধরে বিক্রম।
বিক্রমের হাতে একটা কালচে ছোপ
ধরা পেতলের চাবি, আর ধুলোয় মলিন হয়ে যাওয়া পাঁচটা পাঁচশো টাকার নোট।
_____
অলঙ্করণঃ সুমিত রায়
ভূতের গল্প ঠিক এমনটাই হওয়া উচিৎ, একটু গা-ছমছম, একটু মায়া, আর অনেকটা ভালো-লাগা।
ReplyDeleteঅদ্ভুত ভালো লাগল।
ReplyDeleteকষ্টজড়ানো,রেশ রয়ে যাওয়া ভাল লাগা...
ReplyDeleteঅনেক মায়া জড়ানো লেখা
ReplyDeleteখুব সুন্দর গল্প
ReplyDelete