রাতের
আঁধারে গোরস্থানে
নীল
শুষ্টারম্যান ও টেরি ব্ল্যাক
অনুবাদঃ
অনন্যা দাশ
“বোকার মতন কথা বলিস না তো!”
রুডি খেঁকিয়ে উঠল, “মরে যাওয়া লোকেরা তোর কী ক্ষতি করতে পারবে শুনি?”
মার্ক ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল।
হ্যাঁ, দিনের আলোয় সেই সব কথা বলা যায়, বা বিশ্বাসও করা যায় ঠিকই কিন্তু এখন
জ্যোৎস্নার ভয়াবহ আবছা আলোআঁধারিতে পারপেচুয়াল রেস্ট গোরস্থানে মরচে পড়া গেটগুলোকে
দেখেই কেমন যেন ভয় লাগছিল ওর। পুরো
ব্যাপারটাকেই পাগলামি বলে মনে হচ্ছিল।
“আমার মনে হয় আমাদের বাড়ি
ফিরে যাওয়া উচিত,” মার্ক পিছিয়ে যেতে যেতে আমতা আমতা করে বলল।
রুডি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে
হেসে দুহাত দিয়ে মরচে পড়া রডগুলোকে ধরে গেটের ওপর উঠতে শুরু করল তরতর করে। হাতের
ওপর হাত আর তারপরই লাফিয়ে ওপাশে নেমে পড়ল। বিড়ালের মতন ক্ষিপ্র পায়ে সোজা হয়ে
নামল, তারপর বলল, “দে, এবার বেলচাটা আমাকে দে!”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও গেটের শিকের
ফাঁক দিয়ে দাদা রুডিকে বেলচাটা এগিয়ে দিল মার্ক। রুডি ওর চেয়ে বয়সে চার বছরের বড়,
আর অভিজ্ঞতায় অনেকটা বেশি। ফল কী হবে না ভেবেই উলটো পালটা কাজ করার নেশা তার।
হ্যাঁ, সেই পথে কখনও কখনও মজা হয় বটে কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই বুকের ভিতর দুরুদুরু,
ঠিক যেমনটা এখন হচ্ছে। মার্ক হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে এবার, ওর দাদাকে কেন বারবার
অনেকটা করে সময় জুভেনাইল ডিটেনশান ফেসিলিটিতে কাটাতে হয়, বন্ধ ঘরে কমলা রঙের পোশাক
পরে।
“এটাকে কিন্তু আইনত চুরি বলা
যায় না,” রুডি বলল, “কারণ যারা মারা গেছে তাদের কাছ থেকে চুরি কী করে করা যাবে?
সেটাই সত্যি!”
মার্কের অবশ্য এই নৈশ অভিযানে
যোগ দেওয়ার একমাত্র কারণ এক জোড়া জুতো। সে এই রাতের বেলায় গোরস্থানে ঢুকে বড়লোকদের
কবর খুঁড়ে দামি জিনিস চুরি করতে এসেছে স্রেফ এক জোড়া স্পোর্টস কোয়েস্টের জুতোর
জন্যে। ওই জুতোগুলোই নাকি পৃথিবীর সেরা জুতো। সব
ভাল খেলোয়াড়রাই ওই জুতো পরে। ওরা বিজ্ঞাপন দেয় স্পোর্টস কোয়েস্টের জুতো পরলে যে
কেউ সেরা খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পারে! আরো বলে, চাঁদকে পায়ে নিয়ে ফুটবল খেলতে পারো যদি
তোমার পায়ে থাকে স্পোর্টস কোয়েস্টের জুতো। এখন পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে
মার্কের মনে হল কথাটা সত্যি।
মার্ক অবশ্য অত বোকা নয় যে সে
ভেবে বসবে একজোড়া জুতো তাকে সেরা খেলোয়াড় করে দেবে, কিন্তু ওর নিজের পায়ের ছেঁড়া
জুতোটার চেয়ে তো ভাল হবে! মা বলেন নতুন জুতো কিনে দেবেন কিন্তু এখনও তো কিনে দিতে
পারেননি। এই ছেঁড়া জুতো পরে কী ভাবে স্কুলের টিমে ঢুকবে মার্ক?
এমনিতেই সবাই হাসাহাসি করে ওর জুতো দেখে। লজ্জায় ওর কান লাল হয়ে যায়। তাই এখন
ওর সামনে একটাই উপায়, নিজের জুতো কেনার ব্যবস্থা নিজেই করা। ওই স্পোর্টস কোয়েস্টের
জুতোগুলোর দাম ২০০ ডলার থেকে শুরু, তাই মার্কের কাছে ওই জুতো কেনা চাঁদকে পায়ে
নিয়ে ফুটবল খেলার মতনই অসম্ভব!
আইডিয়াটা রুডির মাথা থেকেই বেরোল,
সে বলল, “বড়লোকরা না খুব লোভি হয়। তারা নিজের কবরে সব কিছু নিয়ে শুয়ে থাকে। যেন সব
সঙ্গে করে নিয়ে যাবে! কানের দুল, ব্রেসলেট, হিরের হার – যা চাস তাই পাবি। আমি
একজনের কথা শুনেছি যাকে তার ফেরারি গাড়িটাতে করে
কবর দেওয়া হয়েছিল!”
“এই প্ল্যানে এতটুকু ফাঁক
নেই!” রুডি আবার ওকে সাহস দেওয়ার জন্যে বলেছিল।
এমন গয়নাগাটি খুঁড়ে বার করা
যেগুলো চুরির কথা কেউ জানতেও পারবে না! মার্কের কাজ শুধু টর্চ ধরা আর পাহারাদার
চলে আসছে কিনা সেই দিকে নজর রাখা। ছ’মাস ধরে কারো বাগানের ঘাস কেটে টাকা রোজগারের
চেয়ে তো অনেক সহজ। অন্তত এখানে আসার আগে মার্ক তাই ভেবেছিল।
“চল রে, হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলি
কেন?” রুডি গেটের ওপাশ থেকে বলল। মার্ক লোহার উঁচু গেটটার দিকে তাকিয়ে দেখল। পারপেচুয়াল
রেস্টের আরের ডান্ডিটা ভেঙ্গে গিয়ে পারপেচুয়াল পেস্ট হয়ে গেছে নামটা।
মার্ক টর্চটা গেটের ফাঁক দিয়ে
রুডির হাতে দিতে দিতে বলল, “তুই ভিতরে যা, আমি এখান থেকে দেখছি!”
“ওরে ভিতুর ডিম, জুতোর কথা
তাহলে ভুলে যা!” রুডি এমন চিৎকার করে বলল যে মৃতরা জেগে উঠবে বলে মনে হল!
“না আসলে আসবি না, জুতোও
কিন্তু পাবি না!” বলে খ্যাক খ্যাক করে হাসল রুডি, “জীবনে কিছু করতে গেলে একটু শক্ত
হতে হয় রে ভাই! নে গেটটা টপকা। দেখা যাক কতটা শক্ত হয়েছিস তুই!”
হ্যাঁচড় প্যাঁচড় করে মার্ক
গেটের ওপরে উঠতে লাগল। ছেঁড়া জুতো পরে মরচে পড়া লোহার শিকগুলো বেয়ে উঠতে পায়ে বেশ
লাগছিল।
“তাড়াতাড়ি কর!” রুডি খেঁকিয়ে
উঠল।
রুডি যেন সব কিছুই কত সহজে
করে ফেলে। মার্ক অবশ্য একবার ভাবল দাদার সঙ্গে থেকে থেকে ওকেও জুভেনাইল ডিটেনশানে
যেতে হবে না তো? গোরস্থানে চুরির জন্যে যদি ওদের পুলিশ ধরে?
“উফফ এত সময় নিলি!” মার্ক
গেটটা ডিঙ্গিয়ে ওপাশে নামতে রুডি বলল, “এই নে, বেলচাটা ধর। আমি আগে কবরটা খুঁজে
বার করি।”
“তুই জানিস কার কবর?”
“হ্যাঁ, রে বাপু! আমি রিসার্চ
করেই এসেছি,” রুডি জানাল, ভাবখানা এমন যেন স্কুলের প্রোজেক্ট করেছে!
রুডি হনহন করে এগিয়ে গেল।
কুয়াশা যেন জাপটে ধরল ওকে, যেন এক ভূতুড়ে সমুদ্রে ডুবে গেল সে। মার্ক দীর্ঘশ্বাস
ফেলে অনিচ্ছার সঙ্গে ওর পিছু নিল। যেতে মোটেই ইচ্ছে নেই কিন্তু একলা থাকতেও চায় না
সে!
সামনে রুডির টর্চের আলো এদিক
সেদিক গিয়ে গিয়ে পড়ছে, তাতে শ্বেতপাথরের ফলক, শুকিয়ে যাওয়া ফুলের তোড়া এক এক ঝলক
করে দেখা যাচ্ছে। প্রতিটা পদক্ষেপে অন্ধকার ছায়ারা নাচছে – অন্ধকারে ছুটে যাওয়া
জন্তুর মতন। সদ্য খোঁড়া মাটির গন্ধ চারিদিকে।
মার্ক তাল রাখতে না পেরে একবার
বলে উঠল, “রুডি দাঁড়া!”
কিন্তু রুডির কানে যেন কিছুই
যাচ্ছিল না।
তারপর হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে সে
বলল, “এসে গেছি!”
একটা বিশাল শ্বেতপাথরের তৈরি
মূর্তি দিয়ে সাজানো সমাধির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা। এক ভয়ঙ্কর ক্রুর দেখতে মহিলা
সিংহাসনে বসে রয়েছেন – দাঁতগুলো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে আর বাঁকানো আঙ্গুলগুলো থাবার
মতন!
সমাধির সামনের ফলকে খোদাই করা রয়েছে :
ম্যাডাম ভোরাসিয়া থর্নহিল
(১৮৯৮-১৯৬২)
‘গতকালটা আমার ছিল, আগামীকাল কী হবে তাও
আমি জানি’
ইজিপসিয়ান বুক অফ দা ডেড
“কী ভয়ানক!” মার্ক বলল।
“হ্যাঁ, ভয়ানকই বটে, ভয়ানক
বড়লোক!” রুডি বলল, “চারবার বিয়ে করেছেন মহিলা – সব স্বামীগুলোই টাকার কুমির আর
রহস্যজনক ভাবে মারা যায়! জন থর্নহিল, ওনার চতুর্থ বরের ভাই হলফ করে বলেছিল যে
মহিলা নাকি খুনি। সেই একদিন থর্নহিল প্রাসাদে ঢুকে ভোরাসিয়াকে খুন করে।”
এর পর রুডি গলা নামিয়ে বলল,
“তারপর থেকে জনকে পাগলা গারদে রাখা হয় কারণ সে নাকি ক্রমাগত বলছিল যে ভোরাসিয়া
নাকি মানুষ নয় – ভয়ঙ্কর অন্যরকম একটা কিছু!”
“তোর কী মনে হয়?” মার্কের গলা
কাঁপছিল, “সেটা সত্যি?”
“দূর দূর, লোকটার তো মাথা
খারাপ হয়ে গেছে!” রুডি হেসে বলল, “নে এবার টর্চটা ঠিক করে ধর!” বলে সে ভোরাসিয়ার কবরটা
খুঁড়তে শুরু করল।
###
দু ঘন্টারও বেশি সময় লাগল
রুডির।
ততক্ষণে সে হাঁপিয়ে, ঘেমে
নেয়ে একসা। মার্ক সাহায্য করার চেষ্টা করছিল, রুডি কেবল বলছিল, “ধুস, তোর দ্বারা কিসসু
হবে না, অত সময় নিলে চলে?”
ঘাম ঝরছিল দরদর করে এই
ঠান্ডাতেও, গলা ভেঙ্গে গিয়েছিল কিন্তু তাও রুডি থামল না, খুঁড়েই চলল।
“তোর জুতো তুই পেয়ে যাবি,”
রুডি খুঁড়তে খুঁড়তে বলল, “আর আমি এখান থেকে চিরকালের মতন ভ্যানিশ হয়ে যাওয়ার মত
অর্থ!”
“কোথায় যাবি তুই?”
কিন্তু রুডি বলল না সে কোথায়
যাবে।
তারপর যখন মনে হচ্ছিল রুডি
হাল ছেড়ে দেবে তখন টং করে একটা শব্দ হল। কিসের সঙ্গে
জানি ধাক্কা খেল বেলচাটা। রুডি মাটি সরিয়ে দেখল মেহগনি কাঠের একটা কফিন।
এর পর রুডি পাগলের মতন মাটি
সরাতে লাগল। আর দশ মিনিটের মধ্যেই কফিনের ঢাকা খোলার মতন মাটি সরিয়ে ফেলল।
গর্তে নেমে রুডি বাক্সের
ঢাকনাটা দু হাত দিয়ে ধরে বলল, “খুলছি এবার, তুই রেডি তো?”
মার্ক বলল, “জানি না, আমার
ব্যাপারটা ঠিক ভাল লাগছে না রে!”
“বড্ড দেরি হয়ে গেছে!” বলে
রুডি কফিনের ডালাটা খুলে ফেলল।
মার্ক খাবি খেল! ম্যাডাম
থর্নহিলের দেহটা শুকিয়ে মমির মতন হয়ে গেছে। চোখের জায়গায় গর্ত। জামাকাপড় ঝুরঝুরে।
কিন্তু সেটাই সব নয়। সত্যি ম্যাডাম থর্নহিলের দেহটাকে দেখে মানুষের দেহ বলে মনে
হচ্ছিল না। হাতগুলো কেমন যেন কব্জি থেকে উলটো দিকে ঘোরানো। আঙ্গুলগুলো বেঁটে বেঁটে
আর নখগুলো ইয়া বড় বড়। যেন কোন পশুর নখ। দাঁতগুলোও যেন কেমন খিঁচিয়ে রয়েছে।
মার্ক ভয়ে ভয়ে বলল, “রুডি চল
রে এখান থেকে পালাই, এখুনি!”
কিন্তু রুডি নখ বা দাঁত কিছুই
দেখছে না, ওর চোখ ম্যাডামের গলার হিরের হারটার দিকে।
“ওগুলো হিরে!” সে উত্তেজিত
হয়ে বলল, “আমি জানতাম!”
মার্কের তখন মনে হচ্ছিল ওর আর
কিছু চাই না, হিরে না, জুতো না, কিছু না। সে ওখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে!
“রুডি!”
“চুপ কর! আমি হারটা খুলছি!”
হারটা খুলতেই সেটা পাঁজরের
গর্তে গলে পড়ে গেল। মার্ক কেঁপে উঠল।
“উফফ কী গেরো!” বলে রুডি
পাঁজরের গর্তে হাত ঢুকিয়ে হারটাকে খুঁজতে লাগল। পেয়েও গেল সেটাকে। হিরেগুলো চাঁদের
আলোয় চকচক করছে।
“নে পেয়েছিস তো, এবার চল!”
“আরে দাঁড়া! আরো চকচকে কী সব
দেখতে পাচ্ছি!” বলে আবার পাঁজরের গর্তে হাত ঢুকিয়ে কী সব বার করে এক ঝলক দেখে নিয়ে
বলল, “আরে এই গুলি দিয়েই মনে হয় ম্যাডামকে মারা হয়েছিল!”
“দে আমাকে দে ওগুলো। নিয়ে
এবার চল,” মার্ক বলল।
রুডি হাত বাড়িয়ে গুলিগুলো
মার্কের হাতে দিল।
যা ভেবেছিল ঠিক তাই! এগুলো যে
সে গুলি নয়!
“রুডি, এগুলো রুপোর গুলি!”
“তাই? তাহলে বিক্রি করে কিছু
পাওয়া যাবে বলছিস?”
রুডি কিছুই বুঝতে পারছিল না,
কিন্তু মার্কের কাছে সব কিছু জলের মতন পরিষ্কার। রুপোর গুলি দিয়ে তো আর মানুষ মারা
হয় না, ওগুলো তো ব্যবহার করা হয় ওয়্যের উলফদের জন্যে।
মার্ক গুলিগুলোকে পকেটে রেখে
বলল, “রুডি এখুনি চল!”
কিন্তু রুডি হিরের হারটা
দেখতেই ব্যস্ত, বলল, “যাক, আমাদের কাজ হয়ে গেছে!”
মার্ক রুডিকে সাবধান করতে
চাইছিল কিন্তু ওর গলা থেকে কোন আওয়াজ বেরল না – কারণ ম্যাডাম থর্নহিলের দেহটা নড়ে
উঠেছে! সত্যি, বড্ড দেরি হয়ে গেছে! যে মুহূর্তে চোখগুলো নড়ে উঠেছিল। হাত পা আড়মোড়া
ভাঙছিল তখন পালাতে পারলে হত, কিন্তু রুডি তখন ভয় আর অবিশ্বাসে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে
রইল – আর তারপর বড্ড দেরি হয়ে গেল।
রুডির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল
জন্তুটা! রুডি পড়ে গেল! মার্ক আর কিছু না দেখেই ছুট দিল। টর্চটা হাত থেকে ছিটকে
গিয়ে গর্তে পড়ে গেল, যেখানে রুডি তার প্রাণের জন্যে লড়াই করতে করতে হেরে গেছে!
রুডি মৃত কিন্তু ম্যাডাম থর্নহিল তখনও ক্ষুধার্ত!
মার্ক শুধু একবারই পিছন ফিরে
তাকিয়েছিল এবং সেই দৃশ্য সে জীবনে ভুলবে না। একশো বছর বয়স হয়ে গেলেও না! ম্যাডাম
থর্নহিল উঠে দাঁড়িয়ে দাঁতগুলো খিঁচিয়ে রাগে চিৎকার করছে – সেই বীভৎস আওয়াজ
প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চারিদিকে! মাথা ঘুরিয়ে মার্কের দিকে তাকাল সে। রুডির জন্যে আর
কিছু করা যাবে না, খুব দেরি হয়ে গেছে কিন্তু সে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা তো করতে
পারে। নেকড়েরা করতে পারে না এমন কিছু করতে হবে তাকে। যেমন ওই দশ ফুট উঁচু লোহার
গেট টপকে গোরস্থান থেকে বেরুতে পারা।
মার্ক যদি গেটটার কাছে পৌঁছে সেটাকে টপকাতে পারে তাহলে ওর বাঁচার একটা সুযোগ
থাকলেও থাকতে পারে! কিন্তু ওয়্যের উলফরা ক্ষিপ্র হয়, তাদের দৌড়ে হারানো বেশ শক্ত। শুধু
মাত্র কোনও খেলোয়াড়ই পারবে সেটা। হ্যাঁ, ফুটবল
খেলোয়াড়!
মার্ক ভাবতে চেষ্টা করল যে সে
মাঠে নেমেছে। বল পায়ে নিয়ে ছুটছে, পিছনে অন্য দলের খেলোয়াড়রা আর সামনে গোলপোস্ট।
ওয়্যের উলফের গরম নিঃশ্বাস যেন ওর ঘাড়ে এসে পড়ছিল – থাবার তীক্ষ্ণ নখ ওর গায়ে ছুঁই
ছুঁই! মার্ক দৌড়তে থাকল, জীবনে কখনও যেমন দৌড়য়নি সেই ভাবে। লোহার গেট ওর সামনে!
মার্ক একটা লাফ দিয়ে গেটের গ্রিলের ওপর গিয়ে পড়ল আর তখুনি পায়ে প্রচন্ড ব্যথা
অনুভব করল। ওর বাঁ পায়ে দাঁত বসিয়েছে নেকড়েটা। না, ব্যথা বা নিজের রক্ত দেখে
দুর্বল হলে চলবে না মার্কের। সে অন্য পাটা দিয়ে জন্তুটার মুখে একটা লাথি চালাল।
লাথি খেয়ে ওর পাটা ছাড়তেই মার্ক পড়ি কি মরি গেটের ওপর চড়তে লাগল। নেকড়েটা আবার লাফ
দিল কিন্তু ততক্ষণে মার্ক বেশ কিছুটা ওপরে উঠে গেছে তাই ওকে ধরতে পারল না। মার্কের
গা গুলোচ্ছিল কিন্তু জোর করে নিজেকে টেনে টেনে উপরে তুলছিল সে শিকগুলোর মধ্যে পা
ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে।
তারপরই ওর পাটা আটকে গেল।
পাটাকে এদিক ওদিক করে ছাড়াতে
চেষ্টা করল মার্ক কিন্তু পারল না। ওর সস্তা ছেঁড়া জুতোটা একটা শিকের গায়ে আটকে
গিয়েছিল। মরিয়া হয়ে মার্ক গেটের ওপরের একটা অংশ ধরে নিজেকে টেনে তুলতে চাইল কিন্তু
ওর দুর্ভাগ্য মরচে পড়া শিকটা ভেঙ্গে গেল। পড়ে গেল মার্ক। নেকড়েটার একেবারে পায়ের
কাছে!
জন্তুটা মুখ হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে, জিভ
দিয়ে লালা ঝড়ছে। ম্যাডাম থর্নহিলের গাউন পরে তাকে হাস্যকর দেখাচ্ছিল কিন্তু হাসার মতন মনের অবস্থা মার্কের ছিল না। সে নিজের
পকেট থেকে রুপোর গুলিগুলো বার করল। যদিও কী করবে সেগুলো নিয়ে ওর জানা ছিল না।
ওয়্যের উলফটা এবার এক লাফ
দিল। তার দাঁতগুলো শান দেওয়া ছুরির মতন দেখাচ্ছিল। এখন আর কোনও উপায় নেই। আরেকটা দিনের সুন্দর সূর্যোদয় দেখা ওর ভাগ্যে
নেই ভেবেও মার্ক একেবারে মরিয়া হয়ে নেকড়েটাকে একটা ঘুসি মারল।
ওর মুঠো করা হাত ভোরাসিয়া
থর্নহিলের পাঁজরের ফুটোর ভিতর ঢুকে গেল।
চিৎকার করতে লাগল জন্তুটা, ওর গুলিতে লাগা ক্ষতগুলো কী এখনও সেরে ওঠেনি?
ওকে কামড়ে না দিয়ে নেকড়েটা
ধপাস করে পড়ে গেল। মার্ক এবার বুঝতে পারল কেন। ওর মুঠো করা হাতে ওই রুপোর গুলিগুলো
ধরা ছিল বলে।
ধীরে ধীরে মুঠোটা খুলে নেকড়ের
পাঁজর থেকে হাতটা সরিয়ে নিল সে। গুলিগুলো ভিতরেই ছেড়ে দিল। নেকড়েটা নড়ল না। সে মৃত
– আবার মৃত। গুলিগুলো বার করে নিয়ে রুডি ওকে জীবন্ত করে ফেলেছিল।
সাবধানে গেট ডিঙিয়ে মার্ক
পারপেচুয়াল রেস্টে গোরস্থান থেকে বিদায় নিল।
###
কেউ জানতে পারল না রুডির
মৃত্যু কী ভাবে হয়েছিল। মার্ক ওখানে ছিল সেটা তো আর কেউ জানত না তাই ওকে কেউ কিছু
জিগ্যেসও করেনি।
পুলিশ বিবৃতি দিল যে রুডি আর
আরো কিছু কবর চোর মিলে গোরস্থানে ঢুকেছিল। সেখানে ওদের নিজেদের মধ্যে বচসা হয় আর
ওরা রুডিকে ছুরি মারে। পরে জীবজন্তুরা এসে ওর দেহটাকে
ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে যায়। গোরস্থানের গেটের কাছে দ্বিতীয় মৃতদেহটাকে পড়ে থাকতে
দেখে ওরা বেশ আশ্চর্য হয়েছিল, তারপর অবশ্য ওটা ভোরাসিয়া থর্নহিলের বলে সনাক্ত করা
হয়। ওই দেহটা কেন এবং কী ভাবে ওখানে গেল সেই নিয়ে আর খতিয়ে দেখার সাহস করেনি কেউ।
ওদের মা রুডির মৃত্যুতে বেশ ভেঙে
পড়েছিলেন, কিন্তু মার্ক জানে মা সেই শোক কাটিয়ে উঠবেন। মা মার্ককে বলেছেন যে উনি
বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিলেন যে রুডি যে কোনও
দিন ভয়ানক কোন বিপদে পড়বে। রুডি তো নিজেই ওখান থেকে চিরদিনের জন্যে চলে যেতে চাইত
তাই ও যা চেয়েছিল তাই পেয়েছে।
রুডি ওকে বার বার বলত, “ভাই তোকে আরো শক্ত হতে
হবে এই পৃথিবীতে কিছু করতে গেলে!” সেটা ঠিক কিন্তু বুদ্ধিরও প্রয়োজন আছে। গোরস্থান
থেকে একা বেরিয়ে আসার দুঃখটাকে কাটিয়ে উঠছে মার্কও। সে শুধু বেঁচে পালিয়েই আসেনি
ভয়ঙ্কর ক্ষতটাকে সারিয়ে তুলেছে কারো কিছু বুঝে ফেলার আগে।
নাহ, স্পোর্টস কোয়েস্ট জুতো
মার্কের কেনা হয়নি, কিন্তু সে বুঝেছে যে ওই জুতো তার আর লাগবে না। গোরস্থানের সেই
রাত ওর আত্মবিশ্বাসকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সে যদি একটা ভয়ঙ্কর নেকড়েকে দৌড়ে
পরাস্ত করতে পারে তাহলে বিরোধী টিমকে দৌড়ে হারানোটা
তো কোনও ব্যাপারই না, আর খেলাগুলো যদি
পূর্ণিমার রাতে হয় তাহলে তো কথাই নেই!
_________
ছবি - তন্ময় বিশ্বাস
নীল শুষ্টারম্যান ও টেরি ব্ল্যাক দুজনেই মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন এবং কিশোরদের জন্যে গল্প, টিভি সিরিয়াল ইত্যাদি লেখেন।
‘পারপেচুয়াল পেস্ট’ দুজনের একসঙ্গে মিলে লেখা প্রথম গল্প।
ওফ ভয়ানক উত্তেজনাপূর্ণ গল্পো।চমৎকার অনুবাদ অনন্যাদি :)
ReplyDeleteDhanyabad Pradipta! Tumi porechho jene bhalo laglo.
Deleteঅসাধারণ, অনুবাদ আরো চাই
ReplyDeleteঅসাধারন। গায়ে কাঁটা দেওয়া গল্প। খুব thrilling.
ReplyDeleteম্যাজিক ল্যাম্পে এই গল্পটি সবচেয়ে ভালো লাগলো।
anobodyo anubad ....golper Mul ros k bonchito na kore...
ReplyDeleteআর খেলাগুলো যদি পূর্ণিমার রাতে হয় তাহলে তো কথাই নেই
ReplyDeleteer ki kono alada mane ache..naki emni e line ta..
darun galpo