বিলু
ধূপছায়া মজুমদার
।। এক।।
“আরে
বিলু, আস্তে
ব্যাট চালা ভাই,” বাউণ্ডারির ধার
থেকে হেঁকে উঠল তাপস।
“চেঁচিয়ে
লাভ নেই, কানে
ঢুকবে নাকি? ওকে
হাত নেড়ে থামতে বল,” পাশ থেকে
রাণা বলল।
পরের
বলটা সোহম ফুল-টস দিল,
আর বিলু মনের সুখে ব্যাট বাগিয়ে তেড়ে একটা শট নিল। বল উড়ে গিয়ে
ঢুকে পড়ল মাঠের পাশের পোড়ো বাড়িটায়।
“যাহ্! এই ভয়টাই পেয়েছিলাম। এবার কে পাঁচিল
ডিঙিয়ে ঢুকবে ওই পোড়ো বাড়িতে?” তাপস বরাবর একটু ভীতু, পোড়ো বাড়িটার দিকে পারতপক্ষে তাকায় না
ও।
“হাবাটাকে
ঠেলে পাঠা।”
“মুখ
সামলে কথা বলবি রাণা! মেরে পাট করে দোব নইলে,” গর্জে ওঠে তাপস। ওর
চেহারা বয়সের তুলনায় বড়োসড়ো, রেগে গেলে হুঁশ থাকে না, সবাই জানে।
রাণা থমকে গেল তাপসের চেহারা দেখে। নিজেও
ভুলটা বুঝতে পেরেছে। বিলুকে ওভাবে বলাটা ঠিক হয়নি। বেচারা
ছোটো থেকেই কানে শোনে না,
কথাও বলতে পারে না।
সোহম, তাপস, বিলু, রাণা এরা সব ছোট্ট
থেকে এক পাড়ায় একসঙ্গে বড়ো হচ্ছে। বিলু বাদে সবাই
একই স্কুলে পড়ে, এখন
ক্লাস নাইন। জন্মগত কিছু সমস্যার জন্য বিলু কানে শোনা
বা কথা বলা কোনওটাই পারে না। খুব উত্তেজিত
হলে, সে আনন্দ
বা রাগ যাই হোক, ওর মুখ
দিয়ে দুর্বোধ্য কিছু শব্দ বেরোয় কেবল। তা বলে যেন ভেবে বসো না, বিলু সবসময় মনমরা হয়ে থাকে, কিংবা পড়াশোনা
বা দুরন্তপনায় সে অন্য কারও চেয়ে বিশেষ পিছিয়ে।
এই শহরতলিতে তো মূক-বধিরদের জন্য আলাদা
স্কুল নেই, আর
পাঁচজনের মতো সাধারণ স্কুলেই ওকে ভর্তি করা হয়েছিল ছোটোবেলায়। সেখানে
ওর না বলতে পারা কথাই বা কে বুঝবে, আর না শুনতে পাওয়া কথাই বা কে বুঝিয়ে
দেবে! তাই
এক-দেড়বছর পর থেকে ওর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে
পাড়ার তন্ময়কাকু, যিনি
কলকাতায় ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব স্কুলে পড়ান, আর উইকএন্ডে নিজের বাড়িতে বিলুর মতো
ছ-সাতটি ছেলেমেয়ে আর তাদের বাড়ির লোকেদের ক্লাস নেন, কথা বলতে না পারা আর শুনতে না পাওয়ার
বাধা টপকে কেমনভাবে নিজের স্বপ্নগুলো সত্যি করার শক্তি জোগাড় করতে হয় তার ক্লাস, সেই তন্ময়কাকুই
সাইন ল্যাঙ্গোয়েজের খুঁটিনাটি বিলুকে আর বাড়ির সবাইকে হাতে ধরে শিখিয়েছেন। বিলুর
প্রাণের বন্ধু সোহম আর তাপস, একসঙ্গে থাকতে থাকতে ওরাও যেন কবে সেই ইশারার ভাষা শিখে ফেলেছে। সাইন
ল্যাঙ্গোয়েজ আর সেলফোনের হরেকরকম কমিউনিকেশন অ্যাপ, সব মিলিয়ে বিলু এখন খুব খারাপ নেই। ওপেন
স্কুল থেকে সামনের বছর সে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে।
পাড়ার
কিছু ছেলে অবশ্য ওকে অকারণে বড্ড বিরক্ত করত ছোটোবেলায়, অকারণে বিশ্রী
অঙ্গভঙ্গি করে ছেলেটাকে উত্যক্ত করে নিষ্ঠুরভাবে মজা দেখত। তবে
তাপস আর সোহমের চড়-চাপড় খেয়ে, আর বিলুর বুদ্ধির কাছে হেরে গিয়ে আস্তে আস্তে বন্ধুত্বের হাত
বাড়িয়ে দিয়েছিল। এখন প্রায় সারা পাড়া বিলুর বন্ধু।
তার বাড়িতে আছে তিন বছরের বড়ো দিদি তিথি, উচ্চমাধ্যমিক
পাশ করেছে কিছুদিন হল। গতকাল বাথরুমে
পা পিছলে পড়ে পা মচকে এখন সে ঘরবন্দি। বাড়ির
মধ্যে টুকটুক করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বাইরে বেরনো বন্ধ। আর আছেন
বাবা, মা, ঠাম্মি আর মঞ্জুদিদি। এরা
সবাই মিলে ভারি আগলে রাখে বিলুকে। দিদি
আর বাবা অবশ্য ঠিক আগলায় না, বরং বাইরের লোকজন এলে বিলুকেই সামনে এগিয়ে দেয় আপ্যায়ন করার
জন্য, নিজেরা
পাশে থেকে সাপোর্ট করে।
বিলুর পরিচয় দিতে অনেক কথা খরচ করে ফেললাম, এবার চলো খেলার
মাঠে যাই। মাঠের পাশেই যে পোড়ো বাড়িটা আছে সেটা
হল মুখার্জীবাড়ি। বাড়ির মালিক সনাতনদাদু গতবছর মারা গেছেন, ছেলে অনিকেত
সিডনিতে থাকেন। দেখভাল করার লোকের অভাবে এখন বাড়িটা তালাবন্ধ
থাকে, তাই
খেলতে খেলতে বল উড়ে গিয়ে বাড়িটায় ঢুকে পড়লে পাঁচিল ডিঙোনো ছাড়া গতি থাকে না। বিলু
আর সোহম ডাকাবুকো, বেশিরভাগ
সময়ে ওরাই গিয়ে বল নিয়ে আসে। আজ সন্ধে হয়ে
আসছে বলে বিলু-সোহম দু’জনেই ঢুকল বাড়িটায়। রাণা আর তাপস
হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই, বিলুদের আর আসার নাম নেই। একটা
বল খুঁজে আনতে এত সময় লাগে! বিরক্ত
হয়ে রাণা সবে একটা হাঁক পাড়তে যাবে, অমনি দেখে বাড়িটার সদর দরজা খুলে বিলু
আর সোহম বেরিয়ে আসছে।
“এ কী রে, দরজা খুলে দিল
কে?”
“নতুন
ভাড়াটে এসেছে নাকি? জঙ্গল
সাফ না করেই শিফট করেছে?
সাপখোপের ভয় নেই?”
রাণা
আর তাপসের প্রশ্নের উত্তরে সোহম কিছু বলার আগেই বিলু ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে হাত নেড়ে অনেক
কিছু বোঝাতে শুরু করল। অন্য সময় হলে বাকিরা ঠিকই বুঝতে পারত, কিন্তু এখন ও
এতটাই তাড়াহুড়ো করে বলার চেষ্টা করছে যে কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। শেষকালে
সোহম বাকিটুকু বলতে উত্তেজনার কারণ বোঝা গেল।
মুখার্জীবাড়িতে ঢুকেই ওরা দেখে একটা তারে
জামাকাপড় মেলে রাখা আছে,
আর উঠোনের ধারের বাথরুমের কল খোলা, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, নালী দিয়ে সাবানগোলা
জল বেরোচ্ছে। তালাবন্ধ বাড়িতে এসব দেখে একটু ঘাবড়ে
গিয়েছিল দু’জনেই। তবুও মনে বল এনে ঝোপের মধ্যে বল খুঁজতে খুঁজতে একটা জানালার
নিচে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। জানালা খোলা আছে দেখে বিলু কৌতূহলী হয়ে
ভেতরে উঁকি দেয়, আর তখনই
জানালায় এসে দাঁড়ায় একটা ছেলে। তার মাথার চুল
থেকে শুরু করে গা-হাত-পা,
সারা শরীরের রং সাদা। চোখের সামনে
অমন একখানা চেহারা দেখে বিলু আঁতকে উঠেছিল। সম্ভবত সেই চিৎকার
শুনেই বাথরুমের দরজা দড়াম করে খুলে বেরিয়ে এল গামছা পরা সিড়িঙ্গে মতন একটা লোক। ততক্ষণে
ঘরের ভেতরের মূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেছে। লোকটা এদের দেখেই যাচ্ছেতাই দুয়েকটা গালি দিয়ে সোহমের কলার ধরে ঝাঁকাতে
শুরু করল। বিলু এসে বন্ধুকে ছাড়াতে চেষ্টা করতে
করতে তার নিজের ভাষায় রাগ উগরোতে লাগল। অবাক কাণ্ড, যেই না বিলুকে
দেখা আর ওর কথা শোনা,
অমনি লোকটা মারমুখী মূর্তি ছেড়ে এক্কেবারে বিনয়ের অবতার হয়ে পড়ল। দু’জনকে
ভারি আদর-আপ্যায়ন করে বলটা খুঁজে দিয়ে সদর দরজা খুলে বাইরে বেরোতে দিল। এরা
তো হাঁ! চলে
আসার আগে আবার সোহমকে ডেকে লোকটা বলেছে, “স্যাঙাতকে নিয়ে এসো আবার।”
কী ব্যাপার
এরা কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারল না। সন্ধে হয়ে গেছে, যে যার বাড়ির
পথে হাঁটা লাগাল।
।। দুই।।
বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসেছে বিলু। বাকিরাও
রয়েছে, গল্পগাছা
হচ্ছে, টিভিতে
খবর চলছে ওদিকে। খবরের দিকে কারও মন ছিল না বিশেষ, কিন্তু একটা
খবরে সবার চোখ আটকে গেল। সারা রাজ্যে
নাকি প্রায় জনাবিশেক প্রতিবন্ধী শিশুকিশোর নিখোঁজ হয়েছে গত কয়েকদিনে। রাজ্যের
বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাচ্চাদের হারিয়ে যাওয়ার খবর আসছে। কেবল
তাই নয়, কয়েকটা
মিসিং ডায়েরি থেকে জানা গেছে অ্যালবিনো বাচ্চারাও এই কিডন্যাপারদের টার্গেট। খবর
শুনে ঠাকুমা অস্থির হলেন। এই বাচ্চারা
বিপদে পড়লে চেঁচিয়ে কাউকে ডাকতেও পারবে না, যাদের হাঁটাচলার সমস্যা তারা দৌড়ে পালাতেও
পারবে না। বিলুটা ডানপিটে বলে ওকে নিয়ে তাঁর বেশি
চিন্তা।
সবার
চোখ টিভির পর্দায়। তাই দেখে বিলুও সেদিকে তাকাল। তাকিয়েই চেয়ার
ছেড়ে লাফিয়ে উঠল। আরে! এই ছেলেটাকেই তো ওরা বিকেলে বাড়িটার জানালায়
দেখেছিল! কে ও? খবরে কী বলছে
ছেলেটাকে নিয়ে? জানতেই
হবে বিলুকে। একে তো অমন চেহারার মানুষ ওরা কখনও দেখেনি, তারপর আবার সে
ঠোঁটের ওপর আঙুল দিয়ে কী যেন বলছিল ইশারায়। টিভিতেই বা তাকে
দেখাচ্ছে কেন? কিচ্ছু
বুঝতে পারে না বিলু। পাশের চেয়ারে বসা দিদির হাত খামচে ধরে
ও।
তিথি
ভাইয়ের দিকে তাকিয়েই বুঝল, কিছু গোলমাল আছে। ভাই যখন উত্তেজিত
হতে শুরু করে
তখন ওর ফর্সা মুখটা লালচে হয়ে যায়। ও তাড়াতাড়ি বাবা-মাকে
ডাক দিল। সবাই মিলে বুঝিয়ে শান্ত করে বিলুর কাছে
বিকেলের গোটা ঘটনাটা জানল।
“কী
আশ্চর্য! সনাতনকাকুর
ছেলে এর মধ্যে দেশে আসেনি তো! এলে আমি জানতে পারতাম। ওর ভাইপো
আমাদের অফিসে কাজ করে। পরশুও অনিকেতের ব্যাপারে কথা হল। ওদের
আসার কথা এ-বছরের শেষদিকে। বাড়ি কাউকে ভাড়া
দিলে আমরা তো খবর পেতাম!” বাবার
কথায় মা আর ঠাম্মি খুব চিন্তায় পড়ে যান।
“তাহলে লোকটা কে ও-বাড়িতে? অ্যালবিনো ছেলেটাই
বা কে?” মায়ের
কথায় বাবার খেয়াল হল, বিলু অ্যালবিনিজম নিয়ে কিচ্ছু জানে না। প্রথম
থেকে তিনি চেষ্টা করেছেন ছেলেমেয়ের মনে প্রতিটি ব্যাপার নিয়ে যথাসম্ভব স্বচ্ছ ধারণা
গড়ে দিতে। তাই এক ফাঁকে বিলুকে নিয়ে নেটে বসবেন
ঠিক করলেন। আপাতত ঠিক হল, তন্ময়কে আর সনাতনকাকুর
ভাইপোকে ফোনে পুরো ব্যাপারটা জানানো হবে। কাল সকালে বাড়িটায়
খোঁজ নেওয়া দরকার।
অ্যালবিনিজম
একটা জন্মগত অসুখ মাত্র,
যাতে আক্রান্ত মানুষের শরীরে মেলানিন নামের পিগমেন্ট একেবারেই থাকে না। এই মেলানিন
না থাকার জন্য রোগীর চামড়া,
চুল, চোখের
স্বাভাবিক রং তৈরি হয় না। সারা শরীরে কেবল একটাই রং থাকে, সাদা। মেলানিন
না থাকায় ত্বক সূর্যের তাপে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, দৃষ্টিশক্তির সমস্যা হতে পারে। তবে
হ্যাঁ, আর পাঁচটা
অসুখের মতোই এটাও একটা অসুখ। অ্যালবিনিজম
নিয়েও একজন মানুষ দিব্যি সবার মাঝে স্বাভাবিক জীবন কাটাতে পারে, যদি না আশেপাশের
মানুষ ভুল ধারণার বশে তাদের অচ্ছুৎ ভাবে, তাদের নিয়ে নির্মম মস্করা করে তার জীবন
অতিষ্ঠ করে তোলে।
বাসব
ডিনারের পর ছেলেকে পাশে বসিয়ে এসব বোঝাচ্ছিলেন। শুনতে
শুনতে বিলু কেমন আত্মস্থ হয়ে যাচ্ছিল। বাসব বুঝতে পারছিলেন,
বিকেলে দেখা অ্যালবিনো ছেলেটির সঙ্গে বিলু নিজের মিল খুঁজছে।
আলোচনা
ভাঙল ফোনের আওয়াজে। বাসব উঠলেন ফোন ধরতে। কথা
বলতে বলতে বাসবের মুখের ভাব বদলাচ্ছে, খেয়াল করছিল বিলু।
ফোনটা
রাখার পর বেশ কিছুক্ষণ ধরে আরও তিনটে ফোন সেরে বিলুকে ডেকে দু’জনে মিলে ভাইবোনের ঘরের
দিকে চললেন। অনেক কথা আছে, সময় লাগবে বোঝাতে। বিলুর
বন্ধুদুটোকেও খবর দেওয়া দরকার।
।। তিন।।
পরের দিন রবিবার। তন্ময়কাকুর
পরিচালনায় পাড়ার ছেলে-ছোকরার দল ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’-এ নেমে পড়ল। সকাল
ন’টা থেকেই সাজ সাজ রব চারপাশে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে
ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো,
নালা-নর্দমার পাশের আগাছা সাফ করা, এককথায় কর্মযজ্ঞ যাকে বলে! প্ল্যানটা গত
সপ্তাহেই ঠিক হয়েছিল। গতকাল রাত্রে তন্ময়, বাসব আর পিনাকী
মিত্রের ফোন-বৈঠকের পর কোমর বেঁধে ফিল্ডে নামা হয়েছে। পিনাকীবাবুর
পরিচয় একটু পরে দিচ্ছি। ওই দ্যাখো, তিনি আবার তাঁর চেনা দুটি
লোককে পাঠিয়েছেন ঝুড়ি-কোদাল দিয়ে। তারাও এদের সঙ্গে
হাত লাগিয়েছে।
বিলু, সোহম আর পিনাকীবাবুর
কাছ থেকে আসা শ্যামলদা আর অঞ্জনদা –
এরা গিয়েছিল খেলার মাঠ সাফসুতরো করতে। এগারোটা
নাগাদ মাঠ সাফ করে চারদিকে ব্লিচিং ছড়ানো শেষ হল। তারপর
ওরা মুখার্জীবাড়ির দরজায় টোকা দিল।
আজও
কালকের সিড়িঙ্গে লোকটাই দরজা খুলেছে, তবে ভেতর থেকে উঁকি মারছে আরেকটা মাথা। দরজার
সামনে এত লোক দেখে বেজায় রেগে লোকটা চেঁচামেচি শুরু করছিল, বিলু হাসি হাসি
মুখ করে সামনে এসে দাঁড়াল। ব্যস, তাকে দেখেই লোকটা
গলে এক্কেবারে আইসক্রিম!
পারলে বিলুকে বুকে জড়িয়ে ধরে। সোহমের দিকে
তাকিয়ে বলে উঠল, “আমার
একটা ভাইপো আছে, গাঁয়ে
থাকে, একদম
এইরকম। সারাক্ষণ আমার পায়ে পায়ে ঘোরে। কাল
একে দেখে তার কথা বড়ো মনে পড়ছে গো!” বলেই জামার হাতায় চোখদুটো মুছে নিল
লোকটা। “তা, এদিকে কী মনে করে, বাবারা?”
“একটু
ব্লিচিং ছড়াতে এলাম, কাকু। যা ঝোপঝাড় হয়ে
আছে, কখন
কী বেরোয় বলা যায়? এসো
দাদারা, এই বাড়িটায়
অনেক কাজ আছে, আগাছা
উপড়োতে হবে,” বলেই দলবল নিয়ে
সোহম বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। সিড়িঙ্গে বাধা
দেওয়ার সুযোগ পেল না।
একটু
আগে উঁকি দেওয়া লোকটাকে দেখা গেল না ভেতরে ঢুকে। তবে
ব্লিচিং ছড়ানোর নামে ইতিউতি তাকাতে বাড়ির নকশাটা নজরে এল। পাঁচিল
দিয়ে ঘেরা বাড়ি, সদর
দরজা দিয়ে ঢুকেই উঠোন। উঠোনের একধারে তিনটে ঘর আর রান্নাঘর, ঘরের সামনে চওড়া
দাওয়া। উঠোনের শেষপ্রান্তে টিনের দরজাওয়ালা বাথরুম। বাথরুমের
পাশে কিছুটা ফাঁকা জমি। এককালে বাগান ছিল, এখন আগাছার ঝোপ। এর পাশেই পাঁচিল, পাঁচিলের ওপাশে
মাঠ। ওই পাঁচিল ডিঙিয়েই বিলুরা বল কুড়োতে আসে।
এছাড়াও
চোখে পড়ল, দুটো ঘরই তালাবন্ধ। ঘরের সামনে তিনজোড়া
জুতো আর একটা হাওয়াই চটি রাখা। তার মধ্যে একজোড়া
স্কুলের জুতো। দাওয়ায় তিনটে থালা মেজে উপুড় করে রাখা
আছে, একপাশে
হাঁড়িতে ভাত ফুটছে। উঠোনে তারে মেলা আছে সাদা শার্ট, খয়েরি
প্যান্ট। একপাশে পড়ে আছে একটা স্কুল-ব্যাগ, তার ভেতর থেকে উঁকি মারছে স্কুল-ডায়েরির
কোণ। লোকটার চোখ এড়িয়ে সুট করে ডায়েরিটা ব্লিচিংয়ের
ঝোলায় পুরে ফেলল শ্যামলদা।
এমন
সময়ে একটা বন্ধ ঘরের ওপার থেকে ভেসে এল একটা দুর্বোধ্য চিৎকার, যেন কেউ প্রাণপণে
চিৎকার করে কাউকে ডাকতে চাইছে, কিন্তু গোঙানি ছাড়া গলা দিয়ে আর কোনও আওয়াজই বেরোচ্ছে না। সোহমের
খুব চেনা লাগছিল শব্দটা। কোথায় শুনেছে মনে পড়ছে না কিছুতেই। এদিকে
পাশের ঘরটার জানালায় দেখা গেল দুটো ছেলের মুখ – মাথার চুল, ভুরু, গায়ের রং তাদের
পুরো সাদা। তারা প্রাণপণে কী যেন ইশারা করছে এদের। সোহমরা
কিচ্ছু বুঝতে পারল না। লাভের মধ্যে
হল কী, সিড়িঙ্গের
চোখে পড়ে গেল ছেলেদুটো,
অশ্রাব্য গালি দিতে দিতে লোকটা ছুটে গেল ঘরটার দিকে।
রহস্য তো আছেই। বেশিক্ষণ
দাঁড়ালে সিড়িঙ্গে আর তার স্যাঙাত সন্দেহ করবে, তাই এরা বেরিয়ে আসছিল, হঠাৎ বিলু আর্তনাদ
করে মাটিতে পড়ে গেল।
“কী হয়েছে? কী হয়েছে?” ছুটে এল অন্য
লোকটা, যাকে
বাড়িতে ঢোকার পরে আর দেখা যায়নি। তার
আবার গলায় ইয়া মোটা সোনার চেন ঝুলছে! “কী হয়েছে ছেলেটার? এই ব্যাটারা, চুপ করে আছিস
কেন? ফিটের
ব্যামো আছে নাকি?” এই
লোকটার কথায় ‘স’-এর দোষ আছে।
ব্যাপার
বুঝতে সোহমের একটু সময় লাগল। বিলুর পাশে বসে
ওর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করতে লাগল। পাশে দাঁড়িয়ে
অঞ্জনদা, দু’হাত
প্যান্টের পকেটে ঢোকানো। শ্যামলদা হঠাৎ বলে উঠল, “তোমরা দাঁড়াও। আমি
ওর বাড়ির লোককে ডেকে আনি। কী মুশকিল হল বল দেখি!”
বাড়ির
বাইরে পা বাড়াতে যেতেই গলায় চেন পরা লোকটা অন্য মূর্তি ধরল। “ওসব
খপর-টপর দিতে হবে না। আমরা আচি, আমরাই সামলে
নোবো। তোমরা এয়েচ, ডেরা চিনেচ, এদিক ওদিক উঁকিঝুঁকি
দিয়ে ঢের জিনিস দেকে ফেলেচ,
একন চলে যাবার কতা বললি হয় নাকি চাঁদ!” লোকটার হাতে কখন যেন উঠে এসেছে একটা
পিস্তল, আর সেটা
এখন বিলুর কপালে ঠেকিয়ে রেখেছে।
হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল সোহমের। তবে
একটা নিশ্চিন্তি, অঞ্জনদার
হাত পকেটের বাইরে। তার মানে, কাজটা সেরে ফেলেছে। আর, সবার অনুমান
যদি ঠিক হয় তাহলে
ওরা এক্ষুনি বিলুর কোনও ক্ষতি করবে না।
ঠিক
সেই মুহূর্তে সোহমের মনে পড়ল, ঘরের ভেতর থেকে আসা ওই গোঙানির আওয়াজ এর আগে কোথায় শুনেছে। পাড়ার
কিছু বেয়াড়া অসভ্য ছেলে বিলুকে যখন তার কথা বলার অক্ষমতা নিয়ে খোঁটা দিত তখন অসহায়
রাগে বিলুর গলা দিয়ে এমন শব্দ বেরিয়ে আসত। তারপর
ছেলেটা অসহায়ভাবে গুমরে গুমরে এমন কাঁদত যা দেখে বড়োদের চোখেও জল আসতে দেখেছে ওরা। এখন
অবশ্য বিলু ওদের পাড়ার হিরো। কিন্তু
তার মানে, ওই
বন্ধ দরজার ওপাশে যে আছে সেও কথা বলতে পারে না? বন্দি-দশা ঘোচাতে চেয়ে অসহায়ভাবে মানুষের
সাহায্য চাইছিল সে? সাদা
রঙের ছেলেদুটোও এদেরই বন্দি? বিলু আর কাকুদের অনুমানই ঠিক? ওরা ইশারায়
সে কথাই বোঝাতে চাইছিল? এত
কিছু জেনে ফেলেছে বলেই লোকদুটো সোহমদের আটকে রাখতে চাইছে?
ভাবতে
ভাবতেই দেখে, বিলু
চোখ খুলছে। পরমুহূর্তেই বিলুর চিৎকারে সবাই চমকে
উঠল। পিস্তল ধরে থাকা লোকটাও ঘাবড়ে গিয়েছিল। অন্যমনস্কতার
সুযোগ নিয়ে চোখের নিমেষে বিলু লোকটার হাতে মোক্ষম একটা ঘুসি ঝাড়ল। পিস্তল
ছিটকে গেল হাত থেকে। লোকটা অবাক হয়ে দেখল। শ্যামলদা
আর অঞ্জনদার হাতে উঠে এসেছে দুটো পিস্তল। তখনই
বাইরে জিপের আওয়াজ শোনা গেল।
লোকাল
থানার অফিসার-ইন-চার্জ পিনাকী মিত্র ফোর্স নিয়ে এসে দেখলেন, কাজ প্রায় সেরে ফেলেছে
এরা চারজন। শ্যামলদা আর অঞ্জনদার পিস্তলের ডগায় হাত
তুলে দাঁড়িয়ে আছে চেন পরা বদমাশ আর তার সিড়িঙ্গে স্যাঙাত, আর দুটো ঘরের
দরজা খুলে তিনটে ছেলের হাত ধরে নিয়ে আসছে বিলু আর সোহম। ছেলেগুলোর
অবস্থা দেখে পিনাকীর মতো কড়া অফিসারেরও মায়া লাগে। কী মার
মেরেছে অসহায় বাচ্চাগুলোকে!
এই ক্রিমিনালগুলোকে সাতদিন ধরে পেটালেও ওর রাগ কমবে না বোধহয়। একটি
ছেলে মূক-বধির, আর দু’জনের
মাথার চুল থেকে পায়ের নখ সম্পূর্ণ সাদা, রঙের লেশমাত্র নেই সেখানে। সোহম
আর বিলু ওদের তিনজনের হাত ধরে ভারি যত্নে আগলে এগিয়ে চলে জিপের দিকে। সেখানে
তখন দুই ক্রিমিনালকেও তোলা হয়েছে।
থানায়
পৌঁছে দেখা গেল, বিলু
আর সোহমের বাড়ির সবাই সেখানে হাজির, মায় ক্রেপ ব্যাণ্ডেজ বাঁধা পা নিয়ে তিথি
পর্যন্ত!
পিনাকীদার
কাছে শোনা গেল, গত
একমাসে রাজ্য জুড়ে প্রায় জনাবিশেক শিশুকিশোর নিখোঁজ, যাদের কোনও
না কোনও প্রতিবন্ধকতা আছে কিংবা অ্যালবিনিজম নামের জন্মগত রোগের শিকার। সম্ভবত
হিউম্যান ট্রাফিকিংয়ের কোনও চক্র জোর করে ভিক্ষা করার কাজে লাগাবে বলে এদের কিডন্যাপ
করছে। আজকের দিনে এটা একটা বিরাট ব্যাবসা। এরা
টার্গেট করেছিল প্রতিবন্ধকতা আছে এমন বাচ্চাদের, যাতে মানুষের সহানুভূতি এবং ভিক্ষার
পরিমাণ, দুইই
বেশি হয়। যথেষ্ট আটঘাট
বেঁধে কাজ করতে নেমেছিল গ্যাং-টা। বাচ্চাগুলোকে
কিডন্যাপ করে দিন কয়েক মারধর, ইঞ্জেকশন চালিয়ে প্রায় পঙ্গু করে দিয়ে ভিনরাজ্যে পাচার
করা হত। বেশ কিছু জায়গায় পুলিশ আঁচ পেয়েও ধরার
আগেই পাখি উড়ে গেছে। এখনও বোঝা যাচ্ছে
না ক’জনকে উদ্ধার করা যাবে। এখানে তিনজনকে
উদ্ধার করা গেল, দুই
চাঁই ধরা পড়ল। এবার এদের কাছ থেকে বাকিদের সন্ধান পাওয়া
যাবে।
লোকগুলো
মুখার্জীবাড়িতে ঘাঁটি গেড়ে মস্ত ভুল করেছিল। ওরা বোঝেনি, বিলু অ্যান্ড
কোং ওদের ঘাঁটিতে ঢুকে পড়ে সব প্ল্যান বানচাল করে দেবে।
“আমায়
একটা কথা বলো,”
বিলুর মা একটু রাগি স্বরেই বলে ওঠেন, “তোমরা যদি জানতেই যে ওই বাড়িটা ছেলেধরাদের
আখড়া, যেচে
বিলুদের পাঠিয়েছিলে কী করতে?”
“হ্যাঁ
দিদি, এটা
আমারও প্রশ্ন। উফ্, ঠাকুর বাঁচিয়েছেন!” হাতজোড় করে বলে ওঠেন
সোহমের মা।
“ম্যাডাম, আপনাদের গুণধর
পুত্রদেরই প্ল্যান ছিল পুরোটা। ওরা
নিজেদের, বিশেষ
করে বিলু নিজেকে
টোপ হিসেবে কাজে লাগিয়েছিল।” পিনাকী হাসতে
হাসতে বলেন।
“কাল
রাতে অনিকেত ওর খুড়তুতো ভাইয়ের কাছে খবর পেয়েই আমায় কল করেছিল। ওর কাছে
শুনে শিওর হয়ে গেলাম, ওরা বাড়িতে ভাড়াটে বসায়নি। তারপর
তন্ময় আর পিনাকীবাবুকে ফোন করে সব বলি। পিনাকীবাবু
বলেন, সাদা পোশাকের পুলিশ পাঠিয়ে তদন্ত করবেন, সন্দেহজনক কিছু পেলে ফোর্স নিয়ে নিজে
যাবেন।”
বিলুর
বাবা থামতেই বলতে শুরু করল বিলুর দিদি তিথি, “বাবা আমাদের সবকথা বলতেই ভাই ধরে বসল,
ওকেও টিমে নিতে হবে। লোকগুলো যদি সত্যিই কিডন্যাপার হয়, আর প্রতিবন্ধী
বাচ্চাদের টার্গেট করে, তবে
নাকি আমার ভাইয়ের চেয়ে ভালো টার্গেট এ তল্লাটে আর কেউ নেই!”
সবার
কথা সাইন ল্যাঙ্গোয়েজে তর্জমা করে সোহম বুঝিয়ে দিচ্ছিল। এই কথাটা
বুঝে বিলু মায়ের দিকে তাকিয়ে একখানা ফিচেল হাসি হাসল। মা তো
তখন প্রায় মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়!
“বিলু
প্ল্যানটা রাত্রেই সোহমকে জানায় হোয়াটস অ্যাপ করে। তিনিও সব শুনে
এক পায়ে খাড়া! আজ জঞ্জাল
সাফাইয়ের প্ল্যান ছিলই,
ঠিক হল সেটাকেই কাজে লাগানো হবে।”
“সব
কাজ প্ল্যানমাফিক এগোতে থাকে। ঠিক সময়মতো অঞ্জনদা
পকেটে হাত ঢুকিয়ে কায়দা করে পিনাকীবাবুকে কল করে দিয়েছিলেন। ফোর্স আসতে আরেকটু
দেরি হলে মুশকিল হত।” বলে ওঠে সোহম।
“আমায় একটা কথা বলো, বিলুর তখন
কী হয়েছিল? ব্লিচিংয়ের
গন্ধে শরীর খারাপ লাগছিল?”
অঞ্জনদার
প্রশ্নের উত্তরে হেসে ওঠে সোহম, “আরে না না, ওটা তো নাটক ছিল। ওটা
না করলে তো আমাদের বাড়িটা থেকে বেরিয়ে আসতে হত। একটা
কিছু বাহানা তো চাই ভেতরে থাকার! তাই বিলু আমায় ইশারা করে ঠাস করে মেঝেতে পড়ে গেল তখন।”
দিদি
কথাগুলো বিলুকে বোঝানোর পরে বিলু ইশারায় যা বলল, তার অর্থ – অজ্ঞান হওয়ার আইডিয়াটা হঠাৎই
মাথায় এল। ভাগ্যিস! নইলে ওদের দাঁতনখ
বের করা চেহারাটা অত তাড়াতাড়ি সামনে আসত নাকি?
“ও হরি! আমরা তো ভেবেছি,
বিলুর শরীর খারাপ লাগছে,
ও অজ্ঞান হয়ে গেছে। তাই তো তড়িঘড়ি স্যারকে কল করলুম আমি!”
অঞ্জনের
কথায় সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। ইতিমধ্যে খবর
আসে, শ্যামলদার নিয়ে আসা ডায়েরি থেকে একটি ছেলের নামঠিকানা পাওয়া গেছে। তার
বাড়িতে খবর পাঠানো হয়েছে। ছেলেগুলো একটু ধাতস্থ হয়েছে, তাদের সঙ্গে
কথা বলা হচ্ছে।
সবার মন থেকে একটা বোঝা নেমে গেল।
“যাক বাবা, ভালোয় ভালোয়
ছেলেগুলো বাড়ি ফিরে যাক ঠাকুর, মা-বাপের
মুখে হাসি ফুটুক! কই গো, তোমরাও সব চলো
দেখি, বাচ্চা
হিরোর দলবল বাড়ি
গিয়ে দুটো মুখে দিয়ে জিরিয়ে নেবে। খুব হল যা হোক
রহস্য উদ্ধারপর্ব!”
ঠাম্মির
কথায় আরেক দফা হাসির ঢেউ ওঠে থানার অফিসঘরের মধ্যে।
_____
অলঙ্করণঃ সুজাতা চ্যাটার্জী
বাঃ, খুব ভালো লাগলো। ভিন্ন আঙ্গিকের লেখা। এত দরদ দিয়ে চরিত্রনির্মাণ করতে শুধু তুমিই পারো। জবাব নেই।
ReplyDeleteবাচ্চা হিরোর দলবলকে ঠিকঠাক আঁকতে পেরেছি??
Delete