সিদ্ধিদাতার অন্তর্ধান
ডাঃ পল্লব বসু
।। ১।।
বেশ একচোট বৃষ্টি হয়ে গেল। বাতাসে সোঁদা গন্ধ লেগে আছে এখনও। বরানগর থানার অপর পারে অনেকটা জায়গা জুড়ে জল দাঁড়িয়ে গেছে। শ্রীপর্ণা সবে
বাড়ি ফেরার তোড়জোড় করছে, কনস্টেবল
সুশান্ত চেম্বারে প্রবেশ করল। “ম্যাডাম, ডিউটি রুমে এক ভদ্রলোক ডায়েরি লেখাতে
এসেছেন। জয়িতা-ম্যাডাম তাঁকে আপনার কাছে পাঠানোর অনুমতি চাইলেন।”
“জয়িতা যখন আমার কাছে পাঠাতে চায় নিশ্চয়ই ব্যাপারটা
আমার নোটিসে আনা জরুরি মনে হয়েছে ওর। আপনি পাঠিয়ে দিন তাঁকে।”
দামি পাঞ্জাবি-পাজামা পরিহিত বছর চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের
সুপুরুষ, ছ’ফিটের মতো উচ্চতার এক ভদ্রলোককে নিয়ে জয়িতা চেম্বারে ঢুকল। শ্রীপর্ণা ওদের সামনের চেয়ারে বসতে নির্দেশ করল। “আপনি
একটা জন্মদিনের পার্টি থেকে সোজা চলে এসেছেন দেখছি। অনুষ্ঠানের হলে কোনও দুর্ঘটনা
ঘটেছে নাকি?”
চেয়ারে বসেও লোকটির আঙুল কাঁপছিল তির তির করে। শ্রীপর্ণার চেম্বারটা শীততাপ
নিয়ন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও দরদর করে ঘামছিলেন। এবার শ্রীপর্ণার কথায় মুখটা তার হাঁ
হয়ে গেল। জয়িতাও
কম অবাক হয়নি, তবে তাঁদের ম্যাডামের এই বিস্ময়কর পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি এবং তার থেকে
নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর ক্ষমতা সম্বন্ধে সে যথেষ্টই অবহিত।
“অবাক হবার মতো কিছু নেই। আপনার পরনের পোশাক, পাঞ্জাবির সোনার বোতাম আর তীব্র পারফিউমের গন্ধই বলে
দিচ্ছে আপনি কোনও অনুষ্ঠানবাড়ি থেকে আসছেন। কিন্তু হাতের আঙুলগুলো যেভাবে কাঁপছে
আর যেরকম ঘামছেন, মাথার চুল যেরকম অবিন্যস্ত তাতে একটা বড়ো দুর্ঘটনা...”
“কিন্তু জন্মদিনের পার্টি, সেটা কীভাবে বলছেন? চারদিকে বহু বিয়ের অনুষ্ঠানও
তো...” শ্রীপর্ণার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ভদ্রলোক এবার মুখ খোলেন।
“খুবই সাধারণ পর্যবেক্ষণ। একটু আগেই কেক কাটার অনুষ্ঠানটা হয়েছে। যার
জন্মদিন, আপনি তাঁর নিকট আত্মীয়। ফলে দুষ্টুমি করে কেক খাওয়াতে গিয়ে সে আপনার
মুখে-গায়ে কেকের ক্রিম লাগিয়েছে। মোছার বা ধোবার পরেও কানের পাশে, গালের অংশে, আর
পাঞ্জাবিতে তার অবশেষ এখনও লেগে আছে।”
“ঠিক ধরেছেন। সবে সারা মুখে লাগিয়ে দেওয়া পেস্ট্রির ক্রিম মুছছি, এমন সময়েই
তো পাওয়ার কাট, তারপরেই অন্ধকারে মেয়ের চিৎকার, আর আলো আসতেই দেখি, মেয়ের গলার
লকেটটা উধাও!”
“একটু বিস্তারিত বলুন, তাহলে সুবিধা হয়।”
“আমার নাম গৌতম ঘটক। আজ মেয়ে শালিনীর পাঁচ বছরের জন্মদিনের অনুষ্ঠান চলছিল
বাড়িতেই একতলার হলঘরে। আমন্ত্রিতদের মধ্যে প্রধানত নিকট আত্মীয়রা, আমার কারখানার স্টাফেরা,
আর মেয়ের স্কুলের কিছু বন্ধু আর তাঁদের বাবা-মায়েরা। কেক কাটার পর আমাকে, ওর মাকে,
দুই মাসি, মামা, দিদা, এক কাকা আর এক পিসিকে ও নিজের হাতে কেকের টুকরো খাওয়ায়।
এরপর ক্যাটারিংয়ের দু’জন সার্ভিস বয় প্লেটে করে বাকিদের কেক সার্ভ করতে থাকে। আমরা
তখন ওর দুষ্টুমি করে মাখানো ক্রিমগুলো মুছতে ব্যস্ত। মেয়ে বাকি বাচ্চাগুলোর সঙ্গে
হুল্লোড় করছে। ঠিক এই সময় সমস্ত বাড়ি অন্ধকার হয়ে যায়। আমার বাড়ির পাওয়ার মেইনের
সাথে ইনভার্টার লিঙ্ক করা আছে। পাওয়ার কাট হলেই ইনভার্টার চালু হয়ে যায়। কিন্তু
এক্ষেত্রে তা হয়নি। এই ঘটনার জন্য আমরা স্বভাবতই কেউ তৈরি ছিলাম না। এরমধ্যে
অন্ধকারে বাচ্চাদের চিৎকার-চ্যাঁচামেচি বেধে যায়। কেউ কেউ মোবাইলের আলোয় দেখার
চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু অত বড়ো হলঘরে তখন একটা সাংঘাতিক এলোমেলো অবস্থা। তার মধ্যে
ভয়ে বাচ্চারা ছোটাছুটি করতে গিয়ে, এর ওর সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি, কাচের গ্লাস-বাটি
ভেঙে চুরমার, আর আমার মেয়ের চিলচিৎকার। লোডশেডিং এখন কলকাতায় প্রায় হয়ই না, তায়
বাড়িতে ইনভার্টার রয়েছে। ফলে সঙ্গে সঙ্গে যে কোনও একটা আলোর ব্যবস্থা করা যাবে,
তাও সম্ভব হয়নি। আর যে লোকটা কিছু করতে পারত, সেই বাবুলালকে তার একটু আগেই আমি
সিগারেট কিনতে বাইরে পাঠিয়েছিলাম। ওই অন্ধকারে ভিড়ের মধ্যে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকাই
শ্রেয় মনে হয়েছিল। ভেবেছিলাম,
এই বুঝি আলো এসে যাবে। খুব হলে মিনিট পাঁচ-সাতেক আলো ছিল না। এরপরেই আলো জ্বলে
ওঠে। তখনই আবিষ্কার করি, মেয়ের গলায় বহুমূল্য লকেটটা নেই। একটা দুই ইঞ্চির সোনার
গণেশ, একটা সবুজ পান্না তাঁর নাভিতে, দুই চোখে সাত সেন্টের দুটি হিরে একটা সোনার
চেনের সঙ্গে মূর্তিটা ঢালাই করে লাগানো। আমার মেয়ে যেদিন জন্মায়, সেদিন বাবা ওই
লকেটটা দিয়েই মেয়ের মুখ দেখেছিলেন। ওটা আমার সিন্দুকে রাখা থাকে। আমি ওই মূর্তিকে খুব শুভ মনে করি। কারণ, ওই
মূর্তি বাড়ি আসার পরই আমার ব্যাবসা ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। প্রত্যেক বছর জন্মদিনে আমার মেয়ে
ওই লকেটটা পরে থাকে। মেয়ে তো কেঁদেকেটে একশা। মেয়েকে জিজ্ঞেস করতে বলল, অন্ধকারের মধ্যে কে যেন গলা
থেকে লকেটটা টান মেরে ছিঁড়ে নিয়ে পালায়। আমি ঘরের মধ্যে খেয়াল করি। সবাই পরিচিত মানুষজন, আর সার্ভিসের ছেলেদুটি। আমি
ছুটে হলঘরের বাইরে যাই। আমাদের বাড়িতে রাতদিনের জন্য থাকে বাবুলাল। ও প্রায় দশ বছর আছে। চল্লিশের ঘরে বয়স। আর আছে রান্নার একটি মেয়ে। তিরিশের ঘরে বয়স, বছর দুয়েক
আছে আমার বাড়িতে। ওদের
দু’জনেই, সঙ্গে ক্যাটারিংয়ের অন্য চার-পাঁচটি ছেলেও হলঘরের ঠিক বাইরের বারান্দায়
চলে এসেছে। আমি ছুটে বাইরের লনে, সেখান থেকে মূল ফটকের দিকে গেলাম ছুটে। ফটকে
দারোয়ান ছিল। তাকে
জিজ্ঞেস করতে জানাল, পাওয়ার কাটের সময়ও সে ফটকেই দাঁড়িয়ে ছিল, একটুও নড়েনি, বাবুলালকে
শুধু পাওয়ার কাটের সামান্য পরেই ঢুকতে দিয়েছিল কিন্তু কেউ বেরিয়ে যায়নি। এরপর আমি বাগানের দিকেও ছুটে
যাই, কিন্তু কোথাও কাউকে দেখতে পাইনি। এরপর বাড়ির সবাইকে হলঘরে থাকতে বলে থানায়
আসি খবর করতে।”
“সিইএসসির পোল নাম্বার, আর কনজিউমার নাম্বার বলুন।”
গৌতমবাবু তাঁর বাড়িতে ফোন করলেন, “হ্যালো, মৌসুমি, শোনো, আমি থানায় আছি।
তুমি একবার ইলেকট্রিক বিল দেখে আমায় পোল
নাম্বার, আর কনজিউমার নাম্বারটা বলো তো।”
জয়িতা ওঁর দিকে কাগজ আর পেন এগিয়ে দিলেন। নাম্বার লিখে
গৌতমবাবু এগিয়ে দিলেন শ্রীপর্ণার দিকে।
“হ্যালো, বরানগর থানা থেকে আইসি বলছি। একটা পোল নাম্বার, আর কনজিউমার নাম্বার বলছি, আধাঘণ্টার
মধ্যে এখানে বা এই এলাকায় কোনও পাওয়ার কাট হয়েছে কিনা প্লিজ জানান।”
“শুনুন, গৌতমবাবু, আজ
কোনওরকম পাওয়ার কাট আপনার বা আপনার আশেপাশের কোনও এলাকায়ই হয়নি। বুঝতেই পারছেন
আপনি একটা গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। সম্ভবত আপনার বাড়ির মেইন সুইচ সাময়িক
বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং তার মধ্যেই চুরিটা করা হয়, কাজ মিটে গেলে আবার মেইন অন
করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ পুরো ব্যাপারটাই পূর্বপরিকল্পিত এবং এতে একাধিক লোকের হাত
আছে। কারণ, একই সঙ্গে মেইন অফ করা আর লকেট কেড়ে নেওয়া একজনের পক্ষে সম্ভব না।”
“কিন্তু, ইনভার্টার কাজ করল না কেন?”
“আরে, এ তো জলের মতো সোজা। ইনভার্টারের ইউপিএসের পাওয়ার সুইচ কেউ অফ করে দিয়েছিল। তাই মেন সুইচ বন্ধ
হওয়া সত্ত্বেও ইনভার্টার চালু হয়নি। আর দেরি নয়, চলুন আপনার বাড়ি গিয়ে বাকি তদন্ত
সারতে হবে, আর সেটা যত তাড়াতাড়ি করা যাবে ততই ভালো।”
।। ২।।
“আপনার সমস্ত বাড়িটা আমি আগে ঘুরে দেখে নিতে চাই। তাহলে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে
যেতে অনেকটা সুবিধা হবে।” প্রধান ফটক দিয়ে পুলিশের জীপে ঢুকতে ঢুকতে শ্রীপর্ণা
গৌতমবাবুকে বলে ওঠে।
“চলুন তবে, বাড়ির বাইরেটা আগে ঘুরে দেখে নিন।”
ফটক থেকে পিচ বাঁধানো রাস্তা চলে গেছে বাড়ির দরজা অবধি। রাস্তার দু’পাশে
অত্যন্ত যত্নে সাজানো ফুলের বাগান। দু’ধার দিয়ে আর পাঁচিলের গা ঘেঁষে ফুলগাছের টব
সাজানো - গোলাপ, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা এইসব। পুরো বাড়িটা ঘিরেই রয়েছে বাগান। ছোটো
গাছের পাশাপাশি বিভিন্নধরনের বড়ো বড়ো গাছও ছড়িয়ে বাগান জুড়ে। বাকিদের আসতে বারণ
করে শ্রীপর্ণা একাই বাগানের দিকে পা বাড়ায়। আসলে ও চায় না, বহুজনের পদাঘাতে
বাগানের বৃষ্টিসিক্ত মাটিতে যদিবা কোনও প্রমাণ থাকার আশা থাকে, তা লোপ পায়।
একতলায় ঢুকলেই বিরাট বারান্দার একপাশ থেকে দোতালায় যাবার ঘোরানো সিঁড়ি উঠে
গেছে। সিঁড়ির ঠিক নিচে ইনভার্টার স্টেশন। শ্রীপর্ণার কথাই মিলে গেল। দেখা গেল
ইনভার্টারের পাওয়ার স্যুইচ অফ করা আছে। এটা যদি চোরের কাজ হয়, তাহলে বাড়ির
বিদ্যুতের মেইন স্যুইচ অন করার সময় এটা অন করার কথা সে ভুলে গেছে। বারান্দার ডানদিকে
প্রশস্ত ডাইনিং স্পেস। তারপরেই রান্নাঘর। ডাইনিংয়ের দেয়াল জুড়ে চোখ জুড়ানো কেরালার
কোভালাম বিচের শোভা। বাঁপাশে হলঘরের দরজা। এছাড়া একতলায় ছড়িয়ে আছে অতিথিদের থাকবার
সুসজ্জিত দুটি ঘর, আর বাবুলাল ও রাঁধুনি নন্দিনীর থাকার জন্য নির্দিষ্ট রয়েছে ছোটো
আকারের আরও দুটো ঘর।
হলঘরের ভিতরে সবাইকে একঝলক দেখে নিয়ে শ্রীপর্ণা প্রত্যেককে একে একে জেরা করার
প্রস্তাব করল। শালিনীর কাকা অরিন্দম মৃদু প্রতিবাদ করে বললেন, “ভোরে
আমায় দিল্লীর ফ্লাইট ধরতে হবে। বাড়ি ফিরে বেশ কিছু কাজ বাকি রয়েছে। এখন জেরার জন্য
ডিটেইন্ড হওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। আপনি আমায় আগেই জেরা করে ছেড়ে দিন, প্লিজ।”
“আমি আগে শালিনীর সঙ্গে কথা বলব, তারপরেই বাকিদের জেরা
করা সম্ভব। কারণ, ওর বয়ানের উপরে আমার পরবর্তী জেরার ধরন নির্ভর করবে। আমি চেষ্টা
করব শালিনীর পরে আপনার সঙ্গে কথা বলে দ্রুত ছেড়ে দিতে।”
“কিন্তু ম্যাডাম, কাল মেয়ের স্কুল আছে ভোরবেলা। এখানে
কতক্ষণ আটকে থাকব?” মিসেস দত্তগুপ্ত, শালিনীর এক বন্ধুর মা বলে উঠলেন।
“দেখুন, আপনাদের সবার উপস্থিতিতে একটা বড়ো চুরি হয়ে
গেছে এই হলঘরে। অত্যন্ত দামি একটি লকেট। আমি আপনাদের কাউকেই চোর বলছি না, কিন্তু
আপনাদের জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে দিয়েই একটা সূত্র বেরিয়ে আসতে পারে, কারণ আপনারা
সকলেই সে সময় হলঘরে উপস্থিত ছিলেন। শালিনী আপনাদের সকলেরই প্রিয়। আমার মনে হয় তার
মুখ চেয়েই আপনাদের এটুকু কো-অপারেশন করা উচিত। আমি খুব বেশি সময় নেব না। আপনারা খেতে শুরু করে দিন
এখানে বসেই। এই ঘর থেকে শুধু কেউ এখন আর বেরোবেন না, প্লিজ। খাবার এখানেই সার্ভ
করবে।”
“আচ্ছা, আপনি সকলের একবার তল্লাশি নেবার কথা বলছেন না
কেন? এখানেই কারও কাছে যদি থেকে থাকে?” শালিনীর পিসি মল্লিকা বলে ওঠেন। তাঁর কথায়
চারদিক থেকে কোলাহল শুরু হয়।
“আপনি ঠিকই বলেছেন। পুলিশি তদন্তের একটি বাঁধা গত হল
তল্লাশি। কিন্তু আপনার কি মনে হয় না, যে তল্লাশির কথাটা চোরেরও মনে এসেছে, আর এতটা
সময়ের মধ্যে সে সেটা পাচারও করে দিয়েছে?”
“না ম্যাডাম, আমি খেয়াল রেখেছিলাম। এখানে যারা
উপস্থিত, তাঁদের মধ্যে মাত্র দু’জন আলো আসার পর থেকে বাইরে বেরিয়েছিলেন। মিসেস
দত্তগুপ্ত, অর্থাৎ পম্পার মা আর মিস্টার সেন, মানে গৌতমের বন্ধু।”
“মানে আপনি কি বলতে চাইছেন, আমি বেরিয়েছিলাম, এর অর্থ
আমি চুরির জিনিস পাচার করতে গেছিলাম! মেয়ে পম্পাকে টয়লেটে নিয়ে গেছিলাম। আমি আপনার
নামে মানহানির মামলা করব।” দত্তগুপ্ত প্রায় তেড়ে এলেন মল্লিকার দিকে। মিস্টার সেন
করুণ চোখে বন্ধু গৌতমের দিকে চাইলেন।
“আমি উপস্থিত থাকার সময় নো পার্সোনাল অ্যাটাক। মিসেস
মল্লিকা, আপনি কি জানেন কারা কারা পাওয়ার কাটের পাঁচ-সাত মিনিট সময়ের মধ্যে বাইরে
বেরিয়ে আবার হলে ফিরে এসেছিলেন?”
“না। তখন এত অন্ধকার ছিল,
মোবাইলের আলোতেও বাচ্চাদের ছোটাছুটি আর ধাক্কাধাক্কির মধ্যে অত খেয়াল করতে
পারিনি।”
“তার প্রয়োজনও নেই। এখন আর কোনও কথা নয়। জেরার সময়
আপনারা যা দেখেছেন বা বুঝেছেন সব বলবেন, তার থেকে সত্যিমিথ্যে বেছে নেওয়ার দায়
আমার। আমার তদন্ত পদ্ধতিটা একটু অন্যরকম। তল্লাশির মতো অন্ধকারে হাতড়ানো পদ্ধতিতে
আমি বিশ্বাসী নই। যে অপরাধী, তাকে সরাসরি চিহ্নিত করতে পারলে আর ‘beating about the bush’ অপ্রয়োজনীয়।”
।। ৩।।
শালিনীর সঙ্গে কথা বলে তারপর শ্রীপর্ণা
প্রতিশ্রুতি মতো ডাকল অরিন্দমকে। দোতলায় শালিনীর স্টাডি-রুমেই জেরার ব্যবস্থা
হয়েছে। বাবুলাল হলঘর থেকে একজন একজন করে ডেকে দেবার দায়িত্বে আছে। ক্যাটারিংয়ের
অন্য চার-পাঁচটি ছেলে খাবার দিতে শুরু করে দিয়েছে হলঘরেই। তবে কারোরই খাওয়ায় খুব
একটা আর মন নেই। পুলিশি জেরার ভয় সবাইকেই গ্রাস করেছে।
“যখন অন্ধকার হয়ে গেল আপনি তখন কী করছিলেন, অরিন্দমবাবু?”
“শালু আসলে আমার সারা মুখে পেস্ট্রি মাখিয়ে দিয়েছিল। আমি টিস্যু পেপারে সেটাই মুছছিলাম, এসময়েই সমস্ত
অন্ধকার হয়ে যায়।”
“অন্ধকার হয়ে যেতে কী করলেন?”
“প্রথমে ভেবেছিলাম, এখুনি ইনভার্টার চালু হয়ে যাবে। তার মধ্যেই শালুর চিৎকার
শুনলাম। আমি ওর থেকে খানিকটা দূরেই ছিলাম। ওর চিৎকারে ভয় পেয়ে অন্যান্য বাচ্চাগুলো
ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছিল। আমাকেই দুটো বাচ্চা এসে ধাক্কা মারে। মোবাইলের ফ্ল্যাশের আলোয় দেখতে চেষ্টা
করলাম কী ব্যাপার। কিন্তু কেক কাটাকে কেন্দ্র করে সবাই হলঘরে জমায়েত হয়েছিল, ফলে
ওই ভিড়ের মধ্যে একেবারে দিশাহারা ব্যাপার আর কী!”
“কাউকে ঘর থেকে বেরোতে বা ঢুকতে দেখেছিলেন কি?”
“না, ম্যাডাম।”
অরিন্দম বেরোতেই শ্রীপর্ণা বাবুলালকে জেরার জন্য ডেকে নিল। বাবুলাল রীতিমতো ভয়ে কাঁপতে
কাঁপতে ঘরে এল এবং বসতে বলা সত্ত্বেও দাঁড়িয়েই রইল।
“যখন আলো চলে যায় তুমি কোথায় ছিলে, বাবুলাল?”
“বাবুর সিগারেটের প্যাকেট শেষ হয়ে গেছিল, আমি দোকান থেকে আনতে
গেছিলাম। যখন বাড়ির দিকে আসছি, দেখলাম সমস্ত বাড়ি অন্ধকার। অথচ আশেপাশের বাড়িগুলোয়, দোকানপাট, আর রাস্তায়
সর্বত্র আলো আছে।”
“তুমি কী করলে তখন?”
“একতলার দরজাটা আমি ভেজিয়ে গেছিলাম। কোনওরকমে হাতড়ে
হাতড়ে ভেতরে ঢুকলাম। ক্যাটারিংয়ের ছেলেগুলো তখন কেউ লাইটার, কেউ
মোবাইলে আলো জ্বালিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। আমার ঘরে একটা টর্চ থাকে। আমি কোনওরকমে
আমার ঘর থেকে টর্চ নিয়ে এলাম। আমি দিদিভাই, একটু আধটু ইলেকট্রিকের কাজ জানি। আমার
সন্দেহ হল, এটা আমাদের বাড়ির লাইনের কোনও সমস্যা। কারণ, আর কোথাও লোডশেডিং হয়নি। তাই আমি সিঁড়ির নিচে
বাড়ির মেইনটা চেক করতে গেলাম। দেখি, মেইন স্যুইচ বন্ধ করা। আমিই ওটা অন করে দিই,
আর আলো এসে যায়।”
“ও, তাহলে চোর নয়, তুমি মেইন অন করেছ। একথা বাবুকে বলোনি কেন?”
“কখন বলব, দিদিভাই? যেই আলো জ্বলল, শালুদিদির চিৎকার, বাবু, মেমসাহেবের
চিৎকার, বাবুর কাছে শুনি, দিদিভাইয়ের লকেট চুরি হয়ে গেছে। আর তখনই তো বাবু ছুটল
থানায়, ওসব কথা আর খেয়াল নেই।”
“আচ্ছা, ইনভার্টারের পাওয়ার স্যুইচটা যে অফ করা ছিল, সেটা খেয়াল করেছিলে?”
“তাই নাকি? না তো দিদিভাই, আমার চোখ তো ছিল মেইন স্যুইচের দিকে। আর টর্চের
আলোয় সবদিক দেখাও যায় না।”
বাবুলাল বেরিয়ে গিয়ে নন্দিনীকে পাঠিয়ে দিল শ্রীপর্ণার কাছে। নন্দিনী শাড়ির আঁচলটা আঙুলে পাকাতে পাকাতে দাঁড়িয়ে রইল
চেয়ারের সামনে।
“যখন আলো চলে যায় তখন তুমি কী করছিলে?”
“শালিনীদিদির কেক কাটার সময় হলঘরেই ছিলাম। বিকেল থেকে বড্ড গা-টা গোলাচ্ছিল,
মাথা ধরেছিল। দিদিভাই
একটুকরো কেক মুখে দিয়ে দিচ্ছিল। তা, সেটা আমি খাইনি। ওটা হাতে করে এনে আমার ঘরে
রাখতে ঢুকেছি, অমনি সব অন্ধকার হয়ে গেল। আমার আবার দিদি, অন্ধকারে বড়ো ভয়। মোবাইলের টর্চটা জ্বালিয়ে ঘরেই বসেছিলাম।
ঘর থেকে বেরোতেই ভয় লাগছিল। এখন তো তেমন লোডশেডিং বড়ো একটা হয় না, ভাবলাম এই বুঝি
আলো চলে আসবে। একটু বসেই থাকি। তা মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই চলে এল তো।”
“তোমার ঘর থেকে বারান্দায় সন্দেহজনক কিছু দেখোনি?”
“সে তো ঘন অন্ধকার দিদি, মাঝে মাঝে কারও কারও মোবাইলের আলোর ঝলকানি শুধু।
কিন্তু অত বড়ো বারান্দা, সে আলো কোথায় হারিয়ে যাচ্ছিল।”
“তোমার আঙুল কাটল কী করে?”
“আর বলেন কেন, দিদি। আজ দুপুরে কাপড় সেলাই করতে গিয়ে ছুঁচ ফুটে গেছে।”
।। ৪।।
জেরা সাময়িক স্থগিত আছে। শ্রীপর্ণা
বাবুলালের সঙ্গে পুরো একতলাটা আরেকবার ঘুরে দেখছে। সিঁড়ির একপাশে বাবুলালের ঘর,
আরেক পাশে নন্দিনীর। তার পাশেই দুটো পরপর বাথরুম-পায়খানা। এরপাশেই একটা ছোটো স্টোর-রুম।
রান্নাঘরে ক্যাটারিংয়ের কয়েকটি ছেলে খাবারের বাটি, গামলার সামনে জটলা করে নিজেদের
মধ্যে কথা বলছিল। শ্রীপর্ণাকে দেখে চুপ করে যায়। ওদের সবারই মুখেচোখে আতঙ্ক।
“পাওয়ার কাটের সময় তোমাদের কে কে হলঘরে কেক সার্ভ করছিলে?”
“আমি আর ও, মানে, বিকাশ তখন হলের ভেতরে ছিলাম কেকের ট্রে নিয়ে, ম্যাডাম। আলো নিভে যেতে চুপ করে দাঁড়িয়ে
যাই একটা সোফার পাশে। সেখানেই ছিলাম একভাবে আলো আবার জ্বলে ওঠা অবধি।”
“বিকাশ, তোমার কথা বলো।”
“আমি সামনে একটা টেবিল পেয়ে ট্রেটাকে নামিয়ে রাখি। তার মধ্যেই কোনও একটা
বাচ্চা ‘আমার লকেট’ বলে খুব জোরে চেঁচিয়ে ওঠে। ওর চিৎকারের পরেই অন্য বাচ্চাগুলো
এদিক ওদিক ছোটাছুটি, ধাক্কাধাক্কি করতে শুরু করে ভয়ে। আমি ম্যাডাম দরজার কাছেই ছিলাম।
একটা অন্ধকারের ডেলা মনে হল ছুটে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। তবে আমার ভুল হতে পারে, অত
অন্ধকার...”
শ্রীপর্ণা আবার দোতলায় শালিনীর স্টাডি-রুমে গিয়ে জেরা শুরু করল। একে একে শালিনীর মা, বাবা, দিদা,
দুই মাসি, গৌতমবাবুর কর্মচারীদের, শালিনীর বন্ধুদের, তাদের মা-বাবাদের ক্রমান্বয়ে
জেরা করে গেল। কিন্তু কারোর কাছ থেকেই কোনওরকম ক্লু পাওয়া গেল না। ঘন অন্ধকারে
ভিড়ের মধ্যে না কেউ চুরি করতে দেখেছে, না পালাতে।
“ম্যাডাম, কিছুই তো সূত্র মিলল না যা দিয়ে চোর কে হতে পারে সে সম্বন্ধে
বিন্দুমাত্র ধারণা করা যায়।”
“জয়িতা, জেরা মানে জাস্ট কতগুলো প্রশ্ন করা নয়। এর অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ
দিক আছে। তোমার প্রশ্ন শুনে উত্তরদাতার প্রতিক্রিয়া, উত্তর দেবার সময় উত্তরদাতার
কনফিডেন্স লেভেল, সে ফাম্বল করছে কি না, দু’জন উত্তরদাতার উত্তরের মধ্যে দ্বন্দ্ব,
উত্তরদাতার কোনও বিষয়ে সদর্থক বিশ্লেষণ, জেরায় বেরিয়ে আসা কোনও নতুন অজানা তথ্য
ইত্যাদি বহু জরুরি জিনিস তদন্তকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বিশেষ সাহায্য করে। তুমি সবাইকে
হলঘরে জমা কর। থানায় ফোন করে বিকাশবাবু আর রাখালদাকে চলে আসতে বল। within 15 to 30 minutes I shall unveil the mystery,
get ready for arrest. আমি জাস্ট একটু ঘুরে আসছি।”
।। ৫।।
পুরো বাড়ি এখন হলঘরে। ক্যাটারিংয়ের
ছেলেগুলোকেও ডেকে নেওয়া হয়েছে সেখানে। হলঘরের বাইরে প্রহরায় বিকাশবাবু আর
রাখালবাবু। সবাই উদ্বেগ নিয়ে শুকনো মুখে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে। কেউই বুঝতে
পারছে না, শ্রীপর্ণা তাদের ঠিক কী বলতে চান।
“আপনারা সকলেই বেশ উদ্বেগে আছেন, সেটা আপনাদের মুখ দেখেই বুঝতে পারছি।
তাছাড়া আপনারা অনেকক্ষণ আটকেও আছেন। যাক, আপনাদের আর বেশি সময় নেব না। শুধু আমি
আপনাদের ওপেন কয়েকটা প্রশ্ন করব। আলো চলে যাবার পরে যে অন্ধকারে আপনারা হলঘরে আপনাদের পাশের লোকটিকেই সঠিক
ঠাহর করতে পারছিলেন না, সেখানে ওই ঘন অন্ধকারে আলো নেভার মুহূর্তের মধ্যে কেউ
শালিনীর লকেটটা ছিনিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল কী করে? ঘটনাটা এতটাই দ্রুত এবং আলো নেভার সঙ্গে
সঙ্গেই ঘটানো হয়েছিল, যে তখনও ঘরের অতিথিরা কেউ দিশাহারা ভাবটাই কাটিয়ে উঠতে
পারেনি। কীভাবে ঘটল এটা?”
সারা ঘরে গুঞ্জন। সত্যিই এর উত্তর সেভাবে চোর ছাড়া আর কারোর কাছেই নেই।
“জানি আপনারা এর ব্যাখ্যা দিতে পারবেন না,” শ্রীপর্ণা আবার বলতে শুরু করে,
“আমি এবার শালিনীকে কয়েকটা প্রশ্ন করব, যার অনেকগুলোই আমি আগেও একবার ওকে করেছি
এবং লকেট খুঁজে বার করতে ওর উত্তরগুলো আমায় খুব সাহায্য করেছে। আপনাদের অবগতির
জন্য আমি ওকে প্রশ্নগুলো আবার করছি।”
“শালিনী, মনে করে বলো, যখন পাওয়ার কাট হয় তুমি ঠিক কী করছিলে?”
“আমি পম্পা, মাম্পি, লিজা, অহনা, ওদের নিয়ে হলের মাঝের টেবিলে রাখা একটা
গিফট প্যাক খুলছিলাম।”
“ওই বাচ্চারা ছাড়া তোমার আশেপাশে আর কেউ ছিল?”
“হ্যাঁ, বড়োমাসি, পিসি, রায়-আন্টি, দত্তগুপ্ত-আন্টি
ছিল। আর কেউও থাকতে পারে, খেয়াল করিনি।”
“গুড। অন্ধকার হওয়ামাত্র কেউ তোমার
লকেট ছিনিয়ে নিল?”
“প্রায় সঙ্গে সঙ্গে, আর মুহূর্তে অন্ধকারে মিশে গেল।”
“আচ্ছা, ঠিক সেই মুহূর্তে কোনও বিশেষধরনের গন্ধ
পেয়েছিলে?”
“হ্যাঁ, দিদুন আর রায়-আন্টি যেমন জর্দা খায় ওই ধরনের
গন্ধ। লোকটা অন্ধকারে মিশে গেল আর গন্ধটাও হারিয়ে গেল।”
“চমৎকার। আচ্ছা, তোমার গলার ঐ যে খুব সুন্দর একটা হার
ঝুলছে, ওর পুঁতিগুলো ফ্লুরসেন্ট ম্যাটেরিয়ালে তৈরি, তাই না? অন্ধকারে কি পুঁতিগুলো
উজ্জ্বল হয়ে থাকে, দেখতে পাওয়া যায়?”
“হ্যাঁ শ্রীপর্ণামাসি, আমার খুব পছন্দ
হয়েছে এটা।”
“হারটা তোমায় কে উপহার দিয়েছেন আজ?”
“রায়-আন্টি।”
“আচ্ছা, গণেশের লকেটটা কি ওই মালার উপরে পরেছিলে, না নিচে?”
“আরে, রায়-আন্টি নিজের হাতে ওটা আমায় পরিয়ে দেন। তবে গণেশের
অত্যন্ত শুভ ওই লকেটটা যাতে ওর জন্য ঢাকা পড়ে না যায় তাই নিজে গণেশের লকেটটা খুলে
ওই হারটা আগে পরিয়ে দেন, আর তার উপরে লকেট।”
“আচ্ছা, তোমার রায়-আন্টির কালো রঙ কি খুব পছন্দ? যেমন
আজ কালো রঙের শাড়ি, ম্যাচিং ব্লাউজ, এমনকি গলার পুঁতির হার, কানের দুল, কপালের টিপ
সব কালো!”
“কে জানে মাসি, আন্টির তো প্রিয় রঙ সাদা। সবসময় সাদা
বা ঘিয়ে ঘেঁষা সালোয়ার, শাড়ি, হার, দুল পরেন। এমনকি ওঁদের গাড়িটাও সাদা রঙের। আজই
প্রথম ওঁকে কালো জিনিস পরতে দেখলাম। তাছাড়া আন্টির দুই হাতেই তিনটে করে সোনার চুড়ি
ছিল। আজই কেন জানি না চুড়িগুলো হাতে দেখতে পাচ্ছি না, আন্টি খুলে রেখেছেন।”
“আচ্ছা শালু, নন্দিনীদি শুধু তোমাদের বাড়িতেই থাকে,
রান্না করে?”
“হ্যাঁ, এতদিন তাই করছিল। তবে গত দু’মাস হল রায়-আন্টির রান্নার দিদিটা কাজ ছেড়ে
দিয়েছে। রায়-আন্টিরা তো আমাদের পাড়াতেই থাকে। তাই মা বলল, ওঁদের অসুবিধা হচ্ছে,
যতদিন না ওঁরা আরেকজন রাঁধুনি পাচ্ছেন, নন্দিনীদি ওখানে একবেলা অন্তত রান্না করে
দিয়ে আসুক।”
“শালু, আজ দুপুরে নন্দিনীর যে ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা কেটে
গেছে, তুমি জানো? তুমি সাদা কাপড় বেঁধে দিয়েছিলে?”
“ও মা, কই না তো! সেটা কী করে হবে? আমি দিদিকে যখন কেক
খাওয়াতে গেলাম, দিদি বাধা দিয়েছিল, বলেছিল শরীর ভালো নেই। আমার হাত থেকে কেকটা ডান হাতেই তো নিয়েছিল, কোনও
ব্যান্ডেজ ছিল না। আমি স্পষ্ট দেখেছি।”
“Well, thanks
Shalini, তোমাকে আমার আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। এই ঘরে উপস্থিত
সবাই আমাদের প্রশ্নোত্তরের থেকে হালকা একটা আভাস পেয়েছেন বলেই আমার বিশ্বাস। আর
চোরেরা হয়তো পালানোর রাস্তা খুঁজছেন। কিন্তু, হা হতোস্মি! এই ঘর থেকে পালানোর সব পথ
বন্ধ। তাই চুপচাপ আমি এবার যে কথাগুলো বলছি, শুনে যান। ওই ঘন অন্ধকারে মোবাইলের
ফ্ল্যাশের আলো জ্বলে ওঠার বা সবার চোখ সয়ে যাবার আগেই চোর চুরি করে লকেটটা
হস্তান্তর করতে চেয়েছিল। সেক্ষেত্রে তাকে শালিনীর একদম কাছে, শালিনীর দিকে স্থিরদৃষ্টি
রেখে দাঁড়িয়ে থাকা জরুরি ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ-বিষয়ে আমারই মতো চোরেরও সন্দেহ
ছিল, অন্ধকারে লকেটটার সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা আদৌ যাবে কি না। আর একটুও নিশানা
ভুল হবার অর্থ সুযোগ হাতছাড়া করা, এমনকি ধরা পড়ে যাবার সম্ভবনা। সুতরাং এমন কিছু
করতে হবে যাতে অব্যর্থ নিশানায় একটানে সেকেন্ডের ভগ্নাংশে ওটা ছিনিয়ে নিয়ে শাগরেদের
হাতে তুলে দেওয়া যায়। আর তার অমোঘ পথটি যে কী, তা আপনারা এখুনি শালিনীর মুখে
শুনেছেন। গণেশের
লকেটের ঠিক নিচেই ছিল উজ্জ্বল ওই মালা, যা অন্ধকারেও লকেটের অবস্থান নির্দেশ করছিল। জর্দার নেশাটা রায়-গিন্নির অনেকদিনের। লকেটটা কাড়তে
গিয়ে শালিনীর খুব কাছে এসেছিলেন তিনি, আর তখনি গন্ধটা শালু পেয়েছিল। অনেক সময়েই রহস্য সমাধানের চাবিকাঠি লুকিয়ে থাকে শব্দ,
গন্ধ আর বর্ণের মধ্যে। সাদা রঙ এমন এক রঙ যা অন্ধকারেও একটু চোখ সয়ে গেলে চোখে
পড়ে। অন্ধকারে মিশে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো রঙ কালো। আর তাই সাদার বদলে আজ কালো বেশে
রায়-গিন্নি। লকেট কেড়ে নেওয়ার সময় চুড়িতে চুড়িতে লেগে শব্দ হতে
পারে, তাতে শালু চুরির পিছনে কোনও মেয়ের হাত থাকার কথা মনে করতে পারে, তাই হাতের
চুড়ি বাড়িতে খুলে রেখে আজ মিসেস রায় মাটির ট্রেন্ডি গয়না পরেছেন।
“বাবুলাল বেরিয়েছে। ক্যাটারিংয়ের
ছেলেগুলোও ডাইনিংয়ের দিকে, কেক কাটার পর বাকি সবাই হলঘরে। নন্দিনীর ঠিক ঘরের
সামনেই সিঁড়ির তলায় মেন স্যুইচ, ইনভার্টার। চারদিক দেখে নিয়ে এই সুযোগে নন্দিনী ওই দুটো স্যুইচই বন্ধ করে দিল। এবার হলঘরের মুখে এসে মিসেস
রায়ের থেকে নিল লকেটটা। নন্দিনীর ঘরের পাশের বাথরুমের পিছনে সুইপারের ঢোকার দরজা।
জেরার সময় নন্দিনী আমায় বলল, ও পাওয়ার কাটের সময় থেকেই নিজের ঘরে আছে আলো জ্বলে
ওঠা অবধি। ওর
ঘরের সামনেই সিঁড়ির তলার অংশ। বাবুলাল মেইন স্যুইচ অন করল আর ও দেখতেই পেল না? তার
মানে ও আমায় মিথ্যা বলেছে। বাবুলাল যখন মেইন অন করে, তখন ও আশেপাশে কোথাও ছিল না। বাথরুমের
পিছনের দরজাটা দেখলাম ভেজানো রয়েছে মাত্র। ভিতর থেকে বন্ধ নেই। বাথরুমের মেঝেতে
কাদা পায়ের ছাপ আর ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ে রয়েছে। বাগানের বৃষ্টিভেজা নরম মাটিতে
পায়ের ছাপ অনুসরণ করে এগিয়ে পৌঁছলাম পাঁচিলের গা বরাবর রাখা একটা বড়ো গোলাপের টবের
সামনে। পায়ের ছাপটা সেখানে গভীর, মানে এখানে দাঁড়িয়ে ছিল কেউ। টবের মাটি এলোমেলো,
তাড়াহুড়োয় খুঁড়ে আবার বোজানো হয়েছে। পাশে খুরপিতে টাটকা মাটি লেগে। গোলাপ পাতার
উপরে পড়ে আছে টাটকা রক্তের ফোঁটা।”
শ্রীপর্ণা একটু থামে। সারা ঘরে গুঞ্জন। মিসেস রায় আর নন্দিনী মুখে হাতচাপা দিয়ে মাথা নিচু করে
বসে। নন্দিনী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মিসেস রায়ের মেয়ে মাম্পি এখনও ঠিক ব্যাপারটা
ধরতে পারেনি, তাই অবাক হয়ে মায়ের মুখটা হাতের ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে।
শ্রীপর্ণা হাতে গ্লাভস পরে নেয়। তারপর পকেট থেকে বার করে আনে ওর দলা পাকানো
রুমাল। আর তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে পান্না আর হীরকখচিত সোনার গণেশ মূর্তি; দক্ষ পুলিশ অফিসারের
যোগ্য হাতে পুনরাবির্ভাব ঘটে সিদ্ধিদাতার।
_____
অলঙ্করণঃ সুমিত রায়
দারুণ লেখা, তবে চুরির মোটিভটাও বললে আরো ভালো হত।
ReplyDeleteচমৎকার গোয়েন্দা গল্প। অপরাধ ঘটানোর উপায়, এবং অপরাধীকে চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া, দুটোতেই অভিনবত্ব আছে। শুধু মোটিভ এবং দল ভারি করার উপায় আরেকটু বিস্তৃত হওয়া দরকার ছিল।
ReplyDeleteআপনাকে অনেক ধন্যবাদ ঋজুদা। এত দ্রুত পাঠ প্রতিক্রিয়া পেয়ে আমি অভিভূত। এই গল্প যদি কোথাও সংকলিত হয়, তবে আপনার প্রশ্নের উত্তরগুলো সংযোজিত করে দেব অবশ্যই। ধন্যবাদ
Deleteআপনাকে অনেক ধন্যবাদ ঋজুদা। এত দ্রুত পাঠ প্রতিক্রিয়া পেয়ে আমি অভিভূত। এই গল্প যদি কোথাও সংকলিত হয়, তবে আপনার প্রশ্নের উত্তরগুলো সংযোজিত করে দেব অবশ্যই। ধন্যবাদ
Deleteঅনেক দিন পর একটা ভালো গল্প পড়ে খুব ভালো লাগলো,স্যার।
ReplyDeleteশ্রীপর্ণাকে তো আমার এমনিতেই খুব পছন্দ।খুব ভালো লেগেছে গল্পটা।শেষটা একটু বিস্তারিত হওয়ার সুযোগ ছিল,ঋজুদা যেটা বলল।আর পাঁচবছরের মেয়ের কথাগুলো আরেকটু শিশুসুলভ হলে ভালো লাগত।পরের গল্পের অপেক্ষায়।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
ReplyDeleteচোর ধরা পড়ল, চোরাই জিনিষ উদ্ধার হল, কিন্তু মোটিভ জানা না গেলে শ্রীপর্ণা ম্যাডাম চার্জ ফ্রেম করতে পারবেন তো???
ReplyDeletebeautiful analysis.elegant style.
ReplyDelete