হিউয়েন সাং-এর বাতিদান
দেবদত্তা ব্যানার্জী
।। এক।।
পূজাসংখ্যার লেখাটা শেষ করে দিঠি উঠে এসে বারান্দায় দাঁড়াল। জুনের শেষ, তবুও আকাশে তেমন মেঘ নেই। মাঝে মধ্যে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হচ্ছে, তবে গরম কমছে না। তিনটে নামকরা পত্রিকায় ওর গল্প যাবে এবার। এ ছাড়া নতুন দুটো ছোটো পত্রিকা লেখা চাইছে। সময় পেলে দেবে বলেছে ও।
আজ আবাসনের পূজা-কমিটির তরফ থেকে বাদলদা একটা লেখা চেয়েছেন আবার। নিচের পার্কের পাশের লনে খুঁটিপূজার তোড়জোড় চলছে। আগামীকাল রথযাত্রা। খুঁটিপূজা দিয়ে শারদোৎসবের সূচনা হবে। অয়নের আজ আবার ফিরতে দেরি হবে।
বাচ্চাগুলো পার্কে হুটোপুটি করছে। বেশ লাগছিল দেখতে। হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজে ড্রইংরুমের দিকে এগিয়ে যায় দিঠি। আই হোলে চোখ রেখে দেখে নিচের ফ্ল্যাটের
বড়ুয়াবৌদি। একটু অবাক হয়েই দরজা খুলে দেয় দিঠি।
বড়ুয়াদা সি.ই.এস.সি.তে কাজ করেন। বৌদি একটা বাচ্চাদের স্কুলে পড়ান। ওঁরা আসামের লোক। কথায় একটা হালকা টান আছে। খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া কারও সাথে মেশেন না। তবে এমনি খুব ভালো। দিঠি একটু হেসে ওঁকে ভেতরে আসতে বলল। সোফায় বসেই উনি অয়নের খোঁজ করলেন। আসতে রাত হবে শুনে একটু চিন্তিত মনে হল। দিঠি দুটো গ্লাসে আমপানা বানিয়ে এনে দেয়। বৌদিকে ভীষণ অন্যমনস্ক লাগছিল। দিঠি এক-দু’কথার পর বলে, “আপনি কিছু একটা সমস্যায় পড়েছেন বুঝতে পারছি। চাইলে আমায় খুলে বলতে পারেন।”
কিন্তু বড়ুয়াবৌদি একমনে ওয়াল
হ্যাঙ্গিংটার
দিকে তাকিয়ে থাকেন। ওটা কয়েকমাস আগে গ্যাংটক থেকে কিনেছিল দিঠি। একটা মনেস্ট্রির ছবি।
সরবতটা শেষ করেই উঠে পড়েন উনি। দিঠি বলে যে, অয়ন ফিরলে ও ফোন করবে। বৌদি বেরিয়ে যেতেই দিঠি ভাবতে বসে, ওনার কী এমন দরকার থাকতে পারে!
আবার কলিং বেলের আওয়াজে চমকে ওঠে দিঠি। ঘড়িতে রাত আটটা। অয়ন ফিরল বোধহয়। দিঠি দরজা খুলে দেয়। বিধ্বস্ত চেহারায় অয়ন ঘরে ফেরে। দিঠির এগিয়ে দেওয়া জলটুকু খেয়ে এসিটা ফুল করে দেয়। একটু পরে জামাকাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে বসতেই ফোনটা বেজে ওঠে। আননোন নম্বর। অয়ন ফোনটা নিয়ে বেডরুমে চলে যায়। টুকরো টুকরো কথা শুনে দিঠি বোঝে এটা ঐ বড়ুয়াদের বাড়ির কেউ ফোন করেছে। ফোনটা কাটার পর দিঠি বলে যে সন্ধ্যায়
বড়ুয়াবৌদি এসেছিলেন অয়নের খোঁজে। কিছুক্ষণের মধ্যে বড়ুয়াদা, বৌদি দু’জনেই চলে আসেন। দিঠি এবার স্প্রাইটের বোতল খোলে।
অয়ন ওঁদের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমাকে খুলে বলতে পারেন যে কোনও সমস্যা। এতবার করে যখন আসছেন, নিশ্চয়ই গুরুতর দরকার।”
ওরা দু’জন মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। বড়ুয়াদা বলেন, “আসলে ক’দিন ধরে একটা প্রবলেমে ফেঁসে গেছি, ভাই। কী করব বুঝতে পারছি না। তাই আপনার কাছে এলাম। আপনাদের চেনা-পরিচিতি প্রচুর। কী করা উচিত যদি...” এটুকু বলেই উনি স্ত্রীর দিকে তাকালেন।
বৌদি বললেন, “আসলে পৈতৃক সূত্রে আমি কিছু সম্পত্তির অধিকারিণী হয়েছি একমাস হল। তারপর থেকেই কিছু বিরক্তিকর ফোন আসা শুরু হয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত আমার এক কাকাকে নিয়ে।”
এটুকু বলে উনি আবার ঐ ওয়াল
হ্যাঙ্গিংটায়
মন দিলেন। অয়ন বুঝতে পারছিল, ওনারা একটা দোলাচলে রয়েছেন। ও একটা স্প্রাইটের গ্লাস তুলে নিয়ে বলল, “আপনি বলুন। আমি শুনছি।”
দিঠি ওঁদের হাতে গ্লাস তুলে দিয়ে ছোটো কৌচটায় বসল। হাতে ফোন।
“আমরা বুদ্ধের উপাসক, জানো নিশ্চয়ই। আমার জন্ম অরুণাচলে, বমডিলায়। আমার এক কাকা তাওয়াংয়ে থেকে তিব্বতি ভাষার উপর গবেষণা করতেন। বিয়ে করেননি। ছুটিছাটায় বাড়ি আসতেন। আমায় খুব ভালোবাসতেন। এরপর হঠাৎ কাকা বহুদিন তিব্বতে চলে যান। লামাদের সঙ্গে মিশে হিমালয়ের দুর্গম স্থানে যেসব বৌদ্ধ মঠ আছে সে সব ঘুরে বেড়াতেন উনি। আমি বিয়ের পর কলকাতা চলে আসি। শ্বশুরবাড়ি অবশ্য তেজপুর। বহুদিন কাকার সাথে কোনও যোগাযোগ ছিল না। পাঁচবছর আগে বাবা-মা একটা দুর্ঘটনায় মারা যেতে কাকার খোঁজ পাই। কাকা সে সময় বমডিলার সম্পত্তি আমার অনুমতি নিয়ে বিক্রি করে কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট কেনে। আমিই চেয়েছিলাম কাকা এখানে থাকুক। কিন্তু কাকা ঘুরেই বেড়াতেন। সিংহল থেকে লাদাখ, তিব্বত থেকে চিন - কোথায় যাননি তিনি।
“ছ’মাস আগে কলকাতায় এসে ফ্ল্যাটে বসবাস শুরু করেন। তার দু’মাসের মাথায় আমাকে একদিন ডেকে বলেছিলেন, যদি ওঁর কিছু হয়ে যায় একটা জিনিস আমায় তাওয়াং
মনেস্ট্রিতে
প্রধান লামা চিপার হাতে পৌঁছে দিতে হবে। একটা জুতোর বাক্সর মতো কালো চ্যাপ্টা বাক্স দেখান আমাকে এবং বলেন শত প্রলোভনেও ওটা বিক্রি না করতে। তাহলে পাপের ছোঁয়া লাগবে সংসারে। ওঁর পক্ষে নাকি তাওয়াং যাওয়া সম্ভব নয়। শত্রু রয়েছে চারদিকে। বাক্সটা পেপার দিয়ে মুড়ে আমায় দিয়ে দেন তিনি এবং বলেন লকারে রাখতে যতদিন ফেরত দিতে না পারি।
“আমি বাক্সটা এনে আলমারিতে রেখেছিলাম। এরপর কাকা আবার কোথাও চলে যান। মোবাইল ব্যবহার করতেন না। তাই খোঁজ পেতাম না। একমাস আগে উনি ফোনে জানতে চান কাজটা করেছি কি না। আমি তো ভুলেই গেছিলাম। বললাম, একটু সময় লাগবে। পূজার ছুটিতে যাব।
“তার তিনদিন পর খবর এল, কাকা কলকাতার এক হাসপাতালে ভর্তি। একটা গাড়ির নিচে পড়েছিলেন কোনওভাবে। হাসপাতালে যেতেই কাকা ওটা কোথায় আছে জানতে চাইলেন। মিথ্যা বললাম যে লকারে রাখা আছে। কাকা শান্তিতে চোখ বুজলেন। বললেন, ওনার সব সম্পত্তির মালিক আমি। কিন্তু এই বাক্স তাওয়াং
মনেস্ট্রির সম্পত্তি। ওখানে যে প্রধান লামা রয়েছেন, তার হাতে ঐ বাক্স তুলে দিলেই আমার দায়িত্ব শেষ। সেদিন রাতেই কাকা মারা যান। আর অদ্ভুতভাবে পরদিন কাকার ফ্ল্যাটে চুরি হয়। কী কী চুরি গেছে জানি না। আমরা তো সবসময় যেতাম না। তবে কাকা ডায়েরি লিখতেন জানতাম। হসপিটালেও ওঁর সঙ্গে একটা ডায়েরি ছিল। পুরনো ডায়েরিগুলো আমি পাইনি। টাকাপয়সা সব ব্যাঙ্কে ছিল। বাড়িতে কিছুই তেমন ছিল না চুরি যাওয়ার মতো। পাশের ফ্ল্যাটের লোক ঘরে টর্চের আলো দেখে নিচে সিকিউরিটিকে ফোন করেছিল মাঝরাতে। সিকিউরিটি এসে দেখে ঘর বন্ধ, কিন্তু কোলাপসিবলের তালা ভাঙা।
“আমাদের পরদিন খবর দিতেই গিয়ে দেখি সারা ফ্ল্যাট লন্ডভন্ড। বুঝতে পারি, কেউ ঐ বাক্সের খোঁজ করছিল। ভেবেছিলাম, কাকার শোক-কাজ মিটে গেলেই রেখে আসব ওটা। কী আছে জানতাম না। এর মধ্যেই একটা ফোন আসে। এক ভদ্রলোক মিঃ গুপ্তা কাকার রেফারেন্স দিয়ে একটা জিনিস কিনতে চায়। কাকার কাছে নাকি একটা বহু পুরনো পুঁথি ও বাতিদান ছিল। আমি এ-ব্যাপারে কিছু জানি না বলেছি। এর পরের দিন আবার একটা ফোন আসে। আমাকে ঐ বাক্সটার জন্য তিন লক্ষ টাকা দেবে বলে প্রস্তাব দেয় এক চাইনিজ ভদ্রমহিলা, নাম সু-তাং-লাই। ওতে নাকি কীসব পুঁথি আর বাতিদান রয়েছে। আমি বলেছি, কিছু বিক্রি করব না।
“কিন্তু কৌতূহল হচ্ছিল খুব। বাক্সটা খুলে দেখি একটা বহু প্রাচীন তিব্বতি ভাষায় লেখা পুঁথি ও একটা খুব সুদৃশ্য রত্নখচিত সোনার বাতিদান রয়েছে। আর একটা তিব্বতি ভাষায় লেখা চিঠি। আমি সব গুছিয়ে তুলে রাখি।
“ইতিমধ্যে ঐ চাইনিজ মহিলা আরও তিনবার ফোন করেছিলেন। দশ লক্ষ টাকা দেবেন বলেছেন। শেষবার একটু থ্রেট করেছেন।”
এতক্ষণ একভাবে কথা বলে বৌদি
হাঁপিয়ে গেছিলেন। স্প্রাইটের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বড়ুয়াদার দিকে তাকান।
বড়ুয়াদা বলেন,
“আমি পরশু তাওয়াং যাব ভেবে গৌহাটির টিকিট কেটেছি। কিন্তু কাল থেকে আমাদের কাছে এক অদ্ভুত ফোন আসছে। নাম বলেনি। ঐ পুঁথি আর বাতিদান না দিলে আমাদের একমাত্র ছেলেকে তুলে নেবে বলেছে। পুলিশে গেলে আরও ক্ষতি করে দেবে বলেছে। ওর কাকার মৃত্যু নাকি স্বাভাবিক ছিল না, একথাও বলেছে। আমরা পাত্তা দিইনি।
“আজ সকালে আমাদের ছেলে দীপকে আঁকার ক্লাসে ছেড়ে বাজারে গেছি। ও একাও যায় আঁকার ক্লাসে। আমাদের আবাসনের বাইরেই, ঐ বাজারের দিকে যেতে ডানদিকের গলির শেষ বাড়ি। বাজার করে ফিরছিলাম, আবার ফোন। আমায় বলল, যদি বাক্সটা না দিই দীপ আর বাড়ি ফিরবে না। আমি তাড়াতাড়ি আঁকার মিসের বাড়ি গিয়ে শুনি ছেলে আসেনি। অথচ আমি গলির মুখে বাইকে করে নামিয়ে দিয়ে বাজার গেছিলাম। ছুটতে ছুটতে বাড়ি এসে দেখি ছেলে বাড়িতে। বলছে, গেটের কাছে একটা আঙ্কেল ওকে বলেছে, আজ মিস ছুটি দিয়েছে। সেই লোকটা ওকে বাড়িও পৌঁছে দিয়েছে গাড়িতে করে।
“এমন সময় আবার ফোন। বলল যে, এবার তো ছেলে বাড়ি ফিরেছে, জিনিসটা না দিলে আর ফিরবে না। ইতিমধ্যে আজ আরেক টিবেটিয়ান ভদ্রলোক মিঃ খুংসু লামা দুপুরে সোজা বাড়ি এসে হাজির। বলেন, জিনিসটা একবার দেখবেন। ঐ পুঁথি নাকি হিউয়েন সাং-এর সময়কার। ঐ বাতিদান
প্রাগজ্যোতিষপুরের
মহারাজ হিউয়েন সাংকে উপহার দিয়েছিলেন।
পুঁথিটাতে হিউয়েন সাং-এর পূর্বভারত ভ্রমণের ঘটনা লিপিবদ্ধ রয়েছে। এগুলো হিমালয়ের কোনও বহু পুরনো মঠে অবহেলায় পড়েছিল। সেই মঠের প্রধান এগুলো সংরক্ষণ করে তাওয়াং
মনেস্ট্রিতে
পাঠাতে চেয়েছিলেন। ওঁর কাকা প্রভাত লিংপা ঐ মঠে ছিলেন বেশ কিছুদিন। তাই ওঁর হাতে এগুলো দিয়েছিলেন ঐ মঠের প্রধান লামা। আমরা যদি চাই উনি জিনিসগুলো তাওয়াং পৌঁছে দিতে পারেন। প্রচুর অসৎ লোক ওগুলোর খোঁজে ঘুরছে। কাকাকেও ওরাই মেরেছে। তাই উনি ওগুলোর খোঁজ করছেন। আমি বলি, জিনিসগুলো বাড়িতে নেই, লকারে রয়েছে। উনি দু’দিন পর আসবেন বলেছেন।”
“এখন জিনিসগুলো আর আপনাদের ছেলে দীপ কোথায়?” দিঠি জানতে চায়।
“দীপকে বিকেলে আমার দাদার বাড়ি দমদমে পাঠিয়ে দিয়েছি। দাদার ছেলে আর ওর এক স্কুল। এক ক্লাস। ক’দিন ওখানেই রাখব। আর জিনিসটা এই যে...” বলে উনি একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে একটা জুতোর বাক্সর মতো চ্যাপ্টা বাক্স বের করে খুললেন।
একটা বহু প্রাচীন ক্ষয়ে যাওয়া হাতে লেখা পুঁথি। আর বেশ সুন্দর চুনি, পান্না, আরও কতরকম রত্নখচিত বাতিদান। একটা চার ইঞ্চি
স্ট্যান্ডের
ওপর বাতিদানটা বসানো। এর মধ্যে প্রদীপ বা মোম দিয়ে জ্বালাতে হবে। বহু পুরনো
অ্যান্টিক জিনিস হলেও জৌলুস একটুকুও কমেনি।
অয়ন হাতে নিয়ে ভালো করে লক্ষ করে বলল, “এটার আর্থিক মূল্য কত আমরা জানি না। সত্যি হিউয়েন সাং-এর কি না, তাও জানি না। তবে ঐতিহাসিক মূল্য যে অনেক, তা জানি। এখন কী করবেন ভাবছেন?”
“আমাদের একটা অনুরোধ ছিল। আমরা দু’জন এটা নিয়ে তাওয়াং যেতে সাহস পাচ্ছি না। আপনি যদি
মূল্যবান সময় নষ্ট করে একটু আমাদের সঙ্গে যান, খুব ভালো হয়। সকালের ফ্লাইটে গৌহাটি। পবনহংসের হেলিকপ্টারে দেড় ঘণ্টায় তাওয়াং। আপনি চাইলে পরদিন ফিরে আসবেন। আমরা বমডিলা আর তেজপুর ঘুরে দু-চারদিন পরে ফিরব।”
অয়ন ঘুরতে যেতে বরাবর ভালোবাসে। জার্নালিস্ট হওয়ার সুবাদে ওর প্রচুর ঘোরাও হয়। তাওয়াং গেছিল ২০১১ সালে। ওখানকার
মুখ্যমন্ত্রী
হেলিকপ্টার ভেঙে পড়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন, সে সময় খবরের সন্ধানে। তখনও দিঠির সঙ্গে বিয়েটা হয়নি, আর কাজের ফাঁকে ঘোরাও হয়নি সেবার।
মুখ্যমন্ত্রীর মৃত্যুতে সারা পাহাড়ে ছিল শোকের ছোঁয়া। অফিসে যদি কী কারণে যাচ্ছে বলে, অফিস থেকেই সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এত বড়ো একটা খবর গোপনীয়তা বজায় রেখে করতে পারাই তো বিরাট ব্যাপার।
ক’দিন আগেই তাওয়াং
মনেস্ট্রি থেকে
ন’শো বছরের পুরনো তেরতন ‘পেমা লিংপা’ মূর্তি চুরি গেছিল। অবশ্য দিল্লি পুলিশের তৎপরতায় ডিসিপি ক্রাইম মধুর বর্মার জন্য সে মূর্তিসমেত ধরা পড়ে প্রধান লামা চিপার প্রাক্তন জামাই ও প্রেমিকা। তাওয়াং মনেস্ট্রিকে নিয়ে এ-মুহূর্তে খবর করলে তা হট কেক। তাই অয়ন একটু চিন্তা করে নিয়ে বলে, “আমি একটু অফিসে কথা বলেই জানাচ্ছি।”
ফোনটা নিয়ে উঠে যায় ভেতর-ঘরে। দিঠি
পুঁথিটা দেখছিল। ধরতে ভয় লাগে। ঝুরঝুরে প্রায়, কোনও গাছের ছাল মনে হয়। লেখাগুলো সেই সিকিমে যে হোলি ফ্ল্যাগ দেখেছিল সারা পাহাড়জুড়ে, সেরকম অনেকটা। বাতিদানটা সত্যিই খুব সুন্দর।
একটু পরেই হাসিমুখে অয়ন এ-ঘরে এসে বলে, “সব
ব্যবস্থা পাকা। আমরা দু’জনেই যাচ্ছি।”
“তাহলে এখনই আপনাদের টিকিট...”
বড়ুয়াদা কথা শেষ করার আগেই অয়ন বলে, “আমাদের সব খরচ অফিসের। শুধু ফিরে এসে ঘটনাটা নিয়ে আমি একটা স্টোরি করব। আপনাদের ফটো আর নাম থাকবে তাতে। আপনাদের থেকে এটুকু সহযোগিতা পাব নিশ্চয়ই।”
“আপনারা দু’জন যাবেন, এ তো ভালো কথা। কিন্তু
ম্যাডামের খরচাটা তাহলে আমরা দিই।” বড়ুয়াদা আবার বলে ওঠেন।
“ওর লেখা ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা, বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোচনা আমাদের পেপারে বের হয়। তাই বস বলেছে, ওকে অফিসিয়ালি পাঠানো হচ্ছে আমার সাথে। ও লেখাটা কভার করবে। পরশু সকালে ফ্লাইট। এয়ার ইন্ডিয়া। ওখান থেকে পবনহংসের কপ্টারে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধমঠে পৌঁছে যাব।” অয়ন বলে।
“কিন্তু জিনিসটা ওঁদের ঘরে রাখা কি সেফ? ওটা যদি ওঁরা বিশ্বাস করেন, আমাদের ঘরেই থাক এই দু’দিন।” দিঠি বলে ওঠে।
বড়ুয়াবৌদি বলেন, “আমরাও তাই চাইছি। আপনারা যদি এটা রাখেন, রাত দু’টো নিশ্চিন্তে শুতে পারব।”
আর একটু আলোচনার পর ওঁরা চলে গেলেন। অয়ন বাক্সটা নিয়ে বেডরুমের লকারে রাখল। দিঠি ভাবছিল, এই জুনের শেষে তাওয়াংয়ে ঠাণ্ডা হবে নিশ্চয়ই। সিকিম ঘুরে শীতের পোশাক সব ধুতে পাঠিয়েছিল। পরের দিন নিয়ে আসতে হবে। টুকটাক জিনিস সব গুছিয়ে নিল রাতেই।
।। দুই।।
পরদিন সকালেই বাসিমুখে আবার বড়ুয়াদা এসে হাজির। রাতে নাকি আবার ফোন এসেছিল ঐ চাইনিজ মহিলার। এই বাতিদান নাকি ওঁর চাই। উনি যে কোনও মূল্যে এটা নিতে চাইছেন। রীতিমতো জীবন নাশের থ্রেট দিচ্ছেন।
অয়ন একটু চিন্তিত হয়ে বলল, “সবক’টা ফোন নম্বর আমায় দিন। আমি দেখছি।”
বড়ুয়াদা নম্বর দিতেই অয়ন তার বন্ধু ঋষিকে লালবাজারে ফোন করে ব্যাপারটা জানাল।
দুপুরে অয়ন সেদিন বাড়ি ফিরে আসে। দিঠি লন্ড্রি ঘুরে এসে গোছগাছে ব্যস্ত। হঠাৎ একটা চ্যাঁচামেচি শোনা গেল নিচের ফ্লোরে। অয়ন নিচে নেমেই দেখে বড়ুয়াদাদের ঘরের সামনে জটলা। দাদা সকালে সাড়ে ন’টায় অফিসে গেছিলেন। বৌদি আটটায় বেরিয়ে গেছিলেন স্কুলে। দুটোয় ফিরেই দেখেন ফ্ল্যাটের লক ভাঙা। সিকিউরিটি বলছে, কেউ ঢোকেনি। অথচ লক ভাঙা শুধু নয়, ঘরেও সব লন্ডভন্ড। দিঠিও নেমে এসেছিল। অয়ন ওকে ঘরে যেতে বলে।
অনেক খোঁজ নিয়ে সিসিটিভি দেখে যা বোঝা গেল, খুঁটিপূজার উৎসবের জন্য সেদিন প্রচুর বাইরের লোক, ডেকরেটার্সের লোক এসব ঢুকেছিল। আবার ঈদের জন্য কিছু মুসলিম পরিবারের প্রচুর
গেস্ট এসেছিল। বোরখা পরেও অনেকে এসেছিল। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে আগন্তুক।
অয়নকে বৌদি বলেছিলেন, কিছুই চুরি হয়নি। অয়ন বলে, বাকি সময়টুকু সাবধানে থাকতে।
এর মধ্যে ঋষি খবর দিয়েছে, ঐ মহিলা সু-তাং-লাই একজন বিশাল বড়ো
অ্যান্টিক ব্যবসায়ী। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল। কিন্তু ওঁকে ছোঁয়া যায় না, এতটাই ধূর্ত। এই মুহূর্তে উনি দিল্লিতে রয়েছেন বলে খবর আছে। প্রমাণ নেই বলে ধরতে পারব না। ফোনের টাওয়ার লোকেশন বলছে কাল উনি ট্যাংরায় ছিলেন। আর মিঃ গুপ্তা কলকাতার একজন কিউরিও ডিলার। তবে ঐ খুংসু লামার কোনও খবর পাওয়া গেল না। আর যে একটা আননোন নম্বর থেকে থ্রেট আসছিল, সেটা কোনও লোকাল ক্রিমিনালের দলের। হাতকাটা ভেরু ঐ ছেলেটার নাম। টাকা নিয়ে ওর দল কিডন্যাপ টু মার্ডার, সব করে।
অয়ন থম মেরে বসে ছিল। প্রতিপক্ষ একজনের বেশি। সবাই ক্ষমতাবান। রাতে অয়ন বড়ুয়াদাদের ওর ফ্ল্যাটে থাকতে বলেছিল। কারণ, ভোর সাড়ে তিনটায় বের হতে হবে ওদের। সন্ধ্যায় আবার ফোন এসেছিল ঐ ভেরুর। ফোনটা অয়ন নিয়ে বলেছিল, “ভাই ভেরু, এই কেসটা ছেড়ে দাও। খামোখা তোমার বদনাম হবে। জিনিসটা ওঁদের কাছে নেই।”
ওপাশ থেকে জবাব আসে, “কোনও কেস ছাড়িনি। এটাও ছাড়ব না। দেখে নিচ্ছি সবাইকে।”
দিঠি বলে, “দীপের কী খবর? ওর স্কুল যাওয়াটা কি খুব জরুরি এ ক’দিন?”
“আসলে কাল-পরশু ওর স্কুল ছুটি। ঐ ঈদ, রথ একদিনে পড়েছে বলে ছুটি বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের কাজ মিটে গেলে ওকে এ-বাড়ি আনব। এমনিতে আমার দাদার বাড়ি সেফ। ও বাড়ির গাড়িতে স্কুল যাবে। স্কুল আবার ভীষণ স্ট্রিক্ট এসব ব্যাপারে।” বড়ুয়াদা বলেন।
পরদিন সকালে সবাই ঠিকঠাক এয়ারপোর্ট পৌঁছে যায়। দিঠি কিছু গণ্ডগোল আশা করেছিল। কিছুই হল না। ফ্লাইট যখন মেঘের বুক চিরে উড়ে চলেছিল, দিঠির ভাবনাও ডানা মেলেছিল। ঝড়ের আগে চারপাশ যেমন শান্ত হয়ে ওঠে, ওর মন বলছিল তেমন কিছু হতে চলেছে। ওদের মাত্র দুটো লাগেজ। একটা প্লেনের পেটে গেছে আরেকটা সাথে রয়েছে। এয়ারপোর্ট ম্যানেজার দিঠির মামাতো দাদা। তাই ফটাফট সব হয়ে গেছে। দিঠি ভয় পাচ্ছিল যে ঐ রত্নখচিত বাতিদান স্ক্যানিংয়ে আটকে না দেয়। অয়ন এসব ব্যাপারে এক্সপার্ট। সব ঠিকঠাক হয়ে গেছিল। বাইরে সাদা মেঘ ভেদ করে কিছু পাহাড়চূড়া দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। দিঠিদের পাশের সিট ফাঁকা। ওধারে জানালায় বৌদি, আর মাঝের সিটে বড়ুয়াদা। অন্যটা ফাঁকা। দিঠি একবার উঠে দাঁড়িয়ে দেখে প্রচুর সিট ফাঁকা যাচ্ছে। বাকি যাত্রীদের মধ্যে তিনজন মণিপুর বা অরুণাচলের লোক। একজন চিনা মনে হয়। আর বাকিরা অসমীয়া মনে হয়। অবশ্য এদিকে সবাইকেই দিঠির একরকম লাগে। পার্থক্য বোঝা যায় না।
হঠাৎ এক ভদ্রলোক চলন্ত ফ্লাইটে উঠে এসে বড়ুয়াদার পাশে এসে বসলেন এবং নিচু স্বরে ওঁকে কিছু বললেন। অয়ন একটা ম্যাগাজিন দেখছিল। কান সজাগ থাকলেও ও কিছুই শুনতে পেল না। দিঠি দেখছিল, বড়ুয়াদার চোয়াল ঝুলে পড়েছে। ফর্সা মুখ সাদা হয়ে রক্তশূন্য। একটু পরে ভদ্রলোক চলে যেতেই বড়ুয়াদা উঠে অয়নের পাশে এলেন। বললেন, “এই লোকটা ঐ সু-তাং-লাইয়ের সেক্রেটারি। উনি এখনও আশা করছেন জিনিসটা আমরা ওনাকে দিয়ে দেব। টাকাটা উনি
ব্যাঙ্কে দিয়ে দেবেন বলছেন। চাইলে ক্যাশেও দেবেন।”
“উনি একা নন, ঐ গুপ্তাও এই ফ্লাইটেই আছেন। আমার যদি ভুল না হয়, মিঃ লামাও আছেন। সবাই আপনার সঙ্গে যাচ্ছে।” অয়ন গম্ভীর হয়ে বলে। “তবে ফ্লাইটে আপনি সেফ। আপনার জিনিসও সেফ।”
বিরস বদনে বড়ুয়াদা নিজের সিটে ফিরে যান। বৌদি ওদিকে ঘুমিয়ে কাদা।
একটু পরেই মেঘে আচ্ছন্ন গৌহাটি এয়ারপোর্টের উপর চক্কর কাটতে লাগল বিমান। দিঠিরা সিট বেল্ট বেঁধে তৈরি। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার জন্য কিছুতেই বিমান অবতরণ করতে পারছিল না। কুড়ি মিনিট চক্কর কাটার পর ফ্লাইটকে জোরহাট পাঠিয়ে দেওয়া হল। অয়ন এবং বড়ুয়াদা দু’জনেই চিন্তিত। জোরহাট ছোট্ট এয়ারপোর্ট। ওরা লাগেজের জন্য কনভেয়ার বেল্টের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। আবার ঐ ফ্লাইটের লোকটা এসে বড়ুয়াদার
সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছিল। কয়েকজন মাত্র যাত্রী। লোকটি চলে যেতেই খেয়াল হল দিঠির মেরুন সুটকেসটা আসেনি। ফাঁকা কনভেয়ার বেল্ট। সবাই যে যার লাগেজ নামিয়ে চলে যাচ্ছে। দিঠিদের মেরুন সুটকেস কোথাও নেই। অয়ন টিকিটের পার্ট নিয়ে অফিসে দেখা করল। ওঁরা দেখছেন বলে দৌড়াদৌড়ি শুরু হল। প্লেনের কিছু যাত্রী নামেনি। তারা কলকাতা ব্যাক করবে এই ফ্লাইটেই। অথবা আকাশ পরিষ্কার হলে যদি প্লেন গৌহাটি যায় তাই ওয়েট করছে। অয়ন নিজের আই কার্ড দেখাতেই এয়ারপোর্ট ম্যানেজার ছুটে এসেছেন। ওদের বসিয়ে
সুটকেসের খোঁজ চলছে। দিঠি জানত, ঐ সুটকেসেই সেই বাতিদান আছে। তাই বড়ুয়াদাদের কী বলবে ভাবছিল। ওঁরাও চিন্তিত।
অবশেষে ম্যানেজার এসে অনেক দুঃখ প্রকাশ করলেন। ওঁদের বক্তব্য, লাগেজটা কলকাতাতেই থেকে গেছে মনে হচ্ছে। দিঠি নিজের দাদাকে এয়ারপোর্টে ফোন করে দিয়েছে ততক্ষণে। এদিকে অয়ন ফোনের পর ফোন করে যাচ্ছে।
বড়ুয়াদা এসে বললেন, “এখান থেকে তাওয়াংয়ের হেলিকপ্টার সার্ভিস নেই। তাছাড়া এই ওয়েদারে কেউ কপ্টার নিয়ে যেতেও চাইছে না। আমাদের সড়কপথে যেতে হবে মনে হচ্ছে।”
অয়ন বলল, “আমার অফিস গাড়ির ব্যবস্থা করেছে। এখনই এসে যাবে। তবে আজ আমাদের ভালুকপঙে থাকতে হবে। কারণ, বৃষ্টিতে রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। কাল খুব ভোরে রওনা দিলে বিকেলে পৌঁছে যাব আশা করি।”
মুষলধারে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ওদের স্কর্পিও ছুটে চলেছে চা-বাগানের বুক চিরে। সুটকেস আর পাওয়া যায়নি।
বড়ুয়াদার কাছে ফোন আসাও বন্ধ হয়েছে। অয়ন একবার বলেছিল, “ঐ লোকটা এয়ারপোর্টে আপনাকে কী বলল?”
বড়ুয়াদা রুমাল দিয়ে ঘাম মুছে বললেন, “ওরা আমাকে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চাইল। যা ওরা চাইছিল পেয়ে গেছে। আমাদের ভ্রমণ আনন্দময় হয়ে উঠুক, এও বলল।”
চা-বাগানের পর এবার দু’ধারে সবুজ ধানিজমি ও মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো গ্রাম। কিন্তু দিঠির এখন একটাই চিন্তা, সুটকেসের মধ্যে পুঁথি ও বাতিদানটা ছিল। সবসুদ্ধু চুরি হয়ে গেল! ওদের জামাকাপড়গুলোও গেল। অবশ্য অন্য ব্যাগেও কাজ চালাবার মতো জামাকাপড় আছে। শীতের জিনিসগুলোই সুটকেসে ছিল।
বড়ুয়াদা, বৌদি সব বুঝতে পেরেও কোনও প্রশ্ন করেননি। অসম্ভব চুপচাপ। সবার মন খারাপ।
বিকেলে ওরা ভালুকপঙ পৌঁছে দেখে বৃষ্টিতে পথ এমনিই বন্ধ। প্রচুর টুরিস্ট আটকে গেছে। হোটেল নেই বললেই চলে। সকালেই অয়ন অফিসে বলে দিয়েছিল আসাম
গভর্নমেন্টের
গেস্ট হাউসে ওর জন্য দুটো রুম রাখতে। জিয়া-ভরালি নদীর তীরে একটা টিলার উপর খুব সুন্দর এই গেস্ট হাউসটা। ওরা একটা ডুপ্লেক্স কটেজ পেয়েছিল। শেষবেলায় হঠাৎ মেঘ কেটে সূর্য দেখা দিতেই অয়ন ছুটল
ক্যামেরা নিয়ে নদীর ফটো তুলতে। দিঠির কিছুই ভালো লাগছিল না। এমন হতে পারে ও কখনও ভাবেইনি। এখন আর তাওয়াং গিয়ে কী লাভ ও ভেবেই পায় না।
সন্ধ্যা নেমে আসছে প্রকৃতির বুকে। গোধূলির কনে দেখা আলোয় নদীর বুকে পাখির ফটো তুলতে ব্যস্ত অয়ন। দিঠি ওকে বলে, “জিনিসটাই যখন চুরি হয়ে গেল, আমদের আর গিয়ে কী হবে ওখানে? মনটাই ভেঙে গেছে। ওদের বলে বাড়ি ফিরে চল।”
অয়ন একমনে ফটো তুলতেই থাকে। বলে, “আমরা ঘুরতে যাচ্ছি। বুঝলে?”
সন্ধ্যায় বড়ুয়াদা আর বৌদি ওদের ঘরে ছুটে আসেন। বড়ুয়াদা বলেন, “আচ্ছা, জিনিসটা কোথায়? ঠিক আছে তো? আবার ফোন করেছিল সু-তাং। খুব রেগে গেছে। বলছে, আসল বাতিদান ওর চাই যেভাবেই হোক।”
অয়ন হাসে। বলে, “তাহলে আমার সুটকেস চুরি করেও ওদের লাভ হয়নি?”
“কিন্তু তুমি ওটা সুটকেসেই রেখেছিলে।
স্ক্যানিংয়ে
আমি দেখেছি ওরকম কিছু। মেয়েটাও দেখছিল অবাক হয়ে।” দিঠি বলে।
“ও সেটাই দেখছিল যতটুকু ওকে আমি দেখিয়েছি।” অয়ন গম্ভীর হয়ে বলে। “আসল জিনিস একদম ঠিক আছে।”
দিঠির মনে পড়ে এবার, ব্যাগ গুছিয়েছিল অয়ন। জামাকাপড়ও বেশি বেশি নিচ্ছিল। ভালো জিনিস সব নিজেদের সাথে যে ব্যাগটা তাতে রেখেছিল। তবে কি ও জানত যে এমন হতে পারে!
অয়ন বলে, “সবাই তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ুন। কাল ভোরে রওনা না দিলে তাওয়াং পৌঁছনো যাবে না।”
দশটার মধ্যে সবাই শুয়ে পড়ল। ওদিকে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। এ যেন মহাপ্রলয় আসন্ন।
কিন্তু পরদিন সকালে উঠে ওরা শুনল বৃষ্টিতে ধ্বস পড়ে রাস্তা বন্ধ দশ কিমি আগে। তাই গাড়ি যাচ্ছে না। ওদিক থেকে গাড়ি এলে তবেই এরা রওনা দেবে। অয়ন ড্রাইভারকে বলল, “সামনে টিপির অর্কিড গার্ডেন অবধি চল। ততক্ষণে রাস্তা খুলে যাবে দেখবে।”
ভারতের মধ্যে হলেও সীমান্তবর্তী রাজ্য বলে অরুণাচলেও ইনার লাইন পারমিট লাগে। বড়ুয়াবৌদিরও লাগল। কারণ, এখন উনি কলকাতার লোক। অয়ন সব বানিয়ে এনেছিল ‘অরুণাচল ভবন’ থেকে। সেসব গেটে দেখিয়ে ওদের গাড়ি প্রবেশ করল সূর্যোদয়ের রাজ্যে। ভারতের প্রথম সূর্য ওঠে এই অরুণাচলেই।
টিপিতে অর্কিড গার্ডেনে একটা কলসপত্রী গাছ দেখছিল অয়ন মন দিয়ে। মাংসাশী গাছটা কী নিষ্পাপ, স্নিগ্ধ, সুন্দর! দিঠি রঙবেরঙের অর্কিড দেখতে ব্যস্ত। বড়ুয়াবৌদি ছেলের সঙ্গে কথা বলছেন ফোনে। বড়ুয়াদা রাস্তার খোঁজ করছিলেন যে কখন রওনা দেওয়া যাবে। উল্টোদিক থেকে ভারী ভারী মিলটারি ট্রাক নামছিল। ড্রাইভার বলল যে রাস্তা খুললেও নিচের থেকে অন্তত একটা দুটো গাড়ি আগে যাক, তারপর ও যাবে।
অবশেষে দশটায় দিঠিদের গাড়ি এগিয়ে চলল। ড্রাইভার পাসাং অরুণাচলের ছেলে। বাড়ি দিরাং-এ। প্রথম প্রায় দশ কিমি রাস্তা কুয়াশাচ্ছন্ন।
কাঁচা মাটির কাদা প্যাচপ্যাচে রাস্তায় একহাত দূরের কিছু দেখা যায় না। সরু রাস্তার একদিকে খাড়া পাহাড়, অন্যদিকে খরস্রোতা জিয়া-ভরালি নদী ছুটে চলেছে। এ এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। হঠাৎ করে একটা পাহাড় পার হতেই ঝকঝকে সুন্দর রোদ ঝলমলে পাহাড়। রাস্তাও অনেক ভালো। পাসাং গাড়ি চালিয়ে দিল বেশ জোরে। দিঠি ভাবছিল সুটকেসের কথা। ওদের অন্য ব্যাগে বাতিদান নেই। সুটকেসে না থাকলে বাকি থাকল অয়নের পিঠের ব্যাগ। ওতে ল্যাপটপ, ক্যামেরা এসব আছে। তবে কি ওর ভেতর রেখেছে অয়ন!
সামনেই টেঙ্গা ভ্যালি। খুব সুন্দর সাজানো গোছানো এক মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট এরিয়া। ফুলে ফুলে সাজানো। বাচ্চারা সব স্কুল যাচ্ছে। পরিষ্কার ছবির মতো সুন্দর। গাড়ি ছুটে চলেছে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে। ছোটো ছোটো গ্ৰাম পার হয়ে ওপরে উঠছে। সঙ্গী সেই নদী। লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে গিরিখাত দিয়ে বয়ে চলেছে। কোথাও রাস্তার সমতলে উঠে এসেছে। তবে পাহাড়গুলো রুক্ষ হয়ে উঠেছে, গাছপালা কম। ভেড়ার দল পথ আটকাল কয়েকবার। একধরনের হলুদ
ক্যাকটাস ফুল একটু দূরে দূরেই ফুটে রয়েছে। তিন ঘন্টা একভাবে চলার পর ওরা দাঁড়াতে বাধ্য হল। আবার ধ্বস নেমেছে। এ পথে গাড়ির সংখ্যা কম। পনেরোই জুনের পর বর্ষা শুরু হয়ে যায় বলে টুরিস্টও কম। যারা আসে হেলিকপ্টারেই আসে বেশি। পাসাং বলল যে এখানেই শাহরুখ-মাধুরীর সেই বিখ্যাত ছবি কোয়লার শুটিং হয়েছিল। একটা লেকের নাম তো মাধুরীর নাচের জন্য বদলে মাধুরী লেক হয়ে গেছে।
অয়ন ওর ফোনে নেট আসছে না দেখে বিরক্ত। বড়ুয়াদা আর বৌদি দু’জনেই কম কথা বলে। তবে এই পথে এসে বৌদির অনেক ছোটোবেলার কথা মনে পড়ছে। সামনেই বমডিলায় কেটেছে বৌদির ছোটোবেলা।
প্রায় দু’ঘন্টা পরে রাস্তা পরিষ্কার হলেও আকাশের কোণে কালো মেঘের সাজসজ্জা দেখে পাসাং বলল যে মনে হয় না আজ আর তাওয়াং পৌঁছানো হবে। দিঠি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার একটা বই খুলে বসেছিল। কিন্তু গাড়ির ঝাঁকানি আর রাস্তার শার্প টার্নিংয়ে মনোনিবেশ করতে পারছিল না। এভাবেই বেশ কিছুটা পথ পার করে ওরা পৌঁছল মেঘের দেশ বমডিলায়। বৌদি ফিরে গেলেন নিজের কৈশোরে। গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়েছে সবাই। সুন্দর ছিমছাম পাহাড়ি শহর বমডিলা। বৌদির সঙ্গে তাদের বাড়িতে গেল
সবাই। যদিও বেশ কয়েকবছর আগেই বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছিল। তবে কিনেছেন বৌদিদের এক আত্মীয়। তাই দিঠিদের খুব যত্ন করে আপ্যায়ন করে বসালেন। দিঠি তাকিয়ে তাকিয়ে ঘরের সৌন্দর্য দেখছিল। টিবেটিয়ান স্টাইলে সাজানো ঘর। অপূর্ব সব শো-পিস, ছবি, ওয়াল
হ্যাঙ্গিং। ঘরটা একটা টিলার ওপর। বড়ো কাচের জানালা দিয়ে মেঘের দলের আসা যাওয়া দেখতে দেখতে অয়ন গরম কফিতে চুমুক দিচ্ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই নামল বৃষ্টি। আকাশ ভেঙে পড়বে মনে হচ্ছিল। বড়ুয়াদা বললেন, “তাহলে কি আজ এখানেই থেকে যাব? কারণ, এখনও প্রচুর রাস্তা বাকি।”
বৌদি তো খুব খুশি। বহু বছর পর নিজের বাড়িতে ফিরেছেন। যদিও বাড়ির অনেক অংশ বদলে গেছে, তবুও বৌদির ঘরটা একইরকম আছে। একটা অতলস্পর্শী খাদের উপর ঝুলন্ত কাঠের ঘরে বৌদি থাকতেন। বারান্দায় দাঁড়ালে চোখ জুড়িয়ে যায়। বৌদির আত্মীয়ের বাড়ি হঠাৎ এসেও বেশ জমিয়ে দুপুরের খাবার পাওয়া গেল। একটু পরেই বৃষ্টি কমে আবার সূর্য দেখা দিল। ঘড়ির কাঁটায় চারটা। এদিকে সূর্য যেমন ওঠেও সবার আগে, ডোবেও তাড়াতাড়ি। তাই আর সেদিন তাওয়াং পৌঁছানোর সম্ভাবনা নেই। এগিয়ে গেলে দিরাং-এ থাকতে হবে। তাও পৌঁছতে রাত হবে। সবাই রাতটা এখানেই কাটাতে চাইছিল।
বড়ুয়াবৌদি বললেন, “বমডিলা
মনেস্ট্রিও খুব সুন্দর। এছাড়া একটা মিউজিয়াম আছে এখানে।”
সবাই চলল বৌদির সঙ্গে বমডিলায় ঘুরতে। মনেস্ট্রিটা বেশ বড়ো, তবে নতুন। সঙ্গে স্কুল, চিকিৎসালয়, গেস্ট হাউস সব রয়েছে। বেশ কিছু অল্পবয়স্ক লামার দেখা পাওয়া গেল। অয়ন তাদের সঙ্গে গল্প করতে শুরু করেছিল। বৌদির কাকাকে এখানে সবাই চেনে এবং খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করে জানা গেল। ওঁর
মৃত্যুতে সবাই
ব্যথিত। খুব গুণী মানুষ ছিলেন।
মিউজিয়ামে ঘোরার সময় হঠাৎ বড়ুয়াদার ফোনটা বেজে উঠল। হঠাৎ নেটওয়ার্ক এসেছে। কিন্তু বড়ুয়াদার চোখমুখের বদল বলে দিল যে তিনি এ ফোনে খুশি হননি। ফোনটা কাটতেই অয়ন বলল, “সু-তাং আপনাকে ধমকাল আবার?”
অবাক হয়ে তাকালেন বড়ুয়াদা। বললেন, “আপনি শুনতে পেলেন এত দূর থেকে?”
“না, শুনিনি। তবে আন্দাজ করেছিলাম। সু-তাং-এর হাত বহু লম্বা। ও ইন্টারন্যাশনাল অপরাধী। কলকাতা এয়ারপোর্টে ওর প্রচুর লোক। ঐ পেমা লিংপা ও কিনতে চেয়েছিল। না পেয়ে এখন বাতিদানে নজর। পেমা লিংপার বাজার দর দেড় কোটি। এই বাতিদান তার চেয়েও পুরনো। ও যে জিনিসটা ওখানেই হস্তগত করতে চাইবে জানতাম। তাই ইচ্ছা করে চিনাবাজার ঘুরে একটা পিতলের বাতিদান কিনেছিলাম। ওটাই সুটকেসে রেখেছিলাম। স্ক্যানিং-এ মেটালটা কী ওরা বোঝেনি। ওদের বলা ছিল এমন কিছু যে লাগেজে থাকবে সেটা আলাদা করে রাখতে। ওরা আমার সুটকেস ওখানেই সরিয়ে ফেলেছিল। জিনিস বের করে হয়তো পরের ফ্লাইটে পাঠিয়েও দিয়েছে। এইসব লোকেরা সু-তাং-এর কেনা গোলাম। এদের দিয়েই স্মাগলিং হয়।
“যাই হোক, পিতলের বাতিদান কাল পেয়ে গেছিল। তবে আমাদের দুর্বল নেটওয়ার্ক, তাই যোগাযোগ করতে পারেনি। অবশ্য ও শিওর ছিল না যে জিনিসটা প্লেনের পেটে যাবে নাকি
হ্যান্ড লাগেজে। তবে ঐ জিনিস
হ্যান্ড লাগেজে আটকে যেতে পারে। তবুও ও একটা লোককে প্লেনে পাঠিয়েছিল। যদি জিনিসটা
হ্যান্ড লাগেজে ধরা পড়ত, ও হয়তো প্লেনেই ওটা চুরি করত। প্লেন
ল্যান্ড করার পর ওর কাছে খবর আসে কাজ ঠিকমতো হয়ে গেছে। তাই ও ফিরে যায়। যাই হোক, গুপ্তার লোক কিন্তু আশা ছাড়েনি। কাল ভালুকপঙে আমাদের ঘরে চোর ঢোকার চেষ্টা হয়েছিল। আমি তৎপর থাকায় ঢোকেনি।
“তবে গুপ্তাও কাল শুনেছে সুটকেস হারানোর কথা। ও ভাবছে, তাহলে জিনিসটা ওর
প্রতিদ্বন্দ্বী
পেয়ে গেছে বোধহয়। কিন্তু আমরা তাও তাওয়াং যাচ্ছি দেখে ও অবাক। তাই ওর লোক আমাদের ফলো করছে। ঐ গাড়ির আড়ালে চোখ রাখুন। প্লেনে ছিল ঐ লোকটা। কাল ভালুকপঙেও ছিল। আমরা না হয় আত্মীয়ের বাড়ি আছে বলে বমডিলায় থাকলাম। ও তো দিরাং পৌঁছে যেতেই পারত। নর্মাল টুরিস্টরা দিরাং-এ থাকে প্রথমদিন। ফেরার সময় বমডিলা হয়ে ফেরে। ও আপনাদের আত্মীয়ের যে তাশিডাং গেস্ট হাউস, ওখানে উঠেছে। আমি খেয়াল করেছি। রাতটা ঘটনাবহুল হতে চলেছে।”
অয়নের কথায় দিঠিও লোকটাকে দেখতে পায়।
রাতে বৌদি নিজের পুরানো ঘরে থাকলেও অয়নদের তাশিডাং-এর একটা রুম খুলে দিল বৌদির মাসতুতো দাদা। এই হোটেলটা ওদের। দিঠি অয়নকে এতক্ষণে একা পেয়ে বলল, “আসল জিনিসটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছ আমায়ও বলবে না!”
“হে মহান লেখিকা, আপনি আপনার কল্পনাচক্ষে উহা পর্যবেক্ষণ করুন। তাহলেই বুঝিব আপনার বুদ্ধি এই অধমের সাথে থাকিয়া পরিপক্ব হইতেছে।” অয়ন কপট গাম্ভীর্যে বলে উঠল।
রাতে ডিনারের পর ঘরে ফিরে দিঠি বুঝল ঘরে কেউ এসেছিল। অয়ন কিন্তু একটুকুও চিন্তিত নয় এ ব্যাপারে।
পরদিন এক
রৌদ্রোজ্জ্বল
দিনের শুরুতেই ওরা বেরিয়ে পড়ল তাওয়াং-এর উদ্দেশ্যে।
।। তিন।।
অসাধারণ সুন্দর
গ্ৰাম দিরাং। পাশে বয়ে চলেছে দিরাং নদী। সবুজ সতেজ পাহাড়ি গ্ৰামের লোকজন খুব হাসিখুশি।
পাসাং-এর বাড়ি এই গ্ৰামেই। ও চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু আজ তাওয়াং পৌঁছতেই
হবে বলে অয়ন রাজি হয়নি। বলেছিল ফেরার পথে ঢুকবে। দিঠি ভাবছিল, হেলিকপ্টারে এলে এই সুন্দর
জায়গাগুলো অদেখাই থেকে যেত। খুব ইচ্ছা করছিল কিছুটা সময় এই দিরাং-এ কাটাতে। কিন্তু
যে কাজে এসেছে তার গুরুত্ব চিন্তা করে ওরা এগিয়ে চলে পাহাড়ি পথে।
কিছুক্ষণ পরেই
পৌঁছে যায় সেলা পাশে। ১৩,০০০ ফিট উচ্চতায় মেঘে ঢাকা সেলা পাশ ও সেলা লেক দেখে দিঠি
অভিভূত। ঠাণ্ডা হওয়ায় শরীরের খোলা অংশ কেটে যাচ্ছিল। বমডিলা থেকে কেনা জ্যাকেট আর মাফলার,
টুপিতেও ঠাণ্ডা আটকানো যাচ্ছিল না। প্রিমুলা ফুলের কার্পেট আর সবুজ ঘাস-জমি পার করে
সবাই নেমে গেছিল লেকের ধারে। অয়ন তাড়া দেওয়ায় সবাই আবার গাড়িতে উঠে আসে।
গাড়ি এগিয়ে চলে।
হাওয়ায় ভেজা ভাব। সামনেই যশবন্তগড়। কদিন আগেই দিঠিরা সিকিমের বাবা-মন্দির ঘুরে এসেছিল।
গল্পটা সেই একইরকম রোমাঞ্চকর। এই ভদ্রলোক জীবনমৃত্যুর সীমানা ছাড়িয়ে সীমান্তে কর্তব্য
পালন করে যাচ্ছেন দিবারাত্র। সরকার এদের অস্তিত্ব মেনে নিয়েছে। বাবা-মন্দিরের মতো বড়ো
না হলেও এই মন্দিরটাও বিখ্যাত। এদিকে কর্তব্যরত সেনাবাহিনীর কাছে উনি মহানায়ক। পাশেই
ওয়ার মেমোরিয়াল। কফি, মোমো আর ডিমের অমলেট দিয়েই দুপুরের খাওয়া মিটিয়ে আবার পথ চলা
শুরু। পাসাং দূর থেকে দেখাল জং ফলস। অয়ন বলেছে সব দেখবে ফেরার পথে। নদী এখানে শীর্ণকায়
ও খরস্রোতা।
হঠাৎ দূরের পাহাড়ে
মৌমাছির চাকের মতো সাদা হলুদ তাওয়াং মনেস্ট্রি দেখাল পাসাং। বহুদূর থেকে এই মনেস্ট্রি
দেখা যায়। পাসাং জানাল, মহাকাশ থেকেও নাকি এই মনেস্ট্রি দেখা যায়। এই বিখ্যাত মনেস্ট্রির
অধিকারের দাবী জানিয়ে আসছে চিন। এই নিয়ে দিল্লিতে বহু চাপাচাপি চলছে। কূটনৈতিক চালে
ভারত এগিয়ে রয়েছে।
হঠাৎ একটা টাটা
সুমো দ্রুত গতিতে এসে পথ আটকাল পাসাং-এর গাড়ির। তিনজন আগন্তুকের একজন সেই প্লেনের লোকটা।
অয়ন সবাইকে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে বলেছে। ওদের একটাই দাবী, ঐ জিনিসদুটো ওদের চাই। অয়ন বলল
যে তাদের কাছে ঐ জিনিস নেই। কেউ মানতে রাজি নয়। আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে সবাইকে নামিয়ে
ওদের সবার ব্যাগ চেক করেও যখন ওরা কিছু পেল না হতাশ হয়ে সু-তাংকে ফোন করল লোকটা। এই
পথে গাড়ি খুব কম। হঠাৎ কয়েকটা মিলিটারি ট্রাকের আগমনে ওরা চটপট ফিরে গেল তাওয়াং-এর
দিকেই।
বড়ুয়াদার ফোনে
সু-তাং-এর ফোন। তবে ধরার আগেই সিগন্যাল লস্ট হয়ে গেল। পাসাং বেশ ঘাবড়ে গেছে। অয়ন বলল,
“কাল রাতে তবে গুপ্তার লোক এসেছিল আমাদের ঘরে।”
দিঠি বড়ুয়াদা-বৌদি
সবাই ভাবছে জিনিসটা তবে গেল কোথায়! তন্ন তন্ন করে খুঁজেও যখন ওটা পাওয়া গেল না, তার
মানে অয়নের সঙ্গে ওটা নেই। অয়ন তবে কি এসব বুঝে ওটা কলকাতাতেই ফেলে এল? তবে এইভাবে
এসে কী লাভ হল!
বিকেল বিকেল
সবাই তাওয়াং পৌঁছল। অয়নের অফিস থেকে গভর্নমেন্ট গেস্ট হাউস বুক করে দিয়েছিল। সবাই সেখানেই
উঠল। আগেরবারও অয়ন এখানেই উঠেছিল। ম্যানেজার ওর বন্ধু হয়ে গেছিল। এবার অয়ন আগেই ফোন
করে দিয়েছিল আসছে বলে। বেশ রাজকীয় ব্যবস্থা তাই সবার জন্য। অয়ন পৌঁছেই থানায় যোগাযোগ
করে রাস্তার ঘটনা জানিয়ে দিয়েছিল। গাড়ির নম্বর বলায় কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ ড্রাইভারকে
তুলে নিয়ে এল। কিন্তু ওর বক্তব্য, ওকে ভাড়া করেছে তেজপুর থেকে ঐ তিনজন। উঠেছে তাওয়াং
ভিউ হোটেলে। সেই হোটেলে গিয়েও পুলিশ ঐ তিনজনকে পেল না। তবে আশ্বাস দিল, এই ছোট্ট তাওয়াং
শহরে কারও পক্ষে লুকিয়ে থাকা সম্ভব নয়। ওরা ধরা পড়বেই।
রাতে এবার অয়নের
ফোনেই সু-তাং-এর ফোন এল। ও তখনও বলে যাচ্ছে, জিনিসটা ওর চাই। অয়ন বলল, “আপনার লোক তো
দেখেছে ওটা আমাদের কাছে নেই।”
সু-তাং কাটা
কাটা ইংরাজিতে বলে চলেছে, ঐ জিনিস না পেলে ও কাউকে কলকাতা ফিরতে দেবে না। অয়ন ইংরাজিতে
উত্তর দিল, “তাহলে জিনিসটা কোনওদিনও আর পাবেন না। ওটা আবার অন্ধকারেই চলে যাবে যেভাবে
এত বছর অন্ধকারে ছিল।”
রাতটা সবাইকে
অবাক করে নির্ঝঞ্ঝাট কাটল। সকালে সবাই রেডি হয়ে চলল মনেস্ট্রি দর্শনে। বিশাল মনেস্ট্রি।
বৌদি গাইডের কাজ করছিলেন। কাকার সঙ্গে বহুবার এসেছেন এখানে। একপাশে সবাই অধ্যয়ন করছে।
একদিকে ধ্যানমগ্ন লামার দল। বাতাসে ফুল, ধূপমিশ্রিত এক পবিত্র গন্ধ। বেশ কয়েকজন টুরিস্ট
ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রধান লামার সঙ্গে দেখা করবে বলে ওরা মন্দিরের চাতালে ওয়েট করছিল।
হঠাৎ তিনমূর্তির আগমন। সবাই লামার পোশাকে, চুল ছোটো করে ছাঁটা। প্রথমে অয়ন চিনতে পারেনি।
আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে ওদের একপাশে নিয়ে শুরু হল ব্যাগ তল্লাশি। কিন্তু যথারীতি কিছুই
পাওয়া গেল না। অয়ন আবার বলল, “জিনিসটার গুরুত্ব বুঝে ওটা আমি কলকাতায় রেখে এসেছি। আগে
নিশ্চিত হই এখানে ওটা নিরাপদে থাকবে, তবেই ওটা দিতে আসব।”
তিনজন দ্রুত
বাইরে বের হতেই সাদা পোশাকের পুলিশ ওদের ধরে ফেলল এবার।
প্রধান লামা
চিপা যথেষ্ট বিরক্ত একমাসেই বার বার পবিত্র প্রাঙ্গণে পুলিশের আগমনে। কয়েকদিন আগেই
প্রাক্তন জামাই চুরি করেছিল সেই তেরতন ‘পেমা লিংপা’ মূর্তি। তিব্বতি
বৌদ্ধধর্মের ভুটানি নিংগমা শাখার পাঁচজন রত্নাকর রাজার মধ্যে প্রধান হলেন পেমা লিংপা।
পদ্মসম্ভবের পরেই মর্যাদায় পেমা লিংপার স্থান বলে মানা হয়। তাওয়াং মঠের প্রধান সন্ন্যাসী
বা চিপার ঘরেই সযত্নে রাখা থাকত দ্বাদশ শতকে তৈরি মূর্তিটি। ৩১শে মে দরজা ভেঙে প্রাক্তন
জামাই গাওয়াং ঐ তেরতন চুরি করে প্রেমিকা গাকের সঙ্গে দিল্লি পালিয়ে গেছিল। দিল্লি পুলিশ
ওকে ধরে মূর্তি উদ্ধার করে।
বড়ুয়াবৌদি নিজের
পরিচয় দিতেই ওদের নিয়ে গিয়ে একটা ঘরে বসালেন লামা চিপা। বৌদি নিজেই পুরো ঘটনাটা বললেন।
চিপা বললেন যে লিংপা তাকে জানিয়েছিল জিনিসটার কথা। জিনিসটা বহু পুরনো। পুঁথিটা বৌদ্ধধর্মে
যে তন্ত্রসাধনা হত তার নিদর্শন। বাতিদানটি হিউয়েন সাং-এর পাণ্ডিত্যে তুষ্ট হয়ে তৎকালীন
কামরূপের মহারাজ ওনাকে দিয়েছিলেন। বহু হাত ঘুরে ওটা হিমালয়ের এক প্রাচীন মঠে ছিল। চিপা
একসময় সেই মঠে ছিলেন। উনি দেখেছেন জিনিসদুটো। তবে ঐ মঠের প্রধান বুঝতে পেরেছিলেন যে
জিনিসদুটো ওখানে সুরক্ষিত নয়। প্রথমে ধর্মশালার মঠে পাঠিয়েছিলেন উনি। লিংপা বুঝতে পেরেছিলেন,
ওখানেও ও-দুটো সুরক্ষিত নয়। তাই এখানে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঐ জিনিস ওঁর হস্তগত
হওয়ার পর ওঁর জীবন সংশয় দেখা দেয়। একবার গৌহাটি এসেও ওঁকে ফিরে যেতে হয় এদের জন্য।
বাধ্য হয়ে ও নিজের ভাইঝির হাতে দায়িত্ব দিয়ে ঐ দুষ্কৃতীদের ভুল পথে চালনা করেন। অবশেষে
জিনিসটা এসে পৌঁছল এখানে।
অয়ন বলে, “আপনার
কি মনে হয় জিনিসটা এখানে নিরাপদ?”
প্রধান লামার
মুখে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে ওঠে। উনি বলেন যে মঠ হল পবিত্র স্থান। প্রচুর প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য
মূল্যবান জিনিস রয়েছে এসব মঠে। তবে মানুষজন জানলেই বিপদ। লোভ মানুষের শত্রু। এই লোভ
বিপদ ডেকে আনে। তবে এই মঠেই মিউজিয়াম আছে যা সুরক্ষিত। সেখানেই রাখা হবে ঐ ঐতিহাসিক
বাতিদান ও পুঁথি।
দিঠি বলে, “সব
বুঝলাম। কিন্তু সেগুলো কোথায়? কলকাতায় ফেলে এসেছ বিশ্বাস হয় না আমার।”
সবাইকে অবাক
করে ও বাইরে বেরিয়ে যায়। একটু পরেই একটি ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে ঢোকে। দিঠির মনে পড়ে, এরা
একটু আগেও বাইরে ঘুরছিল টুরিস্টের মতো। এদের বোধহয় গেস্ট হাউসেও দেখেছিল কাল রাতে।
কিন্তু আগে কোথায় দেখেছে মনে করতে পারে না।
বড়ুয়াদা এবং
বৌদিও অবাক নতুন চরিত্রের আগমনে। অয়ন পরিচয় করায়, “এ আমার ছোটোবেলার বন্ধু আলোক, আর
ওর বৌ সাহানা। ওরা ছোট্ট একটা ইনভেস্টিগেশন হাউস চালায়। আলোক আগে আইবিতে ছিল।”
সবার সঙ্গে সবার
পরিচয় করানোর পর অয়ন বলে, “আমি জানতাম আমাদের বেশ কয়েক জোড়া অপরাধী সর্বদা লক্ষ করছে।
জিনিসটা পথেই ছিনতাই হয়ে যাবে। তখন মনে পড়ে ওদের কথা। পরদিন সকালেই জিনিসটা নিয়ে দৌড়ে
যাই আলোকের কাছে। আলোকরা বিকেলের সরাইঘাটে স্পেশাল টিকিট কেটে রওনা দেয়। সড়কপথে কাল
ওরাও এসে পৌঁছায় তাওয়াং। কথা ছিল, আমি আগে এলে ওয়েট করব, কেউ কাউকে প্রয়োজন ছাড়া ফোন
করব না, দেখা হলেও চিনব না। অপরাধীরা আমাদের ফলো করে গেছে যথারীতি। আর ওরা ঐতিহাসিক
বাতিদান আর পুঁথি নিয়ে নিরাপদে পৌঁছে গেছে তাওয়াং। কাল রাতে গুপ্তার লোক ধরা পড়েছে
গেস্ট হাউসে ঢুকতে গিয়ে। ওরাই বোধহয় ভেরুকে ফিট করেছিল। সু-তাং-এর লোক এখানেই ধরা পড়ল।
লামা অবশ্য বমডিলায় খবর পেয়েছিল, জিনিস আমাদের কাছে নেই। ওরা ভেবেছে কলকাতাতেই আছে
ওগুলো। তাই ফিরে গেছে। এই লামাও একজন ক্রিমিনাল কিন্তু।”
আলোকের পিঠের
ব্যাগ থেকে বের হল সেই বাতিদান আর পুঁথি। সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। প্রধান লামা চিপা
ওগুলো হাতে নিয়ে খুব খুশি। শুদ্ধিকরণ করেই সবাইকে নিয়ে মিউজিয়ামে গেলেন। একটা কাচের
বড়ো বাক্সে কিছু দুষ্প্রাপ্য মূর্তির পাশে স্থান পেল হিউয়েন সাং-এর বাতিদান। ম্যাগনেটিক
লকে বন্দি হল। আরেকটা কাচের দেওয়ালের আলমারিতে পুঁথিটি সাজিয়ে রাখলেন উনি।
বড়ুয়াদা এবং
বৌদি আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন। আলোকের হাত ধরে বড়ুয়াদা বললেন, “অয়ন ওর যাতায়াত ভাড়া,
খরচা কিছুই নেয়নি। আপনাকে কিন্তু বলতে হবে আপনার ফিস কত। নাহলে আমাদের তথাগত ক্ষমা
করবে না।”
আলোক হেসে বলে,
“সেসব নিশ্চয়ই হবে। এখন চলুন আপনারা আমাদের তাওয়াং ঘুরিয়ে দেখাবেন। হিউয়েন সাং-এর জন্য
আমাদের অরুণাচল ট্যুরটা হয়ে গেল বেশ।”
দিঠি আর সাহানার
ভালোই বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল কিছুক্ষণের ভেতর। ওরা প্ল্যান করছে পরদিন বুমলা পাস, মাধুরী
লেক এসব ঘোরার। অয়ন আলোককে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, “তোর জন্য আজ এই মহান কাজটা করতে পারলাম।”
আলোক হেসে বলল,
“আর তোর জন্য এই মহান দায়িত্ব পালন করতে পারলাম।”
সবাই আজ মঠের
অতিথি। অয়নের বন্ধু পুলিশের দুই অফিসারও প্লেন ড্রেসে মঠ-চত্বরেই উপস্থিত ছিল। এমন
সময় অয়নের ফোনে খবর এল আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল সু-তাং-লাই দমদম এয়ারপোর্টৈ ধরা পড়েছে
একটু আগেই।
বাইরে তখন সুন্দর
রোদ উঠেছে। পাহাড় হাসছে।
_____
অলঙ্করণঃ অর্ক
চক্রবর্তী
অর্ক চক্রবর্তী কে অলংকরণের জন্য ধন্যবাদ। খুব সুন্দর ছবি গুলো।
ReplyDeleteদারুণ সুন্দর ও উপভোগ্য লেখা। গোয়েন্দা এবং রহস্য গল্প লেখায় ওনার কলমের মুন্সিয়ানা প্রশংসনীয়।
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deletedarun sundor crime thriller.
ReplyDeleteখুব ভালো লাগল গল্পটা। টানটান উত্তেজনা!
ReplyDeleteমুগ্ধ।
ReplyDeleteআপনার গল্প খুব ভালো লাগলো
ReplyDeleteআমি আপনার গল্প আমার youtube চ্্যানেেলে পাঠ করতে চাই
আপনি রাজি থাকলে যানাবেন।