ছোটোমামার কীর্তি
রম্যাণী গোস্বামী
আমার
ছোটোমামার তখন ক্লাস সিক্স কি সেভেন। মাথায় কদমছাঁট চুল। চোখদুটো বোতামের মতো
গোল্লা গোল্লা। লম্বা দুটো কান। এমনিতে শান্তশিষ্ট দেখতে হলেও মাথায় ছিল তার নানা
দুষ্টু বুদ্ধির বাসা। ছোটোমামার সবচাইতে উদ্ভট ব্যাপারটা ছিল ঘুমের মধ্যে কথা বলা।
কথা মানে কিন্তু ফিসফিস বা মৃদু স্বরে জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলা নয়। বাজখাই গলায়
প্রাণপণ চিৎকার করে ছোটোমামা ঘুমের মধ্যে গান গাইত। সুর, তাল একেবারে খাপে খাপ।
এদিকে এই ছোটোমামাই রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীর দিন পাড়ার ঘরোয়া জলসায় স্টেজে উঠতেই
চাইত না। জোর করে তুলে দিলে ঢোঁক গিলে হাঁটু কাঁপিয়ে কোনওমতে যাও বা দু’তিন কলি বেরোত
তার কণ্ঠ থেকে তা শুনলে সেই গানের জন্মদাতারা নির্ঘাত মুচ্ছো যেতেন! সুতরাং সেই ছোটোমামাই
যখন ঘুমের মধ্যে নির্ভুল সুরে কঠিন কঠিন দ্বিজেন্দ্রগীতি অবধি গেয়ে দিত তখন
রানুমাসি, বাবলিমাসি, বড়োমামা, মেজোমামা, মা সবাই যে হাঁ হয়ে চোখ ছানাবড়া করে
তাকিয়ে থাকবে তা তো স্বাভাবিক। সব্বাই বলত, উঁহু, এ নিশ্চয়ই বাবলুর দুষ্টুমি।
মামাবাড়িতে
রোজ সন্ধেবেলা ছড়ি হাতে আসতেন অঙ্কের মাস্টারমশাই নীহারেন্দুস্যার। সব ভাইবোনেরা
টানা মাটির দালানে মাদুর পেতে বসে যেত লাইন দিয়ে। একটাই কুপি জ্বলত মাঝখানে। সেই
কুপির টিমটিমে আলোয় নীহারেন্দুস্যার প্রত্যেকের অঙ্ক কষা দেখতেন পালা করে। তা
নামতায় বড়োই কাঁচা ছিল ছোটোমামা। রোজই যেত নামতা ভুলে। ছোটোমামার পালা এলেই
খিটখিটে নীহারেন্দুস্যার আরও বেশি করে রেগে উঠতেন।
একদিন
হল কী, ছোটোমামা ঘুমোতে ঘুমোতে আওড়াতে থাকল কুড়ি ঘর অবধি নামতা। সব কারেক্ট। আর সে
কী স্পীড! আমি একটুও বানিয়ে বলছি না বিশ্বাস করো। এ যে আমার নিজের মায়ের মুখ থেকেই
শোনা। অবশ্য তোমরা অবিশ্বাস করলেও দোষের কিছু নেই। ইস্কুলে ইংরেজি পিরিয়ডে কীটসের পোয়েট্রি
মুখস্থ বলতে না পারার জন্য মঙ্গলবার ছোটোমামাকে ক্লাসের বাইরে নিলডাউন হতে হল –
তখন ওর ছলছলে চোখের দিকে তাকিয়ে কেই বা বিশ্বাস করবে যে একদিন আগেই অর্থাৎ সোমবার
রাত দুটোর সময় বড়োমামার আচমকা ঘুম ভেঙে গেছিল ছোটোমামার ঐ পোয়েট্রিটার ঠেলায়! কী
স্পষ্ট উচ্চারণ! কী ভাব! আহা! আহা! অবশ্য তক্ষুনি ওকে ঠেলা মেরে তুলে দিয়ে বড়োমামা
যখন আবার একই কবিতা বলতে বলল, সে বিচ্ছু তো একেবারে আকাশ থেকে পড়েছে। কিছুতেই পারে
না! প্রত্যেকবার এমন হত। আর ছোটোমামা কিছুতেই মানতে চাইত না ওর ঘুমন্ত অবস্থার
কীর্তিকলাপগুলোকে। সব ভাইবোনেরা হাসাহাসি করলে ও মুখে আঙুল পুরে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত
গাল ফুলিয়ে। দিদা সারাদিন প্রচুর পরিশ্রমের পর অনেক রাতে শুতে এসে বিছানায় পড়তেই
ঘুমে কাদা হয়ে যেতেন। তিনি এসব টের পাননি প্রথমটা। তাছাড়া তিনি তাঁর সবচাইতে ছোটো আদরের ছেলেটিকে বড্ড স্নেহও
করতেন। তিনি সব্বাইকে বকাবকি করতে লাগলেন বানিয়ে বানিয়ে ছোটোমামার সম্পর্কে এসব
বলার জন্য। কিন্তু যেদিন দিদাও শুনতে পেলেন ছোটোমামার ঘুমের মধ্যের বকবকানি, উনি
তো একেবারে হাঁ হয়ে গেলেন। মামাদের ধানিজমিতে কাজ করত যে পলানকাকা? ছোটোমামা
দিব্যি তার নাম ধরে ডাকছে আর ধান-পাটের হিসেব চাইছে অবিকল দাদুর মতো! সে সঙ্গে এবছর
বৃষ্টি কেন কম হল সেসব নিয়ে মস্ত আলোচনাও জুড়ে দিয়েছে ছোটোমামা একেবারে বিজ্ঞের মতো। চোখদুটো
বোজা। মুখখানা হাসি হাসি। মৃদু শ্বাস পড়ছে আর ঠোঁট ফাঁক করে অনর্গল বকে চলেছে ছোটোমামা।
এই দৃশ্য দেখে মাঝরাতে দিদা ছুটলেন দাদুকে খবর দিতে। এরপর ডাক্তার-বদ্যি এল, ওঝা-গুণিন
এল, কিন্তু কেউ কিছু করতে পারল না। সুতরাং ছোটোমামা নির্ভাবনায় ঘুমের মধ্যে বকেই
চলল, বকেই চলল।
সেবার
শীতকাল। কনকনে ঠাণ্ডায় জবুথবু বালুরঘাটের রাস্তা। সন্ধে হতে না হতেই কুয়াশার চাদর
গায়ে জড়িয়ে নিচ্ছে শুনশান পথঘাট। রাস্তার ধারের হলদেটে আলোয় দু’হাত দূরের জিনিস
চোখে পড়ে না। আত্রেয়ী নদীর ওপর থমকে আছে কুয়াশার আস্তরণ। আমার মামাবাড়িটা ছিল বেশ
ছড়ানো ছিটানো। এখনকার মতো তো আর ফ্ল্যাটবাড়ি নয়। গোয়ালঘর, উঠোন, কুয়োপাড়, বিশাল এক
বাগান, পুকুর, ধানের গোলা এইসব মিলিয়ে দশ-বারো কাঠা জায়গা তো হবেই। কলতলা,
বাথরুমগুলো ছিল মূল বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে। বৃষ্টির দিনে ছাতা মাথায় দিয়ে
সেখানে যেতে হত। আর এই হাড় হিম করা শীতে খিড়কি দরজা দিয়ে উঠোন পেরিয়ে রাতের বেলায়
‘ছোটো বাইরে’ যাওয়াটা এক মস্ত প্রকল্প। এক মামা হ্যারিকেন লন্ঠন হাতে আগে আগে যেত
আর পিছন পিছন সার বেঁধে টয়ট্রেনের মতো যেত মা, মাসিমণি এরা সবাই।
গোয়ালঘরের
পাশে ধানের গোলা। তার ঠিক চার হাত দূরে একটা প্রকাণ্ড সাইজের পাকুরগাছ। ছোটোমামার
মাথায় দুষ্টু বুদ্ধিরা গিজগিজ করত সেকথা আগেই বলেছি। ঐ পাকুরগাছের পাশ দিয়ে যাওয়ার
সময় ছোটোমামা প্রত্যেকবার হাতের হ্যারিকেনটা একটু উঁচু করে ধরে থমকে দাঁড়াত আর নাক
কুঁচকে কী যেন শুঁকত। এদিকে পিছনে তিন-চারজন মাসিদের টয়ট্রেন থমকে গেছে। রানুমাসি
ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ছোটোমামাকে জিগ্যেস করত, “কী হয়েছে রে, বাবলু?”
অমনি
ছোটোমামা খোনা গলায় কার সঙ্গে যেন দিব্যি গল্প জুড়ে দিত। খানিক বকবক করার পর বলত, “আরে,
ও হল আমার শাঁকচুন্নিপিসি। ঐ যে দেখছিস না, কেমন সরু সরু পা ঝুলিয়ে মগডালে বসে
আছে? হাওয়ায় পাদুটো নড়ছে, দ্যাখ। এসব শুনেই রানুমাসি ভ্যাঁ করে কেঁদে দিত আর
লাইনের একদম শেষে থাকা টয়ট্রেনের শেষ বগি অর্থাৎ বাবলিমাসি লাইনচ্যুত হয়ে এগিয়ে
এসে জোরসে গাঁট্টা মারত ছোটোমামার মাথায়। শুনেছি, ওরকমই এক মাঘের রাতে ঘুমের ঘোরে
ভয়ংকর খোনা গলায় ছোটোমামা এমন ছড়া বলতে শুরু করেছিল যে কলেজে পড়া বড়োমামার পর্যন্ত
দাঁতে দাঁত লেগে গিয়েছিল।
যাক গে
বাজে কথা। তা যেটা বলছিলাম সে কথায় আসি। তখন শীতকাল। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কাবু হয়ে
পড়েছে সবাই। সন্ধে হতে না হতেই রাস্তাঘাট ফাঁকা। খুব দরকার ছাড়া কেউ বাড়ির বাইরে
বেরোচ্ছে না। রাত দশটা সাড়ে দশটার মধ্যেই লোকজন খেয়েদেয়ে ঘুম। এগারোটা বাজতে না
বাজতেই পাড়াগুলো নিঝুম। সেদিন রাত সবে সাড়ে দশটা। মামাবাড়ির
খুদেগুলো কখন দুটো করে লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়েছে। খাওয়াদাওয়া আগেভাগেই সারা হয়ে
গেছে তাদের। দিদারা হেঁসেলে বসে গরম গরম রুটি গড়েছে, সঙ্গে ঘন ছোলার ডাল আর জমির
বেগুনখেতের বেগুন ভাজা। ওরা উনুনের ধারে গোল হয়ে বসে ওম নিতে নিতে গপ গপ করে খেয়ে
কোনওরকমে আঁচিয়ে এসেই জাম্প দিয়েছে বড়ো ঘরের পালঙ্কের উপর। রোদে দেওয়া লেপগুলো
ভাঁজ করে রাখাই থাকে পায়ের কাছে। কাড়াকাড়ি করে টেনে নিলেই হল। একটু বড়োদের তখনও
খাওয়া হয়নি। মেজোদাদু কুপি জ্বালিয়ে আইনের বই পড়ছিলেন। বাকি কলেজ পড়ুয়া মামারা
অঙ্ক কষছিল। হঠাৎ কানে এল প্রবল চিৎকার। চোর, চোর, চোর...
দেখ
না দেখ, গোটা রায়বাড়ি ভেঙে পড়ল উঠোনে। কই চোর? কোথায় চোর? সে এক হইহই রইরই
ব্যাপার। বড়ো আর মেজোমামা অঙ্কের খাতা ফেলে টর্চ হাতে দৌড়োদৌড়ি করতে লাগল উঠোনময়।
মা, মাসিমণিরা একে অপরকে জাপটে ধরে সুর করে চেঁচাতে লাগল, চোর, চোর, চোর। দিদারা
হেঁসেলের জ্বলন্ত উনুন ছেড়ে আসতে পারছেন না। ওখান থেকেই চেঁচাচ্ছেন, চোর, চোর, কে
আছ, বাঁচাও গো।
পলানকাকা
আর আরও একজন মুনিষ হ্যারিকেন হাতে ছুটল গোয়ালঘরের দিকে। পলানকাকা তরতর করে উঠে গেল
ধানের গোলা ভেঙে। যদি চোরব্যাটা সেখানে লুকিয়ে বসে থাকে? পুরোটা সময় তারাও বাজখাই
গলায় চেঁচাতে লাগল, চোর চোর, ধরো ধরো। একটু পরেই গোটা পাড়া জমা হল রায়বাড়ির দরজায়।
দাদুরা তাদের আপ্যায়ন করবেন নাকি চোরকে খুঁজবেন কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। কিন্তু কোথায় চোর? আধঘণ্টা ধরে গরুখোঁজা করেও
কোনও চোরের সন্ধান পাওয়া গেল না। লাভের মধ্যে লাভ, এই শীতে দৌড়ঝাঁপ করে সকলেরই
একটু গা গরম হল। সবকিছু শান্ত হয়ে এলে বড়োদাদু রান্নাঘরের দিকে হেঁকে বললেন, “বড়োবউমা,
চা-আ-আ...”
একটু
পরে গরম চায়ে চুমুক দিতেই চড়াৎ করে কী যেন মনে পড়ে গেল দাদুর। বারান্দায় দাঁড়িয়ে
থাকা ছোটো-মেজো-সেজো নানান সাইজের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বাবলু কোথায়? তাকে তো দেখছি
না?”
বাবলু
মানে বুঝতে পারছ তো? আমাদের ছোটোমামা। সঙ্গে সঙ্গে যে খুদেগুলো এতক্ষণ ভ্যাঁ ভ্যাঁ
করছিল, তারা চোখটোখ মুছে একবাক্যে স্বীকার করল যে ছোটোমামা ওদের সঙ্গেই আজ ঘুমোতে
গেছিল। আর এতকিছুর পরও সে ঘুম ভাঙেনি। ব্যস। তখন আর কারোরই বুঝতে বাকি রইল না যে
কী ঘটেছে। দারুণ হাসির রোল উঠল তখন রায়বাড়িতে। কী কাণ্ড! কী জব্দ! বাবা রে বাবা!
অথচ যে কিনা এতকিছু ঘটিয়ে বসে থাকল, সে নিজেই আগাগোড়া ঘুমের দেশে। মহা বিচ্ছু যাকে
বলে। এমনি করে আরও কিছুক্ষণ গল্প আড্ডা দিয়ে সবাই যখন ঘুমোতে গেল তখন ঘড়ির কাঁটা বারোটা
পেরিয়ে গেছে।
আরও
আধঘণ্টা পর যখন সত্যিই পুরো পাড়া নিশ্চিন্তির ঘুমে তলিয়ে গেছে, তখন পাড়ার সবচাইতে
উঁচু নারকেলগাছটা থেকে সড়সড় করে নেমে এল খালি গা, মালকোঁচা মারা চপচপে করে তেলমাখা
দুটি সিরিঙ্গে লোক। অত শীতেও তাদের গায়ে ঘাম। প্রথম লোকটির নাম ‘প্রফুল্ল চোর’। সে
রায়দীঘি অঞ্চলের সবচাইতে এক্সপার্ট চোর। চোর শিরোমণি উপাধি পাওয়া আর কী। সে আর তার
স্যাঙাত বল্টু এসেছিল অনেকটা পথ উজিয়ে। প্রথমটা একটু ঘুরেফিরে পাড়াটায় সরেজমিন
তদন্ত করে শেষ রাতে শাঁসাল বাড়ি খুঁজে ঝোপ বুঝে কোপ মারবে, এই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।
গাছ থেকে নেমেই কোনওদিকে না তাকিয়ে দু’জন দিল ছুট। বাপ রে বাপ! এই শীতে পাড়ার কুকুরগুলো
পর্যন্ত ঘুমোচ্ছে, আর তারা কিনা সবে পাড়ার সীমানার চৌহদ্দিতে পা রাখতেই ঠিক ঈশানকোণের
বাড়িটার লোকজন ‘চোর চোর’ বলে শোরগোল ফেলে দিল? কে জানে, জিন-পরি পোষে নাকি ঐ বাড়ির
লোকে? না বাবা! আর এই এলাকায় কোনওদিনও নয়। চোর বাবাজিরা এই বলে পগারপার।
বলাই
বাহুল্য যে ছোটোমামা তখনও নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। আর ঘুমের মধ্যে ফিক ফিক হাসছে!
_____
অলঙ্করণঃ
পুষ্পেন মণ্ডল
দারুণ। ঘুমের ঘোরে চলাফেরা কথাবলা এক রহস্যময় অথচ কৌতুক উদ্রেককারী রোগ। কিছুটা কল্পনা মিশিয়ে সেটা নিয়ে এমন জমজমাট গল্প পড়তে বেশ লাগল।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
Deleteবাঃ, অনেকদিন পর সেই ছোটোবেলায় শুনে মজা পাওয়া গল্পগুলোর মতো একটা গল্প পড়া গেল। ধন্যবাদ রম্যাণী।
ReplyDeleteথ্যাঙ্কস আ লট ঋজুদা
Deleteছোটবেলায় পড়া শিশু সাহিত্যের ভাল লাগা ফিরে পেলাম।
ReplyDeleteথ্যাঙ্কস আ লট
ReplyDelete