প্রতীক কুমার মুখার্জি
নাতি আর নাতবউ নাছোড়বান্দা। তাই বেশ অনেকদিন পরেই সেজেগুজে পুতির হাত ধরে বিয়েবাড়ি গেছিলেন রন্তিদেব। নিজেই ‘প্রিজারভেশন ক্লোসেট’ থেকে বার করেছিলেন সযত্নে রাখা গরদের ধুতি-পাঞ্জাবির সেট, কোলাপুরি, টিসটের সোনার ঘড়ি, রিমলেস চশমা। আসলে এসব জিনিস এখনকার দিনে ভয়ানক ‘ভিন্টেজ’। এখন দিনের বিভিন্ন অংশে নানারকম ‘অরগ্যানিক বাবল’ পরে থাকতে হয়। তাই বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানেই এগুলির দরকার পড়ে বনেদিয়ানা বোঝাতে। চশমা, ঘড়ির দরকারও ফুরিয়েছে। ওসব বেসিক গেজেটস শরীরজুড়ে বসানো।
যাক সে কথা। কালেভদ্রে একটা দুটো জায়গায় ডাক পেলে রন্তিদেব খুবই খুশি হন। যেমন আজ হয়েছেন। হবেন না? এই একশো বাষট্টি বছর বয়সেও মানুষ তাকে মনে করে নেমন্তন্ন তো করে। এই ২০৯০ সালেও! সেজেগুজে নাতি, নাতবউ আর পুতির সঙ্গে চড়ে বসেছিলেন নাতির নতুন কেনা মাল্টিসিটার ‘প্রিভিজেটে’। ঠিক দু’মিনিটে আসানসোলের বিয়েবাড়িতে কোলাপুরি মচমচিয়ে ঢুকলেন কোঁচা সামলে চওড়া হাসি মুখে ঝুলিয়ে।
আধঘন্টার মধ্যেই বাড়ি ফিরলেন চোয়াল চিপে
গজগজ করতে করতে, রেগে টং হয়ে একা। বিয়েবাড়ি থেকে মাত্র সাড়ে চার মিনিটে ‘মোনোক্যাব’ তাকে তার রাজারহাটের বাড়িতে এনে ফেলল। এই সেলুলার ক্যাবগুলো ভীষণ ভালো চলে, সার্ভিসও দারুণ। কপালের পাশে রগের ভিতর ইমপ্ল্যান্ট করা মাইক্রোচিপের কল্যাণে একবার কপাল ছুঁয়ে ‘ইউজ আ ক্যাব’ ভাবলেই হল। এবার কতজন ক্যাব ব্যবহার করবে তার উপর নির্ভর করে বাড়ির ছাতে এসে নামবে হয় মোনোক্যাব, ডাইক্যাব, ট্রাইক্যাব ইত্যাদি ইত্যাদি।
এসেই বাডি-৩কে ডেকে পাঠিয়ে ‘রিফ্রেশো ক্যাপসুল’-এ ঢুকলেন রন্তিদেব। তরতাজা হয়ে বেরিয়ে আসতেই সে নীরবে এগিয়ে এসে তার জামাকাপড় ছাড়িয়ে, নাইট বাবল পরিয়ে, ম্যাসেজ করিয়ে, মেডিক্যাল স্ট্যাটাস চেক করার পরে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে স্লাম্বারড্রোমে তার ট্রেতে শুইয়ে দিল। তারপর পরা জামাকাপড় ড্রাইক্লোরো ওয়াশ করে, জুতো ডিটক্সিফাই করে সবকিছু আবার ক্লোজেটে তুলল ঠিক পনেরো সেকেন্ডের ভিতর! এই বাডি সিরিজের রোবটরা আবার অতীতের ‘ম্যাগলেভ’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বলে এদের ‘সাইলেন্ট বাডিস’ও বলা হয়।
তা সদাহাস্য, বন্ধুবৎসল, দিলদরিয়া শ্রীযুক্ত রন্তিদেব মজুমদার মশাইয়ের এহেন রাগের কারণ কী? কী এমন হল আজ যাতে তার মতো লোক রাগ করে, মেজাজ হারিয়ে বিয়েবাড়ি থেকে সটান বাড়ি ফিরে এলেন? রাগের কারণটা ঝালিয়ে নিতে রন্তিদেব ছোটোবেলায় ফিরলেন আরেকবার, স্মরণশক্তিতে ভর করে। শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলেন তার পৈতের সময় তার বাবা, কাকা, জ্যাঠারা মিলে কী এলাহি ব্যাপারই না করেছিলেন বাড়িতে। এমনিতেই জমিদারবাড়ি। আর এঁরা ছিলেন ভালো জমিদার, অর্থাৎ যাদের জমিদারিতে প্রজারা খুশি থাকতেন সর্বদা। সুতরাং
পৈতের খাবারদাবারের আয়োজনও এলাহি। বিশাল বিশাল রুই-কাতলা উঠতে লাগল পুকুর থেকে। তেলচুকচুকে নধর খাসিরা শহীদ হবার জন্য সানন্দে পা বাড়াল। শুক্তো, চচ্চড়ি, ইলিশ-ভাপা, চিতলের মুইঠ্যা, আরও কত কী? তার সঙ্গে বড়ো করে ভিয়েন বসল। আয়োজন দেখে ন’বছরের রন্তিদেবের তো আর আনন্দ ধরে না। এতসব কিছু শুধু তার জন্য? বরাবরের লোভী, পেটুক আর ভোজনবিলাসী ছেলেটার ধেই ধেই করে নাচার অবস্থা!
কিন্তু বেচারা জানত না, এইসব মহার্ঘ সুস্বাদু খাবারের এক ফোঁটাও তার জিভে ঠেকাবার জন্য তৈরি হচ্ছে না। সারাদিন উপোস করে অং-বং-চং মন্ত্র পড়ার পর নাপিত এসে খপাৎ করে চেপে ধরে কুরকুর করে তার চুলগুলো সাবাড় করে দেওয়াতেও তার কষ্ট হয়নি। এমনকি হাতে কলা ধরিয়ে দিয়ে কান ফুটো করার সময়ও সে চোখে জল নিয়ে হাসিমুখে বীরত্ব দেখিয়েছে। ভিক্ষা চাইতেও তার লজ্জা লাগেনি। কিন্তু ওসব হবার পরে যখন চারদিকে নানারকম খাবারের ভয়ংকর সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে, তখন সবাই মিলে হাসতে হাসতে তাকে অনেক ফলমূল আর দই-মিষ্টিতে ঠাসা একটা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে আটকে দিল, তখন সে রাগের চোটে খেপে গিয়ে ঠকঠক করে
কেঁপেছিল। ঠিক আজকের মতোই!
বাইরে
সবাই মনপ্রাণ ভরে কবজি, আহা, শুধু কবজি কেন, কনুই অবধি ডুবিয়ে মহাভোজে ব্যস্ত। একটু পরে মা আর
ছোটোকাকা মিলে
এসে তাকে অনেক বুঝিয়েছিলেন যে সে হল ব্রহ্মচারী। তাকে এখন একটি বছর
নিরামিষ খেয়ে থাকতে হবে। আর তিনদিন ওই
‘দন্ডিঘরে’ বন্দি থাকতে
হবে। কিন্তু রন্তিদেব কি কম যায়? পরের সপ্তাহ
থেকেই বদমায়েসির
মাত্রা এত বাড়িয়ে ফেলে
যে বাড়ির লোক তিতিবিরক্ত হয়ে তাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে
দেন। সেখানে গিয়ে
সে মনপ্রাণ ভরে খাওয়াদাওয়া করে কোনওক্রমে
নিজের প্রাণ বাঁচায়। তা
সে আরেক গল্প। আজ
কিন্তু রন্তিদেব প্রায় সেই একই
কারণে রেগেমেগে বাড়ি ফিরে
এসেছেন। খাওয়া নিয়ে
খেয়োখেয়ি তার ধাতে সয় না একেবারেই।
এপাশ ওপাশ করতে লাগলেন রন্তিদেব। রাগের চোটে ঘুমটুম সব উড়ে গেছে তার। এর ভিতর বাডি-৩ এসে দু’বার ব্লাডপ্রেশার আর সুগারের অ্যাম্পুল দিয়ে গেছে। লাইভ ভিশনে তিনবার নাতিরা খোঁজ নিয়েছে তার। বলেছে, ওরা এক্ষুনি ফিরছে। রন্তিদেব অবশ্য তাদের অভয় দিয়ে বলেছেন সব সেরে সাবধানে ফিরতে। তিনি ঠিক আছেন। কিন্তু এবার কী করেন তিনি? ঘুম না এলে তো খুব ঝামেলা। কালই ‘অটোডক’ তাকে ধরে-বেঁধে ‘আপগ্রেডেশন’-এ পাঠিয়ে দেবে। আবার বাডি-৩ এগিয়ে এল তাকে চেক করার জন্য। আর তখনই তার মাথায় প্ল্যানটা এসে গেল।
বাডিকে রন্তিদেব ‘ড্রিমোস্কোপ’টা চালু করতে বললেন।
আদ্যিকালে ওয়াকম্যানের আকারের যন্ত্রটাতে পছন্দমতো ড্রিম সিকোয়েন্স চিপ ভরে দিলেই আজকাল ইচ্ছেমতো স্বপ্ন দেখা যায়। ঘুম না এলে এটাই রন্তিদেবের হাতিয়ার। এই তো সেদিন ঘুম আসছিল না। রন্তিদেব আরাম করে ১৯৮৬ ফুটবল বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড বনাম আর্জেন্টিনার খেলা দেখতে দেখতে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আহা, মারাদোনার সে কী খেলা! হাতে-পায়ে খেলে লালমুখোগুলোকে হয়রান করিয়ে ছাড়ল ছেলেটা। খুব আনন্দ করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে খেলা দেখলেন অন্যদের
সঙ্গে স্টেডিয়ামে বসে।
ড্রিমোস্কোপ চালু হতে ‘এভি থিয়েটার’ পরে ফেললেন রন্তিদেব। আর তারপর চিপ স্লটে ‘ডিসি চিপ’ ভরে আয়েশ করে পাশবালিশ জড়িয়ে পাশ ফিরলেন তিনি। দু’মিনিটের ভিতর চোখের সামনে ভেসে উঠল টুনি বাল্ব দিয়ে সাজানো টিমটিমে এক গ্রাম্য সন্ধ্যা, টিপটিপ করে ইলশেগুঁড়ি, সামনে লালহলুদ কাপড়ের ভিজে ঢোল ম্যারাপ, আর ব্যাকগ্রাউন্ডে মাঝে মাঝে বেতাল বিসমিল্লা। গেটের মুখে দাঁড়িয়ে বিগলিত হাসি আর বিনয়ের হাত কচলানি নিয়ে মেয়ের বাড়ির কাকা-জ্যাঠারা, আর ক’টি সাজুগুজু করা মেয়ে পালা করে গোলাপজল আর খুচরো ফুলের মিক্সচার জোরে জোরে ছুঁড়ে মারছে অতিথিদের অকারণ হাসিতে ঢলে পড়তে পড়তে। তিনি ধোপদুরস্ত
পোশাকে আতর মেখে, হাতে একটি বাহারী প্যাকিংবাক্স নিয়ে ‘আসুন, আসুন’ আর গোলাপজলের ফোয়ারা পেরিয়ে ঢুকে পড়লেন প্যান্ডেলে। সেখানে তখন খাবারদাবারের গন্ধে চারদিক মাতোয়ারা, আর খেতে আসা লোকেদের জটলা। সবাই পরিচিতদের
সঙ্গে কথা, হাসি, কুশল বিনিময় করছে ঠিক কথা, কিন্তু তারই ভিতর বাজপাখির চোখে মেপে চলেছে কোন ব্যাচে কোন পদ পরিবেশন চলছে, আর কনুই দিয়ে পরিবারকে ঠেলে ঠেলে সম্ভাব্য খালি টেবিলের দিকে নিয়ে চলেছে। রন্তিদেবও এর মাঝে টুক করে মেয়ের কোলে উপহারের বাক্স ফেলে দিয়ে এসে ‘এবার খাব’দের দলে যোগ দিয়ে ফেললেন।
তা আধঘন্টার ভিতর বরাতজোরে পরের ব্যাচেই জায়গা পেয়ে গেলেন। হাসিমুখে অচেনা লোকেদের
সঙ্গে বসে পড়লেন পাত পেড়ে। যে সময়ের বিয়েবাড়িতে তিনি এসে পড়েছেন, এই ধরো ১৯৬০-৬৫ সালের, তখনও ক্যাটারিং বস্তুটির জন্ম হয়নি। আর তাই চারজনের টেবিলের দেখাও মিলল না এখানে। সেই দুটো নড়বড়ে
সাঁড়াশির মতো
স্ট্যান্ডের
উপর লম্বা কাঠের পাটাতন, আর তার চেয়েও নড়বড়ে প্লাইউডের ফোল্ডিং চেয়ার, যেগুলোতে ঠিকঠাক না বসলে কচি থেকে বুড়ো সকলে ডিগবাজি খেতে পারে। আর খেলোও তাই। আশেপাশে দু-তিনজন দমাদ্দম মাটিতে আছড়েও পড়ল, সামলেও নিল কয়েকজন।
এরপরেই দেখা পাওয়া গেল গলদঘর্ম, দাদু-গেঞ্জি পরা আর কোমরে নতুন গামছা বাঁধা পরিবেশকদের। তারা কেউ কাঁধে করে, কেউ হাতে করে ট্রে, ঝুড়ি করে খাবারের পসরা নিয়ে তৈরি। দু’জন ছেলে হুড়হুড় করে কলাপাতার বোমাবাজি করে যেতেই তিনটে বাচ্চাছেলের একজন বুলেটের মতো গতিতে মাটির খুরি বসিয়ে দিয়ে গেল। বাকি দু’জনে জল ঢালতে ঢালতে চলল তার পিছনে। এইবার খাইয়েরা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। নিপুণ হাতে খুরি থেকে জল ঢেলে পাতা ধুয়ে নিতে লাগলেন, আর এদিক ওদিক থেকে আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল, “এই ছেলে, খুরি পালটে দিয়ে যা, ফুটো আছে!” বা “যাহ্, গায়ে জল ঢেলে দিলেন, মশাই?” ইত্যাদি ইত্যাদি। একটুকরো করে পাতিলেবু আর
কাঁচালঙ্কা দেগে গেল প্রতি পাতে একটা দড়কচা মারা টেনিয়া, সঙ্গে লবণ।
তা রন্তিদেবের কোনও হেলদোল নেই। তিনি গুছিয়ে বসে পরিবেশনকারীদের মাপতে থাকলেন, আর বাঘের মতোই যেন ঠোঁট চাটতে লাগলেন, শিকারের জন্য প্রস্তুত।
প্রথমেই
এসে পড়ল
পেটফোলা, ভাপ ওঠা কড়াইশুঁটির কচুরি। মুচমুচে ভাজা ময়দার তলা থেকে ফেটে বেরোনো মটরশুঁটির হাল্কা সবুজ গ্ল্যামার, সঙ্গে খুনখারাপি মশলাদার গায়েমাখা আলুর দম। পলকের ভিতর চারখানা উড়িয়ে দিয়ে জুল জুল করে তাকাতে লাগলেন রন্তিদেব।
তারপর স্যালাড আসার সঙ্গে সঙ্গে পাত আলো করে ফিশ কাটলেট পড়তেই তর্জনীর বিশেষ ভঙ্গির
সঙ্গে মাথা হেলিয়ে মুচকি হেসে, “ভাই, একেবারে আর দুটো দিয়েই
দেবেন। কতবার আর বিরক্ত করি বলুন? আর কাসুন্দিটা একটু... হে হে।”
এবার খাওয়া শুরু করলেন রন্তিদেব। পরিবেশনকারী তার জাত চিনে নিয়ে অন্যদের অর্থবহ ইশারা করে দিলেন। পরিষ্কার করে খেয়ে ভাতের অপেক্ষায় রইলেন রন্তিদেব। ধপধপে সাদা শিউলিফুলের মতো ভাত দিয়ে
মেখে ভাগে ভাগে সোনামুগের ডালের সঙ্গে ডাঁটিওয়ালা বেগুনভাজা আর শুক্তো দিয়ে সাপটে খেলেন। তারপর ধোকার ডালনা, পরে ইলিশের মাথা আর কুমড়ো দেওয়া পুঁইচচ্চড়ি দিয়ে ভাত মেখে পেটের একদিকে চালান করে নির্বিকার মুখে বসে রইলেন। আহা, খাওয়াকে যেন শিল্পের স্তরে নিয়ে যাচ্ছেন
রন্তিদেব!
ওই তো, এবার ইলিশের পাতুড়ি নিয়ে এক বাবরিবাবুকে দেখা যাচ্ছে। কী তার হাবভাব! মনে হচ্ছে যেন রায়বাহাদুর গরিবদের কম্বল বিলোবেন এবার। রেগে উঠে ভীষণ
ভ্রূকুটি করে ওজন দেখাতে যাচ্ছিলেন রন্তিদেব। হঠাৎ কানের পাশ থেকে আকর্ণবিস্তৃত একটা হাসি ভেসে এল, “আপনারা সব দেখেশুনে নেবেন, বাবুরা। আপনাদের আশীর্বাদে যেন আমাদের মেয়েটা সুখে শান্তিতে থাকে। নিজের মতো করে খাবেন, চেয়েচিন্তে নেবেন, বাবুরা।”
এরপর বলাই বাহুল্য, পাতুড়িবাবুকে আর কিছু করা গেল না। তবে সে ছেলেও ধুরন্ধর। সে রন্তিদেবের মেজাজ বুঝে তার পাতে চার-চারখানা পাতুড়িপাত করে পাততাড়ি গুটিয়েছে। তিনি সব ভুলে জমিয়ে পাতুড়ির মোড়ক ছাড়াতে লাগলেন। আর তখনই মাথার উপর থেকে ঘোষণা শোনা গেল, “পোলাও দেব, বাবু?”
লক্ষ্মীছেলের মতো মাথা হেলিয়ে দিলেন চোখ বুজিয়ে পরম আরামে ইলিশ খেতে খেতে। পাতে গাওয়া ঘিয়ের সুগন্ধ আর কাজু-কিশমিশ গিজগিজ করা হাল্কা হলুদ পোলাও দু’হাতা পড়তে না পড়তেই রন্তিদেবের বোজা চোখ তার চোখা নজর বাড়িয়ে দিল ক্রমশ এগিয়ে আসা মাছের কালিয়া আর একটু দূরে থাকা খাসির মাংসের
কোর্মার দিকে। আজ তিনি কাউকে নিরাশ করবেন না। কেউ যেন তার কাছ থেকে ‘না’ শুনে না ফিরে যায়।
টেনিয়ার পুনঃপ্রবেশ ঘটল প্যান্ডেলে। এবার টুপটাপ করে কোয়ার্টার সাইজের মাটির খুরি বসিয়ে দিয়ে সে পালাতেই তূরীয় স্বাদ, গন্ধ আর রাজকীয় ক্যারিশমা নিয়ে খুরি ভর্তি করে সবার সামনে এসে এসে বসতে লাগল কোর্মা। এই রাউন্ডটাই সাংঘাতিক। কারণ, পাক্কা চল্লিশ মিনিট ধরে পোলাও আর কোর্মা পরিবেশনকারীরা নতুন করে ঘেমে স্নাত হলেন। রন্তিদেবের মতো বেশ ক’জনের পাতেই হাড়ের পাহাড় গজিয়ে উঠল। তার ভিতর আবার ঝামেলা লেগে গেল, কার মাংসের আধসিদ্ধ আলু জোর করে পোলাওয়ে মাখতে গিয়ে নাকি পিছলে গিয়ে ছিটকে উঠে উলটোদিকে বসা কোন ডাক্তারবাবুর আদ্দির পাঞ্জাবি নষ্ট করে দিয়েছে।
গোলমাল থিতোবার আগেই রন্তিদেব বাবরিবাবুকে মোলায়েম করে হেসে-টেসে আরেক ভাঁড় মাংস আর বাঘা বাঘা দুটো কালিয়ার পিস আনিয়ে জেট-স্পিডে সাবাড় করে ফেলেছেন পোলাওয়ের সঙ্গে। ইচ্ছে হচ্ছিল বটে আর এক-দুটো ফিশ কাটলেট নিয়ে লেট কাট করেন, কিন্তু পেটটা যেন একটু হলেও টাইট লাগছে। বাকি আইটেমগুলো না খেলে ওদের প্রতি অনাদর করা হবে। আর সেটা তিনি প্রাণ থাকতে হতে দিতে পারেন না। তাও মনকে না মানাতে পেরে আবার একটু সাদা ভাত আনিয়ে মাছের কালিয়া দিয়ে খেতে খেতে লক্ষ করলেন, পরের ব্যাচের লোকজন যেন প্রবল জিঘাংসা নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে। ততক্ষণে চাটনি আর পাঁপড় দেওয়া শুরু হয়েছে ওদিক থেকে। ঝোলঝাল মাখা পাত সাফ করে ফেললেন হাতের নিখুঁত আড়াই প্যাঁচে। দই-মিষ্টির অ্যাকোমোডেশনের ব্যবস্থা খতম।
এরপর আর বলার মতো কিছু নেই। প্রায় আধসের মিষ্টি লালদই, কুড়িটা সন্দেশ, আর আধ বালতি রাজভোগ - সংখ্যায় চল্লিশটার মতো খেয়ে উঠেই পড়লেন রন্তিদেব। আশেপাশের লোকেরা তার খাওয়ার তারিফ করতেই তিনি লজ্জা লজ্জা মুখে বললেন, “এখন আর পারি না। কমবয়সে একটা কচি পাঁঠা একাই মানে... হে হে হে!”
তার খাওয়াদাওয়ার বহর দেখে একেবারে ঢি ঢি না পড়ে গেলেও উঠতি খাইয়েরা তাকে জরিপ করে যাচ্ছে। দু-একজন তো বলেই গেল, “দাদু, আরেক হাত হবে নাকি? বলেন তো লড়ে যাই!”
ডাহা সর্বনাশের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে
কাঁচুমাচু মুখে কনের বাড়ির কাকা-জ্যাঠারা তাকে ঘিরে ধরলেন। প্রথমে লেমনেড, তারপর সুগন্ধি পান হাতে ধরিয়ে নিপুণ আতিথেয়তায় আস্তে আস্তে প্যান্ডেলের গেটের কাছে এনে ফেললেন। ব্যবস্থা পাকা করতে এনারা রন্তিদেবের হাতে আবার খড়কে কাঠিও গুঁজে দিয়েছেন।
বাব্বা, একে রামে রক্ষে নেই... এরপর আবার খাওয়ার লড়াই? কে জানে এখনই মিষ্টি কম পড়বে কি না। কনেপক্ষ টেনশনে পড়ে গিয়েছেন। তা আমাদের রন্তিদেব সবে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে গুছিয়ে দরাজ সার্টিফিকেট দিতে শুরু করেছিলেন, হঠাৎ হাল্কা বিপ বিপ বিপ শব্দ কানে ঢুকতেই তিনি সচকিত হলেন। এ তো ড্রিমোস্কোপের ‘টি আর’ অর্থাৎ কিনা টাইম রিমাইন্ডার! তার স্বপ্ন আপাতত এখানেই শেষ। ধন্যবাদ-টাদ জানিয়ে আস্তে আস্তে তিনি বিয়েবাড়ি থেকে সরে এলেন পাশের অন্ধকার মাঠটায়। এবার হিসেবমতো একটা স্নিগ্ধ নীল আলো তাকে ঘিরে ধরবে, আর তিনি এখান থেকে ভ্যানিশ হয়ে আবার স্লাম্বারড্রোমে গিয়ে উঠবেন। প্রমাণ সাইজের একটা লম্বা
ঢেঁকুর তুলতেই নীল আলোর কারসাজি শুরু হল।
পরদিন সকালে তাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে ওয়ার্কআউট করাবার পর ‘কে-১ বাবল’ পরিয়ে রেডি করে দিয়ে বাডি-৩ চলে গেছে। রন্তিদেবের মন পুরোপুরি গ্লানিহীন। তবে শরীরটা জুতে নেই। কেমন যেন আইঢাই করছে। এমন সময়ে নাতবউ দেখা করতে এল পুতির হাত ধরে, বেশ ভয়ে ভয়ে। পুতির ওসব নেই। সে এক লাফে কোলে উঠে পড়ে বলল, “গ্র্যান্ডি, তুমি কাল কেন একা চলে
এলে? আমি ওখানে একা একা বোর হলাম!”
রন্তিদেব তার ‘হেডবাবল’-এর উপর দিয়েই চুলগুলো
ঘেঁটে দিয়ে নাতবউকে জিগ্যেস করলেন, “তা, সে ভদ্রলোক কই?”
নাতবউ আমতা আমতা করতে রন্তিদেব বলে উঠলেন, “এবার থেকে জেনে রাখ মেয়ে, কোনওরকম অনুষ্ঠানের নেমন্তন্ন এলে একটু নির্লজ্জ হয়েই জেনে নিস, খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা কি সাবেক না আধুনিক। আধুনিক হলে বাপু আমায় ডাকবি না। যত সব পাকামি!”
একদমে বলে চললেন রন্তিদেব। তার জমিদারি রক্ত আবেগে ফুটছে, “বাড়িতে নিয়মে থাকি, অটোডকের কথামতো খাওয়াদাওয়া করি ঠিক আছে, কিন্তু ন’মাসে ছ’মাসে একটা নেমন্তন্ন আসে এই বুড়োর। আর সেখানে গিয়ে কী দেখি? না, রাইস পাউডার, ডালের ট্যাবলেট, মুড়িঘণ্ট
অ্যাম্পুলে বন্দি, আলুভাজার গ্লোবিউলিন, এমনকি হতচ্ছাড়ারা কাটলেট, কবিরাজির
পর্যন্ত ক্যাপসুল বানিয়েছে? যেদিক যাই পালাবার পথ নেই। মাছ, ফাউল, মাটন, বাগদা, গলদা, পোলাও, কোর্মা, কালিয়া, বিরিয়ানি সবই হয় ট্যাবলেট, নয় ক্যাপসুল, নয় সিরাপ। চাটনি, দই-মিষ্টি, পায়েস-আইসক্রিম তাও ‘ফুড ভ্যালু’ মেপে বিস্বাদ পাউডারে বিরাজমান। ওখানে কী করব আমি? দাঁত বার করে হেসে হেসে ওসব দাঁতে কাটতে পারব না আমি। উফ্! তারপর আবার কায়দা করে বুফের ব্যবস্থা করেছেন বাবুরা! জলেরও ব্যবস্থা নেই রে ভাই। সেখানেও
অ্যাম্পুল!”
রন্তিদেব যখন তোড়ে বলে চলেছিলেন, পিছন থেকে পা টিপে টিপে এসে অপেক্ষা করছিল রন্তিদেবের নাতি। উনি থামতেই পিছন থেকে জাপটে ধরে দাদুকে কোলে তুলে নিল সে, আর রন্তিদেব হাউমাউ করে চিৎকার জুড়লেন। “নামিয়ে দে আমায় ভুতো, খারাপ হচ্ছে কিন্তু।”
এই দেখে পুতি ও নাতবউও দু’হাত তুলে নাচতে লাগল। আর দাদুকে নামিয়ে ভুতোবাবু ঘোষণা করলেন, “কাল আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝেই অটোডককে কনসাল্ট করেছি, দাদু। তুমি পারমিশন পেয়েছ। তাই আজ আমরা রাতে ‘২০০০ এ ডি’ রেস্তোরাঁয় ডিনার করতে যাচ্ছি সবাই মিলে। নকল নয়, আজ আমরা মন ভরে আসল মুরগি-মাটন-কোপ্তাকারি, রাইস-পোলাও-বিরিয়ানি, দই-মিষ্টি-রাবড়ি সব খাব।”
রন্তিদেব ভুতোবাবুর কানখানি কষে মুলে দিলেন। তারপর আদর করে গাল টিপে দিয়ে মুচকি হেসে বললেন, “থাক রে। পরে কোনও একদিন যাওয়া যাবে’খন। কাল বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি।”
নাতিমশাই ও তার পরিবার হা করে রন্তিদেবের চলে যাওয়া দেখল। মনে মনে ভাবল, দাদু তার গতকালের ব্যবহারে লজ্জিত। কিন্তু তার খাদ্যরসিক দাদু যে কী বলে গেলেন, সেটা সে বেচারা জানবে কেমন করে? সে সটান চিন্তিত মুখে ইউরেনাসে তার বাবা মা, অর্থাৎ রন্তিদেবের ছেলে ও বউমাকে ‘ইন্টার প্ল্যানেটরি কনভো’তে ধরে বলছে, “আমার মনে হয় দাদুর সাইকোলজি রিলেটেড কিছু প্রবলেম দেখা দিচ্ছে। এত ভালোবাসেন খাওয়াদাওয়া করতে, আজ দড়াম করে না বলে দিলেন? তোমরা একটু কথা বল না দাদুর সঙ্গে, প্লিজ!”
রন্তিদেব তখন বাডি-৩র কন্ট্রোল প্যানেল সুইচ অফ করে দিয়ে পাগলের মতো হজমের ওষুধ খুঁজে চলেছেন। কাল সত্যি বাড়াবাড়ি ধরনের খাওয়া হয়ে গিয়েছে।
কী হল? ওহো, আমারই ভুল হয়েছে দেখেছ! বাইশ শতকে স্বপ্ন ব্যাপারটা যে আর ভার্চুয়াল নয় সেটাই বলতে ভুলে গেছি আমি তোমাদের। যখন স্বপ্নে খেলা দেখার কথা বলেছিলাম, ভেবেছি তখনই তোমরা ব্যাপারটা ধরে ফেলবে। রন্তিদেব কি আর সাধে আজ হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলে ফেললেন? ভাগ্যিস বুদ্ধি করে বাডিকে অফ করে দিয়েছিলেন। নইলে এতক্ষণে সোজা রিহ্যাব-এর গিনিপিগ বনতে হত।
ভাবতে ভাবতেই ওষুধের শিশিটা খুঁজে পেলেন তিনি।
-----
অলঙ্করণঃ সুমিত রায়
অভিনব ভাবনা। উপাদেয় পরিবেশন! খাওয়া দাওয়া নিয়ে গল্পে প্রতীকদার একটা সহজাত প্রতিভা আছে!
ReplyDeleteব্যাপক লাগল!
ReplyDeleteঅপূর্ব কন্সেপ্ট #প্রতীকদা, সাইফাই আর ট্র্যাডিশানাল বাঙালী খাবারের গন্ধে "ম-ম" করছে।
ReplyDeleteদারুণ
ReplyDeleteসাইফাই থেকেই নাকি অনেক যন্ত্রের উদ্ভব। এই গল্প আর ওই কথাটা মিলেমিশে সত্যি হোক
ReplyDeleteঅসামান্য ভাবনা, খুব ভালো লেখা একেবারে "গোগ্রাসে খেলাম",থুড়ি, পড়লাম
ReplyDelete