পাখি দেখুন পাখি চিনুন
প্রতিম দাস
দ্বিতীয় পর্ব
প্রথমেই সবাইকে জানাই শারদ শুভেচ্ছা। আশা রাখছি এই সিরিজের প্রথম অংশ আপনাদের ভালো
লেগেছে। আরও সাতটি পাখির পরিচয় থাকল এবারে। যবে থেকে এই সিরিজ নিয়ে কাজ
করছি অনেকেই একটা প্রশ্ন করেছেন, কেন আমি এইসব পাখিদের বাংলা নাম দিই না।
উত্তরে জানাই, অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি সর্বভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক
ক্ষেত্রে ইংরেজি নামগুলোরই মান্যতা বেশি এবং অনেক সুবিধেও হয়। আর
একটা কথা। আঞ্চলিক নামগুলো অঞ্চল বিশেষে আলাদা হয়ে যায় এটাও
লক্ষ করেছি। তাই অযথা বিভ্রান্তি না বাড়াতেই বাংলা নাম দিই না।
গ্রে ক্রেস্টেড টিট (Lophophanes dichrous) Paridae পরিবারের একটি
প্রজাতি। ভুটান, চীন, পাকিস্তান,
ভারত, বার্মা ও নেপালে দেখতে পাওয়া
যায়। এদের প্রাকৃতিক
বাসস্থান নাতিশীতোষ্ণ বনাঞ্চল এবং প্রায় ক্রান্তীয় বা ক্রান্তীয় আর্দ্র
পার্বত্য অরণ্য।
১১.৫ থেকে ১২.৫ সেমি লম্বা, ১১.২ থেকে ১৪ গ্রাম ওজন। মাঝারি আকারের টিট এরা। দীর্ঘ
খাড়া মুকুট বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পেটের তলার দিক বাফ রঙের হয়। ফ্যাকাশে বাফ রঙ থাকে কপালের
নিচের দিকে। মোটামুটি শান্ত প্রকৃতির পাখি। ডাক উচ্চ বা নিচুমাত্রার ‘zee’ বা ‘Zai’ ধরনের শব্দ এবং দ্রুত তালের কিন্তু কাটা
কাটা ‘তি-তি-তি-তি’। খাদ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অমেরুদন্ডী প্রাণী এবং শূককীট।
লার্জ উডশ্রাইক (Tephrodornis gularis) T. virgatus
বিজ্ঞানসম্মত
নামটিও অপর্যাপ্ত ভিত্তিতে একটি বিকল্প হিসাবে প্রদান করা হয়েছে এই প্রজাতিকে। Tephrodornithidae পরিবারভুক্ত একটি প্রজাতি। পূর্বে এদের Campephagidae (cuckooshrikes) প্রজাতিভুক্ত বলে মনে করা হত। বাংলাদেশ, ভুটান, ব্রুনেই, কম্বোডিয়া, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, নেপাল, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামে এদের দেখতে পাওয়া যায়। তার প্রাকৃতিক আবাসস্থল নাতিশীতোষ্ণ বনাঞ্চল, প্রায় ক্রান্তীয় বা ক্রান্তীয় আর্দ্র নিম্নভূমি অরণ্য, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বা ক্রান্তীয় ম্যানগ্রোভ বন এবং প্রায় ক্রান্তীয় বা ক্রান্তীয় আর্দ্র পার্বত্য বনাঞ্চল। এদেরকে মালাবার উডশ্রাইকের সাথেও কখনও-সখনও একই প্রজাতিরূপে দেখা হয়েছে।
১৮.৫
থেকে ২৩ সেমি লম্বা। ২৮ থেকে ৪৬ গ্রাম ওজন। মোটা ঠোঁটওয়ালা গাট্টাগোট্টা ধরনের পেশল পাখি। স্বতন্ত্রভাবে নাকের কাছে কিছু সরু লোমের অস্তিত্ব
লক্ষণীয়। পুরুষদের সাদা কপাল, চোখের চারপাশজুড়ে কালচে নীল মাস্কের মতো থাকে। উচ্চস্বরে ধ্বনিত ‘পাই-পাই-পাই-পাই-পাই-পাই’ বা ‘কি-কি-কি-কি’ শব্দ এদের ডাক বা গানের বৈশিষ্ট্য।
বড়ো পোকামাকড়, বিশেষভাবে ম্যান্টিস (Mantidae), ঝিঁঝিঁ (Gryllidae), লাঠি-পতঙ্গ (Phasmatodea), ফড়িং, পঙ্গপাল খায়।
স্ট্রাইপ থ্রোটেড ইউহিনা (Yuhina gularis) হোয়াইট-আই পরিবার Zosteropidae -ভুক্ত একটি পাখি প্রজাতি। ভুটান, চীন, ভারত, লাওস, মায়ানমার, নেপাল এবং ভিয়েতনামে এদের দেখা পাওয়া যায়।
প্রাকৃতিক বাসস্থান প্রায় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বা ক্রান্তীয় আর্দ্র পার্বত্য অরণ্য, শীতপ্রধান ওক, বার্চ এবং রডোডেনড্রন বন অথবা রডোডেনড্রন আধিক্যযুক্ত এবং কনিফেরাস বনাঞ্চল।
১২
থেকে ১৬ সেমি লম্বা। ১২ থেকে ২৬ গ্রাম ওজন। তুলনামূলকভাবে
বড়ো মাপের এই ইউহিনার বিশিষ্ট খাড়া ঝুঁটি, কালো ডোরাকাটা গলা এবং কমলা-বাদামি পাখার বিস্তার
লক্ষণীয়। সামান্য চেরা লেজ। সাধারণত উচ্চমাত্রার, সংক্ষিপ্ত, অনুনাসিক ‘mherr’ বা ‘wherr’ বা ‘skyeer’ ধরনের ডাক।
বিটল (Coleoptera), বোলতা (Hymenoptera) এবং অন্যান্য পোকামাকড়, এছাড়াও berries (Heptapleurum), বিভিন্ন ফুলের মধু এদের খাদ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত। অস্তিত্ব চিন্তাজনক নয়। নেপালে ল্যাংট্যাং ন্যাশনাল
পার্কে ব্যাপকভাবে দেখতে পাওয়া যায়।
হোয়াইট
ব্রোওড ক্রেক
(Amaurornis cinerea) Rallidae পরিবারের একটি পাখি
প্রজাতি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং গ্রেটার সুন্দা এলাকা
হয়ে ফিলিপাইন, সুলাওয়েসি, মোলাক্কাস
এবং লেসার সুন্দা থেকে নিউগিনি এবং উত্তর অস্ট্রেলিয়া, সাথে মাইক্রোনেশিয়া
এবং মেলানসিয়া (ভানুয়াতু
এবং নিউ ক্যালেডোনিয়া)
ডব্লু. সি. পলিনেশিয়া (ফিজি এবং সামোয়া)-তে এদের দেখা মেলে। আগে জাপানের আগ্নেয়গিরি, আইয়ো জিমা এলাকাতেও
এদের দেখা পাওয়া যেত।
১৫
থেকে ২০ সেমি
লম্বা। ৪০ থেকে ৬২.৫ গ্রাম ওজন। পাখার
প্রসারতার দৈর্ঘ্য প্রায় ২৭ সেমি।
ছোটো মাপের ক্রেক প্রজাতি,
অপেক্ষাকৃতভাবে দীর্ঘ পা এবং আঙুলের অধিকারী। প্রচলিত
ডাক উচ্চমাত্রার
অনুনাসিক, দ্রুত
পুনরাবৃত্তির
‘চিকা’ শব্দ। পুরুষ এবং নারী পাখি এক সঙ্গে ডাকে। খাদ্যতালিকায় থাকে কেঁচো, শামুক, জোঁক, পোকামাকড়, জল মাকড়সা, ব্যাঙের ডিম এবং ছোটো
মাছ। এছাড়াও বীজ ও জলজ উদ্ভিদের পাতা। প্রাকৃতিক
বাসস্থান প্রায় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বা ক্রান্তীয় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। এদের একটি
উপপ্রজাতি ‘আইয়ো জিমা রেইল’, যা এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মাস
কয়েক আগে ভারতবর্ষে এদের দেখা পাওয়া গেছে। সাথে দেওয়া ছবিটি সেই ফটোগ্রাফ থেকেই
আঁকা।
ব্লাইথস পিপিট (Anthus godlewskii) একটি মাঝারি আকারের চড়াই-জাতীয় পক্ষীবিশেষ যা
মঙ্গোলিয়া এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার প্রজাতিরূপে বিবেচিত হয়। দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম
করে এরা দক্ষিণ এশিয়ায় নিম্নভূমিতে মাইগ্রেট করে চলে আসে। পশ্চিম
ইউরোপে এদের দেখা পাওয়া খুবই বিরল। এরা বেশ বড়ো মাপের পিপিট প্রজাতি।
কিন্তু
অন্য প্রজাতির সাথে বিশেষ কোনও পার্থক্য দেখা যায় না। কেবলমাত্র তলার অংশ
বাদামি এবং নিচে ফ্যাকাশে রঙ পরিলক্ষিত হয়।
রিচার্ডস
পিপিট পাখির অনুরূপ দেখতে কিন্তু মাপে সামান্য
ছোটো, খাটো
পা এবং ঠোঁট
ছোটো, কালচে রঙের। এদের ওড়ার ক্ষমতা বেশি। এদের ডাকের
একটি বৈশিষ্ট্য ‘pshee’ ধরনের আওয়াজ যা
রিচার্ডস
পিপিটের চেয়ে উচ্চতর মাত্রার। এই প্রজাতি পতঙ্গভূক।
রুফাস ক্যাপড ওয়ারবলার (Basileuterus rufifrons) একটি নিউ ওয়ার্ল্ড ওয়ারব্লার প্রজাতির পাখি। সাধারণত
১২.৭
সেমি (৫ ইঞ্চি) লম্বা হয়। জলপাই বা ধূসর জলপাই রঙের গায়ের রঙ। পেটের
তলা সাদা, উজ্জ্বল
হলুদ বুক এবং গলা। সাথে সাদা রঙের ভুরু যা মাথার রুফাস
মস্তকাবরণের সাথে যুক্ত। একটি
কালচে দাগ রুফাস রঙের গাল পর্যন্ত বিস্তৃত। চোয়ালের কাছে সাদা
দাগ থাকে। এদের ঠোঁট অন্যান্য ওয়ারবলারদের তুলনায় স্থুলকায়। ডানা বৃত্তাকার এবং
যথেষ্ট মোটাসোটা হয়। লেজ লম্বা, প্রায়ই একটি উচ্চকোণ অনুসারে
উত্থাপিত থাকে এবং নাচাতে দেখা যায়।
যদিও এরা সাধারণভাবে ক্রান্তীয় গুল্মময় উচ্চভূমির
পাখি, তবুও উত্তর আমেরিকায় ঘন
গাছপালা কম থাকার কারণে নদী বা জলাশয়ের কাছাকাছি ওক
বনভূমিতে
বিচরণ করে। এদের ডাক দ্রুতমাত্রার পুনরাবৃত্তিযুক্ত, ‘চিট-চিট-চিট-চিট-চিট-চিট’
ধরনের
শব্দ। যার সাথে রুফাস ক্রাউন্ড স্প্যারোর ডাকের মিল আছে।
তবে অন্যান্য নিউ ওয়ার্ল্ড ওয়ারবলারের মতো এই প্রজাতি আসলে নির্দিষ্টভাবে গান করে
না। প্রাথমিকভাবে পোকামাকড় এবং মাকড়সা খেতে ভালোবাসে। ঘন ঝোপ এবং মাটিতে বেশ
মনোযোগ দিয়ে খাবার খুঁজতে এদের দেখা যায়। এদের উড়ন্ত অবস্থায় পোকা ধরতে দেখা যায়
না বলা যেতেই পারে।
আন্দামান বুলবুল (Pycnonotus fuscoflavescens) বুলবুল পরিবার passerine
গোত্রের এক সদস্য। এদের দেখা মেলে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ
এলাকায়। প্রধানত জলপাই রঙের সাথে হলুদ পালকের মিশ্রণ থাকে এবং মাথা জলপাই রঙের হয়। ১৪ থেকে ১৭
সেমি. মাপের ছোটো, ছটফটে পাখি।
পুরুষদের কালচে
কপাল এবং গলা। সাথে চকচকে
পাঁশুটে জেল্লা লক্ষণীয়। জলপাই রঙের মুকুট থাকে। এদের
গান একটি সংক্ষিপ্ত উচ্চমাত্রার ছোটো, পাতলা, ধাতব ‘tsit-tsut-tsit’ আওয়াজের
দ্রুত সিরিজ। এরা ছোটো ফল এবং বেরি খেতে ভালোবাসে। সাথে পোকামাকড় থাকে খাদ্য
তালিকায়। ফলগাছ ঝোপঝাড়ের শাখা থেকে পেড়ে খায়।
[ক্রমশঃ]
_____
ছবিঃ লেখক
Nice Work..
ReplyDelete