কাজু ও পিএস-এইট
তৃষিতা মিত্র
স্টেশনে পৌঁছোতে না
পৌঁছোতেই কাজু দেখল দাদান আর ফুচকামামা হাসি হাসি মুখে ওদের ওয়েলকাম করতে
প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে। ক্লাস ওয়ানের অ্যানুয়াল এগজাম শেষ। তাই এখন টানা থ্রি উইক
লম্বা ভ্যাকেশন। অতএব বাপি ডিক্লেয়ার করল, “চলো শিলিগুড়ি।”
যেমন কথা তেমনি কাজ।
শেষদিন জিওগ্রাফি এগজামের পর কাজু প্ল্যান করেই রেখেছিল ঝিঙ্কাইদের দুটো হোয়াইট র্যাবিট
কুকু আর কিকোর সঙ্গে ভাব জমাতে যাবে। সেইমতো স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে বেশ কিছু
নরম নরম সবুজ লতাপাতা আর ঘাস সংগ্রহ করেছিল ও। কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে যা হয় আর
কী! মাম্মাম তো কিছুতেই যেতে দিল না, উল্টে বায়না করায় একচোট বকাবকিও করল। তাই
রাতের সমস্তটা পথ কাজুর মনটা ছিল বড্ড খারাপ। জানালার পর্দা একটুখানি সরিয়ে বাইরের
দৃশ্য দেখার চেষ্টা করেছিল ও। কিচ্ছুটি নেই। শুধুই ঘুটঘুট্টি অন্ধকারের রাজ্য।
ভয়ের চোটে কাজু তাড়াতাড়ি চোখ বুজে ফেলেছিল। ঘুম ভাঙল এক্কেবারে
পরদিন। মায়ের ডাকে।
দাদানবাড়ির এই পুরনো
বাগানে এলেই মনটা কেমন যেন হয়ে যায় কাজুর। কত্ত নাম না জানা ঘাস, ঝোপঝাড়, একটুখানি হাত দিলেই কুঁকড়ে যাওয়া লজ্জাবতীরা! সাদা সাদা লিলি, গোলাপি
নয়নতারা, বেগুনি রঙের অপরাজিতা এদিকে সেদিকে ফুটে রয়েছে। টাইগার লিলি গাছের বড়ো
বড়ো পাতাগুলোর নিচের দিকে তো লুকিয়ে আছে ছোটো ছোটো শক্তখোলার শামুক!
দোয়েল-শালিক-বুলবুলি-চড়ুইয়ের আনাগোনা লাগাই! আর আছে রামঝগড়ুটে ছাতারের দল।
আপনমনে গঙ্গাফড়িংটার
ওড়াওড়ি দেখতে দেখতে হঠাৎ মুসাণ্ডাগাছটার দিকে চোখ গেল কাজুর। মাঝারি উচ্চতার
ঝাঁকড়া একটা গাছ, তাতে গোলাপি ফুলে ছেয়ে আছে। দাদান বলে, মুসাণ্ডা ফুল
নাকি আরও নানা রঙের হয়। আগে একটা লাল রঙের মুসাণ্ডা
ফুলগাছ ছিল। তাতে ছিল প্রজাপতিদের অবাধ আনাগোনা। হঠাৎ যে কী হল, গাছটা ফুল-পাতা
ঝরিয়ে একদম শুকনো খটখটে হয়ে গেল।
ওম্মা! কত্ত বড়ো
প্রজাপতি! আসমানি নীল রঙের বড়ো বড়ো ডানা তাতে, আবার সোনালি আভার ছোটো ছোটো ফুটকি!
পিসিমণির বিয়েতে মা ঠিক এরকমই তো একটা শাড়ি পরেছিল! ভাবতেই ফ্যাক করে হেসে ফেলল
কাজু। ওর হাসির শব্দেই বুঝি কিনা জানা নেই, প্রজাপতিটা উড়ে উড়ে ওর এক্কেবারে
কাছে চলে এল। কাজু অবাক! এরকমও কি সম্ভব! ঠিক মানুষের মতন ছোট্ট এতটুকুনি
মুখ-হাত-পা-চোখ, কিন্তু পিঠে ইয়াব্বড় দুটো ডানা! আর শরীরটা অবিকল প্রজাপতির! ফ্যাল
ফ্যাল করে চেয়ে রইল কাজু।
“হ্যাল্লো কাজু, আমি পতঙ্গসম্রাট
পিএস-এইট! তোমাদের পৃথিবী থেকে একশো লাইট ইয়ার দূরের প্ল্যানেট থেকে এখানে এসেছি। আমি পৃথিবীর যাবতীয় ভাষা
বুঝি ও বলতে পারি।”
“কিন্তু তুমি, মানে আপনি
এখানে কেন? কী দরকারে?”
“দেখো কাজু, আমরা মাঝেমধ্যেই
ইউনিভার্স ভিজিটে বেরিয়ে যাই। আমার মাথায় যে অ্যান্টেনা দেখছ, এর সাহায্যে আমরা
নিজস্ব সংকেত আদানপ্রদান করি। ঘুরতে ঘুরতে একদিন এখানে এসে দেখি, তোমাদের পৃথিবীতে এতটাই দূষণ যে আমার অ্যান্টেনার মিউটেশন হয়ে গিয়েছে। ফলে আমার সঙ্গে আমাদের
প্ল্যানেটের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আর তখন থেকেই আমি তোমাদের এই
বাগানকে আমার পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস বানিয়ে নিয়েছি।”
“এখন তুমি, মানে আপনি
ফিরবেন কীভাবে, পতঙ্গসম্রাট?”
“জানি না কাজু! যদি
কোনওদিন কোনও রেসকিউ টিম আসে তবে হয়তো সম্ভব। আর আমাকে ‘আপনি’ বলার
কোনও দরকার নেই।”
কাজু দেখল পিএস-এইটের
চোখে জল!
“তুমি কাঁদছ!”
“আমি কাঁদতে জানতাম না,
কাজু। আমাদের প্ল্যানেটে কোনও অনুভূতিই নেই! কিন্তু মিউটেশনের প্রভাবে
অনুভূতির সঙ্গে সঙ্গে লোভ,
হিংসা, রাগ, দুঃখ এসব
কিছুটা হলেও আমার মধ্যে এসে গিয়েছে আর তারই সাইড এফেক্ট হয়তো এই কান্না।”
কাজু কিছুই বুঝতে পারল
না। চেয়ে রইল খালি।
“আমি কি তোমাকে আমার
বন্ধু করতে পারি, পতঙ্গসম্রাট?”
“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই!”
সেই থেকে কাজু আর পিএস-এইট
বন্ধু। ওরা এখন কলকাতার বাড়িতে এক সঙ্গে থাকে। দু’জনে মিলে বাগান করে। গাছ লাগায়।
পিএস বলেছে, ওদের প্ল্যানেট নাকি পৃথিবীর মতো এত সুন্দর নয়। গাছপালা ওখানে সারভাইভ
করতে পারে না। কাজু জানে, ওর দায়িত্ব পৃথিবীকে সুন্দর রাখা। আর পৃথিবী সুন্দর থাকলেই
না সবাই ভালো থাকবে! তাই গাছে নিয়মিত জল দেয় কাজু। নিজের হাতে ওর ঘরের ডাস্টবিন
পরিষ্কার করে। রাস্তাঘাট কক্ষনও নোংরা করে না। কারণ পিএস বলে, ছোটো ছোটো
পদক্ষেপ নিলেই আমরা সবাই পৃথিবীকে সুন্দর রাখতে পারব। কিন্তু পিএস-এর বড্ড মনকেমন
করে ওর প্ল্যানেটের জন্যে। পিএস ভালো নেই। রাতে যখন সবাই
ঘুমিয়ে পড়ে তখন চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে আকাশে ওড়ে পিএস। কাজু জানে সেটা। বাপি, মাম্মাম বা অন্য
কেউ কিন্তু পিএসের কথা জানে না। পিএস জানাতে বারণ করেছে। পিএস-এরও
কি বাপি আছে? মাম্মাম আছে? কাজু অনেকবার জিগ্যেস করেছে, কিন্তু
কোনও উত্তর মেলেনি।
যেদিন ওদের পোঁতা
শিউলিগাছে প্রথম কুঁড়ি ধরল, সেদিন কাজু ভীষণ খুশি। পুজো আসছে! বিন্দুমাত্র দেরি না
করে খবরটা পিএস-এইটকে জানাল কাজু। পিএস আবার পুজোআচ্চা, ধম্ম-কম্ম ব্যাপারটা
বিশেষ বুঝতে পারে না কোনওদিনই। ও অতটা বোধহয় খুশি হতে পারল না। কাজু বুঝতে পারে,
পিএস রোজ রেসকিউ টিমের অপেক্ষা করে। পৃথিবীতে ও ভালো নেই। কাজু তাই
ভেবে রেখেছে, এবারে ও মা দুগ্গার কাছে মন দিয়ে প্রার্থনা করবে যেন পিএসকে রেসকিউ টিম
খুব তাড়াতাড়ি খুঁজে পায়। ওর প্ল্যানেটে ফিরতে হবে তো ওকে!
_____
অলঙ্করণঃ শ্রীময় দাশ
ভাল লাগল। পি.কে ছবির কথা মনে পড়ল ঘরছাড়া পি এস এইটের কথা পড়ে। কিছু কিছু শব্দ ইংরেজির বদলে বাংলাতেও লেখা যেতে পারত মনে হল।
ReplyDeletekhub valo lekha..
ReplyDeletekhub valo lekha..
ReplyDeleteKhub valo hoiche re Trishu.....😘😘😘
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteDarun hoechhe trishita...chhotobelar kotha mone koranor moto....r ami tor 5 to 12 er a section er frnd 😘😘😘😘😘😘😘😘😘
ReplyDelete