নিউমেরোলজি
বাবিন
“কই
হে? সব এখনও ঘুমুচ্ছ নাকি?”
রবিবারের সক্কাল সক্কাল অমরবাবু হই হই করে হাজির বিশাল বড়ো এক
চাঙারি গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ডালপুরি আর একটা মস্ত মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে। আমি
আর বুল্টি বৈঠকখানা ঘরে সবে টোটোদার কাছে অঙ্কের খাতাটা খুলে বসেছিলাম। ডালপুরির
সুবাসে পড়া মাথায় উঠল। জুল জুল করে সেদিকে চেয়ে জুতসই কিছু
একটা বলার কথা ভাবছিলাম। টোটোদা আলতো করে আমার জুলপিটা ধরে
টান মেরে অমরবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার? আজ
হঠাৎ সাতসকালে?”
ততক্ষণে টোটোদার মা, আমাদের জেঠিমাও বেরিয়ে এসেছেন
হাসিমুখে, “কী ব্যাপার দাদা, খুশির খবরটা কী?”
“খুশি হব না!” অমরবাবু চাঙারি
আর প্যাকেটটা জেঠিমার হাতে চালান করে দিয়ে হাঁ হাঁ করে উঠলেন, “বাবলু এবার ইস্কুলে
স্ট্যান্ড করেছে, বুঝলেন। এক থেকে
দশের মধ্যে নাম রয়েচে! নিন, ধরুন ধরুন এগুলো, সবাইকে ভাগ করে দিন।”
তারপর টোটোদার দিকে ঘুরে বললেন, “ধন্যি তুমি। সত্যিই গাধা
পিটিয়ে ঘোড়া বানাতে পার দেখছি। অমন
বিচ্ছু ছেলে যে এত ভালো রেজাল্ট করবে সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি।”
টোটোদা মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।
টোটোদা হল সুবোধজেঠুর ছেলে। ভালো নাম, সুবাস চট্টোপাধ্যায়।
যাদবপুরে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ছে। দারুণ
বুদ্ধি। গোটাকতক টিউশনি করে নিজের হাতখরচ
নিজেই চালায়। আমাকে আর বুল্টিকে অঙ্ক-বিজ্ঞান পড়ায়
হপ্তায় তিনদিন। বুল্টি হল তিনুকাকুর মেয়ে।
আমাদের বাড়ির ঠিক উলটোদিকে ওদের বাড়ি। আমার সঙ্গে
একই ক্লাসে পড়ে। আর আমি হলাম বাঘু। ভালো
নাম, অর্চিস্মান
রায়।
টোটোদাদের বাড়িটা আমাদের দুটো বাড়ি পরেই।
কোন্নগরে এই বিশ্বম্ভর ব্যানার্জী লেনের প্রতিটি বাড়িই প্রত্যেকের আত্মীয়ের মতো। সবাই
সবাইকার খুব আপন। টোটোদাকেও কোনওদিন আমার নিজের দাদা
ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। অমরবাবুও এই
পাড়াতেই থাকেন। বেশ ভালো মানুষ। সদা
হাস্যময়। মাঝারি উচ্চতার গোলগাল ফর্সা একমাথা
টাক মানুষটিকে দেখলেই আমার কেন জানি টেডি বিয়ারের কথা মনে পড়ে যায়। ওঁর
একটিমাত্র সন্তান, বাবলু। ভীষণ
বিচ্ছু ছেলে। বরাবর মোটামুটি গোছের রেজাল্ট করে এসেছে।
তাই টোটোদা পড়াবার পর এই বছর ওর যে উন্নতি হয়েছে সেটার পুরো ক্রেডিট আর কাউকে
দেওয়া যাবে না। টোটোদার এই সাফল্যে আমারও খুব আনন্দ হল।
ডালপুরি মুখে পুরে অমরবাবু বললেন, “এমনি সব ঠিকই আছে, তবে
ওর রোল নম্বরটা নিয়ে একটু চিন্তায় আছি। ভাবছি কাল
একবার ইস্কুলে যাব।”
টোটোদা একটা জলভরা তালশাঁস সন্দেশ খুব সাবধানে কাত করে,
যাতে রসটা না গড়িয়ে পড়ে এমনিভাবে, কামড় বসিয়ে বলল, “রোল নম্বর নিয়ে চিন্তা? এটা তো ঠিক বুঝলাম না।”
“আর বোলো না। ওর ডেস্টিনি নম্বর হল সাত, আর ওদের ইস্কুলে
রোল নম্বর দেয় আগের ফাইন্যাল পরীক্ষার র্যাঙ্ক অনুযায়ী।”
অমরবাবু চোখ গোল গোল করে বললেন, “এ বছর ওর রোল নম্বর ছিল পঁচিশ। দুই প্লাস পাঁচ ইজ ইকুয়াল্টু সাত, মানে ওর লাকি
নম্বর। কিন্তু
র্যাঙ্ক অনুযায়ী ক্লাস সিক্সে ওর রোল নম্বর হবে এইট। এটাই
আমার চিন্তার কারণ। যে কোনওভাবে ওটা হয় সাত, নয়তো ষোল করতেই হবে।”
দেখলাম টোটোদাও আমার মতো কথাটা শুনে অবাক হয়ে ভ্রূ কুঁচকে
ফেলল, “কী বলছেন মশাই, ঠিক বুঝতে পারলাম না। একটু বুঝিয়ে
বলুন তো।”
অমরবাবুর ডালপুরি ফুরিয়ে গিয়েছিল।
উনি মিষ্টি খান না। তাই প্লেটটা নামিয়ে রেখে গ্লাস থেকে একটু জল
খেয়ে বললেন, “হ্যাঁ, এই ব্যাপারটা সকলে জানে না। আমিও
আগে জানতুম না। অবনী চৌধুরীর সঙ্গে দেখা না হলে হয়তো
কোনওদিন জানতেও পারতুম না। জিনিসটা
আশ্চর্যজনক বললেও কম বলা হবে। প্রত্যেক
মানুষের একটা ডেস্টিনি নম্বর থাকে।”
“ডেস্টিনি নম্বর!” টোটোদা ভারি অবাক হয়ে বলল।
“হ্যাঁ গো, ডেস্টিনি নম্বর।”
অমরবাবু বললেন, “তোমার জন্ম-তারিখটা বল দিকি।”
“টেনথ
ডিসেম্বর, নাইনটি সিক্স।”
“ইসস,” অমরবাবু চুকচুক করে উঠলেন, “একটুর জন্য হল না।”
“কী হল না?” আমি থাকতে
না পেরে বলে উঠি। বুল্টি আমাকে আলতো করে একটা চিমটি কাটল। আমি
ভুলে গেছিলাম বড়োদের কথার মাঝখানে কথা বলাটা টোটোদা আবার পছন্দ করে না।
তবে টোটোদা দেখলাম ব্যাপারটা নিয়ে এতই উত্তেজিত যে আমার কথাটা গ্রাহ্য করল না।
অমরবাবু আমাদের বোঝাতে লাগলেন, “জন্ম-তারিখের মোট যোগফল যদি
কারও এক হয় তো সে হল গিয়ে যাকে বলে রাজা।”
“কীরকম?” টোটোদা
ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া স্বরে বলে, “একটু খুলে বলুন তো।”
“তোমার জন্ম-তারিখ দশ। দশের
এক আর শূন্য যোগ করলে হয় এক। ডিসেম্বর
মানে হলে বারো। এক আর দুই যোগ করলে হয় তিন।
উনিশশো ছিয়ানব্বইয়ের এক, নয়, নয় আর ছয় যোগ করলে হয় পঁচিশ।
আবার পঁচিশের দুই আর পাঁচ যোগ করলে হয় সাত। এবার
সব যদি যোগ কর, মানে তারিখের এক, মাসের তিন আর বছরের সাত যোগ করলে কী হবে? এগারো। আর এগারোর
এক আর এক যোগ করলে হয় দুই! অর্থাৎ, তোমার ডেস্টিনি নম্বর হল দুই।”
আমার মাথা ঘুরতে লাগল।
কিস্যু মাথায় ঢুকল না। বুল্টির দিকে চেয়ে দেখলাম, ওর
অবস্থাও তথৈবচ।
“কিন্তু তাতে কী হল?”
টোটোদা যেন আমার প্রশ্নটাই করল, “আপনি কি জানেন, সত্যজিৎ রায়ের জন্ম-তারিখ দোসরা
মে উনিশশো একুশ?”
“দেখ বাপু, যাদের ডেস্টিনি নম্বর এক তারা হল লগন চাঁদা।
তোমার দুই। খুব একটা মন্দ নয় অবিশ্যি, তবে এক হলে জীবনে
বহুদূর যেতে। সত্যজিৎ রায়ের ডেস্টিনি নম্বর যদি দুই না হয়ে এক
হত তাহলে যে আরও অনেক বেশি নাম করতে পারতেন না, সেটাই বা কে বলতে পারে?”
“তাহলে যাদের ডেস্টিনি নম্বর এক নয় তারা কি জীবনে উন্নতি
করবেন না?” টোটোদা ভাবলেশহীন মুখ করে জিজ্ঞেস করল।
আমি হাসি লুকোবার চেষ্টা করলাম। অমরবাবু যে
এতটা কুসংস্কারগ্রস্ত, এটা জানতাম না। তবে
ভদ্রলোক বেশ ভালো একটা চাকরি করেন বলে শুনেছি।
“উঁহু, তা কেন হবে। তবে
ডেস্টিনি নম্বরকে ব্যবহার করতে পারলে জীবনে বেশি উন্নতি করা যায়।”
“আর একটু বুঝিয়ে বলুন।”
টোটোদা বলল।
“যেমন তোমার ডেস্টিনি নম্বর দুই।
তাই যদি তোমার নামটির সাংখ্যমান দুই করা যায় তবে উন্নতি পায়ের তলায় লুটোপুটি খাবে। জীবনে
সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ যদি দুই, এগারো বা কুড়ি তারিখে করতে পার, তোমার সাফল্য
ঠেকায় কে! আমার ছেলের ডেস্টিনি নম্বর সাত। তাই ওর
জীবনে সাত নম্বরটি গুরুত্বপূর্ণ। যদি ওর ইস্কুলের
রোল নম্বর সাত করা যায় তাহলে দেখে নিও পরের বারও ভালো ফল হতে বাধ্য।”
আমি ভাবছি, তাহলে কি উনি বলতে চাইছেন টোটোদার পড়ানোর কোনও
দামই নেই? শুধু কি নম্বরের জন্যই এত সাফল্য? ভয় হল টোটোদা রেগে না যায়।
কিন্তু ও দেখলাম বেশ ভালোমানুষের মতো মুখ করে জিজ্ঞেস করল, “এই বিদ্যেটি আপনাকে
দিল কে? মানে কোনও বই-টই পড়ে...”
“সে অনেক বড়ো ঘটনা।” অনেক
পুরনো ঘটনা মনে করার ভঙ্গিতে অমরবাবু ধীরে ধীরে ভেবেচিন্তে বলতে শুরু করলেন, “আমি
আগে তোমার মতোই এই নিউমেরোলজি সম্পর্কে বিলকুল ওয়াকিবহাল ছিলুম না। কিন্তু
একটা ঘটনার পর থেকে সমস্ত ধারণাটাই পালটে গেল।
খুলে বলি, রোসো।”
আমরা বেশ উত্সুক হয়ে তাকিয়ে রইলাম অমরবাবুর দিকে।
বুঝলাম, একটা জমাটি গল্প শুরু হতে চলেছে।
“গেল বোশেখ মাসের কথা। শনিবার
সকাল ন’টা
নাগাদ ঢাকুরিয়ায় ডাক্তার স্বরূপ ঘোষের চেম্বারে বসেছিলুম। ডাক্তারবাবু
রুগী দেখছিলেন। কম্পাউন্ডারকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে ডাক পড়ার অপেক্ষা
করছি। মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ বন্ধু
রাজার কাছে শুনেছিলুম ডাক্তারবাবু নাকি একটা গাড়ি জলের দরে বেচে দিচ্ছেন। বেশ
ভালো কন্ডিশন। আমারও একটা গাড়ি কেনার শখ ছিল।
সস্তায় পাওয়া যাবে শুনে রাজার মারফত ডাক্তারবাবুর কাছে আর্জি জানিয়ে পাঠাতেই
মঞ্জুর হয়ে গেল। তার পরদিনই পঞ্চাশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে
গাড়িটা বুক করে নিই। সেদিন
গিয়েছিলুম ডাক্তারবাবুর কাছে আমার পরিচিতি সংক্রান্ত কাগজপত্র দেবার জন্য।
সোমবার কোর্টে গিয়ে হস্তান্তরপর্ব পুরোপুরি চুকে যাবে। তখনই
উনি বাকি টাকাটা নেবেন।
“আমার পাশে বসে এক রোগাসোগা মোটা গোঁফওলা সুবেশ ভদ্রলোক
নিউজ পেপারে অনেকক্ষণ ধরে কীসব আঁকিবুঁকি কাটছিলেন। রুগী
হতে পারেন। আচমকা উনি অনেকটা স্বগতোক্তির ঢঙে
বলে উঠলেন, ‘ইয়ে, জন্ম-তারিখটা ঠিক আছে তো?’
“বিষম খেয়ে বলি, ‘আপনি কী
করে...’
‘চিন্তার কিছু নেই,’ লক্ষ করলুম,
কথা বলতে বলতে ভদ্রলোক ঘন ঘন নিজের মাথাজোড়া টাকে হাত বোলাচ্ছেন। বোঝা
গেল এটা ওঁর মুদ্রাদোষ। উনি চাপা সুরে বললেন, ‘বয়স
নিয়ে সমস্যা অনেকেরই থাকে। একটা
এফিডেবিট করে দিলেই হয়ে যাবে।’
“বুঝলুম, ভদ্রলোক আমার হাতে থাকা প্যান কার্ডের ফটোকপিটা লক্ষ
করেছেন। উনি ঠিকই বলছেন। আসলে
ইস্কুলে আমার জন্ম-তারিখটা ভুল ছিল। বার্থ
সার্টিফিকেটে সঠিক তারিখটা আছে। আমার প্যান-রেশন-আধার কার্ড সমস্ত জায়গায় ভুলটাই রয়ে গেছে। কিন্তু
ইনি সেটা বুঝলেন কীভাবে?
“ভদ্রলোক আমার প্রশ্নটা আঁচ করলেন বোধহয়, ‘আপনার হাতের ফটোকপিতে দেখছি জন্ম-তারিখ পয়লা জানুয়ারি,
১৯৭০। অর্থাৎ জন্ম-তারিখ ১, জন্ম-মাস
জানুয়ারি মানে ১ আর সবসুদ্ধ যোগফলও ১ । এ তো
রাজযোগ! এইধরনের মানুষরা প্রচন্ড ড্যাশিং-পুশিং হয়, যেটা আপনাকে
দেখে মোটেও লাগছে না।’
“এটাও উনি ঠিকই বললেন। আমি একদমই
বলিয়ে-কইয়ে নই। বেশি মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে
পারি না। নিজের জগতেই ডুবে থাকি। অফিসে
বাড়িতে একইরকম। নিজের কমফর্ট জোন থেকে বেরোতে ভীষণ
ভয় পাই। তবে ভদ্রলোকের কথার পুরোটা আমার কাছে
পরিষ্কার হল না। তাই জিজ্ঞেস করলুম, ‘মোট
যোগফল ১ কীভাবে হয়? ঠিক বুঝতে পারলুম না।’
“উনি বোঝালেন, ‘পুরো জন্ম-তারিখটা
যোগ করলে হয় উনিশ, ১+১+১+৯+৭+০ = ১৯। আবার
উনিশের ১ ও ৯ যোগ করলে হয় ১০ আর দশের ১ আর ০ যোগ করলে তো ১ হয়!’
“কিন্তু
এর সঙ্গে ড্যাশিং-পুশিংয়ের কী সম্পর্ক আছে?’
“উনি বললেন, ‘পুরোটাই! এই দুনিয়ায় ঘটা সব ঘটনার
সঙ্গেই নম্বরের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে।’
“বিশ্বাস করো, আমার হাসি পেল। হাসি চেপে
ভালোমানুষের মতো মুখ করে জিজ্ঞেস করি, ‘কীভাবে?’
“আপনার
আসল জন্মতিথিটি বলুন দেখি অমরবাবু।’ উনি আমার নামটাও দেখে ফেলেছেন বুঝলুম।
“৬
আগস্ট, ১৯৭২।’
“তার
মানে ৬+৮+১+৯+৭+২ = ৩৩ = ৩+৩ = ৬ হল?’ ভদ্রলোক
ভারি খুশি হয়ে হাতে হাত ঘষতে ঘষতে বললেন, ‘এবার আপনার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ
গোটা কয়েক তারিখ বলুন দিকি।’
“ভেবে দেখলুম, আমার বিয়ের তারিখ ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০০৫। তার
মানে ৬ তো রয়েইছে, আবার ৬+২+২+০+০+৫ = ১৫ = ১+৫ = ৬
“দেখলেন?’
“আমিও তলিয়ে দেখি, যেখানে আজ প্রায়
বছর চোদ্দ ধরে চাকরি করছি সেই কোম্পানির অফার লেটার পেয়েছিলুম ২৪ এপ্রিল, ২০০৩
তারিখে। তার মানে ২৪ হল ২+৪ = ৬ আর
২+৪+৪+২+০+০+৩ = ১৫ = ৬!
“জীবনে কিছু কিছু দিন থাকে যেগুলোকে কখনও ভোলা যায় না।
যেমন এই চাকরি পাবার দিনটা। এটাই আমার
প্রথম চাকরি নয় যদিও। কিন্তু আগের কোম্পানি থেকে চাকরি
যাবার পর বেশ হতাশায় ভুগছিলুম। এই চাকরিটা
আমাকে যেন খাদের ধার থেকে টেনে আনে। তাই
তারিখটা কক্ষনও ভুলতে পারব না।
“এবার
এটা দেখুন,’ ভদ্রলোক চটপট একটা ছক এঁকে দেখালেন —
“আশ্চর্য! আমার নামের সাংখ্যমান ৬, আবার পদবিতেও রয়েছে ৬! ব্যাপারটার
মধ্যে একটা চমত্কারিত্ব আছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
কিন্তু ধন্দ কাটে না আমার। জিজ্ঞেস করলুম, ‘আমার নাম তো বাবা-মা এই সাংখ্যমান মিলিয়ে রাখেননি, এটা তো
কাকতালীয়ই বলা যেতে পারে, তাই না?’
“অবনীবাবু বললেন, ‘অবশ্যই এটা
কাকতালীয়। আপনার বাবা-মা নিশ্চয়ই নিউমেরোলজি মেনে নাম
রাখেননি। কিন্তু এই মিলটুকুর জন্যই আপনি আজ উন্নতির শিখরে।
আমার ধারণা, কর্মক্ষেত্রেও আপনি যথেষ্ট উন্নতি করেছেন এবং তার জন্য আপনার নামটাই
দায়ী। আপনার নামের সাংখ্যমান আপনাকে অনেক দূর নিয়ে
যাবে।’
“হয়তো ব্যাপারটা কাকতালীয়, তবুও ভেবে দেখলুম, আমার
জীবনের অনেক ঘটনাই জড়িয়ে আছে ৬ সংখ্যাটির সঙ্গে। আর
আমি জীবনে অনেকটাই উন্নতি করেছি, অথচ বলার মতো তেমন কোনও গালভরা ডিগ্রি আমার নেই।
সত্যিই কি নম্বরের জাদু আছে?
“আলাপ করলুম। ভদ্রলোকের
নাম অবনী চৌধুরী। পেশায় বেসরকারি চাকুরে অবনীবাবু নিউমেরোলজি
নিয়ে শখের চর্চা করেন। এই নিয়ে নাকি অনেক বইপত্রও পাওয়া যায়। ব্যাপারটা
আমার বেশ আকর্ষণীয় লাগল। আগে এসব নিয়ে শুনিনি বা জানিনি কখনও। ওর
সঙ্গে আমার বিজনেস কার্ড বিনিময় করলুম।
“ডাক্তারবাবুর চেম্বার থেকে আমার ডাক পড়েছিল।
উঠে যাচ্ছিলুম, ভদ্রলোক আমার দিকে একটু এগিয়ে এসে বিদঘুটে চোখে চেয়ে প্রায় ফিসফিস
করে বললেন, ‘মশাই, ৩ নম্বরটা থেকে সাবধান। ৬
যেমন আপনার জন্য ভালো, তেমনি থ্রি আপনার জন্য ভয়ংকর রকমের বিপজ্জনক।
পারলে এই সংখ্যাটা এড়িয়ে চলবেন।’
“ডাক্তারবাবুর হাতে ডকুমেন্টগুলো জমা দিয়ে আপিসে ফিরলুম। আমাদের
একটা নতুন আপিস তৈরি হচ্ছে নিউটাউনের দিকে। ইলেকট্রিকের
কাজ কতটা এগিয়েছে সেটা দেখার জন্য যেতে হবে। সচরাচর
আপিসের কাজে বাইরে যেতে হলে আপিসের গাড়িই পাওয়া যায়। কিন্তু
সেদিন গাড়িগুলো নানান দিকে বেরিয়ে গেছিল। একটাও গাড়ি
বা ড্রাইভার ফাঁকা ছিল না। তাই
ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম বেলা বারোটা নাগাদ। লম্বা
রাস্তা। প্রায় ঘন্টা খানেকের জার্নি। আসনে
গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে একটু ঘুমাবার চেষ্টা করছিলুম। কিন্তু
মাথার মধ্যে সেই অদ্ভুতুড়ে সংখ্যাগুলো আবার ঘুরতে লাগল। অবনী
চৌধুরী বলছিলেন, আমার জন্য ৩ নাকি খুব খারাপ সংখ্যা। ভেবে
দেখলুম, ৩
এপ্রিল ২০০৩ অ্যালকাসফট থেকে
চাকরি চলে যায়। কোম্পানি লোকসানে চলছিল বলে যেসব কর্মীদের
ছাঁটাই করে আমিও তাদের মধ্যে ছিলুম। ৩
বছর কাজ করেছিলুম ওই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। ১২
মে ২০১২ মরতে মরতে বেঁচে গেছিলুম একটা বাইক দুর্ঘটনায়। পা
ভেঙে ৩ মাস বিছানায় শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল।”
এই সময় জেঠিমা আমাদের জন্য চা নিয়ে এলেন বলে অমরবাবুকে
থামতে হল। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে উনি বলতে থাকলেন,
“এইসব ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেল ডাক্তার স্বরূপ ঘোষের গাড়ির নম্বরটা। WB02AH3333! চমত্কার নম্বর। মনে রাখার
জন্য ভীষণ সোজা। এই বিশেষ নম্বরটা পাবার জন্য ডাক্তারবাবু
প্রায় দশ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ করেছেন। একে বলে
প্রাইম নম্বর। মনে মনে যোগ করে চমকে উঠলুম! আরে
এটাও তো তিন নম্বর! তার মানে নিউমেরোলজির হিসেব মতো এটা আমার জন্য খুব একটা ভালো
হবে না! কিন্তু সত্যিই কি তাই হয়? এত সস্তায়
গাড়িটা পেলুম, সেটা ছেড়ে দেব?
“আমাদের ঠিক পিছন পিছন অনেকক্ষণ ধরে একটা ট্রাক আসছিল।
মাঝে মাঝেই সেটা ওভারটেক করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু
পাশাপাশি আরও অনেক গাড়ি থাকায় সেটা পারছিল না। বারবার
হর্নের আওয়াজে বিরক্ত হয়ে চোখ মেলতেই সামনের আসনের পেছনে লেখা ট্যাক্সির নম্বরটায়
চোখ পড়ল। WBJ011533! মনে মনে হিসেব করে চমকে উঠলুম! সাংখ্যমান
৫+২+১+০+১+১+৫+৩+৩ = ২+১ = ৩! একের পর এক চমক! মানে আমার জন্য আবারও একটা বিপজ্জনক
সংখ্যা! বিস্ময়,
হতবুদ্ধিতা আর আতঙ্ক মিলিয়ে মিশিয়ে আমি ভয়ে প্রায় আর্তনাদ করে উঠলুম। কিন্তু
বললে বিশ্বাস হবে না তোমাদের, ঠিক সেই মুহূর্তেই ট্যাক্সি ড্রাইভার কেন জানি আচমকা
গাড়িতে ব্রেক কষে দিল। তীব্র একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ট্যাক্সির
বাঁদিকের দরজাটা খুলে গেল আর আমি ছিটকে পড়লুম রাস্তায়। কিন্তু
ট্যাক্সিটার ঠিক পেছনে ফুল স্পীডে আসা ট্রাকটা ব্রেক কষতে পারল না। প্রচন্ড
বেগে ট্রাকটা চোখের পলকে আমাদের ট্যাক্সিটার ওপর উঠে গেল। বীভত্স
একটা শব্দ করে ট্যাক্সিটাকে তালগোল পাকিয়ে দিয়ে খানিকটা ঘষটে ঘষটে এগিয়ে ট্রাকটা
থেমে গেল। দুর্ঘটনার পর কিছুক্ষণের জন্য কথা
বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলুম। তবে
সামান্য ছড়ে যাওয়া ছাড়া আর তেমন কিছু ক্ষতি হয়নি আমার। আশেপাশে
দ্রুত একটা ভিড় জমে গেল। ট্রাক
ড্রাইভার ততক্ষণে ট্রাক ফেলেই চম্পট দিয়েছে। হতভম্ব
ভাবটা কাটিয়ে ওঠার পর নজরে এল, ট্রাকটার
নম্বর GJ03ER0011 - গুজরাটের
ট্রাক। এই নম্বরগুলো সারাজীবনেও ভুলতে পারব
না! গুণে দেখেছি সাংখ্যমান ৬। যা কিনা
আমার জন্য লাকি! সেইজন্যই কি দুর্ঘটনার
মুহুর্তে দরজা খুলে আমি ছিটকে পড়ি? ওই নম্বরই কি আমাকে বাঁচিয়ে দিল? জানি
না, কোনও
উত্তর নেই আমার কাছে।
“খুব স্বাভাবিকভাবেই ট্যাক্সি ড্রাইভার প্রাণে
বাঁচেনি। পুলিশ এসে যখন ওর পকেটে থাকা
ড্রাইভিং লাইসেন্সটা চেক করছিল, দেখলুম ওর জন্ম-তারিখ ১২ ডিসেম্বর,
১৯৭৫। ১২ মানে ৩, ডিসেম্বর
মানেও ১২ অর্থাৎ ৩, আবার সমস্ত সংখ্যাগুলো যোগ করলেও ৩ হচ্ছে। অবনী
চৌধুরীর কথামতো নিউমেরোলজির হিসেবে ৩-এর জন্য ৬ হল অশুভ সংখ্যা।
“এই ঘটনাটার পর আমি প্রচন্ড আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলুম।
অনেকদিন বাড়ি থেকে বাইরে বেরুতেই পারিনি। ওই
ট্যাক্সি আর ট্রাকটার নম্বর দুটো কোনদিনও ভুলতে পারব না। বাস-ট্যাক্সি
চাপলেও আমি নম্বরটা মিলিয়ে দেখে তারপরই চড়ি। জীবন তো
একটাই, ভাই!
“সে রাতেই অবনী চৌধুরীকে ফোন করে সমস্ত ঘটনা জানিয়ে বলেছিলুম
যে ডাক্তার স্বরূপ ঘোষের গাড়িটা আমি মোটেও কিনছি না। সে
উনি অ্যাডভান্সের
টাকাটা ফেরত দেন, চাই না দেন। সমস্ত
ঘটনাটা মন দিয়ে শুনে ভদ্রলোক দুঃখ প্রকাশ করে সহানুভূতি জানালেন। তারপর
ব্যাপারটা নিয়ে আরও বইপত্র কিনে পড়াশোনা করে দেখেছি।”
“তা অ্যাডভান্সের
টাকাটা ফেরত পেয়েছিলেন কি?” টোটোদা
জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ, দিন কতক পর ডাক্তারবাবু ওঁর ড্রাইভারকে দিয়ে আমার আপিসে
টাকাটা ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। উনি ভারি ভদ্রলোক।”
“হুম।” টোটোদা কী
যেন ভাবতে ভাবতে বলল, “গাড়ির নম্বরটা কী যেন বললেন?
ডব্লিউ বি জিরো টু...” বলতে বলতে টোটোদা নিজের মোবাইল খুলে মেসেজ বক্সে কী যেন
খুটখাট করতে লাগল।
“এ এইচ থ্রি থ্রি থ্রি থ্রি — ভীষণ ক্যাচি নম্বর।”
অমরবাবু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “কী করবে?”
টোটোদা ওঁর দিকে চেয়ে বলল, “আর.টি.ও.-র একটা এসএমএস
ব্যবস্থা আছে। বাহন — ভি
এ এইচ এ এন, তারপর একটা স্পেস দিয়ে গাড়ির নম্বর লিখে ৭৭৩৮২৯৯৮৯৯ নম্বরে এসএমএস
করলেই গাড়ির মালিকানাসংক্রান্ত সমস্ত বিবরণ ফিরতি এসএমএসে আপনার কাছে এসে পৌঁছবে।”
“তার মানে?” অমরবাবু
কিছু বলার আগে বুল্টিই সবার হয়ে জিজ্ঞেস করে ওঠে।
টোটোদা বাঁ কানের ওপরের চুলে আঙুল ঘষতে ঘষতে মুখে রহস্যময়
একটা হাসি নিয়ে বলল, “ডাক্তারবাবুর গাড়িটা এখন কার কাছে আছে সেটা জানতে হবে না?”
টুং করে আওয়াজ করে একটা এসএমএস ঢুকল টোটোদার নম্বরে।
আমি আর বুল্টি হুমড়ি খেয়ে পড়লাম মোবাইলটার ওপর।
টোটোদা এক ঝলক দেখেই মুচকি হেসে উঠল। অমরবাবু
আশ্চর্য ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হল?”
“যেটা আন্দাজ করেছিলাম সেটাই হয়েছে।”
টোটোদা ভ্রূদুটো তুলে ঠোঁটের ডগায় হাসিটা ঝুলিয়ে রেখে বলল, “গাড়িটা এখন অবনী
চৌধুরীর নামেই রেজিস্টার্ড। আপনাকে নিউমেরোলজির
গপ্পো শুনিয়ে ভয় পাইয়ে দিয়ে গাড়িটা কেনা থেকে পিছু হটিয়ে দেয়।
এলেম আছে বলতে হবে ভদ্রলোকের।”
“তার মানে!” অমরবাবু যেন আকাশ থেকে পড়েন।
“আপনার সঙ্গে যেটা হয়েছে সেটা কাকতালীয় বলেই আমার ধারণা।” টোটোদা
বলল, “আর গাড়ি দুর্ঘটনাটার জন্য আপনি নিজেই দায়ী ছিলেন।
সেদিন যদি আপনি ভয় পেয়ে চিত্কার না করে উঠতেন, ট্যাক্সি ড্রাইভারও অন্যমনস্ক হয়ে
ব্রেক কষত না, আর দুর্ঘটনাটাও আদৌ ঘটত না। এর জন্য
নম্বরকে মোটেই দায়ী করা যায় না। সবচেয়ে
ভালো হয় যদি আপনি একবার আপনার বন্ধু রাজার মাধ্যমে খবর নেন।
আমার বিশ্বাস অবনীবাবুও গাড়িটা কেনার জন্য ঘুরঘুর করছিলেন। খবরটা
পেতে ওঁর একটু দেরি হয়ে যায়। ততদিনে
আপনি গাড়িটা কেনার জন্য অ্যাডভান্স
করে বসে আছেন। তাই আপনাকে রাস্তা থেকে সরাতেই উনি এই চালাকিটা
করেন। উনি জানতেন, একবার যদি এই নম্বরের
ভূত আপনার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তাহলে ওই গাড়ি আর আপনি কিনবেন না।
তাই কায়দা করে আপনাকে বুঝিয়ে দেন যে তিন নম্বর আপনার জন্য ভীষণ ক্ষতিকর।”
“বলছ কী!”
“হুম। এটাই হল
সত্যি।”
অমরবাবু খানিকটা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বললেন, “তার মানে তুমি বলতে
চাও, সমস্ত ব্যাপারটাই অবনী চৌধুরীর কারসাজি ছিল!”
“অবশ্যই! দুর্ঘটনাটুকু বাদ দিয়ে। একটু
তলিয়ে দেখলে এমন অনেক ভালো ঘটনাই পাবেন যেগুলো আপনার লাকি নম্বরওয়ালা দিনে হয়নি।”
টোটোদা অমরবাবুর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলতে থাকল, “আবার এমন অনেক দুঃখজনক
ঘটনাও খুঁজে পাবেন যেগুলো আপনার শুভদিনগুলোতে ঘটেছে।”
“হুম,” অমরবাবু মুষড়ে পড়া গলায় বললেন, “তাহলে দেখা যাচ্ছে এই
ঘটনাগুলোর সঙ্গে নম্বরের কোনও ভূমিকাই নেই।”
“মানুষের এসব অতিপ্রাকৃত ব্যাপারের প্রতি আগ্রহটাকে কাজে
লাগিয়ে কত লোক যে করে খাচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই! এজন্যই তো জ্যোতিষী, বাবাজীরা এই
একবিংশ শতাব্দীতেও রমরমিয়ে ব্যাবসা চালিয়ে যাচ্ছে।”
টোটোদা আমার অঙ্কের খাতাটা টেনে নিয়ে উদাস সুরে বলল, “যাক তাহলে বাবলুর রোল নম্বর পাল্টাবার
জন্য আর আপনাকে স্কুলে যেতে হচ্ছে না তো?”
একটু লজ্জা লজ্জা গলায় মাথা চুলকে অমরবাবু বললেন, “সে আর
বলতে!”
(গল্পে ব্যবহৃত সমস্ত সংখ্যাই কাল্পনিক। এর
সঙ্গে বাস্তব কোনও ঘটনার বিন্দুমাত্র মিল নেই।)
_____
অলঙ্করণঃ পুষ্পেন মণ্ডল
বাঃ!😊😊😊
ReplyDeleteধন্যবাদ|
ReplyDeleteBesh valo laglo golpota.
ReplyDelete